ছোটগল্প | ছায়ামেঘ | নিবেদিতা আইচ

ছায়ামেঘ
নিবেদিতা আইচ



ইয়্যু গো লেফট দ্যান রাইট...

নীলচোখের মানুষটা বারবার ধন্যবাদ দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ইউক্যালিপটাসের ছায়ায় ঢাকা পথ ধরে হেঁটে চলে গেলো। ইংরেজিটা কখনো এত কাঁচা ছিল না আমার। তবু সাদা চামড়া দেখে কথা বলতে গিয়ে ঠিকই বুক ঢিপঢিপ করছিল।

প্রায় ছ’ফুট উচ্চতার নীল চোখ মানুষটা কথা বলছিল অনেকটা ঝুঁকে। নিজেকে আমার বামন বলে মনে হচ্ছিল। চলে যাবার পরেও কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমি। তোতা মিয়ার দোকান থেকে দুটো ছোকরা পিছু নিয়েছে নীল চোখ মানুষের। আমি জানি কুন্দতলি গির্জার ফাদারের কাছে এসেছে লোকটা। এত বছরেও কেউ আসেনি কখনো। আজ হঠাৎ কেন এলো সেও জানি না। নামটা জিজ্ঞেস করতে পারিনি। সেটা আসলে ভদ্রতাজনিত সঙ্কোচের জন্য নয়, হুট করে এমন বেজায়গায় অসময়ে ওকে দেখে ভড়কে গেছি আমি। এখন মনে হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানাও যেত।

তোতা মিয়ার দোকানে গিয়ে বসলে একটু পর পুরো খবরটাই হয়তো জানা যাবে। কিন্তু বরাবরের মতো নির্লিপ্ততা ধরে রেখে সেদিকে না গিয়ে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।

গির্জার আধভাঙ্গা টাওয়ারের শিক বরাবর কেউ ঢিল ছুঁড়ছে অনবরত। একটা সময় এই খেলাটা আমাদেরও বেশ লাগতো। পরপর তিনবার নিশানা ছুঁতে পারলেই দশ টাকা জিতে যেতাম। দশ টাকা দিয়ে বাদুড়ডাঙার মোড়ে আধপ্লেট তেহারি খেয়ে হুল্লোড় করতে করতে ফিরতাম। আজকাল ছেলেপুলে কত টাকা বাজি ধরে জানি না। বাদুড়ডাঙার মোড়টাও এখন আর তেমন নেই, স্কুল বিল্ডিং উঠে গেছে সেখানে। তাই আড়াই হাত দৈর্ঘ্যের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি দেখতে মজাই লাগে আমার।

আমার ব্যালকনি আর গির্জার মাঝে বালুর মাঠের ব্যবধান। ছেলেপুলেরা এখনো ছুটোছুটি করছে সেখানে। মিনিট দশেক পর আজানের সুর ভেসে এলে সুড়সুড় করে যে যার বাড়িতে গিয়ে ঢুকবে। ধেঁড়েগুলোর আড্ডা অবশ্য আরো ঘন্টাখানেক পর ভাঙবে। তারপর বালুর মাঠ কিছুক্ষণ শুনশান থাকবে।

নেশারুদের আনাগোনা শুরু হবে রাত একটু গভীর হলে।

শেষ বিকেলের লালচে আলোয় বড় মায়াবী লাগে গির্জার ক্রুশচিহ্নটা। ছ’টা বাজতেই নিয়ম মতো ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসে। কার্নিশজুড়ে পায়চারি করা পায়রার দল ভীষণ চমকে গিয়ে ডানা ঝাঁপটে উড়ে যায় এদিক ওদিক। ঘুরেফিরে সেদিকেই চোখ চলে যায় আমার।

পাম গাছের সারির ফাঁকে সবুজ লনে ফাদার মার্গোসের পাশে হাঁটছে কেউ। দীর্ঘাঙ্গী যে সেই নীল চোখ মানুষ আমি ঠিক বুঝতে পারলাম। এখন আমার মন বলছে এ ল্যরিস ছাড়া আর কেউ নয়।

বিস্বাদ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে দিই আমি। মার্গোস কি বাড়ি ফিরে যাবেন এবার? আশির উপরে বয়স হয়েছে তার। এবার একবার দেখা করতেই হবে। সেই কবে আমাদের শেষ কথা হয়েছে!

এতদিন পর আমার এই কৌতূহলের পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। আমি জানি মানুষটা যদি ল্যরিস হয় তাহলে মার্গোসের বুকের ভেতর এখন নিদারুণ ঝড় বইছে। এমন কি বেখেয়াল আর আত্মমগ্ন এই আমিই ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ছটফট করতে শুরু করেছি! আর তাই মার্গোসের সাথে কথা না বললেই নয়।
রাতে খেয়ে রাস্তায় হাঁটতে বের হলাম। বেশ উত্তুরে হাওয়া বইছে। মাফলারটাকে ভালো করে জড়িয়ে কান দুটো ঢাকলাম আমি। মাঠের পাশ দিয়ে না গিয়ে একটু ঘুরপথ দিয়ে এগোলাম। নেশারুদের বিশ্বাস নেই, প্রতিদিনই ছিনতাই হয় এদিকটায়। পকেট খালি করে বেরুলে বিপদের সম্ভাবনা আরো বেশি। তোতা মিয়ার দোকান বন্ধ হয় নি। একটু দাঁড়াতেই ওর উৎসুক চোখমুখ দেখতে পেলাম। আমি জানি আজ সন্ধ্যা থেকে তোতা মিয়া সবাইকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক খবরই শুনিয়েছে। আমাকে হাতের ইশারায় বসতে বলে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো লোকটা। একটু ইতস্তত করে বসে পড়লাম। ভাবছি আগ বাড়িয়ে কিছুই জানতে চাইবো না।

চা খেতে খেতে তোতা মিয়া নীল চোখ মানুষ আর মার্গোসকে নিয়ে আবোল তাবোল অনেক কথাই বললো। এতদিনের জানাশোনায় বুঝতে পারছিলাম বেশিরভাগই তার মন গড়া কথা। হু-হা করে কাটিয়ে দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম আমি।

গির্জার মূল ফটকের কাছে গিয়ে এলোমেলো হাঁটাহাঁটি করার মিনিট পাঁচেক পর দেখি কেউ একজন বেরিয়ে আসছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মানুষটাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি।

হেসে এগিয়ে এসে নিজের নাম বললো নীল চোখ মানুষটা। আলো আঁধারিতে ল্যরিসকে আপাদমস্তক দেখে নিলাম আরেকবার। মাথায় কাঁচা পাকা চুল। বছর পয়তাল্লিশের মতো বয়স হবে। হাত বাড়িয়ে দিলো নিজ থেকেই। আমিও হাত বাড়ালাম। জানালো মার্গোসের শরীরটা ভালো নেই, একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। একা ঘরে বসে একঘেয়ে লাগছিলো বলে একটু হাওয়া খেতে বেরিয়েছে ল্যরিস।

ল্যরিসের মুখে ভাঙা ভাঙা বাংলা শুনে আমি আরেকবার অবাক হলাম। একটা প্রজেক্টের কাজে মাস দুয়েক আগে সে এদেশে এসেছে। কাজের স্বার্থেই বাংলাটা অল্প বিস্তর রপ্ত করতে হয়েছে। সে এতদূরে শুধু মার্গোসের কাছে এসেছে ব্যাপারটা আসলে তা নয়। বরং কাজের ফাঁকে একটা খোঁজ পাওয়া যায় কিনা তাই দেখতে এসেছে!

এ সবই আমার অনুমান। মার্গোসকে প্রশ্নগুলো অনায়াসে করা যেতো কিন্তু ল্যরিসের সাথে এসব আলাপ চলে না। অবশ্য ল্যরিসকে আমি চিনি অনেক বছর ধরে, কম করে হলেও বছর পঁচিশ তো হবেই। শুনলে সেও নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে। মার্গোসের মুখে গল্প শুনে শুনে ল্যরিস যেন আমার খুব পরিচিত কেউ হয়ে উঠেছিলো!

কুন্দতলি গির্জার ফাদার মার্গোস ক্যাপ্রিয়েল যখন আমাদের শহরে আসেন তখন তার সাথে আমার এত গল্প হতো না। আমি তখন মাত্র দশ বছরের হাফপ্যান্ট পরা বালক। কাননবালা অনাথালয়ে থেকে বাদুড়ডাঙা স্কুলে পড়তাম। শান্ত আর মনোযোগী ছাত্র ছিলাম আমি। ছুটির পর সোজা অনাথালয়ে ফিরতাম। মার্গোসের সাথে দেখা হতো উৎসবের দিনগুলিতে৷ দূর থেকে দেখতাম তাকে। সবাই এত ভক্তি শ্রদ্ধা করতো, ওই বয়সে ধারে কাছে ঘেঁষতে পারি নি।

মার্গোসের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয় আরো অনেক বছর পর। তখন আমি অনার্স পরীক্ষা পাশ করে সদ্য বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সেই ঘোরতর হতাশার দিনগুলিতে আমার হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। বাজে ছেলেপুলেদের সাথে মেলামেশা শুরু হতেই জুয়া খেলার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলাম। রাত জেগে জুয়া খেলতাম।

সেরকম এক সন্ধ্যারাতে আড্ডার ছেলেদের হাতে একবার বেদম মার খেলাম। এই বালুর মাঠ তখন আরো বেশি নিরিবিলি থাকতো। মার্গোস সেদিন এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। জানি না ছেলেগুলো কেন আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলো, শুধু মার্গোস এসে বাঁধা দেয়ায় নাকি আরো কারণ ছিল সে আমি জানতে পারিনি।
সেই থেকে মার্গোসের সাথে আমার সখ্য। আমি ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে হয়ে যেতাম কবেই! মার্গোস আমাকে একটু শান্তির সন্ধান দিয়েছিলেন। লোকটা চুপচাপ পাশে বসে থাকলেও মনে হতো যেন শান্ত কোনো নদী তীরে বসে আছি। কিংবা একটা ছায়ামেঘ যেন আমাকে আগলে রেখেছে রোদের খরতাপ থেকে। লোকটা আমায় সম্বোধন করতেন ‘মাই চাইল্ড’ বলে। সবাইকেই তাই বলতেন। তবু তার সন্তানের বয়সী বলে আমাকে যেন কিছুটা স্নেহের চোখেই দেখতেন তিনি। বয়সের এত ব্যবধান থাকলেও আমরা ছিলাম বন্ধুর মতো।

মাঝেমাঝে আমাকে ভুলিয়ে রাখতে নিজের অতীতের গল্প শোনাতেন মার্গোস। ল্যরিস আর তার মা নীনা ক্যাপ্রিয়েল -এরা আমার চোখে রুপকথার চরিত্রের মতো ছিলো। তাই তোতা মিয়ার দোকানে বসে কখনো যে ল্যরিস আমার সাথে গল্প করবে এটা স্বপ্নেও ভাবিনি। এই ছোট আর পুরনো শহরটা সে ঘুরে দেখতে চায়। কথাচ্ছলে আমাকে তার গাইড হতে অনুরোধ করে। সবকিছু কেমন ঘোরের মতো লাগে আমার! অন্যমনস্ক হয়ে যাই বারবার।

মার্গোস কাল সারাদিন ব্যস্ত থাকবেন। গির্জা সাফ সুতরো করা থেকে শুরু করে মাঙ্গলিক সকল কাজের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। কারণ পরশুদিন ৬ জানুয়ারি। প্রতিবছর কুন্দতলি গির্জায় আর্মেনীয় রীতিতে বড়দিনের উৎসব হয় এই তারিখে। গির্জাটি শত বছরের পুরনো। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন আর্মেনীয় ভদ্রলোক। শুরু থেকেই বেশ জাঁকজমক করে যে বড়দিনের উৎসব হতো আজকাল আর সে রকমটি নেই। এদিকটায় খ্রিস্টান লোকের সংখ্যাও এখন হাতে গোণা। সকাল আর সন্ধ্যায় উপাসনা ছাড়া আর বিশেষ কিছুর আয়োজন হয় না বহু বছর।

ল্যরিস প্রস্তাব দিল যেহেতু কাল মার্গোসের হাতে সময় নেই, তাই শুধু শুধু ঘরে বসে না থেকে কাল আমরা সারা শহর ঘুরে বেড়াবো। আমি রাজি হলাম, না হবার কোনো কারণও নেই। বরং ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে রইলাম আমি। রাতে ঘুমটাও হলো না ঠিক করে। সারা রাত ক্যাপ্রিয়েল পরিবারের কথাই ভাবলাম। কী অদ্ভুত করুণ তাদের গল্পটা! গল্পটা শোনাতে গিয়ে মার্গোস বারবার চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতেন।

মার্গোস আমাকে বলেছিলেন তার বাউল মনের কথা। ঈশ্বর তাকে সংসারের উপাদানে তৈরি করেন নি। তাই তিনি ভেবেছিলেন কখনো ঘর বাঁধবেন না। তবু প্রথম দেখায় নীনা তাকে মুগ্ধ করেন। নিজেকে সংবরণ করতে পারেন নি মার্গোস। প্রকৃতির নিয়মেই প্রেমের সম্পর্ক হয় তাদের মধ্যে। বিয়ে হলে ঘরকন্নায় মন দেয় নীনা। বছর ঘুরতেই ল্যরিস আসে কোল জুড়ে।

সংসারের ক্লেদে পড়ে মার্গোসের ভেতরের সুরটা যেন কেটে যায়, খেলাঘরে মন বসে না আর। সেই আগের শেকলছেঁড়া জীবন ফিরে পেতে চান তিনি। নীনাও টের পায় মার্গোসের অন্যমনস্কতার কথা। তবু সে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যায়। ল্যরিসের বয়স যখন পাঁচ তার জন্মদিনের ঠিক দু’দিন পর মার্গোস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। সবার নাগাল থেকে দূরে যেতে চলে যান অন্য শহরে। তাকে যেন খোঁজা না হয় সেই অনুরোধ করে চিঠি লিখে রেখে যান। মাস তিনেক পথে পথে ঘুরে তিনি যখন আজেরবাইজানে গিয়ে পৌঁছুলেন তখন সেখানেই এক পুরনো প্রতিবেশীর সাথে তার দেখা হয়ে যায়। তার কাছেই জানতে পারেন নীনার মৃত্যুর খবরটা।

কাস্পিয়ান হ্রদের বুকে তখন এলোমেলো ঢেউ বইছে। মার্গোস ঘোরগ্রস্তের মতো উঠে বসলেন জাহাজে। কোনো গন্তব্য জানা ছিল না। শুধু চেয়েছিলেন পৃথিবীর সুদূরতম কোনো প্রান্তে গিয়ে মনটাকে শান্ত করবেন। তারপর মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলো, বছর পেরুলো। নানা বন্দর পেরিয়ে মার্গোস এসে পৌঁছুলেন বাংলাদেশে।

আমি কল্পনায় এই গল্পটা দেখতে পেতাম। এত সব কথা অবশ্য ল্যরিসের জানা নেই। শহরটা ঘুরতে বেরিয়ে ওর চোখে মুখে আশ্চর্য বিস্ময় দেখতে পেয়ে মায়া লাগলো আমার। তাই ওকে তখনই কিছু বলে ভড়কে দিতে ইচ্ছে হলো না। চুপচাপ ওর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম। ল্যরিস এই এলাকার ইতিহাস জানতে চাইলো। এখানে জীবন কেমন তা নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই ওর। তারপর আমাকে নিয়ে পড়লো মানুষটা। কী করে অনাথালয়ে এলাম, আমার ইতিহাস জানার জন্য ওর চোখেমুখে কৌতূহল ঝকমক করছিলো৷

আমার ইচ্ছে হলো ওকে সব বলতে। সব বলতে দু’ তিন লাইনের গল্প ছাড়া কিছু নয়। অনাথালয়ের আশ্রিত হিসেবে মায়ের মুখ যে আমি কখনো দেখিনি সে তো অনুমান করেই নেয় সকলে। কিন্তু এই অদেখার আরো একটা কারণ ছিল যেটা খুব কম লোকই জানতো ৷ মাঝেমাঝে একজন ভদ্রমহিলা আমাকে দূর থেকে দেখে চলে যেতেন, নীরবে। প্রতিবারই তার মুখটা বোরকার পর্দার আড়ালে থাকতো। দেখা অদেখার বিভ্রম ছিল তাই। একসময় সেটাও চুকে যায়। এক মন খারাপের বিকেলে আমার অনেক দিনের জমানো অভিমান আগ্নেয়গিরির মতো জেগে উঠেছিলো। খুব দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম সেই ভীতু মহিলাটিকে। ওই শেষবার, আর কখনো দেখি নি।

আমার কথাগুলো শুনে ল্যরিস মন খারাপ করে ফেললো। আমার খারাপ লাগা বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই, বহুদিন আগে এসব ছেড়ে এসেছি। ল্যরিসের মন ভালো করতে বাদুড়ডাঙার মোড়ে ফুচকা খেতে বসলাম। ঝাল খেয়ে নাক চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো ওর। একচোট হাসাহাসি করলাম এই নিয়ে। রাস্তার লোকজন অবাক চোখে দেখছিল আমাদের। একে তো ল্যরিসের মতো সুদর্শন সাদা চামড়ার লোক তার উপর আমাদের দুজনেরই মাথায় কাঁচা পাকা চুল। হাঁ করে দেখছিলো অনেকেই। স্কুল ছুটির সময় হয়ে এলো বলে ভিড় এড়াতে সেখান থেকে উঠে পড়লাম আমরা।

ল্যরিসের মায়াবী নীল চোখ দেখে আমি মাঝেমাঝেই আনমনা হয়ে যাচ্ছিলাম। মার্গোসের কাছে ওর দুরন্ত ছেলেবেলার গল্প শুনেছি বহুবার। কপালের বাঁ দিকে কাটা চিহ্নটা লক্ষ্য করলাম। আমি জানি ওটা মাংস কাটার ছুরিতে আঘাত লেগে হয়েছিলো। তখন ওর বয়স ছিল মাত্র চার। দাগটার কথা জিজ্ঞেস করতেই নীল চোখ জোড়া মেলে তাকিয়ে রইলো। এই নীল রঙ ওর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। নীনা ক্যাপ্রিয়েল ছিলেন নীল নয়না, অসম্ভব রুপসী আর ঘোরতর সংসারী একজন মহিলা।

হু আর ইয়্যু? হাউ ডু ইয়্যু নো অল দিজ, শ্যামল!

সহসা কিছু বলে উঠতে পারলাম না। এক কালে মার্গোসের সাথে যে ঘনিষ্টতা ছিল তাতে এসবই আমার জানার কথা। আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট করেছিলাম আমিই। অকৃতদার আমার এই একাকী জীবনে টাকাপয়সার প্রয়োজন এতটাও বেশি ছিল না যে অসদুপায় অবলম্বন করতে হবে। তবু করেছিলাম, লোভে পড়ে অফিসের ডেস্কে বসে হিসেবের এদিক ওদিক করে দিয়েছিলাম। মার্গোস জানতেন না কিছুই তবু আমার চোখের দিকে তাকালে ভেতরটা পড়ে নিতেন ঠিকঠাক। হয়তো এত বছরের ফাদারহুড তাকে এই ক্ষমতা দিয়েছে! মার্গোস বহুবার জিজ্ঞেস করলেও আমি স্বীকার করি নি।

তোমার কী হয়েছে শ্যামল? তোমার চোখ দুটো এত নিষ্প্রভ কেন, মাই সন?

ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নতুন ঘড়িটা আড়াল করেছিলাম আমি। সদ্য কেনা দামী শার্টের ভেতরে আমার শরীরটা ঘেমে উঠেছিল। প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো মুখ ছিল না আমার। তাই এরপর থেকে মার্গোসকেই এড়াতে শুরু করলাম। তবু ধরা পড়তে হলো। শুধু ওর কাছে নয়, সমস্ত শহর জানতে পারলো। স্থানীয় পত্রিকায় খবরটা ছাপা হয়ে গেলো। লক্ষাধিক টাকার হিসেব আমি দিতে পারি নি। ক’দিনের মধ্যেই আমার ব্যাংকের চাকরিটা চলে গেলো। তবু মার্গোস আমাকে ক্ষমা করতেন হয়তো, কিন্তু আমি যে ক্ষমা চাই নি!

কিছু লোক প্রায়ই বলতো মার্গোস আমাকে ধর্মান্তরিত করতে চান, তাই এত কাছে টানেন। আমার নিজস্ব চিন্তাশক্তি হয়তো লোপ পেয়েছিল, নইলে এমন অসত্য ভিত্তিহীন কথা বিশ্বাস করতে পারলাম কী করে! তাই পত্রিকায় খবরটা বেরুনোর পর মার্গোস যখন আমাকে ডেকে পাঠালেন আমি বলে দিয়েছি ধর্মান্তরিত হবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, উনি যেন অন্য শিকার বেছে নেন।

এত বড় অপমান জানি না কী করে হজম করেছিলেন মার্গোস। এরপর প্রায় দু’বছর পেরিয়ে গেছে, আমার ছায়া দেখলেও তিনি এড়িয়ে যান। আর আমি ভেতরে ভেতরে অনুতাপে জ্বলে যাই তবু কথা বলার সাহস হয় না আমার।

পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে ফেলি আমি। ল্যরিস আমাকে ফিরিয়ে আনে বর্তমানে। বারবার প্রশ্ন করে জানতে চায়, ওর ব্যাপারে এতকিছু জানি কী করে। উত্তরে মার্গোসের কথা বলতেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ল্যরিস। সেই দৃষ্টির অনুবাদ আমার জানা নেই। শুধু মার্গোসের প্রসঙ্গটা এলো বলে নীনা ক্যাপ্রিয়েলের ব্যাপারে আমার জানার আগ্রহটা শতগুণ বেড়ে যায়।

শুনেছি নীনা মারা যাবার আগে একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলো। কুন্দতলি গির্জার দায়িত্ব নেবার আরো পনেরো বছর পর সেই চিঠিটা হাতে পান মার্গোস। যত দূর মনে পড়ে ল্যরিস নিজেই পাঠিয়েছিল চিঠিটা। মার্গোসকে সংসার থেকে মুক্তি দিতে আত্মহত্যা করেছিলো নীনা। নীনা জানতো মার্গোস বাড়ি ছাড়লেও ওর মন বিক্ষিপ্ত থেকে যাবে, ওকে পুরোপুরি মুক্তি দিতে নীনা নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়।

আমার মনে আছে চিঠিটা পেয়ে মার্গোস খুব মুষড়ে পড়েছিলেন। আমি জানি না কেন অতগুলো বছর পর ল্যরিস চিঠিটা পাঠিয়েছিল। আজকেও প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে, কিন্তু কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারছি না। শুধু ওর চোখ দুটো আমাকে বারবার বিহবল করে দেয়। কল্পনার নীনা ক্যাপ্রিয়েলের সাথে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করি আমি। মার্গোস প্রায়ই বলতেন ল্যরিস দেখতে অনেকটাই তার মায়ের মতো।

তোমার কাছে তোমার মায়ের ছবি আছে, ল্যরিস?

বাড়ির ফেরার পথে আমি কথাটা জিজ্ঞেস না করে পারি নি। ল্যরিস ওর ওয়ালেট বের করে নীনার ছবিটা দেখায়। নীল নয়না নীনার কোলে কোঁকড়া চুলের শিশু ল্যরিসকে দেখে জানি না কেন চোখ ভিজে এলো আমার। সেই ভীতু মহিলাটার কথা ভেবে নাকি কল্পনার নীনা ক্যাপ্রিয়েলকে বাস্তবে দেখতে পেয়ে? সত্যিই জানা নেই!

পরদিন বড়দিনের উৎসব খুব সাদামাটা ভাবে শেষ হলো। অল্প কিছু লোক প্রার্থনায় অংশ নিলো। সব সম্পন্ন হয়ে গেলে আমি মার্গোসের সাথে দেখা করতে গিয়েছি। দু’টো বছর পর সেদিন আমাদের অনেকক্ষণ কথা হলো, অভিমান ভুলে মার্গোস আমার মাথায় হাত রেখেছেন, আমিও ক্ষমা চেয়েছি।

মার্গোসকে বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছিলো। আমার ইচ্ছে করছিল ল্যরিসের সাথে তাকে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু মার্গোস এমন প্রস্তাব মেনে নেন নি, কথাটা ল্যরিসকে বলারই সুযোগ দেন নি আমায়। বললেন তিনি এত বছরের অভ্যস্ততা ছাড়তে পারবেন না, জীবনের শেষ প্রহর পর্যন্ত কুন্দতলি গির্জার ঘণ্টাধ্বনি শুনতে চান তিনি।

ল্যরিস চলে গেলো আরো একদিন পর। প্রজেক্টের কাজ শেষ করে সে মার্গোসকে দেখতে এসেছিলো। এতক্ষণে হয়তো আজেরবাইজান ফেরার বিমানে চেপে বসেছে মানুষটা । যে ক'টা দিন এখানে ছিল আমার সময়টা দারুণ কেটেছে। ওকে আবার আসার আমন্ত্রণ জানালাম আমি। সেও যোগাযোগ রাখবে বলে কথা দিয়ে গেলো।

কিন্তু কখনো ভাবিনি এত দ্রুত ওর সাথে যোগাযোগ করতে হবে। ভাবিনি মার্গোসের হয়ে ল্যরিসকে চিঠি লিখতে হবে এই আমাকেই। লিখতে বসে সব ঝাপসা হয়ে আসে। একবার ফোন করলেই ওকে মৃত্যু সংবাদটা দেয়া যেতো। কিন্তু মার্গোস শেষ বেলায় বলে গেছেন খবরটা যেন দেরিতে দেয়া হয়। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে ল্যরিস যেন ফিরে না আসে।

চিঠিটা পোস্ট করে দিয়ে গির্জার সামনে গিয়ে দাঁড়াই আমি। বহুদিন পর যেন সেই কিশোর বেলার অভিমানটা ফিরে ফিরে আসে। ভাঙা টাওয়ারটার উপরে কিছু ছায়ামেঘ ভেসে বেড়ায়, একটু পর আমাকেও ছুঁয়ে যায় ওরা। শুধু দৃষ্টিটা আবার ঝাপসা হয়ে আসে বলে তাদের স্পষ্ট করে দেখতে পাই না আমি।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট