পরের বার জ্বল্বে আগুন!
যুক্তরাষ্ট্রে শতাধিক বছরের বর্ণবাদের বিষময় ফল
আশফাক স্বপন
দ্য ডেইলি স্টার। ৫ জুন ২০২০
‘ঈশ্বর নূহ নবীকে রংধনুর সংকেত দিয়েছেন। পরের বার পানি নয়, জ্বলবে আগুন!’
গৃহযুদ্ধপূর্ব আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ ভক্তিমূলক গান
ভয়ার্ত বিশ্ব অবাক হয়ে দেখছে, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে যেন আগুন লেগেছে। পুলিশের জঘন্য একটি বর্ণবাদী হত্যাকাণ্ড ছিল স্ফুলিঙ্গ – সেখানে থেকে দাবানলের মতো প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছ যুক্তরাষ্ট্রের ১৪০টি শহরে বিশাল মিছিল রাস্তায় নেমেছে। দাঙ্গা, লুটপাট, শহরে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের অত্যাচার, বড় বড় শহরগুলোতে রাতে সান্ধ্য আইন – সব একসাথে ঘটছে। কেন্দ্রীয় সরকার সে্নাবাহিনী নামিয়ে উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা, আমরা কোন দেশে আছে? মাঝে মাঝে মনে হয় এমন এক নামহীন গোত্রহীন দেশে বসবাস করছি যেখানে স্বৈরাচারী শাসকের গদি কেঁপে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার এর মধ্যে কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল ছত্রভঙ্গ করিয়েছেন, যাতে তিনি গীর্জায় গিয়ে হাতে বাইবেল নিয়ে লোকদেখানো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন। সঙ্গত কারণে গীর্জার লোকজন এই অসভ্যতার তীব্র নিন্দা করেছেন।
জেমস বল্ডউইন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের একজন তীক্ষধী, নির্মম বিশ্লেষক। তিনি ১৯৬৭ সালে রচিত বই ‘এর পরের বার জ্বলবে আগুন’-এ (The Fire Next Time) বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সময় এসেছে দেশটির মূল মহাপাপ – এইদেশে আসার পর থেকে আফ্রিকান আমেরিকানদের নির্যাতন – তার ফলে যে বিষময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সুরাহার উদ্যোগ নেওয়া।
তিনি লেখেন, ‘এখানে, ওখানে, যে কোনখানেই হোক,’ বর্ণবাদ ‘যুক্তরাষ্ট্রের সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টা হয় কলুষিত করে, নয়তো খর্ব করে। মানুষের ক্ষেত্রে, বা ব্যক্তিগতভাবে গাত্রবর্ণের কোন অস্তিত্ব নেই – এর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। কিন্তু এই তফাতটা পাশ্চাত্যের উপলব্ধি করা এমনই কঠিন যে আজো পাশ্চাত্য সেই তফাতটা চিনতে পারে না।’
বল্ডউইন কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
‘আমরা যদি জান বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে না পড়ি, তাহলে বাইবেলের কাহিনির বরাত দিয়ে ক্রীতদাসের গানে যে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হয়েছে, সেটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হবে: ঈশ্বর নূহ নবীকে রংধনুর সংকেত দিয়েছেন। পরের বার পানি নয়, জ্বলবে আগুন!’
