যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পুস্তক পুরস্কার বিজয়ী "হলুদ বাড়ি" | NPR থেকে আলোচনাটি অনুবাদ করেছেন আশফাক স্বপন



'The Yellow House'-বইটির জন্য লেখিকা স্যারা এম. ব্রুম ২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পুস্তক পুরস্কার লাভ করেন। ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও-তে প্রকাশিত বইটির সমালোচনা এখানে নিবেদন করা হলো।

‘হলুদ বাড়ি’ স্থান, স্মৃতি এবং আত্মোপলব্ধির যোগসূত্র স্থাপন করে

মার্থা এ্যান টোল
১৩ আগস্ট ২০১৯
ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও

অনুবাদ আশফাক স্বপন

মূল রচনা
The Yellow House' Connects Place, Memory And Self-Knowledge

Martha Anne Toll
August 13, 2019
National Public Radio

আলোচিত বই
The Yellow House
By Sarah M. Broom
Hardcover, 376 pages
Buy here


বইটির আরেকটি সমালোচনা (ইংরেজি)
Katrina Destroyed 'The Yellow House' — But Inequality Eroded Its Foundation

Maureen Corrigan
September 4, 2019
Fresh Air
National Public Radio
পড়ুন । শুনুন

লেখিকার সাক্ষাৎকার (ইংরেজি)
Sarah M. Broom On 'The Yellow House'

August 10, 2019
Weekend Edition
National Public Radio
পড়ুন । শুনুন

স্যারা এম. ব্রুমের দুর্দান্ত অভিষেক ঘটল ‘The Yellow House’ (হলুদ বাড়ি) বইটি দিয়ে। বইটিতে প্রার্থনার আর্তি রয়েছে, মৃতব্যক্তির সম্মানে রচিত শোকগাঁথার গাম্ভীর্য রয়েছে।

শিরোনামে উল্লেখিত বাড়িটি ব্রুমের বিস্তৃত ও বহুবিচিত্র পরিবার নিয়ে স্মৃতিচারণের কেন্দ্রবিন্দু। আরো যেটা উল্লেখযোগ্য, সেটা হল আমেরিকা কীভাবে আফ্রিকান আমেরিকানদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে, এবং আজও ব্যর্থ, এই বাড়িটি যেন সেটার একটি প্রতীক।
মা আইভরি মে-এর ১২টি সন্তানের মধ্যে ব্রুম সবচাইতে ছোট। ১৯ বছর বয়সে বিধবা হবার পর আইভরি মে তার জীবনের সঞ্চয় দিয়ে পূর্ব নিউ অরলিন্সে একটি ছোট্ট সাদামাটা বাড়ি ক্রয় করেন। টেক্সাসের ক্রোড়পতিরা তাদের বিশাল বিশাল উন্নয়ন প্রকল্প এবং তার চাইতেও বিশাল আস্ফালন নিয়ে এই জায়গাটাতে আসবার আগে এই এলাকাটাকে যে ঠিক কী নামে ডাকা হয় সেটা কেউ জানতো না। তবে লেখকের ভাষায়, ‘নাম না দেওয়াটাও একধরনের নামকরণ।’

বাড়ি ক্রয় করতে না করতেই বাড়ি্টা পেছন দিকে মাটিতে ডুবে যেতে আরম্ভ করে। কারণ জায়গাটা আগে সাইপ্রেস গাছের ডোবা ছিল। লেখকের ভাষায় ‘গাছ অথবা তিনজন মানুষের ওজন বহন করার জন্য জমিটা বড়ই দুর্বল।’

কয়েক বছরের মধ্যে আইভরি মে সাইমন ব্রুম নামে তার চাইতে বয়সে ১৯ বছরের বড় এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন। বিয়ের আগে তাদের যার যার নিজেদের সন্তান ছিল, বিয়ের পর তাদের আরো সন্তান হয়। বিয়ের পরপর ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ে জলাশয় রক্ষাকারী বাঁধ ভেঙে যায়। প্রায় ৭০,০০০ মানুষ গৃহহীন হয়, শত শত মানুষ বাড়ির ছাদে জলবন্দী হয়। এটিই ঘুর্ণিঝড় বেটসি – কাটরিনা ঘুর্ণিঝড়ের ৪০ বছর আগে এই ঘুর্ণিঝড় নিউ অরলিন্সে একই রকম প্রলয়ঙ্কারী আঘাত হানে।

সাইমন পরিশ্রমী ছিলেন। হলুদ বাড়ির নানান সংস্কারে নিবেদিত ছিলেন, তবে কাজ শেষ করতে পারেন নি। লেখিকা ব্রুম যখন শিশু, তিনি অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। ফলে লেখিকার পিতৃস্মৃতির ভাণ্ডারে কিছুই জমা নেই। আইভরি মে দ্বিতীয়বার বিধবা হলেন। এবার একা ১২টি সন্তান লালনের দায়িত্ব তাঁর। সেই সাথে হলুদ বাড়ি, যাকে তাঁর ১৩শ সন্তান বলা চলে।

ব্রুমের গদ্য স্মৃতির বিরহে কাতর। লেখিকা তার জন্মের আগে বাবা-মায়ের জীবনের চিত্র তুলে ধরেন। আর তুলে ধরেন কাটরিনা ঘুর্ণিঝড়ে জলের উত্থান ও পতন - যাকে তিনি ‘জল’ বলে অভিহিত করেন। কাটরিনা সবকিছু কেড়ে নেয়। ব্রুমকে অনেক আদর ও যত্নে মানুষ করেন তার মা, সঙ্গে খুনশুটি আর মমতায় ভরা বড় ভাইবোন, এবং নানী। হলুদ বাড়িটি তাঁর স্বরূপ নির্ণয় করেছে, আবার হলুদ বাড়িটি সেই পরিচয়কে সীমায়িত করেছে। তার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে বাড়িটি ক্রমশ ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে, যদিও আইভরি মে একসাথে একাধিক জায়গায় কাজ করে সংসার সামাল দেবার পরও বাড়ি ঝকঝকে পরিষ্কার রাখতেন। শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি বাড়ির নানান স্থানে অবক্ষয়, ইঁদুর, পোকামাকড়, ও বৃষ্টির সাথে যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারেননি। আইভরি মে একটা কথা বলতেন যারসত্যতা চিরকালীন: ‘জানোতো এই বাড়িটা অন্য লোকের জন্য খুব একটা আরামদায়ক না।’ লেখকের ভাষায়: ‘মর্মবিদারক বাস্তব হল এই - হয়ত আমরা এই সত্যটি আবিষ্কার করেছি – যে মানুষকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ না জানিয়ে আমরা আমাদের নিজেতের স্বভাবের বিরুদ্ধাচরণ করছি। এর কারণ হল লজ্জা, গ্লানি।’

ব্রুমের সাধ জাগে এইসব কিছু পেছনে ফেলে চলে যাবার – তাকে বড় নগরীর বড় রাস্তা, বিশ্ববিদ্যালয়, সাংবাদিকতায় উচ্চশিক্ষা হাতছানি দেয়। তিনি নিউ ইয়র্কের কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যূষিত হারলেম-এ আসেন ‘ও ম্যাগাজিন’-এ চাকরি নিয়ে। আফ্রিকার বুরুন্ডিতে যান। সেখানে বিপদসঙ্কুল পরিবেশে সেই স্থানের মানুষের সামনে আয়না তুলে ধরেন। সেটা তাকে আবার নিউ অরলিন্সের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করে।

যখন কাটরিনা ঘুর্ণিঝড় আঘাত হানে, ব্রুম তখন বাইরে। তাঁর ভাষায়: ‘আমার অনুপস্থিতি, আমি যে শারীরিকভাবে সেখানে উপস্থিত ছিলাম না - এই বিষয়টি খুব সুক্ষ্ম অনুভূতির মধ্য দিয়ে আমার মনে হানা দিতে লাগল। আজ বুঝতে পারি সেই অনুভূতিটা ব্যর্থতার।’ তার পরিবারের মর্মন্তুদ ক্ষতি করে ঘুর্ণিঝড় – পরিবারের বিভিন্ন সদস্য ও তাদের ছেলেমেয়েরা ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও অন্যান্য জায়গায় ছিটকে পড়ে, সেখানে ছাদের থেকে পরিত্রাণের রোমহর্ষক কাহিনিও রয়েছে - লেখিকা সেসব বৃত্তান্ত দিয়েছেন।
কাটরিনার মরণছোবলের পর কোনরকম আগাম বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই জঞ্জাল পরিষ্কারের ট্রাক এসে হলুদ বাড়িটি সমূলে তুলে নিয়ে যায়। লেখকের ভাষায়:
‘এই বাড়িটির ভেতর আমার বাবা ছিলেন, তার সত্তা এখানে রক্ষিত ছিল। এই বাড়িটিতে তার নানান চিহ্ন রয়েছে। যতদিন বাড়িটি ছিল, এই চিহ্নগুলো ছিল, বাবা পুরোপুরি চলে যাননি। এবার, হঠাৎ করে, তিনি চলে গেলেন।’
ব্রুম নিউ অরলিন্স ফিরে আসেন। তিনি নিউ অরলিন্সের মেয়র রে নেগিনের দফতরে গণযোগাযোগের একটি চাকরি নেন। তিনি তার আদরের ভাই কার্লের সাথে সময় কাটান। কার্ল NASA-এর বাগানে কাজ করেন। প্রতি রাতে ফিরে এসে যেই স্থানে হলুদ বাড়িটি ছিল, সেই খালি জমিটি পাহারা দেয়। আজ প্রায় পুরো পাড়াই পরিত্যক্ত। কিন্তু কার্ল জমির ঘাস নিয়মিত ছেঁটে পরিষ্কার রাখে। কারণ, লেখিকার ভাষায়: ‘আমাদের থেকে এই জমি কেড়ে নিতে পারে – যে কোন কারণে বা কোন কারণ ছাড়াই – এই হল আমেরিকার ইতিহাসের একেবারে মৌলিক সত্য।’

সবকিছুতেই গোলমাল। উচ্চ মহলে তার নানা যোগাযোগ সত্ত্বেও উধাও হওয়া বাড়িটির জন্য ব্রুম মায়ের ক্ষতিপূরণ যোগাড় করতে পারেনা। (পর্যায়ক্রমে একেক উকিলের দল নথি ‘হারিয়ে’ ফেলে, ফলে সাত বছর লেগে যায়।) তাঁর নিজ শহরের প্রতি লেখিকা অসহায় অনুভব করেন, তার শিকড়ের সাথে দূরত্ব অনুভব করেন। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই বইটির গবেষণার কাজ শুরু করেন। অর্থাৎ তার পারিবারিক ইতিহাস, এবং নিউ অর্লিন্স-এর ইতিহাসের নানান অলিগলি যেখানে যেখানে এসে যুক্ত হয়েছে, সেইসব বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাটি আরম্ভ করেন। শহরের নানান জায়গায় আবাসনের নথি, নগর পরিকল্পনার নথি, সবই তার নাগালের মধ্যে, কিন্তু বাড়ি পৌঁছুবার পথ আর খুঁজে পান না। কোথায় বাড়ি? তার পরিবারের সদস্যরা দিকে দিকে ছড়িয়ে রয়েছে, এবং জেসমিন ওয়ার্ডের Men We Reaped (যেই পুরুষ আমরা পেয়েছি) বইয়ের মত তারঁ বেলাতেও তার সব বন্ধুরা হয় মৃত, নয়তো কারাগারে, নয়তোবা কে জানে কোথায় চলে গিয়েছে।

পরিবার, মাটি আর হারানোর মাঝে যে বেদনাবিধুর বন্ধন, সেটার উন্মোচনে ‘হলুদ বাড়ি’ মনে করিয়ে দেয় লরেট সাভয়-এর কাব্যময় স্মৃতিকথা ‘Trace’ (ছায়াপাত)-এর কথা। সেই বইয়ে সাভয় তাঁর মিশ্র-বর্ণের পূর্বসূরীদের হারানো স্থান-এর সাথে বিস্তৃত, বহুবিচিত্র আমেরিকার যোগসূত্র স্থাপন করেন। ‘হলুদ বাড়ি’-এর সাথে একইভাবে মিল পাই জে. ড্রু ল্যানহামের ‘The Home Place’ (বাড়ির জায়গা) বইটির।

স্যারা এম. ব্রুম লেখিকা হিসেবে যেমন বিদূষী তেমন তার চিন্তার বিস্তার। বিশাল বিশাল বিষয় তিনি আত্মস্থ করেন। ‘হলুদ বাড়ি’ আফ্রিকান আমেরিকান পরিবারের থেকে নিরবিচ্ছিন্ন আর্থিক বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কাহিনি, সে তারা যতই পরিশ্রম করুন না কেন। পরিবেশের যে ভয়াবহ সঙ্কট সহজে অনুমেয় ছিল সেই সঙ্কট ও তার মর্মবিদারক পরিণতি থেকে আমাদের সবচাইতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে আমাদের দরিদ্র পাড়াগুলোর প্রতি আমাদের চুড়ান্ত অবহেলা। তুলে ধরা হয়েছে অঙ্গীকারের ধাপ্পাবাজি – যার ফলে অঙ্গীকার হয় বাস্তবায়িত হয় না, নতুবা বড্ড সহজে ভঙ্গ করা হয়। তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে অবকাঠামোর গভীর সমস্যা রাজনীতিকরা এবং আমরা সবাই এড়িয়ে যাই।

সেই সাথে ‘হলুদ বাড়ি’ ভালোবাসা এবং শত প্রতিকুলতায় হার না মানার কাহিনি। একজন মাতা কিছুতেই হার মানেন না, তার সন্তানদের সাহায্যের হাত বাড়াতে কখনোই দ্বিধা করেন না। লেখিকার ভাষায়: ‘আমার মা তার ক্রোধ ও হতাশা মনের গভীরে লুকিয়ে রাখতেন, তার বাহ্যিক শিষ্টতার অনেক, অনেক নীচে।’ আর রয়েছে একটি তরুণীর কাহিনি যার জীবনের আঁকাবাঁকা পথ তাকে প্রথমে তার পরিবার থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে আবার কাছে ফিরিয়ে আনে। তাঁর নিজের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করার জন্য তাঁকে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে হয়। তার একটা গভীর উপলব্ধি ঘটে যে চেতনার কিছু কিছু ফাঁক পূরণ হবার নয়।

ব্রুম যেন সমগ্র পৃথিবীকে বুঝবার দায়িত্ব আপন স্কন্ধে তুলে নিয়ে বেসামাল হয়ে গেছেন। আমাদের আশা রইল তিনি ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলো নিয়েও ‘হলুদ বাড়ি’-এর মত দরদ ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুসন্ধান করবেন। তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেন যে তিনি যেসব প্রশ্ন তোলেন, তার ভাষায় ‘তার উত্তর পাওয়া অসম্ভব।’

তিনি লেখেন: ‘এই স্মৃতিচারণ, এই মনে করা ব্যাপারটা একেবারেই সহজ নয়।’ তথাপি আমরা অধীর আগ্রহে তার নতুন অনুসন্ধানের অপেক্ষায় রইলাম।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট