গ্রন্থসংবেদী রবীন্দ্রনাথ
সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়
অ্যান্টিক কাগজে ছাপা কবিতার বই, ...
‘ছুটির আয়োজন’-এর উপকরণগুলির মধ্যে বইয়ের প্রতি রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকেই একটু বেশি সংবেদনশীল। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাত-আট বছর। বয়সে বেশ খানিকটা বড় ভাগিনেয় জ্যোতিঃপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহে, একটি নীল কাগজের খাতায় ‘কতকগুলি অসমান লাইন’ কেটে রবীন্দ্রনাথের কবিতা লেখার সূচনা হল পেনসিলে। পুরানো দিনের সেসব কথার অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে লিখেছিলেন, ‘নিজেই তখন লেখক, মুদ্রাকর, প্রকাশক, এই তিনে-এক একে-তিন হইয়া ছিলাম।’ আর বইপড়ার সূচনালগ্নের অভিজ্ঞতার কথা শেষ জীবনে ছেলেবেলা (১৯৪০)-তে বলেছেন এইভাবে: ‘যা মনে পড়ে সে ষণ্ডামার্ক মুনির পাঠশালার বিষম ব্যাপার নিয়ে, আর হিরণ্যকশিপুর পেট চিরছে নৃসিংহ অবতার— বোধ করি সীসের-ফলকে-খোদাই-করা তার একখানা ছবিও দেখেছি সেই বইয়ে।’ বিগতদিনের ছবি ছাপার অনুন্নত পদ্ধতি সম্পর্কে এখানে যেমন রবীন্দ্রনাথ মার্জিত পরিহাস করেছেন, তেমনি আবার ছেলেবেলা –র ওই একই পৃষ্ঠায় ছাপা হরফের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুরে বলেছেন, ‘রূপকথা আজকাল ছেলেরা মেয়েদের মুখ থেকে শুনতে পায় না, নিজে নিজে পড়ে ছাপানো বই থেকে।’ মুদ্রণের প্রযুক্তির ব্যাপারে এটাই তাঁর একমাত্র মত নয়। মুদ্রণের প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির সম্পর্কে কোনও অনুযোগ ছাড়াই বাংলাভাষা-পরিচয় (১৯৩৮) বইয়ের একাদশ পর্বে রবীন্দ্রনাথ লেখেন: ‘একদা ছিল না ছাপাখানা, অক্ষরের ব্যবহার হয় ছিল না, নয় ছিল অল্প। অথচ মানুষ যে-সব কথা সকলকে জানাবার যোগ্য মনে করেছে দলের প্রতি শ্রদ্ধায়, তাকে বেঁধে রাখতে চেয়েছে এবং চালিয়ে দিতে চেয়েছে পরস্পরের কাছে। ... সাহিত্যের প্রথম পর্বে ছন্দ মানুষের শুধু খেয়ালের নয়, প্রয়োজনের একটা বড়ো সৃষ্টি; আধুনিক কালে যেমন সৃষ্টি তার ছাপাখানা।’ তবে মুদ্রণ কিংবা ছাপা বই সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে কবির দ্বন্দ্বময় মনোভাব কোন অভিমুখে ধাবিত সেই আলোচনায় না-গিয়ে, বরং নিজের লেখা বইগুলি ‘আঙ্গিক ও ভাবিক দিক থেকে’ নির্মাণের নানা পর্যায়ে, তাঁর গ্রন্থসংবেদী মন কতটা সক্রিয় থেকেছে সেটুকুই আমাদের আলোচ্য হোক।
১৯০১-এ বঙ্গদর্শন নব পর্যায়ের সম্পাদনার ভার নেন রবীন্দ্রনাথ এবং বৈষয়িক ভার নেন শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ছোট ভাই, মজুমদার লাইব্রেরির শৈলেশচন্দ্র মজুমদার। এই যোগসূত্রেই চল্লিশ-উত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথ ধারাবাহিকভাবে বই প্রকাশের (১৯০৩) প্রথম একজন প্রকাশক হিসাবে পান শৈলেশচন্দ্রকে। প্রসঙ্গটির উল্লেখ করে প্রভাতকুমার রবীন্দ্রজীবনী-র দ্বিতীয় খণ্ডে জানিয়েছেন: ‘এই মজুমদার এজেন্সির (পরে মজুমদার লাইব্রেরি) সহিত প্রায় সাত বৎসর রবীন্দ্রনাথ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ইহার অন্তর্গত “আলোচনা সভা” বিলাতি সাহিত্যিক ক্লাবের অনুকরণে গড়া হয়; রবীন্দ্রনাথের বহু প্রবন্ধ এখানে পঠিত হয় ... ।’ যে কারণে প্রথম দিকের অনেকগুলো বই-ই রবীন্দ্রনাথ নিজ ব্যয়ে ছেপেছেন আদি ব্রাহ্মসমাজের মুদ্রণযন্ত্রে। ফলে ছাপাখানার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। তা ছাড়া তিনি নিজে একজন মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ কিংবা পেশাদার গ্রন্থ-সম্পাদক না-হলেও গ্রন্থনির্মাণের নানান দিক অর্থাৎ হরফ বিন্যাস, বানান শোধন, মুদ্রণ, অলংকরণ ও বাঁধাই সম্পর্কে অত্যন্ত মনোযোগী এবং সহজে সন্তুষ্ট হওয়ার পাত্র ছিলেন না।
এর পর ১৯০৮ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের বাংলা বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয় ইন্ডিয়ান প্রেস বা ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস। ইন্ডিয়ান প্রেস-এ বই প্রকাশের ব্যাপারে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুরাগী চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাপার ভুলের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-কে এক চিঠিতে (২ নভেম্বর ১৯০৯) তির্যক ইঙ্গিতপূর্ণ ঠাট্টা করে লিখেছিলেন: ‘ঝুড়ি ঝুড়ি ভুল যদি ছাপিয়ে যাই তাহলে পাছে প্রেতাত্মা সেই ভুলগুলোতে জড়িয়ে পড়ে দিনরাত্রি ইণ্ডিয়ান পাব্লিশিং হৌসকে ঘিরে ঘিরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফেলে বেড়ায় এই আমার একটা মস্ত ভয় আছে— অতএব ভুল সংশোধন না হলে আমার গয়ায় পিণ্ডদান হবে না!’ এই প্রুফ দেখা নিয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে এক চিঠিতে লেখেন [২৬ মার্চ ১৯২৬]: ‘প্রুফ দেখবার ভালো লোক সম্বন্ধে বিজ্ঞাপন দিয়ে একজন কাউকে ঠিক করা উচিত। আমি পণ্ডিতের প্রুফ দেখবার যে চাল দেখেচি তাকে কোনো মতেই দ্রুত বলা যায় না এবং নির্ভরযোগ্যও না, কেননা তিনি মানে বোঝেন না।’ এই উদ্বেগ থেকে তিনি কোনওদিনই রেহাই পাননি। এমনকী গ্রন্থ প্রকাশনার ব্যাপারে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহচর কিশোরীমোহনকে ক্রুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে (৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২) লিখেছিলেন: ‘শুদ্ধিপত্রকে তোমরা ব্যর্থ করেছ— নিজেদের লজ্জা গোপন করবার জন্যে। এ চলবে না। ও পত্রকে হয় বইয়ের আরম্ভেই, নয় সূচিপত্রের আরম্ভে দেওয়াই চাই, কিছুতেই যেন তার অন্যথা না হয়।’ কোন বই সম্পর্কে তিনি এই কথা বলেছিলেন, তা নিশ্চিত করে জানা না-গেলেও প্রুফের ভুল নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এমন অনুযোগের উদাহরণ আরও পাওয়া যাবে অন্যান্য চিঠিপত্রের মধ্যে।
শুধু ছাপার ভুল নয়, পৃষ্ঠার মার্জিনের মাপ ও পৃষ্ঠাসংখ্যার সংস্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-যে কতটা খুঁতখুঁতে ছিলেন, তা শান্তা চট্টোপাধ্যায়কে লেখা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের একটি চিঠির (২১ নভেম্বর ১৯২৪) কিয়দংশ পড়লেই বোঝা যাবে: ‘Talks in China’ বইখানা antique কাগজে linotype-এ ছাপানো হয়েছিল কবি রওনা হবার পনেরো দিন আগে। ... বইখানার আর কোনও দোষ নেই— ছাপার ভুলও খুবই সামান্য, শুধু margin কম আছে, আর পৃষ্ঠার অঙ্কটায় bracket দিয়েছে— (27) এইরকম— এইজন্য দেখতে একটু খারাপ হয়েছে। কবি তাতে এত দুঃখিত হলেন যে আমরা সমস্ত edition-টা suppress করতে বাধ্য হয়েছি।’
বইয়ের লেখার সঙ্গে অলংকরণের ভারসাম্য রেখে উপস্থাপন করার ব্যাপারেও তাঁর মতামত ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। কিশোরীমোহন সাঁতরাকে একটি চিঠিতে (৩০ বৈশাখ ১৩৪৪) লিখছেন, ‘“সে” প্রকাশ হতে দেরি হলে ক্ষতি নেই বরঞ্চ ভালোই— কিন্তু ছবিগুলো নিতান্তই চাই। ফটোটাইপকে বোলো ছবি যতদিন না পাই বই বেরবে না।’ অন্য আর এক চিঠিতে কিশোরীমোহনকেই (১০ সেপ্টেম্বর ১৯৪০) রবীন্দ্রনাথ বলছেন: ‘“ছেলেবেলা” ছাপা শেষ হয়ে গেল। এই বইটাতে আমি কোনরকম ছবি দিতে চাই নে। এর ছবি লেখারই মধ্যে। সাহিত্যের মধ্যে অকারণ ছবি এনে চোখ ভোলানো ছেলেমানুষি।’ মুদ্রিত বইয়ের উৎকর্ষের ব্যাপারে বাঙালির রুচিবোধ অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী। তিনি সামগ্রিকভাবে একটি বইয়ের চরিত্রে চারিয়ে দিতে জানতেন এক ধরনের ইন্দ্রিয়-সংবেদী শ্রী।
ছবি ছাপার ব্যাপারেও একইরকম উৎকণ্ঠা ও সতর্কতা ছিল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। চয়নিকা হাতে পেয়ে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুযোগ জানিয়ে লেখেন (২৮ সেপ্টেম্বর ১৯০৯), ‘চয়নিকা পেয়েছি। ছাপা ভাল, কাগজ ভাল, বাঁধাই ভাল। কবিতা ভাল কিনা তা জন্মান্তরে যখন সমালোচক হয়ে প্রকাশ পাব তখন জানাব। কিন্তু ছবি ভাল হয় নি সে কথা স্বীকার করতেই হবে। ... নন্দলালের পটে যেরকম দেখেছিলুম বইয়েতে তার অনুরূপ রস পেলুম না বরঞ্চ একটু খারাপই লাগল।’ খাপছাড়া কেমনভাবে কোন কালিতে ছাপা হবে চিঠিতে (৬ জানুয়ারি ১৯৩৭) তার নির্দেশ দিয়ে কিশোরীমোহনকে জানাচ্ছেন: ‘কালীর নমুনা যা পাঠিয়েছ সে তো ভালই— কিন্তু লাল কালীটা মাঝে মাঝে কোনো কোনো বিশেষ ছবির পক্ষে চলবে— সবগুলো হলে একঘেয়ে হবে ওর চেয়ে সীপিয়া ভালো। আমার বোধ হয় লাইন ব্লক এবং লেটর প্রেস্ এক কালী হলেই ভালো— অন্যগুলো সীপিয়া।’ আনন্দবাজার পত্রিকা-য় ‘পুস্তক আলোচনা’ বিভাগে (১১ এপ্রিল ১৯৩৭) খাপছাড়া সম্পর্কে লেখা হল— ‘বইটির মুদ্রণ পরিপাট্য এবং সাজসজ্জা ইত্যাদি নিখুঁত।’ কিশোরীমোহনকে অপর এক চিঠিতে ‘ছবির অ্যালবম’ চিত্রলিপি ছাপার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলছেন (৯ আষাঢ় ১৩৪৭/ ২৩ জুন ১৯৪০): ‘ছবির অ্যালবম কি দিশি তুলট কাগজে চলে না? একটা পরীক্ষা করেই দেখ না— একটু কর্কশ গোছের হলে তো ভালই, পাৎলা হলেই বা দোষ কি।’ উইলিয়াম মরিস কিংবা জর্জ বার্নাড শ-র মতো মুদ্রণ প্রযুক্তির সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগ না-থাকলেও মুদ্রণের প্রায়োগিক প্রকরণগুলি সম্পর্কে তিনি ছিলেন স্বচ্ছ ধারণার অধিকারী।
বইয়ের আকার, প্রচ্ছদ, বাঁধাই ইত্যাদির ব্যাপারেও তাঁর মনোযোগে কোনও ঘাটতি নেই। ১৩১৫ সালের ৪ আশ্বিন ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস থেকে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় শারদোৎসব। সিল্কের কাপড়ে বাঁধানো বইটির মলাটে ছিল কাশখেতের ওপর দিয়ে বক উড়ে যাওয়ার ছবি। বইটি ‘শোভনরূপে ছেপে প্রকাশ করবার জন্য’ চারুচন্দ্রকে শান্তিনিকেতনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর কবির সেই অনুরোধ রাখতে চারুচন্দ্র যে-উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেকথা তাঁর ‘রবিরশ্মি’ বই থেকে কিছুটা পড়ে নেওয়া যাক : ‘ইহাকে লোচন-রোচন করিবার জন্য ইহার আকার করি একটু নূতন ধরনের,— প্রাচীন পুঁথির আকারে এবং আমি নিজে গিয়া অনুরোধ করিয়া প্রসিদ্ধ চিত্রকর যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়া ইহার প্রচ্ছদের ও মুখপাতের জন্য দুইখানি চিত্র অঙ্কিত করাইয়া লই।’
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের জার্মানি ভ্রমণকালে ফ্যাকসিমিলি ছাপার কৌশল দেখে তাঁর উৎসাহের কথা তাঁর নিজের জবানিতে: ‘জার্মানিতে গিয়ে দেখা গেল, এক উপায় বেরিয়েছে তাতে হাতের অক্ষর থেকেই ছাপানো চলে। বিশেষ কালী দিয়ে লিখতে হয় এল্যুমিনিয়মের পাতের উপরে, তার থেকে বিশেষ যন্ত্রে ছাপিয়ে নিলেই কম্পোজিটরের শরণাপন্ন হবার দরকার নেই।’ (প্রবাসী, কার্তিক ১৩৩৫)। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের তত্ত্বাবধানে কবির হস্তাক্ষরে ছাপা লেখন-এর (১৯২৭) পাতাগুলি বিশেষ জাপানি-বাঁধাই রীতিতে জোড়-বাঁধা পৃষ্ঠা, এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে একটাই পৃষ্ঠাসংখ্যা। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে এই একই লিথোগ্রাফিক মুদ্রণ পদ্ধতিতে পরীক্ষামূলকভাবে বৈকালী ও স্ফুলিঙ্গ ছাপানোর চেষ্টা হয়েছিল, যদিও সে-চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। এর কারণ রবীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে (১১ জানুয়ারি ১৯২৭) প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ জানিয়েছেন: ‘Rota-print-এর কাজ যতোটা পারলুম শেষ করছি। কালিতে লেখা সবগুলোই ভালো হয়েছে। পেন্সিলে লেখা অনেকগুলি নষ্ট হলো। প্রধান কারণ অনেক জায়গায় লেখা ভালো ফোটেনি, যথেষ্ট চাপ দিয়ে না লেখায় দাগ বসেনি, তার উপর অতিরিক্ত ফিক্সিং সলিউশন দেওয়ায় দাগ মুছে গেছে। ... ১টা মেশিন আর পুরো সরঞ্জাম (কাগজ সুদ্ধ) অর্ডার দিয়েছি, আশা করছি ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যেই শান্তিনিকেতনে পৌঁছবে ...।’ বলা বাহুল্য, কবির নির্দেশে ও আগ্রহেই এই যন্ত্র কেনা হয়েছিল।
বই জিনিসটা শিল্পকর্ম না-হলেও বই তৈরিতে শিল্পের একটা পরোক্ষ ভূমিকা আছে। আরকিটেকচার আর স্কাল্পচারের ফারাক বোঝাতে রামকিঙ্কর যেমন স্ব-ভঙ্গিমায় বলেছিলেন— ‘একটি হেতু আর-একটা অহেতুক।’ একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে কথাটা। স্থাপত্যের মতোই বইয়ের প্রয়োগ উপযোগিতামূলক। তাই সুচারুভাবে একটা বই তৈরি করতে গেলে শিল্পের অনুভব আর স্থাপত্যের উপযোগিতার সার্থক মেলবন্ধন ঘটা খুবই জরুরি। আর সেই মেলবন্ধন ঘটানোর প্রক্রিয়ায় নিরন্তর সজাগ রবীন্দ্রনাথ, বইয়ের প্রচ্ছদের ব্যাপারেও তাঁর সযত্ন অভিনিবেশ। সময়ের নিরিখে মহুয়া (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেই প্রচ্ছদশিল্পী রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মলাটের অর্ধেকটা জুড়ে পোড়া লালের আস্তরণ, তার উপর কালো কালিতে লেখা তাঁর নিজের সই আর বাকি অংশে মহুয়া-র অলংকৃত অক্ষরগুলি তির্যক জ্যামিতিক ভঙ্গিতে উপর থেকে নীচে বা নীচ থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে। আবার কিশোরীমোহন সাঁতরাকে একটি চিঠিতে (১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩৫) রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘মলাটে সাদা অক্ষরে “বীথিকা” যেন লেখা থাকে, আমি অলঙ্কৃত করে দেবো না। এই রকম সাজসজ্জা বাঙালে রুচি, নিজের বই সম্বন্ধে নতুন লেখকের গদ্গদ স্নেহের সোহাগ এতে প্রকাশ পায়।’ সে-রকমই ইঙ্গিত দিয়ে স্বাক্ষরহীন, তারিখবিহীন [জুন-জুলাই ১৯৩১] একটি চিঠিতে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে অনুযোগ করে লিখেছেন: ‘বিচিত্রিতার কোনো খবর নেই। করুণার [করুণাবিন্দু বিশ্বাস, যিনি ছিলেন বিচিত্রিতার মুদ্রক] হাতে তিন চারটে ছবি আটকে রইল। আমার রুচি অনুসারে মলাট সম্পূর্ণ নিরলঙ্কৃত হওয়া উচিত— মাড়োয়ারি রুচি অনুসরণ করতে গিয়ে এত বিপদ ঘটল।’ আসলে বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্যহীন শিল্পিত প্রচ্ছদও শেষ পর্যন্ত বইয়ের গাম্ভীর্য নষ্ট করে। The Religion of Man (১৯৩০)–এর শুরুতে অখণ্ডতার বোধের ধারণা দিতে তিনি বইয়ের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন: ‘The leather binding and title-page are parts of the book itself’. অর্থাৎ বইয়ের প্রত্যেকটি অংশের সুচারু উপস্থাপনার উপরই নির্ভর করে কোনও বইয়ের সামগ্রিক সৌকর্য।
এভাবে আরও অনেক উদাহরণের কথাই ভাবা যেতে পারে। ছোটদের পাঠ্যবই নিয়ে তাঁর মৌলিক ভাবনা, ছবিকে ঘিরে টেক্সট নির্মাণ— যেমন সে, খাপছাড়া বইয়ের ক্ষেত্রে তিনি করেছিলেন কিংবা কবিতা ছাপার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠায় হরফ, স্পেস বা অবকাশের ‘ইনটেলিজেন্ট ম্যানিপুলেশন’ ও মার্জিনের অভিনব বিন্যাস করেছেন— এর সবকিছুর মধ্যেই মুদ্রণ প্রযুক্তি ও ছাপা বইয়ের বহিরঙ্গের সৃজনশীল সম্ভাবনাগুলি উন্মোচনের ব্যাপারে তাঁর ধারাবাহিক মননের স্বতন্ত্র ছাপ উজ্জ্বল। ‘চিত্রকলা সাথে করো/ সাহিত্যের মিলনসাধনা সুন্দর/ লেখনীর লীলারঙ্গে মিশুক/ লভুক অভ্যর্থনা।’ আশি বছর আগে, ১১ অক্টোবর ১৯৩৮, রবীন্দ্রনাথ স্বহস্তে লিখে দিয়েছিলেন সমর সরকারের হাতে লেখা পত্রিকা
ডালি-র পাতায়।
এর সঙ্গে অবশ্যই যোগ করতে হবে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর কর্মকাণ্ডে মুদ্রণকে সংযুক্ত করার জন্য তাঁর প্রচেষ্টার কথা। আমেরিকা সফরকালে রবীন্দ্রনাথকে নেব্রাসকার লিংকন শহরের অধিবাসীরা ১৯১৭-র ৮ জানুয়ারি শান্তিনিকেতন আশ্রমের বালকদের জন্য একটি ট্রেডল মুদ্রণ যন্ত্র উপহার দেয়। এই ট্রেডল যন্ত্র দেখতে পায়ে চালানো সেলাই মেশিনের মতো, বিদ্যুৎ ছাড়াই চালানো যায়। এর দু’-দিন পর ১০ জানুয়ারি ওমাহা শহরের বার্নহার্ট ব্রাদার্স অ্যান্ড স্পিন্ডলার কোম্পানিকে তিনি ৫৪০ ডলার দামের হরফ ও আনুষঙ্গিক জিনিস পাঠানোর জন্য বরাত দেন। কিন্তু যুদ্ধের জন্য সেই সরঞ্জাম পাঠাতে অনেকটা সময় লেগে যায়। এর পর অবশ্য যন্ত্রটি কাজে লাগানো নিয়ে নানান সমস্যার মধ্যে পড়েন রবীন্দ্রনাথ। যদুনাথ সরকারকে তিনি এক চিঠিতে (৬ ডিসেম্বর ১৯১৭) লেখেন: ‘চালাই কি করিয়া? ... চিন্তামণিবাবুকে বলিয়াছিলাম এই প্রেসকে তিনি যদি তাঁর ব্যবসায়ের অন্তর্গত করিয়া লন তবে আমরা নিশ্চিন্ত হই। তিনি পারিয়া উঠিবেন না লিখিয়াছেন। ... আপনি কাহাকেও জানেন?’ যা হোক নানান টানাপোড়েনের মধ্যে শেষপর্যন্ত শান্তিনিকেতন প্রেসটি চালু হয়। ১৯১৮-র ৬ জুন চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিতে লেখেন: ‘ছাপাখানাটাকে খাড়া করা গেছে। একজন লোকের দরকার যিনি বলে দিতে পারেন কি কি জিনিসের প্রয়োজন এবং তার খরচ কত।’ কালিদাস নাগের ডায়েরি থেকে জানা যাচ্ছে, ছাপার ব্যাপারে সাহায্যের জন্য চারুচন্দ্র ও সুকুমার রায় আসেন শান্তিনিকেতনে। আর অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতন প্রেসে ছাপা প্রথম বই দিনেন্দ্রনাথের স্বরলিপি সহ গীত-সংকলন গীত-পঞ্চাশিকা প্রকাশ পায়। বর্ণগ্রন্থন ও মুদ্রণে নিমাই, বিষ্ণু ও আরও কয়েকজন তো ছিলই, তার সঙ্গে সাঁওতাল বিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে কলকাতায় পাঠানো হয় বাঁধাইয়ের কাজ শিখতে। ডিসেম্বর মাসে শান্তিনিকেতন প্রেসে মুদ্রিত তাঁর The Fugitive বইটির একটি কপি পিয়ার্সন-কে পাঠান ও সঙ্গের চিঠিতে (১২ ডিসেম্বর) মজা করে লেখেন: ‘The book has been printed in that press which we got from Lincoln. It is too small for regular printing business, so, like that gift of a diamond stud to a man whose shirt was of a poor quality, it has necessitated further expenditure, far exceeding its own value, to give it complete fitness.’ পরে একথাও জুড়ে দেন: ‘There are errors enough in this book to prove that it is a genuine product of our press with নিমাই, বিষ্ণু and a few others for its compositors.’ প্রেসটাকে দাঁড় করানোর উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যালয়ের খরচ কমানো এবং আয়পত্র বাড়ানো, এর পাশাপাশি ছাত্রদের মধ্যে মুদ্রণ ও দপ্তরি কর্মের মতো ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও চালু রাখা ইত্যাদি; কিন্তু তার আশু ফল না-ফললেও রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ মোটেই কমেনি। শান্তিনিকেতন পত্রিকার অগ্রহায়ণ সংখ্যায় (১৩২৬) খবর বেরলো, ‘আশ্রমের ছাপাখানা বাড়িয়া চলিল। সম্প্রতি আর একটি বড়ো machine আসিয়াছে, ...।
এর পর ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউসের স্বত্বাধিকারী চিন্তামণি ঘোষকে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটা চিঠি (১ আশ্বিন ১৩২৯/ ’ ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯২২) লেখেন। চিন্তামণি ঘোষ রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব মেনে নেন এবং বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্র-গ্রন্থ প্রকাশের এই নতুন অধ্যায় শুরু হয় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেপালচন্দ্র রায়, কিশোরীমোহন সাঁতরা, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখের উদ্যোগে। ১৯২৩-এ নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী-গ্রন্থালয় থেকে প্রথম বই হিসাবে প্রকাশিত হল পূরবী। ১৯২৫-এ শান্তিনিকেতন প্রেসে ছাপা হয়ে বেরচ্ছে বসন্ত। তখনও ছিল পৃষ্ঠা-বিন্যাস, মুদ্রণ, বাঁধাই ইত্যাদিতে বেশ খানিকটা অপ্রস্তুতির ছাপ। সুরেন্দ্রনাথ কর লন্ডনের কাউন্টি কাউন্সিল স্কুল থেকে লিথোগ্রাফি ও বই বাঁধাইয়ের কাজ শিখে আসেন। সেখান থেকেই তিনি সংগ্রহ করে আনেন বাঁধাইয়ের বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। কলাভবনের ছাত্র বীরভদ্র রাও ও বিশ্বভারতীর কর্মী শোকলা সাঁওতাল তাঁর কাছে দপ্তরির কাজ শিখতে আরম্ভ করে। সুরেন্দ্রনাথই বিশ্বভারতী প্রকাশনায় প্রথম সফ্ট বাইন্ডিং পদ্ধতির প্রয়োগ করেন।
দুই
বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত বইয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হরফ ও বানান সংস্কারের চেষ্টা, সর্বোপরি বাংলায় প্রথম হাউস স্টাইলের প্রচলন করার চেষ্টা গ্রন্থসংবেদী রবীন্দ্রনাথের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া সম্ভব হত না। যে-কোনও রচনার ‘সামাজিকীকরণ’-এর প্রথম ও অন্যতম প্রধান ধাপ এই ডেস্ক-এডিটিং বা হাউস এডিটিং। এই ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ‘মন্তব্য’ শীর্ষক (১২ মাঘ ১৩৪৪) একটি লেখা থেকে একটু দীর্ঘ অংশ পড়ে নেওয়া প্রয়োজন। তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী ভাবতেন বই সম্পাদনা সম্বন্ধে আর কেনই-বা তিনি এ-ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন: ‘বিশ্বভারতী সম্পর্কে যে গ্রন্থ সম্পাদন বিভাগ স্থাপিত হয়েছে বলা বাহুল্য তার মুখ্য উদ্দেশ্যই আমার রচিত গ্রন্থ সম্পাদন। আসন্ন যে-সব গ্রন্থ ছাপার উপযোগী তাদের প্রস্তুত করতে হবে, ভবিষ্যতে যারা ছাপাখানায় চড়বে তাদেরও তৈরি করে রাখা চাই। বিলাতে ডেন্ট কম্পানি বড়ো পাব্লিশর, তাঁদের প্রকাশোন্মুখ বইগুলিকে সর্বতোভাবে মুদ্রণযোগ্য করার কাজে যিনি নিযুক্ত আছেন তাঁকে আমি বন্ধুভাবে জানি। তাঁর নাম Ernest Rhys, তিনি একজন বিখ্যাত সাহিত্যরচয়িতা, সেইজন্যেই তাঁর ’পরে এই গুরুতর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই কাজের একটা দিক আছে যেটা খুঁটিনাটির কাজ, যেমন চিহ্ন সংকেত বসানো, বানান শোধন ও প্যারাগ্রাফ বিভাগ করা; এমন-কি রচনার কোনো স্খলন থাকলে তার প্রতি লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আর একটা দিক আছে যেটাতে সাহিত্যিক বিচার-বুদ্ধির দরকার অর্থাৎ অসংগতি দোষ, অসংলগ্নতা, ভাষাগত ত্রুটি সম্বন্ধে প্রশ্নদ্বারা মীমাংসা করা। শেষোক্ত কর্তব্যের প্রয়োজন অতি দৈবাৎ ঘটে। কারণ যে লেখকদের বই বেছে নেওয়া হয় তাঁদের ভুলচুক অনবধানতাবশতই ঘটে, সহজে ঘটে না। আমার ইংরেজি Sadhana ছাপবার সময় তাঁর কাজ দেখেছি, এতে যে সতর্কতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন তা যে-সে লোকের দ্বারা সম্ভব নয়, এইজন্যে এ কাজের গৌরব আছে। তাঁকে প্রভূত পরিশ্রম করতে হয় জানি, কিন্তু এই পরিশ্রমের দ্বারা যে ফল পাওয়া যায় তা লেখক ও প্রকাশকের পক্ষে বহু মূল্যবান। আমার গ্রন্থ সম্পাদন কাজে আঙ্গিক ও ভাবিক দিক থেকে এই রকম শ্রদ্ধাপূর্ণ সহায়তা পাব এই আমার আশা ছিল এবং আছে।’
এই অনুষঙ্গে পড়ে নেওয়া যেতে পারে নিজের বইয়ের সম্পাদনা নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা একটি তারিখহীন সম্বোধনহীন পত্রে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছিলেন: ‘আমার বই বের করবার সময় কেবল প্রুফ দেখাই কি যথেষ্ট? এডিট করার কি কোনো প্রয়োজন নেই? চোখের বালি, নৌকাডুবি, ঘরে-বাইরে কেউ কি মাসিকপত্রে প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবার চেষ্টামাত্র করেছিল? সঙ্কলন প্রভৃতি বইয়ে যে সব প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে একবার ওরিজিন্যালের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার দরকার ছিল না? এই রকম অন্ধভাবে আমার বইগুলো এক এডিশন থেকে অন্য এডিশনে চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে চলল। এর কি প্রতিকার করা উচিত নয়?’ একইরকম আক্ষেপের সুর চয়নিকা সম্পর্কেও। কিশোরীমোহনকে তিনি এক চিঠিতে (২৯ মে ১৯৩৭) লিখেছিলেন, ‘চয়নিকার প্রথম দুটি কবিতা চলতেই পারে না। ছেলেমানুষিকে আমার নামে প্রচার কোরো না। চয়নিকায় বিস্তর বাজে মাল আছে— লজ্জা বোধ করি।’ তারিখহীন আর এক চিঠিতে [১৯২৯] রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন: ‘“কাব্যগ্রন্থন” নাম দিয়ে আমার নিজের স্বীকৃত কবিতা ছাপতে চাই। তার থেকে আমার অযোগ্য লেখা বাদ দেব। ভাবী পাঠকদের কাছে এইটেই হবে আমার দান। এটা অবশ্য আয়তনে বড়ো হবে। অবশ্য নাটকগুলো এর মধ্যে ধরবে না, এবং পূরবী ও মহুয়া-ও বাদ পড়বে। জাপানী কাগজে যদি কুলোয় তাহলে মন্দ হয় না।’ পরিকল্পিত এই বইটির প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে করে গেলেও বইটি শেষ পর্যন্ত করে যেতে পারেননি। নিজের বইয়ের ব্যাপারে এমন আক্ষেপের উদাহরণ আরও আছে। ফলে রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যগুলি পড়লে বোঝা যায়, রবীন্দ্র-রচনার পাঠ নির্ভুল ও প্রামাণ্য করে তুলতে তাঁর সহযোগীদের নিরলস চেষ্টা ও অধ্যবসায় বাংলা বইয়ের সম্পাদনার মান নির্ধারণে যে প্রভাবই ফেলে থাকুক না-কেন, রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রেত সম্পাদনারীতির সঙ্গে সত্যই তা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। অনেক উদাহরণের মধ্যে এখানে একটি বইয়ের উল্লেখ করে এই আলোচনার ইতি টানব। ছিন্নপত্র (১৯১২)— শ্রীশচন্দ্রকে লেখা আটটি চিঠি ও ইন্দিরা দেবীকে আট বছর ধরে (১৮৮৭-৯৫) লেখা চিঠিগুলি থেকে নির্বাচিত ১৪৩টি চিঠি রবীন্দ্রনাথ নিজে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন। কবির জন্মশতবর্ষে বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় থেকে পুলিনবিহারী সেনের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় ছিন্নপত্র-র ‘পূর্ণতর’ সংস্করণ ছিন্নপত্রাবলী (১৯৬১)। ছিন্নপত্র-র মূল বিন্যাসকে অবিকৃত না-রেখেই, রবীন্দ্রনাথের বাদ দেওয়া ওই ১০৭-টি অতিরিক্ত চিঠি-সহ পূর্বে ছাপা চিঠির বর্জিত অংশ সমস্ত যোগ করা হয় ছিন্নপত্রাবলী বইতে। এমনকী জন্মশতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী-র একাদশ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয় ছিন্নপত্রাবলী— ছিন্নপত্র নয়। এখন আপনারাই বলুন, লেখকের জীবিতকালে প্রকাশিত, অনুমোদিত কোনও বইয়ের মূল বিন্যাস ‘আঙ্গিক ও ভাবিক দিক থেকে’ বদলে দিয়ে ‘ক্রিটিকাল এডিশন’ তৈরি করা কি গ্রন্থ সম্পাদনার রীতিসিদ্ধ? এই প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহ্য উত্তরের খোঁজে ১৯২১ সালের ৩০ অক্টোবর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে লেখা চিঠি থেকে পড়ে নেওয়া যেতে পারে কিছু অংশ: ‘পুরোনো লেখা ছাপানো সম্বন্ধে আমার ভাবনা আছে। যে-সব জিনিষ যাবার, কালের অমোঘ নিয়মে তারা যায়। মানুষ তাদের টানাটানি করে বাঁচিয়ে রাখে— বাঁচিয়ে রাখা বলাটাও ভুল— হয়ত টিকিয়ে রাখে— ইজিপ্টে মমি যেমন ছিল। তাতে ঐতিহাসিকের সুবিধে হতে পারে কিন্তু যাকে রাখা হয় সজীব সচল সহাস্য কালের কাছে তাকে বড়োই অপদস্থ করা হয়।’
সহায়ক সূত্র
• আকাদেমি পত্রিকা, পঞ্চম সংখ্যা, বৈশাখ ১৪০০/ মে ১৯৯৩।
• প্রশান্তকুমার পাল (সম্পাদিত), কল্যাণীয়েষু প্রশান্ত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৪১১।
• অনির্বাণ রায় (সংকলিত ও সম্পাদিত), রবীন্দ্র-রচনায় গ্রন্থ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়, ছাতিম বুক্স্, ২০১৩।
• দীপঙ্কর সেন, ‘মুদ্রণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’, পুরশ্রী, বৈশাখ ১৩৮৫/ মে ১৯৭৮।
• স্বপন চক্রবর্তী, ‘গ্রন্থ, পাঠ, শিল্পকর্ম: রবীন্দ্রনাথ ও রচনার দৃশ্যপট’, রবীন্দ্রনাথ: শিল্পরূপ পাঠরূপ গ্রন্থরূপ, সম্পা. স্বপন চক্রবর্তী, অবভাস, ২০১১।
• রামকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘কবির ছাপাখানা’, গ্রন্থনির্মাতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সম্পা. শিলাদিত্য সিংহ রায়, অভিযান পাবলিশার্স, ২০১৮।
• রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘শান্তিনিকেতনের কিঙ্করদা’, বিশ্বভারতী পত্রিকা, রামকিঙ্কর বেইজ সংখ্যা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৬।
• সমীর ঘোষ, অলংকরণ শিল্পের অন্যধারা, ঠিক-ঠিকানা, ২০১৫।
প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়, দেশ পত্রিকায়।
সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়
আর চাই রেশমে বাঁধাই-করা
অ্যান্টিক কাগজে ছাপা কবিতার বই, ...