আমেরিকায় শাদা-কালো মানুষের সম্পর্ক জটিল – তার ভালো মন্দ দুই দিকই আছে। কিছু কিছু বিষয়ে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, আবার কিছু ব্যাপারে আফ্রিকান আমেরিকানদের অবস্থা ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ।
জিম ক্রো নামক ভয়াবহ বর্ণবাদী আইন বহু বছর হলো গত হয়েছে। কালো-শাদা মেলামেশায় আজ বিন্দুমাত্র নিষেধ নেই। এক সময় দক্ষিণে কালোদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল, তারও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে প্রথম কালো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে।
তারপরও আফ্রিকান আমেরিকানরা ভীষণ পিছিয়ে রয়েছে। বাড়ি মালিকানা হোক, ব্যাপক হারে কারাবাস হোক, স্বাস্থ্যের অবস্থা হোক – নানান ক্ষেত্রে আফ্রিকান আমেরিকানদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুব খারাপ।
এর ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। ১৯৪০ দশকে আমেরিকার ঐতিহাসিক সোশাল সিকিউরিটি আইন পাশ হয়। এই আইন খেটে খাওয়া মানুষের অবসর জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আইনটি পাশ করার সময় দক্ষিণের বর্ণবাদী ডেমোক্র্যাট দলের নেতারা গৃহকর্মী আর কৃষিকর্মীদের এই আইনের আওতার বাইরে রাখেন। এদের বেশির ভাগ কালো মানুষ। আবার গৃহঋণ দেওয়ার ব্যাপারে ঐতিহাসিকভাবে কালোদের সাথে সাংঘাতিক বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। ফলে এদেশে সম্পদ সৃষ্টির সবচাইতে মৌলিক পথ – বাড়ির মালিকানা – কালোদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়।
মিনিয়াপোলিস শহরে ২৫ মার্চ জর্জ ফ্লয়েডকে পুলিশের হত্যা করার ঘটনা সাম্প্রতিক প্রতিবাদের ঝড় উস্কে দেয়। এর আগে সম্প্রতি আরো দুজন আফ্রিকান আমেরিকানকে সন্দেহজনক কারণে হত্যা করা হয়। মার্চ মাসে কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের লুইভিল শহরে পুলিশ মাদক উদ্ধার অভিযানে ব্রিওনা টেইলরের এপার্টমেন্টে প্রবেশ করে তাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। তার বাড়িতে কোন মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় নাই। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কিছুই হয় নি। তারপর জোর প্রতিবাদের ফলে কর্তৃপক্ষ হত্যাকাণ্ড অনুসন্ধান শুরু করে।
ফেব্রুয়ারি মাসে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চলে একজন শাদা প্রাক্তন পুলিশ আর তার ছেলে আহমাড আরবারিকে ধাওয়া করে। তারপর তার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তির পর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দুই মাস পর্যন্ত কেউ এব্যাপারে কিছু করেনি। জাতীয় পর্যায়ে সংবাদপত্র হৈচৈ করার পর কর্তৃপক্ষ বাপ-বেটাকে গ্রেফতার করে।
ন্যায়বিচারের জন্য বিশাল বিশাল প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছে, এ আর আশ্চর্য কি।
পরিস্থিতি খুব বেদনাদায়ক হলেও কোথাও কোথাও ক্ষীণ আশার আলো দেখা যাচ্ছে। মোটের ওপর প্রতিবাদ মিছিল শান্তিপূর্ণ। সব মিছিলে শাদা আমেরিকান – এরা বেশির ভাগ অল্পবয়স্ক – এর উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আশা জাগায়। নিউ ইয়র্ক শহরে পুলিশ প্রধান টেরেন্স মনাহান জনসমক্ষে এক হাঁটু গেড়ে বসেছেন। এটি আমেরিকায় কালোদের ওপর পুলিশি অত্যাচারের প্রতীকী প্রতিবাদ, যা সচরাচর কালো লোকে করে থাকে। একইভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন অরেগন অঙ্গরাজ্যের পোর্টল্যান্ডের পুলিশ প্রধান, ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্টা ক্রুজ ও নাপা শহরের পুলিশ প্রধান।
তবে প্রতিবাদের একটা অন্ধকার দিকও রয়েছে। মার্কিন দেশের ইতিহাসে ব্যাপক বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদ অনেক সময় জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতায় পর্যবসিত হয়।
এব্যাপারে একটি ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান: ১৯৯২ সালে দক্ষিণ-কেন্দ্রীয় লস এঞ্জেলেসে যেই দাঙ্গা হয়, সেখানে কোরিয়ান আমেরিকান ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার। পরিশ্রমী, কোনমতে-টিকে-থাকা অভিবাসীদের কয়েক দশকের হাড়ভাঙা খাটুনিতে তৈরি সাধের ছোট ব্যবসাগুলোর সর্বনাশ হয়।
আমার নিজের মত হচ্ছে যারা এসব লুটপাট আর অগ্নিসংযোগে অংশ নেই এরা সব বদয়ায়েশ আর গুণ্ডা – প্রতিবাদের কারণ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নাই।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সঙ্গত কারণে রাগে যখন মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয় তখন শান্তি বজায় রাখা কঠিন – কিন্তু সেটা করতে পারলে তাতে মস্ত সুবিধা। মার্টিন লুথার কিং-এর কথা ধরা যাক। কালোদের নাগরিক অধিকারের সংগ্রামে তিনি আরো হিংস্র, বর্ণবাদী প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করেছেন, অথচ সব সময় সম্পূর্ণ অহিংস ছিলেন। অনেকে এজন্য তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে, বলেছে তিনি দুর্বল। অবশেষে ওঁরই বিজয় হয়েছে, কারণ ওঁর অহিংসার ফলে বর্ণবাদী প্রতিপক্ষ কালোদের আন্দোলনকে গালমন্দ করার আরো একটি অজুহাত থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
আজও অবস্থার তারতম্য হয়নি। অগ্নিসংযোগ, লুটপাটে আজকের আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়ার এতটুকু সুরাহা হবে না, বরঞ্চ তার থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে যাবে, তাতে তাদের প্রতিপক্ষ আহ্লাদিত হবে। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে এই বিষয়ে একটা কঠিন শিক্ষামূলক উদাহরণ রয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ যখন সহিংস রূপ নেয়, তখন শাদা মধ্যবিত্ত মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে। তার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে রিপাবলিকান দলের দুই গভর্ণর রিচার্ড নিক্সন আর রোনাল্ড রেগান আইন শৃঙ্খলার দাবিকে মূলমন্ত্র করে দীর্ঘদিনের রক্ষণশীল রাজনীতির আধিপত্যের সূচনা করেন।
জানি, আমার কথায় কোন কোন জঙ্গি প্রতিবাদী মুখ বাঁকাবেন। তাচ্ছিল্যের সাথে প্রশ্ন করবেন: তুমি কে বাপু আমাদের জ্ঞান দিতে এসেছ?
হক কথা।
আমার কথায় কর্ণপাত করবেন না। এবার এমন একজনের কথা বলছি, যার এবিষয়ে মত দেবার নৈতিক অধিকার প্রশ্নাতীত। ইনি মিনিয়াপোলিসে নিহত আফ্রিকান আমেরিকান ব্যক্তিটির ভাই।
যে রাস্তার মোড়ে তার বড় ভাই মারা গিয়েছেন, সেখানে দাড়িয়ে টেরেন্স ফ্লয়েড সম্প্রতি সমর্থকদের বলেন: ‘আমিই যদি এখানে এসে জিনিসপত্র ভাঙচুর না করি, পাড়া লণ্ডভণ্ড না করি, তাহলে আপনারা সবাই কি করছেন? কিসসু না! কারণ এসব কাজ আমার ভাইকে আর ফিরিয়ে আনবে না।
‘তার চাইতে আসুন, একটু অন্যভাবে কাজ করি । এমন চিন্তা মন থেকে দূর করুন যে আমাদের প্রতিবাদে কিছু যায় আসে না। ভোট দিন। কারণ আমরা সংখ্যায় অনেক। আসুন, সহিংসতা বাদ দিয়ে আমাদের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাই।’
এবার শুনলেন তো? যত খুশি প্রতিবাদ করুন। কিন্তু সেই সাথে সংগঠিত হোন। ভোট দিন।
মনে রাখবেন, একদিনে সব পাল্টাবে না, সময় লাগবে। অনুপ্রেরণার জন্য মার্টিন লুথার কিং-এর এই কথাটা মনের রাখুন: ‘জগতে নৈতিকতার সঞ্চারপথ দীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু তার গন্তব্য সুবিচার।’ এটি প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রিয় বচন। ওবামার মতের গুরুত্ব যথেষ্ট – মার্কিন রাজনীতিতে কি করে জিততে হয়, এই ব্যাপারে তার কিঞ্চিত হাতযশ আছে কিনা।
Dailystar এর লিঙ্ক
যুক্তরাষ্ট্রে শতাধিক বছরের বর্ণবাদের বিষময় ফল
আশফাক স্বপন
দ্য ডেইলি স্টার। ৫ জুন ২০২০
‘ঈশ্বর নূহ নবীকে রংধনুর সংকেত দিয়েছেন। পরের বার পানি নয়, জ্বলবে আগুন!’
