ছোটগল্প : কথা কতিপয় | সৈয়দ শামসুল হক | রবিবারের প্রবন্ধ ৭


ছোটগল্প : কথা কতিপয়
সৈয়দ শামসুল হক

বাংলাদেশে মনে হয় কবিতার পরে-পরেই ছোটগল্প অধিক লেখা হয়। লাগসই অনুমানে বলতে পারি, দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী, মাসিক সাহিত্যপত্র আর ছোটকাগজ মিলিয়ে বছরে চার-পাঁচ হাজার কবিতার বিপরীতে, প্রায় হাজার দেড়েক ছোটগল্প তো ছাপা হয়ই; এর বেশি ছাড়া কম হবে না। উপন্যাস সে-তুলনায় সত্যিকার উপন্যাস, ঈদসংখ্যার তাড়া-লিখনে উপন্যাসের ভেক ধরা বড়গল্পগুলো ধরছি না বছরে? বড়জোর শ’দেড়েক!

আমাদের কথাসাহিত্যে তাহলে ছোটগল্পেরই ফলন বেশি। এর একটা কারণ কিংবা উৎসাহ বোধহয় এই ছোটগল্প না হলে সাহিত্য সাময়িকী অচল, মাসিকপত্র অচল, ছোটকাগজেরও তথা বাস্তবতা। অতএব নিরন্ত চাহিদা আছে ছোটগল্পের, নতুন লেখকেরা শুরুও করছেন ছোটগল্প দিয়েই। ছোটগল্পের জন্যে সম্পাদক পথ চেয়ে আছেন, বেশ ব্যাকুলভাবেই; লেখা ছাপা হবার সম্ভাবনাও সেই কারণে অনেক বেশি। লেখক লিখেই চলেছেন, সম্পাদকও ছেপে দিচ্ছেন লেখাটা চলনসই হলেই পত্রপত্রিকায় নিরন্তর যে-গল্পগুলো বেরোচ্ছে তা অভিজ্ঞ চোখে পাঠ করলেই ধরা পড়বে, এর অধিকাংশই অনেকটা কাঁচা, প্রায় শিক্ষানবিশের রচনা। তবু, পাঠযোগ্য কিছু গল্প তো আমরা পাচ্ছিই। কিন্তু সেই ছোটগল্প নিয়ে লেখক যখন বই করতে চান, নতুন লেখক হলে প্রকাশক মুখ ফিরিয়ে নেবেন; আর কিছুটা বা যথেষ্টই খ্যাতি আছে এমন লেখকের গল্পের বই প্রকাশক নিমরাজি হয়ে ছাপবেন বটে, তবে এই কড়ারে যে এরপরে তাকে কিন্তু একটা আস্ত গোটা উপন্যাস দিতে হবে। কারণ, ছোটগল্পের বই বাজারে চলে না; চলে না মানে এর বিক্রিটা নেহাতই নগণ্য। প্রকাশকের কথা বিশ্বাস না করলে, আমরাও বাজারে বা বইমেলায় বেরিয়ে দেখবো ছোটগল্পের বই মোটে চলছে না। ভাবতে অবাক লাগে, যে-ছোটগল্প না হলে পত্রপত্রিকা অচল, বই হয়ে বেরোলে সেই ছোটগল্পেরই সংকলন এমন বেজার বাজার পায় কী করে! বা, কেন?



সন্দেহ জাগে, তবে কি পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠায় যে-গল্পগুলো ছাপা হয় পাঠক তা পড়েন না? কিংবা জীবনের শতেক ব্যস্ততার মধ্যে চট করে গল্প একটা অগত্যা আর পড়বার কিছু বাকি নেই বলে পড়ে নেওয়া পড়াটা এই কারণে? বা, যাত্রাপথের বিরস ও বাধ্যতামূলক দীর্ঘ অতিবাহনে পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠায় ছোটগল্প একটা পড়ে উঠে সময় কাটানোই কি তবে? কিন্তু যখন পকেটের পয়সা খরচ করে বই কেনা, কিংবা অক্ষরে লিখিত মানুষের জীবনকথা যখন জানবার সাধ, তখন দেখি উপন্যাসই হয় পাঠকের প্রথম পছন্দের। ভাবটা যেন এই ছোটগল্প অল্প সময়েই ফুরিয়ে যায়, উপন্যাস অনেকক্ষণ ধরে পড়া যায়। এর দোষটাও তেমন দেখি না; মানুষের জীবনকথাই যদি জানতে ইচ্ছে, তবে উপন্যাসের পরিসরে তা একটু বিশদ করেই জানি না কেন?

বোধহয়, এই কারণেই ছোটগল্প দিয়ে যাঁরা কলম-চালনা শুরু করেন অচিরে তাঁরা উপন্যাস রচনায় প্রবেশ করেন। সুবিধেটা এই, প্রকাশক পাওয়া যায়। কিন্তু কি কেবল প্রকাশকের দিকে চোখ রেখেই কি উপন্যাস লেখা? চলতি সময়ে বোধহয় তাও একমাত্র কারণ নয়। আছে ঈদসংখ্যা। ঈদসংখ্যার বিজ্ঞাপনগুলোতে দেখি আমরা দশটা উপন্যাস দিচ্ছি! বিপরীতে আরেক পত্রের বিজ্ঞাপনে আমরা ছাপছি পনেরোটা উপন্যাস! যেন এক দুরন্ত প্রতিযোগিতা প্রতিটি ঈদসংখ্যার যে, কে কতগুলো উপন্যাস দু-মলাটের ভেতরে পাঠককে দিতে পারছেন। সম্পাদকেরাও ছোটগল্প লেখকদের, বিশেষ করে নতুনদের আকছার অনুরোধ করেন, অনেকদিন তো ছোটগল্প চর্চা করলেন, এবার উপন্যাস লিখুন। তাঁরা লিখছেনও। এবং পরের কালে ছোটগল্প লেখা প্রায় ছেড়েই দিচ্ছেন। মনে রাখছি যে, আজকের আমাদের প্রায় সব ঔপন্যাসিকই কলমের যাত্রা শুরু করেছিলেন ছোটগল্প দিয়ে। এই দফায় বলে রাখি, আমার অনুমান হয়, ছোটগল্প লেখা কি তবে এখন কথাসাহিত্যে যশোপ্রার্থীদের হাত পাকাবার উপায় হয়েই দাঁড়ালো!

ঈদসংখ্যাগুলোর প্রতিযোগিতার ফলে দশা এমন হয়েছে, পনেরো-কুড়ি পাতার লেখাও উপন্যাসের ছাপ নিয়ে আমাদের কাছে হাজির হচ্ছে! এবং অবাক হতে হয়, ক্রোধও হয়, অনেক যোগ্য লেখকও তাঁদের বড়গল্পটি অবলীলায় উপন্যাস বলে সম্পাদকের হাতে তুলে দিচ্ছেন। তবে, ঈদসংখ্যাগুলোর একটা ভালো দিক এই দেখি, যে-প্রতিষ্ঠিত লেখক উপন্যাস দিয়ে উঠতে পারছেন না, সম্পাদক তাঁর নামটির জন্যে আদপে ওই নামটি ব্যবহার করে ঈদসংখ্যাটির মর্যাদা বাড়াবার লক্ষ্যে তাঁকে দিয়ে একটি ছোটগল্প লিখিয়ে নিচ্ছেন। লেখকটিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, আর আমরাও উপন্যাসে গচ্ছিত হয়ে যাওয়া একদার তুখোড় ছোটগল্প লিখিয়ের কাছ থেকে তাঁর হারিয়ে যাওয়া গল্প-কলমটি ফেরত পেলাম।

এই থেকে ভাবনা ওঠে, কথাসাহিত্যের এই যে কয়েকটি ছোটবড় নদী আছে উপন্যাস, বড়গল্প, ছোটগল্প এখন আবার নতুন একটা যোগ হয়েছে, উপন্যাসিকা এই নদীগুলোকে আমরা এখনো ঠিকঠিক শনাক্ত করতে আর পারছি কি? ছোটগল্প তার আকারের জন্যে ছোটগল্পই আছে, ছোটগল্প বলে চিনতেও পারছি, কিন্তু বড়গল্প-উপন্যাসিকা-উপন্যাসের ভেদরেখা চেনা দায় হয়ে উঠেছে। বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র থেকেই এই বিভ্রান্তির জন্ম বলে দেখতে পাই, যদিও ওই মহানদের উদাহরণস্থল মাত্রই একটি কি দুটি; হালে এটি সর্বদায় এবং শতে শতে এসে ঠেকেছে। আমাদের বাংলাদেশে প্রতি বছর উপন্যাস-নামাঙ্কিত যে-বইগুলো বেরোয়, তার অধিকাংশই বড়গল্প বৈ আর কিছু নয়।

ছোটগল্প যে ছোট গল্পই, তার নির্ণয় তার আকারেই কেবল নয়, মেজাজেও, ধরনেও তাকে আমরা শনাক্ত করে উঠতে পারি। রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর ‘নষ্টনীড়‘ গল্পটিকে উপন্যাস বলে উপস্থিত করেননি অনেকেই এই লেখাটিকে উপন্যাস বলতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এর একমাত্র কারণ তো এই বলে দেখি যে, এ-গল্পের প্রধান দুই চরিত্র অমল আর চারুলতা, এদের জীবনযাত্রা গল্পের ঘটনামালা ছাড়িয়েও অতঃপর চলবে, তারা আরো অনেক ঘটনার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাবে যাবেই কিন্তু এটি বলা যাবে না যে, এই যা নষ্টনীড়ে ঘটলো তার পরে জীবন থেকে তাদের আর নেবার বা পাবার কিছু নেই। উপন্যাস তো সেইটে বলে, আমি মনে করি যার পরে আর কিছু নেই, কিংবা আমাদের জানবার শেষ ওখানেই।

কিন্তু ছোটগল্প? ওটি আমি মুহূর্তের বলেই ধারণা করি। একটা সময় ছিল যখন ছোটগল্প আকারে ছোট হয়েও উপন্যাসের বীজ ধারণ করতো; তখন লেখা কোনো কোনো স্মরণীয় গল্পকে আমরা উপন্যাসেরই সংক্ষিপ্তসার বলে দেখতে পাই এখনকার চোখে। এখন তো আমার চোখে ছোটগল্প মুহূর্তের বা খুব কম সময়ের মধ্যে একটিই কি দু-তিনটি ঘটনা উচ্ছ্বাসের ফলে উপস্থিত মানুষটির মানচিত্র মাত্র; এবং উপমায় সে-মানচিত্রটি একটি দেশ বা মহাদেশের নয় ওটি উপন্যাসের অধিকারে বরং ছোট্ট একটি শহর বা গ্রামেরই। ছোটগল্পে যা ঘটে তা একটি মানুষকে আবশ্যিকভাবে কি চিরকালের জন্যে বদলে দেয় না, শোধিত করে না; যেন ওটি হঠাৎ হয়ে যাওয়া বৃষ্টিপাত, ভিজে ওঠা, আর কিছু পরেই শুকিয়ে ফিরে পথ চলা।

ছোটগল্পের সঙ্গে সবচেয়ে মিল আমি দেখতে পাই কবিতার খণ্ড কবিতার। আমি মনে করি, সাহিত্যে যদি সবচেয়ে দীর্ঘযাত্রাটি হয় কবিতার, তবে তার পরে-পরেই দূরযাত্রী হচ্ছে আমাদের ছোটগল্পটি। কবিতা ও ছোটগল্পের এই সান্নিধ্য কখনো কখনো হরিহর পর্যায়ে পৌঁছে যায়। রবীন্দ্রনাথ ‘দেবতার গ্রাস‘ কেন গল্পে নয় কবিতায় লিখলেন, আর তাঁর ‘ছুটি’ই বা কেন গল্পের শরীরে, কবিতায় তাকে আনলেন না, এটি তাঁর সৃজনেরই রহস্য রয়ে গেছে, আমাদের সেখানে রায় দেবার অধিকার নেই; কিন্তু এতেই প্রমাণ পাই কবিতা ও ছোটগল্প কতটা কাছের এবং প্রায় বিনিময়যোগ্য দুটি মাধ্যম।

নিজের কথা বলতে ইচ্ছে করছে, আমি শুরুই করেছিলাম কবিতা আর ছোটগল্প দিয়ে। সেই উনিশশো সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ সালের কথা মনে পড়ে। প্রায় সব লেখকেরই যাত্রা শুরু হয় অগ্রজদের হাত ধরে, তাঁদের লেখার অনুকরণে অনুসরণে পথে পড়ে প্রথম পা। কবিতা শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের যে গুটিকয় পাঠ্যপুস্তকে পড়া ছিল সে-সকলের অনুকরণে, জানা ছিল তিনি আমাদের ভাষার বড় কবি, আর গল্পলেখকও; কিন্তু তাঁর গল্পের অনুসরণ যে তখন আমার কলম করেনি তার কারণ এখন এত বছর পরে মনে হয় গল্প চায় চারদিকের বাস্তব জীবন ও উছলে পড়া ঘটনা, আর রবীন্দ্রনাথের গল্পের ভুবন ছিল আমার জন্যে দূরের ও নিশ্চিত অদেখা। আমার সময়টা ছিল দেশভাগের, দেশত্যাগের, উদ্বাস্তুর, ঈষৎকাল আগে মন্বন্তরের, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। আটচল্লিশেই পুরো একটা খাতা জুড়ে লিখেছিলাম এক হিন্দু পরিবারের গল্প, তারা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে যাচ্ছে।

কিন্তু নিজের কথা পড়ে থাকুক, সেই সময়টার কথা ভাবছি উনিশশো সাতচল্লিশ পরে-পরে, যখন আমার সাহিত্যপাঠ শুরু হয়েছে সেই সময়টা, সাতচল্লিশ থেকে চুয়ান্ন, যে-চুয়ান্নয় আমার আঠারো বছর বয়সে প্রথম ছোটগল্পের বই তাস বেরিয়ে যায় ভাবছি ওই পাঁচ-সাত বছরকালে কথাসাহিত্যের কথা বিশেষ করে। ছোটগল্পের সে ছিল সোনার সময়; এমনটি আর ছিল না, আমাদের জন্যে আর আসবে না বলেও মনে করি। সময়টাই আমাকে তখন কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প লিখিয়ে নিচ্ছে, আর আজও লিখে চলেছি। এবং এখানেই বলে রাখি, ছোটগল্প আর বড়গল্প যার অনেকগুলোই প্রকাশকস্বার্থে উপন্যাস বলে ছাপা, কথাসাহিত্যে এই আমার প্রধান কলম।

ছোটগল্পের সেই সোনার সময়! আমাদেরও তৈরি হবার, হয়ে ওঠার সেই বছরগুলো। তখনকার আমরা রাষ্ট্রসীমানার এদিকে থাকলেও ওদিকের নবীন পশ্চিম বাংলার তথা প্রাচীন অখণ্ড বাংলার সাহিত্যই ছিল আমাদের পাঠ ও মনোযোগের প্রায় সবটা জুড়ে। ছোটগল্পের দুর্দান্ত-কলম সকল তখন কলকাতায়। লিখছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানত রাঢ়বাংলা এবং মাঝেমাঝেই কলকাতা নগরীর প্রান্তিক মধ্যবিত্তদের নিয়ে অসামান্য সব গল্প। সুবোধ ঘোষ মানুষের মনগভীরের গল্প শোনাচ্ছেন কিছুটা রোমান্টিক আর অনেকটাই বেদনাজর্জর বীক্ষণে। লিখছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের জীবন ও সংগ্রামের কথা তিনি বলছেন; তিনিই এ পর্যন্ত বাংলা ছোটগল্পে একমাত্র যিনি একটি সারকথা অবলম্বন করে আলাদা আলাদা গল্প নিয়ে মালা গেঁথেছেন। মধ্যবিত্তদের নিয়ে লিখছেন বিমল কর। প্রেমেন্দ্র মিত্রর কথাও ভুলে যাচ্ছি না, রবীন্দ্রনাথের পরেই ছোটগল্পে তিনি সম্রাট বলে তাঁকে আমরা তখন শনাক্ত করছি। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তখন এসে গেছেন। মনে পড়ছে না জগদীশ গুপ্ত তখনো সক্রিয় কিনা, কিন্তু তাঁকেও আমরা তখন পাঠ করছি। তখন সদ্য এসেছেন এমন দুজনের কথা মনে পড়ছে ননী ভৌমিক আর সুনীল জানা। আর সেই সময়টাতেই মনোজ বসুর বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে জগদীশ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় একের পর এক বেরোতে শুরু হয়েছে বাংলার প্রধান ছোটগল্প লেখকদের ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’; শ্রী ভট্টাচার্যের দীর্ঘ প্রবেশক-প্রবন্ধ থাকতো প্রতিটি বইয়ে; আমরা তা থেকেও নির্ণয় করে নিতে পারছি মাধ্যম হিসেবে ছোটগল্পকে এবং প্রবেশ করতে পারছি সংকলিত গল্পকারের বিশেষ ভুবনটিতে।

