(নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর পুস্তক সমালোচক মিচিকো কাকুতানি টা-নেহিসি কোট্স্-এর প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘Between the World and Me’ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বইটি বর্তমান আমেরিকায় কালো মানুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে ধীর, মর্মবিদারক বিশ্লেষণ।‘ কাকুতানির সমালোচনার লিঙ্ক এখানে)
(https://riton.in/2NnCjl8)
টা-নেহেসি কোট্স্-এর প্রথম উপন্যাসে ইতিহাসের সাথে অতিবাস্তব কল্পনা মিশেছে
এসি এডুগিয়ান
নিউ ইয়র্ক টাইমস
২৪ সেপ্টেমবর ২০১৯
অনুবাদ আশফাক স্বপন
মূল রচনা
(https://riton.in/32rwW93)
Ta-Nehisi Coates’s Debut Novel Mingles History and Fantasy
By Esi Edugyan
New York Times, Sept. 24, 2019
The Water Dancer
By Ta-Nehisi Coates
কথাসাহিত্যে টা-নেহেসি কোট্স্ এর অভিষেক ঘটল The Water Dancer (জলনর্তকী) শীর্ষক বহুমেজাজি উপন্যাসের মাধ্যমে। এর আগে কোট্স্-এর নানান অসামান্য বুদ্ধিদীপ্ত প্রবন্ধ আমেরিকায় বর্নবৈষম্য নিয়ে খোলাখুলি আলোচনার পথ প্রশস্ত করেছে। উপন্যাসের কাহিনি হিরাম ওয়াকার (ডাক নাম ‘হাই’) নামের এক ১২ বছর বয়স্ক ক্রীতদাসকে অনুসরণ করে। সে ভার্জিনিয়ার এক ক্রীতদাস শ্রমনির্ভর বড় খামারে কাজ করে। খামারের নামটি যেন বাস্তবতাকে ব্যঙ্গ করে - Lockless (তালাবিহীন)। হাই বুদ্ধিমান, তার নানান গুণের মধ্যে একটি হল নিখুঁত স্মৃতিক্ষমতা।
হাই খামার মালিকের ঔরসজাত পুত্র। দাসপ্রথার নির্মমতা যে কেমন স্বেচ্ছাচারী আর বিকৃত, সেটা একটি ঘটনায় প্রকাশ পেল। ঘটনাচক্রে তাকে মালিকবাড়িতে ডাকা হল তার আপন ভাইয়ের ভৃত্যের দায়িত্বপালনের জন্য। কিন্তু এক সন্ধ্যায় দুই ভাই বাড়ি ফেরার পথে একট সেতু পার হবার সময় সেতুটি ধ্বসে পড়ে। হাই-এর ভাইয়ের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু সে নিজে অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। সে যে বাঁচল, সেটা শ্রেফ ভাগ্যক্রমে নয়। সে স্তম্ভিত হয়ে লক্ষ করে যে তার একটা বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে সেটা সে ভালো করে বোঝে না, এমনকি চায়ও না।
মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে সে নিজের জীবনের মূল্য কী, সেটা সম্বন্ধে নতুন করেউপলব্ধি করে। সে ঠিক করে, তার প্রেয়সী সোফিয়াকে নিয়ে লকলেস খামার থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু সব গণ্ডগোল হয়ে যায়, এবং অবশেষে হাই আন্ডারগ্রাউন্ড নামের একটি গোপন সংগঠনের সদস্যদের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এই সংগঠন ক্রীতদাসদের পালিয়ে উত্তরে মুক্তজীবন লাভ করায় সাহায্য করে।
আন্ডারগ্রাউন্ড হাই-এর অলৌকিক ক্ষমতা অত্যন্ত মূল্যবান সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করল। আবার হাইয়ের কাছে আন্ডারগ্রাউন্ডের সাহায্যের প্রস্তাব একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে হল। এই সুযোগ শুধু সোফিয়াকে উদ্ধার করা নয়। যেই বিষময় ব্যবস্থা তার আপনজনকে বন্দী করেছে, এবার তার ক্ষতি করা, এবং অবশেষে ধ্বংস করার সুযোগ এল। তাই মাঠের ক্রীতদাসের স্বরূপ বদলে গেল, সে হয়ে উঠল মাঠপর্যায়ের কর্মী। এই বদল হাইকে রোমাঞ্চিত করে, আবার গভীরভাবে ভাবায়। হাই পরিবর্তন আনায় তার নিজের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়।
কোলসন হোয়াইটহেডের-এর (Colson Whitehead) The Underground Railroad (পাতাল রেল) উপন্যাসে আমরা যেমনটা দেখেছি, এখানেও কোট্স্ দাসপ্রথার ভয়াবহতার সাথে অতিবাস্তব কল্পনার একটা ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। যারা ক্ষমতাহীন, লেখক তাদের গুণের চৌহদ্দি প্রসারিত করেছেন, সেখানে অতিবাস্তব ক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে ‘জলনর্তকী’ একেবারেই নিজস্ব সৃষ্টি, এর অতিবাস্তবের ইঙ্গিত বাস্তবতায় গভীরভাবে প্রোথিত। মোদ্দা কথা হল, উপন্যাসটির আগ্রহ ক্রীতদাসপ্রথার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া আবিষ্কারে। এই মর্মান্তিক বেদনার স্বরূপের নানান দিক উদ্ধারে কোট্স্-এর মুনসীয়ানা উল্লেখ্য।
মালিক ও ক্রীতদাস উভয়ের জীবনে যে বৈপরীত্য বিদ্যমান, সেটা বিশেষ দক্ষতার সাথে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যেমন, একই সাথে ক্রীতদাস ও তাদের ভাবী মালিকদের লালন-পালন করার যে প্রথা চালু ছিল, যার ফলে লেখকের ভাষায় ‘একজন বড় হয়ে রাণী হবে, আরেকজন, পা-দানি,’ তার প্রতি বিশদভাবে নজর দেওয়া হয়। ঠিক একইভাবে গভীর দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে ক্রীতদাস নিলামের সভায় অসম্মানজনক শারীরিক পরীক্ষার প্রতি, যেখানে লেখকের ভাষায় ‘মানুষ আরেকটি মানুষকে সম্পূর্ণ মাংসপিণ্ড হিসেবে যাচাই করবার ক্ষমতা নিয়ে আত্মপ্রসাদ পায়।’ কোট্স্ দাসপ্রথায় আবদ্ধ মানুষের মধ্যেও যে দ্বন্দ্ব সংঘাত রয়েছে সেটা তলিয়ে দেখেন। কোন ক্রীতদাস হয়েতো অন্য ক্রীতদাসের ওপর গোয়েন্দাগিরি করে, বা কখনো কোন ক্রীতদাস নিজের উন্নতির জন্য অন্য কারো সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
হাই নিজের অবস্থানকে আত্মস্থ করে যেভাবে সেই সম্বন্ধে আত্মসচেতনতা লাভ করে, সেটা পাঠককে সবচাইতে বিচলিত করে। ক্রীতদাস হিসেবে তার সামাজিক অবস্থান এমন গভীরভাবে তার চেতনায় গেঁথে গেছে, যে ভাল উদ্দেশ্য নিয়েও একজন শ্বেতাঙ্গ - সম্পত্তি হিসেবে নয় - একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে যখন তাকে অভিবাদন জানায়, সে আতঙ্কে কুঁকড়ে যায়। কোট্স্-এর সৃষ্ট জগতে যে কোন একটা আলিঙ্গনে একটি দুর্লক্ষ্য বিস্ময়কর নতুন উপলব্ধি ঘটতে পারে।
উপন্যাসে কিছু হৃদয়বিদারক দৃশ্য আছে। উপন্যাসের এক জায়গায় এক বয়োজ্যেষ্ঠ ক্রীতদাস কী করে নাশকতার জন্য কঠোর শাস্তিভোগ করে সেই কাহিনি বলে। কাজটি সে অপরাধবোধের কারণে করেছিল। তার পুত্রের অনুপস্থিতিতে সে পুত্রের প্রেমিকাকে নিজের প্রণয়িনী হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু পুত্র ফিরে আসে। সেই গ্লানি দুঃসহ। আরেকটি মর্মান্তিক দৃশ্যে এক মুক্তিপ্রাপ্ত মা ১২ বছর বয়স্ক ক্রীতদাস পুত্রকে প্রতিদিন দেখতে আসে। হঠাৎ বালকটি বিক্রি হয়ে যায়। মা পরস্পর-দড়িতে বাঁধা ক্রীতদাসের সারিতে চলমান পুত্রের পাশে হাঁটে আর অঝোর নয়নে কাঁদে।
কোট্স্ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন কীভাবে সচেতনভাবে অজ্ঞতার সাহায্যে এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়। কালো মানুষের প্রতি ইচ্ছাকৃত নিস্পৃহতা দ্বারা ওদের মানবিকতা অস্বীকার করা হয়। বিষয়টি বোঝা মানেই কালো মানুষের প্রতি কিছুটা সহমর্মিতা অনুভব করা, এবং মালিকের মনে এমন অনুভূতির অনুপ্রবেশ পুরো ব্যবস্থাটির পতন ঘটাতে পারে। লেখকের ভাষায় ‘কোন মায়ের সামনে একটা ছোট বাচ্চাকে বিক্রি করতে হলে প্রয়োজন সেই মাকে যতটা সম্ভব কম চেনা। একটা পুরুষকে নগ্ন করে, তাকে প্রহারের আদেশ দিয়ে, তাকে চাবুকে চাবুকে ক্ষত বিক্ষত করে তাতে লবণপানি ছিটাতে গেলে কোনভাবেই তার প্রতি নিজের আপনজনের মতো অনুভব করা চলবে না। ওর মধ্যে নিজেকে দেখা চলবে না, পাছে হাত আটকে যায়।’
তবে একথা সত্যি যে এতে প্রথম উপন্যাসের কিছু অসংলগ্নতা রয়েছে। রোমাঞ্চকর ঘটনা সত্ত্বেও লেখায় কখনো কখনো গতিশীলতার অভাব রয়েছে। সংলাপ বড্ড বেশি বর্ণনামুখর। প্রায় প্রতিবারই হাই কোন নতুন চরিত্রের সাক্ষাত পেলেই সে বিশদভাবে হাইকে তার নিজের ইতিহাস শোনায়। যদিও কাহিনির শুরুতে আমাদের বলা হয়েছে যে মানুষ হাই-কে একজন মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তাই তারা তাকে নিজের মনের কথা না বলে থাকতে পারে না, তবুও এইসব আত্মকথন বড্ড কষ্টকল্পিত আর অস্বাভাবিক মনে হয়।
তবে উপন্যাসের অঙ্গুলিমেয় কিছু দুর্বলতায় তুলনায় এর বিশাল গুণের পাল্লাই ভারী। যখন হাই নিজে ভিটায় ফিরে আসে, নিজের জন্মস্থানের সাথে সে একধরনের দূরত্ব অনুভব করে। লেখকের ভাষায় ‘এ এক অদ্ভুত ব্যাপার, নতুন দৃষ্টিতে এই স্থানটিকে দেখা। যেই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আমি দৌড়েছি, কঠোর প্রশিক্ষণের সময়ে এই সম্পূর্ণ এলাকাটির পরিচয় আমি জেনেছি। এই তো লতাপাতার বাহারে সুশোভিত গাছ গাছালি দেখছি। একটু পড়েই পাহাড়। সেখানে খোলা একটুখানি জায়গা আছে, পাথরের ছাদ আছে। সেখানে দৃষ্টির কাছে বিশ্ব নিজেকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই আঁধারী সময়ের সম্পদ মাইলের পর মাইল জুড়ে পরিষ্কার দেখা যায়। কিন্তু মনের গভীরে আমার ভয় হয়, এই বুঝি আমি ক্রীতদাসের দেশে ফিরে এসেছি, এবং এবার এই দেশের আমার ওপর নজর পড়েছে।’
হাই এর জন্য বাড়ি এখন আর একটা স্থান নয়, এটা এখন একটা মনের অবস্থা,যার অবস্থান তার প্রিয়জনের মাঝে যারা তাকে ভালোবাসে। যখন হাই ভাবে, ‘আমি জীবনে কদাচিত কাউকে বিদায় জানাবার অধিকার লাভ করেছি,’ তখন সে যেন ক্রীতদাসপ্রথায় বন্দী মানুষের মানবিক সম্পর্কের বেদনাবিদ্ধ বাস্তবতার সারকথাটি বলে। এখানে ভালোবাসা যায়, কিন্তু অধিকার লাভ করা যায় না। হাই-এর মতে সেই ভালো। কারণ মানুষের কখনো একে অপরের অধিকার লাভ করে সমীচীন নয়, এমনকি উদ্দেশ্য নিঃস্বার্থও হলেও নয়।
অবশেষে হাই আবিষ্কার করে যে মুক্তি সম্বন্ধে তার নিজের মত যাই হোক না কেন, অন্যে কীভাবে তার স্বরূপ নির্ণয় করবে সেটা হাই-এর ওপর নির্ভর করে না। এমনকি কেউ যদি খাঁচায় বন্দী থাকার পথও বেঁছে নেয়, সে তাঁদের ওপর তার নিজের মুক্তির ধারণা চাপিয়ে দিতে পারেনা। প্রতিটি মানুষকে তার নিজ নিজ মুক্তির স্বপ্ন অনুযায়ী এগোতে হবে। উপন্যাসের একটি চরিত্রের ভাষায়, ‘এই নরক থেকে সবাই বের হয়ে আসতে চায়। কীভাবে বের হবে, সেটাই আসল কথা।’
হাই যদিও কিছুটা শান্তি লাভ করে, তবুও কোথায় একটা ছায়া রয়ে যায়। এখনো যেই অনাচার চলতে থাকবে, সেটা নিয়ে তার মনে তিক্ততা রয়ে যায়। অতিবাস্তব ক্ষমতাও এই মর্ত্যে তার জীবনের নিশানা নির্ধারণ করার শক্তি দিতে পারে না। বহু শতাব্দীর অবিচার খণ্ডন বা সংশোধন করা সেই ক্ষমতার সাধ্যের অতীত। তার ক্ষমতা নেই চিরস্থায়ী সুবিচার সৃষ্টি করবার।
LISTEN TO A SAMPLE FROM THE WATER DANCER (OPRAH’S BOOK CLUB)
আশফাক স্বপন ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী উপমহাদেশীয় সংবাদ মাধ্যমে সাংবাদিকতা করছেন। বর্তমানে ঢাকার Daily Star ও কালি ও কলম পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। তার লেখা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলো ছাড়াও পাকিস্তানের Dawn, ভারতের Times of India ও Statesman পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আটলান্টায় থাকেন।
No comments:
Post a Comment