উত্তরপুরুষ
দেবদ্যুতি রায়
এক
এবার এই ‘আগন’ মাসেই কেমন মাঘের মতো শীত পড়েছে। চার পাঁচদিন থেকে সূর্যের দেখা মিলছে না একেবারে। গায়ের ভারি সোয়েটারের ওপর আলোয়ানটা ভালো করে জড়ায় রতন। আজকাল শরীরটা শীত, গরম কিছুই সহ্য করতে পারে না একদম। কে জানে, শীতের এই ক’টা মাস কী করে কাটবে এবার। ওদের এই এলাকায় শীতের তীব্রতা এমনিতেই দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি।
মণ্ডলপাড়ার একেবারে মাঝ বরাবর রতনদের এই ছন্নছাড়া বাড়িটা। এ বাড়ির খাপছাড়া মাপের দুটি ঘরের মাঝখান জুড়ে ছোটমোট বারান্দাটাই আজকাল রতনের সারাদিনের থাকার জায়গা। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ভাঙ্গাচোরা শরীরটা টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এখানেই বসে সে। খাওয়ার লম্বা টেবিলটার মাপে বানানো বেঞ্চটায় বসে থাকে। যখন আর পারে না, শুয়ে পড়ে ওখানেই। খুব মন চাইলে বাড়ির মানুষদের একটু উঠানে নামার কথা জানায়। নড়বড়ে কাঠের চেয়ারটায় উঠানে তখন খানিক সময় বসা হয় ওর। গত বছর পর্যন্ত তবু কলপাড় বা ল্যাট্রিনে যাওয়া আসা করতে পারত একা একা, এবার সেটাও প্রায় অসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। মা, আবার কখনও সখনও সুমিও ওকে ধরে ধরে সব জায়গায় নিয়ে যায় আজকাল।
সইন্দ্যা নাগি গ্যাল রে ব্যাটা। হাট, তোর হাত পাও ধুইয়া আনো- মা’র কথায় বারান্দার বেঞ্চে বসে থাকা জীর্ণ শরীরটা একটুখানি নড়ে ওঠে ওর। না, ও হাঁটতে পারবে না একা একা- শরীরে অত শক্তি নেই ওর। বসেই থাকে রতন, মা’ই এসে নিয়ে যাবে। রোজ সন্ধ্যায় মা ওকে নিয়ম করে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে আসে, তা সে যত ঠাণ্ডাই হোক না কেন। তারপর তুলসীতলার সামনে দাঁডিয়ে মাথাটা নোয়ায় ও। এখনও, কীসের আশায় যে মা ওকে রোজ রোজ ঠাকুরের কাছে মাথা নোয়াতে বলে তা মাথায় ঢোকে না রতনের। তবু ওর কষ্টে থাকা রোগাভোগা মাকে আর কষ্ট দিতে চায় না বলে এটুকু ও মেনে নেয়। সুমি অবশ্য মাঝেমাঝেই ফোঁস করে ওঠে- এহ্! ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম! খাড়ায় থাকির পায় না ফির ঠাকুরের আগোত পুজা করির নাগে! বালের কাহিনী!
ওর ওপর, ওদের সবার ওপর সুমির রাগের যথেষ্ট কারণ আছে বলেই এই সামান্য মুখ খারাপে তেমন একটা কিছু আসে যায় না রতনের। আজও মা’র সাথে কলপাড় থেকে এসে দিব্যি বাধ্য ছেলেটার মতো মাথা নোয়ায় তুলসীতলায়। আজকের ঠাণ্ডাটা কালকের চেয়েও বেশি, সেই ঠাণ্ডায় তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে রতনের অশক্ত শরীর একটু উষ্ণতা চায় এখন। মা ওকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে পুরনো ভারী আর জায়গায় জায়গায় তুলো জমা লেপটা গায়ে জড়িয়ে দেয়। একটু পরেই হাত পা গরমের আরাম পাবে। আপাতত লেপের তলায় মটকা মেরে শুয়ে থাকে ও।
অল্প ক’দিন আগে ওদের বাড়িতে ‘কারেন’ এসেছে। এ পাড়ায় বিদ্যুত সংযোগ পৌঁছেছে আরও বছর দশেক আগে কিন্তু একটা মিটারের খরচ যোগাড় না করতে পারায় ওরা বাড়িতে সংযোগ নিতে পারেনি তখন। এখন অল্প পাওয়ারের টিমটিমে হলদে বাতির আলোয় বেড়ার ঘরটা কেমন অদ্ভুতুড়ে দেখায়। সে আলোর নিচে অতিপুরনো লেপের তলায় আদুরে ওম খুঁজতে খুঁজতে রতন মনে মনে প্রদীপকে খোঁজে। প্রদীপ ওর চার বছরের ছেলে। সারাদিন বলতে গেলে বাপের কাছে আসেই না। আসলে সুমিই ওকে আসতে দেয় না বাপের কাছে, জানে রতন। সেকথা মনে পড়লে অভিমানে বুকটা ভরে যেতে চায় ওর। তবু শেষ পর্যন্ত সে অভিমানকে জমে উঠতে দেয় না ও বুকের ভেতর।
প্রদীপের নাম রেখেছে পারুল, রতনের মা। একমাত্র ছেলের ঘরে বংশের প্রদীপ ও। রতনের শরীরের যা অবস্থা, আর কত বছর এই শরীরে বেঁচেবর্তে থাকবে ও এটাই একটা বিশাল প্রশ্ন। তারপর মণ্ডল গোষ্ঠীর এই দূর্গাচরণ মণ্ডল অর্থাৎ রতনের বাপের বংশের পূর্বপুরুষদের নামে বাতি জ্বালাবার মতো ওই একজনই থাকবে।
মায়ের আশার কথা মনে করে এখনও হাসি পায় রতনের। শুকিয়ে খরখরে হয়ে আসা ঠোঁটে সে হাসি এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় ঝুলে থাকে টিমটিমে বাতিটার নিচে। প্রদীপ ওরফে পোদীপ যে রতনের নিজের ছেলে নয়, সে কি মা জানে না? যে সময়ে নিজের অসুস্থ ছেলের বিয়ে দিয়েছিল মা, সেই সময়ে একটা বাচ্চার জন্ম দেয়ার ক্ষমতা যে আর ছিল না ওর, এটা তো মা’র ভালোই জানার কথা। সুমির বাপ নেহাত নিয্যস গরিব বলেই মেয়ের সাথে এমন রোগাভোগা ছেলের বিয়ে দিয়েছিল। সেই সাথে যোগ হয়েছিল আরেকটা সূক্ষ্মতম লোভ- মণ্ডলবাড়ির সাথে নিজের পরিবারের আত্মীয়তার লোভে; সে লোভেই ওর শ্বশুর যে নিজের ঢলঢলে মুখের দোহারা গড়নের মেয়েটাকে ওর সাথে বিয়ে দিয়েছে, তা রতন সে সময়েই বুঝে গিয়েছিল। ফুলশয্যার রাতে ফুঁসে ওঠা সুমির মুখচোখ দেখে নিজের অক্ষমতার কথাটা আরও ভালো করে মনে পড়েছিল ওর। ওদের এই ছয় বছরের সংসারজীবনে হাতে গোণা কয়েকবার সুমির সাথে ঘনিষ্ঠ হতে গিয়েছিল রতন, প্রতিবারই নিজের না পারার ব্যর্থতায় ফিরে কাঁদতে হয়েছে ওর।
সেই সুমি বিয়ের এক বছর পার হতে না হতেই যখন নিজের মা হবার ঘোষণা দিল, তখন রতনের বুকের ভেতরটা একেবারে ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। এ কার সন্তান? কার ঔরসের ভ্রূণকে রতনের বাচ্চা বলে চালিয়ে দিতে চাইছে ও? সে সময় এক গভীর রাতে বউয়ের হাত ধরে জানতে চেয়েছিল রতন- কার ছওয়া এইটা সুমি? কার ছওয়া তোর প্যাটোত?
সে রাতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চারপাশের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে হেসে উঠেছিল সুমি নামের লম্বা দোহারা মেয়েটা, ওর বউ। তারপর ফিসফিস করে বলেছিল- যেই মরদের ক্ষ্যামতা নাই, অয় পুছ করে ক্যান এই কতা? গুষ্টির মুকোত আগুন দিবার জইন্যে আইসোছে মোর ছওয়া, এইটাই তো বড় কতা।
তা ঠিক। সুমির পেটের ভেতর যে সন্তান তখন তিল তিল করে বাড়ছে সে তো দিনশেষে রতনেরই গোষ্রি মুখে আগুন দেবে, বংশে প্রদীপ জ্বালাবে। সবকিছুর পরে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা বটে। সেই সময় দিনে দিনে সুমির হাসির শব্দ বেড়েছে, গলার তেজ বেড়েছে, রতনের শীর্ণ শরীর আর ক্ষীয়মাণ দৃষ্টির সামনে সুমির রূপও বেড়েছে। উল্টোদিকে ওর শরীরের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে বাড়তে মন খারাপটা যেন বাড়ির পুরনো তালগাছটার মাথার ওপর উঠে গেছে। ছেলের এমন মন খারাপ দেখেই কি না কে জানে, একদিন পারুল বলেছিল ওকে- তোর ব্যাটা একদিন এই বংশোত বাতি জ্বালাইবে, এইটাই সবচায়া জরুরি খবর বাপ!
সেদিন আরও ভালো করে বুঝে গিয়েছিল রতন, এ পৃথিবীতে বংশরক্ষা একটি বিশাল বড় কাজ। সে কাজের জন্য বড় বা ছোট, অনেক বলিদানই মানা যায়। প্রদীপের জন্মের পর পারুল বা দূর্গাচরণের মতো রতনও ওকে বুকে টেনে নিয়েছে। এই চার বছরে এমন অভ্যাস হয়েছে, প্রদীপকে ছাড়া আজকাল দিন কাটতে চায় না ওর। অথচ সুমি ছেলেটাকে প্রায় আসতেই দেয় না ওর ঘরে। আজও, এই অগ্রহায়ণের প্রবল শীতের সন্ধ্যায় ছেলেটা বিছানায় নেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হলে মন খারাপ বাড়ে ওর; শীতের ঠাণ্ডার চেয়েও সে অনুভূতি তীব্রতর।
দুই
মণ্ডল গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা ছিল জোতদার। তাদের ধন সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তির কথা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। জোতদার বংশের চতুর্থ পুরুষ রতন। প্রথম আর দ্বিতীয় পুরুষের কীর্তিমান লোকেরা এখনও বেঁচে আছে এলাকার মানুষের গালগল্পে। এমনকী এই যে এই গ্রামের নাম ‘স্বরূপপুর’ তাও এ বাড়ির প্রথম পুরুষের একজন প্রবল মানুষ স্বরূপচন্দ্র মণ্ডলের নামে। এককালে নাকি বর্ষা হলে যাতে কাদার মধ্যে হাঁটতে না হয় সে জন্য চলার পথে পুরু করে ধান ছড়াতো এ বাড়ির জোয়ানেরা, কর্তাদের হুকুমে! রতন ভাবে- সেই পাপেই হয়ত এ বংশের অর্ধেক বাড়িতে আজ সারা বছরের ধানের যোগানটুকুও থাকে না!
কী বাড়ি কী হয়ে যায়! রতনের বাবা দূর্গাচরণ মণ্ডল ওর ছোটবেলায় কত আফসোস করত পূর্বপুরুষদের ধনদৌলতের গল্প শেষে। আহা রে ! সেই রামও নাই, সেই অযোধ্যাও নাই রে ব্যাটা! যদি আইজ আগের নাকান সউককিছু থাকিল হায়…
আগের মতো সবকিছু কেন নেই, কেন জোতদারগোষ্ঠী আজ কোনোরকমে টিকে আছে এ পাড়ার মাঝ উঠানে ঝড়ের দিনে নুয়ে ভেঙ্গে পড়তে চাওয়া তালগাছটার মতো- এ আক্ষেপ এ বাড়ির প্রায় সবার। নিজেদের অকীর্তির অগৌরব তারা ঢাকতে চায় বাপ পিতামহের বড় বড় নামের মধ্যে। রতনের মনে পড়ে, দুই পুরুষ আগের গৌরবকে আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়া বাপ কাকাদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল ওর চেয়ারম্যান দাদু। সম্পর্কে বাবার জ্যাঠা হয় লোকটা। জোতদারদের দ্বিতীয় পুরুষের এই প্রবল মানুষটাকে ও খুব বেশিদিন দেখতে পারেনি। ওদের ছোটবেলাতেই কেমন একদিন টুপ করে মরে গেল মানুষটা। প্রথম জীবনে স্কুল মাস্টারি করে শেষ জীবনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিল দাদু। আজও দশ গ্রামের মানুষ ললিত চেয়ারম্যানকে চেনে এক নামে। শেষ বয়সে দাদু বলত- পাপ রে, সবই পাপ। গরিব মাইনষোক ধরিবান্দি মারি ডাঙ্গে আদায় করা টাকার পাপ আছে রে ব্যাটা। সেই পাপেই দ্যাখ না, একশো বছরও হয় নাই, বাড়িটা শ্যাষ হয়্যা গেল। এখনও কওচে, ওইলা পুরান কথা ভুলি যায়া নিজের নিজের ব্যবস্থা করো, পড়ালেখা করাও ছওয়াপোয়াগুলাক, মানুষ হউক। তাতে যদি পাপ ছাড়ে!
গরিব মানুষকে মেরেধরে টাকা আদায় করা জোতদার বংশের রক্তের গুণেই হোক আর মাটিতে মিশে মিশে ফসিল হয়ে যাওয়া সেইসব পথে ছড়ানো ধানের অভিশম্পাতেই হোক, এ বাড়ির খুব বেশি ছেলেপুলে মানুষ হতে পারেনি। এমনকী ললিত দাদুর পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট যে, সেই অরিজিৎ কাকুও লেখাপড়া শিখতে পারেনি মোটেই। দাদুর অন্য ছেলেমেয়েরা সব পাশটাশ করে বিভিন্ন চাকুরি করেছে- তাদের ছেলেমেয়েরাও আজ সরকারি বেসরকারি বড় বড় কীসব পদে চাকুরি করে।
রতন জানে, এসএসসিতে দু’বার গাড্ডা মারার পর থেকেই ওর শরীরটা বিগড়ানো শুরু না করলেও ওর অত মেধা ছিল না। ওদের মতো পড়ালেখা করে চাকুরিবাকুরি করতে পারত না ও। তা না পারুক, এই ভাঙতে থাকা গোষ্ঠীটার একজন হয়ে ও দিব্যি সুস্থভাবে বেঁচেবর্তে তো থাকতে পারত! কিন্তু তা আর হলো কই। কী এক অসুখ ওর শরীরটাকে ভেঙ্গেচুরে শেষ করে দিল, প্রথম ক’বছর এ ডাক্তার ও কবিরাজ দেখানোও হলো, কিন্তু ভালো করে ডাক্তার দেখানোর সাধ্য কোথায় ছিল ওর বাপের? ছিল না। রতনের অবাক লাগে ভাবতে যে বাড়ির প্রথম পুরুষের নামে গ্রামের নাম হয়, সে বাড়ির তৃতীয় পুরুষ তার একমাত্র ছেলের অসুখের ঠিকমতো চিকিৎসাও করতে পারে না!
আগে যখন এসব ভাবত, রতনের দুঃখ হতো খুব। পড়ালেখা না শিখে বাপের রেখে যাওয়া জমি ধ্বংস করে করে সংসার চালানোর জন্য ওর অক্ষম বাপ দূর্গাচরণের ওপর কেমন এক অস্থির রাগও হতো। কিন্তু আজকাল আর তেমন কোনো ভাবান্তর হয় না ওর। কে জানে, সত্যিই পূর্বপুরুষের পাপ ওরও জীবনে এসে লেগেছে কি না। আজকাল তাই টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে না পারা বাপকেও ক্ষমা করে দিয়েছে ও। কেবল মার খুনখুনে কান্না মাঝেমাঝে ওকে নতুন করে অসুখী করে দেয়। ওর ক্ষয়াটে দৃষ্টির সামনে একটু একটু করে মাও কেমন আরও বেশি রোগাভোগা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। মার জন্য কষ্ট লাগে রতনের। বাপটা চিরকালই মুখচোরা, ছেলের দুরবস্থা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না একদম। বাপের জন্য অতটা কষ্ট ওরও হয় না।
সুমির জন্য ওর ঠিক কেমন লাগে বুঝতে পারে না রতন। ও মরে গেলে মেয়েটার আদৌ কিছু আসবে যাবে কি না কে জানে। ছেলে হওয়ায় রতনের ঠাকুরদার সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে জটিলতা কেটে গেছে, প্রদীপ তার বাপের হিস্যা ঠিকই বুঝে পাবে। হয়ত সুমির চলে যাবে ওতেই। নাহলে কে জানে, হয়ত ও এ বাড়িতে থাকবেও না। সুমি তো মা বাপ কারোর সাথেই ভালো ব্যবহার করে না। বিয়ের পর থেকেই শ্বশুর শাশুড়ি কাউকে একটা কথা ছেড়ে বলে না বউটা। মা বলে- সহবত রে বাপ, সহবত। ছোট ঘরের বাড়ির বেটির সহবতের অভাব।
মা হয়ত ঠিকই বলে। মণ্ডলবাড়ির তৃতীয় পুরুষের আমলেও ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়েছে বংশ বুনিয়াদ দেখে। মা কাকিদের প্রত্যেকের বাপের বাড়ি সাবেকি বড়লোক। তাদের আচার আচরণেই তা বোঝা যায়। যতই ধ্বসে পড়া বড় বাড়ি হোক, যতই অভাবের ধাক্কা আসুক বা জ্ঞাতি ঝামেলার- তারা এমন করে প্রকাশ্যে মুখ করে না কেউ। তাদের প্রজন্মে নিজেদের ভেতরের হিংসা ঈর্ষা বিদ্বেষ বাইরের মানুষের কাছে তেমনভাবে ধরা পড়েনি তাই।
এ পুরুষে ওসবের বালাই নেই। কোন বড় ঘরই বা যেচে তেমন পড়ালেখা না জানা ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দেয়, তাও আবার যাদের বাড়ির কেবল নামটাই সাবেকি বাকি সব ঝরঝরে? জোতদার বাড়ির চতুর্থ পুরুষে তাই নানান বংশের মেয়েরা বউ হয়ে এসেছে। সুমির ব্যাপারটা আরও অন্যরকম। সে সময় সুমির দিনমজুর বাপ যে মেয়েটাকে ওর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল সেই তো অনেক। কে জানে, ও মরে যাবার সাথে সাথে বউ হয়ত চলেই যাবে বাপের বাড়ি। নাও যেতে পারে অবশ্য। ঝাড় গরিব বাপের বাড়ি যাওয়ার চেয়ে অবশ্য এ বাড়িতে থেকে যাওয়া আরামের। কিন্তু ও যে শুধু রতনের কথা ভেবে এ বাড়ি আঁকড়ে থাকবে না তা বলাই বাহুল্য।
আজ দুপুরে খেয়েদেয়ে নিজের ঘরের বিছানায় এসে শুয়েছিল রতন। ঘুমিয়েছেও অনেকটা সময়। মা আর বাপ দু’জনেই গেছে রুমকির বাড়ি, রুমকি ওর একমাত্র ছোটবোন। শ্বশুরটা হঠাৎ করে মরে গেল ওর, তারই শ্রাদ্ধে। কাল ফিরবে বোধহয়। পাঁজরের হাড়গুলোর ওপর একবার হাত বুলায় রতন। এক এক করে গোণা যায় সবগুলো হাড়। কেমন কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে শরীরটা, মনে হয় কেবল হাড়গোরের ওপর এক ফিনফিনে চামড়ার চাদর জড়িয়ে দিয়েছে কেউ। সুমি তো সুমি, ওর নিজেরই মাঝেমাঝে ঘেন্না ধরে যায় নিজের ওপর।
ইশ! সুমির কথায় মনে পড়ে মেয়েটা আজকাল কেমন সুন্দর হয়ে গেছে। কমে আসা দৃষ্টিতেও সে ঠিকই দেখতে পায় সুমির কালো ঢলঢলে মুখটার গর্তে বসা চোখগুলো নতুন করে কেমন যেন বড় বড় হয়ে গেছে। শরীরটাতেও কেমন সুখ উপচে পড়ছে মনে হয়। সুমিকে এমন দেখতে রতনের ভালোই লাগে মনে মনে। এমন সুন্দর লেগেছিল প্রদীপ হবার আগেআগেও। আচ্ছা, সুমি কি আবার…
ওর বউটাকে নিয়ে কতজনে কত কথা বলে! হয়ত ঠিকই বলে ওরা। অনেকে তো ঠারেঠোরে প্রদীপের পিতৃত্ব নিয়েও সন্দেহ পোষণ করতে ছাড়ে না সেই কবে থেকে। তবে কেউ সচরাচর ওর বউকে সরাসরি কিছু বলে না। কেউ যদি সুমির মুখের ওপর বেচাল কিছু বলেছে তাহলেই সব শেষ। মুখে ঝামা ঘষে দেবে মেয়েটা একদম। ওকে তাই কেউ ঘাঁটায় না। ঝগড়াটে হিসেবে এলাকায় সুপরিচিত যতীনের মাকে পর্যন্ত সেবার বলেছিল- কোন হারামজাদি দুন্নাম করে রে মোর? যে হারামজাদি মোর ব্যাটাক নিয়া কতা কয়, অর ভাতারের সাতেই যায়া শুতিম… সুমির এইসব কথা শুনে কানে হাত গুঁজে পালাতে দিশা পায়নি মহিলা।
পাশ ফিরতে গিয়ে রতন টের পায় ওর পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। আহা রে বাচ্চা! পোদীপ, ব্যাটা রে, কায় কী কয় কউক, তুইই মোর নিজের ব্যাটা- প্রদীপকে বুকে নিয়ে ভালো করে শোয় ও। বাচ্চাটার নাক দিয়ে কেমন ফোঁসফোঁস শব্দ আসছে। সর্দি লেগেছে মনে হয়। গরমকালের বড় দিন আরও কতক্ষণ আছে কে জানে। টিনের চালার নিচে ঢুকে পড়া রোদের গরমে সশব্দ শ্বাস নেয়া ছেলের সান্নিধ্য এখন রতনের বড় ভালো লাগে।
পাশের ঘর থেকে হঠাৎ চাপা হাসির শব্দ ঢুকে পড়ে এ ঘরের বিষণ্ণ খাটটায়। প্রদীপকে বুকে জড়িয়ে রতন কান পাতে। হু, সুমিরই হাসির আওয়াজ এটা, সে আওয়াজ ভীষণ চাপা। সাথে কোনো পুরুষেরও ফিসফিসানো গলার স্বর ভাসে এ ঘরের বাতাসে। সে কণ্ঠটা চেনে না রতন। চেনার কোনো আগ্রহও পায় না ও, দরকারও নেই তার। ছেলের সাথে এ ঘরের চিটেমারা তোশকের বিছানায় মরার মতো শুয়ে থাকে রতন। ওর কানের চারপাশে ওই ঘর থেকে ভেসে আসা চাপা হাসি মাপা কথার আওয়াজেরা হিল্লোল তোলে। সে হিল্লোলে যেন একটু একটু করে মরে যেতে থাকে ও। ওর পূর্ব পুরুষের পাপ যেমন ঘুরেফিরে আসে এখনও, প্রদীপের জীবনেও কি তাই হবে?
রতন জানে না তার চারপাশে যা ঘটছে এই এখন কিংবা যা ঘটে গেছে প্রদীপের জন্মকে ঘিরে সেই চার বছরেরও বেশি আগে তার কতটা পাপ বা পাপ নয়। কেবল এক তীব্র ভয়ে ছেলেকে আরও ভালো করে বুকে জড়িয়ে ধরে সে। অনেকদিন পর এই মুহূর্তে রতন নিজের ইচ্ছায় ভগবানের নাম নেয় - না, প্রদীপের পূর্বসুরীর করা যাবতীয় পাপ যেন এই ছেলেটাকে কোনোদিন না ছোঁয় ভগবান!
দেবদ্যুতি রায়
এক
এবার এই ‘আগন’ মাসেই কেমন মাঘের মতো শীত পড়েছে। চার পাঁচদিন থেকে সূর্যের দেখা মিলছে না একেবারে। গায়ের ভারি সোয়েটারের ওপর আলোয়ানটা ভালো করে জড়ায় রতন। আজকাল শরীরটা শীত, গরম কিছুই সহ্য করতে পারে না একদম। কে জানে, শীতের এই ক’টা মাস কী করে কাটবে এবার। ওদের এই এলাকায় শীতের তীব্রতা এমনিতেই দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি।
মণ্ডলপাড়ার একেবারে মাঝ বরাবর রতনদের এই ছন্নছাড়া বাড়িটা। এ বাড়ির খাপছাড়া মাপের দুটি ঘরের মাঝখান জুড়ে ছোটমোট বারান্দাটাই আজকাল রতনের সারাদিনের থাকার জায়গা। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ভাঙ্গাচোরা শরীরটা টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এখানেই বসে সে। খাওয়ার লম্বা টেবিলটার মাপে বানানো বেঞ্চটায় বসে থাকে। যখন আর পারে না, শুয়ে পড়ে ওখানেই। খুব মন চাইলে বাড়ির মানুষদের একটু উঠানে নামার কথা জানায়। নড়বড়ে কাঠের চেয়ারটায় উঠানে তখন খানিক সময় বসা হয় ওর। গত বছর পর্যন্ত তবু কলপাড় বা ল্যাট্রিনে যাওয়া আসা করতে পারত একা একা, এবার সেটাও প্রায় অসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। মা, আবার কখনও সখনও সুমিও ওকে ধরে ধরে সব জায়গায় নিয়ে যায় আজকাল।
সইন্দ্যা নাগি গ্যাল রে ব্যাটা। হাট, তোর হাত পাও ধুইয়া আনো- মা’র কথায় বারান্দার বেঞ্চে বসে থাকা জীর্ণ শরীরটা একটুখানি নড়ে ওঠে ওর। না, ও হাঁটতে পারবে না একা একা- শরীরে অত শক্তি নেই ওর। বসেই থাকে রতন, মা’ই এসে নিয়ে যাবে। রোজ সন্ধ্যায় মা ওকে নিয়ম করে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে আসে, তা সে যত ঠাণ্ডাই হোক না কেন। তারপর তুলসীতলার সামনে দাঁডিয়ে মাথাটা নোয়ায় ও। এখনও, কীসের আশায় যে মা ওকে রোজ রোজ ঠাকুরের কাছে মাথা নোয়াতে বলে তা মাথায় ঢোকে না রতনের। তবু ওর কষ্টে থাকা রোগাভোগা মাকে আর কষ্ট দিতে চায় না বলে এটুকু ও মেনে নেয়। সুমি অবশ্য মাঝেমাঝেই ফোঁস করে ওঠে- এহ্! ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম! খাড়ায় থাকির পায় না ফির ঠাকুরের আগোত পুজা করির নাগে! বালের কাহিনী!
ওর ওপর, ওদের সবার ওপর সুমির রাগের যথেষ্ট কারণ আছে বলেই এই সামান্য মুখ খারাপে তেমন একটা কিছু আসে যায় না রতনের। আজও মা’র সাথে কলপাড় থেকে এসে দিব্যি বাধ্য ছেলেটার মতো মাথা নোয়ায় তুলসীতলায়। আজকের ঠাণ্ডাটা কালকের চেয়েও বেশি, সেই ঠাণ্ডায় তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে রতনের অশক্ত শরীর একটু উষ্ণতা চায় এখন। মা ওকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে পুরনো ভারী আর জায়গায় জায়গায় তুলো জমা লেপটা গায়ে জড়িয়ে দেয়। একটু পরেই হাত পা গরমের আরাম পাবে। আপাতত লেপের তলায় মটকা মেরে শুয়ে থাকে ও।
অল্প ক’দিন আগে ওদের বাড়িতে ‘কারেন’ এসেছে। এ পাড়ায় বিদ্যুত সংযোগ পৌঁছেছে আরও বছর দশেক আগে কিন্তু একটা মিটারের খরচ যোগাড় না করতে পারায় ওরা বাড়িতে সংযোগ নিতে পারেনি তখন। এখন অল্প পাওয়ারের টিমটিমে হলদে বাতির আলোয় বেড়ার ঘরটা কেমন অদ্ভুতুড়ে দেখায়। সে আলোর নিচে অতিপুরনো লেপের তলায় আদুরে ওম খুঁজতে খুঁজতে রতন মনে মনে প্রদীপকে খোঁজে। প্রদীপ ওর চার বছরের ছেলে। সারাদিন বলতে গেলে বাপের কাছে আসেই না। আসলে সুমিই ওকে আসতে দেয় না বাপের কাছে, জানে রতন। সেকথা মনে পড়লে অভিমানে বুকটা ভরে যেতে চায় ওর। তবু শেষ পর্যন্ত সে অভিমানকে জমে উঠতে দেয় না ও বুকের ভেতর।
প্রদীপের নাম রেখেছে পারুল, রতনের মা। একমাত্র ছেলের ঘরে বংশের প্রদীপ ও। রতনের শরীরের যা অবস্থা, আর কত বছর এই শরীরে বেঁচেবর্তে থাকবে ও এটাই একটা বিশাল প্রশ্ন। তারপর মণ্ডল গোষ্ঠীর এই দূর্গাচরণ মণ্ডল অর্থাৎ রতনের বাপের বংশের পূর্বপুরুষদের নামে বাতি জ্বালাবার মতো ওই একজনই থাকবে।
মায়ের আশার কথা মনে করে এখনও হাসি পায় রতনের। শুকিয়ে খরখরে হয়ে আসা ঠোঁটে সে হাসি এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় ঝুলে থাকে টিমটিমে বাতিটার নিচে। প্রদীপ ওরফে পোদীপ যে রতনের নিজের ছেলে নয়, সে কি মা জানে না? যে সময়ে নিজের অসুস্থ ছেলের বিয়ে দিয়েছিল মা, সেই সময়ে একটা বাচ্চার জন্ম দেয়ার ক্ষমতা যে আর ছিল না ওর, এটা তো মা’র ভালোই জানার কথা। সুমির বাপ নেহাত নিয্যস গরিব বলেই মেয়ের সাথে এমন রোগাভোগা ছেলের বিয়ে দিয়েছিল। সেই সাথে যোগ হয়েছিল আরেকটা সূক্ষ্মতম লোভ- মণ্ডলবাড়ির সাথে নিজের পরিবারের আত্মীয়তার লোভে; সে লোভেই ওর শ্বশুর যে নিজের ঢলঢলে মুখের দোহারা গড়নের মেয়েটাকে ওর সাথে বিয়ে দিয়েছে, তা রতন সে সময়েই বুঝে গিয়েছিল। ফুলশয্যার রাতে ফুঁসে ওঠা সুমির মুখচোখ দেখে নিজের অক্ষমতার কথাটা আরও ভালো করে মনে পড়েছিল ওর। ওদের এই ছয় বছরের সংসারজীবনে হাতে গোণা কয়েকবার সুমির সাথে ঘনিষ্ঠ হতে গিয়েছিল রতন, প্রতিবারই নিজের না পারার ব্যর্থতায় ফিরে কাঁদতে হয়েছে ওর।
সেই সুমি বিয়ের এক বছর পার হতে না হতেই যখন নিজের মা হবার ঘোষণা দিল, তখন রতনের বুকের ভেতরটা একেবারে ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। এ কার সন্তান? কার ঔরসের ভ্রূণকে রতনের বাচ্চা বলে চালিয়ে দিতে চাইছে ও? সে সময় এক গভীর রাতে বউয়ের হাত ধরে জানতে চেয়েছিল রতন- কার ছওয়া এইটা সুমি? কার ছওয়া তোর প্যাটোত?
সে রাতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চারপাশের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে হেসে উঠেছিল সুমি নামের লম্বা দোহারা মেয়েটা, ওর বউ। তারপর ফিসফিস করে বলেছিল- যেই মরদের ক্ষ্যামতা নাই, অয় পুছ করে ক্যান এই কতা? গুষ্টির মুকোত আগুন দিবার জইন্যে আইসোছে মোর ছওয়া, এইটাই তো বড় কতা।
তা ঠিক। সুমির পেটের ভেতর যে সন্তান তখন তিল তিল করে বাড়ছে সে তো দিনশেষে রতনেরই গোষ্রি মুখে আগুন দেবে, বংশে প্রদীপ জ্বালাবে। সবকিছুর পরে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা বটে। সেই সময় দিনে দিনে সুমির হাসির শব্দ বেড়েছে, গলার তেজ বেড়েছে, রতনের শীর্ণ শরীর আর ক্ষীয়মাণ দৃষ্টির সামনে সুমির রূপও বেড়েছে। উল্টোদিকে ওর শরীরের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে বাড়তে মন খারাপটা যেন বাড়ির পুরনো তালগাছটার মাথার ওপর উঠে গেছে। ছেলের এমন মন খারাপ দেখেই কি না কে জানে, একদিন পারুল বলেছিল ওকে- তোর ব্যাটা একদিন এই বংশোত বাতি জ্বালাইবে, এইটাই সবচায়া জরুরি খবর বাপ!
সেদিন আরও ভালো করে বুঝে গিয়েছিল রতন, এ পৃথিবীতে বংশরক্ষা একটি বিশাল বড় কাজ। সে কাজের জন্য বড় বা ছোট, অনেক বলিদানই মানা যায়। প্রদীপের জন্মের পর পারুল বা দূর্গাচরণের মতো রতনও ওকে বুকে টেনে নিয়েছে। এই চার বছরে এমন অভ্যাস হয়েছে, প্রদীপকে ছাড়া আজকাল দিন কাটতে চায় না ওর। অথচ সুমি ছেলেটাকে প্রায় আসতেই দেয় না ওর ঘরে। আজও, এই অগ্রহায়ণের প্রবল শীতের সন্ধ্যায় ছেলেটা বিছানায় নেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হলে মন খারাপ বাড়ে ওর; শীতের ঠাণ্ডার চেয়েও সে অনুভূতি তীব্রতর।
দুই
মণ্ডল গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা ছিল জোতদার। তাদের ধন সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তির কথা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। জোতদার বংশের চতুর্থ পুরুষ রতন। প্রথম আর দ্বিতীয় পুরুষের কীর্তিমান লোকেরা এখনও বেঁচে আছে এলাকার মানুষের গালগল্পে। এমনকী এই যে এই গ্রামের নাম ‘স্বরূপপুর’ তাও এ বাড়ির প্রথম পুরুষের একজন প্রবল মানুষ স্বরূপচন্দ্র মণ্ডলের নামে। এককালে নাকি বর্ষা হলে যাতে কাদার মধ্যে হাঁটতে না হয় সে জন্য চলার পথে পুরু করে ধান ছড়াতো এ বাড়ির জোয়ানেরা, কর্তাদের হুকুমে! রতন ভাবে- সেই পাপেই হয়ত এ বংশের অর্ধেক বাড়িতে আজ সারা বছরের ধানের যোগানটুকুও থাকে না!
কী বাড়ি কী হয়ে যায়! রতনের বাবা দূর্গাচরণ মণ্ডল ওর ছোটবেলায় কত আফসোস করত পূর্বপুরুষদের ধনদৌলতের গল্প শেষে। আহা রে ! সেই রামও নাই, সেই অযোধ্যাও নাই রে ব্যাটা! যদি আইজ আগের নাকান সউককিছু থাকিল হায়…
আগের মতো সবকিছু কেন নেই, কেন জোতদারগোষ্ঠী আজ কোনোরকমে টিকে আছে এ পাড়ার মাঝ উঠানে ঝড়ের দিনে নুয়ে ভেঙ্গে পড়তে চাওয়া তালগাছটার মতো- এ আক্ষেপ এ বাড়ির প্রায় সবার। নিজেদের অকীর্তির অগৌরব তারা ঢাকতে চায় বাপ পিতামহের বড় বড় নামের মধ্যে। রতনের মনে পড়ে, দুই পুরুষ আগের গৌরবকে আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়া বাপ কাকাদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল ওর চেয়ারম্যান দাদু। সম্পর্কে বাবার জ্যাঠা হয় লোকটা। জোতদারদের দ্বিতীয় পুরুষের এই প্রবল মানুষটাকে ও খুব বেশিদিন দেখতে পারেনি। ওদের ছোটবেলাতেই কেমন একদিন টুপ করে মরে গেল মানুষটা। প্রথম জীবনে স্কুল মাস্টারি করে শেষ জীবনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিল দাদু। আজও দশ গ্রামের মানুষ ললিত চেয়ারম্যানকে চেনে এক নামে। শেষ বয়সে দাদু বলত- পাপ রে, সবই পাপ। গরিব মাইনষোক ধরিবান্দি মারি ডাঙ্গে আদায় করা টাকার পাপ আছে রে ব্যাটা। সেই পাপেই দ্যাখ না, একশো বছরও হয় নাই, বাড়িটা শ্যাষ হয়্যা গেল। এখনও কওচে, ওইলা পুরান কথা ভুলি যায়া নিজের নিজের ব্যবস্থা করো, পড়ালেখা করাও ছওয়াপোয়াগুলাক, মানুষ হউক। তাতে যদি পাপ ছাড়ে!
গরিব মানুষকে মেরেধরে টাকা আদায় করা জোতদার বংশের রক্তের গুণেই হোক আর মাটিতে মিশে মিশে ফসিল হয়ে যাওয়া সেইসব পথে ছড়ানো ধানের অভিশম্পাতেই হোক, এ বাড়ির খুব বেশি ছেলেপুলে মানুষ হতে পারেনি। এমনকী ললিত দাদুর পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট যে, সেই অরিজিৎ কাকুও লেখাপড়া শিখতে পারেনি মোটেই। দাদুর অন্য ছেলেমেয়েরা সব পাশটাশ করে বিভিন্ন চাকুরি করেছে- তাদের ছেলেমেয়েরাও আজ সরকারি বেসরকারি বড় বড় কীসব পদে চাকুরি করে।
রতন জানে, এসএসসিতে দু’বার গাড্ডা মারার পর থেকেই ওর শরীরটা বিগড়ানো শুরু না করলেও ওর অত মেধা ছিল না। ওদের মতো পড়ালেখা করে চাকুরিবাকুরি করতে পারত না ও। তা না পারুক, এই ভাঙতে থাকা গোষ্ঠীটার একজন হয়ে ও দিব্যি সুস্থভাবে বেঁচেবর্তে তো থাকতে পারত! কিন্তু তা আর হলো কই। কী এক অসুখ ওর শরীরটাকে ভেঙ্গেচুরে শেষ করে দিল, প্রথম ক’বছর এ ডাক্তার ও কবিরাজ দেখানোও হলো, কিন্তু ভালো করে ডাক্তার দেখানোর সাধ্য কোথায় ছিল ওর বাপের? ছিল না। রতনের অবাক লাগে ভাবতে যে বাড়ির প্রথম পুরুষের নামে গ্রামের নাম হয়, সে বাড়ির তৃতীয় পুরুষ তার একমাত্র ছেলের অসুখের ঠিকমতো চিকিৎসাও করতে পারে না!
আগে যখন এসব ভাবত, রতনের দুঃখ হতো খুব। পড়ালেখা না শিখে বাপের রেখে যাওয়া জমি ধ্বংস করে করে সংসার চালানোর জন্য ওর অক্ষম বাপ দূর্গাচরণের ওপর কেমন এক অস্থির রাগও হতো। কিন্তু আজকাল আর তেমন কোনো ভাবান্তর হয় না ওর। কে জানে, সত্যিই পূর্বপুরুষের পাপ ওরও জীবনে এসে লেগেছে কি না। আজকাল তাই টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে না পারা বাপকেও ক্ষমা করে দিয়েছে ও। কেবল মার খুনখুনে কান্না মাঝেমাঝে ওকে নতুন করে অসুখী করে দেয়। ওর ক্ষয়াটে দৃষ্টির সামনে একটু একটু করে মাও কেমন আরও বেশি রোগাভোগা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। মার জন্য কষ্ট লাগে রতনের। বাপটা চিরকালই মুখচোরা, ছেলের দুরবস্থা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না একদম। বাপের জন্য অতটা কষ্ট ওরও হয় না।
সুমির জন্য ওর ঠিক কেমন লাগে বুঝতে পারে না রতন। ও মরে গেলে মেয়েটার আদৌ কিছু আসবে যাবে কি না কে জানে। ছেলে হওয়ায় রতনের ঠাকুরদার সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে জটিলতা কেটে গেছে, প্রদীপ তার বাপের হিস্যা ঠিকই বুঝে পাবে। হয়ত সুমির চলে যাবে ওতেই। নাহলে কে জানে, হয়ত ও এ বাড়িতে থাকবেও না। সুমি তো মা বাপ কারোর সাথেই ভালো ব্যবহার করে না। বিয়ের পর থেকেই শ্বশুর শাশুড়ি কাউকে একটা কথা ছেড়ে বলে না বউটা। মা বলে- সহবত রে বাপ, সহবত। ছোট ঘরের বাড়ির বেটির সহবতের অভাব।
মা হয়ত ঠিকই বলে। মণ্ডলবাড়ির তৃতীয় পুরুষের আমলেও ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়েছে বংশ বুনিয়াদ দেখে। মা কাকিদের প্রত্যেকের বাপের বাড়ি সাবেকি বড়লোক। তাদের আচার আচরণেই তা বোঝা যায়। যতই ধ্বসে পড়া বড় বাড়ি হোক, যতই অভাবের ধাক্কা আসুক বা জ্ঞাতি ঝামেলার- তারা এমন করে প্রকাশ্যে মুখ করে না কেউ। তাদের প্রজন্মে নিজেদের ভেতরের হিংসা ঈর্ষা বিদ্বেষ বাইরের মানুষের কাছে তেমনভাবে ধরা পড়েনি তাই।
এ পুরুষে ওসবের বালাই নেই। কোন বড় ঘরই বা যেচে তেমন পড়ালেখা না জানা ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দেয়, তাও আবার যাদের বাড়ির কেবল নামটাই সাবেকি বাকি সব ঝরঝরে? জোতদার বাড়ির চতুর্থ পুরুষে তাই নানান বংশের মেয়েরা বউ হয়ে এসেছে। সুমির ব্যাপারটা আরও অন্যরকম। সে সময় সুমির দিনমজুর বাপ যে মেয়েটাকে ওর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল সেই তো অনেক। কে জানে, ও মরে যাবার সাথে সাথে বউ হয়ত চলেই যাবে বাপের বাড়ি। নাও যেতে পারে অবশ্য। ঝাড় গরিব বাপের বাড়ি যাওয়ার চেয়ে অবশ্য এ বাড়িতে থেকে যাওয়া আরামের। কিন্তু ও যে শুধু রতনের কথা ভেবে এ বাড়ি আঁকড়ে থাকবে না তা বলাই বাহুল্য।
আজ দুপুরে খেয়েদেয়ে নিজের ঘরের বিছানায় এসে শুয়েছিল রতন। ঘুমিয়েছেও অনেকটা সময়। মা আর বাপ দু’জনেই গেছে রুমকির বাড়ি, রুমকি ওর একমাত্র ছোটবোন। শ্বশুরটা হঠাৎ করে মরে গেল ওর, তারই শ্রাদ্ধে। কাল ফিরবে বোধহয়। পাঁজরের হাড়গুলোর ওপর একবার হাত বুলায় রতন। এক এক করে গোণা যায় সবগুলো হাড়। কেমন কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে শরীরটা, মনে হয় কেবল হাড়গোরের ওপর এক ফিনফিনে চামড়ার চাদর জড়িয়ে দিয়েছে কেউ। সুমি তো সুমি, ওর নিজেরই মাঝেমাঝে ঘেন্না ধরে যায় নিজের ওপর।
ইশ! সুমির কথায় মনে পড়ে মেয়েটা আজকাল কেমন সুন্দর হয়ে গেছে। কমে আসা দৃষ্টিতেও সে ঠিকই দেখতে পায় সুমির কালো ঢলঢলে মুখটার গর্তে বসা চোখগুলো নতুন করে কেমন যেন বড় বড় হয়ে গেছে। শরীরটাতেও কেমন সুখ উপচে পড়ছে মনে হয়। সুমিকে এমন দেখতে রতনের ভালোই লাগে মনে মনে। এমন সুন্দর লেগেছিল প্রদীপ হবার আগেআগেও। আচ্ছা, সুমি কি আবার…
ওর বউটাকে নিয়ে কতজনে কত কথা বলে! হয়ত ঠিকই বলে ওরা। অনেকে তো ঠারেঠোরে প্রদীপের পিতৃত্ব নিয়েও সন্দেহ পোষণ করতে ছাড়ে না সেই কবে থেকে। তবে কেউ সচরাচর ওর বউকে সরাসরি কিছু বলে না। কেউ যদি সুমির মুখের ওপর বেচাল কিছু বলেছে তাহলেই সব শেষ। মুখে ঝামা ঘষে দেবে মেয়েটা একদম। ওকে তাই কেউ ঘাঁটায় না। ঝগড়াটে হিসেবে এলাকায় সুপরিচিত যতীনের মাকে পর্যন্ত সেবার বলেছিল- কোন হারামজাদি দুন্নাম করে রে মোর? যে হারামজাদি মোর ব্যাটাক নিয়া কতা কয়, অর ভাতারের সাতেই যায়া শুতিম… সুমির এইসব কথা শুনে কানে হাত গুঁজে পালাতে দিশা পায়নি মহিলা।
পাশ ফিরতে গিয়ে রতন টের পায় ওর পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। আহা রে বাচ্চা! পোদীপ, ব্যাটা রে, কায় কী কয় কউক, তুইই মোর নিজের ব্যাটা- প্রদীপকে বুকে নিয়ে ভালো করে শোয় ও। বাচ্চাটার নাক দিয়ে কেমন ফোঁসফোঁস শব্দ আসছে। সর্দি লেগেছে মনে হয়। গরমকালের বড় দিন আরও কতক্ষণ আছে কে জানে। টিনের চালার নিচে ঢুকে পড়া রোদের গরমে সশব্দ শ্বাস নেয়া ছেলের সান্নিধ্য এখন রতনের বড় ভালো লাগে।
পাশের ঘর থেকে হঠাৎ চাপা হাসির শব্দ ঢুকে পড়ে এ ঘরের বিষণ্ণ খাটটায়। প্রদীপকে বুকে জড়িয়ে রতন কান পাতে। হু, সুমিরই হাসির আওয়াজ এটা, সে আওয়াজ ভীষণ চাপা। সাথে কোনো পুরুষেরও ফিসফিসানো গলার স্বর ভাসে এ ঘরের বাতাসে। সে কণ্ঠটা চেনে না রতন। চেনার কোনো আগ্রহও পায় না ও, দরকারও নেই তার। ছেলের সাথে এ ঘরের চিটেমারা তোশকের বিছানায় মরার মতো শুয়ে থাকে রতন। ওর কানের চারপাশে ওই ঘর থেকে ভেসে আসা চাপা হাসি মাপা কথার আওয়াজেরা হিল্লোল তোলে। সে হিল্লোলে যেন একটু একটু করে মরে যেতে থাকে ও। ওর পূর্ব পুরুষের পাপ যেমন ঘুরেফিরে আসে এখনও, প্রদীপের জীবনেও কি তাই হবে?
রতন জানে না তার চারপাশে যা ঘটছে এই এখন কিংবা যা ঘটে গেছে প্রদীপের জন্মকে ঘিরে সেই চার বছরেরও বেশি আগে তার কতটা পাপ বা পাপ নয়। কেবল এক তীব্র ভয়ে ছেলেকে আরও ভালো করে বুকে জড়িয়ে ধরে সে। অনেকদিন পর এই মুহূর্তে রতন নিজের ইচ্ছায় ভগবানের নাম নেয় - না, প্রদীপের পূর্বসুরীর করা যাবতীয় পাপ যেন এই ছেলেটাকে কোনোদিন না ছোঁয় ভগবান!
No comments:
Post a Comment