বই সমালোচনা
‘আবার অলিভ’ উপন্যাসে এলিজাবেথ স্ট্রাউট পুরনো বান্ধবীর সাথে আবার মিলিত হয়
হেলার ম্যাকআল্পিন
১৭ অক্টোবর, ২০১৯
অনুবাদ আশফাক স্বপন
মূল রচনা
In 'Olive, Again,' Elizabeth Strout Revisits An Old Friend
By Heller Mcalpin
October 16, 20197:00 AM ET
আলোচিত বই:
Olive, Again
By Elizabeth Strout
Hardcover, 289 pages
লেখিকার সাক্ষাৎকার (ইংরেজি)
অলিভ কিটরিজ বিদ্যালয়ে অঙ্কের শিক্ষয়িত্রী। স্বভাবে খিটখিটে কিন্তু প্রথম পরিচয়েই তার প্রতি মায়া পড়ে যায়। এখন অবসরপ্রাপ্ত, কিন্তু জীবন থেকে অবসর নেন নি মোটেও। এই অলিভকে নিয়ে রচিত গল্পসঙ্কলনের জন্য এলিজাবেথ স্ট্রাউট মার্কিন দেশের সবচাইতে নামজাদা সাহিত্য পুরস্কার পুলিৎজার প্রাইজে সম্মানিত হন। তার ১০ বছর পর লেখিকা আরো সাম্প্রতিক ঘটনার সংবাদ নিয়ে মেইন অঙ্গরাজ্যের উপকূল অঞ্চলে দৃষ্টি ফেরালেন । তার নতুন গল্পের ঝাঁপি, প্রথমবারের মতই, অপূর্ব।
Olive, Again (আবার অলিভ) উপন্যাসটি রসাস্বাদনের জন্য প্রথম সঙ্কলন Olive Kitteridge (অলিভ কিটরিজ) পড়ার প্রয়োজন নেই, তবে পড়ার জন্য মন আঁকুপাঁকু করবে। অঙ্কনশিল্পে চিত্রের প্রাথমিক রঙের আস্তরণের মতো গল্পের প্রথম সঙ্কলনটি কাহিনিকে গভীরতা দেয়, তাকে আরো বাঙ্ময় করে তোলে। দ্বিতীয় কিস্তির বইটির সূত্রপাত সম্বন্ধে স্ট্রাউট লিখেছেন: ‘এই যে অলিভ! আমাকে এখনো অবাক করে চলেছে। আমাকে রাগিয়ে দেয়, মনে কষ্ট দেয়, আবার ওকে ভালোও বেসে যাই।’
এই যে এলিজাবেথ স্ট্রাউট! আমাকে এখনো তাক লাগায় (যদিও আর অবাক হই না।) ‘Amy and Isabel’ (‘এমি এবং ইসাবেল’) থেকে শুরু করে ‘Anything is Possible’ (‘যে কোন কিছুই সম্ভব’) পর্যন্ত বইয়ের পর বইয়ে তিনি তাঁর নানান চরিত্রের মনোকষ্ট আর দুশ্চিন্তার গভীরে চলে গেছেন; অতি স্বচ্ছ দৃষ্টিতে, দরদের সাথে তাদের জীবনের আক্ষেপ, জীবনের রমণীয় মুহূর্ত, তাদের দোষেগুণে ভরা মানবিক পরিচয়কে তার রচনায় ধারণ করেছেন। শেরউড এ্যান্ডারসন তার ‘Winesburg, Ohio’ (‘ওয়াইন্সবার্গ, ওহায়ো’) বইয়ে কাহিনির ঘটনাচক্র বয়ানের একটি কাঠামো সৃষ্টি করেছিলেন। মেইন অঙ্গ্রাজ্যের ক্রসবি উপশহরের মানুষের জীবন সময়ের হাত ধরে তিল তিল করে কী করে এগিয়ে যায়, স্ট্রাউট তার একটা সম্মিলিত চিত্র সৃষ্টি করতে গিয়ে এ্যান্ডারসনকেও টেক্কা দিয়েছেন।
‘অলিভ কিটরেজ’-এর গল্প যেখানে শেষ হয়েছিলে, তার কিছু পরেই নতুন উপন্যাসের গল্প শুরু হয়। প্রথম গল্পসঙ্কলনে আমরা জেনেছি স্বামী হেনরির মৃত্যুর পর আমাদের কপরিচিত খিটখিটে স্বভাবের মূল চরিত্রটি খুব একা হয়ে গিয়েছে। তখন হার্ভার্ড অধ্যাপক জ্যাক কেনিসনের সাথে অলিভের সখ্যতা গড়ে ওঠে। ব্যাপারটা একটু অবাক করার মতো, কারণ স্বামীর জীবদ্দশায় হেনরি আর অলিভ জ্যাককে একজন বহিরাগত, উদ্ধত, দাম্ভিক, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি ভেবে খারিজ করে দিয়েছিল। জ্যাককে নদীর পারের এক পথে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় অলিভ আবিষ্কার করার পর তার ধারণা পালটায়। অলিভ জানতে পারে, তার মতো জ্যাকেরও কিছুদিন আগেই পত্নীবিয়োগ ঘটেছে। তার মতো জ্যাকেরও একমাত্র সন্তানের সাথে সম্পর্কে গভীর দূরত্ব রয়েছে বলে আক্ষেপ হয়।
‘আবার অলিভ’ উপন্যাসের সূচনায় আমরা দেখি তাদের সেই সম্ভাবনাময় যোগাযোগটি হারিয়ে গিয়েছে। অনেকটা missed call-এর মতো। নতুন উপন্যাসে জ্যাকের সাথেই আমাদের আবার দেখা হয় প্রথম। গল্প বলার কৌশলটি চমৎকার, এর ফলে আমরা খানিকটা দূর থেকে অলিভ কেমন আছে সেটা জানতে পারি। অলিভের সাথে বিশ্রী ছাড়াছাড়ির তিন সপ্তাহ পর জ্যাক তার চৌকশ লাল টকটকে ছাদখোলা গাড়ি চালিয়ে পোর্টল্যান্ড শহরে যায় একটা পানশালায় গলা ভেজাতে। সে জীবনের নানান হতাশার কারণগুলো সম্বন্ধে আবার ভেবে ভেবে ঠিক করে হয়তো এটাই তার পাওনা। নিজের সমকামী কন্যার প্রতি তার নির্মম দুর্ব্যবহার, তার প্রতি স্ত্রীর বিরাগ (স্ত্রীর পুরনো প্রণয়ীর কাছ থেকে প্রাপ্ত একটি উদ্বেগজনক ইমেল ব্যাপারটি সম্বন্ধে তাকে নতুনভাবে ভাবায়)– এই সব কিছু নিয়ে সে আক্ষেপ করে। আজ ৭৪ বছর বয়েসে সে ভাবে: ‘আচ্ছা, জীবনে সৎভাবে কী করে চলা যায়?’ সে যখন এসব বেদনাদায়ক স্মৃতিতে আচ্ছন্ন, তখন এক ঝটকায় তাকে বাস্তবে নিয়ে আসে এক ট্রাফিক পুলিশ। পুলিশ তাকে দ্রুতিসীমা লঙ্ঘনের জন্য থামায়। তর্কাতর্কি খানিকটা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের রূপ নেয়, তাতে শ্রেণিবিভাজনের ছায়া পড়ে।
একাকীত্বের পাশাপাশি শ্রেণিবিভাজন, উন্নাসিকতা – এসব স্ট্রাউটকে বিশেষভাবে ভাবায়। এবার দৃষ্টি চলে যায় খিটখিটে স্বভাবের অলিভের ওপর। আমরা জানতে পারি যে সে ‘ঐ অসহ্য, বড়লোক বুড়োটার’ ওপরে মহা খাপ্পা। সন্তান্সম্ভবা এক মায়ের অভিষেক অনুষ্ঠানে গিয়ে তার মনে হয়ে খুবই বালখিল্য অনুষ্ঠান, কিন্তু এক অতিথির জরুরি সন্তান প্রসবে অলিভ ঠাণ্ডা মাথায় সাহায্য করে সবার সমীহ আদায় করে। সেই কথা কাউকে বলার জন্য সে অধীর হয়ে ওঠে। ছেলে ক্রিস্টোফারের সাথে তার সম্পর্ক অতি শীতল, তবু সে তাকে ফোন করে। ছেলে পাত্তাই দেয় না। অলিভ জানে, জ্যাকের প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হতো।
আগ বাড়িয়ে সবখানে নাকগলানো অলিভের স্বভাবে মজ্জাগত, পরচর্চাতেও সে আনন্দ পায়, কিন্তু তার মনে মায়া-দয়াও রয়েছে। মানুষ পরস্পরকে সাহায্য করলে উভয়ে যে সুফল ভোগ করে, এইসব নানান গল্পে সেটা ফুটে ওঠে। মৃত্যুপথযাত্রী এক অল্পবয়স্কা মহিলার মনে হয় তার সব বন্ধুরা তাকে ত্যাগ করেছে। অলিভ তার সাথে দেখা করতে যায় বলে সে কৃতজ্ঞ বোধ করে। কিন্তু অলিভ যখন তার কাছে জ্যাকের সাথে তার ঝগড়ার কথা বলে তখন মহিলার খটকা লাগে। তার মৃত্যু সমাসন্ন বলেই কি অলিভ তাকে এসব কথা বলছে? অলিভ উত্তরে বলে না, মোটেই সেজন্য নয়। তার সাথে এসব কথা বলতে সে কোন সঙ্কোচ অনুভব করে না, তাই সে বলেছে।
যখন লারকিন পরিবারের কাছে আমরা আবার ফিরে আসি তখন এক হৃদয়বিদারক কাহিনির ভেতর স্ট্রাউট একটি হৃদয়স্পর্শী সত্য আবিষ্কার করেন। ‘অলিভ কিটরিজ’-এ আমরা পড়েছি লারকিন বাড়ির পুত্র এক মহিলাকে ২৯ বার ছুরিকাহত করার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড লাভ করে। লারকিন বাড়ির মেয়ে সুজ্যান বড় হয়ে বাবার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ক্রসবি ফিরে আসে পারিবারিক উকিলের সাথে সাক্ষাত করতে। আমরা তার পারিবারিক ইতিহাসের আরো কিছু মর্মান্তিক ঘটনা সম্বন্ধে জানতে পারি। কিন্তু ওদের দুজনের কথোপকথনের পর আমাদের মন আবার অনেকটা শান্ত হয়ে যায় – যেমনটা সুজান ও তার উকিলও হয়। সেই কথোপকথন উভয়ের মনকে উজ্জীবিত করে, তাতে উভয়ের মন বেশ হাল্কা হয়।
‘আবার অলিভ’ বারবার সহনশীলতার সীমানা চিহ্নিত করে, মানবচরিত্রের বহুবিচিত্র প্রকাশের ওপর দৃষ্টিপাত করে – কখনো বেশ বলিষ্ঠভাবে। ‘The End of the Civil War’ (‘গৃহযুদ্ধের দিনগুলোর শেষে’ )শীর্ষক একটি অধ্যায়ে এক দম্পতি ৪২ বছরের বিবাহিত জীবনে ৩৫ বছর পরস্পরের সাথে প্রায় বিনা বাক্যালাপে কাটিয়ে দিয়েছে। বাবার শখ গৃহযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রের ঐতিহাসিক অবস্থার পুনর্নিমাণ, আর কন্যার আগ্রহ এক বিশেষ ধরনের যৌন-অভিজ্ঞতায়, যেখানে নারী শক্তিরূপিনী বা dominatrix হয়ে ওঠে। লেখিকা এই দুই ধরনের অভিনয়ে বিস্ময়কর মিলের সন্ধান পান।
‘Poet’ (‘কবি’) অলিভের নিজেকে আবিষ্কার করবার বেদনাময় প্রক্রিয়া নিয়ে একটি অপূর্ব অধ্যায়। এটি (‘যে কোন কিছু ঘটতে পারে’ অধ্যায়ের মত) নিজের আদি শহরে একজন অধুনা বিখ্যাত লেখকের প্রত্যাবর্তন নিয়ে। এ্যান্ড্রিয়া ল্যরিউ অলিভের এক পুরনো ছাত্রী, বড় হয়ে এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কবি হয়েছিল। স্থানীয় কফিশালায় ওর সাথে যখন অলিভের দেখা হয়, তখন সে তার পুরনো ছাত্রীর ছেলেবেলার কথা মনে করে। সে একটি ফরাসীভাষী কানাডিয়ান ক্যাথলিক পরিবারের সদস্যা, আট ভাইবোনের একজন। অলিভের মনে পড়ে সে কেমন মনমরা, একাকিনী ছিল, তার মধ্যে অলিভ বিশেষ সম্ভাবনা দেখতে পায়নি। পরে অলিভের সাথে খোলামেলা কথোপকথনের ভিত্তিতে এ্যান্ড্রিয়া তাকে নিয়ে যে কবিতা লেখে, সেটা কে একজন বেনামীতে অলিভকে পাঠায়, তখন এ্যান্ড্রিয়া কি নির্ভুল নিশানায় তাকে, তার একাকীত্বকে শনাক্ত করে সেটা লক্ষ করে অলিভ প্রথম প্রথম গ্লানিতে স্তম্ভিত হয়। তবে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অলিভ উপলব্ধি করে যে – লেখিকার ভাষায় - ‘অন্যরকম, পর হয়ে সমাজে থাকার অভিজ্ঞতা কী, সেটা এ্যান্ড্রিয়া তার চাইতে বেশি ভালো বুঝতে পেরেছে।’
স্ট্রাউটের ব্যাপারে এটাই বিশেষ লক্ষণীয়: তার চরিত্রগুলো ভীষণ কষ্টের মধ্য দিয়ে যায় – স্বামী বা স্ত্রীর কাছে অত্যাচার, বাবা-মায়ের অবহেলা, বয়সবৃদ্ধির বিড়ম্বনা (এর মধ্যে স্বাধীনতা খর্ব হওয়া, প্রাপ্ত বয়স্কদের ডায়াপার পরার কথাও রয়েছে), হৃদয়-ছারখার-করা অসহ্য একাকীত্ব। কিন্তু অদ্ভুত চারিত্রিক ঋজুতা রয়েছে এইসব মানুষের। অলিভ বড্ড কড়া আর একরোখা, কিন্তু সেও যদি বুঝতে পারে যে একটুখানি সহমর্মিতা পুরো চিত্রটি পালটে দিতে পারে, তাহলে আমরা পারব না কেন? ‘তোমার জীবন কেমন চলছে গো, বেটি?’ অলিভ বেটি নামের এক গৃহ স্বাস্থ্য সেবিকাকে জিজ্ঞেস করে। তার গাড়িতে একটা ছোট্ট স্লোগান দেখে সে বিরক্ত হয়েছিল, তবুও সে প্রশ্নটা করল। এই প্রশ্নটাই আসল জিনিস, সহমর্মিতার পথে প্রথম পদক্ষেপ। ‘আবার অলিভ’ আমাদের হৃদয়স্পর্শীভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়, সহমর্মিতা ভালোবাসার পূর্বশর্ত। এতে জীবন আর অসুখী থাকে না।
No comments:
Post a Comment