গৃহযুদ্ধপূর্ব আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ ভক্তিমূলক গান
ভয়ার্ত বিশ্ব অবাক হয়ে দেখছে, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে যেন আগুন লেগেছে। পুলিশের জঘন্য একটি বর্ণবাদী হত্যাকাণ্ড ছিল স্ফুলিঙ্গ – সেখানে থেকে দাবানলের মতো প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছ যুক্তরাষ্ট্রের ১৪০টি শহরে বিশাল মিছিল রাস্তায় নেমেছে। দাঙ্গা, লুটপাট, শহরে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের অত্যাচার, বড় বড় শহরগুলোতে রাতে সান্ধ্য আইন – সব একসাথে ঘটছে। কেন্দ্রীয় সরকার সে্নাবাহিনী নামিয়ে উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা, আমরা কোন দেশে আছে? মাঝে মাঝে মনে হয় এমন এক নামহীন গোত্রহীন দেশে বসবাস করছি যেখানে স্বৈরাচারী শাসকের গদি কেঁপে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার এর মধ্যে কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল ছত্রভঙ্গ করিয়েছেন, যাতে তিনি গীর্জায় গিয়ে হাতে বাইবেল নিয়ে লোকদেখানো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন। সঙ্গত কারণে গীর্জার লোকজন এই অসভ্যতার তীব্র নিন্দা করেছেন।
জেমস বল্ডউইন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের একজন তীক্ষধী, নির্মম বিশ্লেষক। তিনি ১৯৬৭ সালে রচিত বই ‘এর পরের বার জ্বলবে আগুন’-এ (The Fire Next Time) বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সময় এসেছে দেশটির মূল মহাপাপ – এইদেশে আসার পর থেকে আফ্রিকান আমেরিকানদের নির্যাতন – তার ফলে যে বিষময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সুরাহার উদ্যোগ নেওয়া।
তিনি লেখেন, ‘এখানে, ওখানে, যে কোনখানেই হোক,’ বর্ণবাদ ‘যুক্তরাষ্ট্রের সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টা হয় কলুষিত করে, নয়তো খর্ব করে। মানুষের ক্ষেত্রে, বা ব্যক্তিগতভাবে গাত্রবর্ণের কোন অস্তিত্ব নেই – এর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। কিন্তু এই তফাতটা পাশ্চাত্যের উপলব্ধি করা এমনই কঠিন যে আজো পাশ্চাত্য সেই তফাতটা চিনতে পারে না।’
বল্ডউইন কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
‘আমরা যদি জান বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে না পড়ি, তাহলে বাইবেলের কাহিনির বরাত দিয়ে ক্রীতদাসের গানে যে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হয়েছে, সেটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হবে: ঈশ্বর নূহ নবীকে রংধনুর সংকেত দিয়েছেন। পরের বার পানি নয়, জ্বলবে আগুন!’
আমেরিকায় শাদা-কালো মানুষের সম্পর্ক জটিল – তার ভালো মন্দ দুই দিকই আছে। কিছু কিছু বিষয়ে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, আবার কিছু ব্যাপারে আফ্রিকান আমেরিকানদের অবস্থা ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ।
জিম ক্রো নামক ভয়াবহ বর্ণবাদী আইন বহু বছর হলো গত হয়েছে। কালো-শাদা মেলামেশায় আজ বিন্দুমাত্র নিষেধ নেই। এক সময় দক্ষিণে কালোদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল, তারও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে প্রথম কালো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে।
তারপরও আফ্রিকান আমেরিকানরা ভীষণ পিছিয়ে রয়েছে। বাড়ি মালিকানা হোক, ব্যাপক হারে কারাবাস হোক, স্বাস্থ্যের অবস্থা হোক – নানান ক্ষেত্রে আফ্রিকান আমেরিকানদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুব খারাপ।
এর ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। ১৯৪০ দশকে আমেরিকার ঐতিহাসিক সোশাল সিকিউরিটি আইন পাশ হয়। এই আইন খেটে খাওয়া মানুষের অবসর জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আইনটি পাশ করার সময় দক্ষিণের বর্ণবাদী ডেমোক্র্যাট দলের নেতারা গৃহকর্মী আর কৃষিকর্মীদের এই আইনের আওতার বাইরে রাখেন। এদের বেশির ভাগ কালো মানুষ। আবার গৃহঋণ দেওয়ার ব্যাপারে ঐতিহাসিকভাবে কালোদের সাথে সাংঘাতিক বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। ফলে এদেশে সম্পদ সৃষ্টির সবচাইতে মৌলিক পথ – বাড়ির মালিকানা – কালোদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়।
মিনিয়াপোলিস শহরে ২৫ মার্চ জর্জ ফ্লয়েডকে পুলিশের হত্যা করার ঘটনা সাম্প্রতিক প্রতিবাদের ঝড় উস্কে দেয়। এর আগে সম্প্রতি আরো দুজন আফ্রিকান আমেরিকানকে সন্দেহজনক কারণে হত্যা করা হয়। মার্চ মাসে কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের লুইভিল শহরে পুলিশ মাদক উদ্ধার অভিযানে ব্রিওনা টেইলরের এপার্টমেন্টে প্রবেশ করে তাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। তার বাড়িতে কোন মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় নাই। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কিছুই হয় নি। তারপর জোর প্রতিবাদের ফলে কর্তৃপক্ষ হত্যাকাণ্ড অনুসন্ধান শুরু করে।
ফেব্রুয়ারি মাসে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চলে একজন শাদা প্রাক্তন পুলিশ আর তার ছেলে আহমাড আরবারিকে ধাওয়া করে। তারপর তার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তির পর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দুই মাস পর্যন্ত কেউ এব্যাপারে কিছু করেনি। জাতীয় পর্যায়ে সংবাদপত্র হৈচৈ করার পর কর্তৃপক্ষ বাপ-বেটাকে গ্রেফতার করে।
ন্যায়বিচারের জন্য বিশাল বিশাল প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছে, এ আর আশ্চর্য কি।
পরিস্থিতি খুব বেদনাদায়ক হলেও কোথাও কোথাও ক্ষীণ আশার আলো দেখা যাচ্ছে। মোটের ওপর প্রতিবাদ মিছিল শান্তিপূর্ণ। সব মিছিলে শাদা আমেরিকান – এরা বেশির ভাগ অল্পবয়স্ক – এর উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আশা জাগায়। নিউ ইয়র্ক শহরে পুলিশ প্রধান টেরেন্স মনাহান জনসমক্ষে এক হাঁটু গেড়ে বসেছেন। এটি আমেরিকায় কালোদের ওপর পুলিশি অত্যাচারের প্রতীকী প্রতিবাদ, যা সচরাচর কালো লোকে করে থাকে। একইভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন অরেগন অঙ্গরাজ্যের পোর্টল্যান্ডের পুলিশ প্রধান, ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্টা ক্রুজ ও নাপা শহরের পুলিশ প্রধান।
তবে প্রতিবাদের একটা অন্ধকার দিকও রয়েছে। মার্কিন দেশের ইতিহাসে ব্যাপক বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদ অনেক সময় জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতায় পর্যবসিত হয়।