‘ছুটির আয়োজন’-এর উপকরণগুলির মধ্যে বইয়ের প্রতি রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকেই একটু বেশি সংবেদনশীল। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাত-আট বছর। বয়সে বেশ খানিকটা বড় ভাগিনেয় জ্যোতিঃপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহে, একটি নীল কাগজের খাতায় ‘কতকগুলি অসমান লাইন’ কেটে রবীন্দ্রনাথের কবিতা লেখার সূচনা হল পেনসিলে। পুরানো দিনের সেসব কথার অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে লিখেছিলেন, ‘নিজেই তখন লেখক, মুদ্রাকর, প্রকাশক, এই তিনে-এক একে-তিন হইয়া ছিলাম।’ আর বইপড়ার সূচনালগ্নের অভিজ্ঞতার কথা শেষ জীবনে ছেলেবেলা (১৯৪০)-তে বলেছেন এইভাবে: ‘যা মনে পড়ে সে ষণ্ডামার্ক মুনির পাঠশালার বিষম ব্যাপার নিয়ে, আর হিরণ্যকশিপুর পেট চিরছে নৃসিংহ অবতার— বোধ করি সীসের-ফলকে-খোদাই-করা তার একখানা ছবিও দেখেছি সেই বইয়ে।’ বিগতদিনের ছবি ছাপার অনুন্নত পদ্ধতি সম্পর্কে এখানে যেমন রবীন্দ্রনাথ মার্জিত পরিহাস করেছেন, তেমনি আবার ছেলেবেলা –র ওই একই পৃষ্ঠায় ছাপা হরফের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুরে বলেছেন, ‘রূপকথা আজকাল ছেলেরা মেয়েদের মুখ থেকে শুনতে পায় না, নিজে নিজে পড়ে ছাপানো বই থেকে।’ মুদ্রণের প্রযুক্তির ব্যাপারে এটাই তাঁর একমাত্র মত নয়। মুদ্রণের প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির সম্পর্কে কোনও অনুযোগ ছাড়াই বাংলাভাষা-পরিচয় (১৯৩৮) বইয়ের একাদশ পর্বে রবীন্দ্রনাথ লেখেন: ‘একদা ছিল না ছাপাখানা, অক্ষরের ব্যবহার হয় ছিল না, নয় ছিল অল্প। অথচ মানুষ যে-সব কথা সকলকে জানাবার যোগ্য মনে করেছে দলের প্রতি শ্রদ্ধায়, তাকে বেঁধে রাখতে চেয়েছে এবং চালিয়ে দিতে চেয়েছে পরস্পরের কাছে। ... সাহিত্যের প্রথম পর্বে ছন্দ মানুষের শুধু খেয়ালের নয়, প্রয়োজনের একটা বড়ো সৃষ্টি; আধুনিক কালে যেমন সৃষ্টি তার ছাপাখানা।’ তবে মুদ্রণ কিংবা ছাপা বই সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে কবির দ্বন্দ্বময় মনোভাব কোন অভিমুখে ধাবিত সেই আলোচনায় না-গিয়ে, বরং নিজের লেখা বইগুলি ‘আঙ্গিক ও ভাবিক দিক থেকে’ নির্মাণের নানা পর্যায়ে, তাঁর গ্রন্থসংবেদী মন কতটা সক্রিয় থেকেছে সেটুকুই আমাদের আলোচ্য হোক।
১৯০১-এ বঙ্গদর্শন নব পর্যায়ের সম্পাদনার ভার নেন রবীন্দ্রনাথ এবং বৈষয়িক ভার নেন শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ছোট ভাই, মজুমদার লাইব্রেরির শৈলেশচন্দ্র মজুমদার। এই যোগসূত্রেই চল্লিশ-উত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথ ধারাবাহিকভাবে বই প্রকাশের (১৯০৩) প্রথম একজন প্রকাশক হিসাবে পান শৈলেশচন্দ্রকে। প্রসঙ্গটির উল্লেখ করে প্রভাতকুমার রবীন্দ্রজীবনী-র দ্বিতীয় খণ্ডে জানিয়েছেন: ‘এই মজুমদার এজেন্সির (পরে মজুমদার লাইব্রেরি) সহিত প্রায় সাত বৎসর রবীন্দ্রনাথ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ইহার অন্তর্গত “আলোচনা সভা” বিলাতি সাহিত্যিক ক্লাবের অনুকরণে গড়া হয়; রবীন্দ্রনাথের বহু প্রবন্ধ এখানে পঠিত হয় ... ।’ যে কারণে প্রথম দিকের অনেকগুলো বই-ই রবীন্দ্রনাথ নিজ ব্যয়ে ছেপেছেন আদি ব্রাহ্মসমাজের মুদ্রণযন্ত্রে। ফলে ছাপাখানার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। তা ছাড়া তিনি নিজে একজন মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ কিংবা পেশাদার গ্রন্থ-সম্পাদক না-হলেও গ্রন্থনির্মাণের নানান দিক অর্থাৎ হরফ বিন্যাস, বানান শোধন, মুদ্রণ, অলংকরণ ও বাঁধাই সম্পর্কে অত্যন্ত মনোযোগী এবং সহজে সন্তুষ্ট হওয়ার পাত্র ছিলেন না।
এর পর ১৯০৮ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের বাংলা বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয় ইন্ডিয়ান প্রেস বা ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস। ইন্ডিয়ান প্রেস-এ বই প্রকাশের ব্যাপারে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুরাগী চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাপার ভুলের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-কে এক চিঠিতে (২ নভেম্বর ১৯০৯) তির্যক ইঙ্গিতপূর্ণ ঠাট্টা করে লিখেছিলেন: ‘ঝুড়ি ঝুড়ি ভুল যদি ছাপিয়ে যাই তাহলে পাছে প্রেতাত্মা সেই ভুলগুলোতে জড়িয়ে পড়ে দিনরাত্রি ইণ্ডিয়ান পাব্লিশিং হৌসকে ঘিরে ঘিরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফেলে বেড়ায় এই আমার একটা মস্ত ভয় আছে— অতএব ভুল সংশোধন না হলে আমার গয়ায় পিণ্ডদান হবে না!’ এই প্রুফ দেখা নিয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে এক চিঠিতে লেখেন [২৬ মার্চ ১৯২৬]: ‘প্রুফ দেখবার ভালো লোক সম্বন্ধে বিজ্ঞাপন দিয়ে একজন কাউকে ঠিক করা উচিত। আমি পণ্ডিতের প্রুফ দেখবার যে চাল দেখেচি তাকে কোনো মতেই দ্রুত বলা যায় না এবং নির্ভরযোগ্যও না, কেননা তিনি মানে বোঝেন না।’ এই উদ্বেগ থেকে তিনি কোনওদিনই রেহাই পাননি। এমনকী গ্রন্থ প্রকাশনার ব্যাপারে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহচর কিশোরীমোহনকে ক্রুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে (৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২) লিখেছিলেন: ‘শুদ্ধিপত্রকে তোমরা ব্যর্থ করেছ— নিজেদের লজ্জা গোপন করবার জন্যে। এ চলবে না। ও পত্রকে হয় বইয়ের আরম্ভেই, নয় সূচিপত্রের আরম্ভে দেওয়াই চাই, কিছুতেই যেন তার অন্যথা না হয়।’ কোন বই সম্পর্কে তিনি এই কথা বলেছিলেন, তা নিশ্চিত করে জানা না-গেলেও প্রুফের ভুল নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এমন অনুযোগের উদাহরণ আরও পাওয়া যাবে অন্যান্য চিঠিপত্রের মধ্যে।
শুধু ছাপার ভুল নয়, পৃষ্ঠার মার্জিনের মাপ ও পৃষ্ঠাসংখ্যার সংস্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-যে কতটা খুঁতখুঁতে ছিলেন, তা শান্তা চট্টোপাধ্যায়কে লেখা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের একটি চিঠির (২১ নভেম্বর ১৯২৪) কিয়দংশ পড়লেই বোঝা যাবে: ‘Talks in China’ বইখানা antique কাগজে linotype-এ ছাপানো হয়েছিল কবি রওনা হবার পনেরো দিন আগে। ... বইখানার আর কোনও দোষ নেই— ছাপার ভুলও খুবই সামান্য, শুধু margin কম আছে, আর পৃষ্ঠার অঙ্কটায় bracket দিয়েছে— (27) এইরকম— এইজন্য দেখতে একটু খারাপ হয়েছে। কবি তাতে এত দুঃখিত হলেন যে আমরা সমস্ত edition-টা suppress করতে বাধ্য হয়েছি।’
বইয়ের লেখার সঙ্গে অলংকরণের ভারসাম্য রেখে উপস্থাপন করার ব্যাপারেও তাঁর মতামত ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। কিশোরীমোহন সাঁতরাকে একটি চিঠিতে (৩০ বৈশাখ ১৩৪৪) লিখছেন, ‘“সে” প্রকাশ হতে দেরি হলে ক্ষতি নেই বরঞ্চ ভালোই— কিন্তু ছবিগুলো নিতান্তই চাই। ফটোটাইপকে বোলো ছবি যতদিন না পাই বই বেরবে না।’ অন্য আর এক চিঠিতে কিশোরীমোহনকেই (১০ সেপ্টেম্বর ১৯৪০) রবীন্দ্রনাথ বলছেন: ‘“ছেলেবেলা” ছাপা শেষ হয়ে গেল। এই বইটাতে আমি কোনরকম ছবি দিতে চাই নে। এর ছবি লেখারই মধ্যে। সাহিত্যের মধ্যে অকারণ ছবি এনে চোখ ভোলানো ছেলেমানুষি।’ মুদ্রিত বইয়ের উৎকর্ষের ব্যাপারে বাঙালির রুচিবোধ অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী। তিনি সামগ্রিকভাবে একটি বইয়ের চরিত্রে চারিয়ে দিতে জানতেন এক ধরনের ইন্দ্রিয়-সংবেদী শ্রী।
ছবি ছাপার ব্যাপারেও একইরকম উৎকণ্ঠা ও সতর্কতা ছিল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। চয়নিকা হাতে পেয়ে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুযোগ জানিয়ে লেখেন (২৮ সেপ্টেম্বর ১৯০৯), ‘চয়নিকা পেয়েছি। ছাপা ভাল, কাগজ ভাল, বাঁধাই ভাল। কবিতা ভাল কিনা তা জন্মান্তরে যখন সমালোচক হয়ে প্রকাশ পাব তখন জানাব। কিন্তু ছবি ভাল হয় নি সে কথা স্বীকার করতেই হবে। ... নন্দলালের পটে যেরকম দেখেছিলুম বইয়েতে তার অনুরূপ রস পেলুম না বরঞ্চ একটু খারাপই লাগল।’ খাপছাড়া কেমনভাবে কোন কালিতে ছাপা হবে চিঠিতে (৬ জানুয়ারি ১৯৩৭) তার নির্দেশ দিয়ে কিশোরীমোহনকে জানাচ্ছেন: ‘কালীর নমুনা যা পাঠিয়েছ সে তো ভালই— কিন্তু লাল কালীটা মাঝে মাঝে কোনো কোনো বিশেষ ছবির পক্ষে চলবে— সবগুলো হলে একঘেয়ে হবে ওর চেয়ে সীপিয়া ভালো। আমার বোধ হয় লাইন ব্লক এবং লেটর প্রেস্ এক কালী হলেই ভালো— অন্যগুলো সীপিয়া।’ আনন্দবাজার পত্রিকা-য় ‘পুস্তক আলোচনা’ বিভাগে (১১ এপ্রিল ১৯৩৭) খাপছাড়া সম্পর্কে লেখা হল— ‘বইটির মুদ্রণ পরিপাট্য এবং সাজসজ্জা ইত্যাদি নিখুঁত।’ কিশোরীমোহনকে অপর এক চিঠিতে ‘ছবির অ্যালবম’ চিত্রলিপি ছাপার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলছেন (৯ আষাঢ় ১৩৪৭/ ২৩ জুন ১৯৪০): ‘ছবির অ্যালবম কি দিশি তুলট কাগজে চলে না? একটা পরীক্ষা করেই দেখ না— একটু কর্কশ গোছের হলে তো ভালই, পাৎলা হলেই বা দোষ কি।’ উইলিয়াম মরিস কিংবা জর্জ বার্নাড শ-র মতো মুদ্রণ প্রযুক্তির সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগ না-থাকলেও মুদ্রণের প্রায়োগিক প্রকরণগুলি সম্পর্কে তিনি ছিলেন স্বচ্ছ ধারণার অধিকারী।
বইয়ের আকার, প্রচ্ছদ, বাঁধাই ইত্যাদির ব্যাপারেও তাঁর মনোযোগে কোনও ঘাটতি নেই। ১৩১৫ সালের ৪ আশ্বিন ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস থেকে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় শারদোৎসব। সিল্কের কাপড়ে বাঁধানো বইটির মলাটে ছিল কাশখেতের ওপর দিয়ে বক উড়ে যাওয়ার ছবি। বইটি ‘শোভনরূপে ছেপে প্রকাশ করবার জন্য’ চারুচন্দ্রকে শান্তিনিকেতনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর কবির সেই অনুরোধ রাখতে চারুচন্দ্র যে-উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেকথা তাঁর ‘রবিরশ্মি’ বই থেকে কিছুটা পড়ে নেওয়া যাক : ‘ইহাকে লোচন-রোচন করিবার জন্য ইহার আকার করি একটু নূতন ধরনের,— প্রাচীন পুঁথির আকারে এবং আমি নিজে গিয়া অনুরোধ করিয়া প্রসিদ্ধ চিত্রকর যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়া ইহার প্রচ্ছদের ও মুখপাতের জন্য দুইখানি চিত্র অঙ্কিত করাইয়া লই।’
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের জার্মানি ভ্রমণকালে ফ্যাকসিমিলি ছাপার কৌশল দেখে তাঁর উৎসাহের কথা তাঁর নিজের জবানিতে: ‘জার্মানিতে গিয়ে দেখা গেল, এক উপায় বেরিয়েছে তাতে হাতের অক্ষর থেকেই ছাপানো চলে। বিশেষ কালী দিয়ে লিখতে হয় এল্যুমিনিয়মের পাতের উপরে, তার থেকে বিশেষ যন্ত্রে ছাপিয়ে নিলেই কম্পোজিটরের শরণাপন্ন হবার দরকার নেই।’ (প্রবাসী, কার্তিক ১৩৩৫)। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের তত্ত্বাবধানে কবির হস্তাক্ষরে ছাপা লেখন-এর (১৯২৭) পাতাগুলি বিশেষ জাপানি-বাঁধাই রীতিতে জোড়-বাঁধা পৃষ্ঠা, এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে একটাই পৃষ্ঠাসংখ্যা। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে এই একই লিথোগ্রাফিক মুদ্রণ পদ্ধতিতে পরীক্ষামূলকভাবে বৈকালী ও স্ফুলিঙ্গ ছাপানোর চেষ্টা হয়েছিল, যদিও সে-চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। এর কারণ রবীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে (১১ জানুয়ারি ১৯২৭) প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ জানিয়েছেন: ‘Rota-print-এর কাজ যতোটা পারলুম শেষ করছি। কালিতে লেখা সবগুলোই ভালো হয়েছে। পেন্সিলে লেখা অনেকগুলি নষ্ট হলো। প্রধান কারণ অনেক জায়গায় লেখা ভালো ফোটেনি, যথেষ্ট চাপ দিয়ে না লেখায় দাগ বসেনি, তার উপর অতিরিক্ত ফিক্সিং সলিউশন দেওয়ায় দাগ মুছে গেছে। ... ১টা মেশিন আর পুরো সরঞ্জাম (কাগজ সুদ্ধ) অর্ডার দিয়েছি, আশা করছি ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যেই শান্তিনিকেতনে পৌঁছবে ...।’ বলা বাহুল্য, কবির নির্দেশে ও আগ্রহেই এই যন্ত্র কেনা হয়েছিল।
বই জিনিসটা শিল্পকর্ম না-হলেও বই তৈরিতে শিল্পের একটা পরোক্ষ ভূমিকা আছে। আরকিটেকচার আর স্কাল্পচারের ফারাক বোঝাতে রামকিঙ্কর যেমন স্ব-ভঙ্গিমায় বলেছিলেন— ‘একটি হেতু আর-একটা অহেতুক।’ একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে কথাটা। স্থাপত্যের মতোই বইয়ের প্রয়োগ উপযোগিতামূলক। তাই সুচারুভাবে একটা বই তৈরি করতে গেলে শিল্পের অনুভব আর স্থাপত্যের উপযোগিতার সার্থক মেলবন্ধন ঘটা খুবই জরুরি। আর সেই মেলবন্ধন ঘটানোর প্রক্রিয়ায় নিরন্তর সজাগ রবীন্দ্রনাথ, বইয়ের প্রচ্ছদের ব্যাপারেও তাঁর সযত্ন অভিনিবেশ। সময়ের নিরিখে মহুয়া (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেই প্রচ্ছদশিল্পী রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মলাটের অর্ধেকটা জুড়ে পোড়া লালের আস্তরণ, তার উপর কালো কালিতে লেখা তাঁর নিজের সই আর বাকি অংশে মহুয়া-র অলংকৃত অক্ষরগুলি তির্যক জ্যামিতিক ভঙ্গিতে উপর থেকে নীচে বা নীচ থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে। আবার কিশোরীমোহন সাঁতরাকে একটি চিঠিতে (১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩৫) রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘মলাটে সাদা অক্ষরে “বীথিকা” যেন লেখা থাকে, আমি অলঙ্কৃত করে দেবো না। এই রকম সাজসজ্জা বাঙালে রুচি, নিজের বই সম্বন্ধে নতুন লেখকের গদ্গদ স্নেহের সোহাগ এতে প্রকাশ পায়।’ সে-রকমই ইঙ্গিত দিয়ে স্বাক্ষরহীন, তারিখবিহীন [জুন-জুলাই ১৯৩১] একটি চিঠিতে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে অনুযোগ করে লিখেছেন: ‘বিচিত্রিতার কোনো খবর নেই। করুণার [করুণাবিন্দু বিশ্বাস, যিনি ছিলেন বিচিত্রিতার মুদ্রক] হাতে তিন চারটে ছবি আটকে রইল। আমার রুচি অনুসারে মলাট সম্পূর্ণ নিরলঙ্কৃত হওয়া উচিত— মাড়োয়ারি রুচি অনুসরণ করতে গিয়ে এত বিপদ ঘটল।’ আসলে বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্যহীন শিল্পিত প্রচ্ছদও শেষ পর্যন্ত বইয়ের গাম্ভীর্য নষ্ট করে। The Religion of Man (১৯৩০)–এর শুরুতে অখণ্ডতার বোধের ধারণা দিতে তিনি বইয়ের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন: ‘The leather binding and title-page are parts of the book itself’. অর্থাৎ বইয়ের প্রত্যেকটি অংশের সুচারু উপস্থাপনার উপরই নির্ভর করে কোনও বইয়ের সামগ্রিক সৌকর্য।
এভাবে আরও অনেক উদাহরণের কথাই ভাবা যেতে পারে। ছোটদের পাঠ্যবই নিয়ে তাঁর মৌলিক ভাবনা, ছবিকে ঘিরে টেক্সট নির্মাণ— যেমন সে, খাপছাড়া বইয়ের ক্ষেত্রে তিনি করেছিলেন কিংবা কবিতা ছাপার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠায় হরফ, স্পেস বা অবকাশের ‘ইনটেলিজেন্ট ম্যানিপুলেশন’ ও মার্জিনের অভিনব বিন্যাস করেছেন— এর সবকিছুর মধ্যেই মুদ্রণ প্রযুক্তি ও ছাপা বইয়ের বহিরঙ্গের সৃজনশীল সম্ভাবনাগুলি উন্মোচনের ব্যাপারে তাঁর ধারাবাহিক মননের স্বতন্ত্র ছাপ উজ্জ্বল। ‘চিত্রকলা সাথে করো/ সাহিত্যের মিলনসাধনা সুন্দর/ লেখনীর লীলারঙ্গে মিশুক/ লভুক অভ্যর্থনা।’ আশি বছর আগে, ১১ অক্টোবর ১৯৩৮, রবীন্দ্রনাথ স্বহস্তে লিখে দিয়েছিলেন সমর সরকারের হাতে লেখা পত্রিকা
ডালি-র পাতায়।
এর সঙ্গে অবশ্যই যোগ করতে হবে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর কর্মকাণ্ডে মুদ্রণকে সংযুক্ত করার জন্য তাঁর প্রচেষ্টার কথা। আমেরিকা সফরকালে রবীন্দ্রনাথকে নেব্রাসকার লিংকন শহরের অধিবাসীরা ১৯১৭-র ৮ জানুয়ারি শান্তিনিকেতন আশ্রমের বালকদের জন্য একটি ট্রেডল মুদ্রণ যন্ত্র উপহার দেয়। এই ট্রেডল যন্ত্র দেখতে পায়ে চালানো সেলাই মেশিনের মতো, বিদ্যুৎ ছাড়াই চালানো যায়। এর দু’-দিন পর ১০ জানুয়ারি ওমাহা শহরের বার্নহার্ট ব্রাদার্স অ্যান্ড স্পিন্ডলার কোম্পানিকে তিনি ৫৪০ ডলার দামের হরফ ও আনুষঙ্গিক জিনিস পাঠানোর জন্য বরাত দেন। কিন্তু যুদ্ধের জন্য সেই সরঞ্জাম পাঠাতে অনেকটা সময় লেগে যায়। এর পর অবশ্য যন্ত্রটি কাজে লাগানো নিয়ে নানান সমস্যার মধ্যে পড়েন রবীন্দ্রনাথ। যদুনাথ সরকারকে তিনি এক চিঠিতে (৬ ডিসেম্বর ১৯১৭) লেখেন: ‘চালাই কি করিয়া? ... চিন্তামণিবাবুকে বলিয়াছিলাম এই প্রেসকে তিনি যদি তাঁর ব্যবসায়ের অন্তর্গত করিয়া লন তবে আমরা নিশ্চিন্ত হই। তিনি পারিয়া উঠিবেন না লিখিয়াছেন। ... আপনি কাহাকেও জানেন?’ যা হোক নানান টানাপোড়েনের মধ্যে শেষপর্যন্ত শান্তিনিকেতন প্রেসটি চালু হয়। ১৯১৮-র ৬ জুন চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিতে লেখেন: ‘ছাপাখানাটাকে খাড়া করা গেছে। একজন লোকের দরকার যিনি বলে দিতে পারেন কি কি জিনিসের প্রয়োজন এবং তার খরচ কত।’ কালিদাস নাগের ডায়েরি থেকে জানা যাচ্ছে, ছাপার ব্যাপারে সাহায্যের জন্য চারুচন্দ্র ও সুকুমার রায় আসেন শান্তিনিকেতনে। আর অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতন প্রেসে ছাপা প্রথম বই দিনেন্দ্রনাথের স্বরলিপি সহ গীত-সংকলন গীত-পঞ্চাশিকা প্রকাশ পায়। বর্ণগ্রন্থন ও মুদ্রণে নিমাই, বিষ্ণু ও আরও কয়েকজন তো ছিলই, তার সঙ্গে সাঁওতাল বিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে কলকাতায় পাঠানো হয় বাঁধাইয়ের কাজ শিখতে। ডিসেম্বর মাসে শান্তিনিকেতন প্রেসে মুদ্রিত তাঁর The Fugitive বইটির একটি কপি পিয়ার্সন-কে পাঠান ও সঙ্গের চিঠিতে (১২ ডিসেম্বর) মজা করে লেখেন: ‘The book has been printed in that press which we got from Lincoln. It is too small for regular printing business, so, like that gift of a diamond stud to a man whose shirt was of a poor quality, it has necessitated further expenditure, far exceeding its own value, to give it complete fitness.’ পরে একথাও জুড়ে দেন: ‘There are errors enough in this book to prove that it is a genuine product of our press with নিমাই, বিষ্ণু and a few others for its compositors.’ প্রেসটাকে দাঁড় করানোর উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যালয়ের খরচ কমানো এবং আয়পত্র বাড়ানো, এর পাশাপাশি ছাত্রদের মধ্যে মুদ্রণ ও দপ্তরি কর্মের মতো ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও চালু রাখা ইত্যাদি; কিন্তু তার আশু ফল না-ফললেও রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ মোটেই কমেনি। শান্তিনিকেতন পত্রিকার অগ্রহায়ণ সংখ্যায় (১৩২৬) খবর বেরলো, ‘আশ্রমের ছাপাখানা বাড়িয়া চলিল। সম্প্রতি আর একটি বড়ো machine আসিয়াছে, ...।
এর পর ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউসের স্বত্বাধিকারী চিন্তামণি ঘোষকে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটা চিঠি (১ আশ্বিন ১৩২৯/ ’ ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯২২) লেখেন। চিন্তামণি ঘোষ রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব মেনে নেন এবং বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্র-গ্রন্থ প্রকাশের এই নতুন অধ্যায় শুরু হয় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেপালচন্দ্র রায়, কিশোরীমোহন সাঁতরা, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখের উদ্যোগে। ১৯২৩-এ নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী-গ্রন্থালয় থেকে প্রথম বই হিসাবে প্রকাশিত হল পূরবী। ১৯২৫-এ শান্তিনিকেতন প্রেসে ছাপা হয়ে বেরচ্ছে বসন্ত। তখনও ছিল পৃষ্ঠা-বিন্যাস, মুদ্রণ, বাঁধাই ইত্যাদিতে বেশ খানিকটা অপ্রস্তুতির ছাপ। সুরেন্দ্রনাথ কর লন্ডনের কাউন্টি কাউন্সিল স্কুল থেকে লিথোগ্রাফি ও বই বাঁধাইয়ের কাজ শিখে আসেন। সেখান থেকেই তিনি সংগ্রহ করে আনেন বাঁধাইয়ের বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। কলাভবনের ছাত্র বীরভদ্র রাও ও বিশ্বভারতীর কর্মী শোকলা সাঁওতাল তাঁর কাছে দপ্তরির কাজ শিখতে আরম্ভ করে। সুরেন্দ্রনাথই বিশ্বভারতী প্রকাশনায় প্রথম সফ্ট বাইন্ডিং পদ্ধতির প্রয়োগ করেন।
দুই
বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত বইয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হরফ ও বানান সংস্কারের চেষ্টা, সর্বোপরি বাংলায় প্রথম হাউস স্টাইলের প্রচলন করার চেষ্টা গ্রন্থসংবেদী রবীন্দ্রনাথের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া সম্ভব হত না। যে-কোনও রচনার ‘সামাজিকীকরণ’-এর প্রথম ও অন্যতম প্রধান ধাপ এই ডেস্ক-এডিটিং বা হাউস এডিটিং। এই ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ‘মন্তব্য’ শীর্ষক (১২ মাঘ ১৩৪৪) একটি লেখা থেকে একটু দীর্ঘ অংশ পড়ে নেওয়া প্রয়োজন। তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী ভাবতেন বই সম্পাদনা সম্বন্ধে আর কেনই-বা তিনি এ-ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন: ‘বিশ্বভারতী সম্পর্কে যে গ্রন্থ সম্পাদন বিভাগ স্থাপিত হয়েছে বলা বাহুল্য তার মুখ্য উদ্দেশ্যই আমার রচিত গ্রন্থ সম্পাদন। আসন্ন যে-সব গ্রন্থ ছাপার উপযোগী তাদের প্রস্তুত করতে হবে, ভবিষ্যতে যারা ছাপাখানায় চড়বে তাদেরও তৈরি করে রাখা চাই। বিলাতে ডেন্ট কম্পানি বড়ো পাব্লিশর, তাঁদের প্রকাশোন্মুখ বইগুলিকে সর্বতোভাবে মুদ্রণযোগ্য করার কাজে যিনি নিযুক্ত আছেন তাঁকে আমি বন্ধুভাবে জানি। তাঁর নাম Ernest Rhys, তিনি একজন বিখ্যাত সাহিত্যরচয়িতা, সেইজন্যেই তাঁর ’পরে এই গুরুতর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই কাজের একটা দিক আছে যেটা খুঁটিনাটির কাজ, যেমন চিহ্ন সংকেত বসানো, বানান শোধন ও প্যারাগ্রাফ বিভাগ করা; এমন-কি রচনার কোনো স্খলন থাকলে তার প্রতি লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আর একটা দিক আছে যেটাতে সাহিত্যিক বিচার-বুদ্ধির দরকার অর্থাৎ অসংগতি দোষ, অসংলগ্নতা, ভাষাগত ত্রুটি সম্বন্ধে প্রশ্নদ্বারা মীমাংসা করা। শেষোক্ত কর্তব্যের প্রয়োজন অতি দৈবাৎ ঘটে। কারণ যে লেখকদের বই বেছে নেওয়া হয় তাঁদের ভুলচুক অনবধানতাবশতই ঘটে, সহজে ঘটে না। আমার ইংরেজি Sadhana ছাপবার সময় তাঁর কাজ দেখেছি, এতে যে সতর্কতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন তা যে-সে লোকের দ্বারা সম্ভব নয়, এইজন্যে এ কাজের গৌরব আছে। তাঁকে প্রভূত পরিশ্রম করতে হয় জানি, কিন্তু এই পরিশ্রমের দ্বারা যে ফল পাওয়া যায় তা লেখক ও প্রকাশকের পক্ষে বহু মূল্যবান। আমার গ্রন্থ সম্পাদন কাজে আঙ্গিক ও ভাবিক দিক থেকে এই রকম শ্রদ্ধাপূর্ণ সহায়তা পাব এই আমার আশা ছিল এবং আছে।’
এই অনুষঙ্গে পড়ে নেওয়া যেতে পারে নিজের বইয়ের সম্পাদনা নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা একটি তারিখহীন সম্বোধনহীন পত্রে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছিলেন: ‘আমার বই বের করবার সময় কেবল প্রুফ দেখাই কি যথেষ্ট? এডিট করার কি কোনো প্রয়োজন নেই? চোখের বালি, নৌকাডুবি, ঘরে-বাইরে কেউ কি মাসিকপত্রে প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবার চেষ্টামাত্র করেছিল? সঙ্কলন প্রভৃতি বইয়ে যে সব প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে একবার ওরিজিন্যালের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার দরকার ছিল না? এই রকম অন্ধভাবে আমার বইগুলো এক এডিশন থেকে অন্য এডিশনে চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে চলল। এর কি প্রতিকার করা উচিত নয়?’ একইরকম আক্ষেপের সুর চয়নিকা সম্পর্কেও। কিশোরীমোহনকে তিনি এক চিঠিতে (২৯ মে ১৯৩৭) লিখেছিলেন, ‘চয়নিকার প্রথম দুটি কবিতা চলতেই পারে না। ছেলেমানুষিকে আমার নামে প্রচার কোরো না। চয়নিকায় বিস্তর বাজে মাল আছে— লজ্জা বোধ করি।’ তারিখহীন আর এক চিঠিতে [১৯২৯] রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন: ‘“কাব্যগ্রন্থন” নাম দিয়ে আমার নিজের স্বীকৃত কবিতা ছাপতে চাই। তার থেকে আমার অযোগ্য লেখা বাদ দেব। ভাবী পাঠকদের কাছে এইটেই হবে আমার দান। এটা অবশ্য আয়তনে বড়ো হবে। অবশ্য নাটকগুলো এর মধ্যে ধরবে না, এবং পূরবী ও মহুয়া-ও বাদ পড়বে। জাপানী কাগজে যদি কুলোয় তাহলে মন্দ হয় না।’ পরিকল্পিত এই বইটির প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে করে গেলেও বইটি শেষ পর্যন্ত করে যেতে পারেননি। নিজের বইয়ের ব্যাপারে এমন আক্ষেপের উদাহরণ আরও আছে। ফলে রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যগুলি পড়লে বোঝা যায়, রবীন্দ্র-রচনার পাঠ নির্ভুল ও প্রামাণ্য করে তুলতে তাঁর সহযোগীদের নিরলস চেষ্টা ও অধ্যবসায় বাংলা বইয়ের সম্পাদনার মান নির্ধারণে যে প্রভাবই ফেলে থাকুক না-কেন, রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রেত সম্পাদনারীতির সঙ্গে সত্যই তা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। অনেক উদাহরণের মধ্যে এখানে একটি বইয়ের উল্লেখ করে এই আলোচনার ইতি টানব। ছিন্নপত্র (১৯১২)— শ্রীশচন্দ্রকে লেখা আটটি চিঠি ও ইন্দিরা দেবীকে আট বছর ধরে (১৮৮৭-৯৫) লেখা চিঠিগুলি থেকে নির্বাচিত ১৪৩টি চিঠি রবীন্দ্রনাথ নিজে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন। কবির জন্মশতবর্ষে বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় থেকে পুলিনবিহারী সেনের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় ছিন্নপত্র-র ‘পূর্ণতর’ সংস্করণ ছিন্নপত্রাবলী (১৯৬১)। ছিন্নপত্র-র মূল বিন্যাসকে অবিকৃত না-রেখেই, রবীন্দ্রনাথের বাদ দেওয়া ওই ১০৭-টি অতিরিক্ত চিঠি-সহ পূর্বে ছাপা চিঠির বর্জিত অংশ সমস্ত যোগ করা হয় ছিন্নপত্রাবলী বইতে। এমনকী জন্মশতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী-র একাদশ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয় ছিন্নপত্রাবলী— ছিন্নপত্র নয়। এখন আপনারাই বলুন, লেখকের জীবিতকালে প্রকাশিত, অনুমোদিত কোনও বইয়ের মূল বিন্যাস ‘আঙ্গিক ও ভাবিক দিক থেকে’ বদলে দিয়ে ‘ক্রিটিকাল এডিশন’ তৈরি করা কি গ্রন্থ সম্পাদনার রীতিসিদ্ধ? এই প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহ্য উত্তরের খোঁজে ১৯২১ সালের ৩০ অক্টোবর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে লেখা চিঠি থেকে পড়ে নেওয়া যেতে পারে কিছু অংশ: ‘পুরোনো লেখা ছাপানো সম্বন্ধে আমার ভাবনা আছে। যে-সব জিনিষ যাবার, কালের অমোঘ নিয়মে তারা যায়। মানুষ তাদের টানাটানি করে বাঁচিয়ে রাখে— বাঁচিয়ে রাখা বলাটাও ভুল— হয়ত টিকিয়ে রাখে— ইজিপ্টে মমি যেমন ছিল। তাতে ঐতিহাসিকের সুবিধে হতে পারে কিন্তু যাকে রাখা হয় সজীব সচল সহাস্য কালের কাছে তাকে বড়োই অপদস্থ করা হয়।’
সহায়ক সূত্র
• আকাদেমি পত্রিকা, পঞ্চম সংখ্যা, বৈশাখ ১৪০০/ মে ১৯৯৩।
• প্রশান্তকুমার পাল (সম্পাদিত), কল্যাণীয়েষু প্রশান্ত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৪১১।
• অনির্বাণ রায় (সংকলিত ও সম্পাদিত), রবীন্দ্র-রচনায় গ্রন্থ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়, ছাতিম বুক্স্, ২০১৩।
• দীপঙ্কর সেন, ‘মুদ্রণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’, পুরশ্রী, বৈশাখ ১৩৮৫/ মে ১৯৭৮।
• স্বপন চক্রবর্তী, ‘গ্রন্থ, পাঠ, শিল্পকর্ম: রবীন্দ্রনাথ ও রচনার দৃশ্যপট’, রবীন্দ্রনাথ: শিল্পরূপ পাঠরূপ গ্রন্থরূপ, সম্পা. স্বপন চক্রবর্তী, অবভাস, ২০১১।
• রামকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘কবির ছাপাখানা’, গ্রন্থনির্মাতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সম্পা. শিলাদিত্য সিংহ রায়, অভিযান পাবলিশার্স, ২০১৮।
• রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘শান্তিনিকেতনের কিঙ্করদা’, বিশ্বভারতী পত্রিকা, রামকিঙ্কর বেইজ সংখ্যা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৬।
• সমীর ঘোষ, অলংকরণ শিল্পের অন্যধারা, ঠিক-ঠিকানা, ২০১৫।
প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়, দেশ পত্রিকায়।
No comments:
Post a Comment