পুরুষতান্ত্রিকতার সিন্দবাদের ভূত। বর্ণ, যৌনপরিচয়/প্রবণতা সম্বন্ধে সুতীব্র ঘৃণা। বাঙালির মধ্যে বহুরকমের ভেদবুদ্ধি, সেটা মূল ভুখণ্ডে যেমন, তার বিরূপ প্রভাব সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা অভিবাসী সমাজে। সেই সমাজে অস্ট্রেলিয়া আর ক্যানাডায় বাংলাদেশি বাবা-মায়ের ঘরে বড় হয়েছেন ফারিহা রোশিন। নিজে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তারপর ঘুরে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম উপন্যাস। এই নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রতিবেদন।
জীবনে টিকে থাকার সংগ্রামটা ঠিক কেমন? লেখিকার আশা, যন্ত্রণা নিয়ে তার বইটি সেই বাস্তবতা তুলে ধরবে
প্রিয়া অরোরা
নিউ ইয়র্ক টাইমস; ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
অনুবাদ আশফাক স্বপন
In a Book About Trauma, She Hopes to Show What Survival Looks Like
By Priya Arora
The New York Times | Sept. 27, 2020
Like a Bird
By Fariha Roisin
The Unnamed Press. 288 pp. $26
ফারিহা রোশিন-এর বয়স যখন ১২, তখন যেই চিন্তাটা অবশেষে তার প্রথম উপন্যাসের রূপগ্রহণ করে, সেটা তার কাছে এক স্বপ্নে আবির্ভূত হয়। তখনও তার যা বলার ছিল তার জন্য সব শব্দ তার আয়ত্তে ছিল না, কিন্তু তাতে কি? তিনি কাজ শুরু করলেন।
আজ তার বয়স ৩০, আর আস্তে আস্তে তার লেখার ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হয়েছে। সেখানে কবিতা, ব্যক্তিগত প্রবন্ধ এবং আরো অন্যান্য রচনা রয়েছে। এই সব লেখা তার নিজের নিপীড়ন, শারীরিক আক্রমণ আর লজ্জার অভিজ্ঞতার গভীর অনুসন্ধান করেছে। Unnamed Press প্রকাশিত তার প্রথম বই Like a Bird (পাখির মতো)-এর বেলায়ও এই কথা সত্যি। এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এতো বছর ধরে এই বইটি লেখার প্রক্রিয়া তার মানসিক আরোগ্য পুনুরুদ্ধারে সহায়তা করেছে। কেউ নির্যাতনের শিকার হলে কী ঘটে সেই বিষয়ে গল্পের খুব অভাব। বইটি সেই নিরবতার বিরুদ্ধে একটি প্রত্যুত্তর।
‘আমার ধারণা আমার লেখালেখির একটা বিরাট অংশ মানসিক আরোগ্যলাভ নিয়ে, কারণ আমার নিজের মানসিক আরোগ্যলাভ প্রয়োজন, এবং সারাক্ষণ বর্তমান সময়েই সেই অভিজ্ঞতার সাথে বোঝাপড়া করছি,’ ফারিহা বলেন। ‘আমি বাঁচব, আমি জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে পারব, এই ধারণার প্রতি আমার আস্থা জন্মানো দরকার। আমার যে একটা ভবিষ্যত আছে, এই বিষয়ে আমার আস্থা থাকা দরকার। সেটা পাতায় লিখিতভাবে না দেখলে, সেটা আমার দিব্যচক্ষুতে না দেখতে পেলে আমি নিজেকে সেই নিশ্চয়তা দিতে পারি না।’
Like a Bird তাইলিয়া চ্যাটার্জীর গল্প। তাইলিয়া এক অল্পবয়স্কা তরুণী। নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যানহাটানের অবস্থাপন্ন উত্তর পশ্চিম দিকে বড় হয়েছেন। কিন্তু বাবা মা দুজনই মানসিকভাবে যেন অধরা, তাকে কঠোরভাবে দমন করে রাখে। তার মনে হয় তার চার পাশের সবার কাছে তিনি যেন অদৃশ্য। ব্যতিক্রম তার স্নেহময়ী বড় বোন আলিসা।
তাইলিয়ার ওপর যৌন নির্যাতন হবার পর তার পরিবার তাকে ত্যাগ করে। মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে, আর্থিকভাবে তার নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণ তার নিজের কাঁধে এসে পড়ে। তার নানীর আত্মার সস্নেহ পথপ্রদর্শনায়, তার নতুন বন্ধু ও প্রণয়ীদের সাহায্যে তিনি ধীরে ধীরে তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাথে বোঝাপড়া করে মানসিক আরোগ্যলাভের অর্থ কী সেটা বুঝতে সক্ষম হন। তার মতো যেসব মানুষ নির্যাতন-নিপীড়ন-হিংসার সাথে সংগ্রাম করে নিজেকে রক্ষা করেছেন, এই ফারিহা তাদের উৎসর্গ করেছেন।
‘আমার মনে হয়েছে আমি নিজ অভিজ্ঞতা, নিজ সত্তার বাইরে থেকে যেন কিছু আহরণ করতে পেরেছি, সেটা আত্মস্থ করতে পেরেছি,’ তিনি বলেন।
অস্ট্রেলিয়া আর কানাডায় বাংলাদেশি বাবা-মায়ের ঘরে ফারিহা বড় হন। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা সঙ্কলনসহ পূর্ববর্তী রচনায় তিনি যন্ত্রণার ঐতিহ্য ও মরমী ভাবনার মতো বিষয় অনুসন্ধান করেছেন। তার কবিতা সঙ্কলনের নাম How to Cure a Ghost (প্রেতাত্মা কী করে সারাতে হয়)। ‘আমার পূর্বপুরুষদের থেকে যে আমার কত কিছু শেখার আছে! আমার ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাস, আমার জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, আমাদের অঞ্চলের ইতিহাস – এই সবকিছু থেকে আমার অনেক, অনেক কিছু জানার, শেখার আছে,’ তিনি বলেন।
এই শেকড়সন্ধান ফারিহার ভারতপ্রেমের গভীরে প্রোথিত। তবে তিনি ভারতকে অভিহিত করেন বৃহত্তর ভারত হিসেবে, অর্থাৎ উপনিবেশ হবার আগের ভারত। তানাইস (Tanais) একজন লেখিকা। পাঁচ বছর আগে তিনি ফারিহার লেখার সাথে পরিচিত হন। তাকে যে বিষয়টা চমকে দেয় তা হলো ফারিহার বাংলাদেশের সাথে আত্মীয়তা এবং তার যৌন পরিচয় নিয়ে লেখালেখির ফলে তার সাহিত্যকৃতি যেন একই সাথে দক্ষিণ এশীয় কথাসাহিত্যের অংশ, আবার একই সাথে সে সম্বন্ধে প্রচলিত ধ্যানধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জ। কারণ দক্ষিণ এশীয় কথাসাহিত্য সচরাচর ভারতকেন্দ্রিক, সেখানে উঁচুবর্ণের হিন্দুদের কাহিনির প্রায় একচ্ছত্র দাপট।
‘এই ব্যাপারটা খুব ভেবে দেখার মতো যে এত বিস্তৃত একটা অভিবাসী সমাজের অংশ আমি, অথচ বাঙলা সমকামী নারীত্ব নিয়ে খুব সুনির্দিষ্টভাবে কেউ লিখছেন, তেমনটা একেবারেই মনে হচ্ছে না,’ তানাইস বলেন।
এই দুই লেখক এখন বন্ধু হয়ে গেছেন। Like a Bird-এর প্রাথমিক খসড়া পড়বার পর তানাইস ফারিহাকে পাণ্ডুলিপির কিছু কিছু অংশ - যা তিনি আরেকটু কম বয়সে লিখেছিলেন - সেসব ঘষামাজার পরামর্শ দেন। কারণ সেই অংশগুলোতে যেন অন্য একটা কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল। এই পরামর্শ তার খুব কাজে এসেছিল। এর ফলে তিনি নিজে তফাতটা আরো ভালো করে শনাক্ত করতে পারলেন, এবং সেটা শুদ্ধির আত্মবিশ্বাস লাভ করলেন। ‘এর ফলে ও যেন এক ধরনের মুক্তি লাভ করে, তার মনোবল বেড়ে যায়।’
ফারিহার আরেক বন্ধু, জেবা ব্লে, ফারিহার খসড়া দেখার পর তার অধ্যবসায় দেখে চমৎকৃত হন। ‘সে যেন দূর পাহাড়ে চলে যায়, তারপর এক অপূর্ব সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসে।’
ফারিহা বলেন বইটি লেখা শুরু করার সময় তিনি অনেক কিছু জানতেন না। Audre Lorde, Susan Sontag, June Jordan-এর মতো লেখিকারা, যারা তাদের লেখায় মানসিক আরোগ্যলাভ নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করেছেন, ফারিহা এদের বই গোগ্রাসে পড়েছেন। কিন্তু প্রথম দিককার খসড়াগুলোর ভাষা যে শুধু আরো সরল ছিল তাই নয়, কিছু কিছু বিষয় – যেমন তার যৌন প্রবণতা – সেটা নিয়ে আদৌ লেখা যায় কিনা সেটাই তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
‘পুরনো পাতা দেখলে মনে হয়, কী অবাক কাণ্ড, আমার গল্পবলা সম্বন্ধে ধারণাটাও কত কোণঠাসা,’ তিনি বলেন। যেমন প্রথম দিকে গল্পে একটা প্রেমিক পুরুষের উপস্থিতি ছিল। ফারিহা পরে তাইলিয়ার গল্পের মোড় অন্যদিকে নিয়ে যান যেখানে প্রেম নয়, তার সমাজের সাথে আত্মীয়তার মধ্য দিয়ে সে জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়। এই অবস্থাটাই ফারিহার বেশি সত্য মনে হয়েছে কারণ যৌন পরিচয় ও প্রবণতায় ব্যতিক্রমী যে সমাজ ফারিহার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এটাই বাস্তব অবস্থা।
‘আমার মনে হয়েছে যেন আমার পরিচয়ের একটা অংশ মুছে যেতে বসেছে কারণ আমার আর গত্যন্তর ছিল না,’ ফারিহা বলেন। ‘মানে আমি কি করে এতটা দুঃসাহস দেখাব যার ফলে এমন যৌন পরিচয়/প্রবণতা নিয়ে লিখব অথবা এমন একটা চরিত্র সৃষ্টি করবে যেটা ততটা গ্রহণযোগ্য নয়?’ ওই অংশগুলো আবার ঘষামাজা করে, বিদেশিবিদ্বেষ, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ আর বর্ণবাদের মত অশুভ শক্তিগুলো স্বনামে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে বইটি তার চুড়ান্ত আকার নেয়।
‘আমার তো মনে হয় এই বইটার সবচাইতে বড় গুণ হলো বইটি আমাদের সমাজের বহু বিষয় নিয়ে নিরবতা ভঙ্গ করেছে,’ তানাইস বলেন। ‘আমার মতো মানুষ, যারা নিপীড়ন থেকে বেরিয়ে নিজেদের যন্ত্রণামুক্ত করে মানসিক আরোগ্যলাভ করেছে, যারা নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজেদের রক্ষা করেছে, তাদের জন্য, আর আপামর অল্পবয়সী মানুষের জন্য এই যে আরেকটি অল্পবয়স্ক মানুষ তার বেদনা, তার যন্ত্রণার ব্যাপারে মুখ খুললো, এবং সেই কষ্টকে অতিক্রম করলো, সেটার ঘোষণা একটা বড় প্রাপ্তি।’
ফারিহা যন্ত্রণার অভিজ্ঞতাকে অনেক সময় প্রেতাত্মা আর ভূতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন। এই উপন্যাসে তাইলিয়ার নানী একজন প্রেতাত্মা হয়ে আবির্ভূত হন। তার সবচাইতে বিপদের সময় নানীর আত্মা তাকে পথ দেখান। এর কারণ বাংলাদেশি সংস্কৃতি এবং ইসলামী ঐতিহ্যে জ্বিনের উপস্থিতি। ছোটবেলা থেকে ফারিহা বুহু জ্বিনের কথা শুনেছেন।
‘অশরীরী আত্মার জগতে আমার চেতনা গভীরভাবে নিমগ্ন,’ ফারিহা বলেন। ‘আমরা সবাই তো তাই। আমাদের সবার এই নিয়ে ধারণা, বিশ্বাস বা ভাষা রয়েছে। শুধু প্রশ্নটা হলো আপনি কতখানি এসবে বিশ্বাস করতে চান আর আপনি কি এদের সাথে সহাবস্থান করার ব্যাপারে ইচ্ছুক কিনা।’
এতবছর ধরে এই বইটি লেখার পর ফারিহা বলেন তার এখন নিজের স্বার্থে সমাজ বদলের দরকার। ‘মানসিক আরোগ্যলাভের ব্যাপারে যুক্তি আর জ্ঞানের বিরোধিতা করবার একধরণের প্রবণতা রয়েছে। আমি এই অবস্থাটা বদলাতে চাই,’ ফারিহা বলেন। ‘আমি চাই লোকে এই বই পড়ে যৌন নিপীড়ন সম্বন্ধে আরেকটু সার্বিক ভাবে, আরো গভীর বিশ্লেষণের সাথে বুঝতে শিখুন, আর সেই নিপীড়ন থেকে মানুষের পরিত্রাণ, তার মানসিক আরোগ্যলাভের ব্যাপারে আস্থাবান হোন, সেটা কীরকম হবে সেই সম্ভাবনাটা নিয়ে একটু ভাবুন।’
[প্রিয়া অরোরা নিউ ইয়র্ক শহরবাসী সম্পাদিকা। ২০১৮ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে যোগদান করার আগে HuffPost এবং অন্য পত্রিকায় কাজ করেছেন। তার লস এঞ্জেলেস-এ বড় হয়েছেন।‘