পুঁজিবাদের কবলে শিক্ষা
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
১.
গুণ নির্ভর করে মানের ওপর। বাংলা ভাষায় মানের অর্থ একটা নয়, একাধিক; একটা অর্থ মাত্রা, আরেকটা অর্থ সম্মান। মাত্রা অর্থে মানের সঙ্গে সম্মান অর্থে মানের খুবই নিকট আত্মীয়তা। যে বস্তুর মানসম্মান বেশী তার মাত্রাও উঁচু হবে এমনটা প্রত্যাশিত। সম্মান কমলে মানও কমবে। অন্য ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষাক্ষেত্রেও এটা সত্য। বাংলাদেশে শিক্ষার মানও শিক্ষার সম্মানের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে সংযুক্ত।
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। গল্প নয় সত্য ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাতেই রোকেয়া হলের সামনে এক অধ্যাপক রাস্তা পার হচ্ছিলেন। দ্রুতগামী একটি মোটর গাড়ী তাকে প্রায় চাপা দিয়ে ফেলছিল; কিন্তু দেয় নি, গাড়ীটি থেমে গেছে, ভেতর থেকে আরোহী বের হয়ে এসে অধ্যাপককে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, বন্ধু, তোমার কাছে আমি কত যে ঋণী তা তুমি জানো না।' তারপর তিনি ঋণের কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এবং সংক্ষেপে জানালেন। বললেন, তুমি সাহায্য করেছিলে বলেই আমি দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়েছিলাম, আরও বেশী যে সাহায্য করোনি তার জন্যও আমি বিশেষ ভাবে ঋণী, কারণ সেটা করলে আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রান্তিক অবস্থানে না গিয়ে কিছুটা উঁচুতে থাকতাম, মাস্টার হতাম কলেজে, জীবন হতো অধঃপতিত। দ্বিতীয় শ্রেণীতে নীচু স্থান পেয়ে ইপিসিএস দিলাম, পেলাম কাস্টমস, তাতে দেখো আমার দাপট। আর খোদা না করুন যদি তোমার মতো ফাস্ট ক্লাস পেয়ে যেতাম, তাহলে আমার দশাও তোমার দশাই হতো। তারপর হাসাহাসি করে পরস্পরের পিঠ চাপড়িয়ে তারা বিদায় নিয়েছিলেন।
এটা পাকিস্তান আমলের ঘটনা। সে রাষ্ট্রটি ছিল ঘৃণিত, আমরা স্বপ্ন দেখতাম মুক্তির; মুক্তি আমরা পেয়েছি বলেও প্রচার আছে, তবে শিক্ষার মানমর্যাদা কী বেড়েছে, নাকি কমেছে? মানতেই হবে সত্য তো এটা যে মানসম্মান বৃদ্ধি পায় নি, হ্রাস পেয়েছে। তবে শিক্ষার মান জিনিসটা কেবল যে শিক্ষার মানসম্মানের ওপর ভর করে থাকে তা নয়, দেশের মানসম্মানের বৃদ্ধির ওপরও শিক্ষার মানের ওপরে ওঠাটা নির্ভর করে। এরা পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। পানি যেমন একই স্তরে থাকাটা পছন্দ করে শিক্ষার মানও তেমনি দেশের মানসম্মানের স্তরেই রয়ে যায়।
স্বাধীনতার পরে যুদ্ধের কারণে দেশের মানসম্মান বেড়েছিল, তারপর সেটা ক্রমাগত নেমেছে। এই লেখা লিখতে লিখতেই খবর পড়লাম বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ দেশগুলোর একটি; অথচ এখন এখানে কোনো যুদ্ধ নেই, পরিবেশ শান্ত, এবং উন্নতির ধারা অব্যাহত। মাস দুয়েক আগে খবরের কাগজে শিরোনাম পড়েছি বায়ুদূষণে মৃত্যুর ঝুঁকিতে বাংলাদেশের স্থান এখন শীর্ষে। আরও জানা গেল যে বাংলাদেশে গত দশ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে সাড়ে পঁচিশ হাজার মানুষ । এটা সরকারী হিসাব, বেসরকারী হিসাব বলবে সংখ্যা আরও অধিক, আহতের সংখ্যা হিসাব করা নিশ্চয়ই কঠিন। ওদিকে ঘরে বাইরে পথে ঘাটে যে ভাবে গণধর্ষণ, শিশুধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যা, এমনকি মৃত নারীকে ধর্ষণের সব খবর পাওয়া যায় তাতেও একটা সত্যেরই সমর্থন মেলে, সেটা হলো, জীবনের নিরাপত্তার উন্নতি ঘটে নি, বরঞ্চ অবনতিই পরিস্ফুট; ওদিকে অভাবের দরুন আত্মহত্যার ঘটনাও বাড়তির দিকেই। নিরাপত্তাহীনতা যে শিক্ষার জন্য অনুকূল নয় সেটা তো জানা কথা। একাত্তর সালে বাংলাদেশের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিল, তখন দেশের শিক্ষার চর্চা সম্ভব ছিল না।
শিক্ষার মান আর শিক্ষকের সম্মান, এরাও অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশে শিক্ষকদের সম্মান কতটা বেড়েছে তা কোনো লুকানো ব্যাপার নয়। ইউএনও গেছেন পরীক্ষা কেন্দ্রে, তাঁর পরিচয় জানতে চেয়েছেন কর্তব্যরত শিক্ষক। এই অপরাধে শিক্ষকের কঠিন শাস্তি হয়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে রক্ষা পেয়েছেন, আনুষ্ঠানিক ভাবে মাপ চেয়ে। পরে জানা গেছে সেই প্রশাসক এবং ওই শিক্ষক বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে, একই সময়ে সরকারী চাকরীতে ঢুকেছিলেন; একজন গেছেন প্রশাসনে অপরজন শিক্ষায়, দু’জনের বন্ধুত্ব থাকার কথা, কিন্তু অবস্থা এমন যে এখন শিক্ষককে নতজানু হতে হয় প্রশাসকের কাছে। এ খবর পত্রিকায় এসেছে।
স্বভাবতঃই শিক্ষার মান বাড়ছে না। বিশ্ব জরীপে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই সম্মানজনক উল্লেখ নেই। ওই জরীপ কী ভাবে তৈরী হয়, তথ্য সরবরাহে ঘাটতি ছিল কি না, এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু এই সত্য কেউ অস্বীকার করবেন না যে মান উঠছে না, নামছেই। এবং সেটা অবশ্যই দুশ্চিন্তার ব্যাপার। কিন্তু শিক্ষার মান কিছুতেই বাড়বে না যদি শিক্ষার মানসম্মান বাড়ানো না যায়। বাংলাদেশে এখন মান বাড়ছে একটা জিনিসেরই, সেটা হলো টাকা। টাকায় সব কিছুই কেনা যায়, কেনা যায় শিক্ষাও। কেবল কেনা যায় না, টাকা না থাকলে শিক্ষাকে আয়ত্তে আনা অসম্ভব। যে জন্য হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রাথমিক স্তরেই ঝরে পড়ে, তারপরেও ছিটকে পড়ে যাওয়া সংখ্যা বাড়তেই থাকে। যাদের টাকা নেই, তাদের শিক্ষাও নেই, মানসম্মত শিক্ষার কথা দুরে থাক। একটি গল্প চালু আছে; ঈশপের আধুনিক গল্প, যাতে আমাদের বর্তমান অবস্থাটা সুন্দর ভাবে ধরা পড়ে। হাতী যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে, বেড়াতে। রোজই যায়, আর বোজই দেখা যায় অন্যরা সরে দাঁড়ায়, সম্মান করে, কিন্তু একটি ব্যাঙ লাফিয়ে উঠে হাতীর গায়ে লাথি মারে। বেচারা হাতী আর কী করে, ব্যাঙের সাথে তো লড়াই চলে না। কিন্তু অন্যদের কৌতূহল বাগ মানে না, তারা জানতে চায় ব্যাঙ কী করে এমন সাহসী হলো যে সে হাতীকে লাথি মারে। গোয়েন্দা তদন্তে প্রকাশ পেল যে ব্যাঙটি যেখানে বসে থাকে তার নীচে একটা পুরানো টাকা আছে পোতা; তার গরমেই ব্যাঙের অমন সাহস ও দম্ভ। সাধারণ ব্যাঙ নয়, যে ব্যাঙ টাকার গরমে তপ্ত সেই শুধু পারে হাতীকে ওই ভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে। এই গল্পের গরম ব্যাঙ ও নরম হাতীর সম্পর্কটা বহুক্ষেত্রেই সত্য, সত্য সে বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রও। জ্ঞান এখানে বেশ কুণ্ঠিত অবস্থায় আছে, টাকা ও টাকাওয়ালাদের দাপটে।
ধানের ব্যাপারটা তো আর গল্প নয়। ধানের দাম পড়ে গেছে, কাণ্ডটা ঘটেছে। মিলমালিকদের কারসাজিতে। মিলমালিকরা টাকাওয়ালা, গরীব ধানচাষী অসহায় শ্রমিক বটে, তাই তার দুরবস্থা। বাজারে এখন জ্ঞানের ও ধানের একই অবস্থা, এবং তারা পরস্পর-সম্পর্কিত এই দিক থেকে যে উভয়েই টাকার কারণে অবমূল্যায়িত, এবং টাকার দ্বারা শাসিত। উন্মুক্ত বাজার টাকা চেনে, কোনটা ধান আর কোনটা জ্ঞান তা তার জানার দরকার নেই, এবং বাজারের পক্ষে এটাতো কোনো বিবেচনার বিষয় নয় যে ধান ছাড়া দেশের মানুষ প্রাণে মরবে, জ্ঞান ছাড়া মরবে মনে।
২.
ধানের মতোই জ্ঞানও শ্রামেরই ফসল । বিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা হয়, সেখানে দুটি পক্ষ থাকে; শিক্ষক এবং ছাত্র। এদের মিলিত শ্রমেই শিক্ষার অনুশীলন। শিক্ষার মান সরাসরি নির্ভর করে শিক্ষকের মানের ওপর। শিক্ষকও একজন কর্মী। তিনি জ্ঞান আহরণ করেন, এবং বিতরণ করেন। কিন্তু শিক্ষক কেবল যে দাতা তা নয়, তিনি গ্রহীতাও। ছাত্রের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করেন আগ্রহ ও প্রাণবন্ততা। ছাত্র আগ্রহী হলে শিক্ষকের আগ্রহ বাড়ে; ছাত্রের কৌতূহল, উচ্ছলতা শিক্ষককে প্রাণবন্ত করে তোলে। ছাত্রের প্রশ্ন ও কৌতূহল শিক্ষককে পাঠদানের বিষয়কে আরও ভালোভাবে জানার ব্যাপারে উৎসাহী করে। শিক্ষকতার কাজটা তখন জীবিকার্জনের একঘেয়ে গ্লানিকর কর্তব্য থাকে না। শিক্ষক চরিতার্থতা পান; যে চরিতার্থতা শিক্ষাদানের জন্য একান্ত অপরিহার্য। ভালো শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে বেতন-ভাতার তুলনায় এই চরিতার্থতা কম মূল্যবান নয়। ভালো শিক্ষক না পেলে তো শিক্ষার গুণ ও মান বাড়বে না। বাংলাদেশে ভালো শিক্ষক পাওয়াটা এখন বড় একটা সমস্যা।
কিন্তু শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র ও উন্নত বেতন স্কেল তো বাস্তবে নেই। আর তার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষাখাতে সরকারের ব্যয় বরাদ্দ আনুপাতিক হারে বাড়ছে না, জাতীয় বাজেটের ১১ শতাংশের ওপরে সেটা কিছুতেই ওঠে না, ভীষণ তার গড়িমসি। জিডিপি’র শতকরা ২ ভাগ বরাদ্দ করলে কিছুই চলবে না, অন্তত ৬ ভাগ বরাদ্দ চাই। অনুৎপাদক ও আমলাতান্ত্রিক খাতগুলো থেকে টাকা কেটে সেটা নিয়ে আসা চাই শিক্ষায়।
কিন্তু সমস্যাটা কেবল বরাদ্দের নয়, বরাদ্দের যথাযথ খরচেরও। টাকা কেবল ঢাললেই চলবে না, দেখতে হবে ঠিক জায়গাতে গিয়ে পড়ছে কি না। দুর্নীতি কত যে ব্যাপক সে তো আমরা জানি। পুলিশের ডিআইজি যখন স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালককে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা নগদ ঘুষ দেয় তখন তো বোঝাই যায় যে নজরদারীটা কত দুর্বল। আর ফাস-হয়ে-যাওয়া এ খবর তাৎপর্যও উপেক্ষণীয় নয় যে একজন শিক্ষাকর্মকর্তা ওই দুর্নীতি দমন কমিশনেরই একজন কর্মকর্তার সঙ্গে ঘুষের অঙ্কটিকে এক কোটি থেকে পঞ্চাশ লক্ষতে নামিয়ে আনা যায় কি না এ নিয়ে দরকষাকষি করছেন। অন্য ক্ষেত্রের মতোই শিক্ষাক্ষেত্র দুষ্ট হবার পরে এখন নষ্ট হবার পথে রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এটা আমরা জানি, আর এটাও জানি, বাধ্য হই জানতে যে, শিক্ষক হতে হলে নগদ টাকা ঘুষ দিতে হয়, আর সে-টাকা যে সামান্য তা নয়, বিপুল পরিমাণেরই। নজরদারী তাই অত্যাবশ্যক। তবে তার জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, সামাজিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে। অভিভাবকদের এগিয়ে আসা চাই। সমাজে সৎ লোক যে নেই তা নয়, সংখ্যায় তারাই অধিক, কিন্তু তাদের ক্ষমতা নেই, কারণ তারা বিচ্ছিন্ন, অন্যক্ষেত্রে যেমন এক্ষেত্রেও তেমনি সন্মানুষদের ঐক্য চাই। আবার শুধু যে সরকারী বরাদ্দেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলবে এমনও নয়। বেসরকারী দান অনুদানও আসতে হবে। কিছু কিছু আসেও; আরও আসবে যদি আবহাওয়া তৈরী করা যায়। আবহাওয়া এখন বিরূপ। প্রকৃতিরও, সমাজেরও।
বিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষকের মিলন কেন্দ্র ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশী কিছু । বিদ্যালয় হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠান; যেখানে বিদ্যার চর্চা হয় সামাজিক ভাবে, এবং সাংস্কৃতিক ভাবেও। সামাজিকতাটাই প্রধান। একজন শিক্ষার্থী যখন বাড়ী থেকে বিদ্যায়তনে আসে, তখন ছােট জায়গা থেকে বড় জায়গায় তার প্রবেশ ঘটে। জায়গাটা মুক্তির। শিক্ষার্থীর জন্য একেবারে প্রথম শিক্ষাটাই হলো সামাজিকতার। এই শিক্ষা তার বাকি জীবনের জন্য হবে সবচেয়ে বড় সংগ্রহ। পরে তার জ্ঞান বাড়বে, বাড়বে তার সামাজিকতাও। সামাজিকতাটা বিঘ্নিত হয় যদি সে আনন্দ না পায়, যদি মনে করে সে মুক্ত প্রাঙ্গণে আসে নি, এসে পড়েছে কয়েদখানায় কিংবা কারখানায়। সে ক্ষেত্রে তার শিক্ষা গ্রহণের ক্ষমতা যাবে সংকুচিত হয়ে।
এখন ওই সংকোচনটা বড় বেশী ঘটছে। শিক্ষা যা দেওয়া হচ্ছে সেটা পর্যাপ্ত নয়, আর যেটুকুই বা দেওয়া হচ্ছে তাও শিক্ষার্থী ঠিক ভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। তার সার্বক্ষণিক ভয় পরীক্ষার। আমাদের বিদ্যায়তনিক শিক্ষা সবসময়েই ছিল পরীক্ষামুখী, এখন সেটা রীতিমত পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। পড়ানো যা হচ্ছে তা পরীক্ষায় পাশের জন্য। পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, এবং চেষ্টা হয়েছিল একেবারে প্রাথমিক স্তরেই পরীক্ষার হলে শিশুদেরকে টেনে আনার। আশা করি সেটা পরিত্যক্ত হবে। পরীক্ষা যত কম হয় ততই মঙ্গল, বিশেষ করে পাবলিক পরীক্ষা। পরীক্ষার ব্যাপারে চাপ যত বাড়ে মূল বই পড়ার প্রয়োজন তত কমে যায়। শিক্ষার্থীরা প্রশ্নের উত্তর রপ্ত করতে ব্যস্ত থাকে, শিক্ষার দিকে মনোেযোগ না-দিয়ে । শিক্ষকরাও ওই ভাবেই পড়ান। ছাত্রদেরকে ভালো নম্বর পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করাটাই শিক্ষক হিসেবে তাদের সাফল্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নিরিখ হয়ে দাঁড়ায়। আর পরীক্ষায় যে এম সি কিউ প্রশ্নরীতি চালু হয়েছে এটা খুবই ক্ষতিকর। এতে শিক্ষার্থীরা এমনকি প্রশ্নটাও ভালো করে বুঝতে চায় না। এ বি সি ডি-তে দাগ দেবার কায়দা শেখে। আরেক উৎপাত সৃজনশীল পদ্ধতি। এটা শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক কেউই ঠিক মতো বোঝেন না। ছাত্ররা তো বটেই শিক্ষকরাও গাইড বুকের শরণাপন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা, এম সি কিউ, সৃজনশীল পদ্ধতি, সবকিছুই একত্র হয় কোচিং সেন্টার ও গাইড বুক ব্যবসাকে সরগরম করতে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার কথা ধরা যাক। সবাই বলেন শিক্ষার মান এখানে বেশ ভালো ভাবেই নেমে গেছে। বাড়িয়েই বলেন কারণ মান যে অতীতে খুব উঁচু ছিল আর এখনও যে একেবারে অধঃপতিত তা নয়, আসলে যা কমেছে তা হলো শিক্ষার্থীদের আগ্রহ। শিক্ষার্থীরা আগের তুলনায় কম আগ্রহী। তারা আসে, থাকে, চলে যায়; কিন্তু শিক্ষার ব্যাপারে তাদের প্রবল আগ্রহ দেখা যায় না। এর কারণ আছে। মূল কারণটা ভবিষ্যৎ দেখতে না-পাওয়া। অধিকাংশের চোখেই স্বপ্ন নেই, মুছে গেছে। যাদের আছে তাদেরটাও ম্রিয়মান। শিক্ষার্থীরা জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা দেখতে পায় না। এই অনিশ্চয়তা আগের দিনেও ছিল; কিন্তু তখন তবু আশা করা যেত যে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে, এখন সে আশাটা ক্ষীণ। দেশে যে উন্নতি হয়েছে তার দুর্বলতাগুলোর মধ্যে খুব বড়মাপের একটি হলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া। উন্নতি যা হয়েছে তার প্রায় সবটাই শ্রমের কারণেই; কিন্তু বিনিয়োগ ঘটছে না। কর্মের বিপুল শক্তি আটকা পড়ে গেছে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার জাঁতাকলে। বেকারত্বের সমস্যাটা ক্রমাগত বাড়ছেই; বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা তো এখন ভয়াবহ। যে তরুণ আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে; তার দুশ্চিন্তা হয় বের হয়ে কি করবে। পড়ালেখায় তার সেই দুর্দান্ত আকর্ষণটা নেই যেটা থাকা আবশ্যক ছিল। ছাত্রের এই অনাগ্রহ, শিক্ষককে নীরবে পীড়িত করে; জ্ঞানের অনুশীলনটায় প্রাণের ঘাটতি ঘটে যায়।
শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর গ্রহণক্ষমতা আসলে খুবই বড় ব্যাপার। আগ্রহের অভাব ঘটলে গ্রহণক্ষমতা হ্রাস পায়। হ্রাস প্রাপ্তির অবশ্য আরও কারণ আছে। সেগুলোর একটা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক জীবনের স্তিমিতদশা। শিক্ষার অনুশীলন কেবল ক্লাসে, লাইব্রেরীতে ও লেবরটারিতেই চলে না, ঘটে ছাত্রাবাসে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, পরস্পরের মেলামেশায়। এবং ছাত্রসংসদের নির্বাচনে। এটা অবশ্যই তাৎপর্যহীন নয় যে বিগত আঠাশ বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদের কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি; এমনটা পরাধীনতার আমলে কখনো ঘটে নি; না ব্রিটিশ শাসনে, না পাকিস্তানী শাসনে। এটা সার্বিক ব্যবস্থারই একটি প্রতিফলন। বোঝা যাচ্ছে প্রচারকার্য যতোই চলুক, সারবস্তুতে গণতন্ত্র আসে নি। ছাত্রসংসদ হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রাণবন্ততার কেবল ধারক এবং বাহকই নয়, প্রধান উদ্যোক্তাও। ছাত্র সংসদের নির্বাচন শিক্ষার্থীদের জন্য উৎসব, মেধাবানদের জন্য সামাজিক স্বীকৃতি লাভের সুযোগ, এবং সাংস্কৃতিক জীবনকে সজীব রাখার কর্মাধ্যক্ষ। শিক্ষাঙ্গন যদি আলোচনায়, বিতর্কে, নাটকে, গানে, সাহিত্যসৃষ্টিতে, খেলাধুলায়, জ্ঞানীদের বক্তৃতায় মুখরিত না থাকে তাহলে তো শিক্ষাঙ্গন তার প্রাণই
পুঁজিবাদের কবলে শিক্ষা ৭১ হারিয়ে ফেলে । দেখা দেয় আবিলতা। ছেলেমেয়েরা টের পায় যে সুস্থ বিনোদন নেই, আদান-প্রদান নেই চিন্তার ও কল্পনার, অনুশীলন নেই সাংস্কৃতিক মেধার, বিকাশ নেই নেতৃত্ব দানের শক্তির। তারা হতাশ হয়, অবসাদে ভোগে, মাদক ধরে কেউ কেউ, অন্যরা ঝিমায়, দেখা দেয় কলহ-বিবাদ । আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। আর অতীতে যা কখনো শোনা যায় নি তা এখন শোনা যায়। সেটি হচ্ছে যৌন হয়রানি। চরম দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘটনায় যেখানে তথাকথিত এক ছাত্র ধর্ষণের শতসংখ্যা পূর্তির ঘোষণা দিয়েছিল। যৌন হয়রানির অভিযোগ কেবল ছাত্রদের নয়, শিক্ষকদের ব্যাপারেও উঠছে। সােনাগাজীতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ যখন ছাত্রীকে হয়রানি করে এবং ছাত্রী তার প্রতিবাদ জানালে অধ্যক্ষটি যখন তার রাজনৈতিক আর্থিক প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে জীবন্ত অবস্থায় ছাত্রীটিকে পুড়িয়ে মারে তখন একটি চরম বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে বিদ্যালয়ে মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার বাস্তবতাটা যে কতদূর প্রসারিত হয়েছে সেই সত্যটাই বের হয়ে আসে।
৩.
শিক্ষার ব্যাপারে এই ধরনের বিভিন্ন অসুবিধার কথা আমরা বলতে পারবো, বলবোও; কিন্তু মূল প্রতিবন্ধকতাকে যেন না ভুলি। সেটা হলো তিন ধারার শিক্ষা। তিন ধারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবে কি, উল্টো বিভক্ত করছে। এবং বিভাজনটা ঘটছে শ্ৰেণী পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করেই। জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হয়, কিন্তু ঐক্য যে নষ্ট করা হচ্ছে শিক্ষার মধ্য দিয়েই সেই সত্যটা অস্বীকতই রয়ে যায়। শিক্ষা সংস্কারের জন্য কমিশন ও কমিটি নিয়মিত গঠিত হতে থাকে, কিন্তু কোনো সংস্কারকই বলতে পারে না, হয় তো সাহসই করে না বলতে, তিন ধারাকে কী করে এক ধারাতে নিয়ে আসা যাবে। কারণ এটা তো স্পষ্ট যে এটি সংস্কারের ব্যাপার নয়, ব্যাপার সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে এদেশের মানুষ যুগের পর যুগ ধরে সংগ্রাম করেছে, যে-সংগ্রামের একটি বড় পর্যায় ছিল একাত্তরের ওই মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত হয়েছে, কিন্তু মানুষের মুক্তি আসে নি। আসার কারণ সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন না হওয়া। আর না-হওয়ার অনেক প্রমাণের একটি হচ্ছে তিন ধারার শিক্ষা।
তিন ধারা আগেও ছিল। ব্রিটিশ আমলে ছিল, পাকিস্তানের কালে সেটা বিকশিত হচ্ছিল, বাংলাদেশে এই বিভাজন থাকার আপাত-গ্রাহ্য কোনো অজুহাত ছিল না। সুবিধাভোগী বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা পড়বে ইংরেজী মাধ্যমে, মধ্যবিত্তের জন্য রইলো বাংলা মাধ্যম, আর যারা গরীব তাদের জন্য মাদ্রাসা, এটা তো ব্রিটিশ রাষ্ট্রের বিধান। সেই রাষ্ট্র শ্রেণীভেদকে জিইয়ে রাখতে চেয়েছিল, এবং শিক্ষাকে বিভেদ সৃষ্টির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার বাসনা পোষণ করতো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল; ধারণাটি যে ভ্রান্ত ছিল তার বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে, খুব পরিষ্কার প্রমাণ এটা যে তিন ধারার শিক্ষা রয়ে গেল। রাষ্ট্র চাইছিল সেটা থাকুক। কারণ রাষ্ট্র ছিল ব্রিটিশের উপনিবেশিক রাষ্ট্রের একটি নতুন সংস্করণ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধটা উপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোকে ঠিক রেখে বড় রাষ্ট্র ভেঙে একটি ছােট রাষ্ট্র তৈরী করার ছিল না, ছিল পুরাতন রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলে নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার, যেটি হবে গণতান্ত্রিক, অর্থাৎ শ্ৰেণী বৈষম্যবিহীন। কিন্তু সে রাষ্ট্র আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি নি; কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা যাদের হাতে চলে গেল শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা পূর্ববর্তী রাষ্ট্রশাসকদের মতোই পুঁজিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক চরিত্রেও তাদের আপত্তি ছিল না। ফলে দেখা গেল রাষ্ট্রের বাইরের পরিচয় যাই হােক অন্তর্গত স্বভাব চরিত্রে কোনো পরিবর্তন এলো না। দেশে সরকার বদল হয়েছে, একটির পর আরেকটি এসেছে, কিন্তু দেখা গেছে তারা অন্য ব্যাপারে ভিন্ন, এমন কি কোনো কোনো ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী হলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পুঁজিবাদের প্রতি পক্ষপাতে অভিন্ন। যে জন্য সংবিধানে উল্লেখিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে একটি সরকার এসে কেটে ফেললো, কিন্তু পরের কোনো সরকারই তাকে আর ফেরৎ আনতে আগ্রহ প্রকাশ করল না। সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার এখন অতীতের বিলুপ্ত স্মৃতি।
একধারার শিক্ষার ভিত্তিটা কী? সেটা হলো মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা। সকল শিক্ষা অবশ্যই এক প্রকারের হবে না, ভিন্নতা থাকবে, কিন্তু সকল শিক্ষাই হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে, সার কথা এটাই। এ বিষয়ে তো কোনো দ্বিমত নেই যে শিক্ষার জন্য মাতৃভাষাই সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। আসলে মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ গভীর স্থায়ী স্বাভাবিক ও সৃষ্টিশীল, এগুলোর কোনোটাই হতে পারে না। তদুপরি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাই ঘটেছে বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী-নিয়েই এই সংগ্রামের সূচনা। বাংলা যে এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হবে এ নিয়ে কোনো দ্বিমত ছিল না; এবং মাতৃভাষার সেই স্বীকৃতি লাভে কোনো বিলম্বও ঘটে নি। কিন্তু দেখা গেছে যে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলো বটে কিন্তু রাষ্ট্রের ভাষা হলো না। উচ্চ আদালতে বাংলা কখনোই চালু ছিল না, স্বাধীন বাংলাদেশেও চালু করা যায় নি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমের অগ্রগতি অত্যন্ত সীমিত; কোনো কোনো এলাকাতে তো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এটাও স্মরণীয় যে বাঙালীর সংখ্যা বাংলাদেশেই সতের কোটি ছুঁই ছুই, বাঙালী অন্যত্র এবং অন্য রাষ্ট্রেও আছে, সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ত্রিশ কোটির কাছাকাছি হবার কথা। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তো নয়ই, এমনকি নিম্নতর স্তরেও শিক্ষালাভ করতে পারছে না। এটা বাঙালীদের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়।
সবচেয়ে বড় কথা এই যে, মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে শিক্ষা লাভ না করাতে তাদের শিক্ষা মোটেই মানসম্মত হচ্ছে না। বাংলাদেশে যদি আমরা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারতাম তাহলে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে যেতে। বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হতো, শিক্ষার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটতো, এবং আমরা নিজেরাও বদলে যেতাম। প্রকৃত উন্নতি আটকে যেতো না শ্রেণীর খাদে পড়ে।
তিন ধারা এক হলে বিত্তবানেরা মূলধারার ব্যাপারে এখন যে উদাসীনতা দেখাচ্ছে সেটা দেখাতে পারতো না। কারণ অভিন্ন শিক্ষার মানের সঙ্গে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে পড়তো। এখন তো দেখা যাচ্ছে ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষার মান নিয়ে কোনো সংশয় নেই; সে-মান নামছে না; সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস নেই, সেশনজট ঘটে না, সিলেবাসে ও ক্যারিকুলামে রদবদল হয় না; সরকারী সিদ্ধান্তে পরীক্ষার ফলের ইতরবিশেষও ঘটে না। বিত্তবান অভিভাবকেরা তাই সন্তানদের ওইসব বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিত থাকেন। মূলধারায় নিমগতিতে তাদের কোনো ক্ষতি নেই। সুবিধাই আছে, কারণ মূলধারার শিক্ষার্থীরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আসবে না। শিক্ষা এক ধারাতে থাকলে এরা সেই ধারার উন্নতিতে সচেষ্ট হতেন; সেখানে অর্থ, যত্ন ও উদ্বেগের বিনিয়োগ ঘটাতেন। আর রাষ্ট্র যেহেতু তাদেরই কর্তৃতাধীন তাই সরকারী মনোযোগের অভাব ঘটতো না। যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষার জন্য ব্যয় হয় সেটা চলে আসতো মূলধারাতে। আসততা দান অনুদান, ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশন। শিক্ষার মানসম্মান অনেক বৃদ্ধি পেতো।
পশ্চিমবঙ্গে এখন দেখছি সরকারী দল আওয়াজ তুলেছে ‘জয় বাংলা’র। বিজেপি দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে এখন বাঙালী সত্তাকে জাগিয়ে ভোলা আবশ্যক-উপলব্ধিটা এই রকমেরই। বিজেপির আগ্রাসনের ভেতর রয়েছে হিন্দী ভাষার আধিপত্যবাদিতা। হিন্দী বাংলাকে দখল করে নেবে, এই বিপদের কথাটা ভেবে সেখানকার অনেক মানুষ এখন সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন চাইছে। আমাদের বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, সেখানেই যখন বাংলাকে ব্যবহার নিয়ে আমরা এত অসুবিধার ভেতর আছি তখন বিশাল ভারতের ছােট একটি অঙ্গ রাজ্যে বাংলাকে একক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা যে মোটেই সহজ হবে না সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। সাতচল্লিশের সেই ভয়ঙ্কর দেশভাগ বাংলার মানুষের জন্য অনেক দুর্ভোগের কারণ হয়েছে, মস্ত বড় ক্ষতি হয়েছে বাংলা ভাষার। পশ্চিমবঙ্গের বিত্তবানরা তখন ভয় পাচ্ছিলেন মুসলিম আধিপত্যের, এখন সেখানকার বাঙালীরা বিপদগ্রস্ত হিন্দীর অগ্রাভিযানে। যে কলকাতাকে তারা পাকিস্তানের হাত থেকে রক্ষা করবেন ভেবেছিলেন সেই শহর এখন আর বাঙালীদের নেই। ওদিকে আক্রমণটা যে কেবল হিন্দীর তা তো নয়, ইংরেজীরও। হিন্দীকে রোখার চাইতেও কঠিন কাজ ইংরেজীকে রোখা, যেমনটা আমরা টের পাচ্ছি। উর্দুকে চাপানোর অভিসন্ধিকে আমরা পরাজিত করেছি, কিন্তু ইংরেজীর জন্য পথ দিয়েছি খুলে। মূল শত্রুটা পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। মাতৃভাষা লড়াইটা আসলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই ।
৪.
স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশে এখনো আমরা বাংলা প্রচলনের লড়াইতে আছি। এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয় মানুষকে মুক্তি দেবার অঙ্গীকার নিয়ে। এর সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রধান চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক। সাতচল্লিশে আমরা যখন স্বাধীন হই তখন দুর্ভিক্ষের অবস্থা তৈরী হয়েছিল, একাত্তরের পরেও দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে; সে বিপদ কাটিয়ে উঠে যে চ্যালেঞ্জটা রয়ে গেল সেটা বাংলাভাষাকে সর্বক্ষেত্রে ও সর্বস্তরে ব্যবহার করার । সুস্পষ্ট কর্তব্য ছিল বাংলাকে উচ্চস্তরে শিক্ষার মাধ্যম করা। উচ্চ শিক্ষায় বাংলার ব্যবহারের উদ্যোগ পাকিস্তান আমলে যে নেয়া হয় নি তা নয়। উর্দুর উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলা উন্নয়নের চেষ্টাও রাষ্ট্রকে করতে হয়েছে, বাংলা উন্নয়ন বোর্ড নামে একটি সরকারী সংস্থার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল যার মূল কর্তব্য ছিল বাংলা ভাষায় উচ্চপর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা। সে কাজ অবশ্য বেশী দূর এগোয় নি। স্বাধীনতার পরে ওই বোর্ডটি আর থাকে নি, বাংলা একাডেমীর সঙ্গে মিশে গেছে। প্রত্যাশিত ছিল যে একাডেমী বোর্ডের কাজটিকে আরো বিস্তৃত করবে; সকল বিষয়ে উন্নত মানের পাঠ্যপুস্তক ও অনুষঙ্গী বই পাওয়া যাবে। কাজটা শুরুও হয়েছিল; কিন্তু এগোয় নি, এখন তো প্রায় পরিত্যক্ত ।
বাংলাভাষায় জ্ঞানের চর্চাকে উন্নত এবং সেই সাথে ভাষার ধারণ ও প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ছিল মৌলিক গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি অন্যভাষা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বই প্রচুর পরিমাণে ও ক্রমবর্ধমান হারে অনুবাদ করা। অনুবাদের কাজটা মোটেই সহজ নয়, ক্ষেত্রবিশেষ মৌলিক সৃষ্টির চেয়েও কঠিন। অনুবাদ করতে হয় সতর্কতার সাথে, মূল রচনাকে যথার্থ ভাবে পাঠ করে। অর্থবিকৃতি অমার্জনীয়, যান্ত্রিকতা পরিহার্য। একাজে মূল ভাষা ও বাংলা ভাষা, দুটোতেই বিস্তর জ্ঞান দরকার। আর কাজটা কখনোই একা করা সম্ভব নয়। অন্যকে দেখাতে হয়, পরামর্শ নেওয়ার দরকার পড়ে, সম্পাদনা ও সংশোধন ছাড়া চলে না। আমরা বলছি ও শুনছি যে; বাংলাদেশে এখন গবেষণার মান ও পরিমাণ সন্তোষজনক নয়; বরাদ্দ অল্প, যেটুকু আছে তাও ঠিকমত খরচ হয় না; অনুবাদের বেলাতে দৃশ্যটা আরও করুণ; সেখানে বরাদ্দে প্রায় হাতই পড়ে না, অব্যবহৃত রয়ে যায়। অনুবাদের উদ্যোগ তেমন একটা দেখা যায় না, প্রেরণাও নেই। বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাকালীন মূল অঙ্গীকার ছিল তিনটি; গবেষণা, সংকলন ও অনুবাদ। পরবর্তীতে দেখা গেছে তার আয়োজনে গবেষণা অল্প, সংকলনও উল্লেখযোগ্য নয়, অনুবাদ একেবারেই কম। আর সংকলনের ক্ষেত্রে তাদের প্রধান কৃতিত্ব যদিও অভিধান প্রস্তুত করা, এবং সে কাজ মোটামুটি প্রশংসনীয়ও; কিন্তু বাংলা অভিধানের ক্ষেত্রে তারা যে কারগুলোকে নির্বিচারে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন তাতে বাংলাভাষার কোনো উপকার হয় নি; শিক্ষার্থীরা পড়েছে বিভ্রান্তিতে, আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্নতার । রচনাবলী’কে তাঁরা রচনাবলি করছেন, যেন হত্যাকাণ্ড। বাংলা ‘একাডেমী’কে নিজের নামে ‘ী'কে কর্তন করার জন্য জাতীয় পরিষদের শরণাপন্ন হয়েছে। এ যেন একটা মহাকীর্তি। বাংলা একাডেমী খুব ভালো করবে যদি বিভিন্ন দিবস উদযাপন ও উৎসব অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মনোযোগ কমিয়ে, এমনকি বইমেলার দায়িত্বটা প্রকাশকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে যেসব কাজের জন্য তার প্রতিষ্ঠান সেদিকে দৃষ্টি দেয়। বাংলাভাষার জ্ঞানচর্চায় এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা উক্তৃষ্ট প্রকাশনাও আশা করি। প্রকাশনা প্রসঙ্গে বলা দরকার যে বইমেলা উপলক্ষে হাজার হাজার বই ছাপা হয় ঠিকই কিন্তু জ্ঞান-সমৃদ্ধ বইয়ের সংখ্যা থাকে একেবারেই অকিঞ্চিতকর। গ্রন্থ প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবার কথা; বস্তুত একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যে নিরিখগুলো দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব তার একটি হচ্ছে প্রকাশনা। এক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা যে প্রশংসা করবো এমন উপায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা যে হয় না তা নয়, হয়; কিন্তু সেগুলো জনসমক্ষে আসে কম, কারণ অধিকাংশ গবেষণাই হয় ইংরেজী ভাষাতে, এবং অনেক গবেষণাই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় না।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সবকিছুর ওপরে রাখে বাজারকে, যেখান থেকে মুনাফা আসবে। শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে এমন বক্তব্যও আমরা পাই যে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নীতি চালু করাই মঙ্গলজনক। শিক্ষা যেন মানুষের জন্মগত অধিকার নয়, শিক্ষা ছাড়া যেন জাতি চলতে পারে। বাজার এখন নিয়ন্ত্রণভার নিয়ে নিয়েছে, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই, শিক্ষাক্ষেত্র বাদ থাকে কী করে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বেলাতে এখন আর কিছু বাকি নেই।
প্রতিষ্ঠাকালে, ১৯২১ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য শিক্ষার কোনো স্বতন্ত্র। বিভাগ ছিল না, পরে স্বতন্ত্র ফ্যাকাল্টি হয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিভাগের সংখ্যা; আইবিএও একসময়ে ছিল না, এখন কেবল আছে যে তা নয়, সেখানে ভর্তিতে প্রতিযোগিতা অত্যন্ত তীব্র, এবং শিক্ষাদান চলে দিবারাত্রি। কলেজে বাণিজ্য শাখায় এখন মেধাবী ছাত্রদের উপচেপড়া ভিড়। এসবই উন্নতির এবং বাজারের শক্তিবৃদ্ধির সাক্ষী। দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন একশ’ ছাড়িয়েছে, এদের বিস্তারের পেছনে বাণিজ্যিক প্রণােদনাই প্রধান, এবং প্রায় সকল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই বাণিজ্য-শাখায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর নির্ভরশীল। ওদিকে মানবিক বিদ্যার চর্চা ক্রমাগত কোণঠাসা হচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পাঠের কোনো বিভাগ নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও দর্শনের দশা ম্রিয়মান। দু'য়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বতন্ত্র বিভাগ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইতিহাসের চর্চায় আগ্রহ কমেছে। ইতিহাস না জানলে অতীতের ব্যাখ্যা, বর্তমানের বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ~-সবকিছুই বিঘ্নিত হতে বাধ্য। আবার ভুল ইতিহাস হচ্ছে বিষের মতো ভয়ঙ্কর। অত্যন্ত উঁচুমাপের ইতিহাসবিদ ছিলেন স্যার যদুনাথ সরকার। তিনি এরকম জানিয়েছেন যে, পলাশীতে ইংরেজের বিজয় ভারতবর্ষের জন্য এক রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, যে রেনেসাঁ ইউরোপের রেনেসাঁর সঙ্গে তুলনাতে মোটেই খাটো নয় বরং বড়ই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত History of Bengal গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে যদুনাথ সরকারের এই রকমের মন্তব্য আছে যে, দুই শত বছরের ইংরেজ শাসন ও প্রতিবেশী ইংরেজ সমাজের দৃষ্টান্ত বাঙালীদের জীবন-যাপন ও চিন্তাধারায় এমন একটি ঐক্য উপহার দিয়ে গেছে যা দিয়ে জাতি সৃষ্টি হতে পারে। এটা লিখেছেন নিশ্চয়ই কিছুদিন আগে, হয়তো ঠিক সেই সময়েই বাঙালী জাতি যখন দ্বিখণ্ডিত হচ্ছিল, এবং যেটা ঘটছিল ইংরেজের শাসনের কারণেই। প্রাতঃস্মরণীয় ইতিহাসবিদরাও যে সবসময়ে নির্ভরযোগ্য হন তা নয়। মূল কথাটা হলো দৃষ্টিভঙ্গির; দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যে সাদা কালো হয়ে যেতে পারে, যেমন কালো পারে সাদা হিসেবে হাজির হতে। মানবিক বিদ্যার গুরুত্ব হ্রাস শিক্ষার জন্য কোনো সুসংবাদ বহন করে না। শিক্ষার উদ্দেশ্যই তো শিক্ষার্থীকে মানবিক গুণসম্পন্ন করা, সে যাতে সংবেদনশীল হয়, বিচ্ছিন্ন না হয়ে সামাজিক হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
আরেকটা কথা; আমরা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে খুব বেশী করে ভাবি। কিন্তু প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে কী ঘটছে তার দিকে তাকাই না। শিক্ষার গুণগত মানটা কেমন দাঁড়াবে সে সিদ্ধান্ত কিন্তু ওই স্তরেই গৃহীত হয়ে যায় এবং যাচ্ছে।
৫.
সার কথাটা দাঁড়ায় এই যে সংস্কার, সংশোধন, পরিবর্তন সবই দরকার; কিন্তু সবার আগে চাই এই সিদ্ধান্ত যে শিক্ষা হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে। আর সেটা হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায় হলো বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ইউনেস্কো যে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছে তার কারণ তো এটাই যে বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদের দৌরাত্মে দুর্বল জাতিগুলোর মাতৃভাষা বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
আবারও স্মরণ করা যাক যে, জ্ঞানের চাষ আর ধানের চাষের ভেতর পার্থক্য অবশ্যই বিস্তর, কিন্তু মিল এইখানে যে দুটোই শ্রমের ফসল। এবং তারা উভয়েই আজ উপেক্ষার পাত্র, যদিও তাদের ওপরই মানুষের প্রধান ভরসা। জ্ঞান এবং ধানের শত্রুপক্ষটিও অভিন্ন; সেটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ যখন আসর জাঁকিয়ে বসছে সেই সময়ে নাট্যকার শেকসপীয়র তার দি মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে দেখিয়েছেন যে পণ্যব্যবসায়ী এন্টনিওর প্রাণ সুদব্যবসায়ী শায়লকের হাতে বিপন্ন। চুক্তির বরখেলাফ হয়েছে দাবী করে শায়লক এন্টনিওর হৃদপিণ্ডের কাছের জায়গা থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতে চায়। আদালত তাকে নিবৃত্ত করতে পারছে না, কারণ আইন অনুযায়ী ওই মাংস শায়লকের প্রাপ্য। এন্টনিওকে বাঁচিয়েছে বিজ্ঞ পোর্শিয়ার হস্তক্ষেপ; সে বলেছে ঠিক আছে এক পাউন্ড মাংস কেটে নাও কিন্তু এক ফোঁটা রক্ত ঝরাতে পারবে না, কারণ চুক্তি ওই অধিকার তোমাকে দেয় নি। পুঁজিবাদের বর্তমান কালে ওই দুই ব্যবসায়ী, এন্টনিও এবং শায়লক আর পরস্পরের সঙ্গে আগের সম্পর্কে নেই, মানুষকে শোষণ করার অভিন্ন ক্ষেত্রটিতে; তারা এক হয়ে গেছে, এবং বিপন্ন মানুষকে বাঁচাননাও এখন আর আইনের সাহায্যে সম্ভব নয়। কেননা আইন হয়ে গেছে ব্যবসার দাস। আর কোনো একজন পোর্শিয়ার একার পক্ষেও রক্তলোলুপদের উদ্যত ছুরি থেকে বিপন্ন মানুষকে বাঁচানো সম্ভব নয়; এর জন্য প্রয়োজন হবে সম্মিলিত উদ্যোগ এবং যে ব্যবস্থা রক্তলোলুপদেরকে প্রশ্রয় দেয় সেটাকে ভেঙে ফেলে সম্পদের ওপর সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠার।
শিক্ষার মান উন্নয়ন চেষ্টা আর পুঁজিবাদবিরোধিতা আসলে অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত। পুঁজিবাদ শিক্ষাকে যথার্থ অর্থে উন্নত হতে দেবে না, এবং যেটুকু দেবে সে উন্নতিটুকুও সর্বজনীন হবে না। তাই বলে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের সংস্কারমূলক চেষ্টা যে চলবে না তা নয়, অবশ্যই চলবে; তবে দেখতে হবে উন্নতি যাতে সকলের উপকারে আসে। নইলে টাকার গরমে উত্তপ্ত ব্যাঙ শান্ত হস্তিটিকে লাথি মারা অব্যাহত রাখবে, এবং বলবে, হস্তি, তুমি আসলেই হস্তিমূখ।
কিন্তু হতাশ হবার কারণ নেই। মানুষ সচেতন হচ্ছে। অবস্থা বদলাবে, আমরা মানসম্মত শিক্ষা পাবো, এবং আমরা সবাই সম্মানিত হবো। ইতিহাসের অগ্রগতি পশ্চাৎমুখী হবে না, সম্মুখমুখীই হবে। কিন্তু এটি এমনি ঘটবে না। এগিয়ে আসতে হবে সমাজ নিয়ে যারা ভাবেন তাদের সবাইকে। সমবেত ভাবে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
১.
গুণ নির্ভর করে মানের ওপর। বাংলা ভাষায় মানের অর্থ একটা নয়, একাধিক; একটা অর্থ মাত্রা, আরেকটা অর্থ সম্মান। মাত্রা অর্থে মানের সঙ্গে সম্মান অর্থে মানের খুবই নিকট আত্মীয়তা। যে বস্তুর মানসম্মান বেশী তার মাত্রাও উঁচু হবে এমনটা প্রত্যাশিত। সম্মান কমলে মানও কমবে। অন্য ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষাক্ষেত্রেও এটা সত্য। বাংলাদেশে শিক্ষার মানও শিক্ষার সম্মানের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে সংযুক্ত।
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। গল্প নয় সত্য ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাতেই রোকেয়া হলের সামনে এক অধ্যাপক রাস্তা পার হচ্ছিলেন। দ্রুতগামী একটি মোটর গাড়ী তাকে প্রায় চাপা দিয়ে ফেলছিল; কিন্তু দেয় নি, গাড়ীটি থেমে গেছে, ভেতর থেকে আরোহী বের হয়ে এসে অধ্যাপককে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, বন্ধু, তোমার কাছে আমি কত যে ঋণী তা তুমি জানো না।' তারপর তিনি ঋণের কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এবং সংক্ষেপে জানালেন। বললেন, তুমি সাহায্য করেছিলে বলেই আমি দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়েছিলাম, আরও বেশী যে সাহায্য করোনি তার জন্যও আমি বিশেষ ভাবে ঋণী, কারণ সেটা করলে আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রান্তিক অবস্থানে না গিয়ে কিছুটা উঁচুতে থাকতাম, মাস্টার হতাম কলেজে, জীবন হতো অধঃপতিত। দ্বিতীয় শ্রেণীতে নীচু স্থান পেয়ে ইপিসিএস দিলাম, পেলাম কাস্টমস, তাতে দেখো আমার দাপট। আর খোদা না করুন যদি তোমার মতো ফাস্ট ক্লাস পেয়ে যেতাম, তাহলে আমার দশাও তোমার দশাই হতো। তারপর হাসাহাসি করে পরস্পরের পিঠ চাপড়িয়ে তারা বিদায় নিয়েছিলেন।
এটা পাকিস্তান আমলের ঘটনা। সে রাষ্ট্রটি ছিল ঘৃণিত, আমরা স্বপ্ন দেখতাম মুক্তির; মুক্তি আমরা পেয়েছি বলেও প্রচার আছে, তবে শিক্ষার মানমর্যাদা কী বেড়েছে, নাকি কমেছে? মানতেই হবে সত্য তো এটা যে মানসম্মান বৃদ্ধি পায় নি, হ্রাস পেয়েছে। তবে শিক্ষার মান জিনিসটা কেবল যে শিক্ষার মানসম্মানের ওপর ভর করে থাকে তা নয়, দেশের মানসম্মানের বৃদ্ধির ওপরও শিক্ষার মানের ওপরে ওঠাটা নির্ভর করে। এরা পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। পানি যেমন একই স্তরে থাকাটা পছন্দ করে শিক্ষার মানও তেমনি দেশের মানসম্মানের স্তরেই রয়ে যায়।
স্বাধীনতার পরে যুদ্ধের কারণে দেশের মানসম্মান বেড়েছিল, তারপর সেটা ক্রমাগত নেমেছে। এই লেখা লিখতে লিখতেই খবর পড়লাম বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ দেশগুলোর একটি; অথচ এখন এখানে কোনো যুদ্ধ নেই, পরিবেশ শান্ত, এবং উন্নতির ধারা অব্যাহত। মাস দুয়েক আগে খবরের কাগজে শিরোনাম পড়েছি বায়ুদূষণে মৃত্যুর ঝুঁকিতে বাংলাদেশের স্থান এখন শীর্ষে। আরও জানা গেল যে বাংলাদেশে গত দশ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে সাড়ে পঁচিশ হাজার মানুষ । এটা সরকারী হিসাব, বেসরকারী হিসাব বলবে সংখ্যা আরও অধিক, আহতের সংখ্যা হিসাব করা নিশ্চয়ই কঠিন। ওদিকে ঘরে বাইরে পথে ঘাটে যে ভাবে গণধর্ষণ, শিশুধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যা, এমনকি মৃত নারীকে ধর্ষণের সব খবর পাওয়া যায় তাতেও একটা সত্যেরই সমর্থন মেলে, সেটা হলো, জীবনের নিরাপত্তার উন্নতি ঘটে নি, বরঞ্চ অবনতিই পরিস্ফুট; ওদিকে অভাবের দরুন আত্মহত্যার ঘটনাও বাড়তির দিকেই। নিরাপত্তাহীনতা যে শিক্ষার জন্য অনুকূল নয় সেটা তো জানা কথা। একাত্তর সালে বাংলাদেশের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিল, তখন দেশের শিক্ষার চর্চা সম্ভব ছিল না।
শিক্ষার মান আর শিক্ষকের সম্মান, এরাও অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশে শিক্ষকদের সম্মান কতটা বেড়েছে তা কোনো লুকানো ব্যাপার নয়। ইউএনও গেছেন পরীক্ষা কেন্দ্রে, তাঁর পরিচয় জানতে চেয়েছেন কর্তব্যরত শিক্ষক। এই অপরাধে শিক্ষকের কঠিন শাস্তি হয়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে রক্ষা পেয়েছেন, আনুষ্ঠানিক ভাবে মাপ চেয়ে। পরে জানা গেছে সেই প্রশাসক এবং ওই শিক্ষক বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে, একই সময়ে সরকারী চাকরীতে ঢুকেছিলেন; একজন গেছেন প্রশাসনে অপরজন শিক্ষায়, দু’জনের বন্ধুত্ব থাকার কথা, কিন্তু অবস্থা এমন যে এখন শিক্ষককে নতজানু হতে হয় প্রশাসকের কাছে। এ খবর পত্রিকায় এসেছে।
হাতী যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে, বেড়াতে। রোজই যায়, আর বোজই দেখা যায় অন্যরা সরে দাঁড়ায়, সম্মান করে, কিন্তু একটি ব্যাঙ লাফিয়ে উঠে হাতীর গায়ে লাথি মারে। বেচারা হাতী আর কী করে, ব্যাঙের সাথে তো লড়াই চলে না। কিন্তু অন্যদের কৌতূহল বাগ মানে না, তারা জানতে চায় ব্যাঙ কী করে এমন সাহসী হলো যে সে হাতীকে লাথি মারে। গোয়েন্দা তদন্তে প্রকাশ পেল যে ব্যাঙটি যেখানে বসে থাকে তার নীচে একটা পুরানো টাকা আছে পোতা; তার গরমেই ব্যাঙের অমন সাহস ও দম্ভ। সাধারণ ব্যাঙ নয়, যে ব্যাঙ টাকার গরমে তপ্ত সেই শুধু পারে হাতীকে ওই ভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে। এই গল্পের গরম ব্যাঙ ও নরম হাতীর সম্পর্কটা বহুক্ষেত্রেই সত্য, সত্য সে বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রও। জ্ঞান এখানে বেশ কুণ্ঠিত অবস্থায় আছে, টাকা ও টাকাওয়ালাদের দাপটে।আর যদি এমন হয় যে বেসরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ডেকে আনেন স্থানীয় এমপি (যিনি নির্বাচিত হয়েছেন তোট না পেয়েও) এবং কল্পিত এক অপরাধে শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করান এবং পরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী অবস্থায় ওই শিক্ষক যদি কান্নাভেজা কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন তাকে নিয়ে হৈচৈ না করাটাই ভালো, কারণ তিনি একজন দুর্দশাগ্রস্ত পিতা ঘরে যার তিনটি বিবাহযোগ্যা কন্যা সন্তান বর্তমান, তাহলে শিক্ষার মান ওপরের দিকে উঠবে কি ভাবে? এসব ঘটনাকে ব্যতিক্রমী বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বিভিন্ন মাত্রায় এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে, অতিমাত্রায় হলেই খবর হয়, নইলে চাপা থাকে। পার্থক্যটা আসলে পরিমাণেরই, গুণের নয়। ওদিকে শিক্ষকরা যে বেতন ও ভাতা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করেন, রাস্তায় নামেন, পুলিশের হাতে মার খান, অনশন করেন, এমন কি দুয়েকজনকে মৃত্যুবরণও করতে হয়, এসবও বাস্তব সত্য। এমনটা হলে তো শিক্ষার মান বাড়বে না। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে দেখতে চায় বীর হিসেবে, যে বীরের খোজ তারা অন্যত্র পায় না। শিক্ষকদের সামাজিক দীনতা শিক্ষার্থীদেরকে ভেতরে ভেতরে খুবই হতাশ করে।
স্বভাবতঃই শিক্ষার মান বাড়ছে না। বিশ্ব জরীপে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই সম্মানজনক উল্লেখ নেই। ওই জরীপ কী ভাবে তৈরী হয়, তথ্য সরবরাহে ঘাটতি ছিল কি না, এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু এই সত্য কেউ অস্বীকার করবেন না যে মান উঠছে না, নামছেই। এবং সেটা অবশ্যই দুশ্চিন্তার ব্যাপার। কিন্তু শিক্ষার মান কিছুতেই বাড়বে না যদি শিক্ষার মানসম্মান বাড়ানো না যায়। বাংলাদেশে এখন মান বাড়ছে একটা জিনিসেরই, সেটা হলো টাকা। টাকায় সব কিছুই কেনা যায়, কেনা যায় শিক্ষাও। কেবল কেনা যায় না, টাকা না থাকলে শিক্ষাকে আয়ত্তে আনা অসম্ভব। যে জন্য হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রাথমিক স্তরেই ঝরে পড়ে, তারপরেও ছিটকে পড়ে যাওয়া সংখ্যা বাড়তেই থাকে। যাদের টাকা নেই, তাদের শিক্ষাও নেই, মানসম্মত শিক্ষার কথা দুরে থাক। একটি গল্প চালু আছে; ঈশপের আধুনিক গল্প, যাতে আমাদের বর্তমান অবস্থাটা সুন্দর ভাবে ধরা পড়ে। হাতী যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে, বেড়াতে। রোজই যায়, আর বোজই দেখা যায় অন্যরা সরে দাঁড়ায়, সম্মান করে, কিন্তু একটি ব্যাঙ লাফিয়ে উঠে হাতীর গায়ে লাথি মারে। বেচারা হাতী আর কী করে, ব্যাঙের সাথে তো লড়াই চলে না। কিন্তু অন্যদের কৌতূহল বাগ মানে না, তারা জানতে চায় ব্যাঙ কী করে এমন সাহসী হলো যে সে হাতীকে লাথি মারে। গোয়েন্দা তদন্তে প্রকাশ পেল যে ব্যাঙটি যেখানে বসে থাকে তার নীচে একটা পুরানো টাকা আছে পোতা; তার গরমেই ব্যাঙের অমন সাহস ও দম্ভ। সাধারণ ব্যাঙ নয়, যে ব্যাঙ টাকার গরমে তপ্ত সেই শুধু পারে হাতীকে ওই ভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে। এই গল্পের গরম ব্যাঙ ও নরম হাতীর সম্পর্কটা বহুক্ষেত্রেই সত্য, সত্য সে বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রও। জ্ঞান এখানে বেশ কুণ্ঠিত অবস্থায় আছে, টাকা ও টাকাওয়ালাদের দাপটে।
ধানের ব্যাপারটা তো আর গল্প নয়। ধানের দাম পড়ে গেছে, কাণ্ডটা ঘটেছে। মিলমালিকদের কারসাজিতে। মিলমালিকরা টাকাওয়ালা, গরীব ধানচাষী অসহায় শ্রমিক বটে, তাই তার দুরবস্থা। বাজারে এখন জ্ঞানের ও ধানের একই অবস্থা, এবং তারা পরস্পর-সম্পর্কিত এই দিক থেকে যে উভয়েই টাকার কারণে অবমূল্যায়িত, এবং টাকার দ্বারা শাসিত। উন্মুক্ত বাজার টাকা চেনে, কোনটা ধান আর কোনটা জ্ঞান তা তার জানার দরকার নেই, এবং বাজারের পক্ষে এটাতো কোনো বিবেচনার বিষয় নয় যে ধান ছাড়া দেশের মানুষ প্রাণে মরবে, জ্ঞান ছাড়া মরবে মনে।
২.
ধানের মতোই জ্ঞানও শ্রামেরই ফসল । বিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা হয়, সেখানে দুটি পক্ষ থাকে; শিক্ষক এবং ছাত্র। এদের মিলিত শ্রমেই শিক্ষার অনুশীলন। শিক্ষার মান সরাসরি নির্ভর করে শিক্ষকের মানের ওপর। শিক্ষকও একজন কর্মী। তিনি জ্ঞান আহরণ করেন, এবং বিতরণ করেন। কিন্তু শিক্ষক কেবল যে দাতা তা নয়, তিনি গ্রহীতাও। ছাত্রের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করেন আগ্রহ ও প্রাণবন্ততা। ছাত্র আগ্রহী হলে শিক্ষকের আগ্রহ বাড়ে; ছাত্রের কৌতূহল, উচ্ছলতা শিক্ষককে প্রাণবন্ত করে তোলে। ছাত্রের প্রশ্ন ও কৌতূহল শিক্ষককে পাঠদানের বিষয়কে আরও ভালোভাবে জানার ব্যাপারে উৎসাহী করে। শিক্ষকতার কাজটা তখন জীবিকার্জনের একঘেয়ে গ্লানিকর কর্তব্য থাকে না। শিক্ষক চরিতার্থতা পান; যে চরিতার্থতা শিক্ষাদানের জন্য একান্ত অপরিহার্য। ভালো শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে বেতন-ভাতার তুলনায় এই চরিতার্থতা কম মূল্যবান নয়। ভালো শিক্ষক না পেলে তো শিক্ষার গুণ ও মান বাড়বে না। বাংলাদেশে ভালো শিক্ষক পাওয়াটা এখন বড় একটা সমস্যা।
শিক্ষার মান আর শিক্ষকের সম্মান, এরাও অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশে শিক্ষকদের সম্মান কতটা বেড়েছে তা কোনো লুকানো ব্যাপার নয়। ইউএনও গেছেন পরীক্ষা কেন্দ্রে, তাঁর পরিচয় জানতে চেয়েছেন কর্তব্যরত শিক্ষক। এই অপরাধে শিক্ষকের কঠিন শাস্তি হয়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে রক্ষা পেয়েছেন, আনুষ্ঠানিক ভাবে মাপ চেয়ে। পরে জানা গেছে সেই প্রশাসক এবং ওই শিক্ষক বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে, একই সময়ে সরকারী চাকরীতে ঢুকেছিলেন; একজন গেছেন প্রশাসনে অপরজন শিক্ষায়, দু’জনের বন্ধুত্ব থাকার কথা, কিন্তু অবস্থা এমন যে এখন শিক্ষককে নতজানু হতে হয় প্রশাসকের কাছে। এ খবর পত্রিকায় এসেছে।মেধাবানদেরকে শিক্ষকতায় নিয়ে আসা চাই। মেধাবান হওয়া অর্থ কেবল যে জ্ঞানী হওয়া তা নয়, শিক্ষকতাতে আগ্রহী হওয়াও চাই। অন্য চাকরী পান নি বলে শিক্ষক হয়েছেন এমন লোকদের দিয়ে কুলাবে না। তেমন শিক্ষক চাই যিনি জ্ঞানী এবং একই সঙ্গে উৎসাহী সেই জ্ঞানকে অন্যের কাছে পৌছে দিতে, এবং পৌছে দেবার প্রক্রিয়াতে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলতে। এই রকমের মানুষদেরকে শিক্ষাক্ষেত্রে টেনে আনতে হলে বেতন-ভাতার বিষয়টা দেখতে হবে বৈকি। বেতন ভাতা সম্মানজনক হওয়া চাই, এবং অন্য পেশার চাইতে বেশী হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়, যাতে করে মেধাবীরা আসেন, এবং কোচিং সেন্টারে না গিয়ে ক্লাসরুমে শিক্ষাদানেই নিবিষ্টচিত্ত হন।
কিন্তু শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র ও উন্নত বেতন স্কেল তো বাস্তবে নেই। আর তার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষাখাতে সরকারের ব্যয় বরাদ্দ আনুপাতিক হারে বাড়ছে না, জাতীয় বাজেটের ১১ শতাংশের ওপরে সেটা কিছুতেই ওঠে না, ভীষণ তার গড়িমসি। জিডিপি’র শতকরা ২ ভাগ বরাদ্দ করলে কিছুই চলবে না, অন্তত ৬ ভাগ বরাদ্দ চাই। অনুৎপাদক ও আমলাতান্ত্রিক খাতগুলো থেকে টাকা কেটে সেটা নিয়ে আসা চাই শিক্ষায়।
কিন্তু সমস্যাটা কেবল বরাদ্দের নয়, বরাদ্দের যথাযথ খরচেরও। টাকা কেবল ঢাললেই চলবে না, দেখতে হবে ঠিক জায়গাতে গিয়ে পড়ছে কি না। দুর্নীতি কত যে ব্যাপক সে তো আমরা জানি। পুলিশের ডিআইজি যখন স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালককে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা নগদ ঘুষ দেয় তখন তো বোঝাই যায় যে নজরদারীটা কত দুর্বল। আর ফাস-হয়ে-যাওয়া এ খবর তাৎপর্যও উপেক্ষণীয় নয় যে একজন শিক্ষাকর্মকর্তা ওই দুর্নীতি দমন কমিশনেরই একজন কর্মকর্তার সঙ্গে ঘুষের অঙ্কটিকে এক কোটি থেকে পঞ্চাশ লক্ষতে নামিয়ে আনা যায় কি না এ নিয়ে দরকষাকষি করছেন। অন্য ক্ষেত্রের মতোই শিক্ষাক্ষেত্র দুষ্ট হবার পরে এখন নষ্ট হবার পথে রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এটা আমরা জানি, আর এটাও জানি, বাধ্য হই জানতে যে, শিক্ষক হতে হলে নগদ টাকা ঘুষ দিতে হয়, আর সে-টাকা যে সামান্য তা নয়, বিপুল পরিমাণেরই। নজরদারী তাই অত্যাবশ্যক। তবে তার জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, সামাজিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে। অভিভাবকদের এগিয়ে আসা চাই। সমাজে সৎ লোক যে নেই তা নয়, সংখ্যায় তারাই অধিক, কিন্তু তাদের ক্ষমতা নেই, কারণ তারা বিচ্ছিন্ন, অন্যক্ষেত্রে যেমন এক্ষেত্রেও তেমনি সন্মানুষদের ঐক্য চাই। আবার শুধু যে সরকারী বরাদ্দেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলবে এমনও নয়। বেসরকারী দান অনুদানও আসতে হবে। কিছু কিছু আসেও; আরও আসবে যদি আবহাওয়া তৈরী করা যায়। আবহাওয়া এখন বিরূপ। প্রকৃতিরও, সমাজেরও।
বিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষকের মিলন কেন্দ্র ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশী কিছু । বিদ্যালয় হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠান; যেখানে বিদ্যার চর্চা হয় সামাজিক ভাবে, এবং সাংস্কৃতিক ভাবেও। সামাজিকতাটাই প্রধান। একজন শিক্ষার্থী যখন বাড়ী থেকে বিদ্যায়তনে আসে, তখন ছােট জায়গা থেকে বড় জায়গায় তার প্রবেশ ঘটে। জায়গাটা মুক্তির। শিক্ষার্থীর জন্য একেবারে প্রথম শিক্ষাটাই হলো সামাজিকতার। এই শিক্ষা তার বাকি জীবনের জন্য হবে সবচেয়ে বড় সংগ্রহ। পরে তার জ্ঞান বাড়বে, বাড়বে তার সামাজিকতাও। সামাজিকতাটা বিঘ্নিত হয় যদি সে আনন্দ না পায়, যদি মনে করে সে মুক্ত প্রাঙ্গণে আসে নি, এসে পড়েছে কয়েদখানায় কিংবা কারখানায়। সে ক্ষেত্রে তার শিক্ষা গ্রহণের ক্ষমতা যাবে সংকুচিত হয়ে।
এখন ওই সংকোচনটা বড় বেশী ঘটছে। শিক্ষা যা দেওয়া হচ্ছে সেটা পর্যাপ্ত নয়, আর যেটুকুই বা দেওয়া হচ্ছে তাও শিক্ষার্থী ঠিক ভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। তার সার্বক্ষণিক ভয় পরীক্ষার। আমাদের বিদ্যায়তনিক শিক্ষা সবসময়েই ছিল পরীক্ষামুখী, এখন সেটা রীতিমত পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। পড়ানো যা হচ্ছে তা পরীক্ষায় পাশের জন্য। পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, এবং চেষ্টা হয়েছিল একেবারে প্রাথমিক স্তরেই পরীক্ষার হলে শিশুদেরকে টেনে আনার। আশা করি সেটা পরিত্যক্ত হবে। পরীক্ষা যত কম হয় ততই মঙ্গল, বিশেষ করে পাবলিক পরীক্ষা। পরীক্ষার ব্যাপারে চাপ যত বাড়ে মূল বই পড়ার প্রয়োজন তত কমে যায়। শিক্ষার্থীরা প্রশ্নের উত্তর রপ্ত করতে ব্যস্ত থাকে, শিক্ষার দিকে মনোেযোগ না-দিয়ে । শিক্ষকরাও ওই ভাবেই পড়ান। ছাত্রদেরকে ভালো নম্বর পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করাটাই শিক্ষক হিসেবে তাদের সাফল্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নিরিখ হয়ে দাঁড়ায়। আর পরীক্ষায় যে এম সি কিউ প্রশ্নরীতি চালু হয়েছে এটা খুবই ক্ষতিকর। এতে শিক্ষার্থীরা এমনকি প্রশ্নটাও ভালো করে বুঝতে চায় না। এ বি সি ডি-তে দাগ দেবার কায়দা শেখে। আরেক উৎপাত সৃজনশীল পদ্ধতি। এটা শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক কেউই ঠিক মতো বোঝেন না। ছাত্ররা তো বটেই শিক্ষকরাও গাইড বুকের শরণাপন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা, এম সি কিউ, সৃজনশীল পদ্ধতি, সবকিছুই একত্র হয় কোচিং সেন্টার ও গাইড বুক ব্যবসাকে সরগরম করতে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার কথা ধরা যাক। সবাই বলেন শিক্ষার মান এখানে বেশ ভালো ভাবেই নেমে গেছে। বাড়িয়েই বলেন কারণ মান যে অতীতে খুব উঁচু ছিল আর এখনও যে একেবারে অধঃপতিত তা নয়, আসলে যা কমেছে তা হলো শিক্ষার্থীদের আগ্রহ। শিক্ষার্থীরা আগের তুলনায় কম আগ্রহী। তারা আসে, থাকে, চলে যায়; কিন্তু শিক্ষার ব্যাপারে তাদের প্রবল আগ্রহ দেখা যায় না। এর কারণ আছে। মূল কারণটা ভবিষ্যৎ দেখতে না-পাওয়া। অধিকাংশের চোখেই স্বপ্ন নেই, মুছে গেছে। যাদের আছে তাদেরটাও ম্রিয়মান। শিক্ষার্থীরা জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা দেখতে পায় না। এই অনিশ্চয়তা আগের দিনেও ছিল; কিন্তু তখন তবু আশা করা যেত যে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে, এখন সে আশাটা ক্ষীণ। দেশে যে উন্নতি হয়েছে তার দুর্বলতাগুলোর মধ্যে খুব বড়মাপের একটি হলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া। উন্নতি যা হয়েছে তার প্রায় সবটাই শ্রমের কারণেই; কিন্তু বিনিয়োগ ঘটছে না। কর্মের বিপুল শক্তি আটকা পড়ে গেছে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার জাঁতাকলে। বেকারত্বের সমস্যাটা ক্রমাগত বাড়ছেই; বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা তো এখন ভয়াবহ। যে তরুণ আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে; তার দুশ্চিন্তা হয় বের হয়ে কি করবে। পড়ালেখায় তার সেই দুর্দান্ত আকর্ষণটা নেই যেটা থাকা আবশ্যক ছিল। ছাত্রের এই অনাগ্রহ, শিক্ষককে নীরবে পীড়িত করে; জ্ঞানের অনুশীলনটায় প্রাণের ঘাটতি ঘটে যায়।
শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর গ্রহণক্ষমতা আসলে খুবই বড় ব্যাপার। আগ্রহের অভাব ঘটলে গ্রহণক্ষমতা হ্রাস পায়। হ্রাস প্রাপ্তির অবশ্য আরও কারণ আছে। সেগুলোর একটা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক জীবনের স্তিমিতদশা। শিক্ষার অনুশীলন কেবল ক্লাসে, লাইব্রেরীতে ও লেবরটারিতেই চলে না, ঘটে ছাত্রাবাসে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, পরস্পরের মেলামেশায়। এবং ছাত্রসংসদের নির্বাচনে। এটা অবশ্যই তাৎপর্যহীন নয় যে বিগত আঠাশ বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদের কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি; এমনটা পরাধীনতার আমলে কখনো ঘটে নি; না ব্রিটিশ শাসনে, না পাকিস্তানী শাসনে। এটা সার্বিক ব্যবস্থারই একটি প্রতিফলন। বোঝা যাচ্ছে প্রচারকার্য যতোই চলুক, সারবস্তুতে গণতন্ত্র আসে নি। ছাত্রসংসদ হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রাণবন্ততার কেবল ধারক এবং বাহকই নয়, প্রধান উদ্যোক্তাও। ছাত্র সংসদের নির্বাচন শিক্ষার্থীদের জন্য উৎসব, মেধাবানদের জন্য সামাজিক স্বীকৃতি লাভের সুযোগ, এবং সাংস্কৃতিক জীবনকে সজীব রাখার কর্মাধ্যক্ষ। শিক্ষাঙ্গন যদি আলোচনায়, বিতর্কে, নাটকে, গানে, সাহিত্যসৃষ্টিতে, খেলাধুলায়, জ্ঞানীদের বক্তৃতায় মুখরিত না থাকে তাহলে তো শিক্ষাঙ্গন তার প্রাণই
পুঁজিবাদের কবলে শিক্ষা ৭১ হারিয়ে ফেলে । দেখা দেয় আবিলতা। ছেলেমেয়েরা টের পায় যে সুস্থ বিনোদন নেই, আদান-প্রদান নেই চিন্তার ও কল্পনার, অনুশীলন নেই সাংস্কৃতিক মেধার, বিকাশ নেই নেতৃত্ব দানের শক্তির। তারা হতাশ হয়, অবসাদে ভোগে, মাদক ধরে কেউ কেউ, অন্যরা ঝিমায়, দেখা দেয় কলহ-বিবাদ । আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। আর অতীতে যা কখনো শোনা যায় নি তা এখন শোনা যায়। সেটি হচ্ছে যৌন হয়রানি। চরম দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘটনায় যেখানে তথাকথিত এক ছাত্র ধর্ষণের শতসংখ্যা পূর্তির ঘোষণা দিয়েছিল। যৌন হয়রানির অভিযোগ কেবল ছাত্রদের নয়, শিক্ষকদের ব্যাপারেও উঠছে। সােনাগাজীতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ যখন ছাত্রীকে হয়রানি করে এবং ছাত্রী তার প্রতিবাদ জানালে অধ্যক্ষটি যখন তার রাজনৈতিক আর্থিক প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে জীবন্ত অবস্থায় ছাত্রীটিকে পুড়িয়ে মারে তখন একটি চরম বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে বিদ্যালয়ে মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার বাস্তবতাটা যে কতদূর প্রসারিত হয়েছে সেই সত্যটাই বের হয়ে আসে।
৩.
শিক্ষার ব্যাপারে এই ধরনের বিভিন্ন অসুবিধার কথা আমরা বলতে পারবো, বলবোও; কিন্তু মূল প্রতিবন্ধকতাকে যেন না ভুলি। সেটা হলো তিন ধারার শিক্ষা। তিন ধারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবে কি, উল্টো বিভক্ত করছে। এবং বিভাজনটা ঘটছে শ্ৰেণী পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করেই। জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হয়, কিন্তু ঐক্য যে নষ্ট করা হচ্ছে শিক্ষার মধ্য দিয়েই সেই সত্যটা অস্বীকতই রয়ে যায়। শিক্ষা সংস্কারের জন্য কমিশন ও কমিটি নিয়মিত গঠিত হতে থাকে, কিন্তু কোনো সংস্কারকই বলতে পারে না, হয় তো সাহসই করে না বলতে, তিন ধারাকে কী করে এক ধারাতে নিয়ে আসা যাবে। কারণ এটা তো স্পষ্ট যে এটি সংস্কারের ব্যাপার নয়, ব্যাপার সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে এদেশের মানুষ যুগের পর যুগ ধরে সংগ্রাম করেছে, যে-সংগ্রামের একটি বড় পর্যায় ছিল একাত্তরের ওই মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত হয়েছে, কিন্তু মানুষের মুক্তি আসে নি। আসার কারণ সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন না হওয়া। আর না-হওয়ার অনেক প্রমাণের একটি হচ্ছে তিন ধারার শিক্ষা।
তিন ধারা আগেও ছিল। ব্রিটিশ আমলে ছিল, পাকিস্তানের কালে সেটা বিকশিত হচ্ছিল, বাংলাদেশে এই বিভাজন থাকার আপাত-গ্রাহ্য কোনো অজুহাত ছিল না। সুবিধাভোগী বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা পড়বে ইংরেজী মাধ্যমে, মধ্যবিত্তের জন্য রইলো বাংলা মাধ্যম, আর যারা গরীব তাদের জন্য মাদ্রাসা, এটা তো ব্রিটিশ রাষ্ট্রের বিধান। সেই রাষ্ট্র শ্রেণীভেদকে জিইয়ে রাখতে চেয়েছিল, এবং শিক্ষাকে বিভেদ সৃষ্টির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার বাসনা পোষণ করতো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল; ধারণাটি যে ভ্রান্ত ছিল তার বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে, খুব পরিষ্কার প্রমাণ এটা যে তিন ধারার শিক্ষা রয়ে গেল। রাষ্ট্র চাইছিল সেটা থাকুক। কারণ রাষ্ট্র ছিল ব্রিটিশের উপনিবেশিক রাষ্ট্রের একটি নতুন সংস্করণ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধটা উপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোকে ঠিক রেখে বড় রাষ্ট্র ভেঙে একটি ছােট রাষ্ট্র তৈরী করার ছিল না, ছিল পুরাতন রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলে নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার, যেটি হবে গণতান্ত্রিক, অর্থাৎ শ্ৰেণী বৈষম্যবিহীন। কিন্তু সে রাষ্ট্র আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি নি; কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা যাদের হাতে চলে গেল শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা পূর্ববর্তী রাষ্ট্রশাসকদের মতোই পুঁজিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক চরিত্রেও তাদের আপত্তি ছিল না। ফলে দেখা গেল রাষ্ট্রের বাইরের পরিচয় যাই হােক অন্তর্গত স্বভাব চরিত্রে কোনো পরিবর্তন এলো না। দেশে সরকার বদল হয়েছে, একটির পর আরেকটি এসেছে, কিন্তু দেখা গেছে তারা অন্য ব্যাপারে ভিন্ন, এমন কি কোনো কোনো ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী হলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পুঁজিবাদের প্রতি পক্ষপাতে অভিন্ন। যে জন্য সংবিধানে উল্লেখিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে একটি সরকার এসে কেটে ফেললো, কিন্তু পরের কোনো সরকারই তাকে আর ফেরৎ আনতে আগ্রহ প্রকাশ করল না। সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার এখন অতীতের বিলুপ্ত স্মৃতি।
একধারার শিক্ষার ভিত্তিটা কী? সেটা হলো মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা। সকল শিক্ষা অবশ্যই এক প্রকারের হবে না, ভিন্নতা থাকবে, কিন্তু সকল শিক্ষাই হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে, সার কথা এটাই। এ বিষয়ে তো কোনো দ্বিমত নেই যে শিক্ষার জন্য মাতৃভাষাই সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। আসলে মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ গভীর স্থায়ী স্বাভাবিক ও সৃষ্টিশীল, এগুলোর কোনোটাই হতে পারে না। তদুপরি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাই ঘটেছে বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী-নিয়েই এই সংগ্রামের সূচনা। বাংলা যে এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হবে এ নিয়ে কোনো দ্বিমত ছিল না; এবং মাতৃভাষার সেই স্বীকৃতি লাভে কোনো বিলম্বও ঘটে নি। কিন্তু দেখা গেছে যে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলো বটে কিন্তু রাষ্ট্রের ভাষা হলো না। উচ্চ আদালতে বাংলা কখনোই চালু ছিল না, স্বাধীন বাংলাদেশেও চালু করা যায় নি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমের অগ্রগতি অত্যন্ত সীমিত; কোনো কোনো এলাকাতে তো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এটাও স্মরণীয় যে বাঙালীর সংখ্যা বাংলাদেশেই সতের কোটি ছুঁই ছুই, বাঙালী অন্যত্র এবং অন্য রাষ্ট্রেও আছে, সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ত্রিশ কোটির কাছাকাছি হবার কথা। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তো নয়ই, এমনকি নিম্নতর স্তরেও শিক্ষালাভ করতে পারছে না। এটা বাঙালীদের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়।
সবচেয়ে বড় কথা এই যে, মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে শিক্ষা লাভ না করাতে তাদের শিক্ষা মোটেই মানসম্মত হচ্ছে না। বাংলাদেশে যদি আমরা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারতাম তাহলে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে যেতে। বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হতো, শিক্ষার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটতো, এবং আমরা নিজেরাও বদলে যেতাম। প্রকৃত উন্নতি আটকে যেতো না শ্রেণীর খাদে পড়ে।
তিন ধারা এক হলে বিত্তবানেরা মূলধারার ব্যাপারে এখন যে উদাসীনতা দেখাচ্ছে সেটা দেখাতে পারতো না। কারণ অভিন্ন শিক্ষার মানের সঙ্গে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে পড়তো। এখন তো দেখা যাচ্ছে ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষার মান নিয়ে কোনো সংশয় নেই; সে-মান নামছে না; সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস নেই, সেশনজট ঘটে না, সিলেবাসে ও ক্যারিকুলামে রদবদল হয় না; সরকারী সিদ্ধান্তে পরীক্ষার ফলের ইতরবিশেষও ঘটে না। বিত্তবান অভিভাবকেরা তাই সন্তানদের ওইসব বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিত থাকেন। মূলধারায় নিমগতিতে তাদের কোনো ক্ষতি নেই। সুবিধাই আছে, কারণ মূলধারার শিক্ষার্থীরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আসবে না। শিক্ষা এক ধারাতে থাকলে এরা সেই ধারার উন্নতিতে সচেষ্ট হতেন; সেখানে অর্থ, যত্ন ও উদ্বেগের বিনিয়োগ ঘটাতেন। আর রাষ্ট্র যেহেতু তাদেরই কর্তৃতাধীন তাই সরকারী মনোযোগের অভাব ঘটতো না। যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষার জন্য ব্যয় হয় সেটা চলে আসতো মূলধারাতে। আসততা দান অনুদান, ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশন। শিক্ষার মানসম্মান অনেক বৃদ্ধি পেতো।
শিক্ষকদের সামাজিক দীনতা শিক্ষার্থীদেরকে ভেতরে ভেতরে খুবই হতাশ করে।সম্ভাবনা আরও ছিল। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেশের মেধাশক্তিকে অবারিত করে দিতে পারতো। তাতে জ্ঞানের চর্চা, উদ্ভাবনারও বিতরণ দেশকে নতুন নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতো। শিক্ষা এবং বৈষয়িক উন্নতি পরস্পরের ওপর ক্রিয়াশীল হতো, ফলে উভয়েরই বৃদ্ধি ঘটতো। তার দরুন উন্নতির ইতিহাস বৈষম্যবৃদ্ধির ইতিহাস না হয়ে সর্বজনীন মঙ্গলের ইতিহাসে পরিণত হতো, আর দেশের মানুষের ভেতরে যে বিপুল কর্মশক্তি শ্রেণীবিভাজনের খাদে অবরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে তা অবারিত হয়ে দারিদ্র্য সরিয়ে প্রাচুর্য নিয়ে আসতো। এই শক্তিটা যে কেমন অসাধ্য সাধন করতে পারে তার প্রমাণ তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেই লেখা আছে। কৃত্রিম হলেও, এবং খণ্ডিত মানুষ তৈরী করতে থাকলেও ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষার শক্তি আছে, আর সে শক্তি নিহিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরেই। রাষ্ট্রের কর্তারা পুঁজিবাদে দীক্ষিত আর ইংরেজী হচ্ছে বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রধান ভাষা, তদুপরি রাষ্ট্রের ভেতর প্রবহমান রয়েছে ইংরেজশাসনের উপনিবেশিক উত্তরাধিকার। ওদিকে আবার পুঁজিবাদী বিশ্বের ওপর রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতাও ইংরেজীর কদর বাড়িয়েছে। মনে রাখা দরকার যে ইংরেজী ভাষা যখন শিক্ষার মাধ্যম হয় তখন এটা যে কেবল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যোগাযোগ ঘটায় তাই নয়, একটা ভাবাদর্শ ও সংক্রমিত করে। সেটা হলো পুঁজিবাদী ভাবাদর্শ, যার ভেতর রয়েছে মুনাফালিপ্সা, বিচ্ছিন্নতা ও ভোগবাদিতা। বলা বাহুল্য, এগুলোর প্রত্যেকটি অত্যন্ত ক্ষতিকর।
পশ্চিমবঙ্গে এখন দেখছি সরকারী দল আওয়াজ তুলেছে ‘জয় বাংলা’র। বিজেপি দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে এখন বাঙালী সত্তাকে জাগিয়ে ভোলা আবশ্যক-উপলব্ধিটা এই রকমেরই। বিজেপির আগ্রাসনের ভেতর রয়েছে হিন্দী ভাষার আধিপত্যবাদিতা। হিন্দী বাংলাকে দখল করে নেবে, এই বিপদের কথাটা ভেবে সেখানকার অনেক মানুষ এখন সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন চাইছে। আমাদের বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, সেখানেই যখন বাংলাকে ব্যবহার নিয়ে আমরা এত অসুবিধার ভেতর আছি তখন বিশাল ভারতের ছােট একটি অঙ্গ রাজ্যে বাংলাকে একক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা যে মোটেই সহজ হবে না সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। সাতচল্লিশের সেই ভয়ঙ্কর দেশভাগ বাংলার মানুষের জন্য অনেক দুর্ভোগের কারণ হয়েছে, মস্ত বড় ক্ষতি হয়েছে বাংলা ভাষার। পশ্চিমবঙ্গের বিত্তবানরা তখন ভয় পাচ্ছিলেন মুসলিম আধিপত্যের, এখন সেখানকার বাঙালীরা বিপদগ্রস্ত হিন্দীর অগ্রাভিযানে। যে কলকাতাকে তারা পাকিস্তানের হাত থেকে রক্ষা করবেন ভেবেছিলেন সেই শহর এখন আর বাঙালীদের নেই। ওদিকে আক্রমণটা যে কেবল হিন্দীর তা তো নয়, ইংরেজীরও। হিন্দীকে রোখার চাইতেও কঠিন কাজ ইংরেজীকে রোখা, যেমনটা আমরা টের পাচ্ছি। উর্দুকে চাপানোর অভিসন্ধিকে আমরা পরাজিত করেছি, কিন্তু ইংরেজীর জন্য পথ দিয়েছি খুলে। মূল শত্রুটা পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। মাতৃভাষা লড়াইটা আসলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই ।
৪.
স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশে এখনো আমরা বাংলা প্রচলনের লড়াইতে আছি। এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয় মানুষকে মুক্তি দেবার অঙ্গীকার নিয়ে। এর সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রধান চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক। সাতচল্লিশে আমরা যখন স্বাধীন হই তখন দুর্ভিক্ষের অবস্থা তৈরী হয়েছিল, একাত্তরের পরেও দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে; সে বিপদ কাটিয়ে উঠে যে চ্যালেঞ্জটা রয়ে গেল সেটা বাংলাভাষাকে সর্বক্ষেত্রে ও সর্বস্তরে ব্যবহার করার । সুস্পষ্ট কর্তব্য ছিল বাংলাকে উচ্চস্তরে শিক্ষার মাধ্যম করা। উচ্চ শিক্ষায় বাংলার ব্যবহারের উদ্যোগ পাকিস্তান আমলে যে নেয়া হয় নি তা নয়। উর্দুর উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলা উন্নয়নের চেষ্টাও রাষ্ট্রকে করতে হয়েছে, বাংলা উন্নয়ন বোর্ড নামে একটি সরকারী সংস্থার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল যার মূল কর্তব্য ছিল বাংলা ভাষায় উচ্চপর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা। সে কাজ অবশ্য বেশী দূর এগোয় নি। স্বাধীনতার পরে ওই বোর্ডটি আর থাকে নি, বাংলা একাডেমীর সঙ্গে মিশে গেছে। প্রত্যাশিত ছিল যে একাডেমী বোর্ডের কাজটিকে আরো বিস্তৃত করবে; সকল বিষয়ে উন্নত মানের পাঠ্যপুস্তক ও অনুষঙ্গী বই পাওয়া যাবে। কাজটা শুরুও হয়েছিল; কিন্তু এগোয় নি, এখন তো প্রায় পরিত্যক্ত ।
বাংলাভাষায় জ্ঞানের চর্চাকে উন্নত এবং সেই সাথে ভাষার ধারণ ও প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ছিল মৌলিক গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি অন্যভাষা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বই প্রচুর পরিমাণে ও ক্রমবর্ধমান হারে অনুবাদ করা। অনুবাদের কাজটা মোটেই সহজ নয়, ক্ষেত্রবিশেষ মৌলিক সৃষ্টির চেয়েও কঠিন। অনুবাদ করতে হয় সতর্কতার সাথে, মূল রচনাকে যথার্থ ভাবে পাঠ করে। অর্থবিকৃতি অমার্জনীয়, যান্ত্রিকতা পরিহার্য। একাজে মূল ভাষা ও বাংলা ভাষা, দুটোতেই বিস্তর জ্ঞান দরকার। আর কাজটা কখনোই একা করা সম্ভব নয়। অন্যকে দেখাতে হয়, পরামর্শ নেওয়ার দরকার পড়ে, সম্পাদনা ও সংশোধন ছাড়া চলে না। আমরা বলছি ও শুনছি যে; বাংলাদেশে এখন গবেষণার মান ও পরিমাণ সন্তোষজনক নয়; বরাদ্দ অল্প, যেটুকু আছে তাও ঠিকমত খরচ হয় না; অনুবাদের বেলাতে দৃশ্যটা আরও করুণ; সেখানে বরাদ্দে প্রায় হাতই পড়ে না, অব্যবহৃত রয়ে যায়। অনুবাদের উদ্যোগ তেমন একটা দেখা যায় না, প্রেরণাও নেই। বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাকালীন মূল অঙ্গীকার ছিল তিনটি; গবেষণা, সংকলন ও অনুবাদ। পরবর্তীতে দেখা গেছে তার আয়োজনে গবেষণা অল্প, সংকলনও উল্লেখযোগ্য নয়, অনুবাদ একেবারেই কম। আর সংকলনের ক্ষেত্রে তাদের প্রধান কৃতিত্ব যদিও অভিধান প্রস্তুত করা, এবং সে কাজ মোটামুটি প্রশংসনীয়ও; কিন্তু বাংলা অভিধানের ক্ষেত্রে তারা যে কারগুলোকে নির্বিচারে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন তাতে বাংলাভাষার কোনো উপকার হয় নি; শিক্ষার্থীরা পড়েছে বিভ্রান্তিতে, আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্নতার । রচনাবলী’কে তাঁরা রচনাবলি করছেন, যেন হত্যাকাণ্ড। বাংলা ‘একাডেমী’কে নিজের নামে ‘ী'কে কর্তন করার জন্য জাতীয় পরিষদের শরণাপন্ন হয়েছে। এ যেন একটা মহাকীর্তি। বাংলা একাডেমী খুব ভালো করবে যদি বিভিন্ন দিবস উদযাপন ও উৎসব অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মনোযোগ কমিয়ে, এমনকি বইমেলার দায়িত্বটা প্রকাশকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে যেসব কাজের জন্য তার প্রতিষ্ঠান সেদিকে দৃষ্টি দেয়। বাংলাভাষার জ্ঞানচর্চায় এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা উক্তৃষ্ট প্রকাশনাও আশা করি। প্রকাশনা প্রসঙ্গে বলা দরকার যে বইমেলা উপলক্ষে হাজার হাজার বই ছাপা হয় ঠিকই কিন্তু জ্ঞান-সমৃদ্ধ বইয়ের সংখ্যা থাকে একেবারেই অকিঞ্চিতকর। গ্রন্থ প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবার কথা; বস্তুত একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যে নিরিখগুলো দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব তার একটি হচ্ছে প্রকাশনা। এক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা যে প্রশংসা করবো এমন উপায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা যে হয় না তা নয়, হয়; কিন্তু সেগুলো জনসমক্ষে আসে কম, কারণ অধিকাংশ গবেষণাই হয় ইংরেজী ভাষাতে, এবং অনেক গবেষণাই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় না।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সবকিছুর ওপরে রাখে বাজারকে, যেখান থেকে মুনাফা আসবে। শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে এমন বক্তব্যও আমরা পাই যে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নীতি চালু করাই মঙ্গলজনক। শিক্ষা যেন মানুষের জন্মগত অধিকার নয়, শিক্ষা ছাড়া যেন জাতি চলতে পারে। বাজার এখন নিয়ন্ত্রণভার নিয়ে নিয়েছে, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই, শিক্ষাক্ষেত্র বাদ থাকে কী করে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বেলাতে এখন আর কিছু বাকি নেই।
প্রতিষ্ঠাকালে, ১৯২১ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য শিক্ষার কোনো স্বতন্ত্র। বিভাগ ছিল না, পরে স্বতন্ত্র ফ্যাকাল্টি হয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিভাগের সংখ্যা; আইবিএও একসময়ে ছিল না, এখন কেবল আছে যে তা নয়, সেখানে ভর্তিতে প্রতিযোগিতা অত্যন্ত তীব্র, এবং শিক্ষাদান চলে দিবারাত্রি। কলেজে বাণিজ্য শাখায় এখন মেধাবী ছাত্রদের উপচেপড়া ভিড়। এসবই উন্নতির এবং বাজারের শক্তিবৃদ্ধির সাক্ষী। দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন একশ’ ছাড়িয়েছে, এদের বিস্তারের পেছনে বাণিজ্যিক প্রণােদনাই প্রধান, এবং প্রায় সকল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই বাণিজ্য-শাখায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর নির্ভরশীল। ওদিকে মানবিক বিদ্যার চর্চা ক্রমাগত কোণঠাসা হচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পাঠের কোনো বিভাগ নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও দর্শনের দশা ম্রিয়মান। দু'য়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বতন্ত্র বিভাগ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইতিহাসের চর্চায় আগ্রহ কমেছে। ইতিহাস না জানলে অতীতের ব্যাখ্যা, বর্তমানের বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ~-সবকিছুই বিঘ্নিত হতে বাধ্য। আবার ভুল ইতিহাস হচ্ছে বিষের মতো ভয়ঙ্কর। অত্যন্ত উঁচুমাপের ইতিহাসবিদ ছিলেন স্যার যদুনাথ সরকার। তিনি এরকম জানিয়েছেন যে, পলাশীতে ইংরেজের বিজয় ভারতবর্ষের জন্য এক রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, যে রেনেসাঁ ইউরোপের রেনেসাঁর সঙ্গে তুলনাতে মোটেই খাটো নয় বরং বড়ই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত History of Bengal গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে যদুনাথ সরকারের এই রকমের মন্তব্য আছে যে, দুই শত বছরের ইংরেজ শাসন ও প্রতিবেশী ইংরেজ সমাজের দৃষ্টান্ত বাঙালীদের জীবন-যাপন ও চিন্তাধারায় এমন একটি ঐক্য উপহার দিয়ে গেছে যা দিয়ে জাতি সৃষ্টি হতে পারে। এটা লিখেছেন নিশ্চয়ই কিছুদিন আগে, হয়তো ঠিক সেই সময়েই বাঙালী জাতি যখন দ্বিখণ্ডিত হচ্ছিল, এবং যেটা ঘটছিল ইংরেজের শাসনের কারণেই। প্রাতঃস্মরণীয় ইতিহাসবিদরাও যে সবসময়ে নির্ভরযোগ্য হন তা নয়। মূল কথাটা হলো দৃষ্টিভঙ্গির; দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যে সাদা কালো হয়ে যেতে পারে, যেমন কালো পারে সাদা হিসেবে হাজির হতে। মানবিক বিদ্যার গুরুত্ব হ্রাস শিক্ষার জন্য কোনো সুসংবাদ বহন করে না। শিক্ষার উদ্দেশ্যই তো শিক্ষার্থীকে মানবিক গুণসম্পন্ন করা, সে যাতে সংবেদনশীল হয়, বিচ্ছিন্ন না হয়ে সামাজিক হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
আরেকটা কথা; আমরা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে খুব বেশী করে ভাবি। কিন্তু প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে কী ঘটছে তার দিকে তাকাই না। শিক্ষার গুণগত মানটা কেমন দাঁড়াবে সে সিদ্ধান্ত কিন্তু ওই স্তরেই গৃহীত হয়ে যায় এবং যাচ্ছে।
৫.
সার কথাটা দাঁড়ায় এই যে সংস্কার, সংশোধন, পরিবর্তন সবই দরকার; কিন্তু সবার আগে চাই এই সিদ্ধান্ত যে শিক্ষা হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে। আর সেটা হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায় হলো বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ইউনেস্কো যে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছে তার কারণ তো এটাই যে বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদের দৌরাত্মে দুর্বল জাতিগুলোর মাতৃভাষা বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
আবারও স্মরণ করা যাক যে, জ্ঞানের চাষ আর ধানের চাষের ভেতর পার্থক্য অবশ্যই বিস্তর, কিন্তু মিল এইখানে যে দুটোই শ্রমের ফসল। এবং তারা উভয়েই আজ উপেক্ষার পাত্র, যদিও তাদের ওপরই মানুষের প্রধান ভরসা। জ্ঞান এবং ধানের শত্রুপক্ষটিও অভিন্ন; সেটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ যখন আসর জাঁকিয়ে বসছে সেই সময়ে নাট্যকার শেকসপীয়র তার দি মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে দেখিয়েছেন যে পণ্যব্যবসায়ী এন্টনিওর প্রাণ সুদব্যবসায়ী শায়লকের হাতে বিপন্ন। চুক্তির বরখেলাফ হয়েছে দাবী করে শায়লক এন্টনিওর হৃদপিণ্ডের কাছের জায়গা থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতে চায়। আদালত তাকে নিবৃত্ত করতে পারছে না, কারণ আইন অনুযায়ী ওই মাংস শায়লকের প্রাপ্য। এন্টনিওকে বাঁচিয়েছে বিজ্ঞ পোর্শিয়ার হস্তক্ষেপ; সে বলেছে ঠিক আছে এক পাউন্ড মাংস কেটে নাও কিন্তু এক ফোঁটা রক্ত ঝরাতে পারবে না, কারণ চুক্তি ওই অধিকার তোমাকে দেয় নি। পুঁজিবাদের বর্তমান কালে ওই দুই ব্যবসায়ী, এন্টনিও এবং শায়লক আর পরস্পরের সঙ্গে আগের সম্পর্কে নেই, মানুষকে শোষণ করার অভিন্ন ক্ষেত্রটিতে; তারা এক হয়ে গেছে, এবং বিপন্ন মানুষকে বাঁচাননাও এখন আর আইনের সাহায্যে সম্ভব নয়। কেননা আইন হয়ে গেছে ব্যবসার দাস। আর কোনো একজন পোর্শিয়ার একার পক্ষেও রক্তলোলুপদের উদ্যত ছুরি থেকে বিপন্ন মানুষকে বাঁচানো সম্ভব নয়; এর জন্য প্রয়োজন হবে সম্মিলিত উদ্যোগ এবং যে ব্যবস্থা রক্তলোলুপদেরকে প্রশ্রয় দেয় সেটাকে ভেঙে ফেলে সম্পদের ওপর সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠার।
শিক্ষার মান উন্নয়ন চেষ্টা আর পুঁজিবাদবিরোধিতা আসলে অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত। পুঁজিবাদ শিক্ষাকে যথার্থ অর্থে উন্নত হতে দেবে না, এবং যেটুকু দেবে সে উন্নতিটুকুও সর্বজনীন হবে না। তাই বলে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের সংস্কারমূলক চেষ্টা যে চলবে না তা নয়, অবশ্যই চলবে; তবে দেখতে হবে উন্নতি যাতে সকলের উপকারে আসে। নইলে টাকার গরমে উত্তপ্ত ব্যাঙ শান্ত হস্তিটিকে লাথি মারা অব্যাহত রাখবে, এবং বলবে, হস্তি, তুমি আসলেই হস্তিমূখ।
কিন্তু হতাশ হবার কারণ নেই। মানুষ সচেতন হচ্ছে। অবস্থা বদলাবে, আমরা মানসম্মত শিক্ষা পাবো, এবং আমরা সবাই সম্মানিত হবো। ইতিহাসের অগ্রগতি পশ্চাৎমুখী হবে না, সম্মুখমুখীই হবে। কিন্তু এটি এমনি ঘটবে না। এগিয়ে আসতে হবে সমাজ নিয়ে যারা ভাবেন তাদের সবাইকে। সমবেত ভাবে।
No comments:
Post a Comment