‘বাংলা ভাষার সূর্য অস্ত যায় না’ | সেলিনা হোসেন | রবিবারের প্রবন্ধ ৩

‘বাংলা ভাষার সূর্য অস্ত যায় না’
সেলিনা হোসেন

আমার এই লেখার শিরোনামটি আমার নয়। আমার শ্রদ্ধেয় এবং প্রিয় মানুষ তাঁর একটি বক্তৃতার এই শিরোনামটি ব্যবহার করেছেন। বাংলা একাডেমীতে চাকরি করার সময় তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, এখন থেকে কুড়ি বছর আগে, বাংলা একাডেমী থেকে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। তাঁর অনুসন্ধিৎসার বিচিত্র বিষয় আমাকে আকৃষ্ট করে। তিনি বিচারপতি মুহাহম্মদ হাবিবুর রহমান।

এই শিরোনামটি আমাকে ভাবায়। আমার মনে হয়েছে শিরোনামটির নানা দিক আছে। ভাষার সূর্য অবশ্যই অস্ত যাবে না—অস্ত গেলে বাঙালি হারাবে তার গৌরব এবং অহংকারের ইতিহাস। কিন্তু ভাষার নানা অনুষঙ্গ থাকে—সে অনুষঙ্গ আধিপত্য বিস্তার করে অন্যের ওপর। ব্যক্তি ভাষার সেইসব অনুষঙ্গ, বুঝে অথবা না বুঝে, তাকে স্থায়ী করে ফেলে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। সেজন্য আমরা চাই ভাষার আধিপত্য বিস্তারকারী অনুষঙ্গের যে সূর্য তাকে অবশ্যই অস্ত যেতে হবে। অস্ত যাওয়ার প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে বাংলা ভাষার প্রতিরোধের দিকটির দু-একটা অনুষঙ্গ তুলে ধরে দেখাতে চাই কিভাবে ভাষার সূর্যটি টিকে থাকল।



বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। ভুসুকু চর্যাপদের কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন। তাঁর একটি পঙ্ক্তি এমন : ‘আজই ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী।’ অর্থাৎ আজ ভুসুকু বাঙালি হলো। একজন কবি নিজ জাতিসত্তার পরিচয় ধরে রাখার জন্য উচ্চারণ করেছিলেন এমন অবিনাশী পঙ্ক্তি। একই সঙ্গে মনে হয়েছে এই পঙ্ক্তির ভেতরে দ্রোহ এবং প্রতিরোধের ভাষাও আছে। নিজের জাতিসত্তার অস্তিত্ব সমুন্নত রাখার জন্য কবি তার ভাষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এমন প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করতে হলো তাঁকে? নিশ্চয়ই সেই সময়ে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল যার জন্য ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কবি। আঘাত এসেছিল এবং প্রতিরোধের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। এসবই গবেষণার বিষয়। আজ আর জানার উপায় নেই। কিন্তু সে সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা এই যে কবি ভুসুকুরা লড়াইয়ে জিতেছিলেন সেই অষ্টম শতাব্দীতে, তাই তাদের ভাষার সূর্য অস্তমিত হয়নি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে তাই আমাদের একজন মনীষী সগৌরবে বলতে পারছেন যে ‘বাংলা ভাষার সূর্য অস্ত যায় না’।

লড়াই আরো আছে।

সপ্তদশ শতকে ধর্মীয় গ্রন্থ বাংলা ভাষায় লেখা হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। একশ্রেণীর লোক ধর্মগ্রন্থ বাংলা ভাষায় লেখার ঘোর বিরুদ্ধাচারণ করেন। বিরোধিতাকারীরা বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সুতরাং হিন্দুর ভাষা দিয়ে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ রচিত হতে পারে। সে সময়ের কবি সৈয়দ সুলতান, কবি আবদুল হাকিম এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং যুক্তি দিয়ে তা খণ্ডন করেন। সৈয়দ সুলতান বিরুদ্ধকারীদের ‘মুনাফিক’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন :

যে সবে আপনা বোল না পারে বুজিতে।

পাঁচালি রচিলাম করি আছ এ দুসিতে॥

মুনাফিক বলে আমি কিতাবেতে কাড়ি।

কিতাবেত কাড়ি দিলুম হিন্দুয়ানী করি॥

আল্লা এ বোলিছে মুঞি যে দেশে যে ভাষ

সে দেশে সে ভাষে কৈলুম রছুল প্রকাশ॥

অতএব নিজের ভাষায় রসুলের উপর বই লিখতে তিনি ভয় পাননি। তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘ওফাতে রসুল।’ ধর্মগ্রন্থ বাংলায় লেখা যাবে না এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন কবি আবদুল হাকিম। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের মতে আবদুল হাকিমের বাড়ি ছিল নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত সন্দ্বীপের সুধারামে। তাঁরা মনে করেন তাঁর সময়কাল ১৬২০-১৬৯০ খ্রিস্টাব্দ। আবদুল হাকিম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বিভিন্ন ভাষায় যখন বিভিন্ন পয়গাম্বরদিগের নিকট তাঁহাদের কিতাব অবতীর্ণ হইয়াছে, আমাদের বাংলা ভাষায় ধর্মগ্রন্থ লিখিলে কেন দোষ হইবে? আল্লাহতালা তো সকল ভাষা বুঝেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘গ্রন্থপাঠের প্রথম উদ্দেশ্য হইতেছে আল্লাহর আদেশ পালন করা। আরবী পড়িয়া যদি কোন ব্যক্তি ধর্মভাবে প্রণোদিত না হয় বা ধর্মাদেশ পালন না করে তবে এই আরবী কিতাব পাঠের সার্থকতা কোথায়?’ বাংলা ভাষায় ধর্মীয় গ্রন্থ কম বলে তিনি আক্ষেপ করেছেন। শেষ পর্যন্ত যারা বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে তাদের বিরুদ্ধে কটূক্তি করতে দ্বিধা করেননি। লিখেছেন :

যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥

দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়া এ।

নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে না জাত্র॥

মাতা পিতাসহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।

দেশী ভাষা উপদেশ মন হিত অতি॥

না বুঝি আরবী বাক্য না চিনি অক্ষর।

তে কাজে আশ্বাস মনে ভাবি বহুতর॥

নিজ দেশী ভাষা করি গৃহতে সকল।

আমি সব আগে কর সঙ্কট কুশল॥

আবদুল হাকিমের এই বইটির নাম ‘নূরনামা’। এই বইয়ে তিনি হজরত মুহম্মদ (স.)-এর নূর সৃষ্টির বর্ণনা দিয়েছেন। যাঁরা ধর্মের পবিত্র বাণীকে বিদেশী ভাষা থেকে ছাড়িয়ে এনে নিজের ভাষায় রূপায়িত করেছে তারাই তো সত্যিকারের সৈনিক। নিজ ভাষার সূর্যকে অস্তমিত হতে দেয়নি। ভাষার বিরোধিতাকারীদের যাঁতাকলে স্তব্ধ হয়ে থাকতে দেয়নি নিজেদের সৃজনশীলতাকে। তাঁদের অবিনাশী পঙ্ক্তিমালা আমাদের সামনে সূর্যরশ্মির মতো জ্বলজ্বল করে। তবে বিরোধিতাকারীরা টিকে আছে ভিন্ন খোলসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আবাসিক এলাকার দেয়ালে লেখা আছে, ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।’ একবিংশ শতাব্দীতে এখনো এসব কথা বলতে হচ্ছে। কেননা মৌলবাদের থাবা ক্রমাগত গ্রাস করতে চাইছে এই দেশ। কারণ ধর্মের নামে নিপীড়িত, নিগৃহীত হচ্ছে এ দেশের মানুষ। নিপীড়িত হচ্ছে নারীসমাজ। মৌলবাদীরা ধর্ম যার যার এটা মানতে রাজি নয়। একতরফাভাবে নিপীড়ন করছে আহমদিয়াদের, নিপীড়ন করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের। এর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এই ভাষার সূর্যকে ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো কিভাবে? রাষ্ট্রের ক্ষমতাধররা যে এই ভাষা বুঝতে চায় না। ভাষার সূর্য মাথার ওপর থাকলেই হবে না, সেই ভাষার শক্তিকে বাস্তবে রূপায়িত করার মানুষ চাই।



এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে ‘বাংলা ভাই’ নামে সম্বোধন করে দেশবাসী। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে দেশের সাধারণ মানুষ এই শব্দ দুটি অবলীলায় ব্যবহার করে। প্রবল মর্মযাতনা পীড়িত করে আমাকে। ‘বাংলা’ কোনো সাধারণ শব্দ নয় আমাদের জীবনে। এর অন্তরালে প্রবল শক্তি নানা অভিধা নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় সমুন্নত করার জন্য রাজপথে জীবন দিয়েছিল আমাদের তরুণরা। এই গৌরবের ইতিহাস বাংলাদেশ রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা সূচিত করেছিল। এত যার গৌরব সে শব্দ কেন একটি সন্ত্রাসীর নাম হবে? আমরাই বা কেন অহরহ উচ্চারণ করে যাচ্ছি? কেন প্রতিবাদ করছি না? ‘ভাই’ একটি গভীর অর্থব্যঞ্জক শব্দ। এটি শুধুই মায়ের পেটের ভাইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ভাই দিয়ে তৈরি হয় নারী-পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক। শব্দটি স্নেহের ভালোবাসার, শ্রদ্ধার শব্দ। এটিও সন্ত্রাসীর দখলে চলে গেছে। ভাষার সূর্যকে এভাবে কালিমালিপ্ত করা হলে কুঁকড়ে আসে অস্তিত্ব। মুছে যেতে চায় ভাষার ইতিহাস। কত প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মুখে ভাষা তার আপন সত্তা উজ্জ্বল রাখে সে ইতিহাস তো সবার জানা। তাই বলছিলাম গণমাধ্যমের দায়িত্বে কথা। বিশেষ করে মুদ্রণ গণমাধ্যম পারে ভাষার যথাযথ ব্যবহার পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। বদলাতে পারে ভাষার ওজন।

ভাষার আধিপত্য সবচেয়ে বেশি দমন করেছে নারীকে। এমন অনেক শব্দ আছে যার কোনো পুংলিঙ্গ নেই। যেমন ‘সতী’। এমন অনেক শব্দ আছে যেটি পুংলিঙ্গে একরকম অর্থ বহন করে, স্ত্রীলিঙ্গে অন্যরকম। যেমন ‘একেশ্বর’। ভাষা পুরুষের ক্ষমতা, দম্ভ, গৌরব, অহংকারকে যত দৃঢ়ভাবে প্রচার করেছে নারীর বেলায় তার একভাগও করেনি। নারীর প্রতি প্রযোজ্য ভালো অর্থের শব্দ গালিতে রূপান্তরিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। যেমন ‘মাগী’। মা অর্থ জননী, মাতা। ‘গী’ অর্থ বাক্য, বচন, জ্ঞান, বেদ, সরস্বতী। কিন্তু এখন প্রবল উচ্চারণে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভাষার সূর্যকে অস্ত যেতে দেয়নি সেই ভাষার মানুষ। আবহমানকাল ধরে নারীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে নিজের রচিত গান, গল্প, ছড়া, প্রবাদ, প্রবচন ইত্যাদি। যা সমৃদ্ধ করেছে ভাষাকে। কিন্তু নারীর ওই অবদান অনেক ক্ষেত্রে অদৃশ্য করেছে পুরুষ। ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে নিজের পক্ষে।

‘সম্প্রতি দাতাগোষ্ঠীর সহযোগিতায় বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডসের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলা কর্মসূচি চলছে। এই বিষয়ে একটি গানের কয়েকটি পঙ্ক্তি শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। আমি গানটি স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত করছি। দু-একটা শব্দ ভুলও হতে পারে আগেই স্বীকার করছি। গানটি এমন :

ওরে সরল ছেলেটারে

ঢাকায় আইসা এইচআইভি বাঘে খাইলরে

কামিনী ছলনায় ভুলিয়া

এইচআইভির বাঘে খাইলরে...

কিন্তু অদ্ভুত ভাষার ব্যবহার। ছেলেটা সরল, মেয়েটা ছলনাময়ী। তাই তাকে এইচআইভির বাঘে খায়। ঢাকায় এসেই ছেলেটি পতিতালয়ে যাওয়ার রাস্তা চিনে ফেলে। পতিতালয়ে তৈরি হয় প্রথমত পুরুষের প্রয়োজনে, দ্বিতীয়ত উপায়হীন নারী বেঁচে থাকার তাগাদায় সেখানে আশ্রয় খোঁজে। বিক্রি করে শরীর। গানের সরল ছেলেটি এতই সরল যে তাতে কামিনীর ছলনা বাঘের মুখে তুলে দেয়, কিন্তু সে কনডম ব্যবহার করতে শেখে না। এভাবে ভাষা ব্যবহার করে এইচআইভি সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা যদি হয় তাহলে সচেতনতার কর্মসূচি যে লাটে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই। এভাবে যে কোনো অসুস্থ ধারণাকে অনবরত বলার মধ্য দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় নেতিবাচক শক্তি। ভাষার যে ক্ষুদ্র অংশ জীবনের পক্ষে কাজ করে না তার অস্ত যাওয়াই উচিত। জীবন নারীর একার নয়, নারীর সঙ্গে পুরুষের—যারা সৃষ্টি করে আগামী প্রজন্ম। এই প্রজন্মকে ভাষা বিষয়ে তৈরি করার জন্য ‘প্রথম আলো’ একটি উদ্যোগ নিয়েছে। এদেরকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

কত হাজার বছর আগে জানি না, মহীয়সী খনা তাঁর একটি বচনে বলেছিলেন : ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।’ অর্থাৎ মাঘ মাসের শেষে বৃষ্টি হলে ফসল ভালো হয়। সেই রাজাই পুণ্যবান এবং সেই দেশই ধন্য যারা তার প্রজাদের পেটভরা ভাত দিতে পারে। ভাষার এমন অবিনাশী পঙ্ক্তির সূর্য কোনোদিন যেন অস্তমিত না হয় এই প্রার্থনা, আজকের বাংলাদেশের মানুষের।

০৬-০৯-১৯৯৪

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট