কায়েস আহমেদের সততা সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যে বিরল
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
কায়েস আহমেদের বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর হওয়ার আগেই তার রচনাসমগ্র প্রকাশের উদ্যোগে উৎসবের আভাস নেই, এই প্রকাশ বরং শোক উদযাপনের আয়ােজন; এখানেই তার লেখার সঙ্গে শেষ যোগাযোগ, তার আর নতুন লেখা পড়ার সম্ভাবনার ইতি ঘটলো এখানেই।
গত বছর (১৯৯২) ১৪ জুন তারিখে কায়েস আহমেদের মৃত্যু হয়েছে। জীবনের বিনাশ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ও এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার কাজ তিনি সম্পন্ন করেছেন নিজেই। মরবার পর কোনোকিছু করা আর কিছুতেই সম্ভব নয়, নইলে নিজের দাফনের কাজটিও কায়েস মনে হয় নিজে নিজেই করতেন। নিজের কোনো কাজে কারো ওপর নির্ভর করা তার ধাতে ছিলো না। সংকলন ও সম্পাদনা করে তাঁর লেখা-প্রকাশের দায়িত্ব আর কারো ওপর চাপানো কায়েসের পক্ষে অচিন্তনীয়। তাঁর প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ, বিরল সততা ও অসীম সাহসের পরিণতিতে আত্মহত্যা অনিবার্য কি-না এবং কাজটি তাঁর শিল্পচর্চার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ-এর জবাব খোজার জন্যে কায়েস আহমেদের শিল্পকর্ম পাঠকের মনোযোগ দাবি করে।
ঘনিষ্ঠ কারো মৃত্যুর কয়েক মাসের ভেতর তাঁর রচনার বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ভূমিকা লেখা খুব ভোঁতা মানুষের জন্যেও সহজ কাজ নয়। তা অত নিরপেক্ষতার দরকারই-বা কী? তার আগ্রহী পাঠক হিসাবে কথা বলতে বলতে নিজের ভাবনার জটগুলো খোলার চেষ্টা করা এবং কায়েস সম্বন্ধে আর দশজনের ভাবনা একটু উসকিয়ে তোলা যায়।
কায়েস আহমেদ লিখতে শুরু করেন স্কুলে থাকতেই। ১৯৬৫ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে এইচএসসি-র ছাত্র, তখন তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। এর পরপরই কামাল বিন মাহতাবের সম্পাদনায় ‘ছোটগল্প' প্রকাশিত হলে এখানকার এই প্রথম ছোটগল্প-পত্রিকার সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। নিজে গল্প লেখা ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত তরুণ এবং সম্ভাবনাময় তরুণতরদের মূল্যায়ন ও পরিচিত করার জন্যে তিনি উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। লেখার ব্যাপারে খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোক ছিলেন, আবার পাঠকের মনোরঞ্জন সাধন তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো না; তাই প্রথম বই অন্ধ তীরন্দাজ প্রকাশের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত।
কায়েস আহমেদের সাহিত্যকর্মে তাঁর প্রকাশরীতি, পর্যবেক্ষণের ভঙ্গি ও অনুসন্ধানের পদ্ধতির বিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু তার গল্পের মানুষদের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই প্রথম বইতেই। মিলনের জন্যে কাতর বিচ্ছিন্ন মানুষের পাশাপাশি এখানে দেখি দমবন্ধ-করা বৃত্তের ভেতর বন্দি অসহায় চরিত্র। রেলে কাটা মানুষের ছিন্নভিন্ন শরীর দেখি প্রেমের প্রেক্ষাপটে। মিষ্টি স্বভাবের বৌ স্বামীর সঙ্গে বিছানায় শুয়ে মিলনের চরম মুহূর্তে স্বামীর বন্ধুকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না কিছুতেই। নস্টালজিয়ায় কাতর মানুষ, নিঃসঙ্গ মানুষ, ক্লান্ত মানুষ, স্মৃতির স্বাদে ও কষ্টে আচ্ছন্ন মানুষ—এরা সবাই তাঁর পরবর্তী রচনার সূচিপত্র।
আট বছর পর ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় কায়েসের প্রথম উপন্যাস নির্বাসিত একজন। কায়েসের প্রথম বইয়ের প্রায় সব লোকই এখানে কোনো-না-কোনোভাবে এসে হাজির হয়েছে, কিন্তু এর প্রেক্ষাপট সমস্ত দেশের সমাজ। দাঙা এই উপন্যাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, দাঙাকে এই লেখার নায়ক বলেও চিহ্নিত করতে পারি। স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সঙ্গী দাঙার ফলে মানুষকে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয়, এই স্বাধীনতা তাই শুধু মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার অধিকার অর্জন। তার স্বাভাবিক জীবনের বিকাশ শােচনীয়ভাবে বিঘ্নিত। ক্ষোভ, অপমান ও গ্লানির ভেতর অহরহ যে-জীবন সে যাপন করে সেখানে এই উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষকে দিব্যি শনাক্ত করতে পারি। কিন্তু কাহিনীর শেষে এই প্রেক্ষাপটের গুরুত্ব আড়ালে পড়ে যায় যখন লেখক প্রধান চরিত্রের ভেতর একটি সিদ্ধান্ত আরোপ করিয়ে দেন যা তার জীবনযাপন বা স্বভাবের সঙ্গে খাপ খায় না। এখানে কায়েস ঝুঁকে পড়েন নিটোল কাহিনী রচনা করার দিকে এবং এদিক থেকে তিনি গড়পড়তা উপন্যাসের রীতির কাছেই আত্মসমর্পণ করে বসেন। মনে হয়, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক কাহিনী-বর্ণনার প্রবণতা তাঁর পরবর্তী রচনায় অব্যাহত থাকবে এবং একজন জনপ্রিয় লেখক হিসাবে তিনি পাঠককে আঠার মতো সেঁটে রাখবেন এবং তাঁর উপন্যাস পাঠের পর পাঠক পরম তৃপ্তিতে গা এলিয়ে দেবেন।
সৌভাগ্যক্রমে কায়েস আহমেদের পরিণতি তা হয়নি। তাঁর দ্বিতীয় ও শেষ উপন্যাস দিনযাপন পড়ে কায়েসের বিকাশ দেখে বিস্মিত হতে হয়। প্রথম বইতে মোটামুটি আয়ত্ত গল্প বলার রীতিটিকে তিনি এখানে এসে বর্জন করেছেন। প্রকরণের নতুনত্ব এখানে বড় কথা নয়, এই নতুন পথ অনুসরণের প্ররোচনা তিনি পান অনুসন্ধানের তীব্র স্পৃহা থেকে। ‘দিনযাপন’ কিন্তু কায়েস আহমেদের শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, দুই উপন্যাসের মাঝখানে লেখা একটি গল্প ‘জগদ্দল’ তার সাক্ষী। একই বইয়ের ভেতর ‘জগদ্দল’-এর সহ-অবস্থানের কারণ কি কেবল রোগা বইটির শরীরে মাংস যোগ করা? না। এই রচনা দুটির মধ্যে প্রধান সম্পর্কটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বৈইকী!—একটিতে আমাদের ১ নম্বর স্বাধীনতা ও তার সঙ্গী দাঙার দক্ষযজ্ঞের ভয়াবহ বিবরণ এবং আরেকটিতে ২ নম্বর স্বাধীনতার পর তুমুল অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের ছবি। কিন্তু কি গল্প বলার রীতি, কি চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক, কি দৃষ্টিভঙ্গি—সব ব্যাপারেই দুটি লেখায় লেখকের ভিন্ন স্বভাবের পরিচয় পাই। | ‘জগদ্দল’ গল্পে কায়েস আহমেদের স্যাতসেঁতে প্রকাশ ঝরে পড়েছে। কোনো চরিত্রের প্রতি তরল ভালোবাসা নেই। যে-যুবসম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ নিজেদের জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি নরখাদক সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছে, স্বাধীনতার পর দায়িত্বহীন রাষ্ট্রীয় শাসনের ফলে সেই যুবকদের মধ্যে প্রবলরকম অস্থিরতা, ক্ষোভ এবং এর পরিণামে চরম হতাশার সৃষ্টি হয় তাকে তেতো করে দেখানো হয়েছে এই গল্পে। ঐ সময়ের বাস্তবতা একটু রং পাল্টে কিন্তু এখনো অব্যাহত রয়েছে। এর ওপরকার দৃশ্যটি হলো লুটপাট, ছিনতাই, একবার উগ্র জাতীয়তাবাদী হুঙ্কার এবং আরেকবার ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের ঘেউঘেউ। কিন্তু ভেতরকার সত্যটি হলো এই যে, অনাচারের বিরুদ্ধে যাদের রুখে দাড়াবার কথা তারা নিদারুণভাবে পঙ্গু ও নপুংসক। | ‘জগদ্দল’-এর ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত দিনযাপন’-এর নায়ক। ঢাকা শহরের পুরনো এলাকায় একটি নড়বড়ে বাড়ির অধিবাসীরা হলো এর বিভিন্ন চরিত্র। তাদের সমস্যা ঠিক একরকমের না হলেও বড় করে দেখলে প্রায় একই ধরনের। ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে এরা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং এই কারণে এক ধরনের হীনম্মন্যতার শিকার। উপন্যাসের নায়ক হিসাবে বিশেষ একটি লোককে শনাক্ত করা যায় না। কোনো একক মানুষ কাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করা তত দূরের কথা, আলাদাভাবে চোখে পড়ার মতো ক্ষমতাও অর্জন করে না। এখানে সুস্থ জীবনযাপনের জন্যে উন্মুখ মানুষও আছে, কিন্তু সেই উন্মুখতা কখনো আকাঙ্ক্ষার পর্যায়ে ওঠে না বলে সেখানে কোনো সংকল্প নেই, তা শেষ পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ে লোভ হয়ে। পড়তে পড়তে পাঠক গ্লানিবোধ করতে পারেন, এখানেই কায়েসের সাফল্য। মধ্যবিত্ত, যে মানুষ নাম ধারণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে---এই সত্যটিকে ঘােষণা করে পাঠককে অস্বস্তির মধ্যে ফেলার ভেতরই তার সার্থকতা।
ঐ সত্যটি কায়েস নিজেও উপভোগ করেন না। তাই গোটা উপন্যাসে তাঁর অস্থিরতা বড় প্রকট, মাঝে মাঝে প্রায় আপত্তিকর। নিজের উপলব্ধিকে জানাবার জন্যে তার তাড়াহুড়া ভাবটা চোখে খচখচ করে বেঁধে। একেকটি চরিত্রের স্কেচ এঁকেই তিনি মন দেন আরেকজনের দিকে, তাদের স্বাভাবিক বিকাশ দেখাবার জন্যে ধৈর্য ধরার মতো অবসর তিনি পান না।
অথচ তার সততা সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যে বিরল। এই সততার বলেই কাহিনীর নামে কেচ্ছা বয়ান করার লোভ থেকে তিনি বিরত থাকতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথম উপন্যাসে গল্প বলার যে-প্রবণতা তার মধ্যে পেয়ে বসেছিলো তা অব্যাহত থাকলে এখানে এসে পরিণতরূপ লাভ করতে পারত। এই বইতে যে-শক্তির পরিচয় পাই, তাতে নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, ঐ প্রবণতার কাছে আত্মসমর্পণ করলে মসৃণ ও গতানুগতিক কাহিনী ফেঁদে ব্যাপকসংখ্যক পাঠক এবং সমালোচকদের পৃষ্ঠপোষকতা তিনি লাভ করতেন। সহজ সাফল্যের ঐ নিরাপদ ও সুনিশ্চিত পথ পরিহার করতে পারাটাই তাঁর সততা ও শক্তির প্রকাশ। অনেক দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও কায়েস আহমদ নায়কবর্জিত, ছিমছাম গপ্পোমুক্ত একটি ভাষাচলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সততা ও শক্তির অধিকারী বলেই জীবনের জয়গান করার জন্যে ইচ্ছাপূরণের নাবালক বাণী ছাড়ার পথ তিনি অনায়াসে পরিহার করতে পেরেছেন। আবার এরই মধ্যে দেখি, নড়বড়ে বাড়িটির আসন্ন মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়েছে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের সাহায্যে।
কায়েস আহমেদের সর্বশেষ বই লাশকাটা ঘর একটি গল্পগ্রন্থ। এই বইতেই তার শক্তির সবচেয়ে পরিণত প্রকাশ ঘটেছে। মানুষের নানারকম বেদনা ও ফাপড়কে তিনি দেখতে পান সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের অজস্র বিস্ফোরণ বলে। এখানে মানুষের কেবলই মার খাওয়ার অসহায় বেদনা নেই, রোগের চিকিৎসা করতে সংকল্পবদ্ধ মানুষকেও এখানে পাওয়া যায়। এমন সব হতাশ যুবকদের দেখি যাদের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও মানুষের স্বাধীনতা সমার্থক নয়। সামাজিক মূল্যবোধের নামে প্রচলিত সংস্কারকে ঝেড়ে ফেলে মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে হাতিয়ার তুলে নেয় নতুন যুবক। আবার এর ভেতরেই বেজে চলে তার নস্টালজিয়া, তবে নিজের স্মৃতিকে কেবল একটি ব্যক্তির কষ্টের মধ্যে না দেখে তিনি তা স্থাপন করেন মানুষের বেদনার পটভূমিতে। তার উপন্যাসের কোনো কোনো চরিত্র এখানে ফের হাজির হয়, তবে তাতে আমাদের একঘেয়ে লাগে না, বরং চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার উত্তাপ বোধ করি এবং ঐসব মানুষের গভীর ভেতর জগৎ আমাদের চোখে উন্মোচিত হয়। | ছোটোগল্পের প্রচলিত ও ধরাবাধা ছক তাঁর অনুসন্ধান প্রকাশের জন্যে যথেষ্ট বিবেচিত হয় না, প্রকরণ ভেঙে তিনি বেরিয়ে পড়েন নতুন ও অনিশ্চিত পথের দিকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটেমাটি খুঁজতে যাওয়ার একটি অভিযানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে একটি গল্পে, প্রথমে এটিকে একটি সাদামাটা প্রতিবেদন বলে ভুল হতে পারে । কিন্তু পড়তে পড়তেই কয়েকজন লোককে পেয়ে যাই যারা কেবল ঐ গ্রামের মানুষ নয়, নিরাপত্তার অভাব, গ্লানি ও অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা দাবি করে গল্পের চরিত্রের মর্যাদা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বপুরুষের ভিটে খোঁজ করতে গিয়ে লেখক এদের দেখেন এবং এদের আসন্ন-গৃহত্যাগের সম্ভাবনায় দেখতে পারেন নিজের ভিটেমাটি ত্যাগ করে আসার অভিজ্ঞতা। কিন্তু নিজে তিনি আড়ালেই রয়ে যান। এমনকি যেসব চরিত্র সৃষ্টি করেন তারাও কেবল কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকে না। দেশের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি—সবকিছুর বিশ্লেষণ ধরা পড়ে তাদের তৎপরতা ও এমনকি কেবল নীরব অবস্থানের ভেতরেও। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কায়েসকে মুগ্ধ করেছেন বললে মোটেই ঠিক বলা হয় না, বরং তার অস্থিরতা এই শিল্পীর কল্যাণে রূপ পায় বাঁচার প্রেরণায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি পাঠ করেছিলেন সৃজনশীল পাঠকের উত্তেজনা ও উদ্বেগ নিয়ে। কেবল নিজে পড়ে ক্ষান্ত হননি, কোন লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কীভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাও দেখতে চেয়েছিলেন বলে তাঁর প্রিয় লেখকের ওপর একটি রচনা সংকলন সম্পাদনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, চিঠির পর চিঠি ও তাগাদার পর তাগাদা দিয়ে তাদের অনেকের লেখা জোগাড় করেন এবং নিজেও একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় লেখার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই কাজটি শেষ করার আগেই তিনি নিজেই শেষ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
রথীন্দ্র ঘটক চৌধুরীকে নিয়ে লেখা তার বইটিকে কেবল একটি গবেষণা বই বললে সত্যের ধারেকাছেও যাওয়া যায় না। এই বইয়ের সব তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে, এজন্যে বিপুল পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু এই বস্তুনিষ্ঠ কাজের মধ্যে প্রবাহিত রয়েছে তার মানুষকে পর্যবেক্ষণ করার গভীর প্রবণতা। রথীন্দ্র ঘটক খুব পরিচিত লেখক নন বলেই কায়েস তাঁর গভীর সংবেদনশীল ব্যক্তিত্বকে উপস্থিত করার কঠিন দায়িত্বটি গ্রহণ করেন।
গল্প-উপন্যাস লেখা, প্রিয় লেখকের ওপর প্রবন্ধের সংকলন সম্পাদনা, অপরিচিত লেখকের ভেতর সংবেদনশীল ব্যক্তিত্বের উন্মোচন, অনিয়মিত হলেও সাময়িকীতে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা, সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকা——সবই তাঁর সৃজনশীল অনুসন্ধানের অবিচ্ছিন্ন অংশ।
এই শিল্পীর আত্মহত্যা কি কেবল আকস্মিকভাবে নিজেকে প্রত্যাহত করার স্পৃহার ফল? তার প্রিয় কবির সেই বহুপঠিত কবিতার লোকটি আর তিনি কি এক ব্যক্তি? মেনে নেওয়া মুশকিল।
কিন্তু ফাগুনের তখনো ঢের বাকি। বসন্তকালের রাত্রির অন্ধকার নয়; তখন ঘােরল বিকাল, জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিন সেদিন যতক্ষণ পারে আকাশ জুড়ে চড়া রোদ ঝেড়েছে। ঈদের একদিন পর পবিত্র কোরবানির গোরুখাসির রক্ত দীননাথ সেন রোডের এখানে ওখানে শুখিয়ে কালচে হয়ে এসেছে, নিহত জীবজন্তুর নাড়িভুড়ি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা সতীশ সরকার রোড় জুড়ে, তার গন্ধে দম-বন্ধ-করা গরম বাতাস। এরই মধ্যে তিনতলা বাড়ির ছাদে চিলেকোঠার ফ্ল্যাটে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়েন কায়েস আহমেদ। একটু-আগে-ডুবে-যাওয়া পঞ্চমীর চাঁদের স্মৃতিতে কোমল ও স্নিগ্ধ অন্ধকারে শেষনিশ্বাসটা টেনে নেওয়ার সুযোগ কায়েস আহমেদ নেননি। কোমল ও মিষ্টি, নিরাপদ ও অনায়াস, সরল ও স্নিগ্ধ কোনো ব্যাপারে কায়েস আহমেদ স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না। নিজের তৈরি প্রকরণটিতে অভ্যস্ত হতে-না-হতে তিনি অন্য পথের সন্ধান করতেন। কায়েস আহমেদ সব সময়েই ছিলেন নতুন লেখক। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন নতুন লেখকের প্রেরণা ও কষ্ট এবং নতুন লেখকের উদ্বেগ ও অতৃপ্তি নিয়ে। মানুষের গভীর ভেতরটাকে খুঁজে দেখার জন্যেই একটির পর একটি রাস্তায় তাঁর ক্লান্তিহীন পদসঞ্চার। তাঁর পায়ের নিচে বিরতিহীন ভূমিকম্প, তাই তাঁর এই অবিরত ছুটে চলা। এইসব রাস্তাই তার পছন্দের। ধীর ও শান্ত, সন্তুষ্ট ও নিস্তরঙ্গ সমতল তাকে কখনোই কাছে টানতে পারে না।