এব্যাপারে একটি ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান: ১৯৯২ সালে দক্ষিণ-কেন্দ্রীয় লস এঞ্জেলেসে যেই দাঙ্গা হয়, সেখানে কোরিয়ান আমেরিকান ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার। পরিশ্রমী, কোনমতে-টিকে-থাকা অভিবাসীদের কয়েক দশকের হাড়ভাঙা খাটুনিতে তৈরি সাধের ছোট ব্যবসাগুলোর সর্বনাশ হয়।
আমার নিজের মত হচ্ছে যারা এসব লুটপাট আর অগ্নিসংযোগে অংশ নেই এরা সব বদয়ায়েশ আর গুণ্ডা – প্রতিবাদের কারণ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নাই।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সঙ্গত কারণে রাগে যখন মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয় তখন শান্তি বজায় রাখা কঠিন – কিন্তু সেটা করতে পারলে তাতে মস্ত সুবিধা। মার্টিন লুথার কিং-এর কথা ধরা যাক। কালোদের নাগরিক অধিকারের সংগ্রামে তিনি আরো হিংস্র, বর্ণবাদী প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করেছেন, অথচ সব সময় সম্পূর্ণ অহিংস ছিলেন। অনেকে এজন্য তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে, বলেছে তিনি দুর্বল। অবশেষে ওঁরই বিজয় হয়েছে, কারণ ওঁর অহিংসার ফলে বর্ণবাদী প্রতিপক্ষ কালোদের আন্দোলনকে গালমন্দ করার আরো একটি অজুহাত থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
আজও অবস্থার তারতম্য হয়নি। অগ্নিসংযোগ, লুটপাটে আজকের আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়ার এতটুকু সুরাহা হবে না, বরঞ্চ তার থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে যাবে, তাতে তাদের প্রতিপক্ষ আহ্লাদিত হবে। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে এই বিষয়ে একটা কঠিন শিক্ষামূলক উদাহরণ রয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ যখন সহিংস রূপ নেয়, তখন শাদা মধ্যবিত্ত মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে। তার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে রিপাবলিকান দলের দুই গভর্ণর রিচার্ড নিক্সন আর রোনাল্ড রেগান আইন শৃঙ্খলার দাবিকে মূলমন্ত্র করে দীর্ঘদিনের রক্ষণশীল রাজনীতির আধিপত্যের সূচনা করেন।
জানি, আমার কথায় কোন কোন জঙ্গি প্রতিবাদী মুখ বাঁকাবেন। তাচ্ছিল্যের সাথে প্রশ্ন করবেন: তুমি কে বাপু আমাদের জ্ঞান দিতে এসেছ?
হক কথা।
আমার কথায় কর্ণপাত করবেন না। এবার এমন একজনের কথা বলছি, যার এবিষয়ে মত দেবার নৈতিক অধিকার প্রশ্নাতীত। ইনি মিনিয়াপোলিসে নিহত আফ্রিকান আমেরিকান ব্যক্তিটির ভাই।
যে রাস্তার মোড়ে তার বড় ভাই মারা গিয়েছেন, সেখানে দাড়িয়ে টেরেন্স ফ্লয়েড সম্প্রতি সমর্থকদের বলেন: ‘আমিই যদি এখানে এসে জিনিসপত্র ভাঙচুর না করি, পাড়া লণ্ডভণ্ড না করি, তাহলে আপনারা সবাই কি করছেন? কিসসু না! কারণ এসব কাজ আমার ভাইকে আর ফিরিয়ে আনবে না।
‘তার চাইতে আসুন, একটু অন্যভাবে কাজ করি । এমন চিন্তা মন থেকে দূর করুন যে আমাদের প্রতিবাদে কিছু যায় আসে না। ভোট দিন। কারণ আমরা সংখ্যায় অনেক। আসুন, সহিংসতা বাদ দিয়ে আমাদের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাই।’
এবার শুনলেন তো? যত খুশি প্রতিবাদ করুন। কিন্তু সেই সাথে সংগঠিত হোন। ভোট দিন।
মনে রাখবেন, একদিনে সব পাল্টাবে না, সময় লাগবে। অনুপ্রেরণার জন্য মার্টিন লুথার কিং-এর এই কথাটা মনের রাখুন: ‘জগতে নৈতিকতার সঞ্চারপথ দীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু তার গন্তব্য সুবিচার।’ এটি প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রিয় বচন। ওবামার মতের গুরুত্ব যথেষ্ট – মার্কিন রাজনীতিতে কি করে জিততে হয়, এই ব্যাপারে তার কিঞ্চিত হাতযশ আছে কিনা।
Dailystar এর লিঙ্ক
No comments:
Post a Comment