গল্প হলেও বিস্মৃত এক ভয়াবহ সত্য
ফ্র্যাঙ্ক রিচ
নিউ ইয়র্ক টাইমস। ১৪ জুলাই, ২০১৯
In ‘The Nickel Boys,’ Colson Whitehead Depicts a Real-Life House of Horrors
By Frank Rich
The New York Times | July 14, 2019
THE NICKEL BOYS
By Colson Whitehead
মূল পুস্তক সমালোচনার লিঙ্ক
যে স্কুলের বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে উপন্যাসটি রচিত সে সম্বন্ধে National Public Radio-এর প্রতিবেদনের লিঙ্ক (ইংরেজি)
Tampa Bay Times পত্রিকায় উপন্যাসের ভিত্তি Dozier School নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের লিঙ্ক (ইংরেজি)
দশকের পর দশক ধরে এই হৃদয়বিদারক বাস্তবতা প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সামনে উপস্থিত, অথচ সেটা কীভাবে যেন আমাদের সবার চেতনার আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে। অবশেষে ২০১৪ সালে আচমকা একটা পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে কোলসন হোয়াইটহেড তাঁর ভয়ার্ত মর্মভেদী নতুন উপন্যাস The Nickel Boys (পাঁচ পয়সার পোলাপান)-এর অনুপ্রেরণা পেলেন। তার বইয়ের ঋণস্বীকারে যেমনটা তিনি বলেছেন, খবরটা তিনি The Tampa Bay Times সংবাদপত্র থেকে পেয়েছিলেন। খবরে প্রকাশ, দক্ষিণ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের কিছু ছাত্রছাত্রী কিছু কালো স্কুলছাত্রের দেহাবশেষ খুঁড়ে উদ্ধার করে তাদের সনাক্ত করার চেষ্টা করছে। মৃত ছাত্ররা ম্যারিয়ানা শহরে রাজ্য সরকার-চালিত ডোজার আবাসিক বালক বিদ্যালয়ের ছাত্র । এই কিশোর ছাত্রদের ওপর অত্যাচার করে, ওদের ধর্ষণ করে, দেহ ক্ষতবিক্ষত করে, ইস্কুল চত্ত্বরে একটা গোপন গোরস্থানে পুঁতে রাখা হয়েছিল। ডোজার ইস্কুলের ১০০ বছরের বেশি দীর্ঘ ত্রাসের রাজত্ব সবেমাত্র ২০১১ সালে শেষ হয়েছে। হোয়াইটহেডের উপন্যাস যখন ছাপা হচ্ছে, তখনো নতুন নতুন কবর আবিষ্কৃত হচ্ছে। মার্চ মাসে খুঁড়ে পাওয়া নতুন প্রমাণের ফলে মনে হচ্ছে মৃতের সংখ্যা ৮০ ছুঁতে পারে। সঠিক সংখ্যাটা আমরা কোনদিন জানতে পারব না। ঠিক যেমন এই দেশের জন্মলগ্নের পর থেকে আরো কত ক্ষতবিক্ষত কালো দেহ আবর্জনার মত গুপ্ত কবরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে তারও সম্পূর্ণ হিসাব-নিকাশ কখনো করা হবে না।
The Nickel Boys উপন্যাসে এই ভয়ঙ্কর স্কুলঘরটির কাল্পনিক নাম দেওয়া হয়েছে Nickel Academy of Eleanor, Fla. এটি ফ্লোরিডার এলেনর শহরে। একটা বেনামী গোরস্থান এই স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে এখন এক গৃহনির্মাণ কোম্পানি অফিসপাড়া নির্মাণ করছে। সেই কোম্পানি ভাবল, এ আবার কী উটকো ঝামেলা রে বাবা! একই প্রতিক্রিয়া সরকারপক্ষের উকিলের। তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন একাডেমির অপরাধ তদন্তের কাজ সমাপ্ত হয়ে গেছে। উপন্যাসের পূর্বকথায় নিস্পৃহ কণ্ঠে হোয়াইটহেড লেখেন, ‘শালার পুরো জায়গাটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে, আবর্জনা পরিষ্কার করে ইতিহাস থেকে এর অস্তিত্ব মুছে ফেলা দরকার। কাজটা যে বহু আগেই করা উচিত ছিল, সে বিষয়ে সবাই একমত।’ এই তো আমেরিকার স্বভাব। দেশের ক্রীতদাসপ্রথার মূল পাপটা (সাধারণত) স্বীকার করে, তার সূচনার পর থেকে কালো আমেরিকানদের বিরুদ্ধে লাগাতার অপরাধ (মাঝে মাঝে) স্বীকার করৈ, ইতিহাসের ক্ষণে ক্ষণে আশার দিকচিহ্ন (শীর্ষ আদালতের রায়, নাগরিক অধিকারের আইন, ‘বর্ণবাদ-উত্তর’ প্রেসিডেন্ট) নিয়ে আত্মপ্রসাদ পাও, তারপর সামনে এগিয়া চলো, যতক্ষণ না আরেকটা রর্ণবাদী বিস্ফোরণ ঘটে। তখন আবার নতুন একটা ‘বর্ণবাদ নিয়ে মতবিনিময়’-এর ডাক দাও। হোয়াইটহেডের মতো একজন আফ্রিকান আমেরিকান লেখকও যদি ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত ডোজার স্কুলের কথা না শুনে থাকেন, ভেবে দেখুন এমন কতো ভয়ঙ্কর কাহিনি আজও প্রকাশের অপেক্ষায় লুকিয়ে রয়েছে। কখনো আক্ষরিক অর্থেই লুকানোর ব্যাপারটা ঘটে, হয়তো বা কোন এলাকার সাম্প্রতিক আর্থ-সামাজিক বিত্তায়ন (gentrification)-এর নীচে অপ্রিয় সত্য চাপা পড়ে যায় (যেমন ১৯২১ সালের টালসা শহরে শত শত কালোদের হত্যাকাণ্ডের পর গণকবর দেওয়া)। কখনো অপ্রিয় সত্যকে অস্বীকারের প্রবণতার ফলে জাতীয় চেতনায় সেই মর্মান্তিক বাস্তবতা চাপা পড়ে যায়। নিকেল ‘তো শুধু একটিমাত্র স্থান,’ বইটি বেশ অনেকখানি পড়ার পর হোয়াইটহেড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন। ‘কিন্তু যেখানে এমন একটি স্থান আছে, সেখানে শ’য়ে শ’য়ে এমন স্থান আছে। এগুলো সারা দেশে বেদনার কারখানার মতো ছড়িয়ে রয়েছে।’ নিকেল-এর মতো এদের কাহিনিও প্রকাশিত হবে, যদি ‘কেউ শুনতে চায়।’
আমেরিকার ইতিহাসে বর্ণবাদী সন্ত্রাসের একটি ধামাচাপা দেওয়া অধ্যায়ের ওপর নির্মম আলো ফেলাই যদি হোয়াইটহেডের উপন্যাসের একমাত্র লক্ষ্য হতো, সেটাই একটা বড় অর্জন হতো। এই নতুন উপন্যাস এবং তার আগের উপন্যাস The Underground Railroad (ভুগর্ভস্থ রেলপথ) – এই দুটি রচনায় তিনি বাড়তি যা করেছেন, সেটা তার চাইতেও বেশী দুরুহ। আমেরিকার নিজের ইতিহাস সম্বন্ধে কল্পনাবিলাস যেখানে বর্ণবাদের মুখোমুখি হয়, সেই বিষয়টির উপলব্ধি সেই ১৯৯৮-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস The Intuitionist থেকে তার লেখকচিত্তকে জারিত করে আসছে। এরপর উপন্যাসের নানান বিচিত্র প্রকরণে তার বিহার ঘটেছে (বড় হয়ে ওঠার স্বপ্নময় উপন্যাস Sag Harbor থেকে zombie বা পিশাচ নিয়ে উপন্যাস Zone One)। এবার পরপর দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখলেন। আমেরিকার প্রবণতা তার মূল পাপের কথাটা নামমাত্র স্বীকার করা অথচ দেশটা তার ভয়াবহতা, তার অবিরত অনাচারের অপরিমোচনীয় ইতিহাসের মুখোমুখি হতে ব্যর্থ হয়েছে। মহাকাব্যের গভীর ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত এই দুটি উপন্যাস সেই ভয়াল ইতিহাসের ইতিবৃত্ত।
বইটি মনে হয় লেখকের একটা মহান ব্রতের ফসল, এবং অপরিহার্য সেই ব্রত। আমাদের দেশের আম জনতার সংস্কৃতিতে অন্য শিরোনামে ক্রীতদাসপ্রথা এবং তার পরিণতি নিয়ে কথাসাহিত্য, প্রামাণ্য রচনা, কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্রের তো অভাব নেই (সে গত শতাব্দীর দক্ষিণ অঞ্চলের ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী Jim Crow আইনই হোক, বা গণহারে কালো মানুষের কারাবরণ হোক বা সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র ‘I can’t breathe’ [শ্বাস নিতে পারছি না] হোক)। হোয়াইটহেড আমাদের দিকে একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন: এত কাজ হচ্ছে, কিন্তু তার প্রভাব এত সামান্য কেন? যাও বা প্রভাব, তার স্থায়িত্বই বা এত ক্ষণস্থায়ী কেন? তাঁর গল্পবলার দুর্দান্ত ক্ষমতা দিয়ে তিনি শুধু যে একটি ক্ষতবিক্ষত অতীত পুনুরুদ্ধার করেছেন তাই নয়, সেই সাথে তিনি যেই গল্পগুলো বলতে চাইছেন সেগুলো আমেরিকানরা কীভাবে খর্ব করে, বিকৃত করে, গোপন করে বা ‘পরিষ্কারভাবে মুছে’ দেয় সেই প্রক্রিয়াটি তিনি গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখেছেন। যেমন, Underground Railroad উপন্যাসে প্রাকৃতিক বিস্ময়ের জাদুঘরের একটা পরাবাস্তব মেজাজ আছে। অল্পবয়সী পলাতক ক্রীতদাসী কোরা বহু অত্যাচার সহ্য করেছে। সে এই জাদুঘরে কাঁচের বদ্ধ ঘরে ‘ক্রীতদাসের জাহাজে জীবনচিত্র’ বা ক্রীতদাসের শ্রমনির্ভর বিশাল খামারে ‘একটা প্রাত্যহিক দিনের চিত্র’ এই সব আয়োজনে সাদা দর্শকদের সামনে অভিনয়ের কাজ পেয়েছে। এ যেন মুক্তির ক্ষণস্থায়ী ভাণ। হোয়াইটহেড লেখেন: ‘সত্য যেন দোকানের জানালায় সাজানো এক নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রদর্শনী। আপনার নজরের আড়ালে অদৃশ্য হাত তার অদলবদল করছে। সত্য – সে বড়ো মোহময়, আর চিরকালই নাগালের বাইরে।’ এই লেখকের শক্তিশালী রায় - যারা ইতিহাসের বিস্মরণকে সম্ভব করে তুলে, তারা মানবতার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ মুছে ফেলায় সহায়তা করে, তারা নিজেরাও সেই সমস্ত পাপের অংশীদার।
মাত্র ২০০ পাতার বই। The Nickel Boys লেখকের পূর্ববর্তী বইয়ের চাইতেও সুতনুকা, কিন্তু তাই বলে বইটির নৈতিক কষাঘাত বিন্দুমাত্র কম শক্তিশালী নয়। The Underground Railway-এর পর ইতিহাস যদিবা অপরিবর্তিত রয়েছে, সময় আরো এক শতাব্দী এগিয়েছে। বইটির সময়কাল ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিক। মূল চরিত্র এক কিশোর, তার নাম এলউড কার্টিস। আগের উপন্যাসের কোরার মতো তাকেও মা খুব বিরূপ পরিস্থিতিতে ত্যাগ করেছে। মা তাকে তার নানী হ্যারিয়েটের জিম্মায় ছেড়া চলে গেছে। হ্যারিয়েট ফ্লোরিডার ট্যালাহাসি শহরে এক হোটেলে ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ করেন । দৃঢ়চিত্ত এই মহিলা সহজে হার মানার পাত্রী নন। হ্যারিয়েট আর এলউডের পারিবারিক ইতিহাসের পেছনে আরো বৃহত্তর ইতিহাস রয়েছে। হ্যারিয়েটের বাবা ‘কারাগারে মারা যান। শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় এক সাদা মহিলা অভিযোগ করেছিলেন তিনি ফুটপাথে সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দেননি।’ ওঁর স্বামী, এলউডের নানা, ‘বিলিয়ার্ডের টেবিলে কে আগে, এই নিয়ে একদল টালাহাসির গ্রাম্য সাদা লোকের সাথে মারপিটে’ মারা যান। তার মেয়ে জামাই - এলঊডের বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রশান্ত মহাসাগরের রণক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ‘তিনি সেনাবাহিনীকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি তাঁর ঊর্দ্ধতন ক্যাপ্টেনকে কালো সেনাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলেন, তার জন্য সেনাবাহিনীর থেকে প্রশংসাপত্র পেয়েছিলেন,’ হোয়াইটহেড জানাচ্ছেন। কিন্তু তিনি দেশে ফিরে আবিষ্কার করলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রাক্তন যোদ্ধাদের সাহায্যার্থে G.I. Bill নামে যে সরকারী আইন হয়, কঠোর বর্ণবাদী বাস্তবতার সাথে সেটা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারেনা। ‘যেখানে সাদারা ব্যাঙ্কের ভেতর কালোদের ঢুকতেই দেয় না, সেখানে বিনাসুদের ঋণ থাকলেই বা কী লাভ?’ তার ওপর যেই শহরে থাকেন, সেখানে ‘সাদা ছেলেদের’ ‘জনসমক্ষে উর্দিপরা কালো মানুষদের খুন করার’ প্রবণতা রয়েছে। ক্রুদ্ধ ও তিতিবিরক্ত হয়ে একদিন মাঝরাতে সেই যে এলউডের মাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন – ছেলের বয়স তখন ছয় বছর – তারপর ‘একটি পোস্টকার্ডও পাঠায়নি।’
যে ছেলেটি তারা ফেলে যায়, তার সাথে যখন আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে সে তখন ইস্কুলে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সে পড়ে ট্যালাহাসির একটা বর্ণবিভাজিত কালোদের স্কুলে। স্কুলটার কার্যক্রম দেখে কে বলবে ততদিনে সুপ্রিম কোর্ট Brown v Board of Education মামলার (ব্রাউন বনাম শিক্ষা বোর্ড) রায়ে বর্ণের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা স্কুল পরিচালনা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে? এলউড নিজে অবশ্য অস্বাভাবিকরকমের ‘শক্ত সামর্থ।’ ‘বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, কালো জাতির গর্ব’ – এমনটাই সবার অভিমত। ক্রীতদাস মুক্তি দিবসে ছাত্রদের নাটকে মধ্যমণি সে। এই নাটক আগের উপন্যাসের সেই প্রাকৃতিক বিস্ময়ের জাদুঘরের কাঁচের কক্ষের প্রদর্শনীর কথা মনে করিয়ে দেয়। সে যার ভূমিকায় অভিনয় করছে সে হলো টমাস জ্যাকসন – ‘যে ট্যালাহাসির ক্রীতদাসদের সংবাদ দেয় যে তারা এখন মুক্ত।’ এলউড এখনো অলীক আশা আঁকড়ে আছে যে ‘মুক্ত বিশ্ব’ তারও নাগালের মধ্যে। সহিংস বর্ণবাদী Jim Crow আমেরিকা দাসত্বে শৃংখলিত পূর্বসুরীদের মতো এলউডকেও সাক্ষরতা থেকে বঞ্চিত করতে বদ্ধপরিকর – সাদা স্কুল থেকে যে পুরনো পাঠ্যবই আসে তাতে কারা যেন বর্ণবাদী গালমন্দপূর্ণ মন্তব্য লিখে রেখেছে। কিন্তু সে অধ্যাবসয়ী, হাল ছাড়ে না। এলউডের বাড়িতে টিভি না থাকলে কী হবে, পাড়ার যে সিগারেটের দোকানে সে স্কুলের পরে কাজ করে, সেখানে সে ‘লাইফ সাময়িকীর বিলাসী মোহজালে আবদ্ধ হয়ে যায়। সেই সাময়িকীতে সে কালোদের তখনকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের স্থিরচিত্র দেখে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।’ ১৯৬২ সালে ক্রিসমাসে পাওয়া একটি উপহার তার ভীষণ প্রিয়। সেটি তার সংগ্রহে একমাত্র রেকর্ড। রেকর্ডটির নাম ‘জায়ন হিল-এ মার্টিন লুথার কিং’। কালোদের কিংবদন্তী নেতার গীর্জায় বক্তৃতার রেকর্ড। সে কতবার যে সেই বক্তৃতা শোনে! বরাতটা তার ভালো, সে এক শিক্ষকের সুনজরে পড়ে। তিনি নিকটস্থ কারিগরী কলেজে ওপরের ক্লাসের কোর্সের প্রতি দৃষ্টি তার আকর্ষণ করেন।
কিন্তু হাই স্কুলের ১২শ শ্রেণি থেকে পাশ করে বের হবার আগেই এলউডকে নিকেল ইস্কুলে পাঠানো হয়। যেমন তার আগে ও পরে অসংখ্য কালো মানুষের ক্ষেত্রে ঘটেছে, তারও স্রেফ কালো মানুষ হয়ে গাড়িতে চড়ার জন্য কারাবাস ঘটলো। (এলউডের ক্ষেত্রে সে শুধুমাত্র যাত্রী ছিল।) নিকেল ইস্কুল আনুষ্ঠানিকভাবে কারাগার ছিলনা। ১৮৯৯ সালে ফ্লোরিডা বালক কারিগরী বিদ্যালয় নামে এটি স্থাপিত হয়। নিজেকে এটি সংস্কারমূলক বিদ্যালয় হিসেবে অভিহিত করে। বন্দীদের ‘কারাগারের সহিংস বন্দীদের থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার জন্য এদের বন্দী না বলে ছাত্র বলে ডাকা হয়।’ তাতে কী? এলউড টের পায় এখানে আসলে ‘সব সহিংস অপরাধীরা ইস্কুলের বেতনভুক কর্মচারী’। ট্রেভর নিকেল ‘সংস্কারের অঙ্গীকার’ নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্কুলের পরিচালক হন। তিনি এই চাকরি পেলেন কীভাবে? ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী সংগঠন কু ক্লাক্স ক্ল্যান-এর সভায় ‘নৈতিক উন্নতি ও কাজের মূল্য’ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে শ্রোতাদের সমীহ আদায় করে তিনি চাকরিটা হস্তগত করেন। যেই একবার কাজটা পেয়ে গেলেন, সবকিছুর ওপরে তিনি “শারীরিক সুস্থতার’ প্রতি জোর দিলেন এবং প্রায়ই ‘শারীরিক শিক্ষার উন্নতি কেমন হচ্ছে সেটা দেখার জন্য স্নানঘরের উলঙ্গ ছাত্রদের ওপর নজর রাখতেন।’
নিকেল ইস্কুলে সাদা ছেলেও ছিল। তাদের সাথেও বর্বর আচরণ করা হতো। সাদা কালো ছাত্রদের আলাদা থাকার বর্ণবাদী বন্দোবস্ত। সাদা ছেলেরা অবশ্য একটু ভাল খাবার পেত, আর তাদের শ্রম কালোদের মতো অত নির্মম ছিলনা। নিকেল ইস্কুলে সাদা-কালো সব ছেলেদের এক সাথে হবার সুযোগ ছিল একটাই – বাৎসরিক সাদা বনাম কালোর মুষ্টিযুদ্ধ। রক্তের নেশা জাগানো এই ক্রীড়া দেখার জন্য স্থানীয় জনসাধারণ লালায়িত থাকত, এবং এটাই একমাত্র সময় যখন কালো ছেলেরা ‘ন্যায্য অধিকারের সাক্ষাৎ’ পেত।। আরেকটা স্থানেও কালো আর সাদা বন্দীরা এক সমান ছিল – সেটা হলো হোয়াইট হাউস বা সাদা বাড়ি। এটি একটি পুরনো গুদাম ঘর। এখানে স্কুলের পরিচালক ‘আইনের প্রয়োগ’ করতেন। সেই জন্য ব্যবহৃত হতো তিন ফুট লম্বা চামড়ার দড়ি, নাম ‘কৃষ্ণ সুন্দরী’। এছাড়া আরো মধ্যযুগীয় সরঞ্জাম তো ছিলই। পিটুনিতে চামড়া ফেটে যেত, তার ফলে প্রাণকাঁপানো চিৎকার। বিশাল কারখানার ফ্যানের আওয়াজে সেই সপাং সপাং পিটুনি, চিৎকারের শব্দ, সব ঢাকা পড়ে যেত । সেই আওয়াজ ‘বিজ্ঞানের সকল নিয়ম ভঙ্গ করে পুরো স্কুল এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো।’ সেই পাখার বাতাস সাদা বাড়িটার দেয়ালে দেয়ালে রক্তের ছিটা ছড়্রিয়ে দিত। ‘আরো পেছনে’ আরো বীভৎস শাস্তি দেওয়া হতো। সেটা চিহ্নবিহীন কবরে পৌঁছুবার আগে সর্বশেষ গন্তব্য।
কোরার মত এলউডের গল্পও আসলে ক্রীতদাসের কাহিনি। Underground Railway উপন্যাসের মতো এখানেও হোয়াইটহেডের গোঁ - তিনি সহিংসতার ভয়ঙ্কর চিত্রতে কোনরকম কাট-ছাঁট করবেন না। এবং গল্পের চরিত্র বা পাঠক, কাউকেই পালাবার পথ দিতে রাজি নন তিনি। আগের উপন্যাসে যেমন কোরার বিরতিহীন অত্যাচারে সাদা সমর্থকরা সাময়িক আশ্রয়ের বেশি দিতে অক্ষম ছিলেন, এখানেও ফ্লোরিডার পাড়াগাঁয়ে কোন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ঘটেনা (যেমনটা ঘটেছিল বর্ণবাদ নিয়ে রচিত আরেকটি কালজয়ী উপন্যাস To Kill a Mockingbird-এ। সেখানে ধর্ষণের মিথ্যা বর্ণবাদী অভিযোগের শিকার একজন কালো মানুষের সমর্থনে এক সাদা উকিল এগিয়ে আসে।) আগের উপন্যাসের মতো এখানেও কিম্ভুত সব প্রতিবন্ধকতার দুর্ভেদ্য জাল ভেদ করে, শিকারী কুকুর সদৃশ হিংস্র মানুষ (কখনো বা সত্যিকারের কুকুর)-এর তাড়া থেকে পালিয়ে গল্পের চরিত্ররা মুক্তি নামের মরীচিকার পেছনে ছোটে। আবারও হোয়াইটহেড গল্পে বিশাল সময়ের ব্যবধানের মধ্যে যাওয়া-আসা করেন। কখনো এক দৃশ্যে হয়তো তুলনামূলকভাবে একটুখানি আশা, একটু নিরাপদ আশ্রয়ের দেখা মিলল, পরমুহূর্তেই লেখক সেই অলীক কল্পনাকে কালের এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ভেঙে চুরমার করে দিলেন। এইসব গল্পে সমাপ্তি দূরে থাক, মধুরেণ সমাপয়েত তো আরো দুরস্ত, আদৌ কোন আশ্রয় যে মিলতে পারে লেখক এমন সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন। The Nickel Boys উপন্যাসে সময়ের এই বিচিত্র লুকোচুরি কাহিনির শরীরের সাথে এত অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গেছে যে পড়া শেষ করার আগ পর্যন্ত টেরই পাবেন না যে কাহিনির সময়ের ব্যাপ্তি এই শতাব্দী এবং গত শতাব্দীর অনেকটা জুড়ে রয়েছে। আমেরিকায় ক্রীতদাসপ্রথার আমলে যেসব ক্রীতদাস পালিয়ে ‘মুক্ত’ অঙ্গরাজ্যে বা কানাডায় যাবার চেষ্টা করত, সেইসব গোপন রাস্তা এবং পথে থাকবার নিরাপদ আশ্রয়, সব মিলিয়ে পুরো ব্যবস্থাটাকে Underground Railroad বলা হয়। কিন্তু হোয়াইটহেডের ঐ নামের উপন্যাসে কিন্তু সত্যি সত্যি একটা ভূগর্ভস্থ রেলপথ রয়েছে। ঐ উপন্যাসের জাদুবাস্তবতা নতুন উপন্যাসে পুরোপুরি আমদানি না করলেও, লেখক একটা জাদুকরি চমকের মাধ্যমে এলউডের লুকানো গল্প পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ফলে একই সাথে একটা বিস্ময় ও একটি বেদনাবিধুর কাহিনি সৃষ্ট হয়েছে।
মার্টিন লুথার কিং-এর বাণী এলউডের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত, অথচ সেটা Jim Crow- এর বর্বর বর্ণবাদী বাস্তবতার প্রেক্ষিতে হোয়াইটহেড সেটা মেনে নিতে হিমসিম খান। মধ্যরাতের পর সাদা মুখোশ পরা হিংস্র সন্ত্রাসীদের আমাদের পাড়াগুলোতে পাঠাও, আমাদের কোন পাড়ার গলিতে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাও, তারপর আমাদের মারতে মারতে আধমরা করে ফেলে রেখে যাও, তবুও আমরা তোমাদের ভালোবাসব? যারা আপনার মনোবল ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর তাঁদের বেলায় ‘প্রতিটি হৃদয়ে শুভবুদ্ধি নিহিত সেটা বিশ্বাস’ করা কীভাবে সম্ভব? ‘হিংসায় হিংসা দূর হয়না, শুধু ভালোবাসা দিয়েই সেটা সম্ভব’ কী করে সত্য হতে পারে? ‘কী কথা!’ এলউড ভাবে। ‘যতসব অসম্ভব ভাবনা!’
এই জটিল সমস্যার হৃদয়বিদারক প্রত্যুত্তর দেয় The Nickel Boys। এই দুই বইয়ে হোয়াইটহেড ইতিহাসের যেই সঞ্চারপথ তুলে ধরেন – ১৮২০ থেকে ২০১৪ – সেটা শেষ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যায়। যেই জায়গা থেকে দক্ষিণ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের ছাত্রছাত্রীরা ডোজার ইস্কুলের বিস্মৃত মৃতদেহ উদ্ধার করছে, তার থেকে মাত্র ৬০ মাইল দূরে একটা কণ্ঠস্বরের চিৎকার শোনা গেল: ‘ওদের গুলি করো!’ এইবার প্রসঙ্গ অন্য আরেকটা ঘৃণিত জনগোষ্ঠী – এইক্ষেত্রে মেক্সিকো সীমান্তের অভিবাসী শ্রমিক। মে মাসের হট্টগোলপূর্ণ এক জনসভায় ঘটনাটি ঘটে। ‘শুধু এইরকম জায়গাতেই এমন কথা বলে পার পাওয়া যায়,’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বললেন। জনসমাবেশে মুগ্ধ সাদা মানুষ মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি ও অট্টহাসি দিয়ে প্রেসিডেন্টের উক্তিকে স্বাগত জানায়। বাস্তবতা হলো ওদের ‘গুলি করে পার পাওয়া যায়।’ এ শুধু কথার কথা নয়। আমেরিকার অন্যখানেও এরকম জায়গা আছে। উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন অতীত ‘এখনো অতীতই হয়নি।’ এ যেন আমাদের চিরন্তন মন্ত্র। কিন্তু আজকের দিনে সেই কথাটাও যথেষ্ট মনে হয় না।আমরা আমাদের অতীতের নাগাল পেতে পারি বলে আমাদের যে নিশ্চিন্ত প্রতীতি, হোয়াইটহেড তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। এমন লেখক আজকের দিনে অত্যাবশ্যক।
ফ্র্যাঙ্ক রিচ
নিউ ইয়র্ক টাইমস। ১৪ জুলাই, ২০১৯
In ‘The Nickel Boys,’ Colson Whitehead Depicts a Real-Life House of Horrors
By Frank Rich
The New York Times | July 14, 2019
আমেরিকার পুলিৎজার পুরস্কার এদেশে বিশাল ব্যাপার। কালো আমেরিকান লেখক কোলসন হোয়াইটহেড-এর ‘The Nickel Boys’ উপন্যাসটি ক’দিন আগেই এবছর কথাসাহিত্যে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করে। এই নিয়ে কথাসাহিত্যে দুই-দুইবার এই পুরষ্কার পেয়ে লেখক আমেরিকার সুধীমহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
এদেশে কালো আমেরিকানদের ওপর অত্যাচারের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমন ভয়াবহ। হোয়াইটহেডের উপন্যাস গল্প, কিন্তু তার ভিত্তি ভয়ঙ্কর বাস্তব একটি ঘটনা। গত বছর নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ উপন্যাসটির পুস্তক সমালোচনা বেরোয়।
THE NICKEL BOYS
By Colson Whitehead
মূল পুস্তক সমালোচনার লিঙ্ক
যে স্কুলের বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে উপন্যাসটি রচিত সে সম্বন্ধে National Public Radio-এর প্রতিবেদনের লিঙ্ক (ইংরেজি)
Tampa Bay Times পত্রিকায় উপন্যাসের ভিত্তি Dozier School নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের লিঙ্ক (ইংরেজি)
দশকের পর দশক ধরে এই হৃদয়বিদারক বাস্তবতা প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সামনে উপস্থিত, অথচ সেটা কীভাবে যেন আমাদের সবার চেতনার আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে। অবশেষে ২০১৪ সালে আচমকা একটা পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে কোলসন হোয়াইটহেড তাঁর ভয়ার্ত মর্মভেদী নতুন উপন্যাস The Nickel Boys (পাঁচ পয়সার পোলাপান)-এর অনুপ্রেরণা পেলেন। তার বইয়ের ঋণস্বীকারে যেমনটা তিনি বলেছেন, খবরটা তিনি The Tampa Bay Times সংবাদপত্র থেকে পেয়েছিলেন। খবরে প্রকাশ, দক্ষিণ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের কিছু ছাত্রছাত্রী কিছু কালো স্কুলছাত্রের দেহাবশেষ খুঁড়ে উদ্ধার করে তাদের সনাক্ত করার চেষ্টা করছে। মৃত ছাত্ররা ম্যারিয়ানা শহরে রাজ্য সরকার-চালিত ডোজার আবাসিক বালক বিদ্যালয়ের ছাত্র । এই কিশোর ছাত্রদের ওপর অত্যাচার করে, ওদের ধর্ষণ করে, দেহ ক্ষতবিক্ষত করে, ইস্কুল চত্ত্বরে একটা গোপন গোরস্থানে পুঁতে রাখা হয়েছিল। ডোজার ইস্কুলের ১০০ বছরের বেশি দীর্ঘ ত্রাসের রাজত্ব সবেমাত্র ২০১১ সালে শেষ হয়েছে। হোয়াইটহেডের উপন্যাস যখন ছাপা হচ্ছে, তখনো নতুন নতুন কবর আবিষ্কৃত হচ্ছে। মার্চ মাসে খুঁড়ে পাওয়া নতুন প্রমাণের ফলে মনে হচ্ছে মৃতের সংখ্যা ৮০ ছুঁতে পারে। সঠিক সংখ্যাটা আমরা কোনদিন জানতে পারব না। ঠিক যেমন এই দেশের জন্মলগ্নের পর থেকে আরো কত ক্ষতবিক্ষত কালো দেহ আবর্জনার মত গুপ্ত কবরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে তারও সম্পূর্ণ হিসাব-নিকাশ কখনো করা হবে না।
The Nickel Boys উপন্যাসে এই ভয়ঙ্কর স্কুলঘরটির কাল্পনিক নাম দেওয়া হয়েছে Nickel Academy of Eleanor, Fla. এটি ফ্লোরিডার এলেনর শহরে। একটা বেনামী গোরস্থান এই স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে এখন এক গৃহনির্মাণ কোম্পানি অফিসপাড়া নির্মাণ করছে। সেই কোম্পানি ভাবল, এ আবার কী উটকো ঝামেলা রে বাবা! একই প্রতিক্রিয়া সরকারপক্ষের উকিলের। তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন একাডেমির অপরাধ তদন্তের কাজ সমাপ্ত হয়ে গেছে। উপন্যাসের পূর্বকথায় নিস্পৃহ কণ্ঠে হোয়াইটহেড লেখেন, ‘শালার পুরো জায়গাটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে, আবর্জনা পরিষ্কার করে ইতিহাস থেকে এর অস্তিত্ব মুছে ফেলা দরকার। কাজটা যে বহু আগেই করা উচিত ছিল, সে বিষয়ে সবাই একমত।’ এই তো আমেরিকার স্বভাব। দেশের ক্রীতদাসপ্রথার মূল পাপটা (সাধারণত) স্বীকার করে, তার সূচনার পর থেকে কালো আমেরিকানদের বিরুদ্ধে লাগাতার অপরাধ (মাঝে মাঝে) স্বীকার করৈ, ইতিহাসের ক্ষণে ক্ষণে আশার দিকচিহ্ন (শীর্ষ আদালতের রায়, নাগরিক অধিকারের আইন, ‘বর্ণবাদ-উত্তর’ প্রেসিডেন্ট) নিয়ে আত্মপ্রসাদ পাও, তারপর সামনে এগিয়া চলো, যতক্ষণ না আরেকটা রর্ণবাদী বিস্ফোরণ ঘটে। তখন আবার নতুন একটা ‘বর্ণবাদ নিয়ে মতবিনিময়’-এর ডাক দাও। হোয়াইটহেডের মতো একজন আফ্রিকান আমেরিকান লেখকও যদি ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত ডোজার স্কুলের কথা না শুনে থাকেন, ভেবে দেখুন এমন কতো ভয়ঙ্কর কাহিনি আজও প্রকাশের অপেক্ষায় লুকিয়ে রয়েছে। কখনো আক্ষরিক অর্থেই লুকানোর ব্যাপারটা ঘটে, হয়তো বা কোন এলাকার সাম্প্রতিক আর্থ-সামাজিক বিত্তায়ন (gentrification)-এর নীচে অপ্রিয় সত্য চাপা পড়ে যায় (যেমন ১৯২১ সালের টালসা শহরে শত শত কালোদের হত্যাকাণ্ডের পর গণকবর দেওয়া)। কখনো অপ্রিয় সত্যকে অস্বীকারের প্রবণতার ফলে জাতীয় চেতনায় সেই মর্মান্তিক বাস্তবতা চাপা পড়ে যায়। নিকেল ‘তো শুধু একটিমাত্র স্থান,’ বইটি বেশ অনেকখানি পড়ার পর হোয়াইটহেড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন। ‘কিন্তু যেখানে এমন একটি স্থান আছে, সেখানে শ’য়ে শ’য়ে এমন স্থান আছে। এগুলো সারা দেশে বেদনার কারখানার মতো ছড়িয়ে রয়েছে।’ নিকেল-এর মতো এদের কাহিনিও প্রকাশিত হবে, যদি ‘কেউ শুনতে চায়।’
আমেরিকার ইতিহাসে বর্ণবাদী সন্ত্রাসের একটি ধামাচাপা দেওয়া অধ্যায়ের ওপর নির্মম আলো ফেলাই যদি হোয়াইটহেডের উপন্যাসের একমাত্র লক্ষ্য হতো, সেটাই একটা বড় অর্জন হতো। এই নতুন উপন্যাস এবং তার আগের উপন্যাস The Underground Railroad (ভুগর্ভস্থ রেলপথ) – এই দুটি রচনায় তিনি বাড়তি যা করেছেন, সেটা তার চাইতেও বেশী দুরুহ। আমেরিকার নিজের ইতিহাস সম্বন্ধে কল্পনাবিলাস যেখানে বর্ণবাদের মুখোমুখি হয়, সেই বিষয়টির উপলব্ধি সেই ১৯৯৮-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস The Intuitionist থেকে তার লেখকচিত্তকে জারিত করে আসছে। এরপর উপন্যাসের নানান বিচিত্র প্রকরণে তার বিহার ঘটেছে (বড় হয়ে ওঠার স্বপ্নময় উপন্যাস Sag Harbor থেকে zombie বা পিশাচ নিয়ে উপন্যাস Zone One)। এবার পরপর দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখলেন। আমেরিকার প্রবণতা তার মূল পাপের কথাটা নামমাত্র স্বীকার করা অথচ দেশটা তার ভয়াবহতা, তার অবিরত অনাচারের অপরিমোচনীয় ইতিহাসের মুখোমুখি হতে ব্যর্থ হয়েছে। মহাকাব্যের গভীর ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত এই দুটি উপন্যাস সেই ভয়াল ইতিহাসের ইতিবৃত্ত।
বইটি মনে হয় লেখকের একটা মহান ব্রতের ফসল, এবং অপরিহার্য সেই ব্রত। আমাদের দেশের আম জনতার সংস্কৃতিতে অন্য শিরোনামে ক্রীতদাসপ্রথা এবং তার পরিণতি নিয়ে কথাসাহিত্য, প্রামাণ্য রচনা, কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্রের তো অভাব নেই (সে গত শতাব্দীর দক্ষিণ অঞ্চলের ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী Jim Crow আইনই হোক, বা গণহারে কালো মানুষের কারাবরণ হোক বা সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র ‘I can’t breathe’ [শ্বাস নিতে পারছি না] হোক)। হোয়াইটহেড আমাদের দিকে একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন: এত কাজ হচ্ছে, কিন্তু তার প্রভাব এত সামান্য কেন? যাও বা প্রভাব, তার স্থায়িত্বই বা এত ক্ষণস্থায়ী কেন? তাঁর গল্পবলার দুর্দান্ত ক্ষমতা দিয়ে তিনি শুধু যে একটি ক্ষতবিক্ষত অতীত পুনুরুদ্ধার করেছেন তাই নয়, সেই সাথে তিনি যেই গল্পগুলো বলতে চাইছেন সেগুলো আমেরিকানরা কীভাবে খর্ব করে, বিকৃত করে, গোপন করে বা ‘পরিষ্কারভাবে মুছে’ দেয় সেই প্রক্রিয়াটি তিনি গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখেছেন। যেমন, Underground Railroad উপন্যাসে প্রাকৃতিক বিস্ময়ের জাদুঘরের একটা পরাবাস্তব মেজাজ আছে। অল্পবয়সী পলাতক ক্রীতদাসী কোরা বহু অত্যাচার সহ্য করেছে। সে এই জাদুঘরে কাঁচের বদ্ধ ঘরে ‘ক্রীতদাসের জাহাজে জীবনচিত্র’ বা ক্রীতদাসের শ্রমনির্ভর বিশাল খামারে ‘একটা প্রাত্যহিক দিনের চিত্র’ এই সব আয়োজনে সাদা দর্শকদের সামনে অভিনয়ের কাজ পেয়েছে। এ যেন মুক্তির ক্ষণস্থায়ী ভাণ। হোয়াইটহেড লেখেন: ‘সত্য যেন দোকানের জানালায় সাজানো এক নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রদর্শনী। আপনার নজরের আড়ালে অদৃশ্য হাত তার অদলবদল করছে। সত্য – সে বড়ো মোহময়, আর চিরকালই নাগালের বাইরে।’ এই লেখকের শক্তিশালী রায় - যারা ইতিহাসের বিস্মরণকে সম্ভব করে তুলে, তারা মানবতার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ মুছে ফেলায় সহায়তা করে, তারা নিজেরাও সেই সমস্ত পাপের অংশীদার।
মাত্র ২০০ পাতার বই। The Nickel Boys লেখকের পূর্ববর্তী বইয়ের চাইতেও সুতনুকা, কিন্তু তাই বলে বইটির নৈতিক কষাঘাত বিন্দুমাত্র কম শক্তিশালী নয়। The Underground Railway-এর পর ইতিহাস যদিবা অপরিবর্তিত রয়েছে, সময় আরো এক শতাব্দী এগিয়েছে। বইটির সময়কাল ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিক। মূল চরিত্র এক কিশোর, তার নাম এলউড কার্টিস। আগের উপন্যাসের কোরার মতো তাকেও মা খুব বিরূপ পরিস্থিতিতে ত্যাগ করেছে। মা তাকে তার নানী হ্যারিয়েটের জিম্মায় ছেড়া চলে গেছে। হ্যারিয়েট ফ্লোরিডার ট্যালাহাসি শহরে এক হোটেলে ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ করেন । দৃঢ়চিত্ত এই মহিলা সহজে হার মানার পাত্রী নন। হ্যারিয়েট আর এলউডের পারিবারিক ইতিহাসের পেছনে আরো বৃহত্তর ইতিহাস রয়েছে। হ্যারিয়েটের বাবা ‘কারাগারে মারা যান। শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় এক সাদা মহিলা অভিযোগ করেছিলেন তিনি ফুটপাথে সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দেননি।’ ওঁর স্বামী, এলউডের নানা, ‘বিলিয়ার্ডের টেবিলে কে আগে, এই নিয়ে একদল টালাহাসির গ্রাম্য সাদা লোকের সাথে মারপিটে’ মারা যান। তার মেয়ে জামাই - এলঊডের বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রশান্ত মহাসাগরের রণক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ‘তিনি সেনাবাহিনীকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি তাঁর ঊর্দ্ধতন ক্যাপ্টেনকে কালো সেনাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলেন, তার জন্য সেনাবাহিনীর থেকে প্রশংসাপত্র পেয়েছিলেন,’ হোয়াইটহেড জানাচ্ছেন। কিন্তু তিনি দেশে ফিরে আবিষ্কার করলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রাক্তন যোদ্ধাদের সাহায্যার্থে G.I. Bill নামে যে সরকারী আইন হয়, কঠোর বর্ণবাদী বাস্তবতার সাথে সেটা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারেনা। ‘যেখানে সাদারা ব্যাঙ্কের ভেতর কালোদের ঢুকতেই দেয় না, সেখানে বিনাসুদের ঋণ থাকলেই বা কী লাভ?’ তার ওপর যেই শহরে থাকেন, সেখানে ‘সাদা ছেলেদের’ ‘জনসমক্ষে উর্দিপরা কালো মানুষদের খুন করার’ প্রবণতা রয়েছে। ক্রুদ্ধ ও তিতিবিরক্ত হয়ে একদিন মাঝরাতে সেই যে এলউডের মাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন – ছেলের বয়স তখন ছয় বছর – তারপর ‘একটি পোস্টকার্ডও পাঠায়নি।’
যে ছেলেটি তারা ফেলে যায়, তার সাথে যখন আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে সে তখন ইস্কুলে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সে পড়ে ট্যালাহাসির একটা বর্ণবিভাজিত কালোদের স্কুলে। স্কুলটার কার্যক্রম দেখে কে বলবে ততদিনে সুপ্রিম কোর্ট Brown v Board of Education মামলার (ব্রাউন বনাম শিক্ষা বোর্ড) রায়ে বর্ণের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা স্কুল পরিচালনা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে? এলউড নিজে অবশ্য অস্বাভাবিকরকমের ‘শক্ত সামর্থ।’ ‘বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, কালো জাতির গর্ব’ – এমনটাই সবার অভিমত। ক্রীতদাস মুক্তি দিবসে ছাত্রদের নাটকে মধ্যমণি সে। এই নাটক আগের উপন্যাসের সেই প্রাকৃতিক বিস্ময়ের জাদুঘরের কাঁচের কক্ষের প্রদর্শনীর কথা মনে করিয়ে দেয়। সে যার ভূমিকায় অভিনয় করছে সে হলো টমাস জ্যাকসন – ‘যে ট্যালাহাসির ক্রীতদাসদের সংবাদ দেয় যে তারা এখন মুক্ত।’ এলউড এখনো অলীক আশা আঁকড়ে আছে যে ‘মুক্ত বিশ্ব’ তারও নাগালের মধ্যে। সহিংস বর্ণবাদী Jim Crow আমেরিকা দাসত্বে শৃংখলিত পূর্বসুরীদের মতো এলউডকেও সাক্ষরতা থেকে বঞ্চিত করতে বদ্ধপরিকর – সাদা স্কুল থেকে যে পুরনো পাঠ্যবই আসে তাতে কারা যেন বর্ণবাদী গালমন্দপূর্ণ মন্তব্য লিখে রেখেছে। কিন্তু সে অধ্যাবসয়ী, হাল ছাড়ে না। এলউডের বাড়িতে টিভি না থাকলে কী হবে, পাড়ার যে সিগারেটের দোকানে সে স্কুলের পরে কাজ করে, সেখানে সে ‘লাইফ সাময়িকীর বিলাসী মোহজালে আবদ্ধ হয়ে যায়। সেই সাময়িকীতে সে কালোদের তখনকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের স্থিরচিত্র দেখে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।’ ১৯৬২ সালে ক্রিসমাসে পাওয়া একটি উপহার তার ভীষণ প্রিয়। সেটি তার সংগ্রহে একমাত্র রেকর্ড। রেকর্ডটির নাম ‘জায়ন হিল-এ মার্টিন লুথার কিং’। কালোদের কিংবদন্তী নেতার গীর্জায় বক্তৃতার রেকর্ড। সে কতবার যে সেই বক্তৃতা শোনে! বরাতটা তার ভালো, সে এক শিক্ষকের সুনজরে পড়ে। তিনি নিকটস্থ কারিগরী কলেজে ওপরের ক্লাসের কোর্সের প্রতি দৃষ্টি তার আকর্ষণ করেন।
কিন্তু হাই স্কুলের ১২শ শ্রেণি থেকে পাশ করে বের হবার আগেই এলউডকে নিকেল ইস্কুলে পাঠানো হয়। যেমন তার আগে ও পরে অসংখ্য কালো মানুষের ক্ষেত্রে ঘটেছে, তারও স্রেফ কালো মানুষ হয়ে গাড়িতে চড়ার জন্য কারাবাস ঘটলো। (এলউডের ক্ষেত্রে সে শুধুমাত্র যাত্রী ছিল।) নিকেল ইস্কুল আনুষ্ঠানিকভাবে কারাগার ছিলনা। ১৮৯৯ সালে ফ্লোরিডা বালক কারিগরী বিদ্যালয় নামে এটি স্থাপিত হয়। নিজেকে এটি সংস্কারমূলক বিদ্যালয় হিসেবে অভিহিত করে। বন্দীদের ‘কারাগারের সহিংস বন্দীদের থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার জন্য এদের বন্দী না বলে ছাত্র বলে ডাকা হয়।’ তাতে কী? এলউড টের পায় এখানে আসলে ‘সব সহিংস অপরাধীরা ইস্কুলের বেতনভুক কর্মচারী’। ট্রেভর নিকেল ‘সংস্কারের অঙ্গীকার’ নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্কুলের পরিচালক হন। তিনি এই চাকরি পেলেন কীভাবে? ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী সংগঠন কু ক্লাক্স ক্ল্যান-এর সভায় ‘নৈতিক উন্নতি ও কাজের মূল্য’ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে শ্রোতাদের সমীহ আদায় করে তিনি চাকরিটা হস্তগত করেন। যেই একবার কাজটা পেয়ে গেলেন, সবকিছুর ওপরে তিনি “শারীরিক সুস্থতার’ প্রতি জোর দিলেন এবং প্রায়ই ‘শারীরিক শিক্ষার উন্নতি কেমন হচ্ছে সেটা দেখার জন্য স্নানঘরের উলঙ্গ ছাত্রদের ওপর নজর রাখতেন।’
নিকেল ইস্কুলে সাদা ছেলেও ছিল। তাদের সাথেও বর্বর আচরণ করা হতো। সাদা কালো ছাত্রদের আলাদা থাকার বর্ণবাদী বন্দোবস্ত। সাদা ছেলেরা অবশ্য একটু ভাল খাবার পেত, আর তাদের শ্রম কালোদের মতো অত নির্মম ছিলনা। নিকেল ইস্কুলে সাদা-কালো সব ছেলেদের এক সাথে হবার সুযোগ ছিল একটাই – বাৎসরিক সাদা বনাম কালোর মুষ্টিযুদ্ধ। রক্তের নেশা জাগানো এই ক্রীড়া দেখার জন্য স্থানীয় জনসাধারণ লালায়িত থাকত, এবং এটাই একমাত্র সময় যখন কালো ছেলেরা ‘ন্যায্য অধিকারের সাক্ষাৎ’ পেত।। আরেকটা স্থানেও কালো আর সাদা বন্দীরা এক সমান ছিল – সেটা হলো হোয়াইট হাউস বা সাদা বাড়ি। এটি একটি পুরনো গুদাম ঘর। এখানে স্কুলের পরিচালক ‘আইনের প্রয়োগ’ করতেন। সেই জন্য ব্যবহৃত হতো তিন ফুট লম্বা চামড়ার দড়ি, নাম ‘কৃষ্ণ সুন্দরী’। এছাড়া আরো মধ্যযুগীয় সরঞ্জাম তো ছিলই। পিটুনিতে চামড়া ফেটে যেত, তার ফলে প্রাণকাঁপানো চিৎকার। বিশাল কারখানার ফ্যানের আওয়াজে সেই সপাং সপাং পিটুনি, চিৎকারের শব্দ, সব ঢাকা পড়ে যেত । সেই আওয়াজ ‘বিজ্ঞানের সকল নিয়ম ভঙ্গ করে পুরো স্কুল এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো।’ সেই পাখার বাতাস সাদা বাড়িটার দেয়ালে দেয়ালে রক্তের ছিটা ছড়্রিয়ে দিত। ‘আরো পেছনে’ আরো বীভৎস শাস্তি দেওয়া হতো। সেটা চিহ্নবিহীন কবরে পৌঁছুবার আগে সর্বশেষ গন্তব্য।
কোরার মত এলউডের গল্পও আসলে ক্রীতদাসের কাহিনি। Underground Railway উপন্যাসের মতো এখানেও হোয়াইটহেডের গোঁ - তিনি সহিংসতার ভয়ঙ্কর চিত্রতে কোনরকম কাট-ছাঁট করবেন না। এবং গল্পের চরিত্র বা পাঠক, কাউকেই পালাবার পথ দিতে রাজি নন তিনি। আগের উপন্যাসে যেমন কোরার বিরতিহীন অত্যাচারে সাদা সমর্থকরা সাময়িক আশ্রয়ের বেশি দিতে অক্ষম ছিলেন, এখানেও ফ্লোরিডার পাড়াগাঁয়ে কোন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ঘটেনা (যেমনটা ঘটেছিল বর্ণবাদ নিয়ে রচিত আরেকটি কালজয়ী উপন্যাস To Kill a Mockingbird-এ। সেখানে ধর্ষণের মিথ্যা বর্ণবাদী অভিযোগের শিকার একজন কালো মানুষের সমর্থনে এক সাদা উকিল এগিয়ে আসে।) আগের উপন্যাসের মতো এখানেও কিম্ভুত সব প্রতিবন্ধকতার দুর্ভেদ্য জাল ভেদ করে, শিকারী কুকুর সদৃশ হিংস্র মানুষ (কখনো বা সত্যিকারের কুকুর)-এর তাড়া থেকে পালিয়ে গল্পের চরিত্ররা মুক্তি নামের মরীচিকার পেছনে ছোটে। আবারও হোয়াইটহেড গল্পে বিশাল সময়ের ব্যবধানের মধ্যে যাওয়া-আসা করেন। কখনো এক দৃশ্যে হয়তো তুলনামূলকভাবে একটুখানি আশা, একটু নিরাপদ আশ্রয়ের দেখা মিলল, পরমুহূর্তেই লেখক সেই অলীক কল্পনাকে কালের এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ভেঙে চুরমার করে দিলেন। এইসব গল্পে সমাপ্তি দূরে থাক, মধুরেণ সমাপয়েত তো আরো দুরস্ত, আদৌ কোন আশ্রয় যে মিলতে পারে লেখক এমন সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন। The Nickel Boys উপন্যাসে সময়ের এই বিচিত্র লুকোচুরি কাহিনির শরীরের সাথে এত অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গেছে যে পড়া শেষ করার আগ পর্যন্ত টেরই পাবেন না যে কাহিনির সময়ের ব্যাপ্তি এই শতাব্দী এবং গত শতাব্দীর অনেকটা জুড়ে রয়েছে। আমেরিকায় ক্রীতদাসপ্রথার আমলে যেসব ক্রীতদাস পালিয়ে ‘মুক্ত’ অঙ্গরাজ্যে বা কানাডায় যাবার চেষ্টা করত, সেইসব গোপন রাস্তা এবং পথে থাকবার নিরাপদ আশ্রয়, সব মিলিয়ে পুরো ব্যবস্থাটাকে Underground Railroad বলা হয়। কিন্তু হোয়াইটহেডের ঐ নামের উপন্যাসে কিন্তু সত্যি সত্যি একটা ভূগর্ভস্থ রেলপথ রয়েছে। ঐ উপন্যাসের জাদুবাস্তবতা নতুন উপন্যাসে পুরোপুরি আমদানি না করলেও, লেখক একটা জাদুকরি চমকের মাধ্যমে এলউডের লুকানো গল্প পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ফলে একই সাথে একটা বিস্ময় ও একটি বেদনাবিধুর কাহিনি সৃষ্ট হয়েছে।
মার্টিন লুথার কিং-এর বাণী এলউডের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত, অথচ সেটা Jim Crow- এর বর্বর বর্ণবাদী বাস্তবতার প্রেক্ষিতে হোয়াইটহেড সেটা মেনে নিতে হিমসিম খান। মধ্যরাতের পর সাদা মুখোশ পরা হিংস্র সন্ত্রাসীদের আমাদের পাড়াগুলোতে পাঠাও, আমাদের কোন পাড়ার গলিতে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাও, তারপর আমাদের মারতে মারতে আধমরা করে ফেলে রেখে যাও, তবুও আমরা তোমাদের ভালোবাসব? যারা আপনার মনোবল ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর তাঁদের বেলায় ‘প্রতিটি হৃদয়ে শুভবুদ্ধি নিহিত সেটা বিশ্বাস’ করা কীভাবে সম্ভব? ‘হিংসায় হিংসা দূর হয়না, শুধু ভালোবাসা দিয়েই সেটা সম্ভব’ কী করে সত্য হতে পারে? ‘কী কথা!’ এলউড ভাবে। ‘যতসব অসম্ভব ভাবনা!’
এই জটিল সমস্যার হৃদয়বিদারক প্রত্যুত্তর দেয় The Nickel Boys। এই দুই বইয়ে হোয়াইটহেড ইতিহাসের যেই সঞ্চারপথ তুলে ধরেন – ১৮২০ থেকে ২০১৪ – সেটা শেষ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যায়। যেই জায়গা থেকে দক্ষিণ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের ছাত্রছাত্রীরা ডোজার ইস্কুলের বিস্মৃত মৃতদেহ উদ্ধার করছে, তার থেকে মাত্র ৬০ মাইল দূরে একটা কণ্ঠস্বরের চিৎকার শোনা গেল: ‘ওদের গুলি করো!’ এইবার প্রসঙ্গ অন্য আরেকটা ঘৃণিত জনগোষ্ঠী – এইক্ষেত্রে মেক্সিকো সীমান্তের অভিবাসী শ্রমিক। মে মাসের হট্টগোলপূর্ণ এক জনসভায় ঘটনাটি ঘটে। ‘শুধু এইরকম জায়গাতেই এমন কথা বলে পার পাওয়া যায়,’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বললেন। জনসমাবেশে মুগ্ধ সাদা মানুষ মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি ও অট্টহাসি দিয়ে প্রেসিডেন্টের উক্তিকে স্বাগত জানায়। বাস্তবতা হলো ওদের ‘গুলি করে পার পাওয়া যায়।’ এ শুধু কথার কথা নয়। আমেরিকার অন্যখানেও এরকম জায়গা আছে। উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন অতীত ‘এখনো অতীতই হয়নি।’ এ যেন আমাদের চিরন্তন মন্ত্র। কিন্তু আজকের দিনে সেই কথাটাও যথেষ্ট মনে হয় না।আমরা আমাদের অতীতের নাগাল পেতে পারি বলে আমাদের যে নিশ্চিন্ত প্রতীতি, হোয়াইটহেড তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। এমন লেখক আজকের দিনে অত্যাবশ্যক।
No comments:
Post a Comment