জরুরী অবস্থা
শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী
১
‘ভোট দিবেন কুনখানে?’ প্রশ্ন করে মিছিলের সামনে চলতে থাকা আট-দশজন।
পেছন থেকে সমস্বরে জবাব আসে, ‘গাই বাছুরের মাজখানে’। আজ কয়েকদিন হল এইরকমই মিছিল চলছে বিভিন্ন দলের। সময়-অসময় নেই, প্রায় সারাদিনই গাঁয়ের রাস্তায়, কোন না কোন দলের মিছিল চলছে। সবাই ওই একই প্রশ্ন করে, কোথায় ভোট দেবেন? শুধু উত্তর আলাদা – গাই-বাছুর না লাঙল-কাঁধে-চাষা। মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলো সব ভরে গেছে নির্বাচনী প্রতীক চিহ্নে আর লেখায়। যেমন - আসন্ন ষষ্ঠ লোকসভা নির্বাচনে আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় লোকদল প্রার্থী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করুন। দেশ বাঁচান, গণতন্ত্র বাঁচান। স্বৈরাচারী ইন্দিরা গান্ধীর কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। প্রশ্নও আছে কিছু - ইন্দিরা গান্ধীর মাইলো, কী দিয়ে খাইলো? নিচে ইন্দিরা গান্ধীর বিকৃত মুখচ্ছবি, নাকটা যেন অস্বাভাবিক লম্বা। মনে পড়ে, বছর কয়েক আগের কথা। খাবারের খুব কষ্ট! একফসলি জমি, ঘরে ঘরে চাল বাড়ন্ত। তখন রেশনে গম, মকাই, মটকলাই এসব দেওয়া হত। পাশের দেওয়ালে আবার ইন্দিরা গান্ধীর সুন্দর মুখ, সঙ্গে গাই-বাছুর। উমাশশীর ভারি ভাল লাগে এইসব দেখতে। ঘুঁটে দেওয়া বন্ধ করে হাঁ করে দেখতে থাকে মিছিলের চলে যাওয়া। কেমন সবাই দলবেঁধে লাইন দিয়ে চলেছে – একপাড়া থেকে অন্য পাড়া, এক গাঁ থেকে অন্য গাঁয়ে। মনে হয় সেও বুঝি চলে যায় ওদের সঙ্গে। যেমন অমল চলে যেতে চেয়েছিল দইওলার সঙ্গে!
‘অ মেজগিন্নি, সকাল সকাল হাঁ করে তুমি মিছিল দেকচ? এমন হাবলা মেয়্যা জন্মে দেখিনি বাপু। আজ কি ঘুঁটা দিয়েই দিন কাবার করবে? সংসারের অন্য কাজ-কম্ম কিছু নাই? সিস্টির কাজ পড়ে আচে...ইস্কুলের ভাত। উনি এখন মিছিল দেকচেন। তাড়াতাড়ি লেয়ে এসে মশলাটা বাটো’।
বড় জায়ের চীৎকারে সম্বিত ফেরে উমাশশীর। তাড়াতাড়ি ঘুঁটে দেওয়া শেষ করে গামছা নিয়ে পুকুর-ঘাটে চান করতে যায় তেরো বছরের মেজগিন্নি। তার দিন শুরু হয়েছে সেই কোন্ ভোরে। প্রথমে সারা উঠোন-রান্নাঘর ঝাঁট দেওয়া, উনুনের ছাই ফেলা, ছাই ফেলার আগে আধপোড়া কয়লা আলাদা করা, রাতের বাসনকোসন পুকুর থেকে ধুয়ে আনা, গোবর জল দিয়ে পুরো উঠোন, ছাঁচতলা (টিনের চাল থেকে বৃষ্টির জল পড়ে উঠোনে যে ছোট নালার সৃষ্টি হয়), ওলতলা (বাড়ির একপ্রান্তে অবস্থিত মাটির মূত্রবাহী নালা), রান্নাঘরে ন্যাতা দেওয়া, গোয়াল থেকে পরের দিনের ঘুঁটে দেওয়ার জন্য গোবর সংগ্রহ করা (টাটকা গোবরে ঘুঁটে দেওয়া খুব শক্ত কাজ), তারপর ঘুঁটে দেওয়া – মোটামুটি এই হল চান করার আগে উমাশশীর রোজনামচা।
উমাশশীর শ্বশুরবাড়ি একান্নবর্তী পরিবার। শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাশুর, জা, দেওর, ননদ, ভাশুরের ছেলে-মেয়ে সব মিলিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বত্রিশ জন। পুরনো জমিদারবাড়ি। জমিদারি এখন আর নেই, তবে জমি এখনও আছে প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি বিঘা। চাষবাসের আয়েই সংসার চলে। চাষের কাজ সব নিজেরাই করে। মুনিষ দিয়ে করালে অনেক খরচ। তিনতলা মাটির বারান্দা বাড়ি। বাড়ির পেছনের দিকে একটি বড় পুকুর। এক পাড়ে তাল গাছ, অন্য পাড়ে আম গাছের সারি। পাথর দিয়ে বাঁধানো ঘাট। তাছাড়া আরও একটি ডোবা আছে রান্নাঘরের পেছনের দিকে। সেই ডোবার পাড়ে ফলের বাগান – কলা, পাতিলেবু, বেদানা ইত্যাদি গাছের সমাহার। বাড়ির উঠোনের অর্ধেক অংশে কিছু শাক-সব্জির চাষ। লাউ, কুমড়ো, পুঁই, চিচিঙ্গে এবং নানা রকমের শাক এই বিশাল পরিবারটির দৈনন্দিন চাহিদা মেটায়। উঠোনের বাকি অংশে ধানের মরাই, ধান সেদ্ধ করার বিশাল উনুন, একপাশে ঢেঁকিশাল, তারপর অনেকটা ফাঁকা জায়গা।
উমাশশী চান করে এসে তার বাকি কাজগুলি করতে থাকে নীরবে। হঠাৎ বৃষ্টি নামে অঝোর ধারায়। উমাশশীর মনে পড়ে ইস্কুলে ক্লাস সেভেনের পরীক্ষায় একবার বাংলা রচনা লিখতে দিয়েছিল – একটি বর্ষণমুখর দিনের বর্ণনা। উমাশশী ব্যাকরণ বই মুখস্থ করে আর ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছু ভাল ভাল কথা লিখেছিল – বর্ষাকালে চাষবাস হয়, সারা মাঠে কচি কচি ধানগাছের চারা, মেঘেরা উড়ে যায়, ময়ুর পেখম তুলে নাচে। আরও কিছু লেখার ইচ্ছে ছিল, যেমন – কাঁচা রাস্তায় এত কাদা হয় যে ইস্কুল যাওয়ার পথে দু চারবার গড়াগড়ি খায় অনেকেই। তাছাড়া পুকুর পাড়ে পেচ্ছাপ, পায়খানার জন্য যাওয়াটাও বেশ কষ্টের। পরীক্ষার খাতা বলে এসব কথা উমাশশী লেখেনি। উমাশশী ভাবে, আজ যদি কেউ তাকে বলে ওই একই রচনা লিখতে – সে সব বর্ণনা লিখে দেবে, একেবারে যথাযথ। যেমন – বর্ষাকালে তাল পড়ে, সেই তাল দিয়ে তালের রুটি আর বড়া বানানো হয়। বর্ষার দুপুরে সব কাজ সেরে যখন উমাশশী একটু শুতে যায়, তখনই ডাক আসে, ‘মেজবউমা, তাড়াতাড়ি নেমে এস, তাল মাড়তে হবে’। উমাশশীকে অন্তত দশটা তাল মাড়তে হয়। তিনটি করে আঁটি হলে, তিরিশটা আঁটি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কোন কোন তালের দুটি আঁটি থাকে। তালের খোসা ছাড়িয়ে, তাল ভেঙে, সেইসব আঁটিগুলোকে এক এক করে, উলটো-করে-রাখা বাঁশের ঝোড়ার (ঝুড়ির পুংলিঙ্গ) উপর থেকে নিচে টানতে হয়। ঝোড়ার ভেতরে কাঁসার থালা রাখা থাকে, সেখানেই তালের নির্যাস জমা হয়। তালের খোসাগুলি গোয়ালে দিয়ে আসতে হয়, গরুরা তৃপ্তি করে খায়।
বর্ষাকালের আর এক স্মৃতি হল রাশি রাশি চুনো মাছ বেছে রাখা। জমির শেষ প্রান্তের ঢালানে যেখানে জল গিয়ে বড় নালায় পড়ছে, সেখানে বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি বাড় রাখা হয়। বাড় হল অনেকটা বেড়ার মতোই জিনিস কিংবা বাঁশের কাঠির মাদুরও ভেবে নেওয়া যায়। সেই বাড় খাড়া করে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। বাড়ের কাঠিগুলোর মধ্যে কিছুটা ফাঁক থাকে, যাতে জল গলে বেরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু মাছ পারে না। স্রোতের টানে ভেসে এসে মাছগুলো সব বাড়ে আটকে যায়, তারপর লাফিয়ে অন্যদিক দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে, কিন্তু স্রোতের বিপরীতে যাওয়া কি অতই সহজ? বাড়ের শেষপ্রান্তে, একটু পেছনে, একটি বড় গর্ত করা থাকে। গর্তের উপরে তালপাতা অথবা কাঁটাগাছের ডাল দিয়ে চাপা দেওয়া থাকে। বাড় এবং গর্তের সংযোগ হয় একটি ছোট নালার মাধ্যমে, সেই নালার উপরে একটি ছোট বাড় ঢালু করে রাখা থাকে। মাছেরা বাড়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধস্তি করে, সেই নালার মাধ্যমে গর্তে এসে পড়ে। ফলত উমাশশীর কাজ যায় বেড়ে। দেওররা ঝোড়া ভর্তি করে করে পুঁটি, মাগুর, ল্যাটা, চ্যাং এইসব মাছ নিয়ে আসে। জিওল মাছগুলো উঠোনে বড় গর্ত করে জলে ছেড়ে রাখা হয়, প্রয়োজনমত সেখান থেকে নিয়ে রান্না হয়। মুশকিল হয় পুঁটিমাছগুলোকে নিয়ে, সেগুলো আসার সঙ্গে সঙ্গেই পরিষ্কার করে বেছে, কাঠের উনুনে ভেজে তুলে রাখতে হয়। দিনের বেলা হলে ননদরা মাছ বাছার কাজে সাহায্য করে উমাশশীকে, কিন্তু রাতে উমাশশীকে একাই মাছ বাছা এবং ভাজার কাজ করতে হয়। সারাদিনের কাজের পরে সেই হয়তো ঘুমটি লেগেছে চোখে, তখন ঘুম চোখে উঠে এসে মাছ বাছা এবং ভাজা – সে যে কী কষ্ট!
২
ভোট শেষ পর্যন্ত এসেই পড়ল। চারজন ভোট বাবু, সঙ্গে জিনিসপত্র নিয়ে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেছে গ্রামে। গ্রামের একমাত্র প্রাইমারী স্কুলটিই হবে ভোটকেন্দ্র। বেশ একটা উৎসবের আবহ। চারিদিকে ফেস্টুন, পতাকা, পোস্টারে ছেয়ে গেছে স্কুল চত্বরটি। স্কুলবাড়ির টিনের চাল থেকে সরু সরু পাটের দড়ি সূর্যকিরণের মত ছড়িয়ে গেছে আশেপাশের সব গাছে। সেই সব দড়ির উপর ছোট কাগজের পতাকা আঠা দিয়ে সাঁটানো হয়েছে, বিভিন্ন দলের নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন। বুড়ো শিমুলগাছটার সর্বাঙ্গে কাগজের পোস্টার, যেন নতুন পোশাক পরেছে। দলুইদের উঠোনে ন্যাংটো ছেলেমেয়ের দল, খেলা ভুলে ভোটের প্রস্তুতি দেখছে। ভোট বাবুরা সব ব্যস্ত ব্যবস্থাপনায়। টেবিল-চেয়ারগুলোকে জায়গামত সাজায়, কোথায় ভোটার লিস্ট দেখে নাম মেলানো হবে, স্লিপ দেওয়া হবে, সই অথবা টিপছাপ নেওয়া হবে, কোথায় ব্যালট পেপার দেওয়া হবে, তারপর সেই প্রায়ান্ধকার চটের চেম্বার - ব্যালট পেপারে ছাপ দেওয়ার পর কাগজ ভাঁজ করে ব্যালট বাক্সে ফেলতে হবে।
উমাশশীর শ্বশুরবাড়িতেই ভোট বাবুদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, যেহেতু তারাই এই গ্রামের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু পরিবার। ভোটের আগের রাত থেকে, পরের দিন ভোট হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তারা এখানেই থাকবে। তবে, সকলে নয়। তিনজন স্কুলবাড়িতেই থাকবে, ব্যালট পেপার পাহারা দেওয়ার জন্য। শুধু একজন, যে বড় অফিসার - পিসাইডিং অফিসার না কী যেন নাম, সে রাত্রে থাকবে। পরের দিন তো ভোট হয়ে গেলে সন্ধ্যে নাগাদ লটবহর নিয়ে সবাই চলে যাবে।
উমাশশীর মনটা আজ ভারী খুশী খুশী। শ্বশুরমশাই নিজে ডেকে তাকে বলেছে, ‘শহর থেকে বড় বাবুরা আসচে ভোটের কাজে, দেখবে তাদের যত্ন-আত্তির কোন ত্রুটি না হয় - তোমার শ্বশুরবাড়ির সম্মানের ব্যাপার। আশপাশের বিশটা গাঁয়ের লোক একডাকে আমাদের চেনে’। উমাশশী তাই সকাল থেকে খুব উৎসাহ নিয়ে কাজ করে চলেছে। পুকুরঘাটে গিয়ে তেল, শালপাতা দিয়ে কাঁসার বাসনগুলোকে ঘষে ঘষে একেবারে ঝকঝকে করে তোলে, তিনবার বড় দুয়ারটি ঝাঁট দেয়, চারটি ঝালর-দেওয়া, নকশা-করা বড় আসন বের করে রাখে। একবার ঘরে গিয়ে ফটো দুটি কাপড় দিয়ে মুছে আসে। ফটো দুটি আসলে সূচিশিল্প - কাপড়ের উপর সুতো দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে লেখা কিছু বাণী, উমাশশীর প্রাকবৈবাহিক হাতের কাজের নিদর্শন। উমাশশী বিয়ের পর, সার্টিফিকেটের মত সঙ্গে করে এনেছে। একটিতে লেখা আছে – ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ অন্যটিতে – ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পূরিল/ সকলই ফুরায়ে যায় মা’। উমাশশী দুই বাণীর ভাবার্থ বের করতে পারল আজ। প্রথমটির মানে – আরও কাজ করতে হবে সংসারের জন্য, মুখ বুজে সব মুখঝামটা সহ্য করে যাও। দ্বিতীয়টি মানুষের অবশ্যম্ভাবী শেষ পরিণতি। কিন্তু তের বছরেই উমাশশীর মনে হতে লাগলো – সকলই ফুরায়ে যায় মা। তার উপর বাবা মায়ের ভালবাসার তো অন্ত ছিল না, তাহলে কেন এই বয়সেই তাকে বিদেয় করার জন্য এমন উঠে পড়ে লাগলো? তাও এত বড় পরিবারে? যেখানে ভোর থেকে রাত অব্দি শুধু কাজ আর কাজ। আলোচনার জন্য অন্য কোন বিষয় নেই। পড়াশোনার চর্চাও ওই নামমাত্র। ছেলেরা সব সকালে উঠে মুড়ি খেয়ে, মাঠে গরু চরাতে চলে যায়। তারপর মাঠ থেকে ফিরে এসে, পুকুরে একটা ডুব দিয়ে এসে ভাত খেতে বসে যায়। তারপর কোনরকমে বই, খাতা বগলে ইস্কুলে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। আশ্চর্য নয় যে - এই বাড়ীরই ক্লাস ফাইভের ছাত্র অবলীলায়, অবহেলায়, ক্লাস সিক্সের বিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়ে দেয়। প্রশ্ন ছিল – ‘যত্রতত্র প্রস্রাব করিলে কী হয়?’ উত্তর এল – ‘ভূতে ধরে’।
যাকগে সে-সব কথা। কথা হচ্ছিল আজ উমাশশী খূব খুশী। তার একটা কারণ যদি হয়, বাইরের লোকজন বাড়ীতে আসছে, কিছু অন্য জগতের কথা জানা যাবে, তাহলে প্রধান কারণটি হল আজ উমাশশীর বর আসছে! উমাশশীর বর শশিভূষণ গ্রামের বাড়িতে থাকে না, সে এখনও ছাত্র, মেদিনীপুর কলেজে পড়ে – পি ইউ অর্থাৎ প্রি ইউনিভার্সিটির পড়া। মেদিনীপুর শহরেই গ্রামের পরিচিত একজনের বাড়িতে থাকে, নিজে রান্না করে খায়। পনের-কুড়ি দিন অন্তর বাড়ি আসে।
শশিভূষণ বাড়ি এলে উমাশশী নিজের কষ্টের কথা বলে একটু হালকা হয়, নাহলে তো সেই একটানা দিনের পর দিন মুখ বুজে কাজ করে চলা। তাও তো দিনের বেলা কথা বলার যো নেই, অল্প কিছু কথাবার্তা সেই রাত্রে। শশিভূষণেরও বিশেষ কিছু করার ছিল না তার প্রবল প্রতাপান্বিত বাবা এবং বড় দাদার সামনে। শুধু সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘এখন সব সহ্য করে চল, একদিন ঠিক সুদিন আসবে। আমি পড়াশুনোটা শেষ করে চাকরি পাই, তোমাকে নিয়ে চলে যাব এখান থেকে’।
একটু ভেবে দেখলে অবশ্য উমাশশীর শ্বশুর, ভাশুরের অসন্তোষের সঙ্গত কারণ ছিল কিছু। তারা ঠিক করেছিল শশিভূষণের বিয়ে দেবে তার দাদার শালীর সঙ্গে। দাদার শ্বশুরবাড়ি পাশের গ্রামেই, তারাও সম্পন্ন গৃহস্থ, জমি-জায়গা আছে। বিয়েতে তিন বিঘা জমি দিয়ে দেবে। দুই বোনে দুই জা হবে। তাছাড়া বোনটিও গৃহকর্মনিপুণা, বয়সেও উমাশশীর থেকে বেশ কিছুটা বড় হবে। বড় সংসারের পক্ষে একেবারে আদর্শ বউ। কিন্ত শশিভূষণ ততদিনে মন দিয়ে ফেলেছে – হবু-পত্নীকে নয়, হবু-শ্বশুরমশাইকে। তিনি একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং হাইস্কুলের শিক্ষক। পুজো-আচ্চা, বিবাহ, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, হোম-যজ্ঞ ইত্যাদি কাজে দূরদূরান্ত থেকে তাঁর ডাক আসে। আশেপাশের গ্রামে শিষ্য-সামন্তও অনেক। উমাশশীর শ্বশুরবাড়ির পাশেই হাজরাদের বাড়ি। হাজরা বাড়ির এক বউ বিধবা হয় খুব অল্পবয়েসেই। তার স্বামী কলকাতায় দর্জির কাজ করত। শখ করে দাড়ি রেখেছিল। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় সে খুন হয়ে যায় হিন্দুদের হাতেই। অস্থির সময় তখন – দাড়ির শ্রেণী-বিভাজন করার সময় ছিল না কারও হাতে!
সেই হাজরা গিন্নি পণ্ডিতমশায়ের শিষ্যা। বলেছিল, ‘বাবা, আমাদের সন্ধানে একটি ভাল পাত্র আছে, আমাদেরই পুরোহিত মশায়ের ছেলে – সহজ সরল, পড়াশোনায় ভাল, ম্যাট্রিকে অঙ্কে লেটার পেয়েছে, পুজো-আচ্চায় খুব ঝোঁক। ওখানে দিদির বিয়ে হলে, আমাদের কাছাকাছিই থাকবে, আমরা দেখাশোনা করতে পারব’।
পণ্ডিতমশায়ের মনে একটু দোটানা ভাব। ছেলেটিকে তিনি দেখেছেন মনে হল। ওদের গ্রামেই তিনি যখন রটন্তী কালী পুজো করতে এসেছিলেন, একটি ব্রাহ্মণ ছেলে পাশে পাশেই ঘুরছিল। পুজোর কাজে সাহায্য করছিল, আর মন দিয়ে সব আচার-অনুষ্ঠান লক্ষ্য করছিল। তারপর যখন তিনি উদাত্ত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন, তখন ছেলেটি একেবারে মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। সেই ছেলেটিই হবে মনে হয়। কিন্তু উমার বয়স যে বড্ড কম। অন্তত সেও ম্যাট্রিকটা পাশ করুক। শিষ্যাকে বললেন সে কথা।
হাজরা গিন্নি বলল, ‘বাবা, ওর অন্য জায়গায় বিয়ের সম্বন্ধ চলছে, তাড়াতাড়িই ঠিক হয়ে যাবে মনে হয়। আপনি অনুমতি দিলে, আমি ওদের বাড়িতে কথা বলব। ছেলেটি আপনাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, মনে হয় না তার কিছু আপত্তি হবে। আমি বলি কী, কথাবার্তাটা চালু হোক না, তারপর দেখা যাবে। যদি ঠাকুরের ইচ্ছায় বিয়েটা লেগে যায়, তার থেকে ভাল আর কিছুতে হয় না। পড়াশুনাটা না হয় বাড়িতে থেকেই করবে, এখন তো অনেকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাশ করছে’।
পণ্ডিতমশাই কথা বললেন। ছেলে সানন্দে রাজি, পাত্রী দেখারও প্রয়োজন বোধ করল না। পণ্ডিত মশাই শ্বশুর হবেন, পড়াশুনাটা চালু থাকবে, আর কী চাওয়ার আছে? ছেলের বাবা-মা নিমরাজি। কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়। ছেলের দাদা এবং দাদার শ্বশুর ঠিক করল, ছেলেকে কিছুদিন বাড়িতেই চোখে চোখে রাখতে হবে, তারপর বিয়ের দিন বাড়ি থেকে সটান তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ের আসনে বসিয়ে দেওয়া যাবে। সেইমত লোকলস্করও তৈরি হয়ে রইল। কিন্তু বিয়ের দিন সকালে শশিভূষণকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। খোঁজ করে জানা গেল, সে ভোরবেলাতেই পৌঁছে গেছে তার হবু-শ্বশুর বাড়িতে। দাদা সেখানেও লোক পাঠাল তাকে নিয়ে আসার জন্য, কিন্তু শশিভূষণ এল না।
উমাশশী ভারী হতভম্ব হয়ে বসে রইল। আজ পঁচিশে বৈশাখ। ইস্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। সে আজ একটি কবিতা বলবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৈবেদ্য বই থেকে।
পুরো মুখস্থ হয়ে গেছে,
‘প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী,
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
করি জোড়কর, হে ভুবনেশ্বর
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
তোমার অপার আকাশের তলে
বিজনে বিরলে হে –
নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে......’
বন্ধুরা ডাকতে এসেছে ইস্কুলে যাবার জন্য। তাদের সকাল সকাল স্নান হয়ে গেছে। শাড়ি পরেছে সবাই। কারও হাতে টগর ফুলের মালা। কিন্তু উমাশশীর যাওয়া হল না, মা তাকে আজ ইস্কুল যেতে নিষেধ করেছে। আজ নাকি তার বিয়ে! ভোরবেলাতেই যে মুশকো ধরণের ছোট-চুল, খাটো-ধুতি-পরা লোকটা এসেছে, সেই নাকি তার বর!
বিয়েটা হয়ে গেল অনাড়ম্বর ভাবে। উমাশশী তার এযাবৎ দেখা বিয়ে বাড়ির সঙ্গে এই বিয়ের কোন মিল খুঁজে পেল না। বাজনা নেই, সানাই নেই, ঝলমলে আলো নেই, লোকজনও বিশেষ নেই – শুধুমাত্র গুটিকয় জ্ঞাতি এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা। বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান অবশ্য সব হল নিয়মমতো। তারপর শ্বশুরমশায়ের পাঠানো ভাঙা পাল্কিযোগে উমাশশীর পতিগৃহে যাত্রা। পাল্কি যখন মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, উমাশশীর মনে হচ্ছিল পাল্কি থেকে নেমে একছুটে পালায় কোন একটা দিক ধরে, একেবারে মাঠের শেষে, যেখানে আকাশটা উল্টানো-গামলার মত মিশে রয়েছে পুকুরপাড়ের তালগাছের সারিতে। কিন্তু নানা কারণে সেটা অসমীচীন এবং অসম্ভব মনে হওয়াতে পাল্কির মধ্যে বসেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছেও বিশেষ লোকজন দেখতে পেল না উমাশশী। অনুষ্ঠানবাড়ি বলে মনেই হয় না। অবশ্য শ্বশুরবাড়ির যা জনসংখ্যা, তাতে প্রতিদিনই মোচ্ছব, সে-কথা পরে বুঝেছে উমাশশী। যাই হোক, শ্বাশুড়ি মা বরণ করে ঘরে তুললেন। কচিকাঁচারা ঘিরে ধরল মেজবউ কে। শশিভূষণ কী করবে ঠিক করতে না পেরে একটা পুরনো রেডিয়োর নব ঘোরাতে লাগল।
৩
রাতের খাওয়া-দাওয়ার আগে সদর দুয়ারে (দুয়ার মানে দ্বার নয়, একতলার বারান্দা)বসে ভোট বাবুদের সঙ্গে উমাশশীর শ্বশুর, ভাশুর, বর এবং গ্রামের আরও কয়েকজন গণ্যিমান্যি লোকের কথাবার্তা হচ্ছিল। উমাশশী মাঝে মাঝে উঁকি মেরে যাচ্ছিল সেখানে – কী কথাবার্তা হচ্ছে শোনার জন্য। ইন্দিরা গান্ধী, সঞ্জয় গান্ধী, জরুরী অবস্থা, দুর্নীতি, স্বৈরাচারী, নকশাল, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এইসব শব্দাবলী উমাশশীর কানে আসতে লাগল। গ্রামে যে-ভোটপার্বণ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই উমাশশীর মনে কিছু প্রশ্ন জমা হয়েছিল। সে ঠিক করল, আজ রাতে শোওয়ার পর তার বরের কাছ থেকে এই সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর জেনে নিতে হবে।
রান্নামেলা থেকে হাঁক পাড়ল শ্বাশুড়ি, ‘মেজবৌমা সবাইকে খেতে আসতে বল’।
উমাশশী সদর দুয়ারে গিয়ে বলল সবাইকে খেতে আসার জন্য। দেখতে পেল সকলের সঙ্গে কালীচরণ সামন্তও আছেন। গ্রামের একজন বিচক্ষণ মানুষ হিসাবে তাঁর বিশেষ সুখ্যাতি আছে। এই মানুষটিকে উমাশশী বিশেষ শ্রদ্ধা করে। উমাশশীকে দেখে হেসে বললেন, ‘কিরে মা, ভাল আছিস?’
এই সাধারণ প্রশ্নটিতে কী যে ছিল, উমাশশী তা বুঝিয়ে বলতে পারবে না, কিন্তু সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। হয়তো এমন এক আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল সেই কুশল-জিজ্ঞাসায়, যা সে বহুদিন পায় নি। এমনও হতে পারে এই পিতৃতুল্য মানুষটিকে দেখে উমাশশীর আবার তার বাপের বাড়ির কথা মনে পড়ে গেছে। এছাড়া অন্য যে-সম্ভাবনা আছে, সেটি হল কিছুদিন আগে এই বাড়িরই একটি পারিবারিক বিবাদে মধ্যস্থতা করেছিলেন কালীচরণ সামন্ত এবং সমবেত রোষানল থেকে রক্ষা করেছিলেন উমাশশীকে। সেই ঘটনায় যাবার আগে দেখা গেল, উমাশশী শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে রান্নামেলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সেদিনও শশিভূষণ বাড়ি এসেছিল মেদিনীপুর থেকে। টিউশনি পড়ানোর টাকায় উমাশশীর জন্য তেল, সাবান, শ্যাম্পু, ব্লাউজ এসব কিনে এনেছিল। সেটাও বড় জায়ের সহ্য হত না। বলত, বাড়ি থেকে চাল নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে বৌয়ের জিনিস কিনে আনে। খাওয়ার ব্যাপারে শশিভূষণের কোন বিলাসিতা ছিল না, অবশ্য কোন্ ব্যাপারেই বা ছিল! বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া চাল ফুটিয়ে, একটু পুঁইডাঁটা সেদ্ধ অথবা কচু ভাতে দিয়ে ভাত খেয়েও অনেকদিন কাটিয়েছে। বড় বৌদির আপত্তিতে চাল নিয়ে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায় তারপরে। সেদিন উমাশশীর সেজ দেওরের বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে লোকজন এসেছিল বাড়িতে। উমাশশীর শ্বশুর বলল, ‘বৌমা, সন্ধ্যাটা দিয়ে দাও’।
উমাশশী বাসি কাপড় ছেড়ে ধোওয়া কাপড় পরার জন্য উপরের ঘরে গেছে। কাপড় পরার সময় শুনতে পেল নিচের থেকে শাঁখের আওয়াজ আসছে। ভয়ে উমাশশীর গলা শুকিয়ে গেল। তাহলে কি অন্য কেউ সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিল? তার কি কাপড় ছাড়তে খুব দেরী হয়েছে? উমাশশী ছুটতে ছুটতে ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখে সেখানে তো প্রদীপ জ্বলছে না। উমাশশীর স্পষ্ট মনে আছে - সে প্রদীপে তেল, সলতে দিয়ে ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে গিয়েছিল। তাহলে কি তুলসীমঞ্চের কাছে আছে? না, সেখানেও নেই।
উমাশশী এত ভয় পেয়ে গেল, কাউকে জিজ্ঞেস করার শক্তি পর্যন্ত সে হারিয়ে ফেলল। জিজ্ঞেস করলেই হয়ত বলবে, ‘তুমি ল্যাকা মেয়্যা, এত বয়স হয়ে গেল এখনও জান নি, সন্ধ্যা দেওয়ার পরে শাঁখ বাজানো হয়?’ সে ঠাকুর দুয়ারের একপাশে চুপচাপ বসে রইল।
কিছুক্ষণ পরে উমাশশীর বড় জা কাঁদতে কাঁদতে ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে এল। হাতে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলছে। উমাশশী ঠাকুর ঘরের দরজা থেকে দেখতে পেয়েছিল, ঠাকুর ঘরের এক কোণে আমের ঝোড়ার পেছন থেকেই প্রদীপটি আবিষ্কৃত হল। যদি কুলুঙ্গি থেকে পড়ে গিয়ে থাকতো, তাহলে তো তেল, সলতে সব ছিটকে যাওয়ার কথা। সেরকম কিছু ঘটে নি। তাছাড়া বড় জা যেভাবে সাবলীল ভঙ্গিতে প্রদীপটি বের করে আনল, তাতে সন্দেহ করার অবকাশ আছে যে, সেই হয়তো কিছু আগে প্রদীপটি লুকিয়ে রেখে এসেছিল আমের ঝোড়ার পেছনে।
বড় জা চিৎকার করে কাঁদছে আর সন্ধ্যা দেখাচ্ছে তুলসীমঞ্চে, ‘ওলো, আজ আমাদের কী সব্বোনাশ হোলো লো? ঠাকুরঘরে সন্ধ্যা পড়ে নি। ছ্যানাপ্যানা লিয়ে ঘর-সংসার। যদি কিছু ভাল-মন্দ ঘটে যায়, আমাদের কী হবে গো? সংসারের এত বড় অমঙ্গল কী করে সইব গো?’
উমাশশী কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘ও দিদি, তুমি চুপ কর। অমঙ্গল কিছু হলে আমার দোষেই হয়েছে, তার শাস্তি আমি ঠিকই পাব। আমার দোষ কেন সংসারের গায়ে লাগবে?’
বড়গিন্নী মুখ ঝামটা দিল, ‘তুই চুপ কর লো লক্ষ্মীছাড়া মেয়্যামানুষ। তোর জন্যই আজ এই অনথ্থ ঘটল, নাহলে কুনুদিন কি সন্ধ্যা বন্ধ হয়েছে? ঝড় জল হোক, বজ্রাঘাত হোক, প্রদীপ ঠিক জ্বলেছে ঠাকুর ঘরে’।
বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে গেল ঠাকুরদুয়ারে। বড়গিন্নী তখন মাথা ঠুকছে ঠাকুরদুয়ারে আর বলে চলেছে, ‘ওগো আমাদের বিষ্টু ঠাকুরের যে কঠিন রাগ। দধিবামন রাগলে কি রক্কে আছে গো? পুরা সংসার ছারখার হয়ে যাবে গো......’
উমাশশী আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু এত চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হল এবং সকলে মিলে উমাশশীকে দোষারোপ করতে লাগল যে উমাশশীর বক্তব্য শোনার সময় হল না কারো। শশিভূষণ সকলকে চুপ করানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! দুজনে কিছুক্ষণ স্থাণুর মত বসে রইল সেখানে। তারপর যখন বসে থাকাও অসহ্য হয়ে উঠল, তারা ধীরে ধীরে উঠে, উপরে নিজের ঘরে চলে গেল। শশিভূষণ তখনও ভাল করে বুঝে উঠতে পারে নি, ব্যাপারটা ঠিক কী ঘটেছে? উপরে এসে উমাশশীর কাছে পুরো ঘটনাটা শুনে, বুঝতে পারল সবই। রাগে তার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। এই প্রাত্যহিক অশান্তি একেবারেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সে লক্ষ্য করেছে, যখনই সে মেদিনীপুর থেকে বাড়ি আসে, প্রত্যেকবারই কোন না কোন অজুহাতে এইরকম গোলযোগ লেগে যায় বাড়িতে। সেও গুম হয়ে শুয়ে রইল উমাশশীর পাশে আর আকাশপাতাল ভাবতে লাগল। তারপর রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এলে শশিভূষণ বলল, ‘আমাদের আর খাওয়ার দরকার নেই। এরকম ঝগড়া-অশান্তির সংসারে ওই ভাত কি আমাদের গলা দিয়ে নামবে?’
সে কথা শুনে শশিভূষণের বড়দা বলল, ‘অ, এতবড় অনাচার করে এখন আবার তেজ দেখানা হচ্ছে? মেজবউ এর বাপকে ডাকাও, আজ এর বিচার হবে’।
রাত দশটার সময় গ্রামাঞ্চলে যথেষ্ট রাত। উমাশশীর সেজ দেওরকে এই অসময়ে দেখে, উমাশশীর মা কেঁদে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, কী হয়েছে আমার উমার? ওরা সব ভাল আছে তো? তুমি এত রাতে কেন ওর বাবাকে ডাকতে এসেছ?’
সেজ দেওর কম কথার মানুষ। তার কাছ থেকে কিছুই জানা গেল না। সে শুধু বলল, ‘বাবো ডাকতে পাঠিয়েছে’।
পণ্ডিতমশাই সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে অন্ধকারাচ্ছন্ন গোটা তিনেক গ্রাম পেরিয়ে এসে পৌঁছলেন উমাশশীর শ্বশুরবাড়িতে। দেখলেন আবহাওয়া থমথমে। বাড়ীতে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন মেয়ে জামাই কোথায় আছে। জানা গেল তারা না খেয়ে দোতলার ঘরে শুয়ে আছে। তিনি উপরে উঠে মেয়ে জামাইকে ডাকলেন। বললেন, ‘তোরা নিচে চল। আগে বেয়াই-বেয়ানকে প্রণাম কর। নিশ্চয়ই তোরা কিছু অন্যায় করেছিস। নাহলে এত রাতে বেয়াইমশাই কেন আমাকে ডেকে পাঠাবেন?’
উমাশশীর ভাশুর একটা বড় লাঠি নিয়ে তেড়ে এল, ‘শালা, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এসেচে। এই ডাং দিয়ে মাথা ফাটিয়ে আজ এখেনে রক্তগঙ্গা বয়ি দুব......’
উমাশশীর বড়জা ছুটে এসে লাঠিটা ছাড়িয়ে নিল, নাহলে রক্তগঙ্গা খুব বেশি দূরে ছিল না। উমাশশীর শ্বশুর শাশুড়ির মুখে একটা কথা নেই। পণ্ডিতমশাই এই অতর্কিত আক্রমণে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘বেয়াইমশাই, আজ আপনি নিজের ছেলের এতবড় অন্যায় মুখ বূজে সহ্য করলেন। জানি আপনার ছেলে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, পরিবারের একমাত্র কাঁচা পয়সার জোগানদার। তার মুখের উপর কথা বলার সাহস আপনার নেই। আজ আপনাকে বলে রাখি আপনার এই সংসার টিকবে না। যে ঘরের মধুন আলগা, সেই ঘর আজ নয় কাল ভেঙ্গে পড়বেই’।
তারপর উমাশশীর ভাসুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোকে আমি কান ধরে ক্লাস ফাইভ থেকে টেন অব্দি পড়িয়েছি, আজ তুই আমার মাথায় লাঠি তুলিস। ভাবি কী শিক্ষা তুই পেয়েছিস আর কী শিক্ষাই বা তুই দিচ্ছিস তোর ছাত্রদের’।
ঝগড়া আবার শুরু হয়ে গেল। কে কী বলছে বোঝা দায়। পণ্ডিতমশাই আর থাকতে পারলেন না সেখানে। বাঁশ ঝাড় পেছনে রেখে, পুকুরের পাড়, মাঠের আলপথ ধরে রাতের অন্ধকারে এগিয়ে চললেন। এবারে আর সাইকেলে নয়, পায়ে হেঁটে, একা।
উমাশশী ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘বাবু, তুমি আমাকে এই যমপুরীতে একলা রেখে গেলে......’
পরের দিনও ঝগড়ার রেশ রয়ে গেল। উমাশশীর শরীর তখনও খুব দুর্বল। মাথা ঘুরছিল, সে চুপচাপ শুয়ে ছিল ঘরে। তারপর আবার উমাশশীর পুরনো কোন অপরাধের পুনর্বিচার শুরু হল। শশিভূষণ আর সহ্য করতে পারল না। রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘দেশে কি মানুষজন নেই? আমি গাঁয়ের পাঁচজনকে ডাকছি, তারা এসে সব শুনে বিচার করুক। তোমাদের একতরফা বোলচাল আর কত শুনব? তোমরা কি মেরে ফেলতে চাও আমাদের?’
শশিভূষণের ডাকে গাঁয়ের মুরুব্বি লোকেরা সব সন্ধ্যার সময় তাদের বাড়ীতে জড়ো হয়েছিল। উমাশশীকে অনেক টানা-হ্যাঁচড়া করা হয়েছিল, সকলের সামনে এসে সব ঘটনা বিস্তারিত বলার জন্য। উমাশশী পারলে মাটিতে মিশে যায় – সে এতবড় অপরাধী যে তার বিচারের জন্য দেশের লোক জোটাতে হল। উমাশশীর ভাশুর আর বড়জা গড়গড় করে সব ঘটনা বলে গেল। শেষে সেই অমোঘ প্রশ্ন, ‘সংসারের এত বড় অমঙ্গল কেন করলো?’
উমাশশীর হয়ে শশিভূষণ তার বক্তব্য পেশ করল। গাঁয়ের লোকেরা সব শুনল। কালীচরণ সামন্ত উমাশশীর শ্বশুরকে বললেন, ‘আপনারই তো দোষ। আপনি কেন আগে শাঁখ বাজালেন? নিয়ম তো হচ্ছে সন্ধ্যার পরে শাঁখ বাজানো হয়। তাছাড়া যে সন্ধ্যা দেয়, সেই শাঁখ বাজায়। শাঁখ বাজানো শুনে উমাশশী যদি ভেবে থাকে যে সন্ধ্যা দেওয়া হয়ে গেছে, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তারপর সন্ধ্যার আলো খুঁজে না পেয়ে ও ভয়ে কাউকে কিছু বলে নি। আপনাদেরকেও তো বুঝতে হবে, ওর বয়স কতটা?’
উমাশশীর ভাশুর, শ্বশুর অনেক কূটতর্ক তুলেছিল। কিন্তু দেশের গণ্যমান্য লোকেদের বিচারে তা খারিজ হয়ে যায়। ওরা চলে যাবার পর বড়গিন্নি সদর দুয়ারে বসে মহাভারত পড়ে সবাইকে শুনিয়েছিল। উমাশশীর শাশুড়ি বলেছিল, ‘বড় বৌমা আমার ঘরের লক্ষ্মী’। তা শুনে, কোন এক অজ্ঞাত কারণে উমশশীর অধরে মৃদু হাসি ফুটে উঠেছিল।
৪
রাতের খাবারটা আজ খুব সরেস হয়েছিল। ভাত, আলুভাজা, বেগুনভাজা, মুগের ডাল, পোস্তবড়া, একটা পাঁচমিশেলি ঘ্যাঁট, হাঁসের গোটা-ডিমের ঝোল, আমড়ার অম্বল। খাওয়া-দাওয়ার পর উপরে শুতে এসে উমাশশী তার প্রশ্নের ঝাঁপি খুলল। প্রসঙ্গ – জরুরী অবস্থা।
শশিভূষণ বলল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও তোমার অনেক প্রশ্ন। সে-সব বলার আগে ইন্দিরা গান্ধীর এযাবৎ রাজনৈতিক জীবনটা একটু জানা দরকার। ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী হন ছেষট্টি সালে। শোনা যায় ছোটবেলায় তিনি খুব লাজুক, মুখচোরা প্রকৃতির ছিলেন। কিন্তু পরে তিনিই হয়ে উঠলেন এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেশনেত্রী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বছর তিনিকের মধ্যে তিনি কংগ্রেস দল ভেঙ্গে দেন। ইন্দিরা বুঝেছিলেন কংগ্রেস দলটাকে নিজের অঙ্গুলিহেলনে চালনা করতে হলে দল থেকে বুড়োদের বিদায় করতে হবে। তারপর একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠা। ‘গরিবি হঠাও’ স্লোগানে সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো যে সত্যি সত্যিই দেশে আর গরীব বলে কেউ থাকবে না। ইন্দিরা গান্ধী তখন প্রায় মা দুর্গা। দু হাতে সবকিছু সামলাচ্ছেন। একাত্তরের ভোটে বিশাল ব্যবধানে জিতে আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন’।
‘মা দুর্গাই যদি হলেন, তবে তার কালো হাত কেন?’
‘ক্ষমতার লোভ। একচ্ছত্র ক্ষমতালোভের তাড়নায় তারপর তিনি যে কোন রকম কৌশল অবলম্বন করতে লাগলেন। তার প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে উঠলেন ছোট ছেলে সঞ্জয়। মা ও পুত্র স্নেহে অন্ধ। সঞ্জয় নিজে কোন ভোটে না জিতলেও চাইতেন তার নিজের মর্জিমাফিক দেশটা চলুক। তারপর পঁচাত্তর সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ইন্দিরা গান্ধীর জয়কে অবৈধ ঘোষণা করা হল’।
‘কেন?’
‘আগের ভোটে হেরে যাওয়া প্রার্থী অভিযোগ করেছিলেন, ভোটের প্রচারে ইন্দিরা গান্ধী অন্যায়ভাবে নিজের প্রতিপত্তি খাটিয়ে সরকারি সুযোগ সুবিধা ব্যাবহার করেছেন। বিচারে সেটা প্রমাণও হয়ে গেল’।
‘তারপর কী হোলো?’
‘তারপর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্ব গেল না বটে, কিন্তু অনেকরকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হল। বিরোধী পক্ষের আন্দোলন, মিছিল, ধর্না তুঙ্গে উঠল। জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাইয়ের মত নেতারা এইসব সরকারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এইসব দেখেশুনে ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতারা একটা উপায় বের করলেন। পঁচাত্তরের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে একটা চিঠি পৌঁছল, যাতে লেখা ছিল...there is an imminent danger to the security of India being threatened by internal disturbance. The matter is extremely urgent.’
‘আঃ, বাংলায় বল না’।
‘মানে, সংবিধানের একটা ৩৫২ নং ধারা আছে, সেই হিসেবে......’
‘ওঃ, আবার ইংরেজি বলছ?’
‘মানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব খারাপ, সেই কারণে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হবে। একেই জরুরী অবস্থা বলে। তারপর জরুরী অবস্থা চালু হয়ে গেল’।
‘এতে ইন্দিরা গান্ধীর কী সুবিধে হল?’
‘বিরোধী নেতাদের সব ধরে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। খবরের কাগজের স্বাধীনতা বলে কিছু রইল না। খবর ছাপবার আগে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হত। মোট কথা মানুষের নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা এসব কেড়ে নেওয়া হল। এগুলোকে মানুষের মৌলিক অধিকার বলে। ভারতের সংবিধান সব মানুষকে এই অধিকার দিয়েছে’।
‘আমারও আছে এমন অধিকার?’ উমাশশীর মনে প্রশ্ন জাগে!
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে। তারপর সঞ্জয় গান্ধীর নির্দেশে জোর করে গরীব লোকেদের অপারেশন করানো হতে লাগল’।
‘কিসের অপারেশন?’
‘যাতে বাচ্চা-কাচ্চা না হয়। এভাবেই নাকি দেশের জনসংখ্যা কমবে। আর তাহলেই দেশের সব সমস্যার সমাধান হবে। অনেকে মারাও গেছে তড়িঘড়ি করে করা এই অপারেশনের সময়’।
‘এ তো মহা জুলুম’।
‘ওই জন্যই তো স্বৈরাচারী বলছে ইন্দিরা গান্ধীকে’।
উমাশশী খানিক চিন্তা করে বলল, ‘আমিও চিনি দু’জন স্বৈরাচারীকে। না দু’জন নয়, তিনজন......না, না, অনেক – সবাই স্বৈরাচারী’।
‘তারা কারা?’ শশিভূষণ জিজ্ঞেস করে।
‘সে তুমিও বুঝতে পারবে একটু ভেবে দেখলে। তারপর কী হল বল?’
‘তারপর জরুরী অবস্থা উঠে গেল এই তো কিছুদিন আগে। মানুষ একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। এইবার ভোট হবে। বিরোধীরা বলছে ইন্দিরা গান্ধীর কালো হাত ভেঙ্গে, গুঁড়িয়ে দিতে হবে... ব্যালটের মাধ্যমে। গণতন্ত্র বাঁচাতে হবে। একনায়কতন্ত্রের অবসান চাই’।
‘ওগো, তুমি আবার কঠিন কঠিন কথা বলছ...’
‘গণতন্ত্র মানে হল জনগণ...মানে সাধারণ মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। সব মানুষেরই নিজের নিজের মত আছে। নিজের মত অনুসারে তারা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়। তারাই দেশ চালায়। কিন্তু একনায়কতন্ত্র মানে হল, সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে, অন্য কারুর মতামতের তোয়াক্কা না করে, নিজের মর্জিমাফিক দেশ চালানো’।
‘এ রকম তো হয়েই থাকে’। উমাশশীর ভারী ঘুম পায়, সে পাশ ফিরে শোয়।
শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী
‘ভোট দিবেন কুনখানে?’ প্রশ্ন করে মিছিলের সামনে চলতে থাকা আট-দশজন।
পেছন থেকে সমস্বরে জবাব আসে, ‘গাই বাছুরের মাজখানে’। আজ কয়েকদিন হল এইরকমই মিছিল চলছে বিভিন্ন দলের। সময়-অসময় নেই, প্রায় সারাদিনই গাঁয়ের রাস্তায়, কোন না কোন দলের মিছিল চলছে। সবাই ওই একই প্রশ্ন করে, কোথায় ভোট দেবেন? শুধু উত্তর আলাদা – গাই-বাছুর না লাঙল-কাঁধে-চাষা। মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলো সব ভরে গেছে নির্বাচনী প্রতীক চিহ্নে আর লেখায়। যেমন - আসন্ন ষষ্ঠ লোকসভা নির্বাচনে আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় লোকদল প্রার্থী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করুন। দেশ বাঁচান, গণতন্ত্র বাঁচান। স্বৈরাচারী ইন্দিরা গান্ধীর কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। প্রশ্নও আছে কিছু - ইন্দিরা গান্ধীর মাইলো, কী দিয়ে খাইলো? নিচে ইন্দিরা গান্ধীর বিকৃত মুখচ্ছবি, নাকটা যেন অস্বাভাবিক লম্বা। মনে পড়ে, বছর কয়েক আগের কথা। খাবারের খুব কষ্ট! একফসলি জমি, ঘরে ঘরে চাল বাড়ন্ত। তখন রেশনে গম, মকাই, মটকলাই এসব দেওয়া হত। পাশের দেওয়ালে আবার ইন্দিরা গান্ধীর সুন্দর মুখ, সঙ্গে গাই-বাছুর। উমাশশীর ভারি ভাল লাগে এইসব দেখতে। ঘুঁটে দেওয়া বন্ধ করে হাঁ করে দেখতে থাকে মিছিলের চলে যাওয়া। কেমন সবাই দলবেঁধে লাইন দিয়ে চলেছে – একপাড়া থেকে অন্য পাড়া, এক গাঁ থেকে অন্য গাঁয়ে। মনে হয় সেও বুঝি চলে যায় ওদের সঙ্গে। যেমন অমল চলে যেতে চেয়েছিল দইওলার সঙ্গে!
‘অ মেজগিন্নি, সকাল সকাল হাঁ করে তুমি মিছিল দেকচ? এমন হাবলা মেয়্যা জন্মে দেখিনি বাপু। আজ কি ঘুঁটা দিয়েই দিন কাবার করবে? সংসারের অন্য কাজ-কম্ম কিছু নাই? সিস্টির কাজ পড়ে আচে...ইস্কুলের ভাত। উনি এখন মিছিল দেকচেন। তাড়াতাড়ি লেয়ে এসে মশলাটা বাটো’।
বড় জায়ের চীৎকারে সম্বিত ফেরে উমাশশীর। তাড়াতাড়ি ঘুঁটে দেওয়া শেষ করে গামছা নিয়ে পুকুর-ঘাটে চান করতে যায় তেরো বছরের মেজগিন্নি। তার দিন শুরু হয়েছে সেই কোন্ ভোরে। প্রথমে সারা উঠোন-রান্নাঘর ঝাঁট দেওয়া, উনুনের ছাই ফেলা, ছাই ফেলার আগে আধপোড়া কয়লা আলাদা করা, রাতের বাসনকোসন পুকুর থেকে ধুয়ে আনা, গোবর জল দিয়ে পুরো উঠোন, ছাঁচতলা (টিনের চাল থেকে বৃষ্টির জল পড়ে উঠোনে যে ছোট নালার সৃষ্টি হয়), ওলতলা (বাড়ির একপ্রান্তে অবস্থিত মাটির মূত্রবাহী নালা), রান্নাঘরে ন্যাতা দেওয়া, গোয়াল থেকে পরের দিনের ঘুঁটে দেওয়ার জন্য গোবর সংগ্রহ করা (টাটকা গোবরে ঘুঁটে দেওয়া খুব শক্ত কাজ), তারপর ঘুঁটে দেওয়া – মোটামুটি এই হল চান করার আগে উমাশশীর রোজনামচা।
উমাশশীর শ্বশুরবাড়ি একান্নবর্তী পরিবার। শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাশুর, জা, দেওর, ননদ, ভাশুরের ছেলে-মেয়ে সব মিলিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বত্রিশ জন। পুরনো জমিদারবাড়ি। জমিদারি এখন আর নেই, তবে জমি এখনও আছে প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি বিঘা। চাষবাসের আয়েই সংসার চলে। চাষের কাজ সব নিজেরাই করে। মুনিষ দিয়ে করালে অনেক খরচ। তিনতলা মাটির বারান্দা বাড়ি। বাড়ির পেছনের দিকে একটি বড় পুকুর। এক পাড়ে তাল গাছ, অন্য পাড়ে আম গাছের সারি। পাথর দিয়ে বাঁধানো ঘাট। তাছাড়া আরও একটি ডোবা আছে রান্নাঘরের পেছনের দিকে। সেই ডোবার পাড়ে ফলের বাগান – কলা, পাতিলেবু, বেদানা ইত্যাদি গাছের সমাহার। বাড়ির উঠোনের অর্ধেক অংশে কিছু শাক-সব্জির চাষ। লাউ, কুমড়ো, পুঁই, চিচিঙ্গে এবং নানা রকমের শাক এই বিশাল পরিবারটির দৈনন্দিন চাহিদা মেটায়। উঠোনের বাকি অংশে ধানের মরাই, ধান সেদ্ধ করার বিশাল উনুন, একপাশে ঢেঁকিশাল, তারপর অনেকটা ফাঁকা জায়গা।
উমাশশী চান করে এসে তার বাকি কাজগুলি করতে থাকে নীরবে। হঠাৎ বৃষ্টি নামে অঝোর ধারায়। উমাশশীর মনে পড়ে ইস্কুলে ক্লাস সেভেনের পরীক্ষায় একবার বাংলা রচনা লিখতে দিয়েছিল – একটি বর্ষণমুখর দিনের বর্ণনা। উমাশশী ব্যাকরণ বই মুখস্থ করে আর ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছু ভাল ভাল কথা লিখেছিল – বর্ষাকালে চাষবাস হয়, সারা মাঠে কচি কচি ধানগাছের চারা, মেঘেরা উড়ে যায়, ময়ুর পেখম তুলে নাচে। আরও কিছু লেখার ইচ্ছে ছিল, যেমন – কাঁচা রাস্তায় এত কাদা হয় যে ইস্কুল যাওয়ার পথে দু চারবার গড়াগড়ি খায় অনেকেই। তাছাড়া পুকুর পাড়ে পেচ্ছাপ, পায়খানার জন্য যাওয়াটাও বেশ কষ্টের। পরীক্ষার খাতা বলে এসব কথা উমাশশী লেখেনি। উমাশশী ভাবে, আজ যদি কেউ তাকে বলে ওই একই রচনা লিখতে – সে সব বর্ণনা লিখে দেবে, একেবারে যথাযথ। যেমন – বর্ষাকালে তাল পড়ে, সেই তাল দিয়ে তালের রুটি আর বড়া বানানো হয়। বর্ষার দুপুরে সব কাজ সেরে যখন উমাশশী একটু শুতে যায়, তখনই ডাক আসে, ‘মেজবউমা, তাড়াতাড়ি নেমে এস, তাল মাড়তে হবে’। উমাশশীকে অন্তত দশটা তাল মাড়তে হয়। তিনটি করে আঁটি হলে, তিরিশটা আঁটি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কোন কোন তালের দুটি আঁটি থাকে। তালের খোসা ছাড়িয়ে, তাল ভেঙে, সেইসব আঁটিগুলোকে এক এক করে, উলটো-করে-রাখা বাঁশের ঝোড়ার (ঝুড়ির পুংলিঙ্গ) উপর থেকে নিচে টানতে হয়। ঝোড়ার ভেতরে কাঁসার থালা রাখা থাকে, সেখানেই তালের নির্যাস জমা হয়। তালের খোসাগুলি গোয়ালে দিয়ে আসতে হয়, গরুরা তৃপ্তি করে খায়।
বর্ষাকালের আর এক স্মৃতি হল রাশি রাশি চুনো মাছ বেছে রাখা। জমির শেষ প্রান্তের ঢালানে যেখানে জল গিয়ে বড় নালায় পড়ছে, সেখানে বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি বাড় রাখা হয়। বাড় হল অনেকটা বেড়ার মতোই জিনিস কিংবা বাঁশের কাঠির মাদুরও ভেবে নেওয়া যায়। সেই বাড় খাড়া করে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। বাড়ের কাঠিগুলোর মধ্যে কিছুটা ফাঁক থাকে, যাতে জল গলে বেরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু মাছ পারে না। স্রোতের টানে ভেসে এসে মাছগুলো সব বাড়ে আটকে যায়, তারপর লাফিয়ে অন্যদিক দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে, কিন্তু স্রোতের বিপরীতে যাওয়া কি অতই সহজ? বাড়ের শেষপ্রান্তে, একটু পেছনে, একটি বড় গর্ত করা থাকে। গর্তের উপরে তালপাতা অথবা কাঁটাগাছের ডাল দিয়ে চাপা দেওয়া থাকে। বাড় এবং গর্তের সংযোগ হয় একটি ছোট নালার মাধ্যমে, সেই নালার উপরে একটি ছোট বাড় ঢালু করে রাখা থাকে। মাছেরা বাড়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধস্তি করে, সেই নালার মাধ্যমে গর্তে এসে পড়ে। ফলত উমাশশীর কাজ যায় বেড়ে। দেওররা ঝোড়া ভর্তি করে করে পুঁটি, মাগুর, ল্যাটা, চ্যাং এইসব মাছ নিয়ে আসে। জিওল মাছগুলো উঠোনে বড় গর্ত করে জলে ছেড়ে রাখা হয়, প্রয়োজনমত সেখান থেকে নিয়ে রান্না হয়। মুশকিল হয় পুঁটিমাছগুলোকে নিয়ে, সেগুলো আসার সঙ্গে সঙ্গেই পরিষ্কার করে বেছে, কাঠের উনুনে ভেজে তুলে রাখতে হয়। দিনের বেলা হলে ননদরা মাছ বাছার কাজে সাহায্য করে উমাশশীকে, কিন্তু রাতে উমাশশীকে একাই মাছ বাছা এবং ভাজার কাজ করতে হয়। সারাদিনের কাজের পরে সেই হয়তো ঘুমটি লেগেছে চোখে, তখন ঘুম চোখে উঠে এসে মাছ বাছা এবং ভাজা – সে যে কী কষ্ট!
২
ভোট শেষ পর্যন্ত এসেই পড়ল। চারজন ভোট বাবু, সঙ্গে জিনিসপত্র নিয়ে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেছে গ্রামে। গ্রামের একমাত্র প্রাইমারী স্কুলটিই হবে ভোটকেন্দ্র। বেশ একটা উৎসবের আবহ। চারিদিকে ফেস্টুন, পতাকা, পোস্টারে ছেয়ে গেছে স্কুল চত্বরটি। স্কুলবাড়ির টিনের চাল থেকে সরু সরু পাটের দড়ি সূর্যকিরণের মত ছড়িয়ে গেছে আশেপাশের সব গাছে। সেই সব দড়ির উপর ছোট কাগজের পতাকা আঠা দিয়ে সাঁটানো হয়েছে, বিভিন্ন দলের নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন। বুড়ো শিমুলগাছটার সর্বাঙ্গে কাগজের পোস্টার, যেন নতুন পোশাক পরেছে। দলুইদের উঠোনে ন্যাংটো ছেলেমেয়ের দল, খেলা ভুলে ভোটের প্রস্তুতি দেখছে। ভোট বাবুরা সব ব্যস্ত ব্যবস্থাপনায়। টেবিল-চেয়ারগুলোকে জায়গামত সাজায়, কোথায় ভোটার লিস্ট দেখে নাম মেলানো হবে, স্লিপ দেওয়া হবে, সই অথবা টিপছাপ নেওয়া হবে, কোথায় ব্যালট পেপার দেওয়া হবে, তারপর সেই প্রায়ান্ধকার চটের চেম্বার - ব্যালট পেপারে ছাপ দেওয়ার পর কাগজ ভাঁজ করে ব্যালট বাক্সে ফেলতে হবে।
উমাশশীর শ্বশুরবাড়িতেই ভোট বাবুদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, যেহেতু তারাই এই গ্রামের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু পরিবার। ভোটের আগের রাত থেকে, পরের দিন ভোট হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তারা এখানেই থাকবে। তবে, সকলে নয়। তিনজন স্কুলবাড়িতেই থাকবে, ব্যালট পেপার পাহারা দেওয়ার জন্য। শুধু একজন, যে বড় অফিসার - পিসাইডিং অফিসার না কী যেন নাম, সে রাত্রে থাকবে। পরের দিন তো ভোট হয়ে গেলে সন্ধ্যে নাগাদ লটবহর নিয়ে সবাই চলে যাবে।
উমাশশীর মনটা আজ ভারী খুশী খুশী। শ্বশুরমশাই নিজে ডেকে তাকে বলেছে, ‘শহর থেকে বড় বাবুরা আসচে ভোটের কাজে, দেখবে তাদের যত্ন-আত্তির কোন ত্রুটি না হয় - তোমার শ্বশুরবাড়ির সম্মানের ব্যাপার। আশপাশের বিশটা গাঁয়ের লোক একডাকে আমাদের চেনে’। উমাশশী তাই সকাল থেকে খুব উৎসাহ নিয়ে কাজ করে চলেছে। পুকুরঘাটে গিয়ে তেল, শালপাতা দিয়ে কাঁসার বাসনগুলোকে ঘষে ঘষে একেবারে ঝকঝকে করে তোলে, তিনবার বড় দুয়ারটি ঝাঁট দেয়, চারটি ঝালর-দেওয়া, নকশা-করা বড় আসন বের করে রাখে। একবার ঘরে গিয়ে ফটো দুটি কাপড় দিয়ে মুছে আসে। ফটো দুটি আসলে সূচিশিল্প - কাপড়ের উপর সুতো দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে লেখা কিছু বাণী, উমাশশীর প্রাকবৈবাহিক হাতের কাজের নিদর্শন। উমাশশী বিয়ের পর, সার্টিফিকেটের মত সঙ্গে করে এনেছে। একটিতে লেখা আছে – ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ অন্যটিতে – ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পূরিল/ সকলই ফুরায়ে যায় মা’। উমাশশী দুই বাণীর ভাবার্থ বের করতে পারল আজ। প্রথমটির মানে – আরও কাজ করতে হবে সংসারের জন্য, মুখ বুজে সব মুখঝামটা সহ্য করে যাও। দ্বিতীয়টি মানুষের অবশ্যম্ভাবী শেষ পরিণতি। কিন্তু তের বছরেই উমাশশীর মনে হতে লাগলো – সকলই ফুরায়ে যায় মা। তার উপর বাবা মায়ের ভালবাসার তো অন্ত ছিল না, তাহলে কেন এই বয়সেই তাকে বিদেয় করার জন্য এমন উঠে পড়ে লাগলো? তাও এত বড় পরিবারে? যেখানে ভোর থেকে রাত অব্দি শুধু কাজ আর কাজ। আলোচনার জন্য অন্য কোন বিষয় নেই। পড়াশোনার চর্চাও ওই নামমাত্র। ছেলেরা সব সকালে উঠে মুড়ি খেয়ে, মাঠে গরু চরাতে চলে যায়। তারপর মাঠ থেকে ফিরে এসে, পুকুরে একটা ডুব দিয়ে এসে ভাত খেতে বসে যায়। তারপর কোনরকমে বই, খাতা বগলে ইস্কুলে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। আশ্চর্য নয় যে - এই বাড়ীরই ক্লাস ফাইভের ছাত্র অবলীলায়, অবহেলায়, ক্লাস সিক্সের বিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়ে দেয়। প্রশ্ন ছিল – ‘যত্রতত্র প্রস্রাব করিলে কী হয়?’ উত্তর এল – ‘ভূতে ধরে’।
যাকগে সে-সব কথা। কথা হচ্ছিল আজ উমাশশী খূব খুশী। তার একটা কারণ যদি হয়, বাইরের লোকজন বাড়ীতে আসছে, কিছু অন্য জগতের কথা জানা যাবে, তাহলে প্রধান কারণটি হল আজ উমাশশীর বর আসছে! উমাশশীর বর শশিভূষণ গ্রামের বাড়িতে থাকে না, সে এখনও ছাত্র, মেদিনীপুর কলেজে পড়ে – পি ইউ অর্থাৎ প্রি ইউনিভার্সিটির পড়া। মেদিনীপুর শহরেই গ্রামের পরিচিত একজনের বাড়িতে থাকে, নিজে রান্না করে খায়। পনের-কুড়ি দিন অন্তর বাড়ি আসে।
শশিভূষণ বাড়ি এলে উমাশশী নিজের কষ্টের কথা বলে একটু হালকা হয়, নাহলে তো সেই একটানা দিনের পর দিন মুখ বুজে কাজ করে চলা। তাও তো দিনের বেলা কথা বলার যো নেই, অল্প কিছু কথাবার্তা সেই রাত্রে। শশিভূষণেরও বিশেষ কিছু করার ছিল না তার প্রবল প্রতাপান্বিত বাবা এবং বড় দাদার সামনে। শুধু সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘এখন সব সহ্য করে চল, একদিন ঠিক সুদিন আসবে। আমি পড়াশুনোটা শেষ করে চাকরি পাই, তোমাকে নিয়ে চলে যাব এখান থেকে’।
একটু ভেবে দেখলে অবশ্য উমাশশীর শ্বশুর, ভাশুরের অসন্তোষের সঙ্গত কারণ ছিল কিছু। তারা ঠিক করেছিল শশিভূষণের বিয়ে দেবে তার দাদার শালীর সঙ্গে। দাদার শ্বশুরবাড়ি পাশের গ্রামেই, তারাও সম্পন্ন গৃহস্থ, জমি-জায়গা আছে। বিয়েতে তিন বিঘা জমি দিয়ে দেবে। দুই বোনে দুই জা হবে। তাছাড়া বোনটিও গৃহকর্মনিপুণা, বয়সেও উমাশশীর থেকে বেশ কিছুটা বড় হবে। বড় সংসারের পক্ষে একেবারে আদর্শ বউ। কিন্ত শশিভূষণ ততদিনে মন দিয়ে ফেলেছে – হবু-পত্নীকে নয়, হবু-শ্বশুরমশাইকে। তিনি একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং হাইস্কুলের শিক্ষক। পুজো-আচ্চা, বিবাহ, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, হোম-যজ্ঞ ইত্যাদি কাজে দূরদূরান্ত থেকে তাঁর ডাক আসে। আশেপাশের গ্রামে শিষ্য-সামন্তও অনেক। উমাশশীর শ্বশুরবাড়ির পাশেই হাজরাদের বাড়ি। হাজরা বাড়ির এক বউ বিধবা হয় খুব অল্পবয়েসেই। তার স্বামী কলকাতায় দর্জির কাজ করত। শখ করে দাড়ি রেখেছিল। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় সে খুন হয়ে যায় হিন্দুদের হাতেই। অস্থির সময় তখন – দাড়ির শ্রেণী-বিভাজন করার সময় ছিল না কারও হাতে!
সেই হাজরা গিন্নি পণ্ডিতমশায়ের শিষ্যা। বলেছিল, ‘বাবা, আমাদের সন্ধানে একটি ভাল পাত্র আছে, আমাদেরই পুরোহিত মশায়ের ছেলে – সহজ সরল, পড়াশোনায় ভাল, ম্যাট্রিকে অঙ্কে লেটার পেয়েছে, পুজো-আচ্চায় খুব ঝোঁক। ওখানে দিদির বিয়ে হলে, আমাদের কাছাকাছিই থাকবে, আমরা দেখাশোনা করতে পারব’।
পণ্ডিতমশায়ের মনে একটু দোটানা ভাব। ছেলেটিকে তিনি দেখেছেন মনে হল। ওদের গ্রামেই তিনি যখন রটন্তী কালী পুজো করতে এসেছিলেন, একটি ব্রাহ্মণ ছেলে পাশে পাশেই ঘুরছিল। পুজোর কাজে সাহায্য করছিল, আর মন দিয়ে সব আচার-অনুষ্ঠান লক্ষ্য করছিল। তারপর যখন তিনি উদাত্ত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন, তখন ছেলেটি একেবারে মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। সেই ছেলেটিই হবে মনে হয়। কিন্তু উমার বয়স যে বড্ড কম। অন্তত সেও ম্যাট্রিকটা পাশ করুক। শিষ্যাকে বললেন সে কথা।
হাজরা গিন্নি বলল, ‘বাবা, ওর অন্য জায়গায় বিয়ের সম্বন্ধ চলছে, তাড়াতাড়িই ঠিক হয়ে যাবে মনে হয়। আপনি অনুমতি দিলে, আমি ওদের বাড়িতে কথা বলব। ছেলেটি আপনাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, মনে হয় না তার কিছু আপত্তি হবে। আমি বলি কী, কথাবার্তাটা চালু হোক না, তারপর দেখা যাবে। যদি ঠাকুরের ইচ্ছায় বিয়েটা লেগে যায়, তার থেকে ভাল আর কিছুতে হয় না। পড়াশুনাটা না হয় বাড়িতে থেকেই করবে, এখন তো অনেকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাশ করছে’।
পণ্ডিতমশাই কথা বললেন। ছেলে সানন্দে রাজি, পাত্রী দেখারও প্রয়োজন বোধ করল না। পণ্ডিত মশাই শ্বশুর হবেন, পড়াশুনাটা চালু থাকবে, আর কী চাওয়ার আছে? ছেলের বাবা-মা নিমরাজি। কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়। ছেলের দাদা এবং দাদার শ্বশুর ঠিক করল, ছেলেকে কিছুদিন বাড়িতেই চোখে চোখে রাখতে হবে, তারপর বিয়ের দিন বাড়ি থেকে সটান তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ের আসনে বসিয়ে দেওয়া যাবে। সেইমত লোকলস্করও তৈরি হয়ে রইল। কিন্তু বিয়ের দিন সকালে শশিভূষণকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। খোঁজ করে জানা গেল, সে ভোরবেলাতেই পৌঁছে গেছে তার হবু-শ্বশুর বাড়িতে। দাদা সেখানেও লোক পাঠাল তাকে নিয়ে আসার জন্য, কিন্তু শশিভূষণ এল না।
উমাশশী ভারী হতভম্ব হয়ে বসে রইল। আজ পঁচিশে বৈশাখ। ইস্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। সে আজ একটি কবিতা বলবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৈবেদ্য বই থেকে।
পুরো মুখস্থ হয়ে গেছে,
‘প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী,
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
করি জোড়কর, হে ভুবনেশ্বর
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
তোমার অপার আকাশের তলে
বিজনে বিরলে হে –
নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে......’
বন্ধুরা ডাকতে এসেছে ইস্কুলে যাবার জন্য। তাদের সকাল সকাল স্নান হয়ে গেছে। শাড়ি পরেছে সবাই। কারও হাতে টগর ফুলের মালা। কিন্তু উমাশশীর যাওয়া হল না, মা তাকে আজ ইস্কুল যেতে নিষেধ করেছে। আজ নাকি তার বিয়ে! ভোরবেলাতেই যে মুশকো ধরণের ছোট-চুল, খাটো-ধুতি-পরা লোকটা এসেছে, সেই নাকি তার বর!
বিয়েটা হয়ে গেল অনাড়ম্বর ভাবে। উমাশশী তার এযাবৎ দেখা বিয়ে বাড়ির সঙ্গে এই বিয়ের কোন মিল খুঁজে পেল না। বাজনা নেই, সানাই নেই, ঝলমলে আলো নেই, লোকজনও বিশেষ নেই – শুধুমাত্র গুটিকয় জ্ঞাতি এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা। বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান অবশ্য সব হল নিয়মমতো। তারপর শ্বশুরমশায়ের পাঠানো ভাঙা পাল্কিযোগে উমাশশীর পতিগৃহে যাত্রা। পাল্কি যখন মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, উমাশশীর মনে হচ্ছিল পাল্কি থেকে নেমে একছুটে পালায় কোন একটা দিক ধরে, একেবারে মাঠের শেষে, যেখানে আকাশটা উল্টানো-গামলার মত মিশে রয়েছে পুকুরপাড়ের তালগাছের সারিতে। কিন্তু নানা কারণে সেটা অসমীচীন এবং অসম্ভব মনে হওয়াতে পাল্কির মধ্যে বসেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছেও বিশেষ লোকজন দেখতে পেল না উমাশশী। অনুষ্ঠানবাড়ি বলে মনেই হয় না। অবশ্য শ্বশুরবাড়ির যা জনসংখ্যা, তাতে প্রতিদিনই মোচ্ছব, সে-কথা পরে বুঝেছে উমাশশী। যাই হোক, শ্বাশুড়ি মা বরণ করে ঘরে তুললেন। কচিকাঁচারা ঘিরে ধরল মেজবউ কে। শশিভূষণ কী করবে ঠিক করতে না পেরে একটা পুরনো রেডিয়োর নব ঘোরাতে লাগল।
৩
রাতের খাওয়া-দাওয়ার আগে সদর দুয়ারে (দুয়ার মানে দ্বার নয়, একতলার বারান্দা)বসে ভোট বাবুদের সঙ্গে উমাশশীর শ্বশুর, ভাশুর, বর এবং গ্রামের আরও কয়েকজন গণ্যিমান্যি লোকের কথাবার্তা হচ্ছিল। উমাশশী মাঝে মাঝে উঁকি মেরে যাচ্ছিল সেখানে – কী কথাবার্তা হচ্ছে শোনার জন্য। ইন্দিরা গান্ধী, সঞ্জয় গান্ধী, জরুরী অবস্থা, দুর্নীতি, স্বৈরাচারী, নকশাল, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এইসব শব্দাবলী উমাশশীর কানে আসতে লাগল। গ্রামে যে-ভোটপার্বণ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই উমাশশীর মনে কিছু প্রশ্ন জমা হয়েছিল। সে ঠিক করল, আজ রাতে শোওয়ার পর তার বরের কাছ থেকে এই সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর জেনে নিতে হবে।
রান্নামেলা থেকে হাঁক পাড়ল শ্বাশুড়ি, ‘মেজবৌমা সবাইকে খেতে আসতে বল’।
উমাশশী সদর দুয়ারে গিয়ে বলল সবাইকে খেতে আসার জন্য। দেখতে পেল সকলের সঙ্গে কালীচরণ সামন্তও আছেন। গ্রামের একজন বিচক্ষণ মানুষ হিসাবে তাঁর বিশেষ সুখ্যাতি আছে। এই মানুষটিকে উমাশশী বিশেষ শ্রদ্ধা করে। উমাশশীকে দেখে হেসে বললেন, ‘কিরে মা, ভাল আছিস?’
এই সাধারণ প্রশ্নটিতে কী যে ছিল, উমাশশী তা বুঝিয়ে বলতে পারবে না, কিন্তু সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। হয়তো এমন এক আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল সেই কুশল-জিজ্ঞাসায়, যা সে বহুদিন পায় নি। এমনও হতে পারে এই পিতৃতুল্য মানুষটিকে দেখে উমাশশীর আবার তার বাপের বাড়ির কথা মনে পড়ে গেছে। এছাড়া অন্য যে-সম্ভাবনা আছে, সেটি হল কিছুদিন আগে এই বাড়িরই একটি পারিবারিক বিবাদে মধ্যস্থতা করেছিলেন কালীচরণ সামন্ত এবং সমবেত রোষানল থেকে রক্ষা করেছিলেন উমাশশীকে। সেই ঘটনায় যাবার আগে দেখা গেল, উমাশশী শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে রান্নামেলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সেদিনও শশিভূষণ বাড়ি এসেছিল মেদিনীপুর থেকে। টিউশনি পড়ানোর টাকায় উমাশশীর জন্য তেল, সাবান, শ্যাম্পু, ব্লাউজ এসব কিনে এনেছিল। সেটাও বড় জায়ের সহ্য হত না। বলত, বাড়ি থেকে চাল নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে বৌয়ের জিনিস কিনে আনে। খাওয়ার ব্যাপারে শশিভূষণের কোন বিলাসিতা ছিল না, অবশ্য কোন্ ব্যাপারেই বা ছিল! বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া চাল ফুটিয়ে, একটু পুঁইডাঁটা সেদ্ধ অথবা কচু ভাতে দিয়ে ভাত খেয়েও অনেকদিন কাটিয়েছে। বড় বৌদির আপত্তিতে চাল নিয়ে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায় তারপরে। সেদিন উমাশশীর সেজ দেওরের বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে লোকজন এসেছিল বাড়িতে। উমাশশীর শ্বশুর বলল, ‘বৌমা, সন্ধ্যাটা দিয়ে দাও’।
উমাশশী বাসি কাপড় ছেড়ে ধোওয়া কাপড় পরার জন্য উপরের ঘরে গেছে। কাপড় পরার সময় শুনতে পেল নিচের থেকে শাঁখের আওয়াজ আসছে। ভয়ে উমাশশীর গলা শুকিয়ে গেল। তাহলে কি অন্য কেউ সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিল? তার কি কাপড় ছাড়তে খুব দেরী হয়েছে? উমাশশী ছুটতে ছুটতে ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখে সেখানে তো প্রদীপ জ্বলছে না। উমাশশীর স্পষ্ট মনে আছে - সে প্রদীপে তেল, সলতে দিয়ে ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে গিয়েছিল। তাহলে কি তুলসীমঞ্চের কাছে আছে? না, সেখানেও নেই।
উমাশশী এত ভয় পেয়ে গেল, কাউকে জিজ্ঞেস করার শক্তি পর্যন্ত সে হারিয়ে ফেলল। জিজ্ঞেস করলেই হয়ত বলবে, ‘তুমি ল্যাকা মেয়্যা, এত বয়স হয়ে গেল এখনও জান নি, সন্ধ্যা দেওয়ার পরে শাঁখ বাজানো হয়?’ সে ঠাকুর দুয়ারের একপাশে চুপচাপ বসে রইল।
কিছুক্ষণ পরে উমাশশীর বড় জা কাঁদতে কাঁদতে ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে এল। হাতে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলছে। উমাশশী ঠাকুর ঘরের দরজা থেকে দেখতে পেয়েছিল, ঠাকুর ঘরের এক কোণে আমের ঝোড়ার পেছন থেকেই প্রদীপটি আবিষ্কৃত হল। যদি কুলুঙ্গি থেকে পড়ে গিয়ে থাকতো, তাহলে তো তেল, সলতে সব ছিটকে যাওয়ার কথা। সেরকম কিছু ঘটে নি। তাছাড়া বড় জা যেভাবে সাবলীল ভঙ্গিতে প্রদীপটি বের করে আনল, তাতে সন্দেহ করার অবকাশ আছে যে, সেই হয়তো কিছু আগে প্রদীপটি লুকিয়ে রেখে এসেছিল আমের ঝোড়ার পেছনে।
বড় জা চিৎকার করে কাঁদছে আর সন্ধ্যা দেখাচ্ছে তুলসীমঞ্চে, ‘ওলো, আজ আমাদের কী সব্বোনাশ হোলো লো? ঠাকুরঘরে সন্ধ্যা পড়ে নি। ছ্যানাপ্যানা লিয়ে ঘর-সংসার। যদি কিছু ভাল-মন্দ ঘটে যায়, আমাদের কী হবে গো? সংসারের এত বড় অমঙ্গল কী করে সইব গো?’
উমাশশী কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘ও দিদি, তুমি চুপ কর। অমঙ্গল কিছু হলে আমার দোষেই হয়েছে, তার শাস্তি আমি ঠিকই পাব। আমার দোষ কেন সংসারের গায়ে লাগবে?’
বড়গিন্নী মুখ ঝামটা দিল, ‘তুই চুপ কর লো লক্ষ্মীছাড়া মেয়্যামানুষ। তোর জন্যই আজ এই অনথ্থ ঘটল, নাহলে কুনুদিন কি সন্ধ্যা বন্ধ হয়েছে? ঝড় জল হোক, বজ্রাঘাত হোক, প্রদীপ ঠিক জ্বলেছে ঠাকুর ঘরে’।
বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে গেল ঠাকুরদুয়ারে। বড়গিন্নী তখন মাথা ঠুকছে ঠাকুরদুয়ারে আর বলে চলেছে, ‘ওগো আমাদের বিষ্টু ঠাকুরের যে কঠিন রাগ। দধিবামন রাগলে কি রক্কে আছে গো? পুরা সংসার ছারখার হয়ে যাবে গো......’
উমাশশী আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু এত চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হল এবং সকলে মিলে উমাশশীকে দোষারোপ করতে লাগল যে উমাশশীর বক্তব্য শোনার সময় হল না কারো। শশিভূষণ সকলকে চুপ করানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! দুজনে কিছুক্ষণ স্থাণুর মত বসে রইল সেখানে। তারপর যখন বসে থাকাও অসহ্য হয়ে উঠল, তারা ধীরে ধীরে উঠে, উপরে নিজের ঘরে চলে গেল। শশিভূষণ তখনও ভাল করে বুঝে উঠতে পারে নি, ব্যাপারটা ঠিক কী ঘটেছে? উপরে এসে উমাশশীর কাছে পুরো ঘটনাটা শুনে, বুঝতে পারল সবই। রাগে তার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। এই প্রাত্যহিক অশান্তি একেবারেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সে লক্ষ্য করেছে, যখনই সে মেদিনীপুর থেকে বাড়ি আসে, প্রত্যেকবারই কোন না কোন অজুহাতে এইরকম গোলযোগ লেগে যায় বাড়িতে। সেও গুম হয়ে শুয়ে রইল উমাশশীর পাশে আর আকাশপাতাল ভাবতে লাগল। তারপর রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এলে শশিভূষণ বলল, ‘আমাদের আর খাওয়ার দরকার নেই। এরকম ঝগড়া-অশান্তির সংসারে ওই ভাত কি আমাদের গলা দিয়ে নামবে?’
সে কথা শুনে শশিভূষণের বড়দা বলল, ‘অ, এতবড় অনাচার করে এখন আবার তেজ দেখানা হচ্ছে? মেজবউ এর বাপকে ডাকাও, আজ এর বিচার হবে’।
রাত দশটার সময় গ্রামাঞ্চলে যথেষ্ট রাত। উমাশশীর সেজ দেওরকে এই অসময়ে দেখে, উমাশশীর মা কেঁদে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, কী হয়েছে আমার উমার? ওরা সব ভাল আছে তো? তুমি এত রাতে কেন ওর বাবাকে ডাকতে এসেছ?’
সেজ দেওর কম কথার মানুষ। তার কাছ থেকে কিছুই জানা গেল না। সে শুধু বলল, ‘বাবো ডাকতে পাঠিয়েছে’।
পণ্ডিতমশাই সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে অন্ধকারাচ্ছন্ন গোটা তিনেক গ্রাম পেরিয়ে এসে পৌঁছলেন উমাশশীর শ্বশুরবাড়িতে। দেখলেন আবহাওয়া থমথমে। বাড়ীতে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন মেয়ে জামাই কোথায় আছে। জানা গেল তারা না খেয়ে দোতলার ঘরে শুয়ে আছে। তিনি উপরে উঠে মেয়ে জামাইকে ডাকলেন। বললেন, ‘তোরা নিচে চল। আগে বেয়াই-বেয়ানকে প্রণাম কর। নিশ্চয়ই তোরা কিছু অন্যায় করেছিস। নাহলে এত রাতে বেয়াইমশাই কেন আমাকে ডেকে পাঠাবেন?’
উমাশশীর ভাশুর একটা বড় লাঠি নিয়ে তেড়ে এল, ‘শালা, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এসেচে। এই ডাং দিয়ে মাথা ফাটিয়ে আজ এখেনে রক্তগঙ্গা বয়ি দুব......’
উমাশশীর বড়জা ছুটে এসে লাঠিটা ছাড়িয়ে নিল, নাহলে রক্তগঙ্গা খুব বেশি দূরে ছিল না। উমাশশীর শ্বশুর শাশুড়ির মুখে একটা কথা নেই। পণ্ডিতমশাই এই অতর্কিত আক্রমণে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘বেয়াইমশাই, আজ আপনি নিজের ছেলের এতবড় অন্যায় মুখ বূজে সহ্য করলেন। জানি আপনার ছেলে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, পরিবারের একমাত্র কাঁচা পয়সার জোগানদার। তার মুখের উপর কথা বলার সাহস আপনার নেই। আজ আপনাকে বলে রাখি আপনার এই সংসার টিকবে না। যে ঘরের মধুন আলগা, সেই ঘর আজ নয় কাল ভেঙ্গে পড়বেই’।
তারপর উমাশশীর ভাসুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোকে আমি কান ধরে ক্লাস ফাইভ থেকে টেন অব্দি পড়িয়েছি, আজ তুই আমার মাথায় লাঠি তুলিস। ভাবি কী শিক্ষা তুই পেয়েছিস আর কী শিক্ষাই বা তুই দিচ্ছিস তোর ছাত্রদের’।
ঝগড়া আবার শুরু হয়ে গেল। কে কী বলছে বোঝা দায়। পণ্ডিতমশাই আর থাকতে পারলেন না সেখানে। বাঁশ ঝাড় পেছনে রেখে, পুকুরের পাড়, মাঠের আলপথ ধরে রাতের অন্ধকারে এগিয়ে চললেন। এবারে আর সাইকেলে নয়, পায়ে হেঁটে, একা।
উমাশশী ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘বাবু, তুমি আমাকে এই যমপুরীতে একলা রেখে গেলে......’
পরের দিনও ঝগড়ার রেশ রয়ে গেল। উমাশশীর শরীর তখনও খুব দুর্বল। মাথা ঘুরছিল, সে চুপচাপ শুয়ে ছিল ঘরে। তারপর আবার উমাশশীর পুরনো কোন অপরাধের পুনর্বিচার শুরু হল। শশিভূষণ আর সহ্য করতে পারল না। রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘দেশে কি মানুষজন নেই? আমি গাঁয়ের পাঁচজনকে ডাকছি, তারা এসে সব শুনে বিচার করুক। তোমাদের একতরফা বোলচাল আর কত শুনব? তোমরা কি মেরে ফেলতে চাও আমাদের?’
শশিভূষণের ডাকে গাঁয়ের মুরুব্বি লোকেরা সব সন্ধ্যার সময় তাদের বাড়ীতে জড়ো হয়েছিল। উমাশশীকে অনেক টানা-হ্যাঁচড়া করা হয়েছিল, সকলের সামনে এসে সব ঘটনা বিস্তারিত বলার জন্য। উমাশশী পারলে মাটিতে মিশে যায় – সে এতবড় অপরাধী যে তার বিচারের জন্য দেশের লোক জোটাতে হল। উমাশশীর ভাশুর আর বড়জা গড়গড় করে সব ঘটনা বলে গেল। শেষে সেই অমোঘ প্রশ্ন, ‘সংসারের এত বড় অমঙ্গল কেন করলো?’
উমাশশীর হয়ে শশিভূষণ তার বক্তব্য পেশ করল। গাঁয়ের লোকেরা সব শুনল। কালীচরণ সামন্ত উমাশশীর শ্বশুরকে বললেন, ‘আপনারই তো দোষ। আপনি কেন আগে শাঁখ বাজালেন? নিয়ম তো হচ্ছে সন্ধ্যার পরে শাঁখ বাজানো হয়। তাছাড়া যে সন্ধ্যা দেয়, সেই শাঁখ বাজায়। শাঁখ বাজানো শুনে উমাশশী যদি ভেবে থাকে যে সন্ধ্যা দেওয়া হয়ে গেছে, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তারপর সন্ধ্যার আলো খুঁজে না পেয়ে ও ভয়ে কাউকে কিছু বলে নি। আপনাদেরকেও তো বুঝতে হবে, ওর বয়স কতটা?’
উমাশশীর ভাশুর, শ্বশুর অনেক কূটতর্ক তুলেছিল। কিন্তু দেশের গণ্যমান্য লোকেদের বিচারে তা খারিজ হয়ে যায়। ওরা চলে যাবার পর বড়গিন্নি সদর দুয়ারে বসে মহাভারত পড়ে সবাইকে শুনিয়েছিল। উমাশশীর শাশুড়ি বলেছিল, ‘বড় বৌমা আমার ঘরের লক্ষ্মী’। তা শুনে, কোন এক অজ্ঞাত কারণে উমশশীর অধরে মৃদু হাসি ফুটে উঠেছিল।
৪
রাতের খাবারটা আজ খুব সরেস হয়েছিল। ভাত, আলুভাজা, বেগুনভাজা, মুগের ডাল, পোস্তবড়া, একটা পাঁচমিশেলি ঘ্যাঁট, হাঁসের গোটা-ডিমের ঝোল, আমড়ার অম্বল। খাওয়া-দাওয়ার পর উপরে শুতে এসে উমাশশী তার প্রশ্নের ঝাঁপি খুলল। প্রসঙ্গ – জরুরী অবস্থা।
শশিভূষণ বলল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও তোমার অনেক প্রশ্ন। সে-সব বলার আগে ইন্দিরা গান্ধীর এযাবৎ রাজনৈতিক জীবনটা একটু জানা দরকার। ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী হন ছেষট্টি সালে। শোনা যায় ছোটবেলায় তিনি খুব লাজুক, মুখচোরা প্রকৃতির ছিলেন। কিন্তু পরে তিনিই হয়ে উঠলেন এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেশনেত্রী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বছর তিনিকের মধ্যে তিনি কংগ্রেস দল ভেঙ্গে দেন। ইন্দিরা বুঝেছিলেন কংগ্রেস দলটাকে নিজের অঙ্গুলিহেলনে চালনা করতে হলে দল থেকে বুড়োদের বিদায় করতে হবে। তারপর একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠা। ‘গরিবি হঠাও’ স্লোগানে সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো যে সত্যি সত্যিই দেশে আর গরীব বলে কেউ থাকবে না। ইন্দিরা গান্ধী তখন প্রায় মা দুর্গা। দু হাতে সবকিছু সামলাচ্ছেন। একাত্তরের ভোটে বিশাল ব্যবধানে জিতে আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন’।
‘মা দুর্গাই যদি হলেন, তবে তার কালো হাত কেন?’
‘ক্ষমতার লোভ। একচ্ছত্র ক্ষমতালোভের তাড়নায় তারপর তিনি যে কোন রকম কৌশল অবলম্বন করতে লাগলেন। তার প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে উঠলেন ছোট ছেলে সঞ্জয়। মা ও পুত্র স্নেহে অন্ধ। সঞ্জয় নিজে কোন ভোটে না জিতলেও চাইতেন তার নিজের মর্জিমাফিক দেশটা চলুক। তারপর পঁচাত্তর সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ইন্দিরা গান্ধীর জয়কে অবৈধ ঘোষণা করা হল’।
‘কেন?’
‘আগের ভোটে হেরে যাওয়া প্রার্থী অভিযোগ করেছিলেন, ভোটের প্রচারে ইন্দিরা গান্ধী অন্যায়ভাবে নিজের প্রতিপত্তি খাটিয়ে সরকারি সুযোগ সুবিধা ব্যাবহার করেছেন। বিচারে সেটা প্রমাণও হয়ে গেল’।
‘তারপর কী হোলো?’
‘তারপর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্ব গেল না বটে, কিন্তু অনেকরকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হল। বিরোধী পক্ষের আন্দোলন, মিছিল, ধর্না তুঙ্গে উঠল। জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাইয়ের মত নেতারা এইসব সরকারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এইসব দেখেশুনে ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতারা একটা উপায় বের করলেন। পঁচাত্তরের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে একটা চিঠি পৌঁছল, যাতে লেখা ছিল...there is an imminent danger to the security of India being threatened by internal disturbance. The matter is extremely urgent.’
‘আঃ, বাংলায় বল না’।
‘মানে, সংবিধানের একটা ৩৫২ নং ধারা আছে, সেই হিসেবে......’
‘ওঃ, আবার ইংরেজি বলছ?’
‘মানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব খারাপ, সেই কারণে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হবে। একেই জরুরী অবস্থা বলে। তারপর জরুরী অবস্থা চালু হয়ে গেল’।
‘এতে ইন্দিরা গান্ধীর কী সুবিধে হল?’
‘বিরোধী নেতাদের সব ধরে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। খবরের কাগজের স্বাধীনতা বলে কিছু রইল না। খবর ছাপবার আগে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হত। মোট কথা মানুষের নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা এসব কেড়ে নেওয়া হল। এগুলোকে মানুষের মৌলিক অধিকার বলে। ভারতের সংবিধান সব মানুষকে এই অধিকার দিয়েছে’।
‘আমারও আছে এমন অধিকার?’ উমাশশীর মনে প্রশ্ন জাগে!
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে। তারপর সঞ্জয় গান্ধীর নির্দেশে জোর করে গরীব লোকেদের অপারেশন করানো হতে লাগল’।
‘কিসের অপারেশন?’
‘যাতে বাচ্চা-কাচ্চা না হয়। এভাবেই নাকি দেশের জনসংখ্যা কমবে। আর তাহলেই দেশের সব সমস্যার সমাধান হবে। অনেকে মারাও গেছে তড়িঘড়ি করে করা এই অপারেশনের সময়’।
‘এ তো মহা জুলুম’।
‘ওই জন্যই তো স্বৈরাচারী বলছে ইন্দিরা গান্ধীকে’।
উমাশশী খানিক চিন্তা করে বলল, ‘আমিও চিনি দু’জন স্বৈরাচারীকে। না দু’জন নয়, তিনজন......না, না, অনেক – সবাই স্বৈরাচারী’।
‘তারা কারা?’ শশিভূষণ জিজ্ঞেস করে।
‘সে তুমিও বুঝতে পারবে একটু ভেবে দেখলে। তারপর কী হল বল?’
‘তারপর জরুরী অবস্থা উঠে গেল এই তো কিছুদিন আগে। মানুষ একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। এইবার ভোট হবে। বিরোধীরা বলছে ইন্দিরা গান্ধীর কালো হাত ভেঙ্গে, গুঁড়িয়ে দিতে হবে... ব্যালটের মাধ্যমে। গণতন্ত্র বাঁচাতে হবে। একনায়কতন্ত্রের অবসান চাই’।
‘ওগো, তুমি আবার কঠিন কঠিন কথা বলছ...’
‘গণতন্ত্র মানে হল জনগণ...মানে সাধারণ মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। সব মানুষেরই নিজের নিজের মত আছে। নিজের মত অনুসারে তারা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়। তারাই দেশ চালায়। কিন্তু একনায়কতন্ত্র মানে হল, সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে, অন্য কারুর মতামতের তোয়াক্কা না করে, নিজের মর্জিমাফিক দেশ চালানো’।
‘এ রকম তো হয়েই থাকে’। উমাশশীর ভারী ঘুম পায়, সে পাশ ফিরে শোয়।
No comments:
Post a Comment