সময়গ্রন্থির কবি জীবনানন্দ
সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়
ধূসর পাণ্ডুলিপি-র হেমন্তের জগতে স্বভাবতই ফুলের প্রসঙ্গ প্রায় অনুচ্চারিত। ইয়েটস যে অর্থে ডরোথি ওয়েলেসলিকে বলেছিলেন, Why can’t you English poets keep flowers out of your peotry? - কবি জীবনানন্দের এই ফুল-বিমুখতার সঙ্গে সে অর্থের কোনও সংযোগ নেই। এই অনুচ্চারণ একটা অস্তিবাচক সত্য। আমরা যখন রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথ নজরুলের রৌদ্ররাগ এবং পুষ্পরাগের পরিমণ্ডল পেরিয়ে সেই ধূসর ম্লানতায় প্রথম প্রবেশ করলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। যে সন্ধ্যায় মনে হয়, সূর্যাস্তের ওপারের সূর্যের কথা, এ সন্ধ্যা সে সন্ধ্যা নয়। এ হেমন্তের সন্ধ্যায় যেন কোনও দুর্মর অন্ধকারের বার্তা পাওয়া গেল। তাই ধূসর পাণ্ডুলিপি-তে কবিসত্তার স্বনিয়মী স্বাভাবিকতায় ফুলের ব্যবহার ঘটেনি বললেই হয়। ক্বচিৎ এক আধটি শসাফুল, বিনষ্ট শসার পাশে অথবা বাসি বা ছেঁড়া করবীর এক আধটি পাপড়ি ফুলের বিস্মৃতিকে রোধ করার জন্য প্রয়াসী। নতুবা ধূসর পাণ্ডুলিপি-তে ফুল নেই। ফুল নেই সে সন্ধ্যায়-সে অভবিষ্য অস্পষ্ট অনালোকে মৃত প্রেমিকাদের মুখের মতো বিমর্ষ নক্ষত্রেরা ফুটে উঠেছে। জীবনানন্দের সমগ্র কবিজীবনে অতঃপর নক্ষত্র স্থায়ী কাব্যপ্রসঙ্গ। ধূসর পাণ্ডুলিপিতে এবং কমবেশি তারপরেও জীবনানন্দ শুধু হেমন্তের কবি নন-হেমন্তের সন্ধ্যার কবি। কেবলমাত্র হেমন্তের অনুষঙ্গ, অন্তত বাংলাদেশে কিছুতেই বিষণ্ণতাবাচক নয়। হেমন্তের অনুষঙ্গে ফসল তোলার আশা আনন্দই বাঙালি কৃষকের মনে জড়িত। কিন্তু হেমন্তর সন্ধ্যার নিরুদ্যমতাকে জীবনানন্দ অন্যতর অর্থে নিযুক্ত করতে পেরেছেন। বিশ্বব্যাপী যে স্লাম্প বাঙালি যুবকেরও উত্তাপ ও উৎসাহকে জুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল জীবনানন্দের হেমন্ত-সন্ধ্যা কতকাংশে সেই নিরুদ্যমতার প্রতীক। আর গভীরতর অর্থে ধূসর পাণ্ডুলিপি-তে ক্রমশই একটা কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে জীবনানন্দ মানুষের বিপন্ন সৌন্দর্যবোধের কবি। আক্ষরিকভাবে বাস্তববাদিতাকে যদি বেশি প্রশ্রয় দেওয়া যায় তাহলে আবারও বিপন্ন সৌন্দর্যবোধের প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যার জন্য প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর জীবনের মন্দস্রোতের কথা ওঠে। কিন্তু এ সৌন্দর্যবোধের বিপন্নতারও ইতিহাস আছে। হয়তো তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রোমান্টিকতার ভাবসংকটের জের, জড়িয়ে আছে শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী ব্যক্তির আত্মচ্যুতির অভিজ্ঞতা; জড়িয়ে আছে ক্রমবর্ধমান আত্মসম্বিতের ফলে সঞ্জাত ব্যক্তির নৈঃসঙ্গের চেতনা। হয়তো শেষ পর্যন্ত এই সবকিছুরই ফলে কবিচেতনার তরঙ্গ এক উপলব্ধির তটে প্রহত হয়েছে-মৎস্যকন্যাদের গান আমাকে উদ্দেশ্য করে নয়। কবি জীবনানন্দের মধ্যে মানুষের সেই বিপন্ন সৌন্দর্যবোধের চেতনা নক্ষত্রের প্রতীকে রূপস্থ হয়ে উঠেছে। 'বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল', আর নারকেল নাড়ু বিতরণকারিণী বাসমতী চাল ধোয়া হাতে বিনুনি বাঁধা মেয়ে সেই চেতনারই ইঙ্গিত নিয়ে পরে দেখা দিয়েছে।
বিষণ্ণ হেমন্তের যে অন্ধকার প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষের এবং সভ্যতার তৎকালীন নিরাশ্বাস উদ্যমহীনতার ছায়া সে অন্ধকার, সচেতন ব্যক্তির আত্মসম্বিতের যে সুযোগই দিক, তার বিষণ্ণতায় কোনও সন্দেহ নেই। এ অন্ধকারে নক্ষত্রই একমাত্র আশ্রয়। রবীন্দ্রনাথের সূর্যের আলোকে যে অনাহত সৌন্দর্যচেতনা পরম প্রত্যয়ের সঙ্গে বিকীর্ণ হয়েছে, আলোছায়ার বিচিত্র আলপনা এঁকেছে, জীবনানন্দীয় জগতে সে প্রত্যয় নেই - থাকার কথাও নয়। অন্ধকার সেখানে সমাসন্ন, কুয়াশায় কম্পমান নক্ষত্রটুকুই সেখানে ভরসা। তখন আমরা কেউ কেউ ভেবেছি যে সূর্যের আলোকে সেখানে জীবনের প্রসন্ন পাঠ সম্ভব নয়, নক্ষত্রের অস্পষ্ট আলোকেই সেই অন্ধকারকে যথাসম্ভব এড়াতে হবে। এই নক্ষত্র প্রেমের প্রতীক, এই নক্ষত্র শাশ্বত জীবনের প্রতীক, এই নক্ষত্র ব্যর্থ মানুষের সন্ধ্যায় নিজের কাছে (নীড়ে) ফিরে আসার প্রতীক। ধূসর পাণ্ডুলিপি-র এই কম্পমান নক্ষত্রকে দেখলে একথা মনে না হয়ে পারে না যে জীবনানন্দ যতটা নতুন চেতনার উন্মেষের কবি, তার চেয়ে তিনি অনেক বেশি পুরোনো চেতনার বিদায়ের কবি। সৌন্দর্যের মতোই মানুষের সম্ভোগের বিপন্নতাকে জীবনানন্দ উপলব্ধি করেছেন। তাঁর পঞ্চেন্দ্রিয়-বাসনায় জীবনের স্বাদুতার স্মৃতি দুর্মর কিন্তু মুমূর্ষু।
(১) বাতাসে ঝিঁঝিঁর গন্ধ ... বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে;
(২) ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা ক'রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে
ঘৃণা ক'রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
নীলাভ নোনার বুকে রস ঘন হয়ে আসা, অথবা 'মেয়েমানুষ' শব্দটির প্রয়োগ নিঃসন্দেহে সেই গুণ প্রকাশমান, বুদ্ধদেব যাকে বলেছেন শারীরিকতা। কিন্তু এই শারীরিকতাকে কোনও অর্থেই পঞ্চেন্দ্রিয়পরায়ণতা বলা যাবে না। বরঞ্চ একে বলা যাবে পঞ্চেন্দ্রিয়ের স্মৃতিচেতনতা। উদ্ধৃত অংশ দুটিতে পঞ্চেন্দ্রিয় পরায়ণতার লক্ষণ যতটা পরিস্ফুট, তার চেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে পঞ্চেন্দ্রিয় আকুলতা। যৌবনের অস্তায়মান রক্তরাগকে দেখে ক্লান্ত প্রৌঢ়ের যে করুণ স্মৃতি এক অশরীরী আকুলতার জন্ম দেয় এই আকুলতা সেই জাতীয়। এখানেও সন্ধ্যার স্মৃতি অনিবার্য কাব্য-প্রসঙ্গ হিসাবে দেখা দিয়েছে। এই সন্ধ্যার আকর্ষণেই ফুটে উঠেছে জীবনানন্দের নক্ষত্রেরা।
(ক) তুমি আর আমি
ঠান্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপে থামি
সেইখানে রব পড়ে
যেখানে সমস্ত রাত্রি নক্ষত্রের আলো ঝরে।
(খ) মানুষের অন্তরের অবসাদ-মৃত্যুর জড়তা
সমুদ্র ভাঙিয়া যায় ; - নক্ষত্রের সাথে কয় কথা
যখন নক্ষত্র তবু আকাশের অন্ধকার রাতে -
তখন হৃদয়ে জাগে নতুন সে এক অধীরতা
তাই লয়ে সেই উষ্ণ আকাশেরে চাই যে জড়াতে
গোধুলির মেঘে মেঘ, নক্ষত্রের মতো রব নক্ষত্রের সাথে।
(গ) জীবন পুড়িয়া যায় - আমরাও ঝরে পুড়ে যাই
আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলিবার মতো শক্তি - তবু শক্তি চাই।
(ঘ) তোমার পায়ের শব্দ গেল কবে থামি,
আমার এ নক্ষত্রের তলে!
- জানি তবু - নদীর জলের মত পা তোমার চলে,-
প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথের গানগুলিতে যে অন্ধকার এবং নক্ষত্রের ছবি ও প্রতীক ব্যবহৃত হয়েছে তার সঙ্গে জীবনানন্দের নক্ষত্র প্রসঙ্গের অমিলটুকুও লক্ষণীয়।
(ক) যখন রাত্রি আঁধার হবে
হৃদয়ে মোর গানের তারা উঠবে ফুটে সারে সারে।
(খ) প্রভু তোমার বীণা যেমনি বাজে
আঁধার মাঝে অমনি ফোটে তারা।
(গ) আমার না বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে
তোমার ভাবনা তারার মতো বাজে।
(ঘ) আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারারাত ফোটাক তারা নব নব।
রবীন্দ্রনাথের গানে 'তারা' এক নিসন্দিগ্ধ আশ্বাসের বার্তাবহ। অন্ধকারের পরাভবের ইঙ্গিত রয়েছে তাঁর নক্ষত্ররাজিতে, তাঁর নিশীথ আকাশের তারার মেলায়। জীবনানন্দের নক্ষত্রের ভিতরে এই আশ্বাসের প্রেরণার চেয়ে আশ্বাসের জন্য কবির আকুলতাই ফুটে উঠেছে বেশি। সেখান নক্ষত্রের দীপ্তি অপেক্ষা তার স্তব্ধ প্রশান্তিই প্রধান কথা। তাই বুদ্ধদেবের অসামান্য কবি-পরিচিতির প্রথম চরণ যতটা সত্য, (সে পথ নির্জন যে পথে তোমর যাত্রা,) ওই কবিতাটির শেষাংশ - (একটি জ্বলন্ত তারা আকাশের জ্বলন্ত হৃৎপিণ্ড যেন এঁকে যায় সেই পথ...) - ততটা জীবনানন্দের কবিত্বের পরিচয়বাহী হয়নি। আকাশের জ্বলন্ত তারা জীবনানন্দের নয়। সে আকাশ অধিকাংশ সময়ে কুয়াশায় আত্মলীন এবং ম্লানতায় স্বপ্নগাঢ়। নক্ষত্রে সেখানে শুশ্রূষার সংকেত।
নক্ষত্রের সংকেতের সাহায্যে যে সন্ধ্যাকে জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় গাঢ় করে তোলেন সেই সন্ধ্যারই আকর্ষণে জীবনানন্দ সৃষ্টি করেছেন তাঁর আর এক গূঢ়ার্থসঞ্চারী কাব্য-প্রসঙ্গ। এ কাব্য প্রসঙ্গটি হল নীড়। এখানেও দেখা যাবে যে-নীড় রবীন্দ্রনাথের সে-নীড় জীবনানন্দের নয়। রবীন্দ্রনাথ নীড়ের প্রতি মমতাসম্পন্ন নন। রবীন্দ্রনাথের আকাশ-পিপাসার যে অর্থ-গৌরব তারই বিপরীত ব্যঞ্জনা 'নীড়' শব্দটিতে ধ্বনিত। প্রেমপাত্রীকে চিরবিদায় দেবার মুহূর্তেও তাই রবীন্দ্রনাথের কাব্যের নায়ক নীড়ে-ফেরা পাখির বিক্ষোভে নিজের বিবর্ণ মনের ছবি খুঁজে পায়। 'নীড়ে ফেরা পাখী যবে / অস্ফুট কাকলি রবে / দিনান্তেরে ক্ষুব্ধ করি তোলে' - প্রভৃতি অংশ এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। কিন্তু জীবনানন্দ যে নীড় প্রসঙ্গ সৃষ্টি করেন সে নীড় বহুলাংশে আশ্রিত-বৎসল। জীবনানন্দেরই সৃষ্ট সন্ধ্যার অনুষঙ্গবাহী সেই নীড়। আকাশ-পরিক্রমায় যেখানে নিরর্থকতাজনিত ক্লান্তি, নীড়ের জন্য বিধুরতা সেখানে অনিবার্য। এখানে আবার স্মরণীয় যে রবীন্দ্রনাথের আকাশ-পিপাসা রেনেশাঁসের জাগ্রত ব্যক্তির ব্যাপ্তির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আত্মীয়তাবদ্ধ। স্বভাবতই প্রথম মহাযুদ্ধের পরে উনিশের শতকের বাঙালি যুবকের সেই ব্যাপ্তির বাসনা নানা নিরুত্তাপে হিম হয়ে গেছে। জীবনানন্দ এই সময়ের পটে দাঁড়িয়েই সন্ধ্যার ম্লান কুয়াশায় নীড়ের কল্পনা করেছেন। নীড় নক্ষত্রের মতোই কবির আবেগের, স্মৃতির, কল্পনার আশ্রয়। যেখানে প্রত্যক্ষভাবে 'নীড়' ব্যবহৃত হয়নি সেখানেও প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গ বা আশ্রয়ের প্রসঙ্গ নীড়ের কাল্পনিকতাকেই প্রশ্রয় দিয়েছে। যেমন
(ক) আমাদের অবসর বেশি নয় - ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়
আমাদের সকলের আগে শেষ হয়
দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ-অবসাদ-
আমাদের ডেকে লয়-তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা-অবসন্ন
হাত।
(খ) পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ-মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে।
(গ) সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে।
(ঘ) সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে
সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তার ফেলেছে সে মুছে অবহেলে।
(ঙ) ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে
চলে যাই; কোন এক রুগ্ন হাত আমাদের টানে ?
পাখীর মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে
আরো আকাশের দিকে-অন্ধকারে-অন্য কারো আকাশের থেকে।
এইবার এর সঙ্গে রূপসী বাংলা-র নীড় মমতায় মাখা কবিতাগুলির কথা এবং বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের নীড় প্রসঙ্গকে যদি আমরা স্মরণ করি তাহলে একথা দৃঢ় প্রত্যয়ে পরিণত হয় যে জীবনানন্দের কল্পনার প্রবল আশ্রয় সন্ধ্যার নীড়। অথচ জীবনানন্দ জানেন এ নীড় নিয়তির মতো উদাসীন এক বিরুদ্ধ শক্তির হাতে কত সহজে ভেঙে যায়।
(ক) -চড়ুয়ের ভাঙা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে - পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা ঠান্ডা কড়কড় -
(খ) ধানকাটা হয়ে গেছে কবে যেন ক্ষেতে মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম - সাপের খোলস নীড় শীত
তাই এ অনুমান নিরর্থক নয় যে নীড়ের আকর্ষণে পাখি এবং পাখির জীবনের ক্ষণভঙ্গুরতার অনুষঙ্গে ব্যাধ, আবার ব্যাধের অনুষঙ্গে হরিণের প্রসঙ্গ জীবনানন্দের কবিজীবনের প্রথম অধ্যায়ে এক চমৎকার কল্পনা-বলয়ের সৃষ্টি করেছে
ধূসর পাণ্ডুলিপি-র 'ক্যাম্পে' এবং বনলতা সেন-এর শিকার কবিতা দুটি এই সূত্রে পৃথকভাবে স্মরণীয়। দুটি কবিতাতেই মৃত্যুর একটি বিমর্ষ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। জীবনানন্দের কবিতায় অস্তিবাদের যে প্রভাবটুকু অনুভব করা যায় তার সূত্রপাত এখানে। তবু এ সিদ্ধান্ত অপরিহার্য যে জীবনানন্দের কবি-কল্পনায় মৃত্যুচেতনা শেষ পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। মৃত্যুকে জীবনানন্দ যে দৃষ্টিতে দেখেছেন তা অস্তিত্ববাদীর দৃষ্টি নয় বলেই এমনটা ঘটেছে। জীবনানন্দ মানুষকে বিশ্ব-জীবনের মাঝখানে অকারণে নিক্ষিপ্ত এক সত্তা বলে মনে করেছেন বটে, কিন্তু তাকেই চূড়ান্ত বলে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে পেরেছেন এ ধারণার যৌক্তিকতা মেনে নেওয়া যায় না। এ কথার প্রমাণস্বরূপেই উল্লেখ করা চলে বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের 'সুচেতনা' কবিতাটি
মাটি পৃথিবীর টানে মানব জন্মের ঘরে কখন এসেছি
না এলেই ভালো হ'ত অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
উদ্ধৃত অংশের শেষ দুই পদে যে উপলব্ধি তা কিছুতেই মানুষের নিরর্থকতার অঙ্গীকার নয়। মানুষের চেতনার অগ্রাধিকার অবশ্য ওখানে স্বীকৃত। কিন্তু তার পরম প্রেম সেই চেতনারই সারাৎসার। তাই সেই প্রেমের প্রতীক যে নারী সে সুচেতনা। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের 'আমি' ধূসর পাণ্ডুলিপি-র 'আমি' অপেক্ষা সত্তার গভীরতার ধ্বনি আরও বেশি ঝংকৃত করেছে। 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'তে যে ছিল দ্রষ্টামাত্র -বনলতা সেন-এ সে নিজের পথিক অস্তিত্বের আবহমানতা সম্বন্ধে সচেতন। কিন্তু এ প্রসঙ্গে 'আমি পথ হাঁটিতেছি' এ কথার চেয়ে আরও সত্য 'বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর/কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর'। তাই বনলতা সেন-এ পথিক এবং নাবিকের শ্রান্ত রক্তের মন্থরতায় সংবিতের অনাসক্ত মূল্যায়ন কবির অভীপ্সা। বারে বারে ভূমধ্যসাগরের কূলবর্তী নিবে যাওয়া-সভ্যতাগুলির কথা মনে পড়েছে। সমুদ্রগামী সেই সব নাবিকদের দূরাগত ক্লান্ত গুঞ্জনে ধ্বনিত হয়েছে মানুষের অন্তহীন প্রয়াসের কথা। এই সব প্রয়াসের অন্তহীনতা এবং হয়তো নিরর্থকতা, শেষ পর্যন্ত আর এক সাধ্য খুঁজে পাবে প্রেমে। এই সাধ্যসাধনা-মীমাংসা বনলতা সেন-এর কবিকল্পনার উপজীব্য
মানুষ কাউকে চায় - তার সেই নিহত উজ্জ্বল
ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনও সাধনার ফল।
সেই সাধনারই লক্ষ্য সুচেতনা - যার অপর নাম 'মানুষের তরে এক-মানুষীর গভীর হৃদয়'। নিজ কবিজীবনের এই অংশে জীবনানন্দের মুক্তি ঘটেছে প্রারম্ভিক শারীরিকতার হাত থেকে। এই মুক্তিই পরিণতি পেয়েছে বনলতা সেন পেরিয়ে বেলা অবেলা কালবেলা-য়। তখন ধূসর পাণ্ডুলিপি-র সেই ইন্দ্রিয় সচেতনতা আর নেই। 'মেয়েমানুষ' শব্দটি এখন অনুচ্চার্য। বেলা অবেলা কালবেলা-য় প্রধান কল্পনাসঞ্চারী শব্দ 'মহিলা'। এই মহিলা যিনি মননলোককে স্পর্শ করেন - যিনি অপূর্ববস্তু রচনা করেন প্রত্যেক মানবহৃদয়ে, তাঁর শক্তিকেই প্রতিভা বলা হয়েছে। এই চেতনা আকাশীসত্তার মতো দ্যুতিময় বলে বেলা অবেলা কালবেলা-য় মহিলারই সংস্পর্শে নক্ষত্র শব্দটিরও ব্যঞ্জনাগত পরিবর্তন ঘটেছে।
ধূসর পাণ্ডুলিপি থেকে বনলতা সেন পর্যন্ত সৃষ্টি পর্যায়ে জীবনানন্দের কবিতায় এক বিশেষ স্বরের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। 'হাওয়ার রাত' বা তার মতো দু-একটি কবিতা বাদ দিলে এই সময়ের জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতার পাঠ-জনিত প্রতিক্রিয়ায় এক বিষণ্ণ পঞ্চমাঙ্ক নাটকের শেষ দৃশ্যের আবহাওয়া, ও অনুভূতি তুলিত হতে চায়। যেন শুধু কোনও শত শতাব্দীব্যাপী প্রয়াসের অন্তহীনতাকে জানা গেল, যেন অপরিহার্য নিরর্থকতাকে মেনে নিতে হল - নায়কের কণ্ঠে তারই বিষণ্ণ স্বগতোক্তি। আসন্ন যবনিকাকে উপেক্ষা করে কথাগুলি নীরব প্রেক্ষকের উদ্দেশ্যে বিনা সম্বোধনে অন্ধকারে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক একটি কবিতা আছে যাকে মনে হয় কোনও আন্তরিক কাহিনির শেষাংশ। ধূসর পাণ্ডুলিপি-র 'পঁচিশ বছর পরে', বনলতা সেন-এর 'কুড়ি বছর পরে', 'ধান কাটা হয়ে গেছে', 'হাজার বছর শুধু খেলা করে' এবং 'অঘ্রাণ প্রান্তরে' এ জাতীয় কবিতা। এই দুই ধরনের কবিতার আত্মায় জড়িয়ে রয়েছে এক সমাপ্তি বোধ। ধূসর পাণ্ডুলিপি-র নক্ষত্র প্রসঙ্গের সেই জনক। সমাপ্তি বোধ স্থায়ী। সঞ্চারী হিসেবে দেখা দিয়েছে কখনও নির্বেদ, কখনও ক্লান্তি, কখনও বা শান্তির নির্লিপ্তি। এই সমাপ্তি বোধের পিছনে রয়েছে কবির প্রচ্ছন্ন আত্মজ্ঞান। সমগ্র বিশ্বকে তিনি তাঁর দর্শন-স্থবির অহমের অন্তর্গত করে নিয়েছেন। এর ফলে জানার সমাপ্তি ঘটেছে। যে সমাপ্তি বোধ জীবনানন্দের কবিতায় বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থে কখনও কখনও ক্লান্তির সুরও বাজিয়েছে তারও মূলকথা ওই জ্ঞানের সমাপ্তি। নায়ক বলছেন - আমার জানা শেষ হয়েছে এই কারণে, যে অবিরাম জেনে চলার সাধ আর আমার নেই।
সুতরাং কবি ঠিকই জেনেছিলেন যে এই সমাপ্তির অনুভূতিকে সঞ্চারিত করার এক কালগত সুদূরতার অভিব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তোলা দরকার। এই শৈল্পিক উপলব্ধির সূত্রেই জীবনানন্দের কবিতার আয়বিক রহস্যও উন্মোচিত হতে পারে। স্থানগত এবং কালগত সুদূরতাকে ব্যঞ্জিত করার জন্যই দীর্ঘস্বর ধ্বনির প্রতি জীবনানন্দের পক্ষপাত। দীর্ঘ স্বরধ্বনি, বিশেষ 'আ'-স্বর জীবনানন্দের উক্ত উদ্দেশ্যসাধনে বিশেষ সহায়ক।
(ক) প'ড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার ক্ষেত মাঠ প্রান্তরের পর
এই সব ত্যক্ত পাখী কয়েক মুহূর্তে শুধু - আবার করিছে আরোহণ
আঁধার বিশাল ডানা পাম গাছে, - পাহাড়ের শিঙে শিঙে সমুদ্রের
পারে ;
(খ) চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;
(গ) কাল তারা অতি দূরে আকাশের সীমানায় কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘবর্শা
হাতে
করে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন-
(ঘ) মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ;
(ঙ) মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ
পারস্য গালিচা, কাশ্মিরী-শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল
আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা
আর তুমি নারী -
ভাবছন্দের সঙ্গে কাব্যছন্দের সাযুজ্য জীবনানন্দের স্বভাবতই অন্যতম অণ্বেষা। যে সব মুহূর্তে তাঁর কাব্যছন্দ কথ্যছন্দকে প্রশ্রয় দিতে পারেনি সে সমস্ত মুহূর্তে তাঁর কাব্যছন্দ কথ্যছন্দকে প্রশ্রয় দিতে পারেনি সে সমস্ত মুহূর্তে তাঁর ভাবছন্দের চারিত্রই অধিকতর আধিপত্যপরায়ণ। পূর্বে কথিত সমাপ্তিবোধকে সার্থক করে তোলার জন্য নাবিক-ক্লান্তি এবং পথিক ক্লান্তির যে পটভূমিকা দরকার 'আ'-ধ্বনির কালদৈর্ঘকে ফুটিয়ে তুলে সেই ক্লান্তিকে মূর্ত করছে। এই প্রয়োজন মেনে নিয়েই জীবনানন্দ লৈখিক ক্রিয়াপদকে একেবারে বিদায় দিতে পারেননি। বনলতা সেন কবিতাটির প্রথম এবং শেষ চরণের লৈখিক ক্রিয়াপদ দুটি এখানে স্মরণীয়। 'হাঁটিতেছি'-র বিলম্বিত স্বরধ্বনি ছাড়া হাজার বছরের ক্লান্তিকে ধ্বনিত করা যেত না। আবার শেষ চরণের 'বসিবার' ক্রিয়াপদটিই সমস্ত পাঠকহৃদয়কে এক অন্তহীনতার মাঝে নিক্ষেপ করে গেল। এবং এই প্রকরণের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই জীবনানন্দ বলেন
...তাই বলে কবিতার মানে পাঠকসমাজে নির্বিশেষে বিমুক্ত করতে গিয়ে যে যুগে ও যে দেশে আমি রয়েছি সেখানকার মানুষের মুখের ভাষায় কবিতা লিখব এরকম, বা যে কোনও রকম সংকল্পে কবিতা উতরায় না, সংকল্পের সঙ্গে কবিতার সংস্রব নেই বলে নয় ; সংস্পর্শ রয়েছে; সার্থক কবিতা হয়তো মুখের ভাষায় ফুটে উঠবে, কিংবা ঠিক মুখের ভাষা নয় এমনি কোনও ভাষায় ; কিন্তু কোনও বিশেষ বাগরীতিতে বা অর্থে লেখা উচিত এই সংকল্পের ভিতর থেকে নয়।
- কবিতার কথা; 'মাত্রাচেতনা' জীবনানন্দ দাশ।
নিজ কবিজীবনে জীবনানন্দ যে কারণে তাঁর কবিস্বরের বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করতে গিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন তার ব্যাখ্যা এখানে তিনি দেননি। তিনিও একটি সংকল্পই নির্মাণ করেছেন মাত্র। এবং এই সংকল্প তাঁকে সব সময়ে শৈল্পিক সার্থকতার পথ দেখায়নি। ধূসর পাণ্ডুলিপি-তেই এই বাকছন্দ সংক্রান্ত ভ্রান্ত পদক্ষেপের নিদর্শন তুলনাগতভাবে বেশি।
(ক) হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ মরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালীর
বিছানার পর
(খ) কারণ,-অনেক অশ্রু-রক্তের মতন অশ্রু ঢেলে
আমরা রাখিতে আছি, জীবনের এই আলো জ্বেলে
(গ) সিন্ধুর ঢেউয়ের তলে অন্ধকার রাত্রির মতন
হৃদয় উঠিতে আছে কোলাহলে কেঁপে বারবার।
এই রকম আরও কিছু জায়গায় লৈখিক ক্রিয়া ও মৌখিক ক্রিয়ার মধ্যে সন্ধি স্থাপনের চেষ্টা শৈল্পিক স্বাচ্ছন্দ্যের পরিপন্থী হয়েছে। 'বিয়োবার দেরি নেই আর' - এখানে 'বিয়োবার' শব্দে আপত্তি নেই। যে নারীর রূপ ঝরে যাবে তার সম্বন্ধে আচম্বিত অসম্ভ্রম তাৎপর্যবিহীন নয়। কিন্তু 'বিয়ায়ে গেছে' এই উদ্ধৃত অংশে লৈখিক ক্রিয়াভঙ্গির সঙ্গে একান্তই প্রাকৃত ক্রিয়াটির মিলন সাধন সম্ভব হয়নি। 'রাখিতে আছি' এবং 'উঠিতে আছে' একদিকে লৈখিক ক্রিয়াপদ আবার অন্যদিকে জেলা বিশেষের বাগরীতির বিশেষত্বের স্মারক। এই অবৈধমিলনও কার্যকর হয়নি।
কিন্তু তাই বলে আমার উদ্দেশ্য এই নয় যে জীবনানন্দের কানে কথাছন্দের গুরুত্ব ধরা পড়েনি। শাব্দিক বিন্যাসে জীবনানন্দের পারঙ্গমতা বহুশ্রুত। তাঁর কোনও কোনও কবিতার অংশবিশেষ এক্ষেত্রে আলোচ্য হতে পারে। সে সব ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা ছন্দের প্রতিমুখেই যেন কথ্যছন্দকে ধরে দিয়েছে জীবনানন্দ। যেমন
গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত ;
আমাকে কেন জাগাতে চাও?
হে সময়গ্রন্থি হে সূর্য, হে মাঘ নিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি,
হে হিম হাওয়া,
আমাকে জাগাতে চাও কেন?
অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর ;
উদ্ধৃত অংশটির প্রথম পংক্তিটির দীর্ঘ স্বরধ্বনি জীবনানন্দের ঈপ্সিত ক্লান্তিকে ধারণ করে রয়েছে। আত্মহত্যার বাসনা অস্তিত্বের নিরর্থকতা থেকে উদ্ভূত। সে অস্তিত্ব সকল সংগ্রামে বীতরাগ। তার অভিজ্ঞতা দীর্ঘ। তার ক্লান্তিও দীর্ঘ। দ্বিতীয় পংক্তির সটান কথ্যভঙ্গি শেষ নিদ্রাতুরের বিরক্ত প্রতিবাদ। প্রথম চরণে নিদ্রাচ্ছন্ন স্থলিত গতি - দ্বিতীয় চরণে রূঢ় চমক। এ প্রতিবাদ তাদের প্রতি যারা অস্তিত্বের সার্থকতার কথা কাব্যে, দর্শনে, রাজনীতিতে স্মরণ করিয়ে দেয়। তৃতীয় ও চতুর্ছ পংক্তির দীর্ঘস্বরগুলির সঙ্গে যোগ দিল মহাপ্রাণ বর্ণের সুমিত প্রয়োগ-দীর্ঘশ্বাসের ব্যঞ্জনা এল। অতঃপর পঞ্চম পংক্তিতে আবার দ্বিতীয় চরণটিই ফিরে এল- শুধু 'কেন' শব্দটি স্থানবদল করে একটি আর্ত মিনতিকে ধ্বনিত করেছে। এর পরেই অরব অন্ধকারে অপরিচিত-বিলুপ্তির বাসনা-'অরব' বিশেষণটি নীরবের পরিবর্ত শব্দ মাত্রা নয়। 'অরব' শব্দে নীরবের মিষ্টতা নেই। বিশেষণটিই ইতিপূর্বে কোথাও ব্যবহৃত হয়নি বলেই অপরিচিত। তার কাজ হল অন্ধকারের কঠিন অব্যাখ্যাত শূন্যতাকে ফুটিয়ে তোলা। এই শূন্যতার অনুভূতিকে বারে বারে জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় নানাভাবে মূর্ত করতে চেয়েছেন।
'অরব অন্ধকার', 'উটের গ্রীবার মতো কোনও এক নিস্তব্ধতা এসে', 'পাখীর নীড়ের মতো চোখ', 'বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ', 'স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো', প্রভৃতি বিশিষ্ট জীবনানন্দীয় শব্দচিত্রের মধ্যে তাঁর কবিভাষার গূঢ় রহস্য স্পন্দিত। এগুলি তাঁর কাব্যের স্বতন্ত্র স্বরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এই স্বর-স্বাতন্ত্র্য, সকল কবির ক্ষেত্রেই যেমন তাঁর ক্ষেত্রেও তেমনি, তাঁর জীবনদৃষ্টির দান। 'অরব অন্ধকার' এবং 'উটের গ্রীবার মতো কোনও এক নিস্তব্ধতা এসে'-এই দুই ক্ষেত্রেই অন্ধকার বা নিস্তব্ধতা লক্ষ্য নয়, কবি-লক্ষ্য ছিল এক অনির্দেশ্য শূন্যতার পাত্রবস্তু-নিরপেক্ষ অনাত্মীয়তাকে মূর্ত করা। 'পাখীর নীড়ের মতো চোখ' এই উপমায় স্বভাবতই 'চোখ' কবির উদ্দিষ্ট নয়। উদ্দিষ্ট কবির নিজেরই আশ্রয়াকুল মন। আবার, যে ক্লান্ত মেয়েটির চোখ ম্লান, তার ম্লানতার অন্তর্গত স্বরূপ আমরা জানি না বলেই বেতের ফলের উপমার সার্থকতা। 'স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো' আকারে উপমা, প্রকারে প্রতীক। করুণ শব্দটিই সেই প্রতীককে ধরিয়ে দিচ্ছে। ক্লান্তি, নিরর্থকতা, উদ্বেগ প্রভৃতি নানা কারণে মাতৃকল্পনা এবং মৃত্যুকল্পনা জীবনানন্দের কবিমানসকে কখনও কখনও প্রভাবিত করেছে। মাতৃজঠরে প্রত্যাবর্তন ও মরণাশ্রয়বাসনা একার্থক। মাঝে মাঝে জীবনানন্দ অতি আগ্রহে ব্যাখ্যা করে বলতে চান। তখন তাকে বাহুল্য বলে মনে হয় 'অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি'। এখানে 'অনন্ত মৃত্যুর মতো' এই উক্তির আর প্রয়োজন ছিল না। করুণ শঙ্খের মতো স্তন নিঃসন্দেহে জীবনানন্দের মাতৃকল্পনের প্রতিক্রিয়াসঞ্জাত প্রতীক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ধূসর পাণ্ডুলিপি-র প্রেমিকা-কল্পনা এবং বনলতা সেন-এর প্রেমিকা-কল্পনার মধ্যে যে পার্থক্য অনুভূত হয় তাও এই সূত্রেই বিচার্য। বনলতা সেনের প্রেমিকা-কল্পনায় জীবনানন্দের মাতৃকল্পনার প্রভাব নাতিপ্রচ্ছন্নভাবে কার্যকর থেকেছে। প্রেমিকা সেখানে আশ্রয়দাত্রী। অন্যদিক থেকে আবার মৃত্যুর ভিতরেও সেই আশ্রয়ের ব্যঞ্জনা। তাই নারীর মাথার চুলের প্রসঙ্গ জীবনানন্দের মৃত্যু-চেতনার সঙ্গে গ্রথিত হয়ে তাঁর আশ্রয়াতুর মনোভাবকে স্পষ্টতা দিয়েছে। ধূসর পাণ্ডুলিপি-তে প্রেমিকা-কল্পনার এই বৈশিষ্ট্য ছিল না।
কিন্তু এত সত্বেও জীবনানন্দের যে সমাপ্তি চেতনার কথা আমরা পূর্বে বলেছি তা কিছুতেই পূর্ণতার চেতনা নয়। পূর্ণতার চেতনার জন্য যে দার্শনিক স্থিরীভবন প্রয়োজন তার অভাব জীবনানন্দে ছিল না। কিন্তু এই স্থিরীভূত দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি কোনও সংকটের সংঘাতে অর্জন করেননি। করেননি বলেই এটা তাঁর কাছে সহজ আশ্রয়ের ব্যাপার ছিল। দান্তে বা রবীন্দ্রনাথ যেমন করে তাঁদের আবেগগত বিশ্বাসের সঙ্গে বৌদ্ধিক বা দার্শনিক বিশ্বাসের সাযুজ্য ঘটাতে পারেন, জীবনানন্দ তেমন পারেন নি। মানুষের প্রক্ষিপ্ততা, নিঃসঙ্গতা, তার গ্লানি ও উদ্বেগের কথা তিনি ঠিকই বলেন। তা থেকেই উত্তরণের আশাও একজন মানবতামুখী ভবিষ্যৎবিশ্বাসী আবহমানতা সচেতন ব্যক্তির মতোই তিনি প্রকাশ করেন কিন্তু এই দুই প্রান্তকে মেলাতে পারেন না। বনলতা সেন এবং অনুরূপ কয়েকটি কবিতার অসামান্য সার্থকতা সত্বেও একথা সাধারণভাবে সত্য যে জীবনানন্দের প্রায় কবিতাতেই ভাবের কোনও অগ্রসরণ নেই। প্রথম স্তবকে বা কয়েক চরণেই কবিতাটির মূল কাজ শেষ হয়ে যায়। স্মরণীয়, রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতায়ই এ লক্ষণ ছিল। কিন্তু কবিতার ফুলটির চারপাশে রবীন্দ্রনাথ যে পুঞ্জিত পল্লবের চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করতেন তার সজীবতাও অভিনন্দনীয়। সে ক্ষেত্রে জীবনানন্দের ভরসা ছিল তাঁর মননলব্ধ বিশ্বাস। এর যে সীমাবদ্ধতা তার দায় তাঁকে ভোগ করতেই হয়েছে। হ্রস্ব কবিতায় এবং দীর্ঘ কবিতায় সমান ভাবেই এই শৈল্পিক বিচ্যুতি ঘটেছে। আমরা অবশ্যই রিচার্ড-কথিত আবেগগত বিশ্বাস এবং বৌদ্ধিক বিশ্বাসের পার্থক্যের সারবত্তা এবং এলিয়টের মতান্তর এখানে আলোচনা করতে চাই না। বরঞ্চ এলিয়টকে আমরা এখানে রিচার্ডের বক্তব্যের বিরোধী হিসাবে দেখি না। বিশ্বাসের গাঢ়তম মুহূর্তে বিশ্বাস সমগ্র চৈতন্যেরই বিষয়। আবেগের ভূমিকা সেখানে স্বতঃই গণনীয়। রিচার্ড থেকেই সে সিদ্ধান্তের সমর্থন পাওয়া যাবে। বিশ্বাসের একমাত্র নিরিখ তা কবিকল্পনাকে সক্রিয় রাখতে পেরেছে কি না। বেলা অবেলা কালবেলা-য় বিশ্বাসের সেই ভূমিকা ম্লান। অথচ বেলা অবেলা কালবেলা-য় জীবনানন্দের দার্শনিক অভিপ্রায় আরও স্পষ্টতা লাভ করেছে, সেই অভিপ্রায়সিদ্ধির জন্য কবির প্রয়াসও শুরু হয়েছে।
বস্তুত 'আট বছর আগের একদিন'-এর সেই শূন্যতা-সঞ্চারী ক্লান্তিবোধ, সেই নৈঃসঙ্গ চেতনা থেকে বনলতা সেন-এ 'সুচেতনা' কবিতার বক্তব্যে পৌঁছে জীবনানন্দ আপন কবিসত্তার প্রতি অবিচল নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। বেলা অবেলা কালবেলা-য় সেই অবিচল নিষ্ঠাই বক্তব্যের দিক থেকে তাঁকে আরও অগ্রসর করে দিয়েছে। কিন্তু কবিতা তো শুধু নিষ্ঠা নয়, শুধু বক্তব্য নয়। বেলা অবেলা কালবেলা-য় এখানে ওখানে নিঃসঙ্গ কয়েকটি শিল্পিত কাব্যোক্তি অসংহত স্তবকগুলি পৃথুল কলেবরের পাশে পাশে রুদ্ধশ্বাস। সে পৃথুলতা আপন বিবৃতিতেই ক্লান্ত। 'আটবছর আগের একদিনে' ও শৈল্পিক বিচ্যুতি ঘটেছে, কিন্তু সে বিচ্যুতি অন্য জাতীয়। এই কবিতাটির প্রধান অসঙ্গতি দৃষ্টিকোণ-সংক্রান্ত অসঙ্গতি। যে সব দীর্ঘ কবিতায় দ্বিতীয় স্বরের সফলতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সেখানে উত্তম পুরুষের উক্তি, 'তার' এই সর্বনামের প্রসঙ্গ এবং নৈর্ব্যক্তিক বক্তব্যগুলি পারস্পরিকতায় সমগ্র কবিতাটিকে পূর্ণতা প্রদান করে। প্রসঙ্গত আমরা এলিয়টের বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা The Love Song of J. Alfred Prufrock -এর কথা স্মরণ করতে পারি। 'আটবছর আগের একদিন'-এ প্রারম্ভে, মধ্যে কোথাও উত্তম পুরুষের নিজের কাহিনি বা কথা নেই। 'শোনো' বলে যাকে সম্বোধন করা হচ্ছে তার ভূমিকাও স্বভাবতই গৌণ। সমস্ত কবিতাটিই 'তার' কথা। এই কবিতায় যাকে 'তুমি' বলা হয়েছে এবং যাকে 'তার' এই সর্বনামে উল্লেখ করা হয়েছে এরা এক ব্যক্তি। ' শোনো' যাকে বলা হয়েছে সেই টেবিলের ওপারের বন্ধু শ্রোতা। কবিতাটির শেষে 'আমি' এসেছে। একেবারে শেষে এসেছে 'আমরা'। 'জানি' বলে যে কথা বলেছে তার দার্শনিক উক্তি এবং পরিশেষে 'আমরা' যে উক্তি করেছে সেই 'আমরা'-র অন্তর্বর্তী আমি এক নয়। 'তবু' শব্দটিই তার প্রমাণ। 'আমরা' শব্দে যে অস্মিতা-বিচ্যুতি তার প্রস্তুতি কবিতাটিতে নেই। আবার যে দ্বি ব্যক্তিত্বের কল্পনা শেষে প্রাধান্য বিস্তার করেছে তার অনিবার্যতা জীবনদর্শন সংক্রান্ত পূর্বোক্তির জন্য রচিত হতে পারেনি। এইভাবে কবিতাটি দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। তথাপি যে কবিতাটি দাঁড়াতে পেরেছে সে 'তার' জন্য।
কিন্তু বেলা অবেলা কালবেলা-য় যে শৈল্পিক খঞ্জতা তার ক্ষতিপূরণের কোনও ব্যবস্থা কবির হাতে ছিল না। 'মাঘ-সংক্রান্তির রাতে' কবিতাটি বেলা অবেলা কালবেলা-র কবি-অভিপ্রায়ের সাক্ষ্য বহন করছে। আমরাও সচেতন হয়ে উঠছি এই ভেবে যে হৈমন্তিক বিষণ্ণতার অন্তে কোন বাসন্তী আশ্বাসের তোরণে কবি পৌঁছলেন দেখা যাক
মহাবিশ্ব তমিস্রার মতো হয়ে গেলে
মুখে যা বলনি, নারি, মনে যা ভেবেছ তার প্রতি
লক্ষ রেখে অন্ধকার শক্তি অগ্নি আর সুবর্ণের মতো
দেহ হবে মন হবে - তুমি হবে সে সবের জ্যোতি।
নিঃসন্দেহে এই অমেয় আশার বাণীতে কাব্যগ্রন্থটি ধন্য। কিন্তু এই আশার বাণীকে কবিতার ভাষায় রূপান্তরিত করতে গেলে যে প্রকরণ প্রয়োজন সেখানে কবির শৈথিল্য ঘটেছে। কেননা, যে বিশিষ্ট সৌন্দর্যধারণার সঙ্গে জীবনানন্দের ইতিপূর্বের মূল্যানুগত্য গ্রথিত ছিল তার সবটুকু না হলেও অধিকাংশই ছিল অতীত-নির্ভর। তিনি সন্ধ্যার বিষণ্ণতার কবি, শেষরৌদ্ররাগ মুছে যাবার বেদনায় নীড়ের জন্য বিধুর কবি। আমরা আগেই বলছি যে হেমন্তের যে মাঠের ধান কাটা হয়ে গেছে, যার সম্মুখে সবৈব শূন্যতা, তা করি জীবনানন্দের প্রিয় প্রসঙ্গ। এইখান থেকে মাঘ সংক্রান্তির রাতে উত্তরণের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু এই উত্তরণের প্রস্তুতির দিকে জীবনানন্দের তেমন দৃষ্টি ছিল না। দ্বিরক্তির আশংকা মেনে নিয়েও একথা আর একবার বলা দরকার 'সুচেতনা' জীবনানন্দের কবিজীবনের সন্ধিলগ্নে লিখিত কবিতা। এইখানে আর সেই বিপন্ন বিস্ময়ের কথা নেই যা আমাদের ক্লান্ত করে। অন্য এক বিস্ময়ের কথা আছে, যা আমাদের মূক করে রাখে। তবু সে বিস্ময়কে উপেক্ষা করেই চারিদিকে রক্ত-ক্লান্ত কাজের আহবান। কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতার কথা জীবনানন্দ এর আগেই বলেছেন। কিন্তু 'সুচেতনা' কবিতায় দেখা গেল ওই বিবর্ণতাই সব কথা নয়। এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে-এই দূর শতাব্দীমুখী এক অসংহত ভবিষ্য-বিশ্বাসও এই কবিতায় প্রথম দেখা গেল। 'সূর্যোদয়' কথাটিকে এর আগে এমন করে জীবনানন্দ আর কখনও উচ্চারণ করেননি, যেমন করলেন সুচেতনায়। 'সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে'-এ অনুভূতি এবার বিদায় নিল।
তথাপি এই কবিতাতেই আমরা উপলব্ধি করি যে জীবনানন্দ তাঁর আবেগময় বিশ্বাসের সব ফাঁকটুকু মননের সাহায্যেও ভরাট করতে পারছেন না। যেই তিনি কর্মনিষ্ঠ মানবতার সূর্যের সঙ্গে নক্ষত্ররূপা নারীপ্রেমের মিলিত আশ্বাসকে খুঁজতে যান, তখনই তাঁকে বর্তমানের প্রসঙ্গকে অপরিহার্য বলে মেনে নিতে হয়। ঠিক সেই মুহূর্তেই তাঁর সেই সুদূর অতীতের ব্যঞ্জনাসঞ্চারী ভাষার ভূমিকা পঙ্গু হয়ে পড়ে। তখনই তাঁর ভাষার শৈল্পিক অস্বাচ্ছন্দ্য দেখে আমরা ব্যথিত হই। জীবনানন্দের বাগভঙ্গিতে যে ত্রুটি ক্ষীণভাবে বরাবর বিদ্যমান তা অসতর্কতায় প্রক্ষয় পেয়ে এবারে প্রকট হয়ে উঠল। দীর্ঘায়িত বাক্য কথ্যছন্দ, ভাবছন্দের সীমা ছাড়ালো। 'প্রয়াণ পটভূমি' কবিতার নবম পংক্তি থেকে সপ্তদশ পংক্তি এর একটি সাধারণ প্রমাণ বলে উপস্থাপিত করা চলে। জীবনের যে বিস্তৃতির দিকটি কবি কোনওদিন দেখেননি - মানুষের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে গিয়ে সেই বিস্তৃত জীবনের কথাই তাঁর মনে পড়েছে। কিন্তু এই বিস্তৃতিকে আয়ত্ত করতে গেলে তাঁর দরকার ছিল নতুন করে টেকনিকের রহস্য মোচন। দুর্ঘটনা তাঁকে সেই সময় দেয়নি।
জীবনানন্দ তাঁর সাফল্যের ভিতর দিয়ে মানুষকে শিখিয়েছেন ভালোবাসা। আর তাঁর ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে শিল্পীকে শিখিয়েছেন থীম অথবা আঙ্গিক এককভাবে এর কোনওটাই যেন শিল্পীর কাছে চরম বা absolute না হয়।
প্রথম প্রকাশ
৪র্থ বর্ষ ৫-৬ সংখ্যা
(শারদীয় ১৩৭৩)
No comments:
Post a Comment