বিদ্যানন্দ ও আমাদের বিবেকের লড়াই - আশফাক স্বপন

বিদ্যানন্দ ও আমাদের বিবেকের লড়াই
ধর্মান্ধরা যেন আমাদের পরিচয় নির্ধারণ না করে

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী, বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
- কাজী নজরুল ইসলাম

মানুষের সদিচ্ছা থাকলে অর্জন কী অভাবনীয় হতে পারে, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদ্যানন্দ তার একটা বিস্ময়কর উদাহরণ। সঙ্গত কারণে পেরু-প্রবাসী তরুণ প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাসের লক্ষ লক্ষ ভক্ত।
কিশোরবাবুর ওপর সাম্প্রতিক জঘন্য সাম্প্রদায়িক আক্রমণ দেখে তাই এত অবাক হলাম। বাংলাদেশে সংখায়গরিষ্ঠতান্ত্রিক মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কী জঘন্য হতে পারে এই আক্রমণ সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়েছে। এই ঘটনা একপ্রকার নৈতিক যুদ্ধের আহবান।

এরকম মুহূর্তে আমাদের জাতীয় পরিচয়, আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে আমরা এক মর্মান্তিক প্রশ্নের সম্মুখীন হই।

আসলেই আমরা কে? আমাদের পরিচয় কী?

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যাবার কথা। সেই সময়কার বাংলাদেশ সরকারের একটা পোস্টারে মোদ্দা কথাটা বলা হয়েছে। পোস্টারের পটভূমিতে মন্দির, মসজিদ, গীর্জার ছায়া, তার ওপর দ্বার্থহীন উচ্চারণ: ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান – আমরা সবাই বাঙালী।‘

মনে হয় কিশোরবাবুর নিন্দুকদের কাছে সেই বার্তা এখনো পৌঁছেনি।

আসলে বাস্তব অনেক ঘোলাটে, গোলমেলে।

বাঙালি মুসলমানের নিজের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি আছে, নিজেদের মধ্যে মতভেদ আছে। বাঙালি মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের ফলশ্রুতি ১৯৪৭ সালের পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি। অথচ এক দশক পার না হতেই পাকিস্তানের ধাত্রী যে মুসলিম লীগ, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে তার ভরাডুবি হয়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পালটে আওয়ামী লীগ হয়। ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন দেশ ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে। রবীন্দ্রনথের ‘আমার সোনার বাংলা’ হয় দেশটির জাতীয় সঙ্গীত।

এই তো আমাদের ইতিহাসের চুড়ান্ত রায়, তাই না?

নির্মম সত্য হলো এরপর আমাদের জাতীয় পর্যায়ে পদস্খলন ঘটেছে। স্বাধীনতার পর গোঁড়া, ধর্মান্ধ ইসলামের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। আরব দেশের টাকা আর জাতীয় পর্যায়ের কিছু রাজনৈতিক শক্তির ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির প্রশ্রয় এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা বৃদ্ধিতে ইন্ধন জুগিয়েছে।

কিশোরবাবুর ওপর আক্রমণ এই জঘন্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। এর আগেও আরো আক্রমণের নজির রয়েছে।

বাংলাদেশের এক দুর্দান্ত ক্রিকেটার লিটন দাস। তিনি ফেসবুক পাতায় সবাইকে পূজার শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। ব্যস, আর যায় কোথায়? তার বিরুদ্ধে এমন অশ্রাব্য সাম্প্রদায়িক গালাগাল করা হলো, দেখে আমার রাগ আর ক্ষোভের সীমা ছিলনা।

আসলে বাংলাদেশি মুসলমানের সামাজিক পরিচয়কে একটি কাঙ্খিত দিকে ঠেলে দেবার জন্য এই সব আক্রমণ। মুসলমান হিসেবে আপনার সামাজিক পরিচয় দু’রকম হতে পারে। আমার প্রয়াত মা ও বোন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন/পড়ে, আবার দুজনেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভীষণ ভক্ত। আরেক রকম মুসলমান আছে যাদের চেতনাকে অসহিষ্ণুতা ও গোঁড়ামি এতখানি অধিকার করেছে যে বাংলা সংস্কৃতি, এমনকি ভাষার প্রতিও তাদের বিরাগ, অমুসলমানও তাদের গভীর অপছন্দ।

ধর্ম পালন থেকেই যে সবসময় এই ভেদবুদ্ধির জন্ম, তা নয়। মোহম্মদ আলি জিন্নাহ শুয়োরের মাংস খেতেন, মদ্যপান করতেন, আবার মনে করতেন হিন্দু আর মুসলমান আলাদা জাতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইসলাম ধর্ম পালন করতেন, কিন্তু যে উদার জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন সেখানে সকল ধর্মের বাঙালিদের সাদর আমন্ত্রণ ছিল।

ধর্মভীরু মানুষ – তাদের ধর্ম যাই হোক না কেন –দাবি করে যে তাদের সামাজিক মূল্যবোধের উৎস ধর্মীয় গ্রন্থ – কোরান, হাদিস, বাইবেল বা মনুস্মৃতি। কথাটা একদম ভুল। একই ধর্মের অনুসারী জনগোষ্ঠীর প্রবণতাভেদে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন রূপ হতে পারে। সমাজটি কূপমণ্ডুক, অসহিষ্ণু, হিংস্র হতে পারে, আবার মানবিক, উদার, পরমতসহিষ্ণু হতে পারে।

মাইমোনিডিসের (Maimonides) অভিজ্ঞতা থেকে কথাটি স্পষ্ট হবে। ইনি ১২শ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ইহুদী দার্শনিক ও চিকিৎসক। যখন স্পেনের কর্ডোবায় বেড়ে ওঠেন, তখন মুসলমান মূরীয় শাসনের রমরমা। তিনিও বড় হুন একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ, সুসংস্কৃত ইহুদীসমাজে। এরপর আলমোহাদ নামে উত্তর আফ্রিকা থেকে বারবার (Berber) মুসলমানের শাসকগোষ্ঠী মূরদের গদিচ্যুত করে। রাতারাতি ইহুদীদের অবস্থা পালটে যায়। পথ রইল তিনটি – ধর্মান্তর, নির্বাসন অথবা মৃত্যু। মাইমোনিডিস নির্বাসন বেছে নিলেন। জীবনের শেষের দিকে তিনি ক্রুসেড যুদ্ধের মুসলমান বীর সম্রাট সালাদিনের রাজসভার চিকিৎসক ছিলেন।
মুসলমান সমাজের পক্ষে কি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা পরিত্যাগ করে মানবিক, উদার মূল্যবোধে উত্তরণ সম্ভব?

নিজের হিংস্র অসহিষ্ণুতার কলঙ্কময় ইতিহাস সত্ত্বেও পাশ্চাত্য কিন্তু তা পেরেছে। ২০০১ সালে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় অমর্ত্য সেন মন্তব্য করেন: ‘১৫৯০-এর দশকে আকবর বাদশাহ যখন আগ্রায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার সপক্ষে মত ঘোষণা করছেন, তখন খ্রীষ্টানদের পরধর্মবিরোধী ইনকিউজিশন চলছে। ১৬০০ সালে জরদানো ব্রুনোকে (Giordano Bruno) ধর্মধ্রোহিতার অপরাধে রোমের কাম্পো দি ফেওরে-তে (Campo di Fiore) জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।‘

বাংলাদেশে কিশোরবাবুর ওপর মুসলিম ধর্মান্ধ আক্রমণের ফলে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, তাতে বহু ক্ষুব্ধ মুসলমান সামিল আছেন। এর ইতিবাচক ফল এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে মনে হয়।
এর আগেও ব্যাপক গণধিক্কার কার্যকর হয়েছে। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল মুসলমান চরমপন্থীরা বাংলা নববর্ষে রমনায় ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠনে বোমা হামলা করে। (এবিষয়ে আমার ক্ষোভ গভীর ও ব্যক্তিগত । আমার বোন ও ভগ্নীপতি সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।)

হামলাকারীদের উদ্দেশ্য যদি ত্রাস সৃষ্টি হয়ে থাকে, সেটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

পরের বছরগুলোতে ছায়ানটের অন্তুষ্ঠানে বাঁধভাঙা মানুষের ঢল নেমেছে। এরা অধিকাংশ মুসলমান। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষে যে অপূর্ব মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়, তার বিরুদ্ধে কিছু কাঠমোল্লা তীব্র ভাষায় অভিসম্পাত করে। আর প্রতিবছর মানুষ তার তোয়াক্কা না করে শোভাযাত্রায় যোগ দেয়।

ধর্মান্ধ মুসলমানদের স্থায়ীভাবে পরাস্ত করতে হলে যেটার প্রয়োজন, মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ হারবার্ট মারকুজ তাকে বলেছেন immanent critique - একেবারে জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তর থেকে উঠে আসা সমালোচনা।
ধর্মভীরু মুসলমানরা প্রায়ই উগ্র ধর্মান্ধ মুসলমানদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেন। তাদের বলতে শুনেছি, এদের বর্বরতার কারণে ইসলামের সম্মানহানি হচ্ছে। কিন্তু একথা শুধু মুখে বললেই তো চলবে না। কাজের মাধ্যমে এই সদুদ্দেশ্যের প্রমাণ রাখতে হবে।

যদি মনে করেন অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ মুসলমানদের ইসলামের সামাজিক পরিচয় নির্ধারণ করতে দেওয়া যাবে না, তাহলে আসুন, আপনার ধর্মের সম্মান রক্ষায় ময়দানে নামুন।

যেদিন ধর্মভীরু মুসলমান এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, সেদিন তারা যে ধর্মান্ধতা ও অসহিষ্ণুতা এত অপছন্দ করেন, তার বদলে যে পরমতসহিষ্ণু, মানবিক মুসলমান সমাজ কামনা করেন, সেটা অর্জনের পথ সুগম করবে।

এই কাজ করতে পাশ্চাত্যের কয়েক শতক লেগে গিয়েছে, কিন্তু পাশ্চাত্য তা পেরেছে। খোদ বাংলাদেশেও এটা সম্ভব। তবে বিনাযুদ্ধে সেটা হবে না।

আমরা বাঙালি না মুসলমান, এটাও আরেকটা অসার প্রশ্ন। বহু বাঙালি মুসলমান সগর্বে এবং সানন্দে দুই-ই। (আপনার ধর্মীয় মূল্যবোধে যদি সঙ্গীত গ্রহণযোগ্য না হয়, আপনার সেই মতে চলার অধিকার আমি মান্য করি। তবে অন্যের ওপরে এব্যাপারে জবরদস্তি করবেন না। আর জাতীয় পরিচয় ভৌগলিক, ধর্মীয় নয় – এই কথাটা মান্য করতে শিখুন।) এর ফলে আমাদের সমাজ আরেকটু মানবিক, সহনশীল হবে।
‘আমাদের পরিচয়ের কোন কষ্টকল্পিত একমাত্রিক সাদৃশ্য নয়, সৌহার্দ্যের জন্য সবচাইতে বড় সহায়ক বরং আমাদের পরিচয়ের বহুমাত্রিকতা। আমাদের পরিচয়ের নানান মাত্রা একে অপরকে অতিক্রম করে, তাতে কঠোর বিভাজনের মাধ্যমে দুইটি বিবদমান গোষ্ঠী সৃষ্টি ব্যাহত হয়।‘ অমর্ত্য সেনের উক্তি, প্রাগুক্ত ‘বিশ্ব সুপষ্ঠভাবে বিভাজিত নয়’ শীর্ষক নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর নিবন্ধে।

https://www.thedailystar.net/opinion/news/bidyanondo-and-the-battle-our-soul-1900726

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট