হৃদয়ে কবির জীবন
শাহাদুজ্জামানের ‘একজন কমলালেবু’ আলোচনা লিখেছেন প্রচেত গুপ্ত
নীচের উদ্ধৃতিটি একটু দীর্ঘ হলেও এড়াতে পারছি না। বইটি নিয়ে কিছু কথা বলতে গেলে এটির প্রয়ােজন। উদ্ধৃতিটি নেওয়া হল একেবারে প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম বাক্য থেকে। যাতে গােড়াতেই বই সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়।
“পুরােনাে শতাব্দীর ধুলােমাখা একটা সরীসৃপের মতাে কলকাতা বালিগঞ্জ ডাউন ট্রাম ঘন ঘন ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দিকে। চারদিকে তখন শেষ বিকেলের রােদ। ‘জলখাবার’ দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে বসে চুনীলাল দেখলেন একজন লােক হেঁটে যাচ্ছেন ওই ট্রামের দিকেই। ট্রাম এগিয়ে আসছে, সেই লােকও এগিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম লাইনের দিকে। ট্রামের ড্রাইভার জোরে জোরে ঘণ্টা বাজালেন, চিৎকার করে ডাকলেন, তবু সে লােক উঠে গেলেন ট্রাম লাইনের ওপরে এবং আটকে গেলেন ট্রামের ক্যাচারে। সশব্দে ব্রেক কষল ট্রাম। চুনীলাল দৌড়ে গিয়ে ট্রামের ক্যাচারের ভেতর থেকে টেনে বের করে আনলেন মানুষটাকে। লােকজনে ভিড় জমে গেল, তারা জানতে চাইল, ‘কী নাম আপনার, কোথায় থাকেন?’ তারা কেউ জানে না যে এই লােক একদিন লিখেছেন:
কলকাতার ফুটপাত থেকে ফুটপাতে— ফুটপাত থেকে ফুটপাতে—/ কয়েকটি আদিম সপিনী সহােদরার মতাে এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে... (কবিতাটির আরও বেশ কয়েকটি লাইন রয়েছে। এখানে দেওয়া হল না।)
রক্তাক্ত সেই লােক বললেন, “আমার নাম জীবনানন্দ দাশ, ওই ল্যান্সডাউন রােডে থাকি, ১৮৩ নম্বর বাড়ি। এইটুকু বলে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না, এলিয়ে পড়লেন রাস্তায়। লােকজন তাঁকে ধরাধরি করে একটা ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিয়ে গেল কাছের শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।” পরিচ্ছেদটি ধরে এবার শেষের দিকে এগােই:
“কয়েকটি দিন আশা-নিরাশার দোলাচলে থাকবার পর ওই ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের নানা রকম রােগীর গােঙানাের প্রেক্ষাপটে, ওই রং ওঠা লােহার খাটে মৃত্যুবরণ করেন জীবনানন্দ। ট্রামের মতাে এমন একটা স্লো মুভিং লােকোমােটিভকে এড়িয়ে যাবার টনক মানুষের থাকার কথা। ট্রামের ক্যাচার তৈরি হয়েছিল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পশু তাড়াবার জন্য। কিন্তু জীবনানন্দ সম্ভবত ট্রামের ক্যাচারে আটকে যাওয়া প্রথম এবং শেষ মানুষ। ফলে আদিম সাপের মতাে ছড়িয়ে থাকা ট্রামের চাকার নিচে তাঁর মৃত্যু নিয়ে জট থেকে যায়। প্রশ্ন জাগে, এটা কি একটা দুর্ঘটনা?
নাকি তিনি ট্রামের চাকার নিচে আত্মহত্যা করেছেন?
অথবা এটা কি আসলে একটা হত্যাকাণ্ড, যার পেছনে রয়েছে আরও অনেকের অদৃশ্য। হাত?”
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে এইভাবে যে লেখা শুরু হয় তাকে কি এড়ানাে যায়? হয়তাে যায়, আমি পারিনি। বইটি আমার হাতে হাত রেখেছে কি না জানি না, তবে আমি রেখেছি। রেখে কখনও উৎফুল্ল হয়েছি, কখনও বিষন্ন। কখনও রেগে গিয়েছি, কখনও লেগেছে ঘাের। একই পাঠে আনন্দ ও বেদনা অনুভব করেছি। কোনও ঘটনা পড়ে মনখারাপ হয়েছে, আবার পরক্ষণেই বুঝতে পেরেছি, এই মনখারাপ আসলে জীবনের কোনও অমােঘ রূপ-রং মেশানাে সৃষ্টির প্রেরণা। এই মনখারাপ এমন সব কবিতার জন্ম দিয়েছে, যাদের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিতাদের সঙ্গে বসানাে গেছে এক পঙক্তিতে। তখনই আবার মন ভাল হয়ে গেছে। একই সঙ্গে মন ভাল এবং মনখারাপ এক বিরল আনন্দ অভিজ্ঞতা। খুব কম লেখা পড়েই এই আনন্দ পাওয়া যায়। ‘একজন কমলালেবু' বইটি সেই আনন্দ আমাকে দিয়েছে।
হ্যাঁ, এই বইয়ের নাম ‘একজন কমলালেবু'। লেখকের নাম শাহাদুজ্জামান। প্রকাশক বাংলাদেশের প্রথমা প্রকাশন। প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে। জীবনানন্দের নিজের এবং তাঁকে নিয়ে পণ্ডিতদের লেখা আরও কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের পাশে এই বইকে আমি যত্নে এবং আদরে স্থান দিয়েছি।
বইটির কথা আমি বেশ কিছুদিন আগেই শুনেছিলাম। শুনেছিলাম, বাংলাদেশের বিশিষ্ট গদ্যকার শাহাদুজ্জামান জীবনানন্দকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। তবে এই বঙ্গের কবি, গবেষক, সাহিত্য আলােচকদের মুখে বা লেখালিখিতে বইটির উল্লেখ দেখিনি, থাকলেও চোখে পড়ার মতাে উচ্চকিতভাবে কিছু নয়। বইটি প্রচার পায় মূলত এ বঙ্গের সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে এবং ওপার বঙ্গের সােশ্যাল মিডিয়ার আলােচনায়। একেই জীবনানন্দের জীবন নিয়ে উপন্যাস, তার ওপর ওরকম চমৎকার নাম! আমার মনােযােগ কাড়ে। ‘কমলালেবু’ নামে জীবনানন্দের একটি কবিতা
আছে। ‘একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাবে। আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে / আবার যেন ফিরে আসি / কোনাে এক শীতের রাতে / একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস / নিয়ে কোনাে এক মুমূর্ষর বিছানার কিনারে।’ কবিতাটি সকলের জানা। কিন্তু ‘কমলালেবু'-র আগে ‘একজন’ শব্দটি বসিয়ে তাতে যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা যায়, তা জানা ছিল কি? অন্তত আমার তাে নয়ই। যেন আড়মােড়া ভেঙে কবি জেগে উঠলেন কবিতার ভিতর থেকে। যতই শুনে থাকি, কবিরে পাবে না ‘তাহার জীবনচরিতে’, এই বইটির নামে কবি এবং কবিতা এক হয়ে গেছে। কৌতূহল বেড়েছে। বইয়ের লেখক সম্পর্কেও আমার বিশেষ ধারণা ছিল না। আমি আগে তাঁর কোনও বই পড়িনি। জানলাম, উনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানুষ। আমেরিকার গ্লাসগাে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। একজন ‘জীবনানন্দ উন্মাদ’। কিশাের বয়স থেকেই জীবনানন্দে ‘ভূতগ্রস্ত’। ভদ্রলােক একটু ঘুরিয়ে বলেছেন, তিনি নাকি ঘাড় থেকে সেই ‘ভূত’টিকে নামানাের জন্যই বইটি লিখেছেন। জীবনানন্দের ‘ভূত’ লেখকের ঘাড় থেকে নেমেছে কি না জানি না, তবে এই বই পড়ার পর বহু পাঠকের ঘাড়ে যে ‘ভূত’টি চেপে বসেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
লেখার আগে লেখক দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এই ধরনের কাজে দীর্ঘ প্রস্তুতি স্বাভাবিক। দেখার কথা, সেই প্রস্তুতি, পরিশ্রম কাজে লাগল কি না। পণ্ডশ্রমের বহু উদাহরণই তাে রয়েছে। লেখক যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ, মনে প্রশ্ন জেগেছিল, উনি কি তবে কবির বরিশাল জীবনের অংশটিই বড় করে দেখিয়েছেন? এই উপন্যাসের নায়ক কি মূলত রূপসী বাংলার কবি? যাঁর জীবন সরল শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতির মতাে। পুকুরের জলে লাল সরের মতাে পড়ে থাকা করবীর কচি ডাল হয়ে শুধু ঝুঁকে পড়ে চুমু খেতে চায় মাছরাঙার পায়ে? নাকি কলকাতার জীর্ণ, ক্লিষ্ট, অভাব, অনটন ও অপমানের কথাও এতে থাকবে?
বইটির সন্ধান করি। ভ্রাতৃপ্রতিম একজন সংগ্রহ করে দেয়। এই সুযােগে তাকেও আর-একবার কৃতজ্ঞতা নয়, ভালবাসা জানিয়ে রাখি। যে একটা ভাল বই পড়ায়, বইটির মধ্যে সেও থেকে যায়। আমরা তাকে ভুলে গিয়ে অন্যায় করি। যাই হােক, একজন কমলালেবু পড়তে পড়তে যাবতীয় ভুল ধারণার অবসান ঘটে। ‘একজন কমলালেবু’-তে জীবনানন্দ দুই বাংলার। বরিশালের মায়াভরা প্রকৃতি, পরিবার, লেখাপড়া, অসমাপ্ত কর্মজীবন, সুখদুঃখ যেমন আছে, আছে কলকাতার কাঠিন্য, উদাসীনতা, যন্ত্রণা এবং বন্ধুদের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কাহিনিও। আছে তাঁকে আগলে রাখার কথা। কবি হিসেবে তাঁকে পরিচিত করার গল্প। এটি বইটির মস্ত গুণ। ‘একজন কমলালেবু'-কে কোনও একটা দিক থেকে, একপেশে চোখে দেখা হয়নি। তাঁকে দেখা হয়েছে সবদিক থেকে। কবির শৈশব, বাল্য থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘপথ। হতাশা, যন্ত্রণা, স্ত্রী, প্রেমিকা, ভালবাসা, অবজ্ঞা, চাকরি ও বেকার সময়ের কথা রয়েছে। আছে প্রকৃতিতে ডুবে থাকা এক মানুষের গল্প, অর্থাভাবে দীর্ণ হয়ে থাকার কাহিনি। আছে কবিতা লেখা, সেই কবিতা নিয়েই তীব্র উপেক্ষা, তীক্ষ সমালােচনা, গল্প উপন্যাস লিখে ট্রাঙ্কে লুকিয়ে ফেলা। আছে কর্মজীবন থেকে পালানাে, চারপাশ থেকে পালানাে, নিজের কাছ থেকে পালানাে। বটগাছের মতাে ছায়া নিয়ে আছেন বন্ধু বুদ্ধদেব বসু, ভূমেন্দ্র গুহ। বিশুদ্ধ, সিরিয়াস এক কবির টলমল, অনিশ্চিত, অন্ধকার জীবনের কথা প্রায় সবই রয়েছে এই বইয়ে। যে-জীবনের আদ্যোপান্ত, আদি-অন্ত শুধুই কবিতা আর কবিতা।
সব মিলিয়ে ২৪০ পৃষ্ঠার বই। হিসেবে এক-দু’পাতা কমবেশি হতে পারে। এই ২৪০ পাতা পড়া শেষ হলে বােঝা যায়, শাহাদুজ্জামান একটি বিস্ময়কর এবং প্রয়ােজনীয় কাজ করেছেন। কেন, সে প্রসঙ্গে আসছি, তবে গােড়ায় বলে রাখি, এ আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত মত। আমারই ভাল লাগা, আমারই মনে হওয়া। এই বিষয়ে কারও ভিন্নমত থাকতে পারে, নিশ্চয়ই আছে, সে বির্তক বা আলােচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। বইটির সঙ্গে অন্য কোনও বইয়ের তুলনা অর্থহীন। জীবনানন্দকে নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই লেখা হয়েছে। হয়েছে বিস্তর আলােচনা। এর পরেও আরও হবে। এই ধরনের মানুষকে নিয়ে চর্চা কখনও থেমে থাকে না। নানা ফর্মে হতেই থাকে। একজন কমলালেবু উপন্যাসটিও সেরকম। লেখক উপন্যাস শেষে ৫৬টি বই এবং পত্রপত্রিকার তালিকা দিয়েছেন। সেখানে জীবনানন্দের কবিতা, উপন্যাস, গল্প, ডায়েরি তাে আছেই, দুই বাংলার বিশিষ্ট প্রবন্ধকার, গবেষকরাও আছেন। লেখকের এক সাক্ষাৎকারে পড়লাম, বইটি লেখার আগে তিনি ঘুরে দেখেছেন কলকাতা এবং বরিশালের সেই সব জায়গা, যেসব জায়গায় কবি থাকতেন। গেছেন হাসপাতালেও। এতদিন পরে এসব জায়গা থেকে কী নতুন তথ্য পাবেন? বইটি পড়ে বুঝেছি, না তথ্য নয়, শাহাদুজ্জামান তাঁর উপন্যাসের নায়কের জীবনকে হৃদয়ের মধ্যে নিয়ে এগােতে চেষ্টা করছেন। হ্যাঁ, এই বইয়ে তথ্য অনেক, যা হয়তাে আগেই জানা, বহুচর্চিত, তারপরেও বলব, বইটির হৃদয় কোনও কোনও সময়ে বাইরের তথ্যকে ছাপিয়ে এগিয়ে গেছে অনেকদূর। বড় বড় চরিত্র নিয়ে বিশ্বে অজস্র গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। হয়ে চলেছে। বাংলাতেও সেই তালিকা দীর্ঘ। তালিকায় পৌরাণিক, ঐতিহাসিক চরিত্ররা যেমন আছেন, আছেন বিপ্লবী, শিল্পী, সাহিত্যিক। এমনকী, জীবনানন্দকে নিয়েও এই বঙ্গে উপন্যাস লেখা হয়েছে। দু’টির কথা এখনই মনে করতে পারছি। একটি সুরঞ্জন প্রামাণিকের লেখা ‘সােনালি ডানার চিল’, অন্যটি প্রদীপ দাশশর্মার ‘নীল হাওয়ার সমুদ্রে’। স্বাভাবিক ভাবেই শাহাদুজ্জামানের উপন্যাসটি পড়ার আগে একধরনের মানসিক প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু পড়তে গিয়ে সেই প্রস্তুতি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। তার বদলে এমন অনেক কিছু পেয়েছি, যা ছিল কল্পনার বাইরে। এখানে উপন্যাসের ফর্মকে উলটেপালটে দেওয়া হয়েছে। কখনও মনে হয়েছে এ উপন্যাস কোথায়! এ তাে জীবনী। যেখানে মূল চরিত্র শুধু নিজে নন, তাঁর মা বাবা স্ত্রী প্রেমিকা সকলেই স্বনামে উপস্থিত। কোনও আড়াল-আবডাল নেই। জীবনানন্দকে ‘জীবনানন্দ’ নামে লিখতে দ্বিধা করেননি লেখক। ৫৬টি বই এবং পত্রপত্রিকা থেকে তথ্যের পর তথ্য সাজিয়ে লেখা। যেমনটি জীবনীকাররা করে থাকেন। আবার পাতা উলটেই ধারণা বদলেছে। পাতা জোড়া কবিতা। ‘বােধ’, ‘আট বছর আগের একদিন’, ‘ক্যাম্পে।
তবে কবিতারই বই হল নাকি? আরও এগিয়ে বুঝেছি, না, তাও নয়। এ এক বিচ্ছিন্ন, বিধ্বস্ত, প্রতিভাবান একাকী মানুষের আপনকথা। ডায়েরির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা ব্যর্থতা, গ্লানি, অপমানের কথাই লেখা হয়েছে সাজিয়ে, পরম্পরা ধরে। তবে কি এটিও ভঙ্গি বদলে আত্মকথাই? ভুল ভেঙেছে আবার। যখন নানা মাত্রায় ব্যাখ্যা পেয়েছি। পেয়েছি হিসেবনিকেশ। ঘনভাবে পেয়েছি কবির জীবন নিয়ে আলােচনা।
যে-জীবন প্রীতির স্পর্শ ছুঁয়ে দ্রুত ফিরে গেছে বিষন্নতায়। যে-জীবন অন্তর্গত রক্তের ভিতর বিপন্নতায় খুঁজেছে তার হিসেব। জীবনানন্দের কবিতা গল্প উপন্যাসের নির্মাণ, বিবিধ প্রসঙ্গ এই উপন্যাসে ঘুরেফিরে এসেছে। তখন আবার ভুল করে মনে হয়েছে, শাহাদুজ্জামান আসলে একটি প্রবন্ধের বই-ই লিখে ফেলেছেন। তাও সব মতামত যে নিজের, এমন নয়। বেশিটাই, বলা ভাল অনেকটাই, অন্য কবি, প্রাবন্ধিক, সমালােচক, সম্পাদকের ‘তাঁদের কথা’। তাঁদের ভালবাসা আর অবজ্ঞা। তা হলে কেন এটি। উপন্যাস? লেখক নিজেও তাই আখ্যা দিয়েছেন। বইয়ের মলাটে লেখাও রয়েছে। শুনেছি, বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কেউ কেউ নাকি বলেছেন, জীবনানন্দকে নিয়ে যে বিপুল চর্চা রয়েছে, এই বই তারই বাছাই অংশের কোলাজ। সত্যি কথা বলতে কী, যত ভালই লাগুক, পড়তে গিয়ে আমিও মাঝে মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। ভ্রম কাটে শেষ হলে। বুঝি, যে যা বলুক, সাহিত্যের চিরাচরিত নিয়মে উপন্যাসের সংজ্ঞার্থ যাই থাকুক না কেন, ‘একজন কমলালেবু’ অবশ্যই উপন্যাস, যা আঙ্গিকে, গঠনে, মাত্রায় অন্যরকম। নিভৃত, এলােমেলাে এক জীবনের চারপাশে ঘিরে থাকা কুয়াশার মতাে ভালবাসা, উপেক্ষা, যন্ত্রণা সরিয়ে হাঁটা এক কাহিনি। হ্যাঁ, কাহিনিই তাে। কোনও জীবন কি অবিশ্বাস্য মনে হয় না? মনে হয় না এ জীবন বাস্তব নয়, শুধুই কল্পনার? রং-তুলিতে আঁকা, যার ওপর কখনও কালি, কখনও জল পড়েছে, কখনও মুছে গেছে, কখনও হয়েছে আবছা। কখনও নষ্ট হয়ে আবার নতুন। কোনও ছবি তৈরি করেছে। মনে কি হয় না সে জীবনের কথাও রুদ্ধশ্বাসে পড়ারই মতাে? শাহাদুজ্জামান ‘একজন কমলালেবু’-তে জীবনানন্দকে সেভাবে পাঠকের কাছে এনেছেন। পাশে এনেছেন। যে-জীবনানন্দ মায়া, নিষ্ঠুরতাকে নিংড়ে নির্মাণ করেন কবিতা। প্রতিটি শব্দ, বাক্যবন্ধন, যতিচিহ্নে নিজেকে রেখে যান একই সঙ্গে রক্তের ফোঁটা ও চুম্বনে। উপন্যাসের মূল চরিত্র জীবনানন্দ না হয়ে যদি অন্য কেউ হত, তাতেও এই লেখার মান একবিন্দু খাটো হত না।
আমি জীবনানন্দের নাম না জেনেও এই বই পড়ে ফেলতাম এবং এমন কোনও পাঠকের হাতে যদি এই বইটি তুলে দেওয়া হয়, যে কবিতা বা কবির থেকে শত যােজন দূরে থাকে, সেও বইটি পড়তে শুরু করলে ছাড়তে পারবে না। শেষ হলে জলে ভেজা উজ্জ্বল চোখে বলতে বাধ্য হবে, ‘আমার ভাষার এই কবির জন্য আমি গর্বিত। আমি তাঁর কবিতা পড়ব। তাঁর জীবন পড়ব। তাঁকে নিয়ে আলােচনা শুনব।'
একটি লেখা এর বেশি কী করতে পারে?
শাহাদুজ্জামান কোনও আড়াল রাখেননি। পাঠককে ঠকাননি। উপন্যাসে মূল চরিত্রের লেখা কবিতা লেখা যাবে না, ডায়েরির পাতা নেওয়া যাবে না, প্রাবন্ধিকের বিশ্লেষণ নেওয়া যাবে না। নিলেই তাকে চলে যেতে হবে ননফিকশন বা ডকুফিকশনের আলমারিতে— সাহিত্যের পায়ে এমন শিকল কে পরিয়েছে? বিশ্বজুড়ে এই শিকল ঘেঁড়া হয়েছে, হচ্ছে। বাংলাতেও হয়েছে বারবার। শাহাদুজ্জামান যেমন শিকল ভেঙেছেন, মানুষের মন জয়ও করেছেন। ‘আমি ফর্ম ভেঙেছি, ফর্ম ভেঙেছি’ বলে নিজেকেই ঢক্কানিনাদ করতে হয়নি। ফর্ম নিয়ে আলাদা করে মাথাই ঘামাতে হয়নি যেন। সে এসেছে নিজের খুশিতে।
বইটির শুরু যতই রহস্যময়, কৌতুহলােদ্দীপক, আকর্ষণীয় হােক না কেন, পড়তে হয়েছে ধীরে। সময় নিয়ে। রস অনুভব করতে করতে এগােতে হয়েছে। বলার ভঙ্গিটি অতি স্বাদু। একজন বাহ্যিকভাবে নরম এবং অন্তরে অতি কঠিন ও জটিল মানুষকে নিয়ে লিখতে বসলে যে-ভাষা ও ভঙ্গির কথা মনে আসা স্বাভাবিক এবং ব্যবহারের লােভ জাগে, শাহাদুজ্জামান তাকে এড়িয়েছেন। শব্দ, অলংকার, বাক্যবিন্যাসের মারপ্যাঁচে লেখাকে ভারাক্রান্ত করেননি। অকারণ পাণ্ডিত্য জাহিরের চেষ্টা নেই। সহজ গদ্য, কিন্তু মিয়নাে নয়। তাজা এবং শক্তপােক্ত। পড়তে গিয়ে বারবার থমকে ভাবতে হয়, কিন্তু অযথা হোঁচট খেতে হয় না।
আবার লেখার মধ্যে নেই অতিরিক্ত সরলীকরণ। যেখানে যেমন মনে করেছেন, বােধ, বিশ্বাস,
জীবনদর্শনের কথা বলতে দ্বিধা করেননি। বইজুড়ে জীবনানন্দ দাশ নিজেই থেকেছেন। লেখকের হয়ে যাননি। শুধু লেখক আঁচলের মতাে তাঁর হৃদয়খানি পেতে রেখেছেন।
বইটির এটি অন্যতম গুণ। অতি সাধারণ পাঠকও একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে জানবে অতি উৎসাহে। পরম বিস্ময়ে, মমতায় সে চিনবে গহন সঞ্চারী, নির্জন, একাকী এক প্রতিভাকে। চরিত্রগতভাবে মূলত ধূসর, ছায়া আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে থাকা কোনও জীবন মনােগ্রাহী। করে উপস্থাপনা সহজ কথা নয়। আবার বলছি, পড়তে শুরু করলে থামার সুযােগ দেননি। সেখানে ঠিক-বেঠিকের নিক্তি মাপা অর্থহীন। মনের মাধুরী যদি কোথাও মেশানােও হয়, সে অধিকার লেখাটি নিজেই তৈরি করে নিয়েছে।
অনেকে বলে, বইপাঠে (যে-কোনও লেখার ক্ষেত্রেও সম্ভবত সমানভাবে প্রযােজ্য) নৈর্ব্যক্তিক থাকাটাই সমীচীন। প্রতিক্রিয়া শুরু হবে পাঠশেষে। বিষয়, ভাবনাকে মনের ভিতরে জারিত হতে হবে। আমিও চেষ্টা করি এই পথে হাঁটতে, বেশির ভাগ সময়েই পারি না। এই বইয়ের বেলাতেও তাই হয়েছে। পড়তে পড়তেই মনের ভিতর প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আমাকে প্রভাবিতও করেছে। এখানে বলে রাখা প্রয়ােজন, আমি কোনও সাহিত্য গবেষক, শিক্ষাজগতের মানুষ অথবা মননে, দর্শনে শুধু আচ্ছন্ন গুরুগম্ভীর পাঠক নই। নিছকই পাঁচজনের মতাে সাধারণ মেধার একজন পড়ুয়া। পড়ার আনন্দেও পড়ি। তবে বহুজনের মতাে একজন জীবনানন্দ ভক্ত। আবার একই ভাবে বহুজনের মতােই বেশি ভক্ত। তবে সেখানেও ঘাটতি রয়েছে। এই তীব্র, স্নিগ্ধ এবং অপ্রতিরােধ্য মানুষটির কাজ ও জীবন নিয়ে যে-বিপুল চর্চা হয়েছে, তার খুব সামান্য অংশই আমি জানি। কে জানে, বিস্তৃত পড়া থাকলে হয়তাে খুঁতখুতানি হত। ভাবতাম, এই বইয়ে নতুন কী রয়েছে? ভাবতাম, কেন আবার লেখা? নিজেকেই হয়তাে বলতাম, যিনি কবিতা নিয়ে বেঁচে থেকেছেন, মরেও গেছেন কবিতা নিয়ে, তাঁকে জানতে বইয়ের পাহাড় সাজিয়ে বসতে হয়। না হলে এই মানুষকে জানার, চেনার অধিকারী নও তুমি। একজন কমলালেবু আমাকে সেই হীনমন্যতা থেকে মুক্ত করেছে। আমি জীবনানন্দ দাশকে জানার জন্য আরও আগ্রহী হয়েছি। শেষে একটা কথা বলে নিই। কাহিনি, প্রথম অধ্যায়ের মতাে শেষ অধ্যায়টিতেও ফিরে এসেছে হাসপাতালে। ফিরে এসেছে কবির মৃত্যু। মাঝখানে ক্লান্ত জীবনের পথে পড়ে থেকেছে উজ্জ্বল এক কমলালেবু। না, একজন কমলালেবু।
একজন কমলালেবু
শাহাদুজ্জামান।
প্রথমা প্রকাশন।
আলোচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দেশ ২রা ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সংখ্যায়।
শাহাদুজ্জামানের ‘একজন কমলালেবু’ আলোচনা লিখেছেন প্রচেত গুপ্ত
নীচের উদ্ধৃতিটি একটু দীর্ঘ হলেও এড়াতে পারছি না। বইটি নিয়ে কিছু কথা বলতে গেলে এটির প্রয়ােজন। উদ্ধৃতিটি নেওয়া হল একেবারে প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম বাক্য থেকে। যাতে গােড়াতেই বই সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়।
“পুরােনাে শতাব্দীর ধুলােমাখা একটা সরীসৃপের মতাে কলকাতা বালিগঞ্জ ডাউন ট্রাম ঘন ঘন ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দিকে। চারদিকে তখন শেষ বিকেলের রােদ। ‘জলখাবার’ দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে বসে চুনীলাল দেখলেন একজন লােক হেঁটে যাচ্ছেন ওই ট্রামের দিকেই। ট্রাম এগিয়ে আসছে, সেই লােকও এগিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম লাইনের দিকে। ট্রামের ড্রাইভার জোরে জোরে ঘণ্টা বাজালেন, চিৎকার করে ডাকলেন, তবু সে লােক উঠে গেলেন ট্রাম লাইনের ওপরে এবং আটকে গেলেন ট্রামের ক্যাচারে। সশব্দে ব্রেক কষল ট্রাম। চুনীলাল দৌড়ে গিয়ে ট্রামের ক্যাচারের ভেতর থেকে টেনে বের করে আনলেন মানুষটাকে। লােকজনে ভিড় জমে গেল, তারা জানতে চাইল, ‘কী নাম আপনার, কোথায় থাকেন?’ তারা কেউ জানে না যে এই লােক একদিন লিখেছেন:
কলকাতার ফুটপাত থেকে ফুটপাতে— ফুটপাত থেকে ফুটপাতে—/ কয়েকটি আদিম সপিনী সহােদরার মতাে এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে... (কবিতাটির আরও বেশ কয়েকটি লাইন রয়েছে। এখানে দেওয়া হল না।)
রক্তাক্ত সেই লােক বললেন, “আমার নাম জীবনানন্দ দাশ, ওই ল্যান্সডাউন রােডে থাকি, ১৮৩ নম্বর বাড়ি। এইটুকু বলে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না, এলিয়ে পড়লেন রাস্তায়। লােকজন তাঁকে ধরাধরি করে একটা ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিয়ে গেল কাছের শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।” পরিচ্ছেদটি ধরে এবার শেষের দিকে এগােই:
“কয়েকটি দিন আশা-নিরাশার দোলাচলে থাকবার পর ওই ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের নানা রকম রােগীর গােঙানাের প্রেক্ষাপটে, ওই রং ওঠা লােহার খাটে মৃত্যুবরণ করেন জীবনানন্দ। ট্রামের মতাে এমন একটা স্লো মুভিং লােকোমােটিভকে এড়িয়ে যাবার টনক মানুষের থাকার কথা। ট্রামের ক্যাচার তৈরি হয়েছিল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পশু তাড়াবার জন্য। কিন্তু জীবনানন্দ সম্ভবত ট্রামের ক্যাচারে আটকে যাওয়া প্রথম এবং শেষ মানুষ। ফলে আদিম সাপের মতাে ছড়িয়ে থাকা ট্রামের চাকার নিচে তাঁর মৃত্যু নিয়ে জট থেকে যায়। প্রশ্ন জাগে, এটা কি একটা দুর্ঘটনা?
নাকি তিনি ট্রামের চাকার নিচে আত্মহত্যা করেছেন?
অথবা এটা কি আসলে একটা হত্যাকাণ্ড, যার পেছনে রয়েছে আরও অনেকের অদৃশ্য। হাত?”
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে এইভাবে যে লেখা শুরু হয় তাকে কি এড়ানাে যায়? হয়তাে যায়, আমি পারিনি। বইটি আমার হাতে হাত রেখেছে কি না জানি না, তবে আমি রেখেছি। রেখে কখনও উৎফুল্ল হয়েছি, কখনও বিষন্ন। কখনও রেগে গিয়েছি, কখনও লেগেছে ঘাের। একই পাঠে আনন্দ ও বেদনা অনুভব করেছি। কোনও ঘটনা পড়ে মনখারাপ হয়েছে, আবার পরক্ষণেই বুঝতে পেরেছি, এই মনখারাপ আসলে জীবনের কোনও অমােঘ রূপ-রং মেশানাে সৃষ্টির প্রেরণা। এই মনখারাপ এমন সব কবিতার জন্ম দিয়েছে, যাদের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিতাদের সঙ্গে বসানাে গেছে এক পঙক্তিতে। তখনই আবার মন ভাল হয়ে গেছে। একই সঙ্গে মন ভাল এবং মনখারাপ এক বিরল আনন্দ অভিজ্ঞতা। খুব কম লেখা পড়েই এই আনন্দ পাওয়া যায়। ‘একজন কমলালেবু' বইটি সেই আনন্দ আমাকে দিয়েছে।
হ্যাঁ, এই বইয়ের নাম ‘একজন কমলালেবু'। লেখকের নাম শাহাদুজ্জামান। প্রকাশক বাংলাদেশের প্রথমা প্রকাশন। প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে। জীবনানন্দের নিজের এবং তাঁকে নিয়ে পণ্ডিতদের লেখা আরও কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের পাশে এই বইকে আমি যত্নে এবং আদরে স্থান দিয়েছি।
বইটির কথা আমি বেশ কিছুদিন আগেই শুনেছিলাম। শুনেছিলাম, বাংলাদেশের বিশিষ্ট গদ্যকার শাহাদুজ্জামান জীবনানন্দকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। তবে এই বঙ্গের কবি, গবেষক, সাহিত্য আলােচকদের মুখে বা লেখালিখিতে বইটির উল্লেখ দেখিনি, থাকলেও চোখে পড়ার মতাে উচ্চকিতভাবে কিছু নয়। বইটি প্রচার পায় মূলত এ বঙ্গের সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে এবং ওপার বঙ্গের সােশ্যাল মিডিয়ার আলােচনায়। একেই জীবনানন্দের জীবন নিয়ে উপন্যাস, তার ওপর ওরকম চমৎকার নাম! আমার মনােযােগ কাড়ে। ‘কমলালেবু’ নামে জীবনানন্দের একটি কবিতা
আছে। ‘একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাবে। আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে / আবার যেন ফিরে আসি / কোনাে এক শীতের রাতে / একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস / নিয়ে কোনাে এক মুমূর্ষর বিছানার কিনারে।’ কবিতাটি সকলের জানা। কিন্তু ‘কমলালেবু'-র আগে ‘একজন’ শব্দটি বসিয়ে তাতে যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা যায়, তা জানা ছিল কি? অন্তত আমার তাে নয়ই। যেন আড়মােড়া ভেঙে কবি জেগে উঠলেন কবিতার ভিতর থেকে। যতই শুনে থাকি, কবিরে পাবে না ‘তাহার জীবনচরিতে’, এই বইটির নামে কবি এবং কবিতা এক হয়ে গেছে। কৌতূহল বেড়েছে। বইয়ের লেখক সম্পর্কেও আমার বিশেষ ধারণা ছিল না। আমি আগে তাঁর কোনও বই পড়িনি। জানলাম, উনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানুষ। আমেরিকার গ্লাসগাে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। একজন ‘জীবনানন্দ উন্মাদ’। কিশাের বয়স থেকেই জীবনানন্দে ‘ভূতগ্রস্ত’। ভদ্রলােক একটু ঘুরিয়ে বলেছেন, তিনি নাকি ঘাড় থেকে সেই ‘ভূত’টিকে নামানাের জন্যই বইটি লিখেছেন। জীবনানন্দের ‘ভূত’ লেখকের ঘাড় থেকে নেমেছে কি না জানি না, তবে এই বই পড়ার পর বহু পাঠকের ঘাড়ে যে ‘ভূত’টি চেপে বসেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
লেখার আগে লেখক দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এই ধরনের কাজে দীর্ঘ প্রস্তুতি স্বাভাবিক। দেখার কথা, সেই প্রস্তুতি, পরিশ্রম কাজে লাগল কি না। পণ্ডশ্রমের বহু উদাহরণই তাে রয়েছে। লেখক যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ, মনে প্রশ্ন জেগেছিল, উনি কি তবে কবির বরিশাল জীবনের অংশটিই বড় করে দেখিয়েছেন? এই উপন্যাসের নায়ক কি মূলত রূপসী বাংলার কবি? যাঁর জীবন সরল শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতির মতাে। পুকুরের জলে লাল সরের মতাে পড়ে থাকা করবীর কচি ডাল হয়ে শুধু ঝুঁকে পড়ে চুমু খেতে চায় মাছরাঙার পায়ে? নাকি কলকাতার জীর্ণ, ক্লিষ্ট, অভাব, অনটন ও অপমানের কথাও এতে থাকবে?
বইটির সন্ধান করি। ভ্রাতৃপ্রতিম একজন সংগ্রহ করে দেয়। এই সুযােগে তাকেও আর-একবার কৃতজ্ঞতা নয়, ভালবাসা জানিয়ে রাখি। যে একটা ভাল বই পড়ায়, বইটির মধ্যে সেও থেকে যায়। আমরা তাকে ভুলে গিয়ে অন্যায় করি। যাই হােক, একজন কমলালেবু পড়তে পড়তে যাবতীয় ভুল ধারণার অবসান ঘটে। ‘একজন কমলালেবু’-তে জীবনানন্দ দুই বাংলার। বরিশালের মায়াভরা প্রকৃতি, পরিবার, লেখাপড়া, অসমাপ্ত কর্মজীবন, সুখদুঃখ যেমন আছে, আছে কলকাতার কাঠিন্য, উদাসীনতা, যন্ত্রণা এবং বন্ধুদের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কাহিনিও। আছে তাঁকে আগলে রাখার কথা। কবি হিসেবে তাঁকে পরিচিত করার গল্প। এটি বইটির মস্ত গুণ। ‘একজন কমলালেবু'-কে কোনও একটা দিক থেকে, একপেশে চোখে দেখা হয়নি। তাঁকে দেখা হয়েছে সবদিক থেকে। কবির শৈশব, বাল্য থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘপথ। হতাশা, যন্ত্রণা, স্ত্রী, প্রেমিকা, ভালবাসা, অবজ্ঞা, চাকরি ও বেকার সময়ের কথা রয়েছে। আছে প্রকৃতিতে ডুবে থাকা এক মানুষের গল্প, অর্থাভাবে দীর্ণ হয়ে থাকার কাহিনি। আছে কবিতা লেখা, সেই কবিতা নিয়েই তীব্র উপেক্ষা, তীক্ষ সমালােচনা, গল্প উপন্যাস লিখে ট্রাঙ্কে লুকিয়ে ফেলা। আছে কর্মজীবন থেকে পালানাে, চারপাশ থেকে পালানাে, নিজের কাছ থেকে পালানাে। বটগাছের মতাে ছায়া নিয়ে আছেন বন্ধু বুদ্ধদেব বসু, ভূমেন্দ্র গুহ। বিশুদ্ধ, সিরিয়াস এক কবির টলমল, অনিশ্চিত, অন্ধকার জীবনের কথা প্রায় সবই রয়েছে এই বইয়ে। যে-জীবনের আদ্যোপান্ত, আদি-অন্ত শুধুই কবিতা আর কবিতা।
সব মিলিয়ে ২৪০ পৃষ্ঠার বই। হিসেবে এক-দু’পাতা কমবেশি হতে পারে। এই ২৪০ পাতা পড়া শেষ হলে বােঝা যায়, শাহাদুজ্জামান একটি বিস্ময়কর এবং প্রয়ােজনীয় কাজ করেছেন। কেন, সে প্রসঙ্গে আসছি, তবে গােড়ায় বলে রাখি, এ আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত মত। আমারই ভাল লাগা, আমারই মনে হওয়া। এই বিষয়ে কারও ভিন্নমত থাকতে পারে, নিশ্চয়ই আছে, সে বির্তক বা আলােচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। বইটির সঙ্গে অন্য কোনও বইয়ের তুলনা অর্থহীন। জীবনানন্দকে নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই লেখা হয়েছে। হয়েছে বিস্তর আলােচনা। এর পরেও আরও হবে। এই ধরনের মানুষকে নিয়ে চর্চা কখনও থেমে থাকে না। নানা ফর্মে হতেই থাকে। একজন কমলালেবু উপন্যাসটিও সেরকম। লেখক উপন্যাস শেষে ৫৬টি বই এবং পত্রপত্রিকার তালিকা দিয়েছেন। সেখানে জীবনানন্দের কবিতা, উপন্যাস, গল্প, ডায়েরি তাে আছেই, দুই বাংলার বিশিষ্ট প্রবন্ধকার, গবেষকরাও আছেন। লেখকের এক সাক্ষাৎকারে পড়লাম, বইটি লেখার আগে তিনি ঘুরে দেখেছেন কলকাতা এবং বরিশালের সেই সব জায়গা, যেসব জায়গায় কবি থাকতেন। গেছেন হাসপাতালেও। এতদিন পরে এসব জায়গা থেকে কী নতুন তথ্য পাবেন? বইটি পড়ে বুঝেছি, না তথ্য নয়, শাহাদুজ্জামান তাঁর উপন্যাসের নায়কের জীবনকে হৃদয়ের মধ্যে নিয়ে এগােতে চেষ্টা করছেন। হ্যাঁ, এই বইয়ে তথ্য অনেক, যা হয়তাে আগেই জানা, বহুচর্চিত, তারপরেও বলব, বইটির হৃদয় কোনও কোনও সময়ে বাইরের তথ্যকে ছাপিয়ে এগিয়ে গেছে অনেকদূর। বড় বড় চরিত্র নিয়ে বিশ্বে অজস্র গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। হয়ে চলেছে। বাংলাতেও সেই তালিকা দীর্ঘ। তালিকায় পৌরাণিক, ঐতিহাসিক চরিত্ররা যেমন আছেন, আছেন বিপ্লবী, শিল্পী, সাহিত্যিক। এমনকী, জীবনানন্দকে নিয়েও এই বঙ্গে উপন্যাস লেখা হয়েছে। দু’টির কথা এখনই মনে করতে পারছি। একটি সুরঞ্জন প্রামাণিকের লেখা ‘সােনালি ডানার চিল’, অন্যটি প্রদীপ দাশশর্মার ‘নীল হাওয়ার সমুদ্রে’। স্বাভাবিক ভাবেই শাহাদুজ্জামানের উপন্যাসটি পড়ার আগে একধরনের মানসিক প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু পড়তে গিয়ে সেই প্রস্তুতি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। তার বদলে এমন অনেক কিছু পেয়েছি, যা ছিল কল্পনার বাইরে। এখানে উপন্যাসের ফর্মকে উলটেপালটে দেওয়া হয়েছে। কখনও মনে হয়েছে এ উপন্যাস কোথায়! এ তাে জীবনী। যেখানে মূল চরিত্র শুধু নিজে নন, তাঁর মা বাবা স্ত্রী প্রেমিকা সকলেই স্বনামে উপস্থিত। কোনও আড়াল-আবডাল নেই। জীবনানন্দকে ‘জীবনানন্দ’ নামে লিখতে দ্বিধা করেননি লেখক। ৫৬টি বই এবং পত্রপত্রিকা থেকে তথ্যের পর তথ্য সাজিয়ে লেখা। যেমনটি জীবনীকাররা করে থাকেন। আবার পাতা উলটেই ধারণা বদলেছে। পাতা জোড়া কবিতা। ‘বােধ’, ‘আট বছর আগের একদিন’, ‘ক্যাম্পে।
তবে কবিতারই বই হল নাকি? আরও এগিয়ে বুঝেছি, না, তাও নয়। এ এক বিচ্ছিন্ন, বিধ্বস্ত, প্রতিভাবান একাকী মানুষের আপনকথা। ডায়েরির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা ব্যর্থতা, গ্লানি, অপমানের কথাই লেখা হয়েছে সাজিয়ে, পরম্পরা ধরে। তবে কি এটিও ভঙ্গি বদলে আত্মকথাই? ভুল ভেঙেছে আবার। যখন নানা মাত্রায় ব্যাখ্যা পেয়েছি। পেয়েছি হিসেবনিকেশ। ঘনভাবে পেয়েছি কবির জীবন নিয়ে আলােচনা।
যে-জীবন প্রীতির স্পর্শ ছুঁয়ে দ্রুত ফিরে গেছে বিষন্নতায়। যে-জীবন অন্তর্গত রক্তের ভিতর বিপন্নতায় খুঁজেছে তার হিসেব। জীবনানন্দের কবিতা গল্প উপন্যাসের নির্মাণ, বিবিধ প্রসঙ্গ এই উপন্যাসে ঘুরেফিরে এসেছে। তখন আবার ভুল করে মনে হয়েছে, শাহাদুজ্জামান আসলে একটি প্রবন্ধের বই-ই লিখে ফেলেছেন। তাও সব মতামত যে নিজের, এমন নয়। বেশিটাই, বলা ভাল অনেকটাই, অন্য কবি, প্রাবন্ধিক, সমালােচক, সম্পাদকের ‘তাঁদের কথা’। তাঁদের ভালবাসা আর অবজ্ঞা। তা হলে কেন এটি। উপন্যাস? লেখক নিজেও তাই আখ্যা দিয়েছেন। বইয়ের মলাটে লেখাও রয়েছে। শুনেছি, বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কেউ কেউ নাকি বলেছেন, জীবনানন্দকে নিয়ে যে বিপুল চর্চা রয়েছে, এই বই তারই বাছাই অংশের কোলাজ। সত্যি কথা বলতে কী, যত ভালই লাগুক, পড়তে গিয়ে আমিও মাঝে মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। ভ্রম কাটে শেষ হলে। বুঝি, যে যা বলুক, সাহিত্যের চিরাচরিত নিয়মে উপন্যাসের সংজ্ঞার্থ যাই থাকুক না কেন, ‘একজন কমলালেবু’ অবশ্যই উপন্যাস, যা আঙ্গিকে, গঠনে, মাত্রায় অন্যরকম। নিভৃত, এলােমেলাে এক জীবনের চারপাশে ঘিরে থাকা কুয়াশার মতাে ভালবাসা, উপেক্ষা, যন্ত্রণা সরিয়ে হাঁটা এক কাহিনি। হ্যাঁ, কাহিনিই তাে। কোনও জীবন কি অবিশ্বাস্য মনে হয় না? মনে হয় না এ জীবন বাস্তব নয়, শুধুই কল্পনার? রং-তুলিতে আঁকা, যার ওপর কখনও কালি, কখনও জল পড়েছে, কখনও মুছে গেছে, কখনও হয়েছে আবছা। কখনও নষ্ট হয়ে আবার নতুন। কোনও ছবি তৈরি করেছে। মনে কি হয় না সে জীবনের কথাও রুদ্ধশ্বাসে পড়ারই মতাে? শাহাদুজ্জামান ‘একজন কমলালেবু’-তে জীবনানন্দকে সেভাবে পাঠকের কাছে এনেছেন। পাশে এনেছেন। যে-জীবনানন্দ মায়া, নিষ্ঠুরতাকে নিংড়ে নির্মাণ করেন কবিতা। প্রতিটি শব্দ, বাক্যবন্ধন, যতিচিহ্নে নিজেকে রেখে যান একই সঙ্গে রক্তের ফোঁটা ও চুম্বনে। উপন্যাসের মূল চরিত্র জীবনানন্দ না হয়ে যদি অন্য কেউ হত, তাতেও এই লেখার মান একবিন্দু খাটো হত না।
আমি জীবনানন্দের নাম না জেনেও এই বই পড়ে ফেলতাম এবং এমন কোনও পাঠকের হাতে যদি এই বইটি তুলে দেওয়া হয়, যে কবিতা বা কবির থেকে শত যােজন দূরে থাকে, সেও বইটি পড়তে শুরু করলে ছাড়তে পারবে না। শেষ হলে জলে ভেজা উজ্জ্বল চোখে বলতে বাধ্য হবে, ‘আমার ভাষার এই কবির জন্য আমি গর্বিত। আমি তাঁর কবিতা পড়ব। তাঁর জীবন পড়ব। তাঁকে নিয়ে আলােচনা শুনব।'
একটি লেখা এর বেশি কী করতে পারে?
শাহাদুজ্জামান কোনও আড়াল রাখেননি। পাঠককে ঠকাননি। উপন্যাসে মূল চরিত্রের লেখা কবিতা লেখা যাবে না, ডায়েরির পাতা নেওয়া যাবে না, প্রাবন্ধিকের বিশ্লেষণ নেওয়া যাবে না। নিলেই তাকে চলে যেতে হবে ননফিকশন বা ডকুফিকশনের আলমারিতে— সাহিত্যের পায়ে এমন শিকল কে পরিয়েছে? বিশ্বজুড়ে এই শিকল ঘেঁড়া হয়েছে, হচ্ছে। বাংলাতেও হয়েছে বারবার। শাহাদুজ্জামান যেমন শিকল ভেঙেছেন, মানুষের মন জয়ও করেছেন। ‘আমি ফর্ম ভেঙেছি, ফর্ম ভেঙেছি’ বলে নিজেকেই ঢক্কানিনাদ করতে হয়নি। ফর্ম নিয়ে আলাদা করে মাথাই ঘামাতে হয়নি যেন। সে এসেছে নিজের খুশিতে।
বইটির শুরু যতই রহস্যময়, কৌতুহলােদ্দীপক, আকর্ষণীয় হােক না কেন, পড়তে হয়েছে ধীরে। সময় নিয়ে। রস অনুভব করতে করতে এগােতে হয়েছে। বলার ভঙ্গিটি অতি স্বাদু। একজন বাহ্যিকভাবে নরম এবং অন্তরে অতি কঠিন ও জটিল মানুষকে নিয়ে লিখতে বসলে যে-ভাষা ও ভঙ্গির কথা মনে আসা স্বাভাবিক এবং ব্যবহারের লােভ জাগে, শাহাদুজ্জামান তাকে এড়িয়েছেন। শব্দ, অলংকার, বাক্যবিন্যাসের মারপ্যাঁচে লেখাকে ভারাক্রান্ত করেননি। অকারণ পাণ্ডিত্য জাহিরের চেষ্টা নেই। সহজ গদ্য, কিন্তু মিয়নাে নয়। তাজা এবং শক্তপােক্ত। পড়তে গিয়ে বারবার থমকে ভাবতে হয়, কিন্তু অযথা হোঁচট খেতে হয় না।
আবার লেখার মধ্যে নেই অতিরিক্ত সরলীকরণ। যেখানে যেমন মনে করেছেন, বােধ, বিশ্বাস,
জীবনদর্শনের কথা বলতে দ্বিধা করেননি। বইজুড়ে জীবনানন্দ দাশ নিজেই থেকেছেন। লেখকের হয়ে যাননি। শুধু লেখক আঁচলের মতাে তাঁর হৃদয়খানি পেতে রেখেছেন।
বইটির এটি অন্যতম গুণ। অতি সাধারণ পাঠকও একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে জানবে অতি উৎসাহে। পরম বিস্ময়ে, মমতায় সে চিনবে গহন সঞ্চারী, নির্জন, একাকী এক প্রতিভাকে। চরিত্রগতভাবে মূলত ধূসর, ছায়া আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে থাকা কোনও জীবন মনােগ্রাহী। করে উপস্থাপনা সহজ কথা নয়। আবার বলছি, পড়তে শুরু করলে থামার সুযােগ দেননি। সেখানে ঠিক-বেঠিকের নিক্তি মাপা অর্থহীন। মনের মাধুরী যদি কোথাও মেশানােও হয়, সে অধিকার লেখাটি নিজেই তৈরি করে নিয়েছে।
অনেকে বলে, বইপাঠে (যে-কোনও লেখার ক্ষেত্রেও সম্ভবত সমানভাবে প্রযােজ্য) নৈর্ব্যক্তিক থাকাটাই সমীচীন। প্রতিক্রিয়া শুরু হবে পাঠশেষে। বিষয়, ভাবনাকে মনের ভিতরে জারিত হতে হবে। আমিও চেষ্টা করি এই পথে হাঁটতে, বেশির ভাগ সময়েই পারি না। এই বইয়ের বেলাতেও তাই হয়েছে। পড়তে পড়তেই মনের ভিতর প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আমাকে প্রভাবিতও করেছে। এখানে বলে রাখা প্রয়ােজন, আমি কোনও সাহিত্য গবেষক, শিক্ষাজগতের মানুষ অথবা মননে, দর্শনে শুধু আচ্ছন্ন গুরুগম্ভীর পাঠক নই। নিছকই পাঁচজনের মতাে সাধারণ মেধার একজন পড়ুয়া। পড়ার আনন্দেও পড়ি। তবে বহুজনের মতাে একজন জীবনানন্দ ভক্ত। আবার একই ভাবে বহুজনের মতােই বেশি ভক্ত। তবে সেখানেও ঘাটতি রয়েছে। এই তীব্র, স্নিগ্ধ এবং অপ্রতিরােধ্য মানুষটির কাজ ও জীবন নিয়ে যে-বিপুল চর্চা হয়েছে, তার খুব সামান্য অংশই আমি জানি। কে জানে, বিস্তৃত পড়া থাকলে হয়তাে খুঁতখুতানি হত। ভাবতাম, এই বইয়ে নতুন কী রয়েছে? ভাবতাম, কেন আবার লেখা? নিজেকেই হয়তাে বলতাম, যিনি কবিতা নিয়ে বেঁচে থেকেছেন, মরেও গেছেন কবিতা নিয়ে, তাঁকে জানতে বইয়ের পাহাড় সাজিয়ে বসতে হয়। না হলে এই মানুষকে জানার, চেনার অধিকারী নও তুমি। একজন কমলালেবু আমাকে সেই হীনমন্যতা থেকে মুক্ত করেছে। আমি জীবনানন্দ দাশকে জানার জন্য আরও আগ্রহী হয়েছি। শেষে একটা কথা বলে নিই। কাহিনি, প্রথম অধ্যায়ের মতাে শেষ অধ্যায়টিতেও ফিরে এসেছে হাসপাতালে। ফিরে এসেছে কবির মৃত্যু। মাঝখানে ক্লান্ত জীবনের পথে পড়ে থেকেছে উজ্জ্বল এক কমলালেবু। না, একজন কমলালেবু।
একজন কমলালেবু
শাহাদুজ্জামান।
প্রথমা প্রকাশন।
আলোচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দেশ ২রা ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সংখ্যায়।
No comments:
Post a Comment