বিবর্ণ রেখায় বিপন্ন সুখ
নাসরীন নঈম
জুম্মনের কঙ্কালসার দেহটাকে গোর দিয়ে এসে দাওয়ায় বসে হাত পা ছুঁড়ে বিলাপরতা গোলাপীকে লক্ষ্য করে লাল মিয়া সান্তনার বাণী বর্ষণ করলো— ‘আর কাইন্দা কি করবা। খসম কি আর মাইনসের জিন্দেগানি বইরা বাইচা থাকে’!
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে উঠোনের এক পাশে ধপ্ করে বসে পড়লো লাল মিয়া। তারপর দৃষ্টিটা আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে আবার বললো— মাইয়াটার দিগে চায়আ কোনরহমে কষ্ট-মষ্ট কইরা খসমের এই ভাঙ্গা ঘরটায় ইজ্জত বাচাআ চইলা যাও। খোদায় চাইলে দিন ফিরবারও পারে।
করিমের বউ তখন ভাত খেয়ে এঁটো বাসনটার পানি ফেলতে ফেলতে মুখটা বিকৃত করলো- বেওয়া বেকসের দিগে খোদা ব্যাটাও চায় না।
জুম্মনের সদ্য বিধাব বউ গোলাপী কারও কথায় কর্ণপাত না করে আলু থালু বেশে আপন মনে মর্সিয়ার মতো করে বিলাপ করছে- হায়রে খোদারে। আমারে... ফালায়া... থুইয়া...কই...গেলগারে...। অখন আমারে...আর ক্যাঠা দেখবরে...।
পাঁচ বছরের মেয়ে আঙ্গুরীও মায়ের পাশে বসে সুর করে কেঁদে কেটে নাকের চোখের পানিতে ভেসে গেলো।
তালতলার এই অখ্যাত গলির নোংরা বস্তিটায় দশটি পরিবারের বাস। ছোট ছোট এক একটি কবুতরের খোপের মতো ঘর। কোনটার চালের টিন উড়িয়ে নিয়ে গেছে গেলোবারের বৈশাখী ঝড়ে। কোনটার বা চারদিকের কাঁচাবাঁশের বেড়া উঁই পোকায় খেয়ে এমন ঝরঝরা করে রেখেছে, যে কোন মুহূর্তে ঝুপ করে পড়ে যাবার সম্ভাবনা শতকরা নব্বই ভাগ।
ওরই ভেতর মাসিক চল্লিশ টাকায় ভাড়া দিয়ে হাড় বের করা কাঠি কাঠি হাত পা আর একপাল ন্যাংটা ছেলেমেয়ে নিয়ে এক একজন মাতা-পিতার সংসার।
ওদের কেউ রিক্সা চালায়, কেউ বোঝা টেনে বেড়ায় স্টেশনে। কেউ ঠ্যালাগাড়ী চালায়। কেউ তেঁতুলের নানারকম মসল্লাদার আচার বানিয়ে স্কুলের গেটে গিয়ে বসে। কেউবা আবার প্লাস্টিকের জুতা তৈরীর কারখানায় ফাই ফরমায়েশ খাটে। ওদের স্ত্রী কন্যারাও বিনা পরিশ্রমে ভাত খায় না। বাড়ি বাড়ি পানি দেয়। যেহেতু পুরানো শহরগুলোতে পানির খুব অভাব। কেউ বা থালা বাটি মাজা ঘষা করে, বাটনা বাটে, কাপড় ধোয়। এমনি নানা ধরণের ছুটা কাজ করে ওরাও কিছু বাড়তি উপার্জন করে। কিন্তু তবু দেখা যায় ওদের বাচ্চাগুলো না খেতে পেয়ে ক্ষিদের জ্বালায় সারাক্ষণ চিৎকার করছে। কাজ থেকে ফিরে সময়মতো ভাত না পেয়ে স্বামী দেবতাটি স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টানে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে একপাল লোক জড়ো করছে নিজেদের একচিলতে উঠোনে।
অনাহারে অর্ধাহারে মায়ের বুক চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো ঝুলছে। পরিমিত খাদ্যাভাবে বাচ্চাগুলোর বয়স আন্দাজ করাও যায় না। অথচ বছরের এ মাথা ও মাথায় ওদের প্রতিটি ঘরে এক একটি করে সন্তান আসছে। ওরা পরিকল্পিত পরিবারে বিশ্বাসী নয়। কেননা জীবনের আনন্দ পাবার পথ ওরা খুঁজে পায় না।
অবশ্য ওদের মধ্যে জুম্মনটাই ছিলো এ ব্যাপারে একটু সতর্ক। এক বিদেশী সাহেবের বাড়িতে কাজ করতো ও। বড় ভালোবাসতো ওকে ও বাড়ির সবাই। একদিন কথায় কথায় কাছে বসিয়ে অধিক সন্তানের কুফল সম্পর্কে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রডিক্স সাহেব জুম্মনকে।
সেদিনই জুম্মন গোলাপীকে ডেকে বলেছিলো, ‘বুজলি গোলাপ, বেশি পোলাপান বালা না। না খাওয়াইতে না পিন্দাইতে পারলে মাইনসে ওগো মানুষের বাচ্চা কইবো না, কইবো কুত্তার বাচ্চা।’ গোলাপী সেদিন আঁৎকে উঠেছিলো। কিন্তু সে কথায় ও এমনিভাবে দীক্ষিত হয়েছিলো যে একটি মেয়ে হবার পাঁচটি বছরের মধ্যেও ওদের আর দ্বিতীয়টির সম্ভাবনা দেখা দিলো না। কিন্তু অন্য সব ঘরে এই নিয়ে কানাঘূষা শুরু হয়ে গেলো। লালের বউতো একদিন বলেই বসলো-‘জুম্মাইনারে ব্যারামে ধরছে। বেগমের মা কথাটিকে লুফে নিয়ে বললো- দুর দূর আসলে ঐ ছোঁড়ার কোন দোষ নাই। মাগীরই কোন কিছু বেশকম আছে। নইলে অয়না ক্যা? হু। আমাগো দেহি ঠেকা দেওন যায় না।
একটি মাত্র মেয়ের দিকে তাকিয়ে এমনি অনেক কিছু স্মৃতিকে টেনে টেনে লম্বা করছে গোলাপী। সতিই তো আজ যদি একটি ছেলে থাকতো গোলাপীর। তবে তো নিশ্চয়ই একদিন না একদিন রোজগার করে খাওয়াতো ওকে। কিন্তু সে সুখতো আর হবে না গোলাপীর। বরং মেয়েটাকে তেল নুন দিয়ে পুষে ডাগর করে অন্যের হাতে উপরি কিছু দিয়ে তুলে দিতে হবে। দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো গোলাপী। টোকানীর মা গলাটা একটু আর্দ্র করে বললো- ‘কি করবা অহনে কও? চলবাই বা কেমনে? না অয় এক কাম কর। দেইখা হুইনা, একটা বিয়া শাদী বইয়া যাও।’
গোলাপীর বাইশ বছরের যৌবনভরা দেহটা তীরের মতো খাড়া হয়ে উঠলো- দেহ খালা, ঐ কতা আর কইবা না, তোমার আল্লার কসম লাগে খালা, আমি সইবার পারি না।
পরদিনই গোলাপী কাছের একটি হোটেলওয়ালার দ্বিতীয় স্ত্রীর সংসারে কাজে বহাল হয়ে গেলো। ভোর ছ’টা থেকে আরম্ভ হয় গোলাপীর চরকীর মতো ঘোরা। সারাদিন যন্ত্রের মতো অবিরাম চলতে থাকে ওর আঁট সাঁট বাঁধা দেহটা।
বিরাট দোতলা বাড়ি। ছেলেমেয়ে সবশুদ্ধ ষোলজন। শাহী হোটেলের মালিকের এ স্ত্রীটি আবার পশ্চিমা। শাড়ী টাড়ি পরে না। বিরাট মাংসল শরীরে সিল্কের চকচকে সালোয়ার কামিজ পরা, সুরমা দেয়া মেহেদী রঙ্গা চুলে টারসেল ঝুলিয়ে বেনী বাঁধা মহিলাটির খনখনে গলার কিছু কিছু শব্দ গোলাপীকে মাঝে মাঝে বিব্রত করতো না যে এমন নয়। কিন্তু কর্তাব্যক্তিটি গোলাপীকে সুনজরেই দেখেন। কেনো না যাবতীয় কাজকর্ম অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথেই গোলাপী করে। সেই কাকডাকা ভোরে কয়লার গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মেজে মেয়েটার হাত ধরে বেরিয়ে যায়। যখন সূর্যাস্তের লালিমা এসে পৃথিবীকে বেষ্টন করে। দূর দূরান্ত থেকে কাক চিল ময়নারা সব উড়ে উড়ে আপন কুলায় ফেরে, সে তখন একটি ডানা ভাঙ্গা পাখি সন্তানের হাত ধরে ফিরে আসে আপন নীড়ে।
এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে মানুষ যা ভাবে তা কি সবসময় হয়? হয় না। হাজারটা নিওন লাইটের আলোতে একটি জোনাকী তার নিজস্ব আলো বিন্দু নিয়ে কোথায় যে লুকাবে তার ঠিক পাওয়া যায় না।
তাই হয়তো শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে একদিন গোলাপী বেগমের মার কাছে কেঁদে ফেললো। চাচীগো আমারে একটা দেইখা হুইনা নিকা দিয়া দেও। আমি যে আর চলবার পারি না। মরার মাইনসে আমারে খাবলে খাইবার চায়।
কি নিদারুণ দুঃখে যে গোলাপীর মুখ ফুটে কথাকটি বেরিয়েছিলো সে দিন তা একমাত্র অন্তর্যামীই জানেন। কিন্তু এক সরস কৌতুক মাখিয়ে কথাটাকে রসিয়ে রসিয়ে রটিয়েছিলো ও বাড়ির বাসিন্দারা। ওর সে বলার মধ্যে আর ওদের সে বোঝার মধ্যে ছিলো সেকি ব্যবধান। টোকানীর মা ছুটে এসে মুখের ওপরই বলে দিলো, ‘আমি কইছিলাম না যে মাগী থাকবার পারবো না, পিলপিলানী উঠবই। ঠোঁট বাঁকিয়ে মুখটা আরও বিকৃত করে সমস্ত শরীরে একটা ঝাঁকুনী দিয়ে আবার বললো-‘আ-লো পোড়ামুখী, শরম ভরম সব কি পিয়া খাইছস?
সেদিন সকালে দু’হাতের পিঠ দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে গোলাপী কুয়াতলায় গিয়ে বসলো। করিমের বউ তখন হাতের বদনাটা রেখে বাঁ হাতটা খুব করে মাটিতে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছিলো। আঙ্গুরীর হাত থেকে কয়লার টুকরাটা নিয়ে মুখের ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে চিবাতে চিবাতে গোলাপী বললো-‘হুনছো চাচী, ল্যাংড়া একটা ঘর আনছে আমার লেগা, তোমরা এটু কথা বার্তাটা কইয়া দেহ না।’
ফোঁস করে উঠলো করিমের বউ-‘হ। ঐ ল্যাংড়ার কথায় আমি নাচুম। কামতো আর পাই না, কি করুম।’
ল্যাংড়ার কিন্তু পিতৃপ্রদত্ত একটি নাম আছে- গেদু মিয়া। কৈশোরে ভাইয়ে ভাইয়ে এমনই ঝগড়া বাঁধিয়েছিলো যে সোনা মিয়ার একটি লাঠির আঘাতেই গেদু মিয়ার ডান পাটা এক্কেবারে চিরতরের জন্যে অবশ হয়ে গেলো। অনেক মালিশ, তেল পড়া মাখামাখি হয়েছিলো, কিছুতেই কিছু হলো না। সেই থেকেই গেদু মিয়া লাঠিতে ভর করে হাঁটে, আর অমনি আস্তে আস্তে সে গেদু থেকে ল্যাংড়া হয়ে গেলো। ওকে অবশ্য যে যাই মনে করুক না কেনো, একটু বেশী বাচাল বলে কিন্তু গোলাপী কেনো যেনো ওকে মোটেই অবহেলা করতে পারে না।
গোলাপীর মনে হয় একটি পা নেই, তাই লোকটা অত কাজ করে। আর সবার মতো দুটোই যদি থাকতো তাহলে...। যে সম্বন্ধটা এনেছে ও, গোলাপীর খুবই পছন্দ হয়েছে। অত জোয়ানও না বুড়াও না। স্বাস্থ্য ভালো। উঁচা-লম্বা। মুখ ভর্তি একরাশ দাড়ি। পাজামা পাঞ্জাবী পরে। চোখে হালকা করে সুরমার ছোঁয়া। মাথায় কিস্তি টুপি। প্রশস্ত কাঁধটা জুড়ে রয়েছে সাদা আর কালো মিশানো ডোরাকাটা একটি রুমাল। মাথা নীচু করে ধীরে সুস্থে কথা বলে। চুড়ি তৈরীর কারখানায় আছে। নাম গুল মোহাম্মদ খান। সব মিলিয়ে বড় ভালো লাগলো। গোলাপীর নিজের ভাগ্যটাকে একাধিকবার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হলো ওর। এমন ধনী, সম্মানী লোক যে একটি মেয়েসহ গোলাপীকে নিকা করতে রাজী হয়েছে, একি কম ভাগ্যের কথা? অবশ্য এতে ল্যাংড়ারও যে অপরিসীম দান রয়েছে তা গোলাপী বেশ বুঝে। ওইতো সেদিন গোলাপীকে দেখতে এসে হাতে পঞ্চাশ টাকার কড়কড়ে নোট গুঁজে দিলো অবলীলায়, তারপর আঙ্গুরীকে কোলে তুলে নিয়ে কতো আদর।
গোলাপীর তখন মনে হয়েছিলো জুম্মন মরে গিয়ে ওর ভাগ্যের রুদ্ধ দুয়ারের তালাটা খুলে দিয়ে গেছে। —ও বুয়া তুমি এই হানে। আ দূর উঠ জলদি কইরা এই দেহ খানসাব তোমার লগে কতা কইবো। ল্যাংড়ার অসময়ের উপস্থিতিতে চমকে উঠলো গোলাপী- আমার লগে। বাড়ির মুরুব্বীগো লগে কথাবার্তা কইয়াতো বিয়ার দিন তারিখ ঠিক অইচে, আবার আমি ক্যা?
উঁচু-নীচু দাঁতগুলো বের করে হাসলো ল্যাংড়া। —ইস। নয় বুঝ আর ছয় বুঝবার পারো না? জলদি আহ কইতাছি।
গোলাপী কি বুঝলো ও-ই জানে। একলাফে ঘরে গিয়ে ঢুকলো, ঝুলানো দড়ির ওপর থেকে একটা পরিষ্কার শাড়ি টেনে নিয়ে গুছিয়ে পরে নিলো। কিছুক্ষণ আগের আঁচড়ানো চুলের ওপর আবার নতুন করে চিরুনী বুলালো। বেড়ার গায়ে আটকিয়ে রাখা আয়নাটা টেনে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মুখটাকে দেখলো। আক্ষেপ হলো খুব ওর। একটু কাজলও নেই ঘরে যে চোখ দুটোতে একটু ছোঁয়াবে।
—কই বুয়া, অইলো তোমার?
ল্যাংড়া দ্বিতীয় তাগাদায় তাড়াতাড়ি মাথায় ছোট্ট একটি ঘোমটা টেনে কম্পিত পদভারে ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো গোলাপী।
ঘরের ভেতর মাথাটা ঢুকিয়ে ল্যাংড়া বললো —লন কতা কন খানসাব।
একটি নড়বড়ে চৌকির ওপর উপবিষ্ট গুল মোহাম্মদ খান একটু নড়ে চড়ে বসলো। তারপর বার তুই তিন গলাটা কেশে নিয়ে বললো—দেহেন আপনে আমারে পছন্দ করছেন তো, কেলা কইতাছি জানেন তো আমার আরো দুই দুইডা বিবি আছে, কিন্তুক হালারা কোন কামের না, এউগাও আমার কথা হুনে না। খসমের খেদমত করে না।—তাই হালায় আমি আপনেরে ঘরে নিবার চাই।
ঝটপট উত্তর দিলো গোলাপী। এই কথা কইয়া আর আমারে শরমিন্দা কইরেন না, আপনে হইলেন গিয়া ফেরেস্তার লাহান। চিক করে গালভর্তি পানের পিক ফেলে আনন্দে বিগলিত হলো গুল মোহাম্মদ খান, যাউগ্যা। আমি আপনের মুখে এট্টু হুনবার আইছিলাম। মুহূর্তে গলার স্বরটা পাল্টে গেলো খান সাহেবের। আস্তে করে নরোম গলায় টিয়ে পাখিকে লোকে যেমনি করে ডাকে ঠিক তেমনি আহ্লাদের সুরে ডাকলো, হুনো একটু কাছে আহনা।
চমকে উঠে গোলাপী। কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় ল্যাংড়ার দিকে তাকাতেই ল্যাংড়া নীচু গলায় টেনে টেনে বললো—যা...ও...। কয়দিন পরতো যাইবাই। অহন গেলে দোষ কি... যাও। আঁচলটা একটু টেনে ধীর পায়ে ঘরে গিয়ে দাঁড়ালো গোলাপী।
খান সাহেব গোলাপীর লজ্জা ভয় মিশ্রিত মুখটা তুলে ধরলো। কামনার আগুনে ধিকি ধিকি করে জ্বলে উঠলো গুল মোহাম্মদ খানের শরীরের লোমকূপগুলো। গোলাপীর মুখটা উর্ধ্বশিখা প্রদীপের মতো উজ্জ্বল হলো। পদ্ম পাঁপড়ির ওপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে যেমন থির থির করে কাঁপতে থাকে পদ্মপাতা, ঠিক তেমনি করে কাঁপছে গোলাপীর চিকন দুটো ঠোঁট।
ক্ষণিকের জন্যে হলেও খান সাহেব ভুলে গেলো যে তার শালতী শালতী হাতের দু’আঙ্গুলের ডগায় কাঁপছে একটি বিধবার মুখ।
সহসা যেনো সাগরের দু’প্রান্ত থেকে দু’টি ঢেউ আচমকা এসে লুটোপুটি খেয়ে মোহনায় পড়ে গেলো।
বিদায় নেবার সময় খান সাহেব গোলাপীর হাতে একশত টাকার একটি নোট গুঁজে দিয়ে বললো- রাখো যা যা লাগে কিনবার পারবা।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো গোলাপী। যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না। একসাথে এতোগুলো টাকা। এই বাইশ বছর বয়সে কোনদিন সে একসাথে এতোগুলো টাকা হাতে পায়নি। টুক করে সে খান সাহেবের পা ধরে সালাম করলো। টাকাটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরেছে গোলাপী। মহারাজের মতো ডান হাতটা গোলাপীর পিঠের ওপর তুরে আশীর্বাদ করলো খান সাহেব।
ল্যাংড়া যখন খান সাহেবকে পৌঁছে দেবার জন্যে ঘর থেকে নীচু হয়ে বেরুলো, তখনি হঠাৎ দমকা বাতাসের মতো একশ’ মাইল বেগে উড়ে এসে ঠিক খান সাহেবের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো পরীবানু।
ভালো লাগার আবেশে হাসলো গুল মোহাম্মদ খান।
ল্যাংড়া বিরক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বললো- হালার মোটকির নাতিন।
খান সাহেব একটু ইতস্ততঃ করে বললো- মগর বড়ই খুবসুরত তো...।
ল্যাংড়া বিরক্ত হলো— হ! চলেন জলদি।
সেদিন রাতে গোলাপীর চোখে ঘুম এলো না। সমস্ত দেহ মন জুড়ে এতো আনন্দ এতো শিহরণ তো আর কখনো জাগেনি। কোন রকমে রাতটা কাটলো গোলাপীর। সকালে উঠে প্রতিদিনকার মতো কাজে গেলো না ও। প্রথমেই মোড়ের দোকান থেকে টাকাটা ভাঙ্গিয়ে আনলো। দোকানী এতো সকালে কিছুতেই এতো টাকার ভাংতি দেবে না। একটু চিন্তা ভাবনা করে এক প্যাকেট ‘রাজা’ কিনলো গোলাপী। ঘরে এসে আঙ্গুরীকে পাঠিয়ে বড় বড় দুটো বাকরখানি আর রসগোল্লা আনালো। আজ আর পান্তা নয়। একেবারে খান্দানী নাস্তা। মনে মনে মুচকি হাসলো গোলাপী। আঙ্গুরীর সমস্ত শরীর পার্কের দোলনায় দোল খাওয়ার মতো দুলতে লাগলো। গোলাপী যেনো সে হাসি মাখা মুখের ছায়ায় স্বর্ণ সুখ খুঁজে পেলো।
দুপুরে আজ ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেলো ওরা দু’মায়ে ঝিয়ে। এক খিলি পান কিনে আনলো আঙ্গুরী। ঠিক সে সময় ফেরী করে শাড়ী কাপড়ওয়ালা যাচ্ছিলো সে পথ দিয়ে। ছুটে গিয়ে ডাকলো গোলাপী, ও-মিয়া শুনো......। একটা বাসন্তী রঙের লাল পেরে শাড়ী কিনলো গোলাপী সত্তর টাকায়। অনেক দিনের পালিত স্বপ্নের সফলতা এলো আজ।
ওদেরকে আজই মানা করে দিতে হবে। খেটে খাবার দিন শেষ হয়েছে তার। মনে মনে ভারী কৃতজ্ঞ হলো গোলাপী সে লোকটির উদ্দেশ্যে।
গোলাপীকে না পেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যাচ্ছিলো ল্যাংড়া। করিমের বউ দাওয়ায় বসে মাটির চুলা তৈরী করছিলো নক্সা করে। একটু আড় চোখে চেয়ে মিষ্টি হেসে ডাকলো— অই ছ্যাঁড়া কই যাস, আয়না হেনে একটা কতা কই। ল্যাংড়া ফোঁস করে উঠলো— দূর হালার মোটকি তর কাম তুই কর, আমার সময় নাই। শরীরে অত্যাধিক মেদ জমার ফলে দিন দিন শুধু প্রস্থে বাড়ছিলো। করিমের বউ দৈর্ঘ্যে অবশ্য চার ফুটও হবে না। বাড়ির ছোট বড় সবাই ওকে মোটকি
বলেই ডাকে। ল্যাংড়ার তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথায় বিন্দুমাত্রও বিচলিত হলো না করিমের বউ। বরং দ্বিগুণ উৎসাহে বললো, যার কাছে আইছিলা, হে আবার ঘরে থাকনের মানুষ নিহি, তাইলে বাইরে ফষ্টি নষ্টি করবো কেঠা।
ভুরু জোড়া কুঁচকালো ল্যাংড়ার। এক লাফে করিমের বউয়ের কাছে গিয়ে বসলো ল্যাংড়া— কি কইলা খালা।
—কমু আর কি আমার কপালেরই দোষ। ক্যা, আমার নাতীন পরীবানুরে তুই চোখে দেহছ না? জুয়ান জাহান আবিয়াতা ছেঁড়িটারে থুইয়া তুই গেলি ঐ বুইড়া মাগী, খসম খাগীর নিহা ঠিক করবার। দেহিছ এমুন ভালো ব্যাটাটার কাছে এই বদ মাগীটারে দিয়া তুই যদি বদনাম না অইছস তো আমার কান কাইট্যা কুত্তার গলায় ঝুলামু।
—কি! গোলাপীবুয়া এতো খারাপ খালা? আমি এট্টুও বুঝবার পারিনাইক্যা। ইস খালা আল্লাহ মেহেরবান। তুমি আমার ইজ্জত বাঁচাইছো খালা। আমি- আমি আইজই...। কিন্তুক খালা পরীরে তুমি ঐ বুইড়াটার লগে হতীনের ঘরে...।
—দূর ছ্যাঁড়া। তর যে কথা। ব্যাটাগো আবার বয়েস কিরে? রোগ শোক নাইকা, জুয়ান তাগড়া। টাকা পয়সা আছে...আর কি লাগেরে?
গোলাপীর ওপর থেকে চট্ করে মনটা উঠে গেলো হুজুগে মানুষ ল্যাংড়ার। মানুষটাকে সে এতো ভালো জানতো। নাহ থাকুক পড়ে ওর ভাগ্য নিয়ে। খানসাবকে সবকথা খুলে বলতেই হবে আজ। হাতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে আপন মনে গজরাতে লাগলো গেদু মিয়া ওরফে ল্যাংড়া।
নাসরীন নঈম
জুম্মনের কঙ্কালসার দেহটাকে গোর দিয়ে এসে দাওয়ায় বসে হাত পা ছুঁড়ে বিলাপরতা গোলাপীকে লক্ষ্য করে লাল মিয়া সান্তনার বাণী বর্ষণ করলো— ‘আর কাইন্দা কি করবা। খসম কি আর মাইনসের জিন্দেগানি বইরা বাইচা থাকে’!
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে উঠোনের এক পাশে ধপ্ করে বসে পড়লো লাল মিয়া। তারপর দৃষ্টিটা আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে আবার বললো— মাইয়াটার দিগে চায়আ কোনরহমে কষ্ট-মষ্ট কইরা খসমের এই ভাঙ্গা ঘরটায় ইজ্জত বাচাআ চইলা যাও। খোদায় চাইলে দিন ফিরবারও পারে।
করিমের বউ তখন ভাত খেয়ে এঁটো বাসনটার পানি ফেলতে ফেলতে মুখটা বিকৃত করলো- বেওয়া বেকসের দিগে খোদা ব্যাটাও চায় না।
জুম্মনের সদ্য বিধাব বউ গোলাপী কারও কথায় কর্ণপাত না করে আলু থালু বেশে আপন মনে মর্সিয়ার মতো করে বিলাপ করছে- হায়রে খোদারে। আমারে... ফালায়া... থুইয়া...কই...গেলগারে...। অখন আমারে...আর ক্যাঠা দেখবরে...।
পাঁচ বছরের মেয়ে আঙ্গুরীও মায়ের পাশে বসে সুর করে কেঁদে কেটে নাকের চোখের পানিতে ভেসে গেলো।
তালতলার এই অখ্যাত গলির নোংরা বস্তিটায় দশটি পরিবারের বাস। ছোট ছোট এক একটি কবুতরের খোপের মতো ঘর। কোনটার চালের টিন উড়িয়ে নিয়ে গেছে গেলোবারের বৈশাখী ঝড়ে। কোনটার বা চারদিকের কাঁচাবাঁশের বেড়া উঁই পোকায় খেয়ে এমন ঝরঝরা করে রেখেছে, যে কোন মুহূর্তে ঝুপ করে পড়ে যাবার সম্ভাবনা শতকরা নব্বই ভাগ।
ওরই ভেতর মাসিক চল্লিশ টাকায় ভাড়া দিয়ে হাড় বের করা কাঠি কাঠি হাত পা আর একপাল ন্যাংটা ছেলেমেয়ে নিয়ে এক একজন মাতা-পিতার সংসার।
ওদের কেউ রিক্সা চালায়, কেউ বোঝা টেনে বেড়ায় স্টেশনে। কেউ ঠ্যালাগাড়ী চালায়। কেউ তেঁতুলের নানারকম মসল্লাদার আচার বানিয়ে স্কুলের গেটে গিয়ে বসে। কেউবা আবার প্লাস্টিকের জুতা তৈরীর কারখানায় ফাই ফরমায়েশ খাটে। ওদের স্ত্রী কন্যারাও বিনা পরিশ্রমে ভাত খায় না। বাড়ি বাড়ি পানি দেয়। যেহেতু পুরানো শহরগুলোতে পানির খুব অভাব। কেউ বা থালা বাটি মাজা ঘষা করে, বাটনা বাটে, কাপড় ধোয়। এমনি নানা ধরণের ছুটা কাজ করে ওরাও কিছু বাড়তি উপার্জন করে। কিন্তু তবু দেখা যায় ওদের বাচ্চাগুলো না খেতে পেয়ে ক্ষিদের জ্বালায় সারাক্ষণ চিৎকার করছে। কাজ থেকে ফিরে সময়মতো ভাত না পেয়ে স্বামী দেবতাটি স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টানে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে একপাল লোক জড়ো করছে নিজেদের একচিলতে উঠোনে।
অনাহারে অর্ধাহারে মায়ের বুক চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো ঝুলছে। পরিমিত খাদ্যাভাবে বাচ্চাগুলোর বয়স আন্দাজ করাও যায় না। অথচ বছরের এ মাথা ও মাথায় ওদের প্রতিটি ঘরে এক একটি করে সন্তান আসছে। ওরা পরিকল্পিত পরিবারে বিশ্বাসী নয়। কেননা জীবনের আনন্দ পাবার পথ ওরা খুঁজে পায় না।
অবশ্য ওদের মধ্যে জুম্মনটাই ছিলো এ ব্যাপারে একটু সতর্ক। এক বিদেশী সাহেবের বাড়িতে কাজ করতো ও। বড় ভালোবাসতো ওকে ও বাড়ির সবাই। একদিন কথায় কথায় কাছে বসিয়ে অধিক সন্তানের কুফল সম্পর্কে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রডিক্স সাহেব জুম্মনকে।
সেদিনই জুম্মন গোলাপীকে ডেকে বলেছিলো, ‘বুজলি গোলাপ, বেশি পোলাপান বালা না। না খাওয়াইতে না পিন্দাইতে পারলে মাইনসে ওগো মানুষের বাচ্চা কইবো না, কইবো কুত্তার বাচ্চা।’ গোলাপী সেদিন আঁৎকে উঠেছিলো। কিন্তু সে কথায় ও এমনিভাবে দীক্ষিত হয়েছিলো যে একটি মেয়ে হবার পাঁচটি বছরের মধ্যেও ওদের আর দ্বিতীয়টির সম্ভাবনা দেখা দিলো না। কিন্তু অন্য সব ঘরে এই নিয়ে কানাঘূষা শুরু হয়ে গেলো। লালের বউতো একদিন বলেই বসলো-‘জুম্মাইনারে ব্যারামে ধরছে। বেগমের মা কথাটিকে লুফে নিয়ে বললো- দুর দূর আসলে ঐ ছোঁড়ার কোন দোষ নাই। মাগীরই কোন কিছু বেশকম আছে। নইলে অয়না ক্যা? হু। আমাগো দেহি ঠেকা দেওন যায় না।
একটি মাত্র মেয়ের দিকে তাকিয়ে এমনি অনেক কিছু স্মৃতিকে টেনে টেনে লম্বা করছে গোলাপী। সতিই তো আজ যদি একটি ছেলে থাকতো গোলাপীর। তবে তো নিশ্চয়ই একদিন না একদিন রোজগার করে খাওয়াতো ওকে। কিন্তু সে সুখতো আর হবে না গোলাপীর। বরং মেয়েটাকে তেল নুন দিয়ে পুষে ডাগর করে অন্যের হাতে উপরি কিছু দিয়ে তুলে দিতে হবে। দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো গোলাপী। টোকানীর মা গলাটা একটু আর্দ্র করে বললো- ‘কি করবা অহনে কও? চলবাই বা কেমনে? না অয় এক কাম কর। দেইখা হুইনা, একটা বিয়া শাদী বইয়া যাও।’
গোলাপীর বাইশ বছরের যৌবনভরা দেহটা তীরের মতো খাড়া হয়ে উঠলো- দেহ খালা, ঐ কতা আর কইবা না, তোমার আল্লার কসম লাগে খালা, আমি সইবার পারি না।
পরদিনই গোলাপী কাছের একটি হোটেলওয়ালার দ্বিতীয় স্ত্রীর সংসারে কাজে বহাল হয়ে গেলো। ভোর ছ’টা থেকে আরম্ভ হয় গোলাপীর চরকীর মতো ঘোরা। সারাদিন যন্ত্রের মতো অবিরাম চলতে থাকে ওর আঁট সাঁট বাঁধা দেহটা।
বিরাট দোতলা বাড়ি। ছেলেমেয়ে সবশুদ্ধ ষোলজন। শাহী হোটেলের মালিকের এ স্ত্রীটি আবার পশ্চিমা। শাড়ী টাড়ি পরে না। বিরাট মাংসল শরীরে সিল্কের চকচকে সালোয়ার কামিজ পরা, সুরমা দেয়া মেহেদী রঙ্গা চুলে টারসেল ঝুলিয়ে বেনী বাঁধা মহিলাটির খনখনে গলার কিছু কিছু শব্দ গোলাপীকে মাঝে মাঝে বিব্রত করতো না যে এমন নয়। কিন্তু কর্তাব্যক্তিটি গোলাপীকে সুনজরেই দেখেন। কেনো না যাবতীয় কাজকর্ম অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথেই গোলাপী করে। সেই কাকডাকা ভোরে কয়লার গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মেজে মেয়েটার হাত ধরে বেরিয়ে যায়। যখন সূর্যাস্তের লালিমা এসে পৃথিবীকে বেষ্টন করে। দূর দূরান্ত থেকে কাক চিল ময়নারা সব উড়ে উড়ে আপন কুলায় ফেরে, সে তখন একটি ডানা ভাঙ্গা পাখি সন্তানের হাত ধরে ফিরে আসে আপন নীড়ে।
এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে মানুষ যা ভাবে তা কি সবসময় হয়? হয় না। হাজারটা নিওন লাইটের আলোতে একটি জোনাকী তার নিজস্ব আলো বিন্দু নিয়ে কোথায় যে লুকাবে তার ঠিক পাওয়া যায় না।
তাই হয়তো শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে একদিন গোলাপী বেগমের মার কাছে কেঁদে ফেললো। চাচীগো আমারে একটা দেইখা হুইনা নিকা দিয়া দেও। আমি যে আর চলবার পারি না। মরার মাইনসে আমারে খাবলে খাইবার চায়।
কি নিদারুণ দুঃখে যে গোলাপীর মুখ ফুটে কথাকটি বেরিয়েছিলো সে দিন তা একমাত্র অন্তর্যামীই জানেন। কিন্তু এক সরস কৌতুক মাখিয়ে কথাটাকে রসিয়ে রসিয়ে রটিয়েছিলো ও বাড়ির বাসিন্দারা। ওর সে বলার মধ্যে আর ওদের সে বোঝার মধ্যে ছিলো সেকি ব্যবধান। টোকানীর মা ছুটে এসে মুখের ওপরই বলে দিলো, ‘আমি কইছিলাম না যে মাগী থাকবার পারবো না, পিলপিলানী উঠবই। ঠোঁট বাঁকিয়ে মুখটা আরও বিকৃত করে সমস্ত শরীরে একটা ঝাঁকুনী দিয়ে আবার বললো-‘আ-লো পোড়ামুখী, শরম ভরম সব কি পিয়া খাইছস?
সেদিন সকালে দু’হাতের পিঠ দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে গোলাপী কুয়াতলায় গিয়ে বসলো। করিমের বউ তখন হাতের বদনাটা রেখে বাঁ হাতটা খুব করে মাটিতে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছিলো। আঙ্গুরীর হাত থেকে কয়লার টুকরাটা নিয়ে মুখের ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে চিবাতে চিবাতে গোলাপী বললো-‘হুনছো চাচী, ল্যাংড়া একটা ঘর আনছে আমার লেগা, তোমরা এটু কথা বার্তাটা কইয়া দেহ না।’
ফোঁস করে উঠলো করিমের বউ-‘হ। ঐ ল্যাংড়ার কথায় আমি নাচুম। কামতো আর পাই না, কি করুম।’
ল্যাংড়ার কিন্তু পিতৃপ্রদত্ত একটি নাম আছে- গেদু মিয়া। কৈশোরে ভাইয়ে ভাইয়ে এমনই ঝগড়া বাঁধিয়েছিলো যে সোনা মিয়ার একটি লাঠির আঘাতেই গেদু মিয়ার ডান পাটা এক্কেবারে চিরতরের জন্যে অবশ হয়ে গেলো। অনেক মালিশ, তেল পড়া মাখামাখি হয়েছিলো, কিছুতেই কিছু হলো না। সেই থেকেই গেদু মিয়া লাঠিতে ভর করে হাঁটে, আর অমনি আস্তে আস্তে সে গেদু থেকে ল্যাংড়া হয়ে গেলো। ওকে অবশ্য যে যাই মনে করুক না কেনো, একটু বেশী বাচাল বলে কিন্তু গোলাপী কেনো যেনো ওকে মোটেই অবহেলা করতে পারে না।
গোলাপীর মনে হয় একটি পা নেই, তাই লোকটা অত কাজ করে। আর সবার মতো দুটোই যদি থাকতো তাহলে...। যে সম্বন্ধটা এনেছে ও, গোলাপীর খুবই পছন্দ হয়েছে। অত জোয়ানও না বুড়াও না। স্বাস্থ্য ভালো। উঁচা-লম্বা। মুখ ভর্তি একরাশ দাড়ি। পাজামা পাঞ্জাবী পরে। চোখে হালকা করে সুরমার ছোঁয়া। মাথায় কিস্তি টুপি। প্রশস্ত কাঁধটা জুড়ে রয়েছে সাদা আর কালো মিশানো ডোরাকাটা একটি রুমাল। মাথা নীচু করে ধীরে সুস্থে কথা বলে। চুড়ি তৈরীর কারখানায় আছে। নাম গুল মোহাম্মদ খান। সব মিলিয়ে বড় ভালো লাগলো। গোলাপীর নিজের ভাগ্যটাকে একাধিকবার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হলো ওর। এমন ধনী, সম্মানী লোক যে একটি মেয়েসহ গোলাপীকে নিকা করতে রাজী হয়েছে, একি কম ভাগ্যের কথা? অবশ্য এতে ল্যাংড়ারও যে অপরিসীম দান রয়েছে তা গোলাপী বেশ বুঝে। ওইতো সেদিন গোলাপীকে দেখতে এসে হাতে পঞ্চাশ টাকার কড়কড়ে নোট গুঁজে দিলো অবলীলায়, তারপর আঙ্গুরীকে কোলে তুলে নিয়ে কতো আদর।
গোলাপীর তখন মনে হয়েছিলো জুম্মন মরে গিয়ে ওর ভাগ্যের রুদ্ধ দুয়ারের তালাটা খুলে দিয়ে গেছে। —ও বুয়া তুমি এই হানে। আ দূর উঠ জলদি কইরা এই দেহ খানসাব তোমার লগে কতা কইবো। ল্যাংড়ার অসময়ের উপস্থিতিতে চমকে উঠলো গোলাপী- আমার লগে। বাড়ির মুরুব্বীগো লগে কথাবার্তা কইয়াতো বিয়ার দিন তারিখ ঠিক অইচে, আবার আমি ক্যা?
উঁচু-নীচু দাঁতগুলো বের করে হাসলো ল্যাংড়া। —ইস। নয় বুঝ আর ছয় বুঝবার পারো না? জলদি আহ কইতাছি।
গোলাপী কি বুঝলো ও-ই জানে। একলাফে ঘরে গিয়ে ঢুকলো, ঝুলানো দড়ির ওপর থেকে একটা পরিষ্কার শাড়ি টেনে নিয়ে গুছিয়ে পরে নিলো। কিছুক্ষণ আগের আঁচড়ানো চুলের ওপর আবার নতুন করে চিরুনী বুলালো। বেড়ার গায়ে আটকিয়ে রাখা আয়নাটা টেনে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মুখটাকে দেখলো। আক্ষেপ হলো খুব ওর। একটু কাজলও নেই ঘরে যে চোখ দুটোতে একটু ছোঁয়াবে।
—কই বুয়া, অইলো তোমার?
ল্যাংড়া দ্বিতীয় তাগাদায় তাড়াতাড়ি মাথায় ছোট্ট একটি ঘোমটা টেনে কম্পিত পদভারে ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো গোলাপী।
ঘরের ভেতর মাথাটা ঢুকিয়ে ল্যাংড়া বললো —লন কতা কন খানসাব।
একটি নড়বড়ে চৌকির ওপর উপবিষ্ট গুল মোহাম্মদ খান একটু নড়ে চড়ে বসলো। তারপর বার তুই তিন গলাটা কেশে নিয়ে বললো—দেহেন আপনে আমারে পছন্দ করছেন তো, কেলা কইতাছি জানেন তো আমার আরো দুই দুইডা বিবি আছে, কিন্তুক হালারা কোন কামের না, এউগাও আমার কথা হুনে না। খসমের খেদমত করে না।—তাই হালায় আমি আপনেরে ঘরে নিবার চাই।
ঝটপট উত্তর দিলো গোলাপী। এই কথা কইয়া আর আমারে শরমিন্দা কইরেন না, আপনে হইলেন গিয়া ফেরেস্তার লাহান। চিক করে গালভর্তি পানের পিক ফেলে আনন্দে বিগলিত হলো গুল মোহাম্মদ খান, যাউগ্যা। আমি আপনের মুখে এট্টু হুনবার আইছিলাম। মুহূর্তে গলার স্বরটা পাল্টে গেলো খান সাহেবের। আস্তে করে নরোম গলায় টিয়ে পাখিকে লোকে যেমনি করে ডাকে ঠিক তেমনি আহ্লাদের সুরে ডাকলো, হুনো একটু কাছে আহনা।
চমকে উঠে গোলাপী। কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় ল্যাংড়ার দিকে তাকাতেই ল্যাংড়া নীচু গলায় টেনে টেনে বললো—যা...ও...। কয়দিন পরতো যাইবাই। অহন গেলে দোষ কি... যাও। আঁচলটা একটু টেনে ধীর পায়ে ঘরে গিয়ে দাঁড়ালো গোলাপী।
খান সাহেব গোলাপীর লজ্জা ভয় মিশ্রিত মুখটা তুলে ধরলো। কামনার আগুনে ধিকি ধিকি করে জ্বলে উঠলো গুল মোহাম্মদ খানের শরীরের লোমকূপগুলো। গোলাপীর মুখটা উর্ধ্বশিখা প্রদীপের মতো উজ্জ্বল হলো। পদ্ম পাঁপড়ির ওপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে যেমন থির থির করে কাঁপতে থাকে পদ্মপাতা, ঠিক তেমনি করে কাঁপছে গোলাপীর চিকন দুটো ঠোঁট।
ক্ষণিকের জন্যে হলেও খান সাহেব ভুলে গেলো যে তার শালতী শালতী হাতের দু’আঙ্গুলের ডগায় কাঁপছে একটি বিধবার মুখ।
সহসা যেনো সাগরের দু’প্রান্ত থেকে দু’টি ঢেউ আচমকা এসে লুটোপুটি খেয়ে মোহনায় পড়ে গেলো।
বিদায় নেবার সময় খান সাহেব গোলাপীর হাতে একশত টাকার একটি নোট গুঁজে দিয়ে বললো- রাখো যা যা লাগে কিনবার পারবা।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো গোলাপী। যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না। একসাথে এতোগুলো টাকা। এই বাইশ বছর বয়সে কোনদিন সে একসাথে এতোগুলো টাকা হাতে পায়নি। টুক করে সে খান সাহেবের পা ধরে সালাম করলো। টাকাটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরেছে গোলাপী। মহারাজের মতো ডান হাতটা গোলাপীর পিঠের ওপর তুরে আশীর্বাদ করলো খান সাহেব।
ল্যাংড়া যখন খান সাহেবকে পৌঁছে দেবার জন্যে ঘর থেকে নীচু হয়ে বেরুলো, তখনি হঠাৎ দমকা বাতাসের মতো একশ’ মাইল বেগে উড়ে এসে ঠিক খান সাহেবের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো পরীবানু।
ভালো লাগার আবেশে হাসলো গুল মোহাম্মদ খান।
ল্যাংড়া বিরক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বললো- হালার মোটকির নাতিন।
খান সাহেব একটু ইতস্ততঃ করে বললো- মগর বড়ই খুবসুরত তো...।
ল্যাংড়া বিরক্ত হলো— হ! চলেন জলদি।
সেদিন রাতে গোলাপীর চোখে ঘুম এলো না। সমস্ত দেহ মন জুড়ে এতো আনন্দ এতো শিহরণ তো আর কখনো জাগেনি। কোন রকমে রাতটা কাটলো গোলাপীর। সকালে উঠে প্রতিদিনকার মতো কাজে গেলো না ও। প্রথমেই মোড়ের দোকান থেকে টাকাটা ভাঙ্গিয়ে আনলো। দোকানী এতো সকালে কিছুতেই এতো টাকার ভাংতি দেবে না। একটু চিন্তা ভাবনা করে এক প্যাকেট ‘রাজা’ কিনলো গোলাপী। ঘরে এসে আঙ্গুরীকে পাঠিয়ে বড় বড় দুটো বাকরখানি আর রসগোল্লা আনালো। আজ আর পান্তা নয়। একেবারে খান্দানী নাস্তা। মনে মনে মুচকি হাসলো গোলাপী। আঙ্গুরীর সমস্ত শরীর পার্কের দোলনায় দোল খাওয়ার মতো দুলতে লাগলো। গোলাপী যেনো সে হাসি মাখা মুখের ছায়ায় স্বর্ণ সুখ খুঁজে পেলো।
দুপুরে আজ ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেলো ওরা দু’মায়ে ঝিয়ে। এক খিলি পান কিনে আনলো আঙ্গুরী। ঠিক সে সময় ফেরী করে শাড়ী কাপড়ওয়ালা যাচ্ছিলো সে পথ দিয়ে। ছুটে গিয়ে ডাকলো গোলাপী, ও-মিয়া শুনো......। একটা বাসন্তী রঙের লাল পেরে শাড়ী কিনলো গোলাপী সত্তর টাকায়। অনেক দিনের পালিত স্বপ্নের সফলতা এলো আজ।
ওদেরকে আজই মানা করে দিতে হবে। খেটে খাবার দিন শেষ হয়েছে তার। মনে মনে ভারী কৃতজ্ঞ হলো গোলাপী সে লোকটির উদ্দেশ্যে।
গোলাপীকে না পেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যাচ্ছিলো ল্যাংড়া। করিমের বউ দাওয়ায় বসে মাটির চুলা তৈরী করছিলো নক্সা করে। একটু আড় চোখে চেয়ে মিষ্টি হেসে ডাকলো— অই ছ্যাঁড়া কই যাস, আয়না হেনে একটা কতা কই। ল্যাংড়া ফোঁস করে উঠলো— দূর হালার মোটকি তর কাম তুই কর, আমার সময় নাই। শরীরে অত্যাধিক মেদ জমার ফলে দিন দিন শুধু প্রস্থে বাড়ছিলো। করিমের বউ দৈর্ঘ্যে অবশ্য চার ফুটও হবে না। বাড়ির ছোট বড় সবাই ওকে মোটকি
বলেই ডাকে। ল্যাংড়ার তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথায় বিন্দুমাত্রও বিচলিত হলো না করিমের বউ। বরং দ্বিগুণ উৎসাহে বললো, যার কাছে আইছিলা, হে আবার ঘরে থাকনের মানুষ নিহি, তাইলে বাইরে ফষ্টি নষ্টি করবো কেঠা।
ভুরু জোড়া কুঁচকালো ল্যাংড়ার। এক লাফে করিমের বউয়ের কাছে গিয়ে বসলো ল্যাংড়া— কি কইলা খালা।
—কমু আর কি আমার কপালেরই দোষ। ক্যা, আমার নাতীন পরীবানুরে তুই চোখে দেহছ না? জুয়ান জাহান আবিয়াতা ছেঁড়িটারে থুইয়া তুই গেলি ঐ বুইড়া মাগী, খসম খাগীর নিহা ঠিক করবার। দেহিছ এমুন ভালো ব্যাটাটার কাছে এই বদ মাগীটারে দিয়া তুই যদি বদনাম না অইছস তো আমার কান কাইট্যা কুত্তার গলায় ঝুলামু।
—কি! গোলাপীবুয়া এতো খারাপ খালা? আমি এট্টুও বুঝবার পারিনাইক্যা। ইস খালা আল্লাহ মেহেরবান। তুমি আমার ইজ্জত বাঁচাইছো খালা। আমি- আমি আইজই...। কিন্তুক খালা পরীরে তুমি ঐ বুইড়াটার লগে হতীনের ঘরে...।
—দূর ছ্যাঁড়া। তর যে কথা। ব্যাটাগো আবার বয়েস কিরে? রোগ শোক নাইকা, জুয়ান তাগড়া। টাকা পয়সা আছে...আর কি লাগেরে?
গোলাপীর ওপর থেকে চট্ করে মনটা উঠে গেলো হুজুগে মানুষ ল্যাংড়ার। মানুষটাকে সে এতো ভালো জানতো। নাহ থাকুক পড়ে ওর ভাগ্য নিয়ে। খানসাবকে সবকথা খুলে বলতেই হবে আজ। হাতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে আপন মনে গজরাতে লাগলো গেদু মিয়া ওরফে ল্যাংড়া।
No comments:
Post a Comment