কবন্ধ সময়
নাহার তৃণা
১.
বিয়ে বাড়ির সুবাসিত রান্নার সুগন্ধে গোটা মনেশ্বর রোড এলাকাটা ম ম করছে। গন্ধ, তা সেটা ভালো কিংবা মন্দ যাইহোক না কেন, গণ্ডী কেটে রুখে দেবার সুযোগ তেমন একটা নেই। তাই দাওয়াত বঞ্চিত ভাড়াটে পরিবারগুলোর নাসারন্ধ্রে বাতাস স্বপ্রণোদিত হয়ে সে সুগন্ধ পৌঁছে দেয়। এ পাড়ায় অলিখিত একটা নিয়ম চালু রয়েছে, বাড়িওয়ালা পক্ষ ভাড়াটেপক্ষকে তাদের কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত থাকেন। অবশ্য শোকাবহ অনুষ্ঠান যেমন মৃতের জন্য দোয়া, চল্লিশা ইত্যাদিতে ভাড়াটিয়াদের সামিলের মহত্ত্ব দেখাতে কুন্ঠা দেখান না বাড়িওয়ালাগণ। আনন্দ আর শোক বন্টনে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার মধ্যে এই অদ্ভূত সীমারেখা কাকলিরা আর কোথাও দেখেনি।
ভাড়া বাড়ির অভিজ্ঞতা ওদের পরিবারের কম নেই। সেরকম অনেক বাড়িওয়ালার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক পর্যন্ত গড়িয়েছে, ভাড়ার বাড়ি ছেড়ে এলেও অনেকের সাথে এখনও যোগাযোগ বর্তমান। কাকলির এক নানা, যিনি আদতে মা-বাবার বিয়ের পর পর নতুন ভাড়াটে হিসেবে ওঠা বাড়ির বাড়িওয়ালা ছিলেন, তিনি মা কে মেয়ে বানিয়েছিলেন। সে সূত্রে কাকলিরা তাঁকে নানা ডাকতো, অবশ্য কাকলি তাঁকে বেশিদিন দেখেনি। কয়েক বছর আগে সেই নানা মারা গেছেন।
অথচ এই এলাকার কেমন অদ্ভূতুড়ে নিয়ম। সুগন্ধে পাড়া মাত করে লোভ জাগানো হবে, কিন্তু তার স্বাদ নেবার বেলায় যত বাধা। ভালো ভালো খাওয়ার প্রতি কাকলির নিদারুণ দুর্বলতা। তার ছাপোষা চাকুরে বাবার পক্ষে সম্ভব হয় না মাছ মাংসের যোগান দেয়া। কচুঘেঁচুই প্রায় সারা বছর মুখ বুঁজে খেয়ে যেতে হয়। মুখের স্বাদ পালটানোর জন্য এরকম বিয়ে বাড়ির সুখাদ্য খাওয়ার লোভে মন আঁকুপাঁকু করলে খুব দোষ দেয়া যায় না। কাকলি উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে বড় আপার হাতের কাজ শেষ হলো কিনা। আপার কাজ শেষ হলে কাকলির দুঃখী ভাব কিছুটা কমে। আপা এসে দারুণ খেলাটা শুরু করবে। কাকলি খুব মজা পায় খেলাটা খেলে।
কাকলিরা তিন ভাইবোন। বড় আপা বকুল, ভাইয়া কমল, আর কাকলি। বয়সের তুলনায় কাকলির বুদ্ধি কিংবা শরীর কোনোটাই তেমন পাকেনি। চোদ্দ পেরিয়ে পনেরোতে পড়লো এ মাসে। টেনেটুনে কোনোরকমে ক্লাস সেভেনে ওঠেছে। পড়ালেখা সে করে ঠিকই, কিন্তু সব কেমন গুলিয়ে যায়। কিছুই মনে রাখতে পারে না। এই বয়সী একটা মেয়ের শরীরে নারী হয়ে ওঠার লক্ষণগুলো আরো অনেক আগেই জানান দেবার কথা। কাকলির শরীরে সে রকম কোনো জোয়ারের লক্ষণ নেই। অপুষ্টির ভাটায় সেটা আটকে গেছে, নাকি ওর শারীরিক কোনো সমস্যা আছে, সে ব্যাপারে পরিবারের কারো তেমন মাথা ব্যথা নেই। সামর্থ্য না থাকায় উদাসীনতার কাছে নতিস্বীকার করে নিতে হয়েছে। কারণ সেরকম চিকিৎসার জন্য যার স্মরণাপন্ন হলে একটা বিহিতের সম্ভাবনা ছিল, তেমন একজন ডাক্তারের কাছে পৌঁছানোর মতো রসদ কাকলির বাবার পকেটে থাকে না। যে বেতন পান কাকলির বাবা, তার বেশির ভাগটাই বাড়ি ভাড়ার পেছনে ব্যয় হয়। পকেটে অতি সামান্য যেটুকু থাকে তা দিয়ে সারা মাসের সংসার তেল ফুরিয়ে যাওয়া কুপিবাতির মতো পিটপিট করে চলে। অভাবের সাথে কাকলিদের জন্মের সখ্যতা।
কাকলির ভাইটা চাকরির নাম করে সারাদিন বাইরে বাইরে কাটিয়ে রাতের খাওয়ার আগে আগে বাড়ি ফিরে। মা সংসার বিষয়ে ছেলের এমন আলগা ভাব দেখে গজগজ করেন প্রায়। সারাক্ষণ সংসারের সাথে সেঁটে থাকার কারণে তাদের যেভাবে হামুখো অভাবের মুখনাড়া দেখতে হয়, ছেলে তার বাইরে থাকলেও সংসারের নড়বড়ে অবস্হাটা যে বুঝে না, তা তো না। উপার্জনের রাস্তায় গিয়ে কবে যে বাবার ভরসা হবে তারও কোনো কূল কিনারা নেই। টিউশনির বেতনের অতি সামান্য কিছু মাঝে মধ্যে কমল মায়ের হাতে দেয় বটে। কিন্তু সে মরুভূমিতে একফোটা পানি যেন।
কাকলির বড় আপার হাতের কাজের বেশ সুনাম। আশেপাশের অনেকেই তার কাছে সেলাই ফোঁড়াই করায়। তা থেকে মোটামুটি আয় হয়। পালা পার্বণে প্রচুর সেলাইয়ের অর্ডার আসে, রোজগারও সেসময় বেশ ভালো হয়। রোজগারের প্রায় সবটাই আপা মায়ের হাতে তুলে দেয়। মা,সে টাকা থেকে সামান্য কিছু সরিয়ে একটা দুধের কৌটায় জমায়। নিজেরা সারা মাস কচুঘেঁচু খেয়ে টাকা জমানোর মানে বুঝে না কাকলি। ওই টাকায় দিব্যি পোলাওয়ের সুগন্ধী চাল, গোশত্ হয়ে যাবার কথা। ঈদ ছাড়া তাদের বাড়িতে পোলাও গোশত্ রান্না হয় না। একদিন একবেলা উৎসব ছাড়াই পোলাও কোর্মা খেলে কী ক্ষতি হয়! কিন্তু সে কথা মাকে বলতে গেলেই বিপদ। হয় কিল চড় খাবে, নয়তো গালাগালির চূড়ান্ত। বিয়ে বাড়িতে কতসব মজাদার রান্না হচ্ছে, অথচ ভাগে পাবে না, সে দুঃখে মুখ চূণ করে বারান্দায় ঘুরঘুর করতে থাকা কাকলি অযাচিতভাবেই মায়ের বকুনি খেয়ে বসে, “গতরখাকির আর কিছু না থাকুক নোলা আছে ঠিকই। বই নিয়ে একটু পড়তে বসলে কী হয় তোর?”
মা এত গালাগালি করতে পারে বাবা রে বাবা! এমন এমন গালি দেয় যার সবটার অর্থও জানেনা কাকলি। আশ্চর্যের কথা পরিবারের আর কারো প্রতি মায়ের এতটা ক্ষোভ ঝরতে দেখেনা। মায়ের যত রাগঝাল সব যেন তার প্রতি। কাকলি কী করে বুঝবে, সংসারের ঘায়ে নাস্তানাবুদ অসহায় মা তারচে’ আরো খানিক অসহায় অবস্হানে থাকা মেয়ের উপর নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়ে মনকে শান্ত রাখার ছুতো খোঁজেন!
সে রাতে ঘুমাতে গিয়ে বড় আপাকে জিজ্ঞেস করে, “আপা গতরখাকি অর্থ কী রে?” ওর প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে বড় আপার চোখ ভরে গিয়েছিল পানিতে। কেউ দেখলে ভাবতো বড় আপা বুঝি কাঁদছে। বড় আপাটা সময় অসময়ে হাসিখুশিতে ভরে ওঠতে পারে। ও যেন নিজের ভেতরে সুখ নামের একটা নদী বয়ে বেড়ায়। বড় আপার কাছাকাছি থাকলে কেমন শান্তি শান্তি লাগে। মন খুশিতে ভরে ওঠতে সময় লাগে না। কাকলি বড় আপাকে মায়ের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। বড় আপা কখনও মনে দুঃখ দেবার মতো কথা বলেনা ওকে। গালি কী জিনিস জানেই না হয়ত।
কাকলির গালে টুকুশ করে একটা চুমু এঁকে দিয়ে বড় আপা জানতে চায়, “এটা মা বলেছে বুঝি? হা হা…ওর মানেটা না খুব মজার জানিস পুট্টুশ!” বড় আপা কাকলিকে পুট্টুশ নামে ডাকে। নামটা খুব পছন্দ কাকলির।“ ওর কাকলি নামটা ছোটো করে কা কা ডেকে ক্লাসশুদ্ধ সবাই মজা করে। ওর সব কিছু নিয়ে মজা করতে ক্লাসের সবার ভারী আনন্দ। কাকলির তাই স্কুলে যেতেও ইচ্ছে করে না। স্কুলে ওর কোনো বন্ধু নেই।
“যাহ! গালি আবার মজার হয় নাকি!” “খুব হয়। ওর মানে হচ্ছে আলসে কুঁড়ে। এটা মজার না বল?” আলসে কুঁড়ে বিষয়টাকে এমন বিদঘুটে শব্দে মুড়ে দেয়া হলো কেন, মাথায় আসে না কাকলির। “মা তবে খুব ভুল কিছু বলেনি, বলো আপা? আমি তো আলসেই…” কেমন এক মায়া নিয়ে বোনকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বড় আপা বলে, “তোর মাথায় বিলি কেটে দেই আয়, আরামে ঘুম আসবে।” বড় আপা বোনের মনের মেঘ উড়িয়ে দিয়ে চোখ ভরে ঘুম নামিয়ে দেবার জন্য মাথায় বিলি কাটা শুরু করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় কাকলি। ছোটো বোনের ঘুমন্ত মুখ চুঁইয়ে অপার্থিব এক মায়ার ঝরে পড়া দেখতে দেখতে, কান্নায় দু’চোখ ভরে আসে বকুলের। পৃথিবীর জটিলতা কুটিলতা সম্পর্কে অজ্ঞাত, অপুষ্ট শরীর-মনের বোনটার প্রতি অসীম ভালোবাসায় বড় বোন বকুল নিঃশব্দে কাঁদে। সারাদিন যে মেয়ের মুখের হাসি সরে না, রাতের এই একান্তে এঁটে রাখা হাসিখুশির মুখোশটা খুলে খানিক হাঁপ ছাড়ে বুঝি। এ সময়ে, সে প্রায় নিজের দুঃখ, বোনের দুঃখ,..সংসারের দুঃখ, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে আর কেঁদে আকুল হয়।
২.
বকুলের পানপাতা আকৃতির মুখটা বেশ লাবণ্যে ভরা। সামান্য সাজে ওকে দারুণ দেখায়। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে পড়তে ওর বিয়ের প্রস্তাব আসায় বাবা মা সেটা হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না। কোনো রকম খোঁজ খবর না নিয়েই গ্রামের এক পরিচিত কাকার মাধ্যমে আসা প্রস্তাব লুফে নেন বাবা মা। ছেলে সৌদি আরবে চাকরি করে, জানার মধ্যে এটুকু তথ্যই তাঁরা জানতে পারেন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসার থেকে একটা মুখ কমে যাওয়া মানে বেশ অনেকটা বোঝা নেমে যাওয়া। তাছাড়া পাত্র কিচ্ছু চায় না। মেয়েকে এক কাপড়ে বিয়ে করতে রাজী।
এমন সম্বন্ধ হাতছাড়া করা বোকামি। কাজেই মেয়েটাকে কোনো মতে সৌদি প্রবাসী সেই ছেলের হাতে তুলে দেয়ার ত্বরিত বন্দোবস্ত হয়। বকুলের পিঠাপিঠি ভাই কমল, এভাবে কোনো খোঁজ খবর ছাড়া, দুম করে বোনের বিয়ের পক্ষে ছিল না মোটেও। কিন্তু বাপের ঘাড়ে বসে দু’বেলা অন্ন ধ্বংস করা ছেলের কথার তেমন জোর তো খাটে না। এক্ষেত্রেও খাটেনি। বিয়ের এক সপ্তাহ না কাটতেই বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, বকুল স্বামীর বাড়ি থেকে কোনো রকমে পালিয়ে আসে। আসবার আগে যতটুকু জেনেছে, যার সাথে বিয়ে হয়েছিল, তার আগের পক্ষে কয়েকজন বউ আর বাচ্চা আছে। লোকটা দেশের বাইরে থাকে একথা ঠিক, তবে সেটা সৌদি না মালয়েশিয়া, সেটা নিয়ে খোঁদ বউদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব আছে। এ পর্যন্ত সে কয়টা বিয়ে করেছে তারও সঠিক হদিশ জানা নেই কারো। বিয়ে করে যে বাড়িতে বকুলকে নিয়ে ওঠেছিল, ওটাকে বাড়ি না বলে নারী শরীর বিক্রির আড্ডাখানা বলাই শ্রেয়।
লোকটা, বর্তমান বউয়ের মাধ্যমে আরো কিছু উদ্বাস্তু মেয়ের মাধ্যমে সেবাড়িতে ভালো ব্যবসা ফেঁদেছে। বকুলকে এখানে সে ধান্ধায লাগানোর মতলব ছিল না। ওকে বিদেশে নেবার ব্যবস্হা চলছিল। এ ধান্ধায় কয়েক বছর পর পর লোকটা দেশে আসে। অসহায় গরিব ঘরের চটক আছে, বিদেশের বাজারে ভালো বিকোতে পারে, এমন মেয়ে বিয়ে করে দালালের মাধ্যমে বিয়ে করা বউ সুবিধা মতো দেশে পাচার করে। নারী শিশু পাচারের সাথে জড়িত চক্রের সদস্য লম্পটটা। ভাগ্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে, বলা যায় তার জোরে বকুল বেঁচে যায় অবিশ্বাস্যভাবেই। নইলে মাত্র কয়দিনের পরিচয়ে, বকুলের প্রতি ওবাড়ির এক মেয়ে, পুস্পরানীর কেন এমন মায়া জন্মাবে? যে জীবনে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সে জীবন থেকে বেরিয়ে ফিরে যাবার কোনো দরজা তাদের জন্য খোলা নেই। অথচ খায়রুলের সদ্য বিয়ে করা নিষ্পাপ বউটার বাবা-মা, ভাই-বোন, সব শুদ্ধ একটা পরিবার আছে, তাও এই শহরেই। এমন একজনের জীবন যদি তার কারণে রক্ষা পায় সেটাও তো কম আনন্দের না। এমন মহৎ ভাবনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লম্পটটা যখন বাইরে যায় সে সুযোগে, অন্যদের অলক্ষ্যে পুস্পরানী, বকুলকে পালিয়ে আসতে সাহায্য করে।
এমন সর্বনাশা পরিস্হিতির খবর জেনে বকুলের সহজ সরল মা বাবা যেন পাথর বনে যান। সবটা সামাল দেয় কমল আর তার বন্ধুরা। বন্ধুদের পরামর্শে নিরাপত্তার জন্য, প্রথমে পুরনো বাড়িটা ছেড়ে দেয়া হয়। হুট করে স্বল্প ভাড়ার বাড়ি পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা না। তাই কিছুদিনের জন্য প্রায় বস্তির মতো এক এলাকায় পাওয়া চালাঘরে গিয়ে উঠতে হয় ওদের। থানায় গিয়ে পুলিশকে ঘটনার বিস্তারিত জানাতে ভুল হয় না। বিয়ের পর খায়রুল নামের ভণ্ডটা যে ঠিকানায় বকুলকে নিয়ে ওঠেছিল,পুলিশ সেখানে গিয়ে কাউকে পায়নি। সে বাড়ি ফাঁকা। সে ঘটনার মাস ছয়েক পর বকুলেরা বস্তি এলাকা ছেড়ে মোহাম্মদপুরের দিকে বাসা ভাড়া নিয়েছিল। সেখান থেকে মনেশ্বর রোডের এই বাড়িতে এসেছে প্রায় তিন বছর হতে চললো।
খায়রুল নামের জলজ্যান্ত একটা লোকের কোনো হদিশই আর পাওয়া গেলো না। ভণ্ডটা স্রেফ উবে গেলো যেন! গ্রামের সেই পরিচিত আত্মীয়, যার মাধ্যমে সম্বন্ধ এসেছিল, তার সাথে যোগাযোগের পর বোঝা যায়, বেচারা বাস্তবিকই অজ্ঞ ছিলেন সমস্ত বিষয়ে। পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা হয়ত তেমন করে আর কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু বকুল তার জীবন থেকে ওই সাতটা দিনকে শত চেষ্টাতেও মুছে ফেলতে পারেনি। যে বিভীষিকাময় জীবনের সামান্য ঝলক সে প্রত্যক্ষ করেছে, চাইলেও বকুল সে স্মৃতি ভুলতে পারবে না। আবার বিয়ের জন্য বাবা মা অতটা সরব না হলেও, জীবনের জন্য যে সেটা প্রয়োজনীয়, তাঁদের এমন ইঙ্গিতে বকুল চুপ থাকা শ্রেয় মনে করে। মা বাবা আর কয়দিন। তারপর অসহায় বোনটাকে নিয়ে তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এমন ভাবনা যে আসে না মনে, তা না। যা হয় হবে, এমন ভাবনার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে জীবনের মহার্ঘ মুহূর্তগুলো।
এ ঘটনা যখন ঘটে, কাকলি তখন দশ বছরের। তার বুদ্ধিহীনতার আর্শিবাদে মানুষের নীচুতা আর নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে তেমন কিছু বুঝে ওঠা ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি। হঠাৎ বিয়ে হয়ে বড় আপার তাদের ছেড়ে চলে যাওয়ায় কাকলি সবচে’ বেশি কষ্ট পেয়েছিল। তার অবিরাম কান্নায় সবাই দিশেহারা। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সামনে গোশত পোলাওয়ের প্লেট ধরে তাকে ভোলানো হয়েছিল। বড় আপা ফিরে আসায় তাই সে দারুণ খুশি। কাকলির ধারণা, বড় আপার বর বিদেশে থাকে, আসবে একদিন। প্রায় সে বড় আপার কাছে জানতে চায়, “ দুলাভাই কবে আসবে রে আপা?” বোনের গলা জড়িয়ে বকুল এমন ভাব করে যেন সে কথায় তার ভারী আহ্লাদ হচ্ছে। হেঁয়ালি করে বলে, “চলে আসবে যে কোনো দিন। সেদিন বাড়িতে পোলাও মুরগি রান্না হবে জম্পেশ করে বুঝলি পুট্টুশ!” অনাগত সেই সুখের দিনটা মনে করে এখনই নাক টেনে কাকলি বাতাসের বুক থেকে সুগন্ধ শুষে নিতে চায়। আপার শেখানো খেলা থেকে এই ভঙ্গীটা সে ভালোই রপ্ত করেছে। ওর এমন ভঙ্গীতে বকুলের মুখোশে ঢাকা মুখ থেকে খিল খিল হাসির হল্লায় চারপাশটা ভরে ওঠে। ঝিনুক কষ্ট সয়ে কাকলির বড় আপা হাসিতে মুক্তা ফলায়।
৩.
কাটছাঁটে বেঁচে যাওয়া দামী কাপড়ের টুকরো যারা সেলাই করতে দেন, তাদের কাছ থেকে চেয়ে জমিয়ে রাখে বকুল। টুকরোগুলো জুড়ে জুড়ে চমৎকার ডিজাইনের একটা ফ্রক বানিয়ে দেবে কাকলির জন্য। ওরকম কাপড়ের একটা জামা পেলে বোনটা কত খুশি হবে ভাবতেই ভালো লাগে। অর্ডারে আসা সেরকম কাপড় দেখিয়ে, বকুলকে প্রায় জিজ্ঞেস করে কাকলি, “এগুলোর খুব দাম না রে আপা?” কাকলির জামা কাপড় সব বকুল তৈরি করে দেয়। সস্তা ছিট কাপড়, বা মায়ের পুরনো শাড়ি কেটে তৈরি হয় সেগুলো। ঈদের জন্য তৈরি সস্তা কাপড়ের জামাতে ফুল তুলে দেয় যত্ন করে। সামান্য সেসব আয়োজনে বোনের আনন্দ দেখে বকুলের মনে হয়, পৃথিবীর সবাই যদি ওরকম অল্পে সন্তুষ্ট হতে জানতো, তবে প্রচুর চাহিদার লোভে পড়ে কিছু মানুষ হয়ত অমানুষে পরিণত হতো না। সামনের ঈদে কাকলির জন্য দুটো জামা বানাবে বকুল। এখনই সেটা জানাবে না বোনকে। ঈদের আগের দিন কাকলির জন্মদিন। সে উপলক্ষ্যে বোনটাকে নতুন এক জোড়া জুতো কিনে দেয়া যায় কিনা সেটাও ভাবছে। এক জুতো পরেই স্কুল কিংবা বাইরে যাওয়া আসা করতে হয়। অবশ্য ওরা বেড়াতে সেরকম যায় আর কোথায়। কুটুম্বিতা রক্ষা করাটা ওদের মতো প্রায় হতদরিদ্রদের জন্য বিলাসিতার নামান্তর। কদাচিৎ এবাড়িতে আত্মীয় স্বজনের আগমন ঘটে।
কালো চামড়ার একজোড়া জুতোর কী রকম দাম, কমলের পক্ষে সম্ভব হলে জেনে আসতে বলবে। বাবার জন্যও একজোড়া স্যাণ্ডেল স্যু কেনা খুব জরুরী। বাবা তো নিজের দিকে একদমই তাকান না। বছর তিন আগে কেনা জুতো জোড়ায় তাপ্পি মেরে মেরে চলছে। গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতেই ওই এক জুতো পরে বাবাকে কাজে যেতে হয়। বকুল নিজে গিয়েও জেনে আসতে পারে। কিন্তু গাওছিয়া যেতেও তো বাড়তি খরচ, পায়ে হাঁটা দূরত্বে জুতোর কোন দোকান নেই আশেপাশে। সে কারণে নিজে যেতে চায় না বলে কমলের স্মরণাপন্ন হওয়া। কিন্তু ভাইটার চেহারাই তো দেখা যায় না আজকাল। চাকরির চেষ্টায় সুবিধা করতে না পেরে, কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে চেষ্টা করছে। কমলের সেরকম পুঁজি দেবার সামর্থ্য নেই, কায়িক শ্রম বেশি দিয়ে পুষিয়ে দিচ্ছে।
মা জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র হবার সমূহ সম্ভাবনা। বকুল তার সোনার চেনটা বিক্রি করে, আর প্রতিবেশি পারুলভাবীর কাছ থেকে হাজার পাঁচেক টাকা ধার নিয়ে, কমলের ব্যবসার জন্য সামান্য কিছু টাকার ব্যবস্হা করে দিয়েছে। পারুলভাবীর পাঁচ হাজার পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত, যাবতীয় কাপড় এখন থেকে বিনা পয়সায় সেলাই করে দেবে, এমন শর্তে টাকাটা ধার নিয়েছে। ভাইয়ের ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলে টাকাটা আগেও দিয়ে দিতে পারে। পারুল ভাবীর অত তাড়া নেই অবশ্য। স্বামী স্ত্রী দু’জনে ভালোই উপার্জন করেন তারা। কমলেরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঢাকার বাইরে ফলের বাগান লিজ নিয়েছে। সেখানে থেকে ফল এনে ঢাকার বাজারে সাপ্লাই দেবে। লাভ নাকি বেশ ভালো এ ব্যবসায়। সে কাজে ভাইটা দিনরাত প্রচুর খাটছে। ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে সংসারেও দিতে পারবে কমল।
***
দরজায় আসা মাছওয়ালার কাছ থেকে নরম হয়ে আসা পাঁচ মিশালি মাছের একটা ভাগ বেশ সস্তায় কিনে মাজেদা বেগম বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে যান। শেষ বিকেলের এ সময়ে প্রায় নষ্ট হতে বসা মাছ বিক্রির আর তেমন আশা নেই দেখে, মাছওয়ালাকে যে দাম বলা হয়েছে তাতেই সে রাজী হয়ে যাবে ভাবেননি মাজেদা বেগম। তেল মশলা আর একটু বেশি ঝাল দিয়ে চচ্চড়ি রান্ধবেন। বকুলের বাবা খুব পছন্দ করেন ছোটো মাছের চচ্চড়ি। অবশ্য স্ত্রীর হাতের যে কোনো রান্নাই তার পছন্দের। এখন মানুষটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে তার তুচ্ছ সব রান্নারও উচ্ছ্বিত প্রশংসা করতেন। ভালো পদ আর রান্না হয় কোথায়।
একঘেয়ে শাকপাতা আর সবজির ঘন্ট, এই তো তাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা। সেগুলোই মাজেদা বেগমের হাতের গুণে সুস্বাদ পায়। সামান্য তেল মশলায় মাজেদা বেগম বেশ গুছিয়ে রাঁধতে পারেন। তিনি নিশ্চিত, ছোট মেয়ে কাকলি আজ রাতে এক হাতা ভাত অতিরিক্ত খাবে। ভালো মন্দ খাওয়ার প্রতি এত লোভ মেয়েটার! ভাবনাটায় ওর ঠোঁটে মৃদু কাঁপন ধরিয়ে মিলিয়ে যায়... বিলাপের সময় নেই। ভাত বসাতে হবে। মানুষটা সারাদিন শেষে জ্বলেপুড়ে বাড়ি ফিরবে। অফিস থেকে ফেরার পর সামান্য রং চা আর দুটো টোস্ট বিস্কুট দিলেও আজকাল আর খেতে চায় না। কাকলিকে ডেকে পাশে বসিয়ে খাওয়ায়। মেয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এমন ভাবে খায়, যেন অমৃত খাচ্ছে। দু’চোখ ভরে এদৃশ্য দেখতে দেখতে বুকটা ভারী হয়ে ওঠে মাজেদা বেগমের। আজ আর চা হবে না, একেবারে ভাত দেবেন। দ্রুত হাতে ছোটো মাছগুলো বাছতে থাকেন। বকুল এসে মায়ের সাথে হাত লাগায়। মা মেয়ে হাত লাগানোর ফলে দ্রুত মাছ বাছা হয়ে যায়। বকুল রান্না ঘরে আসবার সময় উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে, কাকলি ঘুমাচ্ছে। ঘুমালে ওর অসহায়ত্ব যেন আরো বেশি ফুটে ওঠে। কিংবা ওর খামতিটা জানা বলেই হয়ত সেরকম মনে হয়। বকুল ওর স্বভাব সুলভ খুশি হওয়া গলায় মাকে বলে, “পুট্টুশটা রাতে খেতে বসে আজ তেমন ঘ্যান ঘ্যান করবে না দেখো।” বড় মেয়ের কথায় মুখ টিপে হাসেন মাজেদা বেগম।
রাতের খাবারটা সবাই বেশ চেটেপুটে খেলো। মাজেদা বেগম তৃপ্তির সাথে সবার পাতে একটু বেশি বেশি মাছের তরকারি তুলে দিলেন। খেতে বসে রহিম সাহেব ফুরফুরে মেজাজে অনেক দিন পর স্ত্রীর হাতের রান্নার প্রশংসা করলেন। সামান্য আয়োজনের এই আনন্দ বাড়ির সবগুলো মানুষকে ছুঁয়ে থাকে কেমন। মাজেদা বেগমকে এত বলার পরও বকুলদের সাথে তিনি খেতে বসেননি। কমলের জন্য অপেক্ষা করবেন। ছেলেটা সেই কোন রাতে আসে, তার জন্য ঢাকা দেয়া ঠাণ্ডা ভাত একা বসে খায়। আজ মা ছেলে দু’জনে একসঙ্গে খাবেন। ছেলের তৃপ্তি নিজ চোখে দেখবার লোভেই সবার অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন।
খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে বকুল টুকটাক কিছু সেলাই করে। পাশে শুয়ে শুয়ে কাকলি দেখে। ও ঘরে মা বাবা কী কথায় ব্যস্ত। আজ বাবা মায়ের মন কেমন ভারহীন ফুরফুরে। বাবার একটা প্রমোশনের কথা চলছে। প্রমোশনটা হলে বেতন কিছু বাড়বে। চিরদিন তো আর সবার কষ্টে যায় না, সুদিন দেরিতে হলেও আসে। কমলদের ব্যবসাটাও দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন ওদের পক্ষে কাকলিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। মানুষের স্বভাবই তো তাই, সুদিনের পায়ের আওয়াজ শুনলো কী শুনলো না, নানান সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে জানে বলেই হয়ত শত যন্ত্রণা উজিয়েও বেঁচে থাকে।
কাজ গুছিয়ে বকুল বোনের পাশে শুয়ে শুয়ে তার প্রিয় খেলাটা শুরু করে। “শোন পুট্টুশ, বাবার প্রমোশন হলে আমাদের সামান্য একটু টাকা হবে। ভাইয়ের ব্যবসা ভালো মতো চলা শুরু করলে আরো একটু বেশি টাকা হবে আমাদের। তখন মাসে দু’বার তোকে পোলাও কর্মা রান্না করে দেবে মা। আমরা কোনোদিন কোনো রেস্টুরেন্টে খাইনি। একদিন সবাই মিলে খেতে যাবো। খুব মজা হবে।” আনন্দে কাকলি হাততালি দেয়। খলখল করে খানিক হাসে। ওর আনন্দ আরো একটু উসকে দিতে বকুল বলে, “ চলন্ত সিঁড়িওয়ালা বড় বড় যে সব মার্কেট আছে না? তার একটাতে যাবো। তোর কী পছন্দ বল দেখি? মনে মনে ভাবতে থাক, আমরা এখন বসুন্ধরা সিটি শপিং মার্কেটে। ভয় পাচ্ছিস কেন! এই আমার হাতটা ধর। সিঁড়িতে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকবি চুপটি করে। কিস্যু হবে না বোকা।...এই তো! দেখলি কেমন তরতর করে ওপরে চলে এলাম। প্রথমে তোর জন্য চমৎকার একটা ড্রেস কিনবো, কেমন? কোন রঙ পছন্দ তোর?” আনন্দে আধবোঁজা গলায় কাকলি বলে, “কমলা।” “বাহ্! চমৎকার। ওই দেখ, কমলার মধ্যে সোনালী আর গাঢ়নীল জরি চুমকির কাজের ড্রেসটা, সুন্দর না?” “খুউব সুন্দর রে আপা!” “আইসক্রিম খাবি পুট্টুশ?” ‘খাবো তো।” “হুম চল, কোন ফ্লেভার খাবি?” মাথা চুলকে খানিক ভেবে নেবার ভান করে কাকলি। “চকোলেট। তুমি খাবে না আপা?” নিশ্চয়ই খাবো। বকুল গলায় খানিকটা গাম্ভীর্য এনে, যেন সত্যি সত্যি আইসক্রিমের অর্ডার দেয়, “এদিকে দুটো আইসক্রিম। একটা চকোলেট, আরেকটা স্ট্রবেরি, প্লিজ্।”
মনে মনে খাওয়া-বেড়ানোর মজার খেলাটা খেলতে খেলতে, দু’বোন কখন ঘুমে তলিয়ে যায় খেয়াল থাকে না।
৪.
গভীর রাতে ধাক্কা দিয়ে কেউ ঘুম ভাঙায় বকুলের। চমকে, ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে দেখে মা। খুব নীচু স্বরে মা জানায়, “রাত তিনটে বাজলো, কমল তো এখনও এলো না বকুল?” ব্যবসার কাজ নিয়ে ভাইয়ের ব্যস্ততার কথা বকুলের জানা। প্রতিরাতেই দেরি হয় কমলের ফিরতে। কিন্তু এত রাত করেনি কখনও। ওঠে বসে মাকে আস্বস্ত করে, “বুঝোই তো নতুন ব্যবসার কত রকমের কাজ থাকে। আজ হয়ত বাড়ি ফিরবে না কমল। তুমি শুয়ে পড়ো মা।” অন্ধকারে বকুলের দেখা হয় না মায়ের শুকনো মুখ। সারাদিন খাটাখাটুনিতেই যায়, তাঁর বিশ্রাম তো তেমন হয়না। ছেলেকে নিয়ে এক সাথে খাবেন বলে রাতের খাওয়াটাও হয়নি তাঁর। বারোটার দিকে খুব ক্ষিদে পেয়েছিল, এখন সেটা চাপা পড়ে গেছে। আর খেতে ইচ্ছেও করছে না। বকুলের কথায় আস্বস্ত হয়ে, একগ্লাস পানি খেয়ে মাজেদা বেগম শুয়ে পড়েন।
খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস মাজেদা বেগমের। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। যদিও রাতে ঘুম ভালো হয়নি। গ্যাস্ট্রিকের পুরনো ব্যথার অস্বস্তিতে প্রায় সারা রাতই তাঁর র্নিঘুম কেটেছে। স্বামী নাস্তা খেয়ে অফিস চলে গেলে খানিকটা গড়িয়ে নেবেন। ছেলেটা রাতে বাড়ি ফিরেনি, সেটা নিয়েও চিন্তা হয়। নাস্তা তৈরি করে, টুকটাক কিছু কাজ সারেন স্বামী গোসল সেরে আসতে আসতে। সংসারে কাজের তো শেষ নেই। কাজের মানুষ রাখা খরচের ব্যাপার। সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়। বকুল মায়ের কাজে অনেক সাহায্য করে। মেয়েটা না থাকলে একা মাজেদা বেগমের পক্ষে কুলিয়ে ওঠা মুশকিল হতো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে খানিক পথ চলতি মানুষ দেখেন অলস চোখে। সামনের চায়ের দোকানটায় রোজকার মতো জটলা। লোকজন ওখানে চা খায় আর সকালের পত্রিকা পড়তে পড়তে রাজনীতি থেকে শুরু করে হেন বিষয় থাকে না যা নিয়ে আলোচনায় মাতে না। কমলের মতে, ওই দোকানে চা খেতে যাওয়া মানে বাড়তি অনেক জ্ঞান নিয়ে বাড়ি ফেরা। বন্ধুরা আসলে ওখানে গিয়ে বসে কমল মাঝে মধ্যে।
গোসল সেরে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে খেতে বসেন রহিম সাহেব। নাস্তার আয়োজন খুব সামান্য। রাতের সবজি আর আটার রুটি। নাস্তার পর এককাপ রঙ চা। তাই খুব পরিতৃপ্তির সাথে খেয়ে অফিসে রওনা হন রহিম সাহেব। স্বামী চলে গেলে মাজেদা বেগম নিজেদের শোবার ঘরে আসেন, একটু গড়িয়ে নেবেন। মাত্রই বিছানায় গা এলিয়েছেন, এমন সময় দরজায় কারো ধাক্কার আওয়াজে ওঠে বসেন। মেয়েরা এখনও ওঠেনি কেউ। নিজেই ওঠে দরজা খুলে দেখেন, পেছনে কিছু কৌতূহলী মুখ নিয়ে দু’জন পুলিশ দরজায় দাঁড়িয়ে। মাজেদা বেগমের বুকটা ধড়াস করে ওঠে, গলাটা মুহূর্তে শুকিয়ে কাঠ। “পুলিশ কড়া গলায় জানতে চায়, আবুল হাসান থাকে এ বাড়িতে?” গলা দিয়ে স্বর না ফোঁটায় মাথা নেড়ে জানান, ‘না’ আবুল হাসান নামে কেউ থাকে না। পুলিশের একজন পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলোর দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকালে তাদের একজন জানায়, “এই বাড়িই, ইনি আবুলের মা।” অকস্মাৎ সম্বিত ফিরে পান যেন মাজেদা বেগম, কমলের ভালো নাম তো ওটাই! দরজায় মানুষের গলার আওয়াজে ততক্ষণে বকুল এসে দাঁড়িয়েছে মায়ের পাশে।
কী হয়েছে প্রশ্ন করতে পুলিশের বয়ানে যা শুনে, তার জন্য ওরা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মায়ের টলে যাওয়া শরীরটা কোনোভাবে আঁকড়ে ধরে বকুল প্রায় চিৎকার করে ওঠে, “অসম্ভব! আমার ভাই মোটেও মাদক ব্যবসায়ী না। ওরা কয়েক বন্ধু মিলে ফলের ব্যবসা শুরু করেছে মাত্রই।” “ওইটা আইওয়াশ, তলে তলে মাদকের বিরাট ব্যবসা। অস্ত্রও পাওয়া গেছে তাদের কাছে। পুলিশের তালিকায় দলটার নাম ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খবর পেয়ে গতরাত আনুমানিক তিন ঘটিকায় তাদের আড্ডাখানায় উপস্হিত হলে, আইনের লোকদের ওপর গোলাগুলি চালিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে, পুলিশ বাধ্য হয় গুলি চালাতে। দলের উপস্হিত তিনজন সদস্য ছিল। তিনজনই নিহত। দলে আর কে কে আছে, নামগুলো জানা প্রয়োজন। আপনাদের থানায় আসতে হবে….. ’’
৫.
কমলদের দুই কামরার বাড়িতে সেদিন বিকেল নাগাদ প্রচুর মানুষের ভীড়বাট্টা। এর মধ্যে বাড়িওয়ালা এসে রাগত স্বরে, জানিয়ে গেছেন,“ছিঃ ছিঃ কেমন মানুষকে ভাড়া দিয়েছি জানতাম না! সামনের মাসে বাড়িটা ছেড়ে দিলে ভালো হয়।”
অথচ এই মানুষই দু’দিন আগে তার কুকুরটা যখন গাড়ি চাপা পড়ে, আর সেই কুকুরকে সুচিকিৎসা দেবার তাগিদে কমল প্রাণান্তকর চেষ্টা করে কুকুরটার প্রাণ বাঁচায়, তখন তিনি কমলের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, “ বুকের ভেতর সেরকম দরদী মন না থাকলে ইতর প্রাণীর জন্য কেউ এতটা করে না। সামান্য কুকুরের জন্য যে এত মায়া বয়ে বেড়ায়, মানুষের প্রতি তার মমত্বের গভীরতা কতটা বেশ বোঝা যায়। তুমি সত্যিই প্রশংসাযোগ্য বাবা।” সেদিন উপস্হিত অনেকেই তার কথায় সহমত জানিয়ে, কমলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় সরব হলেও, আজ এরকম পরিস্হিতিতে বাড়ি ছেড়ে দেবার অমানবিক ঘোষণায় কাউকে তেমন উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায় না।
উদ্ভূত পরিস্হিতির কারণে হোক, কিংবা যেদিকে হাওয়া সেদিকে পাল তুলে দেয়ার মানুষের চিরায়ত স্বার্থপর স্বভাবের কারণে হোক, এ মুহূর্তে মহল্লার উপস্হিত সমবেত মানুষগুলো নীরবতা পালনকে বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনায় চুপ থাকেন। কিন্তু একই পাড়ায় থাকার সুবাদে এরা প্রায় প্রত্যেকেই জানেন কমল এমন কাজে জড়িত হবার ছেলে না। তাদের অভিজ্ঞ চোখে ছেলেটার আচরণের কোন খুঁত ধরা পড়েনি কখনও। আর দশটা কম বয়সী ছেলে-ছোকরাদের চেয়ে কমল আলাদাই ছিল বলা যায়। চলতি সময়ের খোঁজ খবর তারাও রাখেন বৈকি। প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত ক্রসফায়ারে মাদকবিরোধী কিংবা সন্ত্রাসী পরিচয়ের আড়ালে সত্যিকার অপরাধীর পাশাপাশি, অনেক নিরাপরাধীর জীবনও যে ঝরে পড়ছে, সে সত্যিটা তো তাদেরও জানা। কথিতবন্দুক যুদ্ধের নামে নির্বিচারে ছোঁড়া গুলিতে কমলের মায়ের মতো আরো কত মায়ের কোল খালি হয়ে যাচ্ছে …
আরো আশ্চর্যের কথা, কথিত কোনো অপরাধীকে আজ পর্যন্ত জীবিত অবস্হায় আইনের মুখোমুখি করা যায়নি..বন্দুক যুদ্ধে সবাই নিহত… মৃতরা হয়ত সব প্রশ্নের উর্দ্ধ চলে যায়, কিন্তু পেছনে রেখে যাওয়া তাদের হতভাগ্য পরিবারগুলো নিক্ষিপ্ত হয় জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। রাহুগ্রস্হ এক সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাধারণ জনতা কেমন এক বিপন্নবোধে আক্রান্ত যেন। আজ যে মানুষ এক পরিবারের কোল খালি হওয়ার সম্মিলিত শোকে শরিক, সে মানুষটাও তো এতটা নিশ্চিত নন যে, কাল তার বাড়ির উঠোনে এমন হতবিহ্বল শোকগ্রস্হ মানুষের ভীড় জমবে না।
বিধ্বস্ত রহিম সাহেব বোবা বসে থাকেন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেন কৌতূহলী মুখগুলো। ভেতরের ঘর থেকে তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গীর বুকফাটা আর্তনাদ ভেসে আসছে, তিনি শুনতে পান। কিন্তু ওঠে গিয়ে সান্ত্বনা দেবার শক্তিটুকু অবশিষ্ট না থাকায় নিথর বসে থাকেন।
কমল বি এ পাশ করে সুবিধা মতো চাকরি জুটাতে পারেনি। কম কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি ছেলেটাকে। তিনটে টিউশনি করেছে, খামোখাই আড্ডাবাজিতে সময় ব্যয় না করে। কিন্তু কোনো দিন বাবার কাছে হাত পাতেনি। তাঁর নিজের মধ্যে বিন্দুমাত্র অসততা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু কমলের মধ্যে সেরকম আভাস কোনোদিন দেখেছেন বলে মনে পড়ে না। তাঁর ছেলেকে তিনি চেনেন না? আজকে হুট করে কিছু মানুষের বানোয়াট বয়ানে তাঁর জানাটা মিথ্যে হয়ে যায় না! তিনি অন্তত ভুল বুঝবেন না তাঁর ছেলেকে।
….আহা, কত নির্মমভাবে ছেলেটার বুকটা ঝাঁঝরা করেছে গুলিতে। তাঁর বুকটা খালি হয়ে গেলো। প্রতি ঈদে বাবা ছেলে নামাজ শেষে কোলাকুলির সময় রহিম সাহেব ইচ্ছে করে ছেলেকে বুকে জাপটে থাকতেন একটু সময় নিয়ে। কমলও বাবার বুকে নিজেকে সঁপে দিতো কেমন! ওর মুখে সব সময় মিটিমিটি একটা হাসি লেগে থাকতো। ছুটে আসা বুলেট যখন ওকে বিদ্ধ করেছিল, তখনও লেপ্টে ছিল ঠোঁটের হাসিটা? রহিম সাহেবের মনে হয় ডাক দিলেই কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণে ব্যর্থ মানুষের অবয়ব নিয়ে ছেলেটা ঠিক সামনে এসে দাঁড়াবে। যেন সেরকম একটা আশা নিয়ে, গলায় স্বর ফোঁটানোর চেষ্টা করেন তিনি। অদ্ভূত জান্তব একটা কিছু আছড়ে পড়ে তাঁর গলা ফুঁড়ে। সমবেত মানুষেরা বোবা দৃষ্টি মেলে দেখে, এক অসহায় বাবা হাঁটু মুড়ে ভেঙে পড়ছেন অসহ্য যন্ত্রণায়। কান্নার দমকে তাঁর শরীরটা কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠছে….
নাহার তৃণা
১.
বিয়ে বাড়ির সুবাসিত রান্নার সুগন্ধে গোটা মনেশ্বর রোড এলাকাটা ম ম করছে। গন্ধ, তা সেটা ভালো কিংবা মন্দ যাইহোক না কেন, গণ্ডী কেটে রুখে দেবার সুযোগ তেমন একটা নেই। তাই দাওয়াত বঞ্চিত ভাড়াটে পরিবারগুলোর নাসারন্ধ্রে বাতাস স্বপ্রণোদিত হয়ে সে সুগন্ধ পৌঁছে দেয়। এ পাড়ায় অলিখিত একটা নিয়ম চালু রয়েছে, বাড়িওয়ালা পক্ষ ভাড়াটেপক্ষকে তাদের কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত থাকেন। অবশ্য শোকাবহ অনুষ্ঠান যেমন মৃতের জন্য দোয়া, চল্লিশা ইত্যাদিতে ভাড়াটিয়াদের সামিলের মহত্ত্ব দেখাতে কুন্ঠা দেখান না বাড়িওয়ালাগণ। আনন্দ আর শোক বন্টনে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার মধ্যে এই অদ্ভূত সীমারেখা কাকলিরা আর কোথাও দেখেনি।
ভাড়া বাড়ির অভিজ্ঞতা ওদের পরিবারের কম নেই। সেরকম অনেক বাড়িওয়ালার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক পর্যন্ত গড়িয়েছে, ভাড়ার বাড়ি ছেড়ে এলেও অনেকের সাথে এখনও যোগাযোগ বর্তমান। কাকলির এক নানা, যিনি আদতে মা-বাবার বিয়ের পর পর নতুন ভাড়াটে হিসেবে ওঠা বাড়ির বাড়িওয়ালা ছিলেন, তিনি মা কে মেয়ে বানিয়েছিলেন। সে সূত্রে কাকলিরা তাঁকে নানা ডাকতো, অবশ্য কাকলি তাঁকে বেশিদিন দেখেনি। কয়েক বছর আগে সেই নানা মারা গেছেন।
অথচ এই এলাকার কেমন অদ্ভূতুড়ে নিয়ম। সুগন্ধে পাড়া মাত করে লোভ জাগানো হবে, কিন্তু তার স্বাদ নেবার বেলায় যত বাধা। ভালো ভালো খাওয়ার প্রতি কাকলির নিদারুণ দুর্বলতা। তার ছাপোষা চাকুরে বাবার পক্ষে সম্ভব হয় না মাছ মাংসের যোগান দেয়া। কচুঘেঁচুই প্রায় সারা বছর মুখ বুঁজে খেয়ে যেতে হয়। মুখের স্বাদ পালটানোর জন্য এরকম বিয়ে বাড়ির সুখাদ্য খাওয়ার লোভে মন আঁকুপাঁকু করলে খুব দোষ দেয়া যায় না। কাকলি উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে বড় আপার হাতের কাজ শেষ হলো কিনা। আপার কাজ শেষ হলে কাকলির দুঃখী ভাব কিছুটা কমে। আপা এসে দারুণ খেলাটা শুরু করবে। কাকলি খুব মজা পায় খেলাটা খেলে।
কাকলিরা তিন ভাইবোন। বড় আপা বকুল, ভাইয়া কমল, আর কাকলি। বয়সের তুলনায় কাকলির বুদ্ধি কিংবা শরীর কোনোটাই তেমন পাকেনি। চোদ্দ পেরিয়ে পনেরোতে পড়লো এ মাসে। টেনেটুনে কোনোরকমে ক্লাস সেভেনে ওঠেছে। পড়ালেখা সে করে ঠিকই, কিন্তু সব কেমন গুলিয়ে যায়। কিছুই মনে রাখতে পারে না। এই বয়সী একটা মেয়ের শরীরে নারী হয়ে ওঠার লক্ষণগুলো আরো অনেক আগেই জানান দেবার কথা। কাকলির শরীরে সে রকম কোনো জোয়ারের লক্ষণ নেই। অপুষ্টির ভাটায় সেটা আটকে গেছে, নাকি ওর শারীরিক কোনো সমস্যা আছে, সে ব্যাপারে পরিবারের কারো তেমন মাথা ব্যথা নেই। সামর্থ্য না থাকায় উদাসীনতার কাছে নতিস্বীকার করে নিতে হয়েছে। কারণ সেরকম চিকিৎসার জন্য যার স্মরণাপন্ন হলে একটা বিহিতের সম্ভাবনা ছিল, তেমন একজন ডাক্তারের কাছে পৌঁছানোর মতো রসদ কাকলির বাবার পকেটে থাকে না। যে বেতন পান কাকলির বাবা, তার বেশির ভাগটাই বাড়ি ভাড়ার পেছনে ব্যয় হয়। পকেটে অতি সামান্য যেটুকু থাকে তা দিয়ে সারা মাসের সংসার তেল ফুরিয়ে যাওয়া কুপিবাতির মতো পিটপিট করে চলে। অভাবের সাথে কাকলিদের জন্মের সখ্যতা।
কাকলির ভাইটা চাকরির নাম করে সারাদিন বাইরে বাইরে কাটিয়ে রাতের খাওয়ার আগে আগে বাড়ি ফিরে। মা সংসার বিষয়ে ছেলের এমন আলগা ভাব দেখে গজগজ করেন প্রায়। সারাক্ষণ সংসারের সাথে সেঁটে থাকার কারণে তাদের যেভাবে হামুখো অভাবের মুখনাড়া দেখতে হয়, ছেলে তার বাইরে থাকলেও সংসারের নড়বড়ে অবস্হাটা যে বুঝে না, তা তো না। উপার্জনের রাস্তায় গিয়ে কবে যে বাবার ভরসা হবে তারও কোনো কূল কিনারা নেই। টিউশনির বেতনের অতি সামান্য কিছু মাঝে মধ্যে কমল মায়ের হাতে দেয় বটে। কিন্তু সে মরুভূমিতে একফোটা পানি যেন।
কাকলির বড় আপার হাতের কাজের বেশ সুনাম। আশেপাশের অনেকেই তার কাছে সেলাই ফোঁড়াই করায়। তা থেকে মোটামুটি আয় হয়। পালা পার্বণে প্রচুর সেলাইয়ের অর্ডার আসে, রোজগারও সেসময় বেশ ভালো হয়। রোজগারের প্রায় সবটাই আপা মায়ের হাতে তুলে দেয়। মা,সে টাকা থেকে সামান্য কিছু সরিয়ে একটা দুধের কৌটায় জমায়। নিজেরা সারা মাস কচুঘেঁচু খেয়ে টাকা জমানোর মানে বুঝে না কাকলি। ওই টাকায় দিব্যি পোলাওয়ের সুগন্ধী চাল, গোশত্ হয়ে যাবার কথা। ঈদ ছাড়া তাদের বাড়িতে পোলাও গোশত্ রান্না হয় না। একদিন একবেলা উৎসব ছাড়াই পোলাও কোর্মা খেলে কী ক্ষতি হয়! কিন্তু সে কথা মাকে বলতে গেলেই বিপদ। হয় কিল চড় খাবে, নয়তো গালাগালির চূড়ান্ত। বিয়ে বাড়িতে কতসব মজাদার রান্না হচ্ছে, অথচ ভাগে পাবে না, সে দুঃখে মুখ চূণ করে বারান্দায় ঘুরঘুর করতে থাকা কাকলি অযাচিতভাবেই মায়ের বকুনি খেয়ে বসে, “গতরখাকির আর কিছু না থাকুক নোলা আছে ঠিকই। বই নিয়ে একটু পড়তে বসলে কী হয় তোর?”
মা এত গালাগালি করতে পারে বাবা রে বাবা! এমন এমন গালি দেয় যার সবটার অর্থও জানেনা কাকলি। আশ্চর্যের কথা পরিবারের আর কারো প্রতি মায়ের এতটা ক্ষোভ ঝরতে দেখেনা। মায়ের যত রাগঝাল সব যেন তার প্রতি। কাকলি কী করে বুঝবে, সংসারের ঘায়ে নাস্তানাবুদ অসহায় মা তারচে’ আরো খানিক অসহায় অবস্হানে থাকা মেয়ের উপর নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়ে মনকে শান্ত রাখার ছুতো খোঁজেন!
সে রাতে ঘুমাতে গিয়ে বড় আপাকে জিজ্ঞেস করে, “আপা গতরখাকি অর্থ কী রে?” ওর প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে বড় আপার চোখ ভরে গিয়েছিল পানিতে। কেউ দেখলে ভাবতো বড় আপা বুঝি কাঁদছে। বড় আপাটা সময় অসময়ে হাসিখুশিতে ভরে ওঠতে পারে। ও যেন নিজের ভেতরে সুখ নামের একটা নদী বয়ে বেড়ায়। বড় আপার কাছাকাছি থাকলে কেমন শান্তি শান্তি লাগে। মন খুশিতে ভরে ওঠতে সময় লাগে না। কাকলি বড় আপাকে মায়ের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। বড় আপা কখনও মনে দুঃখ দেবার মতো কথা বলেনা ওকে। গালি কী জিনিস জানেই না হয়ত।
কাকলির গালে টুকুশ করে একটা চুমু এঁকে দিয়ে বড় আপা জানতে চায়, “এটা মা বলেছে বুঝি? হা হা…ওর মানেটা না খুব মজার জানিস পুট্টুশ!” বড় আপা কাকলিকে পুট্টুশ নামে ডাকে। নামটা খুব পছন্দ কাকলির।“ ওর কাকলি নামটা ছোটো করে কা কা ডেকে ক্লাসশুদ্ধ সবাই মজা করে। ওর সব কিছু নিয়ে মজা করতে ক্লাসের সবার ভারী আনন্দ। কাকলির তাই স্কুলে যেতেও ইচ্ছে করে না। স্কুলে ওর কোনো বন্ধু নেই।
“যাহ! গালি আবার মজার হয় নাকি!” “খুব হয়। ওর মানে হচ্ছে আলসে কুঁড়ে। এটা মজার না বল?” আলসে কুঁড়ে বিষয়টাকে এমন বিদঘুটে শব্দে মুড়ে দেয়া হলো কেন, মাথায় আসে না কাকলির। “মা তবে খুব ভুল কিছু বলেনি, বলো আপা? আমি তো আলসেই…” কেমন এক মায়া নিয়ে বোনকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বড় আপা বলে, “তোর মাথায় বিলি কেটে দেই আয়, আরামে ঘুম আসবে।” বড় আপা বোনের মনের মেঘ উড়িয়ে দিয়ে চোখ ভরে ঘুম নামিয়ে দেবার জন্য মাথায় বিলি কাটা শুরু করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় কাকলি। ছোটো বোনের ঘুমন্ত মুখ চুঁইয়ে অপার্থিব এক মায়ার ঝরে পড়া দেখতে দেখতে, কান্নায় দু’চোখ ভরে আসে বকুলের। পৃথিবীর জটিলতা কুটিলতা সম্পর্কে অজ্ঞাত, অপুষ্ট শরীর-মনের বোনটার প্রতি অসীম ভালোবাসায় বড় বোন বকুল নিঃশব্দে কাঁদে। সারাদিন যে মেয়ের মুখের হাসি সরে না, রাতের এই একান্তে এঁটে রাখা হাসিখুশির মুখোশটা খুলে খানিক হাঁপ ছাড়ে বুঝি। এ সময়ে, সে প্রায় নিজের দুঃখ, বোনের দুঃখ,..সংসারের দুঃখ, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে আর কেঁদে আকুল হয়।
২.
বকুলের পানপাতা আকৃতির মুখটা বেশ লাবণ্যে ভরা। সামান্য সাজে ওকে দারুণ দেখায়। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে পড়তে ওর বিয়ের প্রস্তাব আসায় বাবা মা সেটা হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না। কোনো রকম খোঁজ খবর না নিয়েই গ্রামের এক পরিচিত কাকার মাধ্যমে আসা প্রস্তাব লুফে নেন বাবা মা। ছেলে সৌদি আরবে চাকরি করে, জানার মধ্যে এটুকু তথ্যই তাঁরা জানতে পারেন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসার থেকে একটা মুখ কমে যাওয়া মানে বেশ অনেকটা বোঝা নেমে যাওয়া। তাছাড়া পাত্র কিচ্ছু চায় না। মেয়েকে এক কাপড়ে বিয়ে করতে রাজী।
এমন সম্বন্ধ হাতছাড়া করা বোকামি। কাজেই মেয়েটাকে কোনো মতে সৌদি প্রবাসী সেই ছেলের হাতে তুলে দেয়ার ত্বরিত বন্দোবস্ত হয়। বকুলের পিঠাপিঠি ভাই কমল, এভাবে কোনো খোঁজ খবর ছাড়া, দুম করে বোনের বিয়ের পক্ষে ছিল না মোটেও। কিন্তু বাপের ঘাড়ে বসে দু’বেলা অন্ন ধ্বংস করা ছেলের কথার তেমন জোর তো খাটে না। এক্ষেত্রেও খাটেনি। বিয়ের এক সপ্তাহ না কাটতেই বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, বকুল স্বামীর বাড়ি থেকে কোনো রকমে পালিয়ে আসে। আসবার আগে যতটুকু জেনেছে, যার সাথে বিয়ে হয়েছিল, তার আগের পক্ষে কয়েকজন বউ আর বাচ্চা আছে। লোকটা দেশের বাইরে থাকে একথা ঠিক, তবে সেটা সৌদি না মালয়েশিয়া, সেটা নিয়ে খোঁদ বউদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব আছে। এ পর্যন্ত সে কয়টা বিয়ে করেছে তারও সঠিক হদিশ জানা নেই কারো। বিয়ে করে যে বাড়িতে বকুলকে নিয়ে ওঠেছিল, ওটাকে বাড়ি না বলে নারী শরীর বিক্রির আড্ডাখানা বলাই শ্রেয়।
লোকটা, বর্তমান বউয়ের মাধ্যমে আরো কিছু উদ্বাস্তু মেয়ের মাধ্যমে সেবাড়িতে ভালো ব্যবসা ফেঁদেছে। বকুলকে এখানে সে ধান্ধায লাগানোর মতলব ছিল না। ওকে বিদেশে নেবার ব্যবস্হা চলছিল। এ ধান্ধায় কয়েক বছর পর পর লোকটা দেশে আসে। অসহায় গরিব ঘরের চটক আছে, বিদেশের বাজারে ভালো বিকোতে পারে, এমন মেয়ে বিয়ে করে দালালের মাধ্যমে বিয়ে করা বউ সুবিধা মতো দেশে পাচার করে। নারী শিশু পাচারের সাথে জড়িত চক্রের সদস্য লম্পটটা। ভাগ্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে, বলা যায় তার জোরে বকুল বেঁচে যায় অবিশ্বাস্যভাবেই। নইলে মাত্র কয়দিনের পরিচয়ে, বকুলের প্রতি ওবাড়ির এক মেয়ে, পুস্পরানীর কেন এমন মায়া জন্মাবে? যে জীবনে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সে জীবন থেকে বেরিয়ে ফিরে যাবার কোনো দরজা তাদের জন্য খোলা নেই। অথচ খায়রুলের সদ্য বিয়ে করা নিষ্পাপ বউটার বাবা-মা, ভাই-বোন, সব শুদ্ধ একটা পরিবার আছে, তাও এই শহরেই। এমন একজনের জীবন যদি তার কারণে রক্ষা পায় সেটাও তো কম আনন্দের না। এমন মহৎ ভাবনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লম্পটটা যখন বাইরে যায় সে সুযোগে, অন্যদের অলক্ষ্যে পুস্পরানী, বকুলকে পালিয়ে আসতে সাহায্য করে।
এমন সর্বনাশা পরিস্হিতির খবর জেনে বকুলের সহজ সরল মা বাবা যেন পাথর বনে যান। সবটা সামাল দেয় কমল আর তার বন্ধুরা। বন্ধুদের পরামর্শে নিরাপত্তার জন্য, প্রথমে পুরনো বাড়িটা ছেড়ে দেয়া হয়। হুট করে স্বল্প ভাড়ার বাড়ি পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা না। তাই কিছুদিনের জন্য প্রায় বস্তির মতো এক এলাকায় পাওয়া চালাঘরে গিয়ে উঠতে হয় ওদের। থানায় গিয়ে পুলিশকে ঘটনার বিস্তারিত জানাতে ভুল হয় না। বিয়ের পর খায়রুল নামের ভণ্ডটা যে ঠিকানায় বকুলকে নিয়ে ওঠেছিল,পুলিশ সেখানে গিয়ে কাউকে পায়নি। সে বাড়ি ফাঁকা। সে ঘটনার মাস ছয়েক পর বকুলেরা বস্তি এলাকা ছেড়ে মোহাম্মদপুরের দিকে বাসা ভাড়া নিয়েছিল। সেখান থেকে মনেশ্বর রোডের এই বাড়িতে এসেছে প্রায় তিন বছর হতে চললো।
খায়রুল নামের জলজ্যান্ত একটা লোকের কোনো হদিশই আর পাওয়া গেলো না। ভণ্ডটা স্রেফ উবে গেলো যেন! গ্রামের সেই পরিচিত আত্মীয়, যার মাধ্যমে সম্বন্ধ এসেছিল, তার সাথে যোগাযোগের পর বোঝা যায়, বেচারা বাস্তবিকই অজ্ঞ ছিলেন সমস্ত বিষয়ে। পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা হয়ত তেমন করে আর কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু বকুল তার জীবন থেকে ওই সাতটা দিনকে শত চেষ্টাতেও মুছে ফেলতে পারেনি। যে বিভীষিকাময় জীবনের সামান্য ঝলক সে প্রত্যক্ষ করেছে, চাইলেও বকুল সে স্মৃতি ভুলতে পারবে না। আবার বিয়ের জন্য বাবা মা অতটা সরব না হলেও, জীবনের জন্য যে সেটা প্রয়োজনীয়, তাঁদের এমন ইঙ্গিতে বকুল চুপ থাকা শ্রেয় মনে করে। মা বাবা আর কয়দিন। তারপর অসহায় বোনটাকে নিয়ে তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এমন ভাবনা যে আসে না মনে, তা না। যা হয় হবে, এমন ভাবনার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে জীবনের মহার্ঘ মুহূর্তগুলো।
এ ঘটনা যখন ঘটে, কাকলি তখন দশ বছরের। তার বুদ্ধিহীনতার আর্শিবাদে মানুষের নীচুতা আর নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে তেমন কিছু বুঝে ওঠা ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি। হঠাৎ বিয়ে হয়ে বড় আপার তাদের ছেড়ে চলে যাওয়ায় কাকলি সবচে’ বেশি কষ্ট পেয়েছিল। তার অবিরাম কান্নায় সবাই দিশেহারা। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সামনে গোশত পোলাওয়ের প্লেট ধরে তাকে ভোলানো হয়েছিল। বড় আপা ফিরে আসায় তাই সে দারুণ খুশি। কাকলির ধারণা, বড় আপার বর বিদেশে থাকে, আসবে একদিন। প্রায় সে বড় আপার কাছে জানতে চায়, “ দুলাভাই কবে আসবে রে আপা?” বোনের গলা জড়িয়ে বকুল এমন ভাব করে যেন সে কথায় তার ভারী আহ্লাদ হচ্ছে। হেঁয়ালি করে বলে, “চলে আসবে যে কোনো দিন। সেদিন বাড়িতে পোলাও মুরগি রান্না হবে জম্পেশ করে বুঝলি পুট্টুশ!” অনাগত সেই সুখের দিনটা মনে করে এখনই নাক টেনে কাকলি বাতাসের বুক থেকে সুগন্ধ শুষে নিতে চায়। আপার শেখানো খেলা থেকে এই ভঙ্গীটা সে ভালোই রপ্ত করেছে। ওর এমন ভঙ্গীতে বকুলের মুখোশে ঢাকা মুখ থেকে খিল খিল হাসির হল্লায় চারপাশটা ভরে ওঠে। ঝিনুক কষ্ট সয়ে কাকলির বড় আপা হাসিতে মুক্তা ফলায়।
৩.
কাটছাঁটে বেঁচে যাওয়া দামী কাপড়ের টুকরো যারা সেলাই করতে দেন, তাদের কাছ থেকে চেয়ে জমিয়ে রাখে বকুল। টুকরোগুলো জুড়ে জুড়ে চমৎকার ডিজাইনের একটা ফ্রক বানিয়ে দেবে কাকলির জন্য। ওরকম কাপড়ের একটা জামা পেলে বোনটা কত খুশি হবে ভাবতেই ভালো লাগে। অর্ডারে আসা সেরকম কাপড় দেখিয়ে, বকুলকে প্রায় জিজ্ঞেস করে কাকলি, “এগুলোর খুব দাম না রে আপা?” কাকলির জামা কাপড় সব বকুল তৈরি করে দেয়। সস্তা ছিট কাপড়, বা মায়ের পুরনো শাড়ি কেটে তৈরি হয় সেগুলো। ঈদের জন্য তৈরি সস্তা কাপড়ের জামাতে ফুল তুলে দেয় যত্ন করে। সামান্য সেসব আয়োজনে বোনের আনন্দ দেখে বকুলের মনে হয়, পৃথিবীর সবাই যদি ওরকম অল্পে সন্তুষ্ট হতে জানতো, তবে প্রচুর চাহিদার লোভে পড়ে কিছু মানুষ হয়ত অমানুষে পরিণত হতো না। সামনের ঈদে কাকলির জন্য দুটো জামা বানাবে বকুল। এখনই সেটা জানাবে না বোনকে। ঈদের আগের দিন কাকলির জন্মদিন। সে উপলক্ষ্যে বোনটাকে নতুন এক জোড়া জুতো কিনে দেয়া যায় কিনা সেটাও ভাবছে। এক জুতো পরেই স্কুল কিংবা বাইরে যাওয়া আসা করতে হয়। অবশ্য ওরা বেড়াতে সেরকম যায় আর কোথায়। কুটুম্বিতা রক্ষা করাটা ওদের মতো প্রায় হতদরিদ্রদের জন্য বিলাসিতার নামান্তর। কদাচিৎ এবাড়িতে আত্মীয় স্বজনের আগমন ঘটে।
কালো চামড়ার একজোড়া জুতোর কী রকম দাম, কমলের পক্ষে সম্ভব হলে জেনে আসতে বলবে। বাবার জন্যও একজোড়া স্যাণ্ডেল স্যু কেনা খুব জরুরী। বাবা তো নিজের দিকে একদমই তাকান না। বছর তিন আগে কেনা জুতো জোড়ায় তাপ্পি মেরে মেরে চলছে। গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতেই ওই এক জুতো পরে বাবাকে কাজে যেতে হয়। বকুল নিজে গিয়েও জেনে আসতে পারে। কিন্তু গাওছিয়া যেতেও তো বাড়তি খরচ, পায়ে হাঁটা দূরত্বে জুতোর কোন দোকান নেই আশেপাশে। সে কারণে নিজে যেতে চায় না বলে কমলের স্মরণাপন্ন হওয়া। কিন্তু ভাইটার চেহারাই তো দেখা যায় না আজকাল। চাকরির চেষ্টায় সুবিধা করতে না পেরে, কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে চেষ্টা করছে। কমলের সেরকম পুঁজি দেবার সামর্থ্য নেই, কায়িক শ্রম বেশি দিয়ে পুষিয়ে দিচ্ছে।
মা জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র হবার সমূহ সম্ভাবনা। বকুল তার সোনার চেনটা বিক্রি করে, আর প্রতিবেশি পারুলভাবীর কাছ থেকে হাজার পাঁচেক টাকা ধার নিয়ে, কমলের ব্যবসার জন্য সামান্য কিছু টাকার ব্যবস্হা করে দিয়েছে। পারুলভাবীর পাঁচ হাজার পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত, যাবতীয় কাপড় এখন থেকে বিনা পয়সায় সেলাই করে দেবে, এমন শর্তে টাকাটা ধার নিয়েছে। ভাইয়ের ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলে টাকাটা আগেও দিয়ে দিতে পারে। পারুল ভাবীর অত তাড়া নেই অবশ্য। স্বামী স্ত্রী দু’জনে ভালোই উপার্জন করেন তারা। কমলেরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঢাকার বাইরে ফলের বাগান লিজ নিয়েছে। সেখানে থেকে ফল এনে ঢাকার বাজারে সাপ্লাই দেবে। লাভ নাকি বেশ ভালো এ ব্যবসায়। সে কাজে ভাইটা দিনরাত প্রচুর খাটছে। ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে সংসারেও দিতে পারবে কমল।
***
দরজায় আসা মাছওয়ালার কাছ থেকে নরম হয়ে আসা পাঁচ মিশালি মাছের একটা ভাগ বেশ সস্তায় কিনে মাজেদা বেগম বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে যান। শেষ বিকেলের এ সময়ে প্রায় নষ্ট হতে বসা মাছ বিক্রির আর তেমন আশা নেই দেখে, মাছওয়ালাকে যে দাম বলা হয়েছে তাতেই সে রাজী হয়ে যাবে ভাবেননি মাজেদা বেগম। তেল মশলা আর একটু বেশি ঝাল দিয়ে চচ্চড়ি রান্ধবেন। বকুলের বাবা খুব পছন্দ করেন ছোটো মাছের চচ্চড়ি। অবশ্য স্ত্রীর হাতের যে কোনো রান্নাই তার পছন্দের। এখন মানুষটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে তার তুচ্ছ সব রান্নারও উচ্ছ্বিত প্রশংসা করতেন। ভালো পদ আর রান্না হয় কোথায়।
একঘেয়ে শাকপাতা আর সবজির ঘন্ট, এই তো তাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা। সেগুলোই মাজেদা বেগমের হাতের গুণে সুস্বাদ পায়। সামান্য তেল মশলায় মাজেদা বেগম বেশ গুছিয়ে রাঁধতে পারেন। তিনি নিশ্চিত, ছোট মেয়ে কাকলি আজ রাতে এক হাতা ভাত অতিরিক্ত খাবে। ভালো মন্দ খাওয়ার প্রতি এত লোভ মেয়েটার! ভাবনাটায় ওর ঠোঁটে মৃদু কাঁপন ধরিয়ে মিলিয়ে যায়... বিলাপের সময় নেই। ভাত বসাতে হবে। মানুষটা সারাদিন শেষে জ্বলেপুড়ে বাড়ি ফিরবে। অফিস থেকে ফেরার পর সামান্য রং চা আর দুটো টোস্ট বিস্কুট দিলেও আজকাল আর খেতে চায় না। কাকলিকে ডেকে পাশে বসিয়ে খাওয়ায়। মেয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এমন ভাবে খায়, যেন অমৃত খাচ্ছে। দু’চোখ ভরে এদৃশ্য দেখতে দেখতে বুকটা ভারী হয়ে ওঠে মাজেদা বেগমের। আজ আর চা হবে না, একেবারে ভাত দেবেন। দ্রুত হাতে ছোটো মাছগুলো বাছতে থাকেন। বকুল এসে মায়ের সাথে হাত লাগায়। মা মেয়ে হাত লাগানোর ফলে দ্রুত মাছ বাছা হয়ে যায়। বকুল রান্না ঘরে আসবার সময় উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে, কাকলি ঘুমাচ্ছে। ঘুমালে ওর অসহায়ত্ব যেন আরো বেশি ফুটে ওঠে। কিংবা ওর খামতিটা জানা বলেই হয়ত সেরকম মনে হয়। বকুল ওর স্বভাব সুলভ খুশি হওয়া গলায় মাকে বলে, “পুট্টুশটা রাতে খেতে বসে আজ তেমন ঘ্যান ঘ্যান করবে না দেখো।” বড় মেয়ের কথায় মুখ টিপে হাসেন মাজেদা বেগম।
রাতের খাবারটা সবাই বেশ চেটেপুটে খেলো। মাজেদা বেগম তৃপ্তির সাথে সবার পাতে একটু বেশি বেশি মাছের তরকারি তুলে দিলেন। খেতে বসে রহিম সাহেব ফুরফুরে মেজাজে অনেক দিন পর স্ত্রীর হাতের রান্নার প্রশংসা করলেন। সামান্য আয়োজনের এই আনন্দ বাড়ির সবগুলো মানুষকে ছুঁয়ে থাকে কেমন। মাজেদা বেগমকে এত বলার পরও বকুলদের সাথে তিনি খেতে বসেননি। কমলের জন্য অপেক্ষা করবেন। ছেলেটা সেই কোন রাতে আসে, তার জন্য ঢাকা দেয়া ঠাণ্ডা ভাত একা বসে খায়। আজ মা ছেলে দু’জনে একসঙ্গে খাবেন। ছেলের তৃপ্তি নিজ চোখে দেখবার লোভেই সবার অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন।
খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে বকুল টুকটাক কিছু সেলাই করে। পাশে শুয়ে শুয়ে কাকলি দেখে। ও ঘরে মা বাবা কী কথায় ব্যস্ত। আজ বাবা মায়ের মন কেমন ভারহীন ফুরফুরে। বাবার একটা প্রমোশনের কথা চলছে। প্রমোশনটা হলে বেতন কিছু বাড়বে। চিরদিন তো আর সবার কষ্টে যায় না, সুদিন দেরিতে হলেও আসে। কমলদের ব্যবসাটাও দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন ওদের পক্ষে কাকলিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। মানুষের স্বভাবই তো তাই, সুদিনের পায়ের আওয়াজ শুনলো কী শুনলো না, নানান সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে জানে বলেই হয়ত শত যন্ত্রণা উজিয়েও বেঁচে থাকে।
কাজ গুছিয়ে বকুল বোনের পাশে শুয়ে শুয়ে তার প্রিয় খেলাটা শুরু করে। “শোন পুট্টুশ, বাবার প্রমোশন হলে আমাদের সামান্য একটু টাকা হবে। ভাইয়ের ব্যবসা ভালো মতো চলা শুরু করলে আরো একটু বেশি টাকা হবে আমাদের। তখন মাসে দু’বার তোকে পোলাও কর্মা রান্না করে দেবে মা। আমরা কোনোদিন কোনো রেস্টুরেন্টে খাইনি। একদিন সবাই মিলে খেতে যাবো। খুব মজা হবে।” আনন্দে কাকলি হাততালি দেয়। খলখল করে খানিক হাসে। ওর আনন্দ আরো একটু উসকে দিতে বকুল বলে, “ চলন্ত সিঁড়িওয়ালা বড় বড় যে সব মার্কেট আছে না? তার একটাতে যাবো। তোর কী পছন্দ বল দেখি? মনে মনে ভাবতে থাক, আমরা এখন বসুন্ধরা সিটি শপিং মার্কেটে। ভয় পাচ্ছিস কেন! এই আমার হাতটা ধর। সিঁড়িতে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকবি চুপটি করে। কিস্যু হবে না বোকা।...এই তো! দেখলি কেমন তরতর করে ওপরে চলে এলাম। প্রথমে তোর জন্য চমৎকার একটা ড্রেস কিনবো, কেমন? কোন রঙ পছন্দ তোর?” আনন্দে আধবোঁজা গলায় কাকলি বলে, “কমলা।” “বাহ্! চমৎকার। ওই দেখ, কমলার মধ্যে সোনালী আর গাঢ়নীল জরি চুমকির কাজের ড্রেসটা, সুন্দর না?” “খুউব সুন্দর রে আপা!” “আইসক্রিম খাবি পুট্টুশ?” ‘খাবো তো।” “হুম চল, কোন ফ্লেভার খাবি?” মাথা চুলকে খানিক ভেবে নেবার ভান করে কাকলি। “চকোলেট। তুমি খাবে না আপা?” নিশ্চয়ই খাবো। বকুল গলায় খানিকটা গাম্ভীর্য এনে, যেন সত্যি সত্যি আইসক্রিমের অর্ডার দেয়, “এদিকে দুটো আইসক্রিম। একটা চকোলেট, আরেকটা স্ট্রবেরি, প্লিজ্।”
মনে মনে খাওয়া-বেড়ানোর মজার খেলাটা খেলতে খেলতে, দু’বোন কখন ঘুমে তলিয়ে যায় খেয়াল থাকে না।
৪.
গভীর রাতে ধাক্কা দিয়ে কেউ ঘুম ভাঙায় বকুলের। চমকে, ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে দেখে মা। খুব নীচু স্বরে মা জানায়, “রাত তিনটে বাজলো, কমল তো এখনও এলো না বকুল?” ব্যবসার কাজ নিয়ে ভাইয়ের ব্যস্ততার কথা বকুলের জানা। প্রতিরাতেই দেরি হয় কমলের ফিরতে। কিন্তু এত রাত করেনি কখনও। ওঠে বসে মাকে আস্বস্ত করে, “বুঝোই তো নতুন ব্যবসার কত রকমের কাজ থাকে। আজ হয়ত বাড়ি ফিরবে না কমল। তুমি শুয়ে পড়ো মা।” অন্ধকারে বকুলের দেখা হয় না মায়ের শুকনো মুখ। সারাদিন খাটাখাটুনিতেই যায়, তাঁর বিশ্রাম তো তেমন হয়না। ছেলেকে নিয়ে এক সাথে খাবেন বলে রাতের খাওয়াটাও হয়নি তাঁর। বারোটার দিকে খুব ক্ষিদে পেয়েছিল, এখন সেটা চাপা পড়ে গেছে। আর খেতে ইচ্ছেও করছে না। বকুলের কথায় আস্বস্ত হয়ে, একগ্লাস পানি খেয়ে মাজেদা বেগম শুয়ে পড়েন।
খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস মাজেদা বেগমের। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। যদিও রাতে ঘুম ভালো হয়নি। গ্যাস্ট্রিকের পুরনো ব্যথার অস্বস্তিতে প্রায় সারা রাতই তাঁর র্নিঘুম কেটেছে। স্বামী নাস্তা খেয়ে অফিস চলে গেলে খানিকটা গড়িয়ে নেবেন। ছেলেটা রাতে বাড়ি ফিরেনি, সেটা নিয়েও চিন্তা হয়। নাস্তা তৈরি করে, টুকটাক কিছু কাজ সারেন স্বামী গোসল সেরে আসতে আসতে। সংসারে কাজের তো শেষ নেই। কাজের মানুষ রাখা খরচের ব্যাপার। সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়। বকুল মায়ের কাজে অনেক সাহায্য করে। মেয়েটা না থাকলে একা মাজেদা বেগমের পক্ষে কুলিয়ে ওঠা মুশকিল হতো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে খানিক পথ চলতি মানুষ দেখেন অলস চোখে। সামনের চায়ের দোকানটায় রোজকার মতো জটলা। লোকজন ওখানে চা খায় আর সকালের পত্রিকা পড়তে পড়তে রাজনীতি থেকে শুরু করে হেন বিষয় থাকে না যা নিয়ে আলোচনায় মাতে না। কমলের মতে, ওই দোকানে চা খেতে যাওয়া মানে বাড়তি অনেক জ্ঞান নিয়ে বাড়ি ফেরা। বন্ধুরা আসলে ওখানে গিয়ে বসে কমল মাঝে মধ্যে।
গোসল সেরে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে খেতে বসেন রহিম সাহেব। নাস্তার আয়োজন খুব সামান্য। রাতের সবজি আর আটার রুটি। নাস্তার পর এককাপ রঙ চা। তাই খুব পরিতৃপ্তির সাথে খেয়ে অফিসে রওনা হন রহিম সাহেব। স্বামী চলে গেলে মাজেদা বেগম নিজেদের শোবার ঘরে আসেন, একটু গড়িয়ে নেবেন। মাত্রই বিছানায় গা এলিয়েছেন, এমন সময় দরজায় কারো ধাক্কার আওয়াজে ওঠে বসেন। মেয়েরা এখনও ওঠেনি কেউ। নিজেই ওঠে দরজা খুলে দেখেন, পেছনে কিছু কৌতূহলী মুখ নিয়ে দু’জন পুলিশ দরজায় দাঁড়িয়ে। মাজেদা বেগমের বুকটা ধড়াস করে ওঠে, গলাটা মুহূর্তে শুকিয়ে কাঠ। “পুলিশ কড়া গলায় জানতে চায়, আবুল হাসান থাকে এ বাড়িতে?” গলা দিয়ে স্বর না ফোঁটায় মাথা নেড়ে জানান, ‘না’ আবুল হাসান নামে কেউ থাকে না। পুলিশের একজন পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলোর দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকালে তাদের একজন জানায়, “এই বাড়িই, ইনি আবুলের মা।” অকস্মাৎ সম্বিত ফিরে পান যেন মাজেদা বেগম, কমলের ভালো নাম তো ওটাই! দরজায় মানুষের গলার আওয়াজে ততক্ষণে বকুল এসে দাঁড়িয়েছে মায়ের পাশে।
কী হয়েছে প্রশ্ন করতে পুলিশের বয়ানে যা শুনে, তার জন্য ওরা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মায়ের টলে যাওয়া শরীরটা কোনোভাবে আঁকড়ে ধরে বকুল প্রায় চিৎকার করে ওঠে, “অসম্ভব! আমার ভাই মোটেও মাদক ব্যবসায়ী না। ওরা কয়েক বন্ধু মিলে ফলের ব্যবসা শুরু করেছে মাত্রই।” “ওইটা আইওয়াশ, তলে তলে মাদকের বিরাট ব্যবসা। অস্ত্রও পাওয়া গেছে তাদের কাছে। পুলিশের তালিকায় দলটার নাম ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খবর পেয়ে গতরাত আনুমানিক তিন ঘটিকায় তাদের আড্ডাখানায় উপস্হিত হলে, আইনের লোকদের ওপর গোলাগুলি চালিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে, পুলিশ বাধ্য হয় গুলি চালাতে। দলের উপস্হিত তিনজন সদস্য ছিল। তিনজনই নিহত। দলে আর কে কে আছে, নামগুলো জানা প্রয়োজন। আপনাদের থানায় আসতে হবে….. ’’
৫.
কমলদের দুই কামরার বাড়িতে সেদিন বিকেল নাগাদ প্রচুর মানুষের ভীড়বাট্টা। এর মধ্যে বাড়িওয়ালা এসে রাগত স্বরে, জানিয়ে গেছেন,“ছিঃ ছিঃ কেমন মানুষকে ভাড়া দিয়েছি জানতাম না! সামনের মাসে বাড়িটা ছেড়ে দিলে ভালো হয়।”
অথচ এই মানুষই দু’দিন আগে তার কুকুরটা যখন গাড়ি চাপা পড়ে, আর সেই কুকুরকে সুচিকিৎসা দেবার তাগিদে কমল প্রাণান্তকর চেষ্টা করে কুকুরটার প্রাণ বাঁচায়, তখন তিনি কমলের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, “ বুকের ভেতর সেরকম দরদী মন না থাকলে ইতর প্রাণীর জন্য কেউ এতটা করে না। সামান্য কুকুরের জন্য যে এত মায়া বয়ে বেড়ায়, মানুষের প্রতি তার মমত্বের গভীরতা কতটা বেশ বোঝা যায়। তুমি সত্যিই প্রশংসাযোগ্য বাবা।” সেদিন উপস্হিত অনেকেই তার কথায় সহমত জানিয়ে, কমলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় সরব হলেও, আজ এরকম পরিস্হিতিতে বাড়ি ছেড়ে দেবার অমানবিক ঘোষণায় কাউকে তেমন উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায় না।
উদ্ভূত পরিস্হিতির কারণে হোক, কিংবা যেদিকে হাওয়া সেদিকে পাল তুলে দেয়ার মানুষের চিরায়ত স্বার্থপর স্বভাবের কারণে হোক, এ মুহূর্তে মহল্লার উপস্হিত সমবেত মানুষগুলো নীরবতা পালনকে বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনায় চুপ থাকেন। কিন্তু একই পাড়ায় থাকার সুবাদে এরা প্রায় প্রত্যেকেই জানেন কমল এমন কাজে জড়িত হবার ছেলে না। তাদের অভিজ্ঞ চোখে ছেলেটার আচরণের কোন খুঁত ধরা পড়েনি কখনও। আর দশটা কম বয়সী ছেলে-ছোকরাদের চেয়ে কমল আলাদাই ছিল বলা যায়। চলতি সময়ের খোঁজ খবর তারাও রাখেন বৈকি। প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত ক্রসফায়ারে মাদকবিরোধী কিংবা সন্ত্রাসী পরিচয়ের আড়ালে সত্যিকার অপরাধীর পাশাপাশি, অনেক নিরাপরাধীর জীবনও যে ঝরে পড়ছে, সে সত্যিটা তো তাদেরও জানা। কথিতবন্দুক যুদ্ধের নামে নির্বিচারে ছোঁড়া গুলিতে কমলের মায়ের মতো আরো কত মায়ের কোল খালি হয়ে যাচ্ছে …
আরো আশ্চর্যের কথা, কথিত কোনো অপরাধীকে আজ পর্যন্ত জীবিত অবস্হায় আইনের মুখোমুখি করা যায়নি..বন্দুক যুদ্ধে সবাই নিহত… মৃতরা হয়ত সব প্রশ্নের উর্দ্ধ চলে যায়, কিন্তু পেছনে রেখে যাওয়া তাদের হতভাগ্য পরিবারগুলো নিক্ষিপ্ত হয় জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। রাহুগ্রস্হ এক সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাধারণ জনতা কেমন এক বিপন্নবোধে আক্রান্ত যেন। আজ যে মানুষ এক পরিবারের কোল খালি হওয়ার সম্মিলিত শোকে শরিক, সে মানুষটাও তো এতটা নিশ্চিত নন যে, কাল তার বাড়ির উঠোনে এমন হতবিহ্বল শোকগ্রস্হ মানুষের ভীড় জমবে না।
বিধ্বস্ত রহিম সাহেব বোবা বসে থাকেন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেন কৌতূহলী মুখগুলো। ভেতরের ঘর থেকে তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গীর বুকফাটা আর্তনাদ ভেসে আসছে, তিনি শুনতে পান। কিন্তু ওঠে গিয়ে সান্ত্বনা দেবার শক্তিটুকু অবশিষ্ট না থাকায় নিথর বসে থাকেন।
কমল বি এ পাশ করে সুবিধা মতো চাকরি জুটাতে পারেনি। কম কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি ছেলেটাকে। তিনটে টিউশনি করেছে, খামোখাই আড্ডাবাজিতে সময় ব্যয় না করে। কিন্তু কোনো দিন বাবার কাছে হাত পাতেনি। তাঁর নিজের মধ্যে বিন্দুমাত্র অসততা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু কমলের মধ্যে সেরকম আভাস কোনোদিন দেখেছেন বলে মনে পড়ে না। তাঁর ছেলেকে তিনি চেনেন না? আজকে হুট করে কিছু মানুষের বানোয়াট বয়ানে তাঁর জানাটা মিথ্যে হয়ে যায় না! তিনি অন্তত ভুল বুঝবেন না তাঁর ছেলেকে।
….আহা, কত নির্মমভাবে ছেলেটার বুকটা ঝাঁঝরা করেছে গুলিতে। তাঁর বুকটা খালি হয়ে গেলো। প্রতি ঈদে বাবা ছেলে নামাজ শেষে কোলাকুলির সময় রহিম সাহেব ইচ্ছে করে ছেলেকে বুকে জাপটে থাকতেন একটু সময় নিয়ে। কমলও বাবার বুকে নিজেকে সঁপে দিতো কেমন! ওর মুখে সব সময় মিটিমিটি একটা হাসি লেগে থাকতো। ছুটে আসা বুলেট যখন ওকে বিদ্ধ করেছিল, তখনও লেপ্টে ছিল ঠোঁটের হাসিটা? রহিম সাহেবের মনে হয় ডাক দিলেই কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণে ব্যর্থ মানুষের অবয়ব নিয়ে ছেলেটা ঠিক সামনে এসে দাঁড়াবে। যেন সেরকম একটা আশা নিয়ে, গলায় স্বর ফোঁটানোর চেষ্টা করেন তিনি। অদ্ভূত জান্তব একটা কিছু আছড়ে পড়ে তাঁর গলা ফুঁড়ে। সমবেত মানুষেরা বোবা দৃষ্টি মেলে দেখে, এক অসহায় বাবা হাঁটু মুড়ে ভেঙে পড়ছেন অসহ্য যন্ত্রণায়। কান্নার দমকে তাঁর শরীরটা কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠছে….
No comments:
Post a Comment