তখনকার আমাদের জন্যে ছোটগল্প একটা লিখবার মতো মাধ্যম হয়ে ওঠে; কবিতার পাশাপাশি আমাদের অনেকেই তখন কবিতার সমান গুরুত্ব দিয়ে চলেছি ছোটগল্পকে। হায়, এখনো কি তা-ই! মনে হয় না। শামসুর রাহমান তো তাঁর প্রথম দিনগুলোতে আফসোস করতেন, গল্প লিখতে চান কিন্তু গল্প আসছে না; অনেক পরে তিনিও ছোটগল্প গুটিকয় লিখে ওঠেন, সম্ভবত তাঁর সেই পুরনো খেদ স্মরণ করে। উনিশশো পঞ্চাশের আগে-পরে হাসান হাফিজুর রহমান গল্প লিখছেন, কবিতার পাশাপাশি দু-হাতে লিখছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরও। আজকের দুর্দান্ত পণ্ডিত, ভাষা ও সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মানিত গবেষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও ভাবা যায়! গল্প লিখছেন। আরো আমরা অনেকেই তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ছোটগল্প নিয়ে পত্রপত্রিকায় আর সাহিত্য-আসরে উপস্থিত হচ্ছি : আনিস চৌধুরী, সরদার জয়েনউদ্দিন, ফজলে লোহানী তাঁর নিজ নাম আর দুটি ছদ্মনাম নিয়ে মুসা মনসুর আর আবদুল্লাহ জয়নুল আবেদিন, আতোয়ার রহমান, রাবেয়া খাতুন, ফজলুল করিম, মীর্জা আ মু আবদুল হাই, মিন্নাত আলী, সৈয়দ মকসুদ আলী, আবু ইসহাক, মঈদুর রহমান, সালেহ আহমেদ, হামেদ আহমেদ। আরো অনেকেই তো সবগুলো নাম এতো বছর পরে হয়তো মনে পড়ছে না; আর, যাঁদের নাম করলাম তাঁদের অনেকেই এখন সাহিত্য-স্মৃতি থেকে মুছে গেছেন যদিও যাবার কথা নয়, তাঁরাও আছেন, ভিতটা তাঁরা ও আমরা সকলে মিলেই রচনা করেছিলাম। দালান যখন ওঠে ভিতটা আর চোখে পড়ে না, তাই বলে ভিত কখনো অনাবশ্যক হয়ে যায় না।

সেই তখন আমরা উপন্যাস লেখার কথা ভাবিইনি। ব্যতিক্রম ছিলেন আনিস চৌধুরী আর ফজলে লোহানী; তাঁরা উপন্যাস লিখেছেন দু-তিনটি করে। তখন ছোটগল্পই ছিল আমাদের কথাশিল্পের একমাত্র মাধ্যম। আর সেই তখন আমাদের গল্পের প্রায় সবটা জুড়ে ছিল, এদেশে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে গড়ে উঠছিল তাদের জীবনকথা, দেশভাগের কথা, কমিউনিস্ট আন্দোলনের মানুষজনের কথা, বামপন্থী চোখে দেখা সংগ্রামের কথা, ভাষা-আন্দোলনের কথা। এই বাস্তবতাগুলো যে তখনকার ছোটগল্পে ভূমি ও উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে লক্ষ করি তখনকার আমাদের কবিতায় কিন্তু তার এক শতাংশ মাত্র লেখকদের এই কাজটিই পরের কালে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করবার পরে পরে আমাদের সমগ্র সাহিত্যের চেহারা রচনা করে দিয়েছে; পশ্চিম বাংলার বাংলা সাহিত্য থেকে আমাদের সাহিত্য আলাদা হয়ে গিয়েছে এরই ফলে, যার শুরু সেই দূর-পঞ্চাশের দশকের প্রথমভাগে। একই ভাষায় লিখলেও রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিন্ন অভিজ্ঞতার কারণে দুই দেশের সাহিত্য অনিবার্যভাবে ভিন্ন হয়ে যায়, এমনকি শব্দ ও বাগ্বিধিও তাদের নিজের ধরনে এসে যায়।

এই যে চারদিকের বাস্তবতা আমাদের ছোটগল্পে এতো প্রবলভাবে উপস্থিত, আর কিছু কি ছিল না? প্রেম? রোমান্টিকতা? ছিল আনিস চৌধুরীর কলমে, ফজলে লোহানীর লেখায়। কিন্তু এ ছিল ক্ষীণধারায়। কথাসাহিত্য কত আর কাল্পনিক হতে পারে বা আকাশের কুসুম হেন? তখনকার সামাজিক বাস্তবতা ছিল মুসলিম সমাজে যুবতী ও অবিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যে অপরিচয় ও অদর্শনের। তাই আমাদের কিছু আগে মুসলিম লেখক যাঁরা দেশভাগের পাঁচ-সাত কি দশ বছর আগে থেকেই লিখতে শুরু করেন, তাঁদের লেখায় পাই খালাতো ফুফাতো মামাতো বা এমনই আরো একটু দূরসম্পর্কের তুতো-ভাইবোনদের ভেতরে রোমান্টিকতার উন্মেষ ও তা নিয়ে গল্প। আমার পাঠ বলে, আবু রুশদের গল্পে আমি এটি প্রথম পাই, এবং তাঁরই কনিষ্ঠ সহোদর রশীদ করীমের লেখায় সেই তাঁরা দেশভাগের আগে কলকাতা থাকতেই। এই তুতো-ভাইবোন সম্পর্কের বাইরে, কিন্তু পরিবারের ভেতরেই, আরেকটি সম্পর্কসূত্র দেবর ভাবির রোমান্টিকতায় খুব স্মরণীয়ভাবে নিয়ে আসেন শাহেদ আলী তাঁর ‘ওই যে নীল আকাশ’ গল্পে। আর গ্রামীণ জীবন তো খোলা আকাশের নিচে, নারী-পুরুষের দেখাসাক্ষাৎও প্রায় অবাধ। কাজী আফসারউদ্দিন আহমদ ও বিশেষ করে শওকত ওসমান, শামসুদ্দিন আবুল কালামের লেখায় গ্রামীণ এই সুযোগ ও সুবিধেটা ব্যবহৃত হতে আমরা দেখেছি।

আমি ভুলে যাচ্ছি না সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কথা। আমাদের কিছু আগে কলম নিয়ে তিনি আসেন এবং দেশভাগের ঈষৎ আগে লালসালু উপন্যাস আর কয়েকটি ছোটগল্প তিনি লিখেও ওঠেন; কিন্তু প্রায় আমাদের সময়ে এসে এবং চাঁদের অমাবস্যা লিখে উপন্যাসে তাঁর প্রত্যাবর্তন-আগের বছর পাঁচেক সময়কালে ছোটগল্পই তাঁর কলমে আমরা পাই। তাঁর ও শওকত ওসমানের লেখা, বিশেষ করে তাঁদের ছোটগল্প, তখন আমাদের বিশ্বাসে আনতে থাকে যে এ-পথেই এই ছোটগল্পেই আমাদের যা কিছু বলবার বলা যেতে পারে।

কথাসাহিত্যের মাধ্যম হিসেবে ছোটগল্প এখন আর আমাদের দৃষ্টিতে বড় একটা নেই বলেই মনে হয় আমার কাছে। ছোটগল্পের সেই যে সোনালি সময়ের কথা বলেছি, তার জন্যে আমার খুব কাতরতা হয়। গোটা কয়েক উপন্যাস লিখে ফেলার পরেও ছোটগল্পই আমার জন্যে কথাসাহিত্যের প্রধান মাধ্যম বলে জানি ও জানছি। আমার গল্পভুবন জলেশ্বরীতে, সেই যে জমিটি আমি কুড়িগ্রামের মাটি দিয়ে তৈরি করে নিয়েছি, সেখানকার গল্প বলতে আমার উৎসাহ কবিতা লেখার চেয়ে এতটুকু কম নয়। আর এ-কথা তো জানিই যে, ছোটগল্প কবিতার মতোই দূরগামী। আমি আমার লেখার দূরযাত্রাই তো অবিরাম পোষণ করি কলমে। আর, এ-ছোটগল্পের এখনকার হাল যা চারদিকে দেখি যেন উপন্যাস রচনার আগে হাত পাকাবার একটা উপায়, যেন ঈদসংখ্যায় উপন্যাস দিতে না পারার কারণে অগত্যা গল্প লেখা, গল্পের বই প্রকাশে প্রকাশকদের অনিচ্ছা, আর যদিওবা বই হয়ে বেরোয় পাঠক কেনে না পড়ে না আমি বিমর্ষ বোধ করি। কালি ও কলম যে বছর বছরে গল্পসংখ্যা প্রকাশ করে চলেছে, আর সেই সুবাদে বেশ কিছু, ভালো ছোটগল্পও আমরা পাচ্ছি, এতে আশা হয়, কথাসাহিত্যের এই মাধ্যমটি সম্পাদক ও প্রকাশকদের জলসেচ পেলে এবং পুরনো ও নতুনেরা লিখলে ছোটগল্পের সেই সোনালি দিন আবার আসবে।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট