আজ সারা আমেরিকায় আগুন জ্বলছে কেন?
আসিতেছে শুভদিন
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
- কাজী নজরুল ইসলাম
আমি আটলান্টায় থাকি। কাল CNN সদর দফতরের সামনে সহিংস প্রতিবাদে পুলিশেরর গাড়ি পুড়েছে, দোকান লুট হয়েছে। মেয়র হাত জোড় করে নগরবাসীকে বাড়ি ফিরতে বলেছে। আজ শহরে সান্ধ্য আইন চালু।
সারা আমেরিকা রাগে কাঁপছে। শহরে শহরে বিক্ষোভ, কত স্থানে আগুন জ্বলছে। একাধিক শহরে সান্ধ্য আইন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নগর প্রশাসন হিমসিম খাচ্ছে।
মিনিয়াপোলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক আফ্রিকান আমেরিকান ব্যক্তিকে হাতকড়া পরাবার পরও পুলিশ তাকে মাটিতে ফেলে গলায় হাঁটু চেপে জনসমক্ষে হত্যা করে। এতে সারাদেশে ক্রুদ্ধ প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছে তা যেন আর থামতে চায় না।
বর্ণবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিবাদ এই প্রথম নয়। আমি তখন ক্যালিফোর্নিয়ায়। ১৯৯২ সালে মে মাসে নির্দয়ভাবে আফ্রিকান আমেরিকান রডনি কিঙকে প্রহার করার পরও মামলায় চারজন পুলিশ বেকসুর খালাস হবার পর সাউথ সেন্ট্রাল লস এঞ্জেলেসে প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে। তিনদিনের ভয়াবহ প্রতিবাদ, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটে ৬৩ জন মারা যায় আর ১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়।
ইদানিং বারবার খবর আসছে, পুলিশ নিরস্ত্র আফ্রিকান আমেরিকানদের হত্যা করছে। অনেক সময় তাদের বিচার হয় না, বিচারে হলেও শাস্তি হয় না। সম্প্রতি যেই জর্জিয়াতে আমি থাকি, সেখানে আফ্রিকান আমেরিকান তরুণ আমড আরবারিকে চোর সন্দেহে ধাওয়া করে সাদা পিতা-পুত্র তাকে গুলি করে খুন করে, অথচ আড়াই মাস তাদের গায়ে আঁচড়টি পড়েনি। মার্চ মাসে কেন্টাকির লুইভিল শহরে পুলিশ এ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে আফ্রিকান আমেরিকান জরুরি সেবাকর্মী ব্রিওনা টেইলরকে গুলি করে হত্যা করে।
দেশ অস্থির, জনতার ক্রদ্ধ। এর কারণ বুঝতে হলে এদেশে কালোদের ওপর পুলিশী নির্যাতনের পেছনে আমেরিকার দীর্ঘদিনের কলঙ্কময় বর্ণবাদী নিপীড়নের ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে হবে। এই অত্যাচারে ভুক্তভোগী আফ্রিকান আমেরিকান সমাজের এক ক্ষুরধার বিশ্লেষণী লেখক জেমস বল্ডউইন। ১৯৬২ সালে নিউ ইয়র্কার সাময়িকীতে তার একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ ছাপা হয়। কুড়ি হাজার শব্দের বিশাল এই প্রবন্ধটি প্রায় একটি ছোট্ট পুস্তিকার সমান। সেখানে সামাজিক বিশ্লেষণের সাথে সাথে নানান বর্ণনা ও স্মৃতিচারণ রয়েছে। তার থেকে অল্প খানিকটা চুম্বক অংশ বাংলায় অনুবাদ করে নিবেদন করছি।
ষাটের দশকে এদেশে আফ্রিকান আমেরিকানদের ওপর যে ভয়ানক বর্ণবাদী স্বেচ্ছাচারের বর্ণনা বল্ডউইন করেছেন, আজ নানা দিক থেকে আমেরিকায় অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে এই উন্নতিতে ভয়াবহ ফাঁকও রয়ে গেছে। প্রায় ৬০ বছর আগে লেখা প্রবন্ধটি পড়লে পাঠক বার বার চমকে উঠবেন। মনে হবে বল্ডউইন-এর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর যেন আজকের পরিস্থিতি বর্ণনা করছে। (নিগ্রো শব্দটা এখন ভদ্রসমাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও যে সময়ে বল্ডউইন লিখেছেন, তখন সাদা কালো সকলেই আফ্রিকান আমেরিকানদের নিগ্রো বলে অভিহিত করত।)
মনের আঙিনা থেকে পত্র (অংশবিশেষ)
জেমস বল্ডউইন
দ্য নিউ ইয়র্কার। ১৭ নভেম্বর, ১৯৬২
অনুবাদ: আশফাক স্বপন
মূল রচনা
Letters from a region of my mind
By James Baldwin
The New Yorker | November 17, 1962
মূল রচনার লিঙ্ক
এই বিষম দুরবস্থার পরিবর্তন যে সম্ভব নয় বুঝতে সেটা বুঝতে তেমন বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি কর্মদিবসে সারাক্ষণ বিনা কারণে লাঞ্ছনা আর বিপদের মুখোমুখি হতে হতে মানুষ যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেজন্য তেমন স্পর্শকাতর হবারও প্রয়োজন নেই। এই লাঞ্ছনা শুধু খেটে খাওয়া মানুষকে ভোগ করতে হয় না। আমার যখন ১৩ বছর বয়স, তখন একদিন আমি নিউইয়র্ক-এর ফিফথ এভিনিউ পার হয় লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছি। রাস্তার মাঝখানে পুলিশ। আমি পাশ দিয়ে যাবার সময় বিড়বিড় করে বলল, ‘এখানে মরতে এসেছিস কেন, নিগার? তোদের পাড়ায় থাকতে পারিস না?’
তাই ত্রাস সৃষ্টির জন্য যে কোন একটা উপায় বড্ড প্রয়োজন। একথা সম্পূর্ণ পরিষ্কার যে পুলিশ আপনাকে পেটাবে, গারদে পুরবে, যদি সে এই সব কাজ করে পার পেয়ে যায়। তারা নিজেদের প্রতি যেমন আচরণ কামনা করে, সভ্যতার বা খ্রীষ্টীয় প্রেমের দোহাই দিলেও তারা আপনার সাথে সেই রকম আচরণ করবে, তার সম্ভাবনা নেই। শুধুমাত্র যদি আপনার জোর পালটা আক্রমণের ক্ষমতা থাকে, তাহলেই তার ভয়ে ওরা সভ্য আচরণ করবে, বা ভালোমানুষির ভাণ করবে (তাই সই)। আমিতো খুব বেশি নিগ্রো চিনি না যারা চায় সাদারা তাকে গ্রহণ করুক। সাদাদের ভালোবাসা চাইবার তো প্রশ্নই ওঠেনা। ওদের চাওয়া সামান্যই – এই ধরণীতে তাদের ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতির সময়টুকু যেন সর্বক্ষণ সাদাদের শারীরিক আক্রমণ থেকে তারা নিষ্কৃতি পায়।
সাদারা সামাজিক শিষ্টতার রীতিনীতি মেনে চলে বলে দাবি করে। কিন্তু সাদাদের জগতে বসবাস করে নিগ্রোসমাজের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার ফলে তাদের মাঝে এই দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা সৃষ্টি সম্ভব নয়। নিগ্রোদের নিজের অবস্থাই তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করে যে সাদা লোকে এইসব রীতি মেনে চলেনা।
সাদা লোকে কালো মানুষের স্বাধীনতা চুরি করেছে, তারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই আত্মসাতের সুবিধা ভোগ করছে। তাদের কোনরকমের নৈতিক গ্রহণযোগ্যতাই নেই। তাদের পক্ষে হাকিম, জুরি, বন্দুক, আইন রয়েছে – অর্থাৎ সব ক্ষমতাই তাদের। কিন্তু এই ক্ষমতা অপরাধীর ক্ষমতা। একে ভয় করা যায়, শ্রদ্ধা করা যায় না।
সাদাদের সমাজে নীতিকথার বুলি কপচানো হয়। তবে সেসব অনুসরণ না করাটা কালোদের দমন করবার আরেকটা ফন্দি।
আমি বজ্রকঠিন পণ করেছিলাম– আমি নিজেই উপলব্ধি করিনি কতো কঠোর সেই পণ – ঘেটো নামের এই বর্ণবিভাজিত আবাসনের ঘেরাটোপের সাথে কোনদিন আমি আপস করবনা। দরকার হলে জাহান্নামে যাব, তবুও কোন সাদা লোক আমার ওপর থুথু মারবে, সেটা মানবো না। এই প্রজাতন্ত্রে আমার জন্য যে ‘জায়গা’ বরাদ্দ করা হয়েছে আমি কিছুতেই সেটা মেনে নেবনা। এই দেশের সাদা লোক আমার পরিচয় নির্ধারণ করে আমার সম্ভাবনাকে খর্ব করবে, সে আমি কিছুতেই হতে দেবনা।
জন্মলগ্ন থেকে নিগ্রোরদের এদেশে – আর কোন দেশে নিগ্রোর অস্তিত্ব নেই – নিজেদের ঘৃণা করতে শেখানো হয়। পৃথিবীটা সাদা আর ওরা কালো। সাদা লোকের হাতে ক্ষমতা, তার অর্থ ওরা কালো লোকের চাইতে শ্রেয় (মৌলিকভাবে শ্রেয়, ঈশ্বরের এমনটাই নির্দেশ কিনা), এবং পৃথিবীর এই ভিন্নতা সম্বন্ধে সজাগ করবার, সেটা উপলব্ধি করবার এবং সেটাকে ভয় করবার অজস্র উপায় রয়েছে।
আমাদের ওপর যে নির্যাতন হয়, তার প্রকৃতি, আমাদের যেই বিশেষধরনের জটিল ঝুঁকির সামাল দিতে হয়, এসবকিছু হয়তো আমাদের – গণিকা, দালাল, জোচ্চর, গীর্জার উপাসক, বাচ্চা – সবাইকে একসূত্রে বেঁধেছে। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এই সীমার মধ্যেই আমরা পরস্পরের সাথে এক ধরনের মুক্তি অর্জন করেছি যা প্রায় প্রেমের কাছাকাছি।
এই মুক্তির ঈঙ্গিত পাই কিছু ভক্তিমূলক গস্পেল গানে বা জ্যাজ সঙ্গীতে। জ্যাজ সঙ্গীতের পুরোটা জুড়ে, বিশেষ করে বেদনবিধুর ব্লুজ সঙ্গীতে কী যেন একটা তীক্ষ্ণ, তীর্যক, ব্যঙ্গাত্মক সুর আছে, আধিপত্যের ছাপ আছে, সেটা যেন খানিকটা শাঁখের করাতের মতো ধারাল। সাদা আমেরিকানরা ভাবে আনন্দের গানে শুধুই আনন্দ, আর দুঃখের গান শুধুই দুঃখের। অদ্ভুত ব্যাপার হলো বেশির ভাগ সাদা আমেরিকানরা গায়ও সেইভাবে। উভয়ক্ষেত্রেই শুনতে এমন ভীষণরকমের ফাঁকা আর অন্তঃসারশূন্য লাগে, যে বোধহীনতার কোন অতল থেকে তাদের প্রাণহীন সুর উঠে আসে সে কথা ভেবে ভেবে আমি হয়রান হয়ে যাই।
উপলব্ধির যেই গভীরতা থেকে এরকম তীর্যক শক্তিময়তা উঠে আসে সেটা সাদা আমেরিকানরা বোঝে না। ওরা সন্দেহ করে এই শক্তি জৈবিক, তারা সেটার হদিশ পায়না বলে আতঙ্কিত হয়। ‘জৈবিক’ কথাটা কিন্তু আদিরসে উত্তেজিত কালো নারী বা সুঠামদেহী কালো পুরুষদের বোঝানো হচ্ছে না। আমি যার কথা বলছি সেটা আরো অনেক সরল। জৈবিক তাড়না বলতে আমি বোঝাচ্ছি নিজের সহজাত প্রাণশক্তিকে সমীহ করা, তাকে নিয়ে, জীবনকে নিয়ে, উল্লসিত হওয়া। এ হলো ভালোবাসা থেকে শুরু করে সবাইকে নিয়ে ভোজন করা পর্যন্ত মানুষের প্রতিটি কাজে সপ্রাণ উপস্থিতি রক্ষা করা।
সাদা খ্রীষ্টানরা ইতিহাসের কিছু গোড়ার কথা ভুলে গেছেন। তারা ভুলে গেছেন, যেই ধর্ম তাদের ন্যায়পরায়ণতা ও ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা – ‘ঈশ্বর আমার পক্ষে’ বলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী নেতা ডক্টর ভেরভোর্ড ঘোষণা করেছেন – সেটা যে পাথুরে স্থান থেকে এসেছে, তার নাম মধ্যপ্রাচ্য। তখনও মানুষের বর্ণভেদ আবিষ্কৃত হয়নি। খ্রীষ্টীয় ধর্মব্যবস্থার পত্তনের জন্য রোমের আদেশে যীশুকে মৃত্যুদণ্ডিত করার প্রয়োজন হয়। ঈষৎ দুর্নামগ্রস্ত, রোদেপোড়া হিব্রু যীশুখ্রীষ্ট, যার নামে এই ধর্ম, সেই খ্রীষ্টীয় ধর্মব্যবস্থার আসল স্থপতি কিন্তু আরেক জন। তিনি নীতিবাগীশ, নির্মম ধর্মান্ধ সেন্ট পল।
সাদা মানুষ যখন আফ্রিকায় আসে, তখন সাদা মানুষের হাতে বাইবেল, আর আফ্রিকান মানুষের কব্জায় জমি। কিন্তু এখন সাদা মানুষকে তার অনিচ্ছায়, কখনো রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে জমি থেকে উৎখাত করা হচ্ছে। আর আফ্রিকান এখন সেই বাইবেল হয় আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে অথবা যেটুকু গলাধঃকরণ করেছে সেটা উগরে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
আমেরিকায় সাদা আমেরিকানরা পরস্পরের প্রতি যেমন আচরণ করে, কালো মানুষের প্রতি সেরকম আচরণ করেনা। সাদা মানুষ যখন কালো মানুষের মুখোমুখি হয়, বিশেষ করে কালো মানুষটি যদি অসহায় হয়, তাহলে ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটে।
কালের থাবা বড় কঠিন। সে এক সময়ে ঠিকই রাজত্বের নাগাল পায়, তাকে ধ্বংস করে। রাজত্বের শাসন আর নীতির মূলমন্ত্রে কাল তার তীক্ষ্ণ দাঁত বসিয়ে তার কাটাছেঁড়া করে। কালের ব্যবধানে সেই সব মূলমন্ত্রের অসারতা প্রমাণ হয়, সেইসব মূলমন্ত্র তখন মুখ থুবড়ে পরে। এই তো, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, রোমে গীর্জার পাদ্রীরা একটা অসহায় কালো দেশে হানাদার আক্রমণে পাঠাবার সময় তরুণ ইতালীয় সেনাদের আশীর্বাদ করেছেন। সেই ঘটনার আগ পর্যন্ত ঐ দেশটি নিজেকে কালো বলেই ভাবত না।
কিন্তু তারপর বেশ কিছু কাল অতিবাহিত হয়েছে, এবং সেই সময়ে খ্রীষ্টান জগৎ যে নৈতিকভাবে দেউলিয়া আর রাজনৈতিকভাবে অস্থির সেটা প্রমাণিত হয়েছে। যখন একটা খ্রীষ্টান জাত একটা জঘন্য হিংস্র তাণ্ডবে মত্ত হয়, যেমন তৃতীয় রাইখে জার্মানীর নাৎসিরা, তখন ‘খ্রীষ্টান’ এবং ‘সভ্য’ কথাগুলো শুনতে অদ্ভুত লাগে। বিশেষ করে যাদের সভ্য বা খ্রীষ্টান কোনটাই বিবেচনা করা হয় না, তাদের কানে ঐ কথাগুলো বেখাপ্পা শোনায়। পূর্বপুরুষের পরিচয়টাই পাপ, সেই কারণে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র – ঈশ্বরের মন্দিরে – এমন সুসংবদ্ধভাবে, এমন ভয়ঙ্করভাবে, এত দীর্ঘসময় ধরে প্রাণসংহার করা হয়, যে এই আলোকিত যুগের আগে আর অন্য কোন যুগে এমন ভয়াবহ নরমেধযজ্ঞ সংঘটন ও নথিবদ্ধ করা দূরে থাক, সেটা কল্পনাই করা যায়নি।
আমার নিজের অভিমত হলো তৃতীয় রাইখের ফলে শুধুমাত্র প্রযুক্তি ছাড়া খ্রীষ্টানদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নটি চিরতরের জন্য অবান্তর হয়ে গেছে। জার্মানির ইহুদি হত্যাযজ্ঞ সাদা লোককে স্তম্ভিত করেছে, আজও করে। তারা ভাবতেই পারেনি তাদের পক্ষে এমন আচরণ সম্ভব। কিন্তু কালো মানুষ স্তম্ভিত হয়েছিল কি? অন্তত যেভাবে সাদারা হয়েছিল? আমার সেবিষয়ে গভীর সন্দেহ রয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিগ্রোদের সাথে যে আচরণ করা হয়, আমার মতে সেটা আমেরিকার সাথে নিগ্রোর সম্পর্কের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে -হয়তো একটু বেশি সরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে – বলতে হয়, একটা আশার মৃত্যু ঘটে, সাদা আমেরিকানদের প্রতি শ্রদ্ধা আরো খানিকটা মুছে যায়।
কল্পনা করুন আপনি এমন একজন মানুষ যে তার দেশের জন্য উর্দি পরেছে, তাকে রক্ষায় আপনার মৃত্যু ঘটতে পারে। তার সহযোদ্ধা আর ঊর্ধতন অফিসাররা তাকে ‘নিগার বলে ডাকে। তাকে প্রায় অবধারিতভাবে সবচাইতে নিকৃষ্ট, কুৎসিত, কঠিন, বাজে কাজগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আপনাকে কল্পনা করতে হবে এত কিছু সহ্য করার পর, দেশে ফেরার পর এই নাগরিকের বরাতে কি জোটে। সে কালো চামড়া নিয়ে বর্ণবিভাজিত বাসে চড়ে, বিভিন্ন স্থানে ‘সাদা’ ‘কালো’ সাইনবোর্ড, বিশেষে করে ‘সাদা ভদ্রমহিলা’ আর ‘কালো মহিলা’ সাইনবোর্ড স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে।
এই সমাজ সম্পূর্ণভাবে বৈরিভাবাপন্ন। তার স্বভাবই হলো আপনাকে পদদলিত করবে। ঠিক যেমন আগে বহু মানুষকে করেছে, এখনো প্রতিদিন বহু লোককে করছে। তখন কোন একটা অপমান কি সত্যি ঘটেছে, নাকি সবটাই আপনার কল্পনা, সেটার তফাৎ বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
যেমন ধরুন আমার জন্য ফ্ল্যাটের দারোয়ান আর পুলিশ সব্বাই এক। আমার এদের সাথে আচরণের মূলসূত্র হলো ওরা আমাকে আতঙ্কিত করার আগে আমি ওদের আতঙ্কিত করব। কারো কারো প্রতি নিঃসন্দেহে আমি অবিচার করছি, কিন্তু আমি নাচার। এই সব মানুষের কাছে এদের ঊর্দির চাইতে যে মানবিকতা বড় হতে পারে, সেটা ধরে নেওয়া আমার জন্য বড্ড বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সাদা মানুষ কি গাত্রবর্ণের চাইতে মানবিকতাকে প্রাধান্য দেয়? বেশির ভাগ নিগ্রো এটা ধরে নেবার মত বড় ঝুঁকি নিতে রাজি না।
মোদ্দা কথা হলো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে, মানুষ হিসেবে কালো মানুষের সম্বন্ধে সত্য কথাটা তার কাছ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে, অন্যায়ভাবে গোপন রাখা হয়েছে। একজন কালো মানুষ যখন সাদা সমাজের সংজ্ঞা মানতে অস্বীকার করে, তখন সাদা সমাজের ক্ষমতার ভিত্তি কেঁপে ওঠে। ফলে কালো মানুষকে খর্ব করার কোন সুযোগ হাতছাড়া করা হয় না।
আজ তো এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে পৃথিবীতে সাদা মানুষ সংখ্যালঘু। এত ভীষণ রকমের সংখ্যালঘু যে পুরো সাদা সমাজের ধারণাটাই কল্পিত মনে হয়। তাদের শাসনের আশাও আঁকড়ে থাকা সম্ভব নয়। যদি তাই হয়, চোরাগোপ্তা চাতূর্য আর ভয়াবহ রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে তারা যে প্রাধান্য অর্জন করেছে তারা দাবি করে তাতে ঈশ্বরের আশীর্বাদ রয়েছে। কিন্তু আসলে সেটা যদি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়ে থাকে? তাই যদি হয়, তাহলে যেই তরবারি এতদিন তারা অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, সেটা আজ নির্মমভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে।
আমেরিকার নিগ্রো দেশটির এক অনন্য সৃষ্টি। তার কোন পূর্বসূরী নেই, তার সাথে তুলনীয় এমন কিছু আর কোথাও নেই।
এটাতো সত্যি কথা যে প্রতিটি আমেরিকান নিগ্রোর নাম মূলত সে যেই সাদা লোকের সম্পত্তি ছিল, তার নাম। আমার নাম বল্ডউইন, কারণ বল্ডউইন নামে এক সাদা খ্রীষ্টানের কাছে হয় আমার আফ্রিকান গোষ্ঠী আমাকে বিক্রি করেছিল, নতুবা আমাকে অপহরণ করার পর সে আমায় পেয়েছে। সে আমাকে ক্রুশের কাছে কুর্নিশ করতে বাধ্য করেছিল। আমি দৃশ্যত ও আইনত একটা সাদা প্রোটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী দেশে ক্রীতদাসের বংশধর। এই হলো আমেরিকান নিগ্রো হবার তাৎপর্য – এই হলো তার পরিচয়। একজন অপহৃত বিধর্মী, যাকে পশুর মত বিক্রি করা হয়, তার সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়, যাকে আমেরিকার সংবিধানে এক সময় ‘তিন-পঞ্চমাংশ’ মানুষ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, এবং সুপ্রীম কোর্টের ড্রেড স্কট মামলার রায় অনুযায়ী যার এমন কোন নাগরিক অধিকার ছিলনা যেটা সম্মান করতে কোন সাদা মানুষ বাধ্য।
এখন কথা হচ্ছে, আমেরিকার রাজনৈতিক আর সামাজিক কাঠামোর খোল নলচে পালটে তাকে ঢেলে সাজানো ছাড়া নিগ্রোর পরিস্থিতিতে সত্যিকার পরিবর্তন আনার কোনরকম সম্ভাবনা নেই। আবার এটাও পরিষ্কার যে সাদা আমেরিকানদের শুধু যে এসব পরিবর্তন আনার কোন ইচ্ছা নেই তাই নয়, মোটের ওপর তারা এই বিষয়ে এমন মানসিক জড়তায় আচ্ছন্ন যে তারা এই পরিবর্তন কল্পনা করতেও অক্ষম। এখানে উল্লেক্ষ্য যে সাদা আমেরিকানদের সদিচ্ছার প্রতি নিগ্রোর নিজেরও আর কোন আস্থা নাই। অবশ্য কস্মিনকালেও ছিল কি?
কাউকে মুক্ত করে দিলেই তাকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। নিগ্রোর ব্যাপারে এই কথাতা খাটে। আমেরিকার প্রজাতন্ত্র এই কাজটি করবার মতো যথেষ্ট মানসিক প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারেনি। সাদা আমেরিকানরা নিগ্রোদের উন্নয়নে যে সব কাজ করে সন্তুষ্টি লাভ করে, তাকে আজকাল লোকদেখানো চাল বলে খারিজ করা হয়। পাকাপোক্ত উদাহরণ হিসেবে ১৯৫৪ সালের সুপ্রীম কোর্টের রায়ের কথা বলা যায়। এই রায়ে স্কুলশিক্ষায় বর্ণবাদী বিভাজন নিষিদ্ধ করা হয়, এবং সেইজন্য আমেরিকানরা গর্ব অনুভব করে। সাদা আমেরিকানরা ভাবে এই রায় আন্তরিক মতবদলের প্রমাণ, যদিও তার বিপক্ষে বিশাল প্রমাণ রয়েছে।
সাদা লোকের শুধু একটা জিনিসই আছে যেটা কালো মানুষের প্রয়োজন, বা তাদের চাওয়া উচিত – সেটা হলো ক্ষমতা। কেউ চিরদিনের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনা।
আবারো বলছি: সাদা মানুষের নিজের মুক্তির জন্য যে মূল্য দিতে হবে সেটা হলো কালো মানুষের মুক্তি – সম্পূর্ণ মুক্তি। সেই মুক্তি আসতে হবে শহরে, শহরতলীতে, আইনের দৃষ্টিতে, চেতনায়।
সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা সবাই মিলিতভাবে একটি জাতি গড়তে চাইলে, আমরা, কালো আর সাদা মানুষ – আমাদের পরস্পরকে গভীরভাবে প্রয়োজন। অর্থাৎ যদি আমরা সত্যি পুরুষ আর নারী হিসেবে আমাদের পরিচয়, মানসিক পরিণতি অর্জন করতে চাই। তবে একটি মিলিত জাতিসত্ত্বা সৃষ্টি অবিশ্বাস্যরকমের কঠিন কাজ।
এই যে নিগ্রোর অতীত – দড়ি, আগুন, অত্যাচার, পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা, শিশুহত্যা, ধর্ষণ, মৃত্যূ, লাঞ্ছনা, অহোরাত্রি ত্রাস - সে এমন ত্রাস যা মজ্জার গভীর পর্যন্ত চলে যায়; তার নিজ জীবনের মূল্য সম্বন্ধে সংশয় হয়, কারণ চারপাশে সবাই সেটার মূল্য অস্বীকার করে; তার নারী, স্বজন, সন্তান, যাদের তার রক্ষা করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু যাদের সে রক্ষা করতে পারেনি - তাদের জন্য বেদনা; ক্রোধ ঘৃণায় মাথায় খুন চেপে যায়, সাদা মানুষের প্রতি এমন গভীর ঘৃণা জন্মায় যে সেই ঘৃণা উলটে তার ও তার নিজের মানুষের ওপর এসে পড়ে, যার ফলে সবরকমের ভালোবাসা, বিশ্বাস, আনন্দ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই অতীত, যেখানে একটা মানবিক পরিচয়, মানবিক কর্তৃত্ব অর্জন, তার বিকাশ, সেটাকে নিশ্চিত করার এক সীমাহীন সংগ্রাম। এই অতীত – যার ভয়াবহতা সত্ত্বেও এতে কী যেন একটা সৌন্দর্য আছে। তবে দুঃখ কষ্ট সম্বন্ধে আমি কোন মোহকে প্রশ্রয় দিতে চাইনা।
যেই মানুষকে মানব নৃশংসতার লেলিহান আগুনের শিখার ভেতর থেকে তার ব্যক্তিত্ব, তার পরিচয়কে দিনের পর দিন ছিনিয়ে বের করে আনতে হয়, সে এই যাত্রায় রক্ষা পাক বা না পাক, সে নিজের সম্বন্ধে, মানবজীবন সম্বন্ধে এমন কিছু আবিষ্কার করে যেটা পৃথিবীর কোন ইস্কুল, কোন গীর্জা শেখাতে পারে না। সে নিজের ওপর কর্তৃত্ব অর্জন করেছে, যেটা আর কিছুতেই আলগা হবে না।
এই মানুষগুলো নিয়ে আমার অনেক গর্ব। সেটা তাদের গাত্রবর্ণের জন্য নয়, তাদের বুদ্ধিমত্তা, তাদের চারিত্রিক বলিষ্ঠতার জন্য, তাদের সত্ত্বার সৌন্দর্যের জন্য। জাতিরও তাদের নিয়ে গর্ব করা উচিত, কিন্তু হায়, খুব বেশি মানুষ তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও জানে না। এই অজ্ঞতার কারণ হচ্ছে মার্কিন জীবনে এসব মানুষের যে ভূমিকা ছিল – এবং আছে – তাতে আমেরিকা সম্বন্ধে আমেরিকানরা যা জানবে, সেকথা তারা শুনতে চায় না।
সাদা আমেরিকানরা নিজেদের সম্বন্ধে নানারকম কল্পকথা আঁকড়ে থাকে – তারা বিশ্বাস করে যে তাদের পূর্বপুরুষেরা সব মুক্তিকামী বীর, তাদের জন্ম পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ দেশে, আমেরিকানরা যুদ্ধে অদম্য, শান্তির সময় বিজ্ঞ, আমেরিকানরা মেক্সিকান, বা আদিবাসী বা অধস্তন মানুষ বা আর সব পড়শিদের সাথে সব সময় ন্যায্য আচরণ করেছে, আমেরিকান পুরুষ পৃথিবীর সবচাইতে সহজ-সরল আর পৌরুষদীপ্ত, আমেরিকান মেয়েরা সবচাইতে নির্মল। আমেরিকান নিগ্রোদের মস্ত সুবিধা হলো তারা কখনই এসব গালগল্পে বিশ্বাস করেনি।
সাদা মানুষের মাঝে আমি এমন একটা গোয়ার্তুমি আর অজ্ঞতা দেখি তাতে প্রতিহি্ংসা অবশ্যম্ভাবী মনে হয়। এই প্রতিহিংসা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের ওপর নির্ভর করে না, তাদের দ্বারা সংগঠিতও নয়। কোন পুলিশ বাহিনি বা সেনাবাহিনীর সাধ্য নাই একে ঠেকাবার। এটা হলো ইতিহাসের প্রতিহিংসা – এর উৎস সেই ধ্রুব সত্য যেটা স্বীকার করে আমরা বলি: ‘যা ওপরে যায়, তা ঠিক আবার নীচে নেমে আসে।’
আজ আমরা সেই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
যদি আমরা – আমি তুলনামূলকভাবে সচেতন সাদা আর কালোদের কথা বলছি, যাদের প্রেমিকের মতো একের অন্যের মধ্যে পূর্ণ সচেতনতা সঞ্চারিত করতে হবে – তারা যদি নিজ দায়িত্বপালনে পিছপা না হই, তাহলে সংখ্যায় অঙ্গুলিমেয় হলেও আমরা হয়তো এই বর্ণবাদী দুঃস্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারব, আমাদের জাতিকে দাড় করাতে পারব, পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারব। আর আমরা যদি আজ জান বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে না পড়ি, তাহলে বাইবেল থেকে আহরিত এক ক্রীতদাসের গানের যেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, সেটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হবে। সেই গানের চরণের মূল কথা, মানব জাতি যখন প্রথমবার ভুল করেছিল তখন ঈশ্বর মহাপ্লাবন দিয়ে শাস্তি দিয়েছিল আর নূহ নবীকে নির্দেশ দিয়েছিল বিশাল এক জাহাজ বানিয়ে তাতে আশ্রয় নিতে। এবার আর পানি আসবে না। সেই চরণের কথা: ‘নূহ নবীকে ঈশ্বর রঙধনুর সঙ্কেত দিয়েছিলেন/ পরের বার আর পানি নয়, আগুন ঝরবে!’
আসিতেছে শুভদিন
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
- কাজী নজরুল ইসলাম
আমি আটলান্টায় থাকি। কাল CNN সদর দফতরের সামনে সহিংস প্রতিবাদে পুলিশেরর গাড়ি পুড়েছে, দোকান লুট হয়েছে। মেয়র হাত জোড় করে নগরবাসীকে বাড়ি ফিরতে বলেছে। আজ শহরে সান্ধ্য আইন চালু।
সারা আমেরিকা রাগে কাঁপছে। শহরে শহরে বিক্ষোভ, কত স্থানে আগুন জ্বলছে। একাধিক শহরে সান্ধ্য আইন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নগর প্রশাসন হিমসিম খাচ্ছে।
মিনিয়াপোলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক আফ্রিকান আমেরিকান ব্যক্তিকে হাতকড়া পরাবার পরও পুলিশ তাকে মাটিতে ফেলে গলায় হাঁটু চেপে জনসমক্ষে হত্যা করে। এতে সারাদেশে ক্রুদ্ধ প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছে তা যেন আর থামতে চায় না।
বর্ণবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিবাদ এই প্রথম নয়। আমি তখন ক্যালিফোর্নিয়ায়। ১৯৯২ সালে মে মাসে নির্দয়ভাবে আফ্রিকান আমেরিকান রডনি কিঙকে প্রহার করার পরও মামলায় চারজন পুলিশ বেকসুর খালাস হবার পর সাউথ সেন্ট্রাল লস এঞ্জেলেসে প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে। তিনদিনের ভয়াবহ প্রতিবাদ, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটে ৬৩ জন মারা যায় আর ১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়।
ইদানিং বারবার খবর আসছে, পুলিশ নিরস্ত্র আফ্রিকান আমেরিকানদের হত্যা করছে। অনেক সময় তাদের বিচার হয় না, বিচারে হলেও শাস্তি হয় না। সম্প্রতি যেই জর্জিয়াতে আমি থাকি, সেখানে আফ্রিকান আমেরিকান তরুণ আমড আরবারিকে চোর সন্দেহে ধাওয়া করে সাদা পিতা-পুত্র তাকে গুলি করে খুন করে, অথচ আড়াই মাস তাদের গায়ে আঁচড়টি পড়েনি। মার্চ মাসে কেন্টাকির লুইভিল শহরে পুলিশ এ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে আফ্রিকান আমেরিকান জরুরি সেবাকর্মী ব্রিওনা টেইলরকে গুলি করে হত্যা করে।
দেশ অস্থির, জনতার ক্রদ্ধ। এর কারণ বুঝতে হলে এদেশে কালোদের ওপর পুলিশী নির্যাতনের পেছনে আমেরিকার দীর্ঘদিনের কলঙ্কময় বর্ণবাদী নিপীড়নের ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে হবে। এই অত্যাচারে ভুক্তভোগী আফ্রিকান আমেরিকান সমাজের এক ক্ষুরধার বিশ্লেষণী লেখক জেমস বল্ডউইন। ১৯৬২ সালে নিউ ইয়র্কার সাময়িকীতে তার একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ ছাপা হয়। কুড়ি হাজার শব্দের বিশাল এই প্রবন্ধটি প্রায় একটি ছোট্ট পুস্তিকার সমান। সেখানে সামাজিক বিশ্লেষণের সাথে সাথে নানান বর্ণনা ও স্মৃতিচারণ রয়েছে। তার থেকে অল্প খানিকটা চুম্বক অংশ বাংলায় অনুবাদ করে নিবেদন করছি।
ষাটের দশকে এদেশে আফ্রিকান আমেরিকানদের ওপর যে ভয়ানক বর্ণবাদী স্বেচ্ছাচারের বর্ণনা বল্ডউইন করেছেন, আজ নানা দিক থেকে আমেরিকায় অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে এই উন্নতিতে ভয়াবহ ফাঁকও রয়ে গেছে। প্রায় ৬০ বছর আগে লেখা প্রবন্ধটি পড়লে পাঠক বার বার চমকে উঠবেন। মনে হবে বল্ডউইন-এর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর যেন আজকের পরিস্থিতি বর্ণনা করছে। (নিগ্রো শব্দটা এখন ভদ্রসমাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও যে সময়ে বল্ডউইন লিখেছেন, তখন সাদা কালো সকলেই আফ্রিকান আমেরিকানদের নিগ্রো বলে অভিহিত করত।)
মনের আঙিনা থেকে পত্র (অংশবিশেষ)
জেমস বল্ডউইন
দ্য নিউ ইয়র্কার। ১৭ নভেম্বর, ১৯৬২
অনুবাদ: আশফাক স্বপন
মূল রচনা
Letters from a region of my mind
By James Baldwin
The New Yorker | November 17, 1962
মূল রচনার লিঙ্ক
এই বিষম দুরবস্থার পরিবর্তন যে সম্ভব নয় বুঝতে সেটা বুঝতে তেমন বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি কর্মদিবসে সারাক্ষণ বিনা কারণে লাঞ্ছনা আর বিপদের মুখোমুখি হতে হতে মানুষ যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেজন্য তেমন স্পর্শকাতর হবারও প্রয়োজন নেই। এই লাঞ্ছনা শুধু খেটে খাওয়া মানুষকে ভোগ করতে হয় না। আমার যখন ১৩ বছর বয়স, তখন একদিন আমি নিউইয়র্ক-এর ফিফথ এভিনিউ পার হয় লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছি। রাস্তার মাঝখানে পুলিশ। আমি পাশ দিয়ে যাবার সময় বিড়বিড় করে বলল, ‘এখানে মরতে এসেছিস কেন, নিগার? তোদের পাড়ায় থাকতে পারিস না?’
তাই ত্রাস সৃষ্টির জন্য যে কোন একটা উপায় বড্ড প্রয়োজন। একথা সম্পূর্ণ পরিষ্কার যে পুলিশ আপনাকে পেটাবে, গারদে পুরবে, যদি সে এই সব কাজ করে পার পেয়ে যায়। তারা নিজেদের প্রতি যেমন আচরণ কামনা করে, সভ্যতার বা খ্রীষ্টীয় প্রেমের দোহাই দিলেও তারা আপনার সাথে সেই রকম আচরণ করবে, তার সম্ভাবনা নেই। শুধুমাত্র যদি আপনার জোর পালটা আক্রমণের ক্ষমতা থাকে, তাহলেই তার ভয়ে ওরা সভ্য আচরণ করবে, বা ভালোমানুষির ভাণ করবে (তাই সই)। আমিতো খুব বেশি নিগ্রো চিনি না যারা চায় সাদারা তাকে গ্রহণ করুক। সাদাদের ভালোবাসা চাইবার তো প্রশ্নই ওঠেনা। ওদের চাওয়া সামান্যই – এই ধরণীতে তাদের ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতির সময়টুকু যেন সর্বক্ষণ সাদাদের শারীরিক আক্রমণ থেকে তারা নিষ্কৃতি পায়।
সাদারা সামাজিক শিষ্টতার রীতিনীতি মেনে চলে বলে দাবি করে। কিন্তু সাদাদের জগতে বসবাস করে নিগ্রোসমাজের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার ফলে তাদের মাঝে এই দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা সৃষ্টি সম্ভব নয়। নিগ্রোদের নিজের অবস্থাই তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করে যে সাদা লোকে এইসব রীতি মেনে চলেনা।
সাদা লোকে কালো মানুষের স্বাধীনতা চুরি করেছে, তারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই আত্মসাতের সুবিধা ভোগ করছে। তাদের কোনরকমের নৈতিক গ্রহণযোগ্যতাই নেই। তাদের পক্ষে হাকিম, জুরি, বন্দুক, আইন রয়েছে – অর্থাৎ সব ক্ষমতাই তাদের। কিন্তু এই ক্ষমতা অপরাধীর ক্ষমতা। একে ভয় করা যায়, শ্রদ্ধা করা যায় না।
সাদাদের সমাজে নীতিকথার বুলি কপচানো হয়। তবে সেসব অনুসরণ না করাটা কালোদের দমন করবার আরেকটা ফন্দি।
আমি বজ্রকঠিন পণ করেছিলাম– আমি নিজেই উপলব্ধি করিনি কতো কঠোর সেই পণ – ঘেটো নামের এই বর্ণবিভাজিত আবাসনের ঘেরাটোপের সাথে কোনদিন আমি আপস করবনা। দরকার হলে জাহান্নামে যাব, তবুও কোন সাদা লোক আমার ওপর থুথু মারবে, সেটা মানবো না। এই প্রজাতন্ত্রে আমার জন্য যে ‘জায়গা’ বরাদ্দ করা হয়েছে আমি কিছুতেই সেটা মেনে নেবনা। এই দেশের সাদা লোক আমার পরিচয় নির্ধারণ করে আমার সম্ভাবনাকে খর্ব করবে, সে আমি কিছুতেই হতে দেবনা।
জন্মলগ্ন থেকে নিগ্রোরদের এদেশে – আর কোন দেশে নিগ্রোর অস্তিত্ব নেই – নিজেদের ঘৃণা করতে শেখানো হয়। পৃথিবীটা সাদা আর ওরা কালো। সাদা লোকের হাতে ক্ষমতা, তার অর্থ ওরা কালো লোকের চাইতে শ্রেয় (মৌলিকভাবে শ্রেয়, ঈশ্বরের এমনটাই নির্দেশ কিনা), এবং পৃথিবীর এই ভিন্নতা সম্বন্ধে সজাগ করবার, সেটা উপলব্ধি করবার এবং সেটাকে ভয় করবার অজস্র উপায় রয়েছে।
আমাদের ওপর যে নির্যাতন হয়, তার প্রকৃতি, আমাদের যেই বিশেষধরনের জটিল ঝুঁকির সামাল দিতে হয়, এসবকিছু হয়তো আমাদের – গণিকা, দালাল, জোচ্চর, গীর্জার উপাসক, বাচ্চা – সবাইকে একসূত্রে বেঁধেছে। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এই সীমার মধ্যেই আমরা পরস্পরের সাথে এক ধরনের মুক্তি অর্জন করেছি যা প্রায় প্রেমের কাছাকাছি।
এই মুক্তির ঈঙ্গিত পাই কিছু ভক্তিমূলক গস্পেল গানে বা জ্যাজ সঙ্গীতে। জ্যাজ সঙ্গীতের পুরোটা জুড়ে, বিশেষ করে বেদনবিধুর ব্লুজ সঙ্গীতে কী যেন একটা তীক্ষ্ণ, তীর্যক, ব্যঙ্গাত্মক সুর আছে, আধিপত্যের ছাপ আছে, সেটা যেন খানিকটা শাঁখের করাতের মতো ধারাল। সাদা আমেরিকানরা ভাবে আনন্দের গানে শুধুই আনন্দ, আর দুঃখের গান শুধুই দুঃখের। অদ্ভুত ব্যাপার হলো বেশির ভাগ সাদা আমেরিকানরা গায়ও সেইভাবে। উভয়ক্ষেত্রেই শুনতে এমন ভীষণরকমের ফাঁকা আর অন্তঃসারশূন্য লাগে, যে বোধহীনতার কোন অতল থেকে তাদের প্রাণহীন সুর উঠে আসে সে কথা ভেবে ভেবে আমি হয়রান হয়ে যাই।
উপলব্ধির যেই গভীরতা থেকে এরকম তীর্যক শক্তিময়তা উঠে আসে সেটা সাদা আমেরিকানরা বোঝে না। ওরা সন্দেহ করে এই শক্তি জৈবিক, তারা সেটার হদিশ পায়না বলে আতঙ্কিত হয়। ‘জৈবিক’ কথাটা কিন্তু আদিরসে উত্তেজিত কালো নারী বা সুঠামদেহী কালো পুরুষদের বোঝানো হচ্ছে না। আমি যার কথা বলছি সেটা আরো অনেক সরল। জৈবিক তাড়না বলতে আমি বোঝাচ্ছি নিজের সহজাত প্রাণশক্তিকে সমীহ করা, তাকে নিয়ে, জীবনকে নিয়ে, উল্লসিত হওয়া। এ হলো ভালোবাসা থেকে শুরু করে সবাইকে নিয়ে ভোজন করা পর্যন্ত মানুষের প্রতিটি কাজে সপ্রাণ উপস্থিতি রক্ষা করা।
সাদা খ্রীষ্টানরা ইতিহাসের কিছু গোড়ার কথা ভুলে গেছেন। তারা ভুলে গেছেন, যেই ধর্ম তাদের ন্যায়পরায়ণতা ও ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা – ‘ঈশ্বর আমার পক্ষে’ বলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী নেতা ডক্টর ভেরভোর্ড ঘোষণা করেছেন – সেটা যে পাথুরে স্থান থেকে এসেছে, তার নাম মধ্যপ্রাচ্য। তখনও মানুষের বর্ণভেদ আবিষ্কৃত হয়নি। খ্রীষ্টীয় ধর্মব্যবস্থার পত্তনের জন্য রোমের আদেশে যীশুকে মৃত্যুদণ্ডিত করার প্রয়োজন হয়। ঈষৎ দুর্নামগ্রস্ত, রোদেপোড়া হিব্রু যীশুখ্রীষ্ট, যার নামে এই ধর্ম, সেই খ্রীষ্টীয় ধর্মব্যবস্থার আসল স্থপতি কিন্তু আরেক জন। তিনি নীতিবাগীশ, নির্মম ধর্মান্ধ সেন্ট পল।
সাদা মানুষ যখন আফ্রিকায় আসে, তখন সাদা মানুষের হাতে বাইবেল, আর আফ্রিকান মানুষের কব্জায় জমি। কিন্তু এখন সাদা মানুষকে তার অনিচ্ছায়, কখনো রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে জমি থেকে উৎখাত করা হচ্ছে। আর আফ্রিকান এখন সেই বাইবেল হয় আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে অথবা যেটুকু গলাধঃকরণ করেছে সেটা উগরে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
আমেরিকায় সাদা আমেরিকানরা পরস্পরের প্রতি যেমন আচরণ করে, কালো মানুষের প্রতি সেরকম আচরণ করেনা। সাদা মানুষ যখন কালো মানুষের মুখোমুখি হয়, বিশেষ করে কালো মানুষটি যদি অসহায় হয়, তাহলে ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটে।
কালের থাবা বড় কঠিন। সে এক সময়ে ঠিকই রাজত্বের নাগাল পায়, তাকে ধ্বংস করে। রাজত্বের শাসন আর নীতির মূলমন্ত্রে কাল তার তীক্ষ্ণ দাঁত বসিয়ে তার কাটাছেঁড়া করে। কালের ব্যবধানে সেই সব মূলমন্ত্রের অসারতা প্রমাণ হয়, সেইসব মূলমন্ত্র তখন মুখ থুবড়ে পরে। এই তো, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, রোমে গীর্জার পাদ্রীরা একটা অসহায় কালো দেশে হানাদার আক্রমণে পাঠাবার সময় তরুণ ইতালীয় সেনাদের আশীর্বাদ করেছেন। সেই ঘটনার আগ পর্যন্ত ঐ দেশটি নিজেকে কালো বলেই ভাবত না।
কিন্তু তারপর বেশ কিছু কাল অতিবাহিত হয়েছে, এবং সেই সময়ে খ্রীষ্টান জগৎ যে নৈতিকভাবে দেউলিয়া আর রাজনৈতিকভাবে অস্থির সেটা প্রমাণিত হয়েছে। যখন একটা খ্রীষ্টান জাত একটা জঘন্য হিংস্র তাণ্ডবে মত্ত হয়, যেমন তৃতীয় রাইখে জার্মানীর নাৎসিরা, তখন ‘খ্রীষ্টান’ এবং ‘সভ্য’ কথাগুলো শুনতে অদ্ভুত লাগে। বিশেষ করে যাদের সভ্য বা খ্রীষ্টান কোনটাই বিবেচনা করা হয় না, তাদের কানে ঐ কথাগুলো বেখাপ্পা শোনায়। পূর্বপুরুষের পরিচয়টাই পাপ, সেই কারণে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র – ঈশ্বরের মন্দিরে – এমন সুসংবদ্ধভাবে, এমন ভয়ঙ্করভাবে, এত দীর্ঘসময় ধরে প্রাণসংহার করা হয়, যে এই আলোকিত যুগের আগে আর অন্য কোন যুগে এমন ভয়াবহ নরমেধযজ্ঞ সংঘটন ও নথিবদ্ধ করা দূরে থাক, সেটা কল্পনাই করা যায়নি।
আমার নিজের অভিমত হলো তৃতীয় রাইখের ফলে শুধুমাত্র প্রযুক্তি ছাড়া খ্রীষ্টানদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নটি চিরতরের জন্য অবান্তর হয়ে গেছে। জার্মানির ইহুদি হত্যাযজ্ঞ সাদা লোককে স্তম্ভিত করেছে, আজও করে। তারা ভাবতেই পারেনি তাদের পক্ষে এমন আচরণ সম্ভব। কিন্তু কালো মানুষ স্তম্ভিত হয়েছিল কি? অন্তত যেভাবে সাদারা হয়েছিল? আমার সেবিষয়ে গভীর সন্দেহ রয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিগ্রোদের সাথে যে আচরণ করা হয়, আমার মতে সেটা আমেরিকার সাথে নিগ্রোর সম্পর্কের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে -হয়তো একটু বেশি সরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে – বলতে হয়, একটা আশার মৃত্যু ঘটে, সাদা আমেরিকানদের প্রতি শ্রদ্ধা আরো খানিকটা মুছে যায়।
কল্পনা করুন আপনি এমন একজন মানুষ যে তার দেশের জন্য উর্দি পরেছে, তাকে রক্ষায় আপনার মৃত্যু ঘটতে পারে। তার সহযোদ্ধা আর ঊর্ধতন অফিসাররা তাকে ‘নিগার বলে ডাকে। তাকে প্রায় অবধারিতভাবে সবচাইতে নিকৃষ্ট, কুৎসিত, কঠিন, বাজে কাজগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আপনাকে কল্পনা করতে হবে এত কিছু সহ্য করার পর, দেশে ফেরার পর এই নাগরিকের বরাতে কি জোটে। সে কালো চামড়া নিয়ে বর্ণবিভাজিত বাসে চড়ে, বিভিন্ন স্থানে ‘সাদা’ ‘কালো’ সাইনবোর্ড, বিশেষে করে ‘সাদা ভদ্রমহিলা’ আর ‘কালো মহিলা’ সাইনবোর্ড স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে।
এই সমাজ সম্পূর্ণভাবে বৈরিভাবাপন্ন। তার স্বভাবই হলো আপনাকে পদদলিত করবে। ঠিক যেমন আগে বহু মানুষকে করেছে, এখনো প্রতিদিন বহু লোককে করছে। তখন কোন একটা অপমান কি সত্যি ঘটেছে, নাকি সবটাই আপনার কল্পনা, সেটার তফাৎ বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
যেমন ধরুন আমার জন্য ফ্ল্যাটের দারোয়ান আর পুলিশ সব্বাই এক। আমার এদের সাথে আচরণের মূলসূত্র হলো ওরা আমাকে আতঙ্কিত করার আগে আমি ওদের আতঙ্কিত করব। কারো কারো প্রতি নিঃসন্দেহে আমি অবিচার করছি, কিন্তু আমি নাচার। এই সব মানুষের কাছে এদের ঊর্দির চাইতে যে মানবিকতা বড় হতে পারে, সেটা ধরে নেওয়া আমার জন্য বড্ড বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সাদা মানুষ কি গাত্রবর্ণের চাইতে মানবিকতাকে প্রাধান্য দেয়? বেশির ভাগ নিগ্রো এটা ধরে নেবার মত বড় ঝুঁকি নিতে রাজি না।
মোদ্দা কথা হলো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে, মানুষ হিসেবে কালো মানুষের সম্বন্ধে সত্য কথাটা তার কাছ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে, অন্যায়ভাবে গোপন রাখা হয়েছে। একজন কালো মানুষ যখন সাদা সমাজের সংজ্ঞা মানতে অস্বীকার করে, তখন সাদা সমাজের ক্ষমতার ভিত্তি কেঁপে ওঠে। ফলে কালো মানুষকে খর্ব করার কোন সুযোগ হাতছাড়া করা হয় না।
আজ তো এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে পৃথিবীতে সাদা মানুষ সংখ্যালঘু। এত ভীষণ রকমের সংখ্যালঘু যে পুরো সাদা সমাজের ধারণাটাই কল্পিত মনে হয়। তাদের শাসনের আশাও আঁকড়ে থাকা সম্ভব নয়। যদি তাই হয়, চোরাগোপ্তা চাতূর্য আর ভয়াবহ রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে তারা যে প্রাধান্য অর্জন করেছে তারা দাবি করে তাতে ঈশ্বরের আশীর্বাদ রয়েছে। কিন্তু আসলে সেটা যদি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়ে থাকে? তাই যদি হয়, তাহলে যেই তরবারি এতদিন তারা অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, সেটা আজ নির্মমভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে।
আমেরিকার নিগ্রো দেশটির এক অনন্য সৃষ্টি। তার কোন পূর্বসূরী নেই, তার সাথে তুলনীয় এমন কিছু আর কোথাও নেই।
এটাতো সত্যি কথা যে প্রতিটি আমেরিকান নিগ্রোর নাম মূলত সে যেই সাদা লোকের সম্পত্তি ছিল, তার নাম। আমার নাম বল্ডউইন, কারণ বল্ডউইন নামে এক সাদা খ্রীষ্টানের কাছে হয় আমার আফ্রিকান গোষ্ঠী আমাকে বিক্রি করেছিল, নতুবা আমাকে অপহরণ করার পর সে আমায় পেয়েছে। সে আমাকে ক্রুশের কাছে কুর্নিশ করতে বাধ্য করেছিল। আমি দৃশ্যত ও আইনত একটা সাদা প্রোটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী দেশে ক্রীতদাসের বংশধর। এই হলো আমেরিকান নিগ্রো হবার তাৎপর্য – এই হলো তার পরিচয়। একজন অপহৃত বিধর্মী, যাকে পশুর মত বিক্রি করা হয়, তার সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়, যাকে আমেরিকার সংবিধানে এক সময় ‘তিন-পঞ্চমাংশ’ মানুষ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, এবং সুপ্রীম কোর্টের ড্রেড স্কট মামলার রায় অনুযায়ী যার এমন কোন নাগরিক অধিকার ছিলনা যেটা সম্মান করতে কোন সাদা মানুষ বাধ্য।
এখন কথা হচ্ছে, আমেরিকার রাজনৈতিক আর সামাজিক কাঠামোর খোল নলচে পালটে তাকে ঢেলে সাজানো ছাড়া নিগ্রোর পরিস্থিতিতে সত্যিকার পরিবর্তন আনার কোনরকম সম্ভাবনা নেই। আবার এটাও পরিষ্কার যে সাদা আমেরিকানদের শুধু যে এসব পরিবর্তন আনার কোন ইচ্ছা নেই তাই নয়, মোটের ওপর তারা এই বিষয়ে এমন মানসিক জড়তায় আচ্ছন্ন যে তারা এই পরিবর্তন কল্পনা করতেও অক্ষম। এখানে উল্লেক্ষ্য যে সাদা আমেরিকানদের সদিচ্ছার প্রতি নিগ্রোর নিজেরও আর কোন আস্থা নাই। অবশ্য কস্মিনকালেও ছিল কি?
কাউকে মুক্ত করে দিলেই তাকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। নিগ্রোর ব্যাপারে এই কথাতা খাটে। আমেরিকার প্রজাতন্ত্র এই কাজটি করবার মতো যথেষ্ট মানসিক প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারেনি। সাদা আমেরিকানরা নিগ্রোদের উন্নয়নে যে সব কাজ করে সন্তুষ্টি লাভ করে, তাকে আজকাল লোকদেখানো চাল বলে খারিজ করা হয়। পাকাপোক্ত উদাহরণ হিসেবে ১৯৫৪ সালের সুপ্রীম কোর্টের রায়ের কথা বলা যায়। এই রায়ে স্কুলশিক্ষায় বর্ণবাদী বিভাজন নিষিদ্ধ করা হয়, এবং সেইজন্য আমেরিকানরা গর্ব অনুভব করে। সাদা আমেরিকানরা ভাবে এই রায় আন্তরিক মতবদলের প্রমাণ, যদিও তার বিপক্ষে বিশাল প্রমাণ রয়েছে।
সাদা লোকের শুধু একটা জিনিসই আছে যেটা কালো মানুষের প্রয়োজন, বা তাদের চাওয়া উচিত – সেটা হলো ক্ষমতা। কেউ চিরদিনের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনা।
আবারো বলছি: সাদা মানুষের নিজের মুক্তির জন্য যে মূল্য দিতে হবে সেটা হলো কালো মানুষের মুক্তি – সম্পূর্ণ মুক্তি। সেই মুক্তি আসতে হবে শহরে, শহরতলীতে, আইনের দৃষ্টিতে, চেতনায়।
সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা সবাই মিলিতভাবে একটি জাতি গড়তে চাইলে, আমরা, কালো আর সাদা মানুষ – আমাদের পরস্পরকে গভীরভাবে প্রয়োজন। অর্থাৎ যদি আমরা সত্যি পুরুষ আর নারী হিসেবে আমাদের পরিচয়, মানসিক পরিণতি অর্জন করতে চাই। তবে একটি মিলিত জাতিসত্ত্বা সৃষ্টি অবিশ্বাস্যরকমের কঠিন কাজ।
এই যে নিগ্রোর অতীত – দড়ি, আগুন, অত্যাচার, পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা, শিশুহত্যা, ধর্ষণ, মৃত্যূ, লাঞ্ছনা, অহোরাত্রি ত্রাস - সে এমন ত্রাস যা মজ্জার গভীর পর্যন্ত চলে যায়; তার নিজ জীবনের মূল্য সম্বন্ধে সংশয় হয়, কারণ চারপাশে সবাই সেটার মূল্য অস্বীকার করে; তার নারী, স্বজন, সন্তান, যাদের তার রক্ষা করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু যাদের সে রক্ষা করতে পারেনি - তাদের জন্য বেদনা; ক্রোধ ঘৃণায় মাথায় খুন চেপে যায়, সাদা মানুষের প্রতি এমন গভীর ঘৃণা জন্মায় যে সেই ঘৃণা উলটে তার ও তার নিজের মানুষের ওপর এসে পড়ে, যার ফলে সবরকমের ভালোবাসা, বিশ্বাস, আনন্দ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই অতীত, যেখানে একটা মানবিক পরিচয়, মানবিক কর্তৃত্ব অর্জন, তার বিকাশ, সেটাকে নিশ্চিত করার এক সীমাহীন সংগ্রাম। এই অতীত – যার ভয়াবহতা সত্ত্বেও এতে কী যেন একটা সৌন্দর্য আছে। তবে দুঃখ কষ্ট সম্বন্ধে আমি কোন মোহকে প্রশ্রয় দিতে চাইনা।
যেই মানুষকে মানব নৃশংসতার লেলিহান আগুনের শিখার ভেতর থেকে তার ব্যক্তিত্ব, তার পরিচয়কে দিনের পর দিন ছিনিয়ে বের করে আনতে হয়, সে এই যাত্রায় রক্ষা পাক বা না পাক, সে নিজের সম্বন্ধে, মানবজীবন সম্বন্ধে এমন কিছু আবিষ্কার করে যেটা পৃথিবীর কোন ইস্কুল, কোন গীর্জা শেখাতে পারে না। সে নিজের ওপর কর্তৃত্ব অর্জন করেছে, যেটা আর কিছুতেই আলগা হবে না।
এই মানুষগুলো নিয়ে আমার অনেক গর্ব। সেটা তাদের গাত্রবর্ণের জন্য নয়, তাদের বুদ্ধিমত্তা, তাদের চারিত্রিক বলিষ্ঠতার জন্য, তাদের সত্ত্বার সৌন্দর্যের জন্য। জাতিরও তাদের নিয়ে গর্ব করা উচিত, কিন্তু হায়, খুব বেশি মানুষ তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও জানে না। এই অজ্ঞতার কারণ হচ্ছে মার্কিন জীবনে এসব মানুষের যে ভূমিকা ছিল – এবং আছে – তাতে আমেরিকা সম্বন্ধে আমেরিকানরা যা জানবে, সেকথা তারা শুনতে চায় না।
সাদা আমেরিকানরা নিজেদের সম্বন্ধে নানারকম কল্পকথা আঁকড়ে থাকে – তারা বিশ্বাস করে যে তাদের পূর্বপুরুষেরা সব মুক্তিকামী বীর, তাদের জন্ম পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ দেশে, আমেরিকানরা যুদ্ধে অদম্য, শান্তির সময় বিজ্ঞ, আমেরিকানরা মেক্সিকান, বা আদিবাসী বা অধস্তন মানুষ বা আর সব পড়শিদের সাথে সব সময় ন্যায্য আচরণ করেছে, আমেরিকান পুরুষ পৃথিবীর সবচাইতে সহজ-সরল আর পৌরুষদীপ্ত, আমেরিকান মেয়েরা সবচাইতে নির্মল। আমেরিকান নিগ্রোদের মস্ত সুবিধা হলো তারা কখনই এসব গালগল্পে বিশ্বাস করেনি।
সাদা মানুষের মাঝে আমি এমন একটা গোয়ার্তুমি আর অজ্ঞতা দেখি তাতে প্রতিহি্ংসা অবশ্যম্ভাবী মনে হয়। এই প্রতিহিংসা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের ওপর নির্ভর করে না, তাদের দ্বারা সংগঠিতও নয়। কোন পুলিশ বাহিনি বা সেনাবাহিনীর সাধ্য নাই একে ঠেকাবার। এটা হলো ইতিহাসের প্রতিহিংসা – এর উৎস সেই ধ্রুব সত্য যেটা স্বীকার করে আমরা বলি: ‘যা ওপরে যায়, তা ঠিক আবার নীচে নেমে আসে।’
আজ আমরা সেই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
যদি আমরা – আমি তুলনামূলকভাবে সচেতন সাদা আর কালোদের কথা বলছি, যাদের প্রেমিকের মতো একের অন্যের মধ্যে পূর্ণ সচেতনতা সঞ্চারিত করতে হবে – তারা যদি নিজ দায়িত্বপালনে পিছপা না হই, তাহলে সংখ্যায় অঙ্গুলিমেয় হলেও আমরা হয়তো এই বর্ণবাদী দুঃস্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারব, আমাদের জাতিকে দাড় করাতে পারব, পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারব। আর আমরা যদি আজ জান বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে না পড়ি, তাহলে বাইবেল থেকে আহরিত এক ক্রীতদাসের গানের যেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, সেটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হবে। সেই গানের চরণের মূল কথা, মানব জাতি যখন প্রথমবার ভুল করেছিল তখন ঈশ্বর মহাপ্লাবন দিয়ে শাস্তি দিয়েছিল আর নূহ নবীকে নির্দেশ দিয়েছিল বিশাল এক জাহাজ বানিয়ে তাতে আশ্রয় নিতে। এবার আর পানি আসবে না। সেই চরণের কথা: ‘নূহ নবীকে ঈশ্বর রঙধনুর সঙ্কেত দিয়েছিলেন/ পরের বার আর পানি নয়, আগুন ঝরবে!’
No comments:
Post a Comment