আপনি তুমি রইলে দূরে
রফিক কায়সার
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে কবি-প্রয়াণের পর থেকেই। তাঁকে নিয়ে কবির জীবৎকালেও ব্যক্তিবিশেষের নেতিবাচক মতামত বা মন্তব্যকে কবি যথেষ্ট গুরুতব দিয়ে খন্ডন করেছেন বা জবাব দিয়েছেন। ব্যক্তিবিশেষের মন্তব্য বা মতামত কবির জীবৎকালে সামাজিক পরিবাদ বা শান্তিনিকেতনে রথীন্দ্রনাথবিরোধী জনমত তীব্রতা পায়নি। কবি-প্রয়াণের পর থেকেই রথীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন নিয়ে শান্তিনিকেতনের বাসিন্দাদের জনরব তৈরি হতে থাকে। তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। যৌক্তিক কারণেই রবীন্দ্রনাথের পরিবারের পক্ষ থেকে এই সম্পর্ক নিয়ে কথা ওঠে, তাঁর গোচরে আনা হয় সামাজিক লোকনিন্দার প্রসঙ্গ। এ-প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথের অবস্থান ছিল নেতিবাচক – তিনি মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে অস্বীকার না করে শান্তিনিকেতন থেকে প্রস্থানকে বিবেচনায় আনেন। ইন্দিরা চৌধুরী সরাসরি রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। বিশ্বভারতীর আচার্য ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কানেও খবরটি পৌঁছে যায়। রথীন্দ্রনাথের ছোট বোন মীরা ঠাকুর প্রথম থেকেই এই সম্পর্ক নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অগ্রজের প্রতি, আবার লুপ্ত করেননি অগ্রজের প্রতি স্বাভাবিক শ্রদ্ধাবোধ। ভ্রাতৃবধূর প্রতি অব্যাহতভাবে জ্ঞাপন করেছে সহমর্মিতা এবং সহানুভূতি। রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্ক নিয়ে সরাসরি কটাক্ষ করেছেন রথীন্দ্রনাথের ভাগ্নি নন্দিতা।
রথীন্দ্রনাথের সম্পর্ক-বহির্ভূত আচরণ যেমন শান্তিনিকেতনে নিন্দার ঝড় তুলেছিল, তেমনি উপাচার্য হিসেবে তাঁর কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জড়িয়ে পড়েন তহবিল তছরুপের মামলায়। একপর্যায়ে মামলায় হাজিরা দিতেও অনাগ্রহী হয়ে পড়েন রথীন্দ্রনাথ। এই পর্যায়ে সবকিছু ছাপিয়ে মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাজারীবাগে ‘হাওয়া বদল’ করতে যাওয়ার ঘটনা তাঁর পদমর্যাদা এবং ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করে। বিশ্বভারতীর স্থানীয় এবং দিল্লির প্রধানমন্ত্রীর দফতর ঘটনাটিকে সহজভাবে নিতে পারেনি। রবীন্দ্রানুরাগী নেহেরু নিজেও রথীন্দ্রনাথের বিষয়ে বিব্রত হন। প্রশান্ত মহালনবীশকে দিয়ে তাঁর কাছে খবর পাঠানো হলো যে, ‘বার্তা’র সারমর্ম হলো, চট্টোপাধ্যায় দম্পতিকে শান্তিনিকেতন থেকে হটাও। রথীন্দ্রনাথ উল্লিখিত ‘বার্তা’র মর্মার্থ গ্রহণ না করে বেছে নিলেন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত। অভিমান করে ছেড়ে এলেন শান্তিনিকেতন। সঙ্গে এলেন মীরা চট্টোপাধ্যায়। জীবনের শেষ আট বছর অতিবাহিত করেছেন এই নারীর সান্নিধ্যে – দেরাদুনে। এই ঘটনাক্রম বিশ্বভারতীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছে কমবেশি জানা।
পঞ্চাশের দশকের পুরোটাই শান্তিনিকেতনবাসীর কাছে চট্টোপাধ্যায় দম্পতির সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে ছিল ‘রসালো গল্প’, ছিল বাস্তব আর কল্পনার মিশেল দেওয়া নানাবিধ চটুল কাহিনি। সময়ের নিয়মে একসময়ে এই গল্পগাছার প্রবাহ থেমে আসে, রবীন্দ্রশতবর্ষের বছরে রথীন্দ্রনাথের নীরব এবং নিশ্চুপ প্রয়াণে শেষ হয়ে আসে এই পর্ব। অনেকটা রবীন্দ্র-কথিত ছোটগল্পের সংজ্ঞার মতো যেন ‘শেষ হয়ে হইল না শেষে’র মতো গত শতাব্দীর আশির দশকে কোনো এক শারদীয় সংখ্যায় (পত্রিকা এবং গল্পের নাম ভুলে গেছি) শংকর শান্তিনিকেতনের পটভূমিতে একটি গল্প লিখেছিলেন। গল্পটির ঘটনাক্রমে স্পষ্টভাবে কবিপুত্রের আদল ফুটে ওঠে। বোঝা যায় মীরা চট্টোপাধ্যায়কে। গল্পের আবহে তৈরি হয় উভয়ের মধ্যকার জৈবিক বন্ধন। শংকর গল্পটিতে নারীপ্রেম এবং পুত্রক্ষুধার আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিতে চেয়েছেন, যার ভিত্তি হচ্ছে প্রচলিত জনরব। প্রচলিত জনরবকে বাতিল করে রবীন্দ্রসার্ধশত বছরে কবিপুত্রকে একটা ঐতিহাসিক পটভূমিতে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হয়েছেন নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আপনি তুমি রইলে দূরে সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথে ব্যবহৃত হয়েছে সর্বমোট ১২৭টি চিঠি, একটি টেলিগ্রাম, তিনটি শংসাপত্র, পৌরসভার কাছে লিখিত একটি পত্রের অনুলিপি এবং কয়েকটি চিরকুটের সমাহারে সংকলিত হয়েছে এ-গ্রন্থটি। এ-গ্রন্থে আলোকচিত্র আছে ৫১টি। চিঠিপত্রের অনুলিপিও আছে বেশ কয়েকটি। সম্পাদকের ভূমিকাটি সারবান ও তথ্যবহুল। রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা দেবীর সম্পর্কের জটিলতা-বিষয়ক ব্যাখ্যাটি যৌক্তিক এবং হৃদয়দ্রাবী।
১৯১৪ সালে লেখা একটি চিঠিতে, তিন কন্যার ব্যর্থ, সংকটক্লিষ্ট পরিণয় জীবনের অসহায় সাক্ষী রবীন্দ্রনাথ তাঁর একমাত্র পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে একটি দূরদর্শী মিনতি জানিয়েছিলেন :
তোমাদের পরস্পরের জীবন যাতে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে সেদিকে বিশেষ চেষ্টা রেখো। মানুষের হৃদয়ের যথার্থ পবিত্র মিলন, সে কোনদিন শেষ হয় না – প্রতিদিন তার নিত্যনূতন সাধনা। ঈশ্বর তোমাদের চিত্তে সেই পবিত্র সাধনাকে সজীব করে জাগ্রত করে রেখে দিন এই কামনা করি।
অনিবার্য এক দূরত্বে বিশ্লিষ্ট রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দুই স্বতন্ত্র, স্বাধীন ভুবনে ‘হৃদয়ের সেই ‘যথার্থ পবিত্র মিলনের’ এক ব্যতিক্রমী সমীকরণ রচনা করে গিয়েছিলেন।’
প্রতিমা-রথীন্দ্রনাথ-মীরা চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিমানস থেকে কি কোনো সমীকরণসূত্র নির্মিত হয়েছে? সম্পর্কের সমীকরণের দায়টা ছিল রথীন্দ্রনাথের ওপর। পাঠকের উদ্দেশে নীলাঞ্জন জোগান দিয়েছেন পত্রাবলির, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যক্তিপরিচিতি এবং আলোকচিত্র। মুখবন্ধে বিশ্বভারতীর উপাচার্য রজত রায় ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন রথীন্দ্রনাথের প্রতি কর্তৃপক্ষের দুর্ভাগ্যজনক আচরণের জন্য, উপাচার্যের এই বচন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। দ্বিতীয়ত, লেখক ও সংকলক নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রভুবনের উপেক্ষিত চরিত্র রথীন্দ্রনাথকে যৌক্তিক ও তথ্যভিত্তিক উপাদান-সহকারে পাদপ্রদীপের আলোতে এনেছেন। ব্যক্তিগত পত্রাবলি জননজরে উন্মোচিত করে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন জয়ব্রত চট্টোপাধ্যায়। পত্রগুলো সংরক্ষণ করেছিলেন নির্মল চট্টোপাধ্যায় – জটিল এক মানবিক সম্পর্কের প্রসঙ্গকে কালের হাতে সঁপে দিয়েছেন নিঃশঙ্কচিত্তে। ফলে আমাদের প্রচলিত মূল্যবোধ এবং সামাজিক সম্পর্কের দিকগুলো প্রবলভাবে নড়ে ওঠে, ভেঙে পড়ে না ব্যতিক্রর্মী জীবনচর্যা বলে। সম্পর্কের এই জটিলতা আমাদের ভাবিত করলেও অনিবার্যভাবেই প্রভাবিত করে না। নীলাঞ্জনের সংকলিত পত্রাবলির মধ্য থেকে বিনির্মাণ ঘটে অন্য এক রথীন্দ্রনাথের। পূর্বে উল্লিখিত রবীন্দ্রভুবনের উপেক্ষিত চরিত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর লিখিত পত্রাবলির মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠেন এক অপঠিত উপন্যাসের প্রধান পুরুষ। বস্ত্ততপক্ষে রথীন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্র-পরিমন্ডলের এক গৌণ চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের পুত্র, এই পরিচয় তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে গ্রাস করেছিল, আক্রান্ত হয়েছেন হীনমন্যতায়, মেনে নিয়েছেন পিতার সব আদেশ-উপদেশ, পরামর্শ, দ্বিমত পোষণ করেননি পিতার সঙ্গে। সচেষ্টভাবে পিতার সান্নিধ্য থেকে দূরে থেকেছেন। পিতৃ-আদেশ মানতে গিয়ে বিসর্জন দিয়েছেন নিজের ব্যক্তিসত্তাকে, সম্ভাবনা ছিল জীবনে নিজের মতো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, পিতার পরিচর্যা করতে গিয়ে ত্যাগ করতে হয়েছে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ছেলেকে আমেরিকায় পাঠালেন কৃষিবিজ্ঞান পড়াতে, পড়া শেষ করে ফিরে এলেন রথীন্দ্রনাথ। ছেলেকে নিয়ে এলেন শিলাইদহে, গড়তে চাইলেন কৃষিপ্রকল্প, পুত্রকে দিয়ে প্রয়োগ করালেন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির। বছর না ঘুরতেই পুত্রকে আবার নিয়ে এলেন শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় পরিচালনার কাজে। এরপর ১৯১২ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত বিরতিহীন বিদেশ ভ্রমণে রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা দেবীকে প্রায় সব সফরে কবির সঙ্গে থাকতে হয়েছে। তাঁর দেখভাল করতে হয়েছে। সফর একটু দীর্ঘমেয়াদি হলে বিদেশে শুরু করতে হয়েছে সংসার। সবকিছুর আগে অগ্রাধিকার পেয়েছে পিতা বা বাবামশাইয়ের দেখভাল বা পরিচর্যা। এমনকি ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ-ডি কোর্সে ভর্তি হওয়ার পর চলে আসতে হয়েছে রথীন্দ্রনাথকে পিতার আদেশে। পিতার নির্দেশে বিয়ে করেছেন পিতার পছন্দের পাত্রীকে, নিজের মতামত জানানোর সুযোগ পাননি। পাননি অধীত বিদ্যার প্রয়োগ ঘটাতে। যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বৌদ্ধিক অনুশীলনের ক্ষেত্রেও আসেনি যথাযথ স্বীকৃতি বা পরিচিতি। প্রাণতত্ত্ব ও অভিব্যক্তি শীর্ষক বিজ্ঞান-বিষয়ক দুটি বই বা আত্মজীবনী On the Edges of times পাঠকের কাছে একসময়ে সমাদৃত হয়েছিল। বিষয়টি এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর। পিতার জীবিতকালে লেখার কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি। অবসরক্ষণে উদ্যানচর্চা, ছবি অাঁকা, বুটিক, কাঠ ও চামড়ার কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। পিতৃস্মৃতি (১৩৭৩) প্রকাশিত হওয়ার পর বাঙালি পাঠক জানতে পারল তাঁর প্রকাশক্ষমতা এবং সাহিত্যিক-দক্ষতার ব্যাপ্তিকে। নিজেকে সবসময় সবকিছু থেকে আড়ালে রেখেছেন। মৃদুভাষী, সজ্জন ও সদা সৌজন্যপরায়ণ এ-মানুষটি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় উৎসর্গ করেছিলেন পিতার উদ্দেশে; রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ছন্দ, শৃঙ্খলা ও বাস্তবতাকে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতিমা ঠাকুর দিয়েছেন সুষমা এবং মাধুর্য। রবীন্দ্র-সৃষ্টির অন্তরালে এঁদের আত্মত্যাগ চাক্ষুষ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কবির তৃতীয় নয়নে অনুভূত হয়েছিল আত্মত্যাগের এক অনুপম চিত্রকল্প :
তোমার সকল চিত্তে,
সব বিত্তে
ভবিষ্যের অভিমুখে পথ দিতেছিল মেলে
তার লাগি যশ নাই পেলে।
কর্মের যেখানে উচ্চ দাম
সেখানে কর্মীর নাম
নেপথ্যেই থাকে একপাশে।
পিতা যেন পুত্রের কাছে ঋণ স্বীকার করছেন। রথীন্দ্রনাথের জীবন কেন পিতৃকেন্দ্রিক হলো? এ-প্রশ্নের উত্তরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকেন্দ্রিক জীবনবৃত্তে। নিজে চল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রীকে হারালেন। হারালেন দুই কন্যা এবং এক পুত্রকে। অচিরেই মৃত্যুতালিকায় যুক্ত হলো দৌহিত্র। নিজের পুনর্বিবাহের কথা বিবেচনায় আনলেন না। পারিবারিক বাস্তবতার্থ পুত্রকে যেন নিয়তির মতো রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিলো। রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁদের পুরো মনোযোগ পেলেন রবীন্দ্রনাথ। বিয়ের প্রথম বছর বাদে অবশিষ্ট ২৯ বছর এই দম্পতির জীবনের পুরো সময়টা কেটেছে বাবামশাইয়ের সেবা ও পরিচর্যায়। নিজেদের তাঁরা উৎসর্গ করেছেন কবির পরিচর্যায়। এই দম্পতি পরিচর্যাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন :
তুই বৌমাকে বলিস তিনি যেন আমাকে তার একটা অসুস্থ শিশুর মত দেখেন এবং মনে জানেন আমি এই অবস্থায় যা কিছু করেছি তার জন্যে আমি দায়ী নই।
রবীন্দ্রনাথের এই আর্তিকে রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা দেবী আপ্তবাক্যজ্ঞানে অনুসরণ করেছেন অবশিষ্ট ২৬ বছর। কবি-প্রয়াণের পর ব্রত পালনের পর্বের সমাপ্তি ঘটল। তখন এই দম্পতির মধ্যে তৈরি হয়েছে দূরত্ব, ব্যবধান এবং সম্পর্কের শৈত্যপ্রবাহ। রথীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৪৭, প্রতিমা দেবীর বয়স ৪৮। উভয়ের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব দূর হলো না। প্রকৃতির নিয়মে দূরত্বজনিত কারণে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করল অন্য এক নারী। পূর্বেই তাঁর কথা বলেছি। তাঁর নাম মীরা চট্টোপাধ্যায়। বিশ্বভারতীর শিক্ষক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী। যাঁদের বিয়ে ‘গুরুদেবে’র দৌত্যে এবং সম্মতিতে ধন্য। রূপসী, চঞ্চল ও এক কন্যার জননী মীরা রথীন্দ্রনাথের জীবনে এনে দিলেন পরিবর্তন। এর আগে থেকেই রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা শান্তিনিকেতনে আলাদা বাড়িতে থাকতে শুরু করেছেন। রথীন্দ্রনাথের জীবনে নির্মল দম্পতির আবির্ভাব হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো দেখা দিলো। মেলামেশার বিষয়টা ক্রমশ জটিলতার দিকে মোড় নিতে থাকে। রথীন্দ্রনাথের নিকটাত্মীয়রা এই মেলামেশাকে দেখেন নির্মল দম্পতির বৈষয়িক কোনো উদ্দেশ্য পূরণের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে, শান্তিনিকেতনের আমজনতা মেলামেশার মধ্যে পেয়েছে সামাজিক গসিপের উপাদান। স্ত্রী প্রতিমা দেবী শঙ্কিত হয়েছেন এই ভেবে যে : ‘ওনার সমস্ত ব্যক্তিত্ব ঐ মেয়ে গ্রাস করে নেবে।’ নির্মল দম্পতি কোনো বৈষয়িক স্বার্থ পূরণ রথীন্দ্রনাথকে দিয়ে করাননি। দেরাদুনে বাসকালে স্ত্রী-কন্যাকে তাঁদের প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেননি। শান্তিনিকেতনের কোনো সম্পত্তিতে নির্মল দম্পতিকে অংশ দেননি বা পিতার গ্রন্থস্বত্বের ভাগ দেননি। নিজের গ্রন্থস্বত্বের ভাগ দিয়েছেন স্ত্রী প্রতিমাকে, মীরাকে নয়। তবে মীরা রথীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব ঠিকই গ্রাস করেছিলেন। তাই হয়তো রথীন্দ্রনাথ দেরাদুন থেকে ফিরে আসতে পারেননি। প্রতিমা ঠাকুরের মতামত ছিল প্রজ্ঞাপ্রসূত এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। মীরা চট্টোপাধ্যায়ের মোহ থেকে রথীন্দ্রনাথ মুক্ত হতে না পারলেও স্ত্রী প্রতিমা দেবীর প্রতি একধরনের অনুরাগ বহন করেছেন আজীবন।
‘আমরা দুজনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারো প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা শোভনীয় হয় না। সেই জন্যে জেনো আমার মনে কোনো রাগ নেই – আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে প্রীতি সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ থাকে এই নতুন বছরে, তাই কামনা করি। তুমি আমার ভালবাসা নিও।’
মীরার সঙ্গে আট বছর একত্র থাকার পরও রথীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীর সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেননি। সাধ্যমতো অর্থ সাহায্য করেছেন। শারীরিক কুশলাদি নিয়েছেন। জানিয়েছেন ঘর-সংসারের টুকিটাকি সংবাদ। উল্লেখ করেননি মীরার কোনো প্রসঙ্গ। মীরার প্রসঙ্গ লেখেন ভাগ্নি নন্দিনীকে। স্বামীর কাছে লেখা পত্রে প্রতিমা দেবী নিজের আবেগকে সংযত রেখেছেন। স্বামীর কাছে জানাননি আর্তির কথা বা জ্ঞাপন করেননি কোনো আকুতি বা মিনতি। নিজের বেদনার কথা জানিয়েছেন ভাই, ননদ এবং ননদকন্যাকে। মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভাইয়ের সম্পর্ক নিয়ে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন মীরা ঠাকুর। তাঁর চিঠিতে রয়েছে প্রতিমা ঠাকুরের প্রতি অকৃত্রিম সহমর্মিতার কথা; আছে সহানুভূতির কথা। ভ্রাতার কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ এই মহিলা ক্ষোভের পাশাপাশি ভাইয়ের গুণাবলির কথাও উল্লেখ করতে ভোলেন না। ভাইয়ের অস্বাভাবিক সম্পর্ককে মেনে নিতে পারেননি। সমর্থন দিয়ে গেছেন ভ্রাতৃবধূকে। নিঃশর্তভাবে। ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, অভিমান আছে; আছে ভাইয়ের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ। নিজের ব্যর্থ বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো চেয়েছিলেন ভাইয়ের সংসারটা টিকে থাকুক। মীরা ঠাকুরের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তাঁর ক্ষোভ কেবল নির্মল দম্পতি বা ভাইয়ের প্রতি নয়, বিশ্বভারতীর প্রতিও তিনি ক্ষুব্ধ। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ যে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের প্রতি সম্মানজনক আচরণ প্রদর্শনে অপারগতা দেখিয়েছে, সেই তিক্ততার কথা ভুলতে পারেননি মীরা ঠাকুর। বিষয়টি কাকতালীয় হলেও রবীন্দ্রশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যা কেউই এলেন না শান্তিনিকেতনে। লোকলজ্জার ভয়ে প্রতিমা দেবী অনুষ্ঠান থেকে দূরে রইলেন।
আপনি তুমি রইলে দূরে সঙ্গ নিঃসঙ্গতা রথীন্দ্রনাথ গ্রন্থের মূল বিষয়টা হচ্ছে, রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কটি। সম্পর্কটি জটিল এবং বহুমাত্রিক। এ দুই বিবাহিত পুরুষ ও নারী, তাদের পূর্বেকার বিবাহিত জীবনের ছেদ ঘটালেন না। মীরা চট্টোপাধ্যায়ের স্বামী নির্মলচন্দ্রও স্ত্রীর সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছেন। এমনকি নির্মলচন্দ্রের পিতা ও পিতৃব্য – যাঁরা দেরাদুনে থাকেন, তাঁদের সঙ্গেও রথীন্দ্রনাথের পূর্বেকার সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। পিতা বা পিতৃব্য কেউই তাঁদের গৃহবধূর সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের বসবাসের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেননি। তবে তাঁরা মাঝেমধ্যে ‘মিতালী’ আসতেন, এই তথ্যটুকু আমরা বিভিন্ন চিঠি থেকে জানতে পারি। মীরা চট্টোপাধ্যায়ের মা কমলা বিশী দেরাদুনে এসে মাঝেমধ্যে থাকতেন। অর্থাৎ মেয়ের এই সংসারকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন। নির্মলচন্দ্র অবকাশকালীন সময়ে কন্যা জয়িতাকে নিয়ে আসতেন। ঠাকুরবাড়ির পুরনো বন্ধুদের অনেকেই এসেছেন দেরাদুনে রথী-মীরার মিতালীতে। এঁদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্র-অনুরাগী এলমহার্স্ট, রবীন্দ্রনাথের রানু, পঙ্কজকুমার মল্লিক, সন্তোষ সেনগুপ্ত ও সুচিত্রা মিত্র। দেরাদুনের স্থানীয় গণ্যমান্যদের অনেককেই রথীন্দ্রনাথ তাঁর গৃহে আপ্যায়িত করেছেন, দিয়েছেন উষ্ণ আতিথ্য। গড়ে তুলেছিলেন একটি সামাজিক বৃত্ত। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেননি রথীন্দ্রনাথ। সম্পর্ক-বহির্ভূত সম্পর্ককে তিনি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তাই হয়তো বাংলার বাইরে এসে মীরাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছেন। যেখানে মীরার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে কথা হবে না বা কথা উঠবে না। দেরাদুনকে বেছে নেওয়ার মূলে ছিল বাঙালি বা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী থেকে দূরে থাকার বাসনা। মীরা ছাড়াও শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসার মূলে ছিল বিশ্বভারতীর নিজস্ব রাজনীতি। এ-কথা ঠিক যে, রথীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সদ্যবিদায়ী উপাচার্য পর্যন্ত – কোনো উপাচার্যের ভাগ্যে নিষ্কলুষ ছাড়পত্র জোটেনি। ভাগ্য ভালো বলে অশীন দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা তুলনামূলকভাবে হ্রস, যেহেতু তাঁর কার্যকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। অব্যবস্থাপনা শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য বললে কম বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, আর্থিক সংকট ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা কোনো অংশেই কম ছিল না। তাঁর সময় পর্যন্ত বিশ্বভারতীর চালিকাশক্তি হিসেবে তাঁর উপস্থিতিই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়েছে। বিশ্বভারতী চলেছে কবি-ব্যক্তিত্বের ওপর ভর করে, চলার তালটা ছিল জমিদারি ব্যবস্থার মতো। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করেননি রবীন্দ্রনাথ। সব দায়দায়িত্ব নিজে বহন করেছেন। গড়ে তোলেননি বিকল্প নেতৃত্ব। রথীন্দ্রনাথ দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পিতা-পুত্রের ব্যক্তিত্বের তারতম্য সমস্যাকে জটিল করে তোলে। নিজের ব্যক্তিগত বিচ্যুতি যুক্ত হয়ে শান্তিনিকেতনে তাঁর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। আর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার মহিমায় তাঁর ব্যক্তিগত বিচ্যুতি এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কাহিনি দিল্লিতে পৌঁছে গেল ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়ে। যে-কাহিনির উপসংহারে ছিল উপাচার্যের পদত্যাগ। রথীন্দ্রনাথের বিচ্যুতি ছিল, ছিল প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার দায়। তারপরও তাঁর অতীত অবদানের কথা বিস্মৃত হয়ে বিশ্বভারতী থেকে এক অবমাননাকর পরিস্থিতিতে চলে যেতে হলো স্বেচ্ছানির্বাসনে। ক্রমশ বিস্মৃত হয়ে এলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আপনি তুমি রইলে দূরে সঙ্গ নিঃসঙ্গতায় রথীন্দ্রনাথ গ্রন্থে রথীন্দ্রনাথকে বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে আমাদের নজরে এনেছেন। এ-বইয়ের কয়েকটি চিঠিতে পাওয়া যাবে বা জানা যাবে রথীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নেহেরুর অবস্থান, অনিল চন্দ, হুমায়ুন কবির এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা। অনিল চন্দের ভূমিকা নিয়ে রথীন্দ্রনাথ সন্দেহ করেছেন, তবে এ-বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য দিতে পারেননি লেখক-সংকলক নীলাঞ্জন। ঘাটতি রয়েছে সম্পাদনার ক্ষেত্রেও। যেমন : চিঠিগুলো সংখ্যাজ্ঞাপক সূচক দ্বারা বিন্যস্ত হলে ধারাবাহিকতা বজায় থাকত। পত্রে উল্লিখিত ব্যক্তিপরিচয়ে কোনো ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। যেমন : ব্যক্তিপরিচয়ে পঙ্কজকুমার মল্লিকের উল্লেখ থাকলেও বাদ পড়েছে সন্তোষ সেনগুপ্তের নাম। ‘ব্যক্তিপরিচয়’ শীর্ষক অধ্যায়ে আরো আঠারোজনের নাম থাকা জরুরি। যথা : সুরেন, ধীরা, সুধীর, রজন, কমলা বিশী, বীরু, অলক, রানু, প্রবোধ বাগচি, অপূর্ব চন্দ, রানী চন্দ, হুমায়ুন কবির, নীহাররঞ্জন রায় – এঁদের পরিচিতি বাদ পড়ায় পত্রাবলীর সম্পাদনা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। সঙ্গে যোগ করার অবকাশ ছিল নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাবা ও কাকার পরিচিতি। মীরা চট্টোপাধ্যায়ের মায়ের উল্লেখ আছে, বাদ পড়েছে তাঁর পারিবারিক পরিচিতি। বিশেষ করে সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত পত্রের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি দেওয়াটা জরুরি ছিল। নীলাঞ্জন বিষয়টা নির্বাচনে সাহসী হলেও সম্পাদনার ঘাটতিটা সহজেই চোখে পড়ে।
মীরা চট্টোপাধ্যায়ের দুটি চিঠি গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পত্র দুটি তাঁর স্বামী নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে লেখা। রথীন্দ্রনাথের কাছে লেখা মীরা চট্টোপাধ্যায়ের কোনো চিঠি নেই। তাঁর কোনো চিঠি কি সংরক্ষিত হয়নি? লেখক অবশ্য বলেছেন যে, তাঁর ‘কোনও চিঠির সন্ধান এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি’। ফলে আমাদেরকে রথীন্দ্রনাথের চিঠির ওপর নির্ভর করে রথীন্দ্র-মীরার সম্পর্কটা বুঝতে হবে। রথীন্দ্রনাথ মীরার স্বামীকে বেশ কয়েকটি পত্রে সরাসরি মীরার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে সংযত ভাষায়, সতর্কতার সঙ্গে। নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অস্পষ্টভাবে হলেও মীরার সঙ্গে একত্রে বসবাস করার অনুমোদন নিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ। মীরার সঙ্গে তাঁর সখ্যের মূল্য নির্মলচন্দ্রকে কম দিতে হয়নি। তাঁকেও ত্যাগ করতে হয়েছে নিজস্ব পারিবারিক জীবন। মীরার প্রতি দুর্বলতা বা মোহকে কাটিয়ে উঠতে পারেননি রথীন্দ্রনাথ। তিনি মীরার প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা তাঁর স্বামীকে জানাতে ভোলেন না। মীরার প্রতি আকর্ষণ অনুভবে তিনি বিস্মৃত হন তাঁর বয়স এবং সামাজিক অবস্থানের কথা :
আমার কেবল মীরু আছে – সেই-ই আমার সমস্ত জগৎ ব্রহ্মান্ড।
অথবা,
আজ ৩রা – আর ৭ দিন। সময় যত কাছে আসছে মন যেন আরো অস্থির হয়ে উঠছে। কি করে শান্ত করি বল তো। ফটো আর দেখি না – তাতে আরো বিচলিত করে।
এ যেন কোনো অতি তরুণের লেখা প্রেমপত্রের অংশবিশেষ। মনে হয় না, একজন প্রৌঢ় এর রচয়িতা। যিনি অতিবাহিত করে এসেছেন তিন দশকের দাম্পত্য জীবন। যে-দাম্পত্য জীবনকে তিনি খারিজ করে দেননি। সম্পর্কের জটিলতা এখানেই তৈরি হয়ে যায়। একইভাবে খারিজ করে দেননি মীরার স্বামী নিজের দাম্পত্য জীবনকে। ‘রথীদা’র প্রতি অনুভব করেছেন দায়বদ্ধতা। যে-দায়বদ্ধতা থেকে নীরবে মেনে নিয়েছেন সামাজিক গ্লানি ও লোকলজ্জাকে। হয়তো এই বোধ থেকেই রথীন্দ্রনাথের মুখাগ্নি করেননি তাঁর পুত্র জয়ব্রত। মুখাগ্নি করতে এসেছিলেন ঠাকুরবাড়ি থেকে সুপ্রিয় ঠাকুর।
রফিক কায়সার
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে কবি-প্রয়াণের পর থেকেই। তাঁকে নিয়ে কবির জীবৎকালেও ব্যক্তিবিশেষের নেতিবাচক মতামত বা মন্তব্যকে কবি যথেষ্ট গুরুতব দিয়ে খন্ডন করেছেন বা জবাব দিয়েছেন। ব্যক্তিবিশেষের মন্তব্য বা মতামত কবির জীবৎকালে সামাজিক পরিবাদ বা শান্তিনিকেতনে রথীন্দ্রনাথবিরোধী জনমত তীব্রতা পায়নি। কবি-প্রয়াণের পর থেকেই রথীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন নিয়ে শান্তিনিকেতনের বাসিন্দাদের জনরব তৈরি হতে থাকে। তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। যৌক্তিক কারণেই রবীন্দ্রনাথের পরিবারের পক্ষ থেকে এই সম্পর্ক নিয়ে কথা ওঠে, তাঁর গোচরে আনা হয় সামাজিক লোকনিন্দার প্রসঙ্গ। এ-প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথের অবস্থান ছিল নেতিবাচক – তিনি মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে অস্বীকার না করে শান্তিনিকেতন থেকে প্রস্থানকে বিবেচনায় আনেন। ইন্দিরা চৌধুরী সরাসরি রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। বিশ্বভারতীর আচার্য ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কানেও খবরটি পৌঁছে যায়। রথীন্দ্রনাথের ছোট বোন মীরা ঠাকুর প্রথম থেকেই এই সম্পর্ক নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অগ্রজের প্রতি, আবার লুপ্ত করেননি অগ্রজের প্রতি স্বাভাবিক শ্রদ্ধাবোধ। ভ্রাতৃবধূর প্রতি অব্যাহতভাবে জ্ঞাপন করেছে সহমর্মিতা এবং সহানুভূতি। রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্ক নিয়ে সরাসরি কটাক্ষ করেছেন রথীন্দ্রনাথের ভাগ্নি নন্দিতা।
রথীন্দ্রনাথের সম্পর্ক-বহির্ভূত আচরণ যেমন শান্তিনিকেতনে নিন্দার ঝড় তুলেছিল, তেমনি উপাচার্য হিসেবে তাঁর কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জড়িয়ে পড়েন তহবিল তছরুপের মামলায়। একপর্যায়ে মামলায় হাজিরা দিতেও অনাগ্রহী হয়ে পড়েন রথীন্দ্রনাথ। এই পর্যায়ে সবকিছু ছাপিয়ে মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাজারীবাগে ‘হাওয়া বদল’ করতে যাওয়ার ঘটনা তাঁর পদমর্যাদা এবং ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করে। বিশ্বভারতীর স্থানীয় এবং দিল্লির প্রধানমন্ত্রীর দফতর ঘটনাটিকে সহজভাবে নিতে পারেনি। রবীন্দ্রানুরাগী নেহেরু নিজেও রথীন্দ্রনাথের বিষয়ে বিব্রত হন। প্রশান্ত মহালনবীশকে দিয়ে তাঁর কাছে খবর পাঠানো হলো যে, ‘বার্তা’র সারমর্ম হলো, চট্টোপাধ্যায় দম্পতিকে শান্তিনিকেতন থেকে হটাও। রথীন্দ্রনাথ উল্লিখিত ‘বার্তা’র মর্মার্থ গ্রহণ না করে বেছে নিলেন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত। অভিমান করে ছেড়ে এলেন শান্তিনিকেতন। সঙ্গে এলেন মীরা চট্টোপাধ্যায়। জীবনের শেষ আট বছর অতিবাহিত করেছেন এই নারীর সান্নিধ্যে – দেরাদুনে। এই ঘটনাক্রম বিশ্বভারতীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছে কমবেশি জানা।
পঞ্চাশের দশকের পুরোটাই শান্তিনিকেতনবাসীর কাছে চট্টোপাধ্যায় দম্পতির সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে ছিল ‘রসালো গল্প’, ছিল বাস্তব আর কল্পনার মিশেল দেওয়া নানাবিধ চটুল কাহিনি। সময়ের নিয়মে একসময়ে এই গল্পগাছার প্রবাহ থেমে আসে, রবীন্দ্রশতবর্ষের বছরে রথীন্দ্রনাথের নীরব এবং নিশ্চুপ প্রয়াণে শেষ হয়ে আসে এই পর্ব। অনেকটা রবীন্দ্র-কথিত ছোটগল্পের সংজ্ঞার মতো যেন ‘শেষ হয়ে হইল না শেষে’র মতো গত শতাব্দীর আশির দশকে কোনো এক শারদীয় সংখ্যায় (পত্রিকা এবং গল্পের নাম ভুলে গেছি) শংকর শান্তিনিকেতনের পটভূমিতে একটি গল্প লিখেছিলেন। গল্পটির ঘটনাক্রমে স্পষ্টভাবে কবিপুত্রের আদল ফুটে ওঠে। বোঝা যায় মীরা চট্টোপাধ্যায়কে। গল্পের আবহে তৈরি হয় উভয়ের মধ্যকার জৈবিক বন্ধন। শংকর গল্পটিতে নারীপ্রেম এবং পুত্রক্ষুধার আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিতে চেয়েছেন, যার ভিত্তি হচ্ছে প্রচলিত জনরব। প্রচলিত জনরবকে বাতিল করে রবীন্দ্রসার্ধশত বছরে কবিপুত্রকে একটা ঐতিহাসিক পটভূমিতে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হয়েছেন নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আপনি তুমি রইলে দূরে সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথে ব্যবহৃত হয়েছে সর্বমোট ১২৭টি চিঠি, একটি টেলিগ্রাম, তিনটি শংসাপত্র, পৌরসভার কাছে লিখিত একটি পত্রের অনুলিপি এবং কয়েকটি চিরকুটের সমাহারে সংকলিত হয়েছে এ-গ্রন্থটি। এ-গ্রন্থে আলোকচিত্র আছে ৫১টি। চিঠিপত্রের অনুলিপিও আছে বেশ কয়েকটি। সম্পাদকের ভূমিকাটি সারবান ও তথ্যবহুল। রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা দেবীর সম্পর্কের জটিলতা-বিষয়ক ব্যাখ্যাটি যৌক্তিক এবং হৃদয়দ্রাবী।
১৯১৪ সালে লেখা একটি চিঠিতে, তিন কন্যার ব্যর্থ, সংকটক্লিষ্ট পরিণয় জীবনের অসহায় সাক্ষী রবীন্দ্রনাথ তাঁর একমাত্র পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে একটি দূরদর্শী মিনতি জানিয়েছিলেন :
তোমাদের পরস্পরের জীবন যাতে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে সেদিকে বিশেষ চেষ্টা রেখো। মানুষের হৃদয়ের যথার্থ পবিত্র মিলন, সে কোনদিন শেষ হয় না – প্রতিদিন তার নিত্যনূতন সাধনা। ঈশ্বর তোমাদের চিত্তে সেই পবিত্র সাধনাকে সজীব করে জাগ্রত করে রেখে দিন এই কামনা করি।
অনিবার্য এক দূরত্বে বিশ্লিষ্ট রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দুই স্বতন্ত্র, স্বাধীন ভুবনে ‘হৃদয়ের সেই ‘যথার্থ পবিত্র মিলনের’ এক ব্যতিক্রমী সমীকরণ রচনা করে গিয়েছিলেন।’
প্রতিমা-রথীন্দ্রনাথ-মীরা চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিমানস থেকে কি কোনো সমীকরণসূত্র নির্মিত হয়েছে? সম্পর্কের সমীকরণের দায়টা ছিল রথীন্দ্রনাথের ওপর। পাঠকের উদ্দেশে নীলাঞ্জন জোগান দিয়েছেন পত্রাবলির, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যক্তিপরিচিতি এবং আলোকচিত্র। মুখবন্ধে বিশ্বভারতীর উপাচার্য রজত রায় ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন রথীন্দ্রনাথের প্রতি কর্তৃপক্ষের দুর্ভাগ্যজনক আচরণের জন্য, উপাচার্যের এই বচন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। দ্বিতীয়ত, লেখক ও সংকলক নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রভুবনের উপেক্ষিত চরিত্র রথীন্দ্রনাথকে যৌক্তিক ও তথ্যভিত্তিক উপাদান-সহকারে পাদপ্রদীপের আলোতে এনেছেন। ব্যক্তিগত পত্রাবলি জননজরে উন্মোচিত করে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন জয়ব্রত চট্টোপাধ্যায়। পত্রগুলো সংরক্ষণ করেছিলেন নির্মল চট্টোপাধ্যায় – জটিল এক মানবিক সম্পর্কের প্রসঙ্গকে কালের হাতে সঁপে দিয়েছেন নিঃশঙ্কচিত্তে। ফলে আমাদের প্রচলিত মূল্যবোধ এবং সামাজিক সম্পর্কের দিকগুলো প্রবলভাবে নড়ে ওঠে, ভেঙে পড়ে না ব্যতিক্রর্মী জীবনচর্যা বলে। সম্পর্কের এই জটিলতা আমাদের ভাবিত করলেও অনিবার্যভাবেই প্রভাবিত করে না। নীলাঞ্জনের সংকলিত পত্রাবলির মধ্য থেকে বিনির্মাণ ঘটে অন্য এক রথীন্দ্রনাথের। পূর্বে উল্লিখিত রবীন্দ্রভুবনের উপেক্ষিত চরিত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর লিখিত পত্রাবলির মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠেন এক অপঠিত উপন্যাসের প্রধান পুরুষ। বস্ত্ততপক্ষে রথীন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্র-পরিমন্ডলের এক গৌণ চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের পুত্র, এই পরিচয় তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে গ্রাস করেছিল, আক্রান্ত হয়েছেন হীনমন্যতায়, মেনে নিয়েছেন পিতার সব আদেশ-উপদেশ, পরামর্শ, দ্বিমত পোষণ করেননি পিতার সঙ্গে। সচেষ্টভাবে পিতার সান্নিধ্য থেকে দূরে থেকেছেন। পিতৃ-আদেশ মানতে গিয়ে বিসর্জন দিয়েছেন নিজের ব্যক্তিসত্তাকে, সম্ভাবনা ছিল জীবনে নিজের মতো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, পিতার পরিচর্যা করতে গিয়ে ত্যাগ করতে হয়েছে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ছেলেকে আমেরিকায় পাঠালেন কৃষিবিজ্ঞান পড়াতে, পড়া শেষ করে ফিরে এলেন রথীন্দ্রনাথ। ছেলেকে নিয়ে এলেন শিলাইদহে, গড়তে চাইলেন কৃষিপ্রকল্প, পুত্রকে দিয়ে প্রয়োগ করালেন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির। বছর না ঘুরতেই পুত্রকে আবার নিয়ে এলেন শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় পরিচালনার কাজে। এরপর ১৯১২ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত বিরতিহীন বিদেশ ভ্রমণে রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা দেবীকে প্রায় সব সফরে কবির সঙ্গে থাকতে হয়েছে। তাঁর দেখভাল করতে হয়েছে। সফর একটু দীর্ঘমেয়াদি হলে বিদেশে শুরু করতে হয়েছে সংসার। সবকিছুর আগে অগ্রাধিকার পেয়েছে পিতা বা বাবামশাইয়ের দেখভাল বা পরিচর্যা। এমনকি ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ-ডি কোর্সে ভর্তি হওয়ার পর চলে আসতে হয়েছে রথীন্দ্রনাথকে পিতার আদেশে। পিতার নির্দেশে বিয়ে করেছেন পিতার পছন্দের পাত্রীকে, নিজের মতামত জানানোর সুযোগ পাননি। পাননি অধীত বিদ্যার প্রয়োগ ঘটাতে। যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বৌদ্ধিক অনুশীলনের ক্ষেত্রেও আসেনি যথাযথ স্বীকৃতি বা পরিচিতি। প্রাণতত্ত্ব ও অভিব্যক্তি শীর্ষক বিজ্ঞান-বিষয়ক দুটি বই বা আত্মজীবনী On the Edges of times পাঠকের কাছে একসময়ে সমাদৃত হয়েছিল। বিষয়টি এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর। পিতার জীবিতকালে লেখার কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি। অবসরক্ষণে উদ্যানচর্চা, ছবি অাঁকা, বুটিক, কাঠ ও চামড়ার কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। পিতৃস্মৃতি (১৩৭৩) প্রকাশিত হওয়ার পর বাঙালি পাঠক জানতে পারল তাঁর প্রকাশক্ষমতা এবং সাহিত্যিক-দক্ষতার ব্যাপ্তিকে। নিজেকে সবসময় সবকিছু থেকে আড়ালে রেখেছেন। মৃদুভাষী, সজ্জন ও সদা সৌজন্যপরায়ণ এ-মানুষটি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় উৎসর্গ করেছিলেন পিতার উদ্দেশে; রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ছন্দ, শৃঙ্খলা ও বাস্তবতাকে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতিমা ঠাকুর দিয়েছেন সুষমা এবং মাধুর্য। রবীন্দ্র-সৃষ্টির অন্তরালে এঁদের আত্মত্যাগ চাক্ষুষ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কবির তৃতীয় নয়নে অনুভূত হয়েছিল আত্মত্যাগের এক অনুপম চিত্রকল্প :
তোমার সকল চিত্তে,
সব বিত্তে
ভবিষ্যের অভিমুখে পথ দিতেছিল মেলে
তার লাগি যশ নাই পেলে।
কর্মের যেখানে উচ্চ দাম
সেখানে কর্মীর নাম
নেপথ্যেই থাকে একপাশে।
পিতা যেন পুত্রের কাছে ঋণ স্বীকার করছেন। রথীন্দ্রনাথের জীবন কেন পিতৃকেন্দ্রিক হলো? এ-প্রশ্নের উত্তরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকেন্দ্রিক জীবনবৃত্তে। নিজে চল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রীকে হারালেন। হারালেন দুই কন্যা এবং এক পুত্রকে। অচিরেই মৃত্যুতালিকায় যুক্ত হলো দৌহিত্র। নিজের পুনর্বিবাহের কথা বিবেচনায় আনলেন না। পারিবারিক বাস্তবতার্থ পুত্রকে যেন নিয়তির মতো রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিলো। রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁদের পুরো মনোযোগ পেলেন রবীন্দ্রনাথ। বিয়ের প্রথম বছর বাদে অবশিষ্ট ২৯ বছর এই দম্পতির জীবনের পুরো সময়টা কেটেছে বাবামশাইয়ের সেবা ও পরিচর্যায়। নিজেদের তাঁরা উৎসর্গ করেছেন কবির পরিচর্যায়। এই দম্পতি পরিচর্যাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন :
তুই বৌমাকে বলিস তিনি যেন আমাকে তার একটা অসুস্থ শিশুর মত দেখেন এবং মনে জানেন আমি এই অবস্থায় যা কিছু করেছি তার জন্যে আমি দায়ী নই।
রবীন্দ্রনাথের এই আর্তিকে রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা দেবী আপ্তবাক্যজ্ঞানে অনুসরণ করেছেন অবশিষ্ট ২৬ বছর। কবি-প্রয়াণের পর ব্রত পালনের পর্বের সমাপ্তি ঘটল। তখন এই দম্পতির মধ্যে তৈরি হয়েছে দূরত্ব, ব্যবধান এবং সম্পর্কের শৈত্যপ্রবাহ। রথীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৪৭, প্রতিমা দেবীর বয়স ৪৮। উভয়ের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব দূর হলো না। প্রকৃতির নিয়মে দূরত্বজনিত কারণে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করল অন্য এক নারী। পূর্বেই তাঁর কথা বলেছি। তাঁর নাম মীরা চট্টোপাধ্যায়। বিশ্বভারতীর শিক্ষক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী। যাঁদের বিয়ে ‘গুরুদেবে’র দৌত্যে এবং সম্মতিতে ধন্য। রূপসী, চঞ্চল ও এক কন্যার জননী মীরা রথীন্দ্রনাথের জীবনে এনে দিলেন পরিবর্তন। এর আগে থেকেই রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা শান্তিনিকেতনে আলাদা বাড়িতে থাকতে শুরু করেছেন। রথীন্দ্রনাথের জীবনে নির্মল দম্পতির আবির্ভাব হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো দেখা দিলো। মেলামেশার বিষয়টা ক্রমশ জটিলতার দিকে মোড় নিতে থাকে। রথীন্দ্রনাথের নিকটাত্মীয়রা এই মেলামেশাকে দেখেন নির্মল দম্পতির বৈষয়িক কোনো উদ্দেশ্য পূরণের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে, শান্তিনিকেতনের আমজনতা মেলামেশার মধ্যে পেয়েছে সামাজিক গসিপের উপাদান। স্ত্রী প্রতিমা দেবী শঙ্কিত হয়েছেন এই ভেবে যে : ‘ওনার সমস্ত ব্যক্তিত্ব ঐ মেয়ে গ্রাস করে নেবে।’ নির্মল দম্পতি কোনো বৈষয়িক স্বার্থ পূরণ রথীন্দ্রনাথকে দিয়ে করাননি। দেরাদুনে বাসকালে স্ত্রী-কন্যাকে তাঁদের প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেননি। শান্তিনিকেতনের কোনো সম্পত্তিতে নির্মল দম্পতিকে অংশ দেননি বা পিতার গ্রন্থস্বত্বের ভাগ দেননি। নিজের গ্রন্থস্বত্বের ভাগ দিয়েছেন স্ত্রী প্রতিমাকে, মীরাকে নয়। তবে মীরা রথীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব ঠিকই গ্রাস করেছিলেন। তাই হয়তো রথীন্দ্রনাথ দেরাদুন থেকে ফিরে আসতে পারেননি। প্রতিমা ঠাকুরের মতামত ছিল প্রজ্ঞাপ্রসূত এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। মীরা চট্টোপাধ্যায়ের মোহ থেকে রথীন্দ্রনাথ মুক্ত হতে না পারলেও স্ত্রী প্রতিমা দেবীর প্রতি একধরনের অনুরাগ বহন করেছেন আজীবন।
‘আমরা দুজনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারো প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা শোভনীয় হয় না। সেই জন্যে জেনো আমার মনে কোনো রাগ নেই – আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে প্রীতি সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ থাকে এই নতুন বছরে, তাই কামনা করি। তুমি আমার ভালবাসা নিও।’
মীরার সঙ্গে আট বছর একত্র থাকার পরও রথীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীর সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেননি। সাধ্যমতো অর্থ সাহায্য করেছেন। শারীরিক কুশলাদি নিয়েছেন। জানিয়েছেন ঘর-সংসারের টুকিটাকি সংবাদ। উল্লেখ করেননি মীরার কোনো প্রসঙ্গ। মীরার প্রসঙ্গ লেখেন ভাগ্নি নন্দিনীকে। স্বামীর কাছে লেখা পত্রে প্রতিমা দেবী নিজের আবেগকে সংযত রেখেছেন। স্বামীর কাছে জানাননি আর্তির কথা বা জ্ঞাপন করেননি কোনো আকুতি বা মিনতি। নিজের বেদনার কথা জানিয়েছেন ভাই, ননদ এবং ননদকন্যাকে। মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভাইয়ের সম্পর্ক নিয়ে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন মীরা ঠাকুর। তাঁর চিঠিতে রয়েছে প্রতিমা ঠাকুরের প্রতি অকৃত্রিম সহমর্মিতার কথা; আছে সহানুভূতির কথা। ভ্রাতার কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ এই মহিলা ক্ষোভের পাশাপাশি ভাইয়ের গুণাবলির কথাও উল্লেখ করতে ভোলেন না। ভাইয়ের অস্বাভাবিক সম্পর্ককে মেনে নিতে পারেননি। সমর্থন দিয়ে গেছেন ভ্রাতৃবধূকে। নিঃশর্তভাবে। ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, অভিমান আছে; আছে ভাইয়ের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ। নিজের ব্যর্থ বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো চেয়েছিলেন ভাইয়ের সংসারটা টিকে থাকুক। মীরা ঠাকুরের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তাঁর ক্ষোভ কেবল নির্মল দম্পতি বা ভাইয়ের প্রতি নয়, বিশ্বভারতীর প্রতিও তিনি ক্ষুব্ধ। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ যে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের প্রতি সম্মানজনক আচরণ প্রদর্শনে অপারগতা দেখিয়েছে, সেই তিক্ততার কথা ভুলতে পারেননি মীরা ঠাকুর। বিষয়টি কাকতালীয় হলেও রবীন্দ্রশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যা কেউই এলেন না শান্তিনিকেতনে। লোকলজ্জার ভয়ে প্রতিমা দেবী অনুষ্ঠান থেকে দূরে রইলেন।
আপনি তুমি রইলে দূরে সঙ্গ নিঃসঙ্গতা রথীন্দ্রনাথ গ্রন্থের মূল বিষয়টা হচ্ছে, রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কটি। সম্পর্কটি জটিল এবং বহুমাত্রিক। এ দুই বিবাহিত পুরুষ ও নারী, তাদের পূর্বেকার বিবাহিত জীবনের ছেদ ঘটালেন না। মীরা চট্টোপাধ্যায়ের স্বামী নির্মলচন্দ্রও স্ত্রীর সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছেন। এমনকি নির্মলচন্দ্রের পিতা ও পিতৃব্য – যাঁরা দেরাদুনে থাকেন, তাঁদের সঙ্গেও রথীন্দ্রনাথের পূর্বেকার সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। পিতা বা পিতৃব্য কেউই তাঁদের গৃহবধূর সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের বসবাসের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেননি। তবে তাঁরা মাঝেমধ্যে ‘মিতালী’ আসতেন, এই তথ্যটুকু আমরা বিভিন্ন চিঠি থেকে জানতে পারি। মীরা চট্টোপাধ্যায়ের মা কমলা বিশী দেরাদুনে এসে মাঝেমধ্যে থাকতেন। অর্থাৎ মেয়ের এই সংসারকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন। নির্মলচন্দ্র অবকাশকালীন সময়ে কন্যা জয়িতাকে নিয়ে আসতেন। ঠাকুরবাড়ির পুরনো বন্ধুদের অনেকেই এসেছেন দেরাদুনে রথী-মীরার মিতালীতে। এঁদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্র-অনুরাগী এলমহার্স্ট, রবীন্দ্রনাথের রানু, পঙ্কজকুমার মল্লিক, সন্তোষ সেনগুপ্ত ও সুচিত্রা মিত্র। দেরাদুনের স্থানীয় গণ্যমান্যদের অনেককেই রথীন্দ্রনাথ তাঁর গৃহে আপ্যায়িত করেছেন, দিয়েছেন উষ্ণ আতিথ্য। গড়ে তুলেছিলেন একটি সামাজিক বৃত্ত। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেননি রথীন্দ্রনাথ। সম্পর্ক-বহির্ভূত সম্পর্ককে তিনি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তাই হয়তো বাংলার বাইরে এসে মীরাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছেন। যেখানে মীরার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে কথা হবে না বা কথা উঠবে না। দেরাদুনকে বেছে নেওয়ার মূলে ছিল বাঙালি বা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী থেকে দূরে থাকার বাসনা। মীরা ছাড়াও শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসার মূলে ছিল বিশ্বভারতীর নিজস্ব রাজনীতি। এ-কথা ঠিক যে, রথীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সদ্যবিদায়ী উপাচার্য পর্যন্ত – কোনো উপাচার্যের ভাগ্যে নিষ্কলুষ ছাড়পত্র জোটেনি। ভাগ্য ভালো বলে অশীন দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা তুলনামূলকভাবে হ্রস, যেহেতু তাঁর কার্যকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। অব্যবস্থাপনা শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য বললে কম বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, আর্থিক সংকট ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা কোনো অংশেই কম ছিল না। তাঁর সময় পর্যন্ত বিশ্বভারতীর চালিকাশক্তি হিসেবে তাঁর উপস্থিতিই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়েছে। বিশ্বভারতী চলেছে কবি-ব্যক্তিত্বের ওপর ভর করে, চলার তালটা ছিল জমিদারি ব্যবস্থার মতো। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করেননি রবীন্দ্রনাথ। সব দায়দায়িত্ব নিজে বহন করেছেন। গড়ে তোলেননি বিকল্প নেতৃত্ব। রথীন্দ্রনাথ দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পিতা-পুত্রের ব্যক্তিত্বের তারতম্য সমস্যাকে জটিল করে তোলে। নিজের ব্যক্তিগত বিচ্যুতি যুক্ত হয়ে শান্তিনিকেতনে তাঁর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। আর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার মহিমায় তাঁর ব্যক্তিগত বিচ্যুতি এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কাহিনি দিল্লিতে পৌঁছে গেল ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়ে। যে-কাহিনির উপসংহারে ছিল উপাচার্যের পদত্যাগ। রথীন্দ্রনাথের বিচ্যুতি ছিল, ছিল প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার দায়। তারপরও তাঁর অতীত অবদানের কথা বিস্মৃত হয়ে বিশ্বভারতী থেকে এক অবমাননাকর পরিস্থিতিতে চলে যেতে হলো স্বেচ্ছানির্বাসনে। ক্রমশ বিস্মৃত হয়ে এলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আপনি তুমি রইলে দূরে সঙ্গ নিঃসঙ্গতায় রথীন্দ্রনাথ গ্রন্থে রথীন্দ্রনাথকে বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে আমাদের নজরে এনেছেন। এ-বইয়ের কয়েকটি চিঠিতে পাওয়া যাবে বা জানা যাবে রথীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নেহেরুর অবস্থান, অনিল চন্দ, হুমায়ুন কবির এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা। অনিল চন্দের ভূমিকা নিয়ে রথীন্দ্রনাথ সন্দেহ করেছেন, তবে এ-বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য দিতে পারেননি লেখক-সংকলক নীলাঞ্জন। ঘাটতি রয়েছে সম্পাদনার ক্ষেত্রেও। যেমন : চিঠিগুলো সংখ্যাজ্ঞাপক সূচক দ্বারা বিন্যস্ত হলে ধারাবাহিকতা বজায় থাকত। পত্রে উল্লিখিত ব্যক্তিপরিচয়ে কোনো ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। যেমন : ব্যক্তিপরিচয়ে পঙ্কজকুমার মল্লিকের উল্লেখ থাকলেও বাদ পড়েছে সন্তোষ সেনগুপ্তের নাম। ‘ব্যক্তিপরিচয়’ শীর্ষক অধ্যায়ে আরো আঠারোজনের নাম থাকা জরুরি। যথা : সুরেন, ধীরা, সুধীর, রজন, কমলা বিশী, বীরু, অলক, রানু, প্রবোধ বাগচি, অপূর্ব চন্দ, রানী চন্দ, হুমায়ুন কবির, নীহাররঞ্জন রায় – এঁদের পরিচিতি বাদ পড়ায় পত্রাবলীর সম্পাদনা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। সঙ্গে যোগ করার অবকাশ ছিল নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাবা ও কাকার পরিচিতি। মীরা চট্টোপাধ্যায়ের মায়ের উল্লেখ আছে, বাদ পড়েছে তাঁর পারিবারিক পরিচিতি। বিশেষ করে সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত পত্রের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি দেওয়াটা জরুরি ছিল। নীলাঞ্জন বিষয়টা নির্বাচনে সাহসী হলেও সম্পাদনার ঘাটতিটা সহজেই চোখে পড়ে।
মীরা চট্টোপাধ্যায়ের দুটি চিঠি গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পত্র দুটি তাঁর স্বামী নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে লেখা। রথীন্দ্রনাথের কাছে লেখা মীরা চট্টোপাধ্যায়ের কোনো চিঠি নেই। তাঁর কোনো চিঠি কি সংরক্ষিত হয়নি? লেখক অবশ্য বলেছেন যে, তাঁর ‘কোনও চিঠির সন্ধান এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি’। ফলে আমাদেরকে রথীন্দ্রনাথের চিঠির ওপর নির্ভর করে রথীন্দ্র-মীরার সম্পর্কটা বুঝতে হবে। রথীন্দ্রনাথ মীরার স্বামীকে বেশ কয়েকটি পত্রে সরাসরি মীরার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে সংযত ভাষায়, সতর্কতার সঙ্গে। নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অস্পষ্টভাবে হলেও মীরার সঙ্গে একত্রে বসবাস করার অনুমোদন নিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ। মীরার সঙ্গে তাঁর সখ্যের মূল্য নির্মলচন্দ্রকে কম দিতে হয়নি। তাঁকেও ত্যাগ করতে হয়েছে নিজস্ব পারিবারিক জীবন। মীরার প্রতি দুর্বলতা বা মোহকে কাটিয়ে উঠতে পারেননি রথীন্দ্রনাথ। তিনি মীরার প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা তাঁর স্বামীকে জানাতে ভোলেন না। মীরার প্রতি আকর্ষণ অনুভবে তিনি বিস্মৃত হন তাঁর বয়স এবং সামাজিক অবস্থানের কথা :
আমার কেবল মীরু আছে – সেই-ই আমার সমস্ত জগৎ ব্রহ্মান্ড।
অথবা,
আজ ৩রা – আর ৭ দিন। সময় যত কাছে আসছে মন যেন আরো অস্থির হয়ে উঠছে। কি করে শান্ত করি বল তো। ফটো আর দেখি না – তাতে আরো বিচলিত করে।
এ যেন কোনো অতি তরুণের লেখা প্রেমপত্রের অংশবিশেষ। মনে হয় না, একজন প্রৌঢ় এর রচয়িতা। যিনি অতিবাহিত করে এসেছেন তিন দশকের দাম্পত্য জীবন। যে-দাম্পত্য জীবনকে তিনি খারিজ করে দেননি। সম্পর্কের জটিলতা এখানেই তৈরি হয়ে যায়। একইভাবে খারিজ করে দেননি মীরার স্বামী নিজের দাম্পত্য জীবনকে। ‘রথীদা’র প্রতি অনুভব করেছেন দায়বদ্ধতা। যে-দায়বদ্ধতা থেকে নীরবে মেনে নিয়েছেন সামাজিক গ্লানি ও লোকলজ্জাকে। হয়তো এই বোধ থেকেই রথীন্দ্রনাথের মুখাগ্নি করেননি তাঁর পুত্র জয়ব্রত। মুখাগ্নি করতে এসেছিলেন ঠাকুরবাড়ি থেকে সুপ্রিয় ঠাকুর।
No comments:
Post a Comment