কোবানীর বীর কন্যা তোমাদের লাল সালাম! - আশফাক স্বপন

কোবানীর বীর কন্যা তোমাদের লাল সালাম!




(মা,খালা, খালাত বোন, আদরের দুই বোন, বান্ধবী, বন্ধুপত্নী – এত অজস্র নারীর ভালোবাসায় আমি ধন্য, যে নারী নির্যাতন আমাকে বিশেষভাবে পীড়িত করে।  ভাবতে অবাক লাগে, মানবসমাজের এত উন্নতির পরও পুরুষতান্ত্রিকতার সিন্দাবাদের ভূত আজো দূর হলো না।  দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনা, লাঞ্ছনার অজস্র গল্প আছে সেকথা সত্যি, তবে আজ শুনব এক নারীগোষ্ঠীর বীরগাঁথা – তবে সেটা বহুদিন আগেকার গল্প নয়, আমাদের সাম্প্রতিক কালের ঘটনা।  মার্কিন দেশের National Public Radio-এর একটা  প্রতিবেদনের বাংলা অনুবাদ নিবেদন করছি।  মূল ইংরেজির অনুলিখন ও অডিও লিঙ্ক একেবারে নীচে।
আন্তর্জাতিক নারীদিবসে বিশ্বের সব নারীর স্বাধীকার আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করি, তাঁদের প্রতি রইল গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।)
সিরিয়ার খবর মানেই যুদ্ধ, হানাহানি, হিংস্রতার মর্মান্তিক সব সংবাদ।  অথচ একটি নতুন বইয়ের মূল কাহিনি সিরিয়া আর যুদ্ধ নিয়ে হলেও নারীর শৌর্য আর বীরত্বের এমন একটা গল্প যা আমাদের মনকে চাঙ্গা করে, মনে আশা জাগায়।
নতুন বইটির নাম The Daughters of Kobani:`A Story of Rebellion, Courage and Justice (কোবানিকন্যা: বিদ্রোহ, সাহস আর ইনসাফ-এর গল্প)।  বইটি ISIS-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্পূর্ণ নারীগঠিত এক মিলিশিয়া নিয়ে।  এক দল নারী কি করে ঠিক করল যে তারা এমন এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়বে যারা নারীধর্ষণ করে, নারীদের ওপর দাসত্ব আরোপ করে – এটা সেই কাহিনি।
লেখিকা গেইল জেমাখ লেমন (Gayle Tzemach Lemmon)  Council on Foreign Relations-এর  adjunct senior fellow এবং Ashley’s War (এ্যাশলির যুদ্ধ) বইয়ের এর লেখিকা।  নারীর সমানাধিকারের লড়াইয়ের গল্প নিয়ে তার সাম্প্রতিকতম বইটি নিয়ে তিনি -NPR-এর সাথে কথা বলেন।
প্রশ্ন: কী করে এই কাহিনির প্রতি আকৃষ্ট হলেন?
লেখিকা: ফোন বেজে ওঠার পর দেখি সেনাবাহিনীর এক সদস্যা আমাকে ফোন করেছে।  আমার এর আগের বইটি সম্পূর্ণ নারীসদস্যে গঠিত একটি বিশেষ তৎপরতার দল বা special-operations team ।নিয়ে।  এই সদস্যার কথা সেই বইয়ে আছে।  সে আমায় বলল – ‘গেইল, তোমাকে সিরিয়াতে আসতেই হবে।  এসে দেখ কী সব কাণ্ড হচ্ছে এখানে।  এখানে মেয়েরা ISIS-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে।  এরা যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষের নেতৃত্ব দিচ্ছে।  মার্কিন সেনারা এদের প্রচণ্ড সমীহ করে।  যেসব পুরুষ মেয়ে কেনা-বেচা করেছে তাদের ঠেকাবার লড়াইয়ে তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে।  আর তারা যে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে অবদান রাখছে তাই নয় – তারা মেয়েদের সমান অধিকারের জন্যও লড়ছে।
বইটির শিরোনামের অর্থ কি?
সিরিয়ার উত্তরপূর্বে ছোট্ট এক শহর কোবানি।  সিরিয়ার বাইরে কেউ এর নাম কখনো শুনেছে কিনা সন্দেহ।  ইসলামিক রাষ্ট্রের পুরুষেরা যখন ভাবল তারা অতি সহজে এই  শহরকে পদানত করে যুদ্ধক্ষেত্রে আরেকটি বিজয় সূচিত করবে, তখন শহরটা আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল।  কারণ বছরটি ২০১৪ আর আইসিস এর আগে একটিবারের জন্যও পরাজিত হয়নি।  এইরকম একটা সময় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো যাতে মানুষের কল্পনায় এটা বাইবেলের ডেভিড আর গোলায়াথের লড়াইয়ের মতো মনে হলো।  একদিকে মহাপরাক্রান্ত দৈত্য গোলায়াথ, আরেক দিকে সামান্য, সাধারণ ডেভিড।   সিরিয়ার একটি কুর্দী বাহিনী, হয়ত এদিক ওদিক খানিকটা সাহায্য পেয়েছে, এর মধ্যে ইরাকি কুর্দী যোদ্ধারাও মদদ দিচ্ছে – এরা সবাই ঠিক করেছে ইসলামিক রাষ্ট্রকে ঠেকাতে আমরণ লড়াই করবে – আর এই যুদ্ধে কেন্দ্রীয় ভূমিকা হচ্ছে নারীদের।  এ যেন ডেভিড আর গোলায়াথের লড়াই।  শুধু ডেভিড এখানে নারী।
একটি অন্যতম প্রধান চরিত্রের – ইনি একজন তরুণী - আইসিস যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে তার পরিবারের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?
শ্রোতারা অনেকেই জানেন অনেক সময় তরুণীরা পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হয়।  তার বেলায় পরিবারের গুরুতর বাধা ছিল।  তার শখ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে, তার চাচা দিলেন সেটা নাকচ করে।  মেয়েটা একজনকে ভালোবেসেছিল, তাকে বিয়ে করতে  চেয়েছিল, কিন্তু সেটা করতে দেওয়া হলো না।  আস্তে আস্তে সে এমন একটা সামাজিক জগতে প্রবেশ করে যেখানে মেয়েরা নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করছে।  সেই যুদ্ধের সাথে ইসলামিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।  আমরা পাঠক হিসেবে দেখি আমাদের চোখের সামনে সে কি করে বদলে যায়।  সে ছিল একজন সহকারী, গাড়িতে করে যখন পাওয়া যেত তখন গোলাবারুদ সরবরাহ করত।  তাও খুব ঘন ঘন নয়।  সেখান থেকে পরে সে আইসিস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নারী পুরুষের নেতৃত্ব দিয়েছে।  আমার মনে হয় বহু নারীকে এই পথটুকু পেরোতে হয়েছে – যাত্রার শুরুতে মানুষ তাদের না করেছে, পরে নিজ চেষ্টায় সেই না তারা কে হ্যাঁ-তে পরিণত করেছে।  আমার তো মনে হয় মেয়েটাও ঠিক তাই করেছে।
তারা আইসিস-এর বিরুদ্ধে লড়াই করবার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিল?
নারী কেনা-বেচা আইসিস-এর পুরুষেদের কর্মকাণ্ড ও চরিত্রের একটি মূল অংশ ছিল।  তো ধরুন এরা এসে আপনার পাড়ায় হাজির  আসলে আইসিস সৃষ্টির বহু আগেই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের অরাজকতার তাণ্ডবের মধ্যে এই সব নারী মাঠে নেমেছে তাদের নিজ নিজ শহর, গৃহকোণ, পাড়াকে রক্ষা করতে।  সেখান থেকেই ব্যাপারটা ইসলামিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রূপ নেয়।  অনেকের জন্য দুটো পথ মাত্র খোলা ছিল – হয় কারো সম্পত্তি হয়ে যাও, বা জবরদস্তি বিয়েতে রাজি হও, নয়তো পুরুষকে সরাসরি প্রতিহত করো।  এটা এমন একটা সময় যখন বহু নারী যেই সব নিয়ম তাদের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলো ঢেলে সাজাচ্ছে, এই সব নারী ঠিক এই কাজটিই করেছে। 
এই সব নারী কী তাদের গল্প বলতে আগ্রহী ছিল?
এদের কেউই কিন্তু মনে করেনা তারা এমন আহামরি কিছু করেছে।  ওরা আমার সাথে ঠাট্টা করে বলত, ‘আরে গেইল, তোমার কবে কাজ শেষ হবে? আর কতবার আমাদের সাথে এসে দেখা করবে? এই বইটা সত্যি সত্যি কবে বেরুবে বলতো?’  একবার একটা ঘটনায় বুঝলাম এই বিষয়টি নিয়ে একটা বই লিখতে হবে।  রোজদা বলে এক নেত্রীকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, তোমরা নারী রক্ষী দলের ইউনিট গড়লে কেন?’ ও আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা আইসিসকে কিছুতেই দাঁড়াতে দেবনা – জানোতো ওরা মেয়েদের কী দশা করেছে।  আর পুরুষমানুষ আমাদের কাজের জন্য বাহবা কুড়াবে, সেটাও আমরা চাইনি।‘ শুনে আমি ভেবেছিলাম – এইতো সারা বিশ্বের একটা চিরন্তন গল্প।।
আইসিস-কে পরাস্তকারী বীর নারী যোদ্ধা হবার ফলে তাদের মনে কি গভীর সন্তোষ ছিল?
একটা মুহূর্ত এসেছিল যখন প্রথমবারের মতো আইসিস পরাজয়ের সম্মুখীন।  মেয়েরা তখন কোবানিতে প্রাণপণ যুদ্ধ করছে।  যুদ্ধের রসদ বাড়ন্ত, লোকবল কম।  খাবারের অভাব।  যেটার অভাব নেই সেটা হলো তেজ আর মনোবল।  এক নারী নেত্রী যোদ্ধাদের বলছিলেন, ‘ওরা তোমাদের কী মনে করে সেটা মনে রেখো। ওদের দেখিয়ে দাও তোমাদের কী ক্ষমতা, বুঝিয়ে দাও মেয়েদের দাম আছে, মেয়েদের দাসী করা যায় না, এই অন্যায় চলবে না। ’ ওরা আমার কাছে যত কথা বলেছে, সব কিছুর ভেতর এই চিন্তাটা কাজ করেছে – এটা শুধু তাদের নিজেদের জন্য লড়াই না, সেই অঞ্চল এবন্ত তার বাইরে সব নারীর জন্য এই লড়াই।
ওরা এখন কী করছে?
যেটা সবচাইতে তাজ্জব ব্যাপার, এই যে সব মানুষগুলোর সাথে আমাদের পরিচয় হয় – কোবানির কন্যারা – তাদের নিজ নিজ পরিবারের ভেতরেও অগ্রযাত্রা ঘটে।  রোসজা বলে এক মেয়ের যখন ছোট্ট বয়স, তখন তার চাচা ভূত সেজে তাকে ভয় দেখিয়েছিল যাতে সে ভাইয়ের সাথে ফুটবল না খেলে, কারণ মেয়েরা ফুটবল খেললে পরিবারের বেইজ্জতি হয়।  আজ সেই চাচাই তাকে ফোন করে নানান বিষয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ চান, পারিবারিক ঝগড়া মীমাংসায় তার সাহায্য চান।  এই যে একটা ধারণা, যেই অর্জন চোখের সামনে দেখা যায়, সেই অর্জন প্রত্যেক মেয়ের নাগালের মধ্যে, মেয়েদের নেতৃত্ব দেবার ধারণাটাই সারা অঞ্চলের মর্মে প্রবেশ করেছে।  একথা মানতে হবে যে কাজ এখনো বাকি, ত্রুটি বিচ্যুতিও রয়েছে, তবে এইখানে যা দেখছি, এমনটি আমি আর কোত্থাও দেখিনি – পৃথিবীর বহু জায়গা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। 

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট