একজন মমতাময়ী লেখকের তাঁর প্রিয় কবিকে নিয়ে স্মৃতিচারণ।
কবি আহসান হাবীব শেষ দেখা
হুমায়ূন আহমেদ
অসুস্থ কবিকে দেখতে গেলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তারিখ ৯ই জুলাই-তার মৃত্যুর আগের দিন। আমি, নির্মলেন্দু গুণ এবং সালেহ চৌধুরী। ঢুকবার মুখেই বাধা। একজন রুগী মারা গেছে। তার মেয়ে কিংবা তার স্ত্রী আকাশ ফাটিয়ে কাঁদছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেলাে।
ওয়ার্ডে ঢুকে দেখি সারি সারি রুগীর মাঝখানে হাবীব ভাই। গেঞ্জি গায়ে বিছানায় পড়ে আছেন। শিশুর মত লাগছে তাকে। মাথার কাছে তাঁর ছেলে মইনুল আহসান মুখ কালাে করে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত পরিবেশটিই মনের উপর চাপ তৈরি করে। দেশের একজন সেরা কবির জন্যে এমন দীন ব্যবস্থা কেন? মইনুল আহসান বললাে-“এটাই ভাল ব্যবস্থা। চোখের সামনে একজন ডাক্তার সব সময় থাকেন। হবে হয়তাে। আমি অবশ্যি আশা করেছিলাম অসুস্থ কবির শয্যাটি হবে অন্য রকম। একটু আলাদা।
হাবীব ভাইয়ের মাথার কাছে একটা চার্ট ঝুলছে। সেখানে ইংরেজিতে লেখা-পােয়েট আহসান হাবীব। তার জন্যে মিকশ্চারের একটি বােতল এলাে; সেখানেও লেখা-পােয়েট আহসান হাবীব। দেখতে ভালই লাগলাে। হাসপাতাল মনে রেখেছে এই রুগী একজন কবি।
মইনুল আহসান বললাে-“আব্বার তেমন কোন অসুবিধা নেই। তার জন্যে আগামীকাল মেডিক্যাল বাের্ড বসবে।” বুঝতে পারছি সে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সে কি বুঝতে পারছে সময় ফুরিয়ে আসছে?
সালেহ চৌধুরী এবং নির্মলেন্দু গুণ কবির পায়ে পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ছােটখাটো কথাবার্তা হতে থাকলাে।
তিনি জানালেন, তাঁর শরীর ভালই আছে। কিন্তু কিছু খেতে পারছেন না। কিছুই হজম হয় না। এছাড়া, আর অন্য কোন অসুবিধা নেই। তিনি গেঞ্জি টেনে পেট অনেকখানি উদাম করে ফেললেন। নির্মলেন্দু গুণ পেটে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এক সময় বললেন-‘হাবীব ভাই, টিভিতে আপনার ইন্টারভুটা দেখলাম, খুব ভাল হয়েছে।' হাবীব ভাই হাসলেন। আমার মনে হলাে, হাবীব ভাই তাে ভালই আছেন। কথাবার্তা অবশ্যি বলছেন নিচু স্বরে। এবং বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করলাম ফিসফিস করে নিজের মনে কি যেন বলছেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যখন কথা বলছেন, তখন (কণ্ঠ কিছুটা জড়ানাে হলেও) চিন্তার কোন অসংলগ্নতা নেই। এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-‘তােমার বইয়ের সংখ্যা কত?' একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষ, যার সেই মুহূর্তে নিজেকে নিয়েই চিন্তা করার কথা, তিনি অন্যের প্রসঙ্গে কীভাবে এতটা আগ্রহ রাখেন কে জানে?
একটি ছেলে তার জন্যে লাল মিকশ্চারের একটি বােতল নিয়ে এলাে। হাবীব ভাইকে পেছনে বালিশ দিয়ে বসানাে হলাে। তিনি বললেন, তাঁর ক্ষিধে পেয়েছে। সােয়াপ্রােটিন বিসকিট সম্পর্কে দুই একটা কথা বললেন। লক্ষ্য করলাম তিনি আমরা কি কথাবার্তা বলছি সেগুলি খুব মন দিয়ে শুনতে চেষ্টা করছেন। মাঝে মাঝে ধরতে পারছেন না। তখন জিজ্ঞেস করছেন-‘সালেহ কী বললাে? নির্মলেন্দু কী বললাে?'
হাবীব ভাইয়ের সহকারী তরুণ কবি নাসির আহমেদকে দেখলাম সারাক্ষণই কবির সেবা করবার সুযােগ খুঁজছেন। কখনাে পায়ে হাত বুলাচ্ছেন, কখনাে গায়ে হাত বুলচ্ছেন। কি গভীর ভালবাসা তার চোখেমুখে। তাতাে হবেই হাত ধরে এদের কবিতার অলিগলি চিনিয়েছেন, এসেছেন ঋণ শােধ করতে।
একটি মেয়ে এলাে কবিকে দেখতে। হাবীব ভাই ক্ষীণকণ্ঠে তার খোঁজ-খবর করলেন। মেয়েটিকে মনে হলাে সে কেঁদে ফেলবে। গল্পকার ভাস্কর চৌধুরী এলেন। তাঁর গায়ে ইউএসএ ছাপ মারা ঝলমলে টি-শার্ট, কিন্তু মুখটি বিষন্ন।
আমরা সবাই তাকে ঘিরে বসে রইলাম। ছােটখাটো কথা বলতে লাগলাম নিজেদের মধ্যে। হাবীব ভাই বসে আছেন বালিশে হেলান দিয়ে। তার মাথা ভর্তি শরতের মেঘের মত ধবধবে সাদা চুল। হাবীব ভাইকে লাগছে প্রাচীন কালের ঋষিদের মত। একটু দূরে বসে থাকা নার্স বার বার কৌতুহলী হয়ে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে।
আমরা প্রায় দেড় ঘন্টার মত থাকলাম তাঁর সঙ্গে। আমার খুব ইচ্ছা করছিলাে তার পা ছুয়ে সালাম করি। কিন্তু তিনি যদি মনে করেন। আমি তাকে শেষ বিদায় জানাচ্ছি, সেই ভয়েই ওদিকে গেলাম না। বললাম-হাবীব ভাই, হাসপাতালের পরিবেশটা আমার ভাল লাগছে না। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন বাড়ি চলে যান।'
হাবীব ভাই মৃদুস্বরে বললেন-“হ্যা, ফিরে যাব। আমার বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে।”
কবির বাড়ি ফেরা হয়নি। কিংবা কে জানে হয়তাে ফিরেছেন। আঁধার বাড়ির কোন রহস্যইতাে আমাদের জানা নেই।
প্রাপ্তি:
কিছু হুমায়ূন (হুমায়ূন আহমেদের অগ্রন্থিত গদ্য ও পত্রগুচ্ছ) (হার্ডকভার) - পিয়াস মজিদ
প্রকাশকাল: ২০১৯
প্রকাশক: অন্বেষা
কবি আহসান হাবীব শেষ দেখা
হুমায়ূন আহমেদ
অসুস্থ কবিকে দেখতে গেলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তারিখ ৯ই জুলাই-তার মৃত্যুর আগের দিন। আমি, নির্মলেন্দু গুণ এবং সালেহ চৌধুরী। ঢুকবার মুখেই বাধা। একজন রুগী মারা গেছে। তার মেয়ে কিংবা তার স্ত্রী আকাশ ফাটিয়ে কাঁদছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেলাে।
ওয়ার্ডে ঢুকে দেখি সারি সারি রুগীর মাঝখানে হাবীব ভাই। গেঞ্জি গায়ে বিছানায় পড়ে আছেন। শিশুর মত লাগছে তাকে। মাথার কাছে তাঁর ছেলে মইনুল আহসান মুখ কালাে করে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত পরিবেশটিই মনের উপর চাপ তৈরি করে। দেশের একজন সেরা কবির জন্যে এমন দীন ব্যবস্থা কেন? মইনুল আহসান বললাে-“এটাই ভাল ব্যবস্থা। চোখের সামনে একজন ডাক্তার সব সময় থাকেন। হবে হয়তাে। আমি অবশ্যি আশা করেছিলাম অসুস্থ কবির শয্যাটি হবে অন্য রকম। একটু আলাদা।
হাবীব ভাইয়ের মাথার কাছে একটা চার্ট ঝুলছে। সেখানে ইংরেজিতে লেখা-পােয়েট আহসান হাবীব। তার জন্যে মিকশ্চারের একটি বােতল এলাে; সেখানেও লেখা-পােয়েট আহসান হাবীব। দেখতে ভালই লাগলাে। হাসপাতাল মনে রেখেছে এই রুগী একজন কবি।
মইনুল আহসান বললাে-“আব্বার তেমন কোন অসুবিধা নেই। তার জন্যে আগামীকাল মেডিক্যাল বাের্ড বসবে।” বুঝতে পারছি সে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সে কি বুঝতে পারছে সময় ফুরিয়ে আসছে?
সালেহ চৌধুরী এবং নির্মলেন্দু গুণ কবির পায়ে পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ছােটখাটো কথাবার্তা হতে থাকলাে।
তিনি জানালেন, তাঁর শরীর ভালই আছে। কিন্তু কিছু খেতে পারছেন না। কিছুই হজম হয় না। এছাড়া, আর অন্য কোন অসুবিধা নেই। তিনি গেঞ্জি টেনে পেট অনেকখানি উদাম করে ফেললেন। নির্মলেন্দু গুণ পেটে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এক সময় বললেন-‘হাবীব ভাই, টিভিতে আপনার ইন্টারভুটা দেখলাম, খুব ভাল হয়েছে।' হাবীব ভাই হাসলেন। আমার মনে হলাে, হাবীব ভাই তাে ভালই আছেন। কথাবার্তা অবশ্যি বলছেন নিচু স্বরে। এবং বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করলাম ফিসফিস করে নিজের মনে কি যেন বলছেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যখন কথা বলছেন, তখন (কণ্ঠ কিছুটা জড়ানাে হলেও) চিন্তার কোন অসংলগ্নতা নেই। এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-‘তােমার বইয়ের সংখ্যা কত?' একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষ, যার সেই মুহূর্তে নিজেকে নিয়েই চিন্তা করার কথা, তিনি অন্যের প্রসঙ্গে কীভাবে এতটা আগ্রহ রাখেন কে জানে?
একটি ছেলে তার জন্যে লাল মিকশ্চারের একটি বােতল নিয়ে এলাে। হাবীব ভাইকে পেছনে বালিশ দিয়ে বসানাে হলাে। তিনি বললেন, তাঁর ক্ষিধে পেয়েছে। সােয়াপ্রােটিন বিসকিট সম্পর্কে দুই একটা কথা বললেন। লক্ষ্য করলাম তিনি আমরা কি কথাবার্তা বলছি সেগুলি খুব মন দিয়ে শুনতে চেষ্টা করছেন। মাঝে মাঝে ধরতে পারছেন না। তখন জিজ্ঞেস করছেন-‘সালেহ কী বললাে? নির্মলেন্দু কী বললাে?'
হাবীব ভাইয়ের সহকারী তরুণ কবি নাসির আহমেদকে দেখলাম সারাক্ষণই কবির সেবা করবার সুযােগ খুঁজছেন। কখনাে পায়ে হাত বুলাচ্ছেন, কখনাে গায়ে হাত বুলচ্ছেন। কি গভীর ভালবাসা তার চোখেমুখে। তাতাে হবেই হাত ধরে এদের কবিতার অলিগলি চিনিয়েছেন, এসেছেন ঋণ শােধ করতে।
একটি মেয়ে এলাে কবিকে দেখতে। হাবীব ভাই ক্ষীণকণ্ঠে তার খোঁজ-খবর করলেন। মেয়েটিকে মনে হলাে সে কেঁদে ফেলবে। গল্পকার ভাস্কর চৌধুরী এলেন। তাঁর গায়ে ইউএসএ ছাপ মারা ঝলমলে টি-শার্ট, কিন্তু মুখটি বিষন্ন।
আমরা সবাই তাকে ঘিরে বসে রইলাম। ছােটখাটো কথা বলতে লাগলাম নিজেদের মধ্যে। হাবীব ভাই বসে আছেন বালিশে হেলান দিয়ে। তার মাথা ভর্তি শরতের মেঘের মত ধবধবে সাদা চুল। হাবীব ভাইকে লাগছে প্রাচীন কালের ঋষিদের মত। একটু দূরে বসে থাকা নার্স বার বার কৌতুহলী হয়ে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে।
আমরা প্রায় দেড় ঘন্টার মত থাকলাম তাঁর সঙ্গে। আমার খুব ইচ্ছা করছিলাে তার পা ছুয়ে সালাম করি। কিন্তু তিনি যদি মনে করেন। আমি তাকে শেষ বিদায় জানাচ্ছি, সেই ভয়েই ওদিকে গেলাম না। বললাম-হাবীব ভাই, হাসপাতালের পরিবেশটা আমার ভাল লাগছে না। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন বাড়ি চলে যান।'
হাবীব ভাই মৃদুস্বরে বললেন-“হ্যা, ফিরে যাব। আমার বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে।”
কবির বাড়ি ফেরা হয়নি। কিংবা কে জানে হয়তাে ফিরেছেন। আঁধার বাড়ির কোন রহস্যইতাে আমাদের জানা নেই।
প্রাপ্তি:
কিছু হুমায়ূন (হুমায়ূন আহমেদের অগ্রন্থিত গদ্য ও পত্রগুচ্ছ) (হার্ডকভার) - পিয়াস মজিদ
প্রকাশকাল: ২০১৯
প্রকাশক: অন্বেষা
No comments:
Post a Comment