ব্যক্তিগত জীবনেও কোনো ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকা তার ধাতে ছিলো না । প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ব্যাপারে জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্মান শ্রেণীতে ঢুকেছিলেন ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে। প্রথম বর্ষের পরীক্ষাগুলোতে খুব ভালো ফল করার আভাস দেখালেও, কিংবা হয়তো এই কারণেই, দ্বিতীয় বর্ষে উঠেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবাংলার হুগলি জেলার বড়তাজপুর গ্রামে, ঐ গ্রামের বিখ্যাত শেখ পরিবারের ছেলে। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত, তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতেন না।
তিনি উপার্জন করতে নামেন এসএসসি পাশ করার পরই, অল্প কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছিলেন, এরপর কেবল শিক্ষকতাই করেছেন। ঢাকার একটি প্রথম শ্রেণীর স্কুল তাকে যেচে চাকরি দেয়, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেখানেই কাজ করে গেছেন। ডিগ্রি ছিলো না বলে সেখানেও যে-কোনো মুহূর্তে কর্মচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। বন্ধুদের অনেক অনুরোধেও ডিগ্রি পরীক্ষা দিতে বসেননি। মনে হয়, অনিশ্চিত অবস্থা তিনি ভালোবাসতেন।
১৯৬৯ সালে কায়েসের পিতা শেখ কামালউদ্দিন আহমদের মৃত্যু হয় তাদের গ্রামে। ঐ সময় গ্রামে যাবার জন্যে কায়েস একবার চেষ্টা করেছিলেন, পাসপোর্ট করতে গিয়ে দেখা গেলো যে, তিনি যে পাকিস্তানি নাগরিক তার কোনো প্রমাণ নেই ! ঝামেলা বাড়লো। গণ-আন্দোলনের ধাক্কা সামলাতে পুলিশ ব্যতিব্যস্ত ছিলো বলে কায়েসকে বিপদে ফেলার সময় পায়নি।
১৯৭১ সালে কায়েস আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে যান। এ-বছর অনেকটা সময় কাটিয়েছেন নিজের গ্রামে মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে। মায়ের ভালোবাসায় বেশিদিন থাকা বোধহয় তার স্বভাবে কুলায়নি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ঢাকায় ফিরে এলেন, নিজের গ্রামে আর কোনোদিন ফিরে যাননি। বড়তাজপুর গ্রামে তাদের পুরনো নোনা-ধরা বাড়ির সামনে শেফালি গাছের নিচে মোড়ায় বসে ছেলের জন্যে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়ের চোখে ছানি পড়ে গেলো—এই ছবিটা ভেবে কায়েস অস্থির হয়ে পড়তেন। কিন্তু মায়ের আঁচলের নিচে কটা দিন থেকে দুই চোখ ভরে ঘুমিয়ে আসার ইচ্ছা করা তার স্বভাবের বাইরে। ভালোবেসে বিয়ে করলেন। আত্মবিশ্বাস ছিলো প্রবল, দৃঢ় ধারণা ছিলো যে প্রেম দিয়ে, যত্ন দিয়ে সেবা দিয়ে স্ত্রীর মানসিক রোগ সারিয়ে তুলতে পারবেন। প্রায় দশটি বছর একনিষ্ঠভাবে স্ত্রীর সেবা করে গেছেন, যত্ন করলেন তাঁকে মায়ের মতো, বাপের মতো চোখে-চোখে রাখলেন। কতরকম চিকিৎসা করলেন। কারো কাছে কোনো সাহায্য চাননি, কাউকে জানতেও দিতে চাননি নিজের সমস্যার কথা।
নিজের পর্যবেক্ষণ, ধারণা, আদর্শ, বিশ্বাস—এসবের কোনো সাহিত্যিক কি অসাহিত্যিক আলাদা চেহারা ছিলো না তার কাছে। কি লেখা, কি পেশা, কি গৃহ সব জায়গায় তিনি ছিলেন একজন অভিন্ন মানুষ। সাহিত্যচর্চা করে সামাজিক সুবিধা আদায়ের বিন্দুমাত্র চেষ্টাও কোনোদিন করেননি। এককালে সাংবাদিকতা করেছিলেন, সেই সময়ের যোগাযোগ ব্যক্তিগত কাজে লাগানো তার রুচির বাইরে। তার মাপের লেখক বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাননি, আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে এই গ্লানি বহন করতে হবে সারাজীবন ধরে। আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন কেবল বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার। এই পুরস্কারের অর্থমূল্য সামান্য, লেখক শিবিরের সঙ্গে তিনি জড়িতও ছিলেন না কোনোদিন। কিন্তু সংগঠনটির প্রাতিষ্ঠানিকতা-বিরোধিতায় তার নিরঙ্কুশ আস্থা ছিলো বলেই পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। আবার প্রকাশকের তাগাদা সত্ত্বেও বিপুল অর্থমূল্যের পুরস্কারের জন্য বই জমা দিতে অস্বীকার করেছেন, কারণ পুরস্কার প্রদানকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃতি ও তাঁর স্বভাব সম্পূর্ণভাবে পরস্পরবিরোধী। দারিদ্র্যপীড়িত লেখকের এই প্রত্যাখ্যান আমরা যেন ভুলে না যাই।
তিনি প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ফেলেছেন নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে। ১৯৯২ সালের ১৪ জুন যে শেষ কাজটি করলেন তাও সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে। কারো কাছে অভিযোগ করেননি, কারো করুণা প্রার্থনা করেননি। মানুষকে জানবার জন্যে, মানুষকে অনুসন্ধান করার জন্যে, নিজেকে নিয়ে হলেও নিরীক্ষা করতে তাঁকে অনেক চড়া দাম দিতে হয়েছে। দারিদ্র্য, পারিবারিক দুর্যোগ, বিচ্ছিন্নতা, বিরামহীন উদ্বেগ—সবই বহন করতে হয়েছে একা। অনুসন্ধান হলো একই সঙ্গে তার প্রবণতা এবং দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ফল যা পেয়েছেন তা তার জন্যে সুখের নয়, যা দেখেছেন তার অনেকটাই, বলতে গেলে বেশির ভাগই অনুমোদন করতে পারেননি। অনুসন্ধান তাই তার প্রতিবাদও বটে। প্রতিবাদ তো আর ইচ্ছাপূরণের আবদার নয়, মস্ত মস্ত কাঠের পুতুল বানিয়ে তার মাথায় সূর্যোদয়ের ছবি লেখার নাবালক তৎপরতা নয়, সমাজ ও মানুষের জটিলতা, এই জটিলতায় অসহায় ও ছোট-হয়ে-পড়া মানুষকে দেখা ও দেখানোই হলো তার প্রতিবাদ জ্ঞাপন। তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু কি তার অনুসন্ধান অব্যাহত রাখার আর প্রতিবাদ জানাবার চরম সংকল্পের সোচ্চার প্রকাশ?
কায়েস আহমেদ রচনাসমগ্র
ভূমিকা
ঢাকা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
কায়েস আহমেদের বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর হওয়ার আগেই তার রচনাসমগ্র প্রকাশের উদ্যোগে উৎসবের আভাস নেই, এই প্রকাশ বরং শোক উদযাপনের আয়ােজন; এখানেই তার লেখার সঙ্গে শেষ যোগাযোগ, তার আর নতুন লেখা পড়ার সম্ভাবনার ইতি ঘটলো এখানেই।
গত বছর (১৯৯২) ১৪ জুন তারিখে কায়েস আহমেদের মৃত্যু হয়েছে। জীবনের বিনাশ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ও এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার কাজ তিনি সম্পন্ন করেছেন নিজেই। মরবার পর কোনোকিছু করা আর কিছুতেই সম্ভব নয়, নইলে নিজের দাফনের কাজটিও কায়েস মনে হয় নিজে নিজেই করতেন। নিজের কোনো কাজে কারো ওপর নির্ভর করা তার ধাতে ছিলো না। সংকলন ও সম্পাদনা করে তাঁর লেখা-প্রকাশের দায়িত্ব আর কারো ওপর চাপানো কায়েসের পক্ষে অচিন্তনীয়। তাঁর প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ, বিরল সততা ও অসীম সাহসের পরিণতিতে আত্মহত্যা অনিবার্য কি-না এবং কাজটি তাঁর শিল্পচর্চার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ-এর জবাব খোজার জন্যে কায়েস আহমেদের শিল্পকর্ম পাঠকের মনোযোগ দাবি করে।
ঘনিষ্ঠ কারো মৃত্যুর কয়েক মাসের ভেতর তাঁর রচনার বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ভূমিকা লেখা খুব ভোঁতা মানুষের জন্যেও সহজ কাজ নয়। তা অত নিরপেক্ষতার দরকারই-বা কী? তার আগ্রহী পাঠক হিসাবে কথা বলতে বলতে নিজের ভাবনার জটগুলো খোলার চেষ্টা করা এবং কায়েস সম্বন্ধে আর দশজনের ভাবনা একটু উসকিয়ে তোলা যায়।
কায়েস আহমেদ লিখতে শুরু করেন স্কুলে থাকতেই। ১৯৬৫ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে এইচএসসি-র ছাত্র, তখন তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। এর পরপরই কামাল বিন মাহতাবের সম্পাদনায় ‘ছোটগল্প' প্রকাশিত হলে এখানকার এই প্রথম ছোটগল্প-পত্রিকার সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। নিজে গল্প লেখা ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত তরুণ এবং সম্ভাবনাময় তরুণতরদের মূল্যায়ন ও পরিচিত করার জন্যে তিনি উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। লেখার ব্যাপারে খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোক ছিলেন, আবার পাঠকের মনোরঞ্জন সাধন তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো না; তাই প্রথম বই অন্ধ তীরন্দাজ প্রকাশের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত।
কায়েস আহমেদের সাহিত্যকর্মে তাঁর প্রকাশরীতি, পর্যবেক্ষণের ভঙ্গি ও অনুসন্ধানের পদ্ধতির বিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু তার গল্পের মানুষদের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই প্রথম বইতেই। মিলনের জন্যে কাতর বিচ্ছিন্ন মানুষের পাশাপাশি এখানে দেখি দমবন্ধ-করা বৃত্তের ভেতর বন্দি অসহায় চরিত্র। রেলে কাটা মানুষের ছিন্নভিন্ন শরীর দেখি প্রেমের প্রেক্ষাপটে। মিষ্টি স্বভাবের বৌ স্বামীর সঙ্গে বিছানায় শুয়ে মিলনের চরম মুহূর্তে স্বামীর বন্ধুকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না কিছুতেই। নস্টালজিয়ায় কাতর মানুষ, নিঃসঙ্গ মানুষ, ক্লান্ত মানুষ, স্মৃতির স্বাদে ও কষ্টে আচ্ছন্ন মানুষ—এরা সবাই তাঁর পরবর্তী রচনার সূচিপত্র।
আট বছর পর ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় কায়েসের প্রথম উপন্যাস নির্বাসিত একজন। কায়েসের প্রথম বইয়ের প্রায় সব লোকই এখানে কোনো-না-কোনোভাবে এসে হাজির হয়েছে, কিন্তু এর প্রেক্ষাপট সমস্ত দেশের সমাজ। দাঙা এই উপন্যাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, দাঙাকে এই লেখার নায়ক বলেও চিহ্নিত করতে পারি। স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সঙ্গী দাঙার ফলে মানুষকে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয়, এই স্বাধীনতা তাই শুধু মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার অধিকার অর্জন। তার স্বাভাবিক জীবনের বিকাশ শােচনীয়ভাবে বিঘ্নিত। ক্ষোভ, অপমান ও গ্লানির ভেতর অহরহ যে-জীবন সে যাপন করে সেখানে এই উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষকে দিব্যি শনাক্ত করতে পারি। কিন্তু কাহিনীর শেষে এই প্রেক্ষাপটের গুরুত্ব আড়ালে পড়ে যায় যখন লেখক প্রধান চরিত্রের ভেতর একটি সিদ্ধান্ত আরোপ করিয়ে দেন যা তার জীবনযাপন বা স্বভাবের সঙ্গে খাপ খায় না। এখানে কায়েস ঝুঁকে পড়েন নিটোল কাহিনী রচনা করার দিকে এবং এদিক থেকে তিনি গড়পড়তা উপন্যাসের রীতির কাছেই আত্মসমর্পণ করে বসেন। মনে হয়, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক কাহিনী-বর্ণনার প্রবণতা তাঁর পরবর্তী রচনায় অব্যাহত থাকবে এবং একজন জনপ্রিয় লেখক হিসাবে তিনি পাঠককে আঠার মতো সেঁটে রাখবেন এবং তাঁর উপন্যাস পাঠের পর পাঠক পরম তৃপ্তিতে গা এলিয়ে দেবেন।
সৌভাগ্যক্রমে কায়েস আহমেদের পরিণতি তা হয়নি। তাঁর দ্বিতীয় ও শেষ উপন্যাস দিনযাপন পড়ে কায়েসের বিকাশ দেখে বিস্মিত হতে হয়। প্রথম বইতে মোটামুটি আয়ত্ত গল্প বলার রীতিটিকে তিনি এখানে এসে বর্জন করেছেন। প্রকরণের নতুনত্ব এখানে বড় কথা নয়, এই নতুন পথ অনুসরণের প্ররোচনা তিনি পান অনুসন্ধানের তীব্র স্পৃহা থেকে। ‘দিনযাপন’ কিন্তু কায়েস আহমেদের শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, দুই উপন্যাসের মাঝখানে লেখা একটি গল্প ‘জগদ্দল’ তার সাক্ষী। একই বইয়ের ভেতর ‘জগদ্দল’-এর সহ-অবস্থানের কারণ কি কেবল রোগা বইটির শরীরে মাংস যোগ করা? না। এই রচনা দুটির মধ্যে প্রধান সম্পর্কটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বৈইকী!—একটিতে আমাদের ১ নম্বর স্বাধীনতা ও তার সঙ্গী দাঙার দক্ষযজ্ঞের ভয়াবহ বিবরণ এবং আরেকটিতে ২ নম্বর স্বাধীনতার পর তুমুল অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের ছবি। কিন্তু কি গল্প বলার রীতি, কি চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক, কি দৃষ্টিভঙ্গি—সব ব্যাপারেই দুটি লেখায় লেখকের ভিন্ন স্বভাবের পরিচয় পাই। | ‘জগদ্দল’ গল্পে কায়েস আহমেদের স্যাতসেঁতে প্রকাশ ঝরে পড়েছে। কোনো চরিত্রের প্রতি তরল ভালোবাসা নেই। যে-যুবসম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ নিজেদের জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি নরখাদক সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছে, স্বাধীনতার পর দায়িত্বহীন রাষ্ট্রীয় শাসনের ফলে সেই যুবকদের মধ্যে প্রবলরকম অস্থিরতা, ক্ষোভ এবং এর পরিণামে চরম হতাশার সৃষ্টি হয় তাকে তেতো করে দেখানো হয়েছে এই গল্পে। ঐ সময়ের বাস্তবতা একটু রং পাল্টে কিন্তু এখনো অব্যাহত রয়েছে। এর ওপরকার দৃশ্যটি হলো লুটপাট, ছিনতাই, একবার উগ্র জাতীয়তাবাদী হুঙ্কার এবং আরেকবার ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের ঘেউঘেউ। কিন্তু ভেতরকার সত্যটি হলো এই যে, অনাচারের বিরুদ্ধে যাদের রুখে দাড়াবার কথা তারা নিদারুণভাবে পঙ্গু ও নপুংসক। | ‘জগদ্দল’-এর ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত দিনযাপন’-এর নায়ক। ঢাকা শহরের পুরনো এলাকায় একটি নড়বড়ে বাড়ির অধিবাসীরা হলো এর বিভিন্ন চরিত্র। তাদের সমস্যা ঠিক একরকমের না হলেও বড় করে দেখলে প্রায় একই ধরনের। ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে এরা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং এই কারণে এক ধরনের হীনম্মন্যতার শিকার। উপন্যাসের নায়ক হিসাবে বিশেষ একটি লোককে শনাক্ত করা যায় না। কোনো একক মানুষ কাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করা তত দূরের কথা, আলাদাভাবে চোখে পড়ার মতো ক্ষমতাও অর্জন করে না। এখানে সুস্থ জীবনযাপনের জন্যে উন্মুখ মানুষও আছে, কিন্তু সেই উন্মুখতা কখনো আকাঙ্ক্ষার পর্যায়ে ওঠে না বলে সেখানে কোনো সংকল্প নেই, তা শেষ পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ে লোভ হয়ে। পড়তে পড়তে পাঠক গ্লানিবোধ করতে পারেন, এখানেই কায়েসের সাফল্য। মধ্যবিত্ত, যে মানুষ নাম ধারণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে---এই সত্যটিকে ঘােষণা করে পাঠককে অস্বস্তির মধ্যে ফেলার ভেতরই তার সার্থকতা।
ঐ সত্যটি কায়েস নিজেও উপভোগ করেন না। তাই গোটা উপন্যাসে তাঁর অস্থিরতা বড় প্রকট, মাঝে মাঝে প্রায় আপত্তিকর। নিজের উপলব্ধিকে জানাবার জন্যে তার তাড়াহুড়া ভাবটা চোখে খচখচ করে বেঁধে। একেকটি চরিত্রের স্কেচ এঁকেই তিনি মন দেন আরেকজনের দিকে, তাদের স্বাভাবিক বিকাশ দেখাবার জন্যে ধৈর্য ধরার মতো অবসর তিনি পান না।
অথচ তার সততা সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যে বিরল। এই সততার বলেই কাহিনীর নামে কেচ্ছা বয়ান করার লোভ থেকে তিনি বিরত থাকতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথম উপন্যাসে গল্প বলার যে-প্রবণতা তার মধ্যে পেয়ে বসেছিলো তা অব্যাহত থাকলে এখানে এসে পরিণতরূপ লাভ করতে পারত। এই বইতে যে-শক্তির পরিচয় পাই, তাতে নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, ঐ প্রবণতার কাছে আত্মসমর্পণ করলে মসৃণ ও গতানুগতিক কাহিনী ফেঁদে ব্যাপকসংখ্যক পাঠক এবং সমালোচকদের পৃষ্ঠপোষকতা তিনি লাভ করতেন। সহজ সাফল্যের ঐ নিরাপদ ও সুনিশ্চিত পথ পরিহার করতে পারাটাই তাঁর সততা ও শক্তির প্রকাশ। অনেক দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও কায়েস আহমদ নায়কবর্জিত, ছিমছাম গপ্পোমুক্ত একটি ভাষাচলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সততা ও শক্তির অধিকারী বলেই জীবনের জয়গান করার জন্যে ইচ্ছাপূরণের নাবালক বাণী ছাড়ার পথ তিনি অনায়াসে পরিহার করতে পেরেছেন। আবার এরই মধ্যে দেখি, নড়বড়ে বাড়িটির আসন্ন মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়েছে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের সাহায্যে।
কায়েস আহমেদের সর্বশেষ বই লাশকাটা ঘর একটি গল্পগ্রন্থ। এই বইতেই তার শক্তির সবচেয়ে পরিণত প্রকাশ ঘটেছে। মানুষের নানারকম বেদনা ও ফাপড়কে তিনি দেখতে পান সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের অজস্র বিস্ফোরণ বলে। এখানে মানুষের কেবলই মার খাওয়ার অসহায় বেদনা নেই, রোগের চিকিৎসা করতে সংকল্পবদ্ধ মানুষকেও এখানে পাওয়া যায়। এমন সব হতাশ যুবকদের দেখি যাদের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও মানুষের স্বাধীনতা সমার্থক নয়। সামাজিক মূল্যবোধের নামে প্রচলিত সংস্কারকে ঝেড়ে ফেলে মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে হাতিয়ার তুলে নেয় নতুন যুবক। আবার এর ভেতরেই বেজে চলে তার নস্টালজিয়া, তবে নিজের স্মৃতিকে কেবল একটি ব্যক্তির কষ্টের মধ্যে না দেখে তিনি তা স্থাপন করেন মানুষের বেদনার পটভূমিতে। তার উপন্যাসের কোনো কোনো চরিত্র এখানে ফের হাজির হয়, তবে তাতে আমাদের একঘেয়ে লাগে না, বরং চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার উত্তাপ বোধ করি এবং ঐসব মানুষের গভীর ভেতর জগৎ আমাদের চোখে উন্মোচিত হয়। | ছোটোগল্পের প্রচলিত ও ধরাবাধা ছক তাঁর অনুসন্ধান প্রকাশের জন্যে যথেষ্ট বিবেচিত হয় না, প্রকরণ ভেঙে তিনি বেরিয়ে পড়েন নতুন ও অনিশ্চিত পথের দিকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটেমাটি খুঁজতে যাওয়ার একটি অভিযানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে একটি গল্পে, প্রথমে এটিকে একটি সাদামাটা প্রতিবেদন বলে ভুল হতে পারে । কিন্তু পড়তে পড়তেই কয়েকজন লোককে পেয়ে যাই যারা কেবল ঐ গ্রামের মানুষ নয়, নিরাপত্তার অভাব, গ্লানি ও অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা দাবি করে গল্পের চরিত্রের মর্যাদা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বপুরুষের ভিটে খোঁজ করতে গিয়ে লেখক এদের দেখেন এবং এদের আসন্ন-গৃহত্যাগের সম্ভাবনায় দেখতে পারেন নিজের ভিটেমাটি ত্যাগ করে আসার অভিজ্ঞতা। কিন্তু নিজে তিনি আড়ালেই রয়ে যান। এমনকি যেসব চরিত্র সৃষ্টি করেন তারাও কেবল কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকে না। দেশের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি—সবকিছুর বিশ্লেষণ ধরা পড়ে তাদের তৎপরতা ও এমনকি কেবল নীরব অবস্থানের ভেতরেও। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কায়েসকে মুগ্ধ করেছেন বললে মোটেই ঠিক বলা হয় না, বরং তার অস্থিরতা এই শিল্পীর কল্যাণে রূপ পায় বাঁচার প্রেরণায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি পাঠ করেছিলেন সৃজনশীল পাঠকের উত্তেজনা ও উদ্বেগ নিয়ে। কেবল নিজে পড়ে ক্ষান্ত হননি, কোন লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কীভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাও দেখতে চেয়েছিলেন বলে তাঁর প্রিয় লেখকের ওপর একটি রচনা সংকলন সম্পাদনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, চিঠির পর চিঠি ও তাগাদার পর তাগাদা দিয়ে তাদের অনেকের লেখা জোগাড় করেন এবং নিজেও একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় লেখার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই কাজটি শেষ করার আগেই তিনি নিজেই শেষ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
রথীন্দ্র ঘটক চৌধুরীকে নিয়ে লেখা তার বইটিকে কেবল একটি গবেষণা বই বললে সত্যের ধারেকাছেও যাওয়া যায় না। এই বইয়ের সব তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে, এজন্যে বিপুল পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু এই বস্তুনিষ্ঠ কাজের মধ্যে প্রবাহিত রয়েছে তার মানুষকে পর্যবেক্ষণ করার গভীর প্রবণতা। রথীন্দ্র ঘটক খুব পরিচিত লেখক নন বলেই কায়েস তাঁর গভীর সংবেদনশীল ব্যক্তিত্বকে উপস্থিত করার কঠিন দায়িত্বটি গ্রহণ করেন।
গল্প-উপন্যাস লেখা, প্রিয় লেখকের ওপর প্রবন্ধের সংকলন সম্পাদনা, অপরিচিত লেখকের ভেতর সংবেদনশীল ব্যক্তিত্বের উন্মোচন, অনিয়মিত হলেও সাময়িকীতে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা, সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকা——সবই তাঁর সৃজনশীল অনুসন্ধানের অবিচ্ছিন্ন অংশ।
এই শিল্পীর আত্মহত্যা কি কেবল আকস্মিকভাবে নিজেকে প্রত্যাহত করার স্পৃহার ফল? তার প্রিয় কবির সেই বহুপঠিত কবিতার লোকটি আর তিনি কি এক ব্যক্তি? মেনে নেওয়া মুশকিল।
কাল রাতে—ফাগুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ;
জীবনানন্দ দাশ আট বছর আগের একদিন
কিন্তু ফাগুনের তখনো ঢের বাকি। বসন্তকালের রাত্রির অন্ধকার নয়; তখন ঘােরল বিকাল, জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিন সেদিন যতক্ষণ পারে আকাশ জুড়ে চড়া রোদ ঝেড়েছে। ঈদের একদিন পর পবিত্র কোরবানির গোরুখাসির রক্ত দীননাথ সেন রোডের এখানে ওখানে শুখিয়ে কালচে হয়ে এসেছে, নিহত জীবজন্তুর নাড়িভুড়ি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা সতীশ সরকার রোড় জুড়ে, তার গন্ধে দম-বন্ধ-করা গরম বাতাস। এরই মধ্যে তিনতলা বাড়ির ছাদে চিলেকোঠার ফ্ল্যাটে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়েন কায়েস আহমেদ। একটু-আগে-ডুবে-যাওয়া পঞ্চমীর চাঁদের স্মৃতিতে কোমল ও স্নিগ্ধ অন্ধকারে শেষনিশ্বাসটা টেনে নেওয়ার সুযোগ কায়েস আহমেদ নেননি। কোমল ও মিষ্টি, নিরাপদ ও অনায়াস, সরল ও স্নিগ্ধ কোনো ব্যাপারে কায়েস আহমেদ স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না। নিজের তৈরি প্রকরণটিতে অভ্যস্ত হতে-না-হতে তিনি অন্য পথের সন্ধান করতেন। কায়েস আহমেদ সব সময়েই ছিলেন নতুন লেখক। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন নতুন লেখকের প্রেরণা ও কষ্ট এবং নতুন লেখকের উদ্বেগ ও অতৃপ্তি নিয়ে। মানুষের গভীর ভেতরটাকে খুঁজে দেখার জন্যেই একটির পর একটি রাস্তায় তাঁর ক্লান্তিহীন পদসঞ্চার। তাঁর পায়ের নিচে বিরতিহীন ভূমিকম্প, তাই তাঁর এই অবিরত ছুটে চলা। এইসব রাস্তাই তার পছন্দের। ধীর ও শান্ত, সন্তুষ্ট ও নিস্তরঙ্গ সমতল তাকে কখনোই কাছে টানতে পারে না।
ব্যক্তিগত জীবনেও কোনো ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকা তার ধাতে ছিলো না । প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ব্যাপারে জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্মান শ্রেণীতে ঢুকেছিলেন ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে। প্রথম বর্ষের পরীক্ষাগুলোতে খুব ভালো ফল করার আভাস দেখালেও, কিংবা হয়তো এই কারণেই, দ্বিতীয় বর্ষে উঠেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবাংলার হুগলি জেলার বড়তাজপুর গ্রামে, ঐ গ্রামের বিখ্যাত শেখ পরিবারের ছেলে। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত, তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতেন না।
তিনি উপার্জন করতে নামেন এসএসসি পাশ করার পরই, অল্প কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছিলেন, এরপর কেবল শিক্ষকতাই করেছেন। ঢাকার একটি প্রথম শ্রেণীর স্কুল তাকে যেচে চাকরি দেয়, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেখানেই কাজ করে গেছেন। ডিগ্রি ছিলো না বলে সেখানেও যে-কোনো মুহূর্তে কর্মচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। বন্ধুদের অনেক অনুরোধেও ডিগ্রি পরীক্ষা দিতে বসেননি। মনে হয়, অনিশ্চিত অবস্থা তিনি ভালোবাসতেন।
১৯৬৯ সালে কায়েসের পিতা শেখ কামালউদ্দিন আহমদের মৃত্যু হয় তাদের গ্রামে। ঐ সময় গ্রামে যাবার জন্যে কায়েস একবার চেষ্টা করেছিলেন, পাসপোর্ট করতে গিয়ে দেখা গেলো যে, তিনি যে পাকিস্তানি নাগরিক তার কোনো প্রমাণ নেই ! ঝামেলা বাড়লো। গণ-আন্দোলনের ধাক্কা সামলাতে পুলিশ ব্যতিব্যস্ত ছিলো বলে কায়েসকে বিপদে ফেলার সময় পায়নি।
১৯৭১ সালে কায়েস আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে যান। এ-বছর অনেকটা সময় কাটিয়েছেন নিজের গ্রামে মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে। মায়ের ভালোবাসায় বেশিদিন থাকা বোধহয় তার স্বভাবে কুলায়নি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ঢাকায় ফিরে এলেন, নিজের গ্রামে আর কোনোদিন ফিরে যাননি। বড়তাজপুর গ্রামে তাদের পুরনো নোনা-ধরা বাড়ির সামনে শেফালি গাছের নিচে মোড়ায় বসে ছেলের জন্যে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়ের চোখে ছানি পড়ে গেলো—এই ছবিটা ভেবে কায়েস অস্থির হয়ে পড়তেন। কিন্তু মায়ের আঁচলের নিচে কটা দিন থেকে দুই চোখ ভরে ঘুমিয়ে আসার ইচ্ছা করা তার স্বভাবের বাইরে। ভালোবেসে বিয়ে করলেন। আত্মবিশ্বাস ছিলো প্রবল, দৃঢ় ধারণা ছিলো যে প্রেম দিয়ে, যত্ন দিয়ে সেবা দিয়ে স্ত্রীর মানসিক রোগ সারিয়ে তুলতে পারবেন। প্রায় দশটি বছর একনিষ্ঠভাবে স্ত্রীর সেবা করে গেছেন, যত্ন করলেন তাঁকে মায়ের মতো, বাপের মতো চোখে-চোখে রাখলেন। কতরকম চিকিৎসা করলেন। কারো কাছে কোনো সাহায্য চাননি, কাউকে জানতেও দিতে চাননি নিজের সমস্যার কথা।
নিজের পর্যবেক্ষণ, ধারণা, আদর্শ, বিশ্বাস—এসবের কোনো সাহিত্যিক কি অসাহিত্যিক আলাদা চেহারা ছিলো না তার কাছে। কি লেখা, কি পেশা, কি গৃহ সব জায়গায় তিনি ছিলেন একজন অভিন্ন মানুষ। সাহিত্যচর্চা করে সামাজিক সুবিধা আদায়ের বিন্দুমাত্র চেষ্টাও কোনোদিন করেননি। এককালে সাংবাদিকতা করেছিলেন, সেই সময়ের যোগাযোগ ব্যক্তিগত কাজে লাগানো তার রুচির বাইরে। তার মাপের লেখক বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাননি, আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে এই গ্লানি বহন করতে হবে সারাজীবন ধরে। আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন কেবল বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার। এই পুরস্কারের অর্থমূল্য সামান্য, লেখক শিবিরের সঙ্গে তিনি জড়িতও ছিলেন না কোনোদিন। কিন্তু সংগঠনটির প্রাতিষ্ঠানিকতা-বিরোধিতায় তার নিরঙ্কুশ আস্থা ছিলো বলেই পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। আবার প্রকাশকের তাগাদা সত্ত্বেও বিপুল অর্থমূল্যের পুরস্কারের জন্য বই জমা দিতে অস্বীকার করেছেন, কারণ পুরস্কার প্রদানকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃতি ও তাঁর স্বভাব সম্পূর্ণভাবে পরস্পরবিরোধী। দারিদ্র্যপীড়িত লেখকের এই প্রত্যাখ্যান আমরা যেন ভুলে না যাই।
তিনি প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ফেলেছেন নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে। ১৯৯২ সালের ১৪ জুন যে শেষ কাজটি করলেন তাও সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে। কারো কাছে অভিযোগ করেননি, কারো করুণা প্রার্থনা করেননি। মানুষকে জানবার জন্যে, মানুষকে অনুসন্ধান করার জন্যে, নিজেকে নিয়ে হলেও নিরীক্ষা করতে তাঁকে অনেক চড়া দাম দিতে হয়েছে। দারিদ্র্য, পারিবারিক দুর্যোগ, বিচ্ছিন্নতা, বিরামহীন উদ্বেগ—সবই বহন করতে হয়েছে একা। অনুসন্ধান হলো একই সঙ্গে তার প্রবণতা এবং দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ফল যা পেয়েছেন তা তার জন্যে সুখের নয়, যা দেখেছেন তার অনেকটাই, বলতে গেলে বেশির ভাগই অনুমোদন করতে পারেননি। অনুসন্ধান তাই তার প্রতিবাদও বটে। প্রতিবাদ তো আর ইচ্ছাপূরণের আবদার নয়, মস্ত মস্ত কাঠের পুতুল বানিয়ে তার মাথায় সূর্যোদয়ের ছবি লেখার নাবালক তৎপরতা নয়, সমাজ ও মানুষের জটিলতা, এই জটিলতায় অসহায় ও ছোট-হয়ে-পড়া মানুষকে দেখা ও দেখানোই হলো তার প্রতিবাদ জ্ঞাপন। তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু কি তার অনুসন্ধান অব্যাহত রাখার আর প্রতিবাদ জানাবার চরম সংকল্পের সোচ্চার প্রকাশ?
কায়েস আহমেদ রচনাসমগ্র
ভূমিকা
ঢাকা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩
No comments:
Post a Comment