রবিবারের প্রবন্ধ ২
প্রবাহিত মনুষ্যত্ব
শঙ্খ ঘোষ
আর অন্যদিকে, একজন বর্ষীয়সী মহিলাকে জানি, মানুষখেকো বাঘেরা বড়ো লাফায় বইটি পড়ে এর কবিকে যিনি একটি চিঠি লিখবার জন্য ব্যাকুল হচ্ছিলেন৷ এর তাপ আর বিক্ষোভ, এর প্রাত্যহিকতা আর পথচারিতায় খুব সহজেই নিজের মন মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন সেই মহিলা৷ বাংলা কবিতার প্রেমিক একজন বিদেশী মানুষকেও জানি, কলকাতায় এসে যিনি কবিতার মধ্যে খুঁজছিলেন এদেশের সাময়িকতার চাপ, এর প্রতিদিনের রক্তক্ষরণ৷ আমাদের মতো দেশে কিংবা লাতিন আমেরিকায় বা আফ্রিকায় যে-ধরণের প্রতিবাদের কবিতা বিদীর্ণ হয়ে উঠবার কথা এখন, তিনি খুঁজছিলেন সেইটে৷ আর এই কাজে প্রচুর সন্ধানের পর তিনি নির্বাচন করে নিয়েছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা––সমস্তরকম লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে আর্তনাদ যেমন লাভাস্রোতে বেরিয়ে আসে ওঁর রচনায়, সেটা মুগ্ধ করেছিল তাঁকে৷ প্রতিবাদের এই প্রত্যক্ষতাতেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষতম কবিতার পরিচয়, এইখানেই তাঁর কবিতার সঙ্গে একাত্মবোধ করেন তাঁর আজকের দিনের পাঠক৷
কিন্তু আমরা, যাঁরা অনেকদিন ধরে তাঁর কবিতা পড়ছি, আমাদের তখন অন্য একটা ভাবনাও এসে পড়ে মনে৷ অনেকদিন আগে যখন তিনি জেগে উঠেছিলেন যেন জীবনানন্দের ভূমি থেকে, তার চেয়ে এখনকার জগৎ কি তবে সরে এসেছে একেবারে? পূর্বাশা-র পৃষ্ঠায় যখন তিনি লিখছিলেন “ক্লান্তি ক্লান্তি”র মতো কবিতা, ‘এমন ঘুমের মতো নেশা’ কিংবা ‘এমন মৃত্যুর মতো মিতা’কে এড়িয়ে জীবন চান না বলে জানাচ্ছিলেন যখন, একাধিক কবিতায় যিনি দেখছিলেন ‘শরবতের মতো সেই স্তন’ তাঁর কবিতায় তখন সদর্থেই একটা প্রচ্ছন্ন আবহ ছিল জীবনানন্দের৷ এটা হতেই পারে যে আজ দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অভ্যাসে তিনি অল্পে অল্পে––কিংবা হঠাৎই একদিন––একেবারে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন সেই আবহ থেকে, মৃত্যুর থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন ক্ষুধার্ত জীবনের দিকে৷ এটা হতেই পারে যে তাঁর কবিতা এখন আর আলোছায়ার কোনো প্রদোষ রাখবে না কবিতায়, হয়ে উঠবে স্পষ্ট এবং রূঢ়, সাময়িকতার প্রয়োজনে অত্যন্ত নির্মমরূপে বাস্তবিক ––ঘোষিত এবং দলীয়৷
তবু, এইটেই কি তাঁর সব পরিচয়? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা লক্ষ করে পড়লে দেখা যাবে যে তাঁর এই মুহূর্তের রচনায় বিষাক্ত ধিককারের সঙ্গে সঙ্গে রয়ে গেছে এক প্রগাঢ় কোমলতা৷ এই অর্থে, মনে হয়, তাঁর অতীত তাঁকে ছেড়ে যায়নি পুরো, বরং কবিতার ভিতরকার পর্দায় সেটা এক মস্ত সামর্থ্য এনে দিচ্ছে৷ প্রথম যৌবনে যে স্বপ্নমদির জগৎ তিনি দেখছিলেন তা আর প্রত্যক্ষে এখন কথা বলে না সত্যি, কিন্তু দেশে দেশে কালে কালে ‘প্রবাহিত মনুষ্যত্ব’র প্রতি তাঁর অটুট ভালোবাসা একটা মমতাময় ধমনী রেখে দেয় তাঁর কবিতার অন্তরালে৷ তখন, এ-রকমই অভিমান আর ক্রোধে মিশে গিয়ে তৈরি হয়ে ওঠে তাঁর ছোটো এক-একটি কবিতা
নাচো হার্লেমের কন্যা, নরকের উর্বশী আমার
বিস্ফারিত স্তনচূড়া, নগ্ন উরু, …লিতবসনা
মাতলামোর সভা আনো, চারদিকের নিরানন্দ হতাশায়,
হীন অপমানে
নাচো ঘৃণ্য নিগ্রো নাম মুছে দিতে মাতলামোর জাত নেই,
পৃথিবীর সব বেশ্যা সমান রূপসী৷
নাচো রে রঙ্গিলা, রক্তে এক করতে স্বর্গ ও হার্লেম৷
যেমন আমাদের অভিজ্ঞতারও আছে দিন আর রাত্রি, যেমন দিনের অনেক রৌরব আমরা মুছে নিই রাত্রিবেলার নির্জন আত্মক্ষালনে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিণত কবিতাতেও তেমনি আমরা দেখতে পাব সেই দুই ছায়াপাত৷ সামাজিক যে-কোনো ঢেউয়ের আঘাতে কেঁপে ওঠেন এই কবি, বিবেচনার কোনো সময় পাবার আগেই ঝাঁপ দিয়ে পড়েন স্রোতে, ভেঙে ফেলতে চান সব ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান––কারোই মুক্তি নেই তাঁর সর্বনাশা রোষ থেকে৷ কিন্তু এইসব ভয়ংকর মুহূর্তেও তিনি হঠাৎ এক-একবার এসে দাঁড়াতে পারেন সেই ঘুমন্ত সীমায়
ভুবনেশ্বরী যখন শরীর থেকে
একে একে তার রূপের অলংকার
খুলে ফেলে, আর গভীর রাত্রি নামে
তিন ভুবনকে ঢেকে
এই হলো তাঁর কবিতার রাত্রি, এইটেই তাঁর কবিতার আত্মস্থ অবকাশ, এইখানে তাঁর কবিতার পলিমাটি৷ এই পলি আছে বলেই তার উপর জেগে ওঠা সমস্ত দিনের শস্য একটা স্বতন্ত্র আলো পেয়ে যায়, হয়ে ওঠে সমকালীন অন্যান্য চিৎকৃত বিক্ষোভের চেয়ে অনেক স্বতন্ত্র৷ তাঁরও আছে চিৎকার, কিন্তু অনায়াস সত্য থেকে উঠে আসে বলে তাঁর সেই চিৎকারে প্রায়ই লিপ্ত থাকে একটা মন্ত্রের স্বাদ
অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা৷
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা,
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা৷
অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার
অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওংকার
সে অন্নে যে বিষ দেয়, কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে৷
এই কবিতা একটা সমগ্র ক্ষুৎকাতর যুগের জাতীয় স্লোগান হয়ে উঠবার যোগ্য৷
এটা ঠিক যে এই কবিতাটিতে, কিংবা এ-পর্যন্ত উদ্ধৃত তিনটি রচনাতেই তাঁর শিল্পসুমিতির যে ধরণ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষ পর্যায়ের কবিতার সেইটেই সাধারণ লক্ষণ নয়৷ তাঁর কবিতা অসমান, অনেকসময়েই তাঁর কবিতা বরং তুলে নিয়ে আসে ঈষৎ ভাঙা চলন, যার ছন্দে ছবিতে শব্দের ব্যবহারে হঠাৎ কখনো মনে হতে পারে যে অশুদ্ধ হলো সুর৷ কিন্তু সেইটেই যেন তাঁর আনন্দ, যেন কিউবার কবি নিকোলাস গ্যিয়েন-এর মতো তিনিও আজ বলে উঠতে পারেন নিজেকে অশুচি বলেই ঘোষণা করছি আমি৷ এই কবিও একদিন ‘নিজের মধ্যে নিহিত থেকে অর্কেস্ট্রা বাজানো’র ভঙ্গি জানছিলেন, যুক্ত ছিলেন তাঁর ভাষার মডার্নিজম-এর আন্দোলনে আর তার থেকে আজ বেরিয়ে এসে এখন তিনি চার পাশে দেখতে পান এক বিশাল চিড়িয়াখানা৷ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও আজ তাঁর ছোটো ছোটো বইগুলির মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন আমাদের আক্রমণকারী সমকালীন ভণ্ড পৃথিবী, আর তাই মুণ্ডহীন ধড়্গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে বা বাহবা সময় তোর সার্কাসের খেলা এইসব হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা-বইয়ের নাম৷ এর অন্তর্গত কবিতাগুলি পড়তে পড়তে কোনো পাঠকের মনে হতে পারে যেন তিনি হেঁটে চলেছেন ধান-কেটে-নেওয়া কোনো জমির ওপর দিয়ে, থেকে-থেকে কাঁটা বেঁধে পায়ে, পিঠে এসে লাগে রোদ্দুরের ফলা সেখানে নেই কোনো সমতল মসৃণতা বা শিল্পসুষমার কোনো সচেতন আয়োজন৷ এর অন্তর্গত কবিতাগুলি পড়তে পড়তে পাঠক কেবলই ঘূর্ণির মতো ঘুরতে থাকবেন এই পাঁচ-দশ বছরের কলকাতার গ্লানিময় ইতিবৃত্তে, সমস্ত ভারতবর্ষের নিরন্তন পচন-লাঞ্ছনায়৷ আর সেই পটভূমি মনে রাখলে এই অসমান ঊষর আঘাতময় শিল্পধরণকে মনে হয় অনিবার্য, অনিবার্য মনে হয় এর আপাতশিল্পহীনতা৷ আপাত, কিন্তু সম্পূর্ণত নয় কেননা অনেকদিনের কাব্যময়তাকে যিনি রেখে দিয়েছেন তাঁর ভিতরে, আজ এই স্পষ্ট ভর্ৎসনার উচ্চারণের সময়েও তাঁর ভাষা হয়ে ওঠে এ-রকম ‘আকাশের দিকে আমি উলটো করে ছুঁড়ে দিই কাঁচের গেলাস’ অথবা ‘ব্রাহ্মমুহূর্তে কারা ছায়ার মতো ছেড়ে গেছে ঘর’ কিংবা ‘কলকাতার ফুটপাথে রাত কাটায় এক লক্ষ উন্মাদ হ্যামলেট/তাদের জননী জন্মভূমি এক উলঙ্গ পশুর সঙ্গে করে সহবাস’ আর ‘আমাদের সন্তানের মুণ্ডহীন ধড়গুলি তোমার কল্যাণে ঘোর লোহিত পাহাড়৷’ তখন বুঝতে পারি কবির যোগ্য সমস্ত ইন্দ্রিয় তাঁর ভিতরে কাজ করে যায় কীরকম সন্তর্পণে, বুঝতে পারি কোথায় আছে পুরোনো সেই কবির সঙ্গে আজকের কবির নিবিড় কোনো যোগ৷
প্রবাহিত মনুষ্যত্ব
শঙ্খ ঘোষ
আর অন্যদিকে, একজন বর্ষীয়সী মহিলাকে জানি, মানুষখেকো বাঘেরা বড়ো লাফায় বইটি পড়ে এর কবিকে যিনি একটি চিঠি লিখবার জন্য ব্যাকুল হচ্ছিলেন৷ এর তাপ আর বিক্ষোভ, এর প্রাত্যহিকতা আর পথচারিতায় খুব সহজেই নিজের মন মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন সেই মহিলা৷ বাংলা কবিতার প্রেমিক একজন বিদেশী মানুষকেও জানি, কলকাতায় এসে যিনি কবিতার মধ্যে খুঁজছিলেন এদেশের সাময়িকতার চাপ, এর প্রতিদিনের রক্তক্ষরণ৷ আমাদের মতো দেশে কিংবা লাতিন আমেরিকায় বা আফ্রিকায় যে-ধরণের প্রতিবাদের কবিতা বিদীর্ণ হয়ে উঠবার কথা এখন, তিনি খুঁজছিলেন সেইটে৷ আর এই কাজে প্রচুর সন্ধানের পর তিনি নির্বাচন করে নিয়েছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা––সমস্তরকম লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে আর্তনাদ যেমন লাভাস্রোতে বেরিয়ে আসে ওঁর রচনায়, সেটা মুগ্ধ করেছিল তাঁকে৷ প্রতিবাদের এই প্রত্যক্ষতাতেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষতম কবিতার পরিচয়, এইখানেই তাঁর কবিতার সঙ্গে একাত্মবোধ করেন তাঁর আজকের দিনের পাঠক৷
কিন্তু আমরা, যাঁরা অনেকদিন ধরে তাঁর কবিতা পড়ছি, আমাদের তখন অন্য একটা ভাবনাও এসে পড়ে মনে৷ অনেকদিন আগে যখন তিনি জেগে উঠেছিলেন যেন জীবনানন্দের ভূমি থেকে, তার চেয়ে এখনকার জগৎ কি তবে সরে এসেছে একেবারে? পূর্বাশা-র পৃষ্ঠায় যখন তিনি লিখছিলেন “ক্লান্তি ক্লান্তি”র মতো কবিতা, ‘এমন ঘুমের মতো নেশা’ কিংবা ‘এমন মৃত্যুর মতো মিতা’কে এড়িয়ে জীবন চান না বলে জানাচ্ছিলেন যখন, একাধিক কবিতায় যিনি দেখছিলেন ‘শরবতের মতো সেই স্তন’ তাঁর কবিতায় তখন সদর্থেই একটা প্রচ্ছন্ন আবহ ছিল জীবনানন্দের৷ এটা হতেই পারে যে আজ দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অভ্যাসে তিনি অল্পে অল্পে––কিংবা হঠাৎই একদিন––একেবারে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন সেই আবহ থেকে, মৃত্যুর থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন ক্ষুধার্ত জীবনের দিকে৷ এটা হতেই পারে যে তাঁর কবিতা এখন আর আলোছায়ার কোনো প্রদোষ রাখবে না কবিতায়, হয়ে উঠবে স্পষ্ট এবং রূঢ়, সাময়িকতার প্রয়োজনে অত্যন্ত নির্মমরূপে বাস্তবিক ––ঘোষিত এবং দলীয়৷
তবু, এইটেই কি তাঁর সব পরিচয়? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা লক্ষ করে পড়লে দেখা যাবে যে তাঁর এই মুহূর্তের রচনায় বিষাক্ত ধিককারের সঙ্গে সঙ্গে রয়ে গেছে এক প্রগাঢ় কোমলতা৷ এই অর্থে, মনে হয়, তাঁর অতীত তাঁকে ছেড়ে যায়নি পুরো, বরং কবিতার ভিতরকার পর্দায় সেটা এক মস্ত সামর্থ্য এনে দিচ্ছে৷ প্রথম যৌবনে যে স্বপ্নমদির জগৎ তিনি দেখছিলেন তা আর প্রত্যক্ষে এখন কথা বলে না সত্যি, কিন্তু দেশে দেশে কালে কালে ‘প্রবাহিত মনুষ্যত্ব’র প্রতি তাঁর অটুট ভালোবাসা একটা মমতাময় ধমনী রেখে দেয় তাঁর কবিতার অন্তরালে৷ তখন, এ-রকমই অভিমান আর ক্রোধে মিশে গিয়ে তৈরি হয়ে ওঠে তাঁর ছোটো এক-একটি কবিতা
নাচো হার্লেমের কন্যা, নরকের উর্বশী আমার
বিস্ফারিত স্তনচূড়া, নগ্ন উরু, …লিতবসনা
মাতলামোর সভা আনো, চারদিকের নিরানন্দ হতাশায়,
হীন অপমানে
নাচো ঘৃণ্য নিগ্রো নাম মুছে দিতে মাতলামোর জাত নেই,
পৃথিবীর সব বেশ্যা সমান রূপসী৷
নাচো রে রঙ্গিলা, রক্তে এক করতে স্বর্গ ও হার্লেম৷
যেমন আমাদের অভিজ্ঞতারও আছে দিন আর রাত্রি, যেমন দিনের অনেক রৌরব আমরা মুছে নিই রাত্রিবেলার নির্জন আত্মক্ষালনে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিণত কবিতাতেও তেমনি আমরা দেখতে পাব সেই দুই ছায়াপাত৷ সামাজিক যে-কোনো ঢেউয়ের আঘাতে কেঁপে ওঠেন এই কবি, বিবেচনার কোনো সময় পাবার আগেই ঝাঁপ দিয়ে পড়েন স্রোতে, ভেঙে ফেলতে চান সব ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান––কারোই মুক্তি নেই তাঁর সর্বনাশা রোষ থেকে৷ কিন্তু এইসব ভয়ংকর মুহূর্তেও তিনি হঠাৎ এক-একবার এসে দাঁড়াতে পারেন সেই ঘুমন্ত সীমায়
ভুবনেশ্বরী যখন শরীর থেকে
একে একে তার রূপের অলংকার
খুলে ফেলে, আর গভীর রাত্রি নামে
তিন ভুবনকে ঢেকে
এই হলো তাঁর কবিতার রাত্রি, এইটেই তাঁর কবিতার আত্মস্থ অবকাশ, এইখানে তাঁর কবিতার পলিমাটি৷ এই পলি আছে বলেই তার উপর জেগে ওঠা সমস্ত দিনের শস্য একটা স্বতন্ত্র আলো পেয়ে যায়, হয়ে ওঠে সমকালীন অন্যান্য চিৎকৃত বিক্ষোভের চেয়ে অনেক স্বতন্ত্র৷ তাঁরও আছে চিৎকার, কিন্তু অনায়াস সত্য থেকে উঠে আসে বলে তাঁর সেই চিৎকারে প্রায়ই লিপ্ত থাকে একটা মন্ত্রের স্বাদ
অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা৷
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা,
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা৷
অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার
অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওংকার
সে অন্নে যে বিষ দেয়, কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে৷
এই কবিতা একটা সমগ্র ক্ষুৎকাতর যুগের জাতীয় স্লোগান হয়ে উঠবার যোগ্য৷
এটা ঠিক যে এই কবিতাটিতে, কিংবা এ-পর্যন্ত উদ্ধৃত তিনটি রচনাতেই তাঁর শিল্পসুমিতির যে ধরণ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষ পর্যায়ের কবিতার সেইটেই সাধারণ লক্ষণ নয়৷ তাঁর কবিতা অসমান, অনেকসময়েই তাঁর কবিতা বরং তুলে নিয়ে আসে ঈষৎ ভাঙা চলন, যার ছন্দে ছবিতে শব্দের ব্যবহারে হঠাৎ কখনো মনে হতে পারে যে অশুদ্ধ হলো সুর৷ কিন্তু সেইটেই যেন তাঁর আনন্দ, যেন কিউবার কবি নিকোলাস গ্যিয়েন-এর মতো তিনিও আজ বলে উঠতে পারেন নিজেকে অশুচি বলেই ঘোষণা করছি আমি৷ এই কবিও একদিন ‘নিজের মধ্যে নিহিত থেকে অর্কেস্ট্রা বাজানো’র ভঙ্গি জানছিলেন, যুক্ত ছিলেন তাঁর ভাষার মডার্নিজম-এর আন্দোলনে আর তার থেকে আজ বেরিয়ে এসে এখন তিনি চার পাশে দেখতে পান এক বিশাল চিড়িয়াখানা৷ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও আজ তাঁর ছোটো ছোটো বইগুলির মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন আমাদের আক্রমণকারী সমকালীন ভণ্ড পৃথিবী, আর তাই মুণ্ডহীন ধড়্গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে বা বাহবা সময় তোর সার্কাসের খেলা এইসব হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা-বইয়ের নাম৷ এর অন্তর্গত কবিতাগুলি পড়তে পড়তে কোনো পাঠকের মনে হতে পারে যেন তিনি হেঁটে চলেছেন ধান-কেটে-নেওয়া কোনো জমির ওপর দিয়ে, থেকে-থেকে কাঁটা বেঁধে পায়ে, পিঠে এসে লাগে রোদ্দুরের ফলা সেখানে নেই কোনো সমতল মসৃণতা বা শিল্পসুষমার কোনো সচেতন আয়োজন৷ এর অন্তর্গত কবিতাগুলি পড়তে পড়তে পাঠক কেবলই ঘূর্ণির মতো ঘুরতে থাকবেন এই পাঁচ-দশ বছরের কলকাতার গ্লানিময় ইতিবৃত্তে, সমস্ত ভারতবর্ষের নিরন্তন পচন-লাঞ্ছনায়৷ আর সেই পটভূমি মনে রাখলে এই অসমান ঊষর আঘাতময় শিল্পধরণকে মনে হয় অনিবার্য, অনিবার্য মনে হয় এর আপাতশিল্পহীনতা৷ আপাত, কিন্তু সম্পূর্ণত নয় কেননা অনেকদিনের কাব্যময়তাকে যিনি রেখে দিয়েছেন তাঁর ভিতরে, আজ এই স্পষ্ট ভর্ৎসনার উচ্চারণের সময়েও তাঁর ভাষা হয়ে ওঠে এ-রকম ‘আকাশের দিকে আমি উলটো করে ছুঁড়ে দিই কাঁচের গেলাস’ অথবা ‘ব্রাহ্মমুহূর্তে কারা ছায়ার মতো ছেড়ে গেছে ঘর’ কিংবা ‘কলকাতার ফুটপাথে রাত কাটায় এক লক্ষ উন্মাদ হ্যামলেট/তাদের জননী জন্মভূমি এক উলঙ্গ পশুর সঙ্গে করে সহবাস’ আর ‘আমাদের সন্তানের মুণ্ডহীন ধড়গুলি তোমার কল্যাণে ঘোর লোহিত পাহাড়৷’ তখন বুঝতে পারি কবির যোগ্য সমস্ত ইন্দ্রিয় তাঁর ভিতরে কাজ করে যায় কীরকম সন্তর্পণে, বুঝতে পারি কোথায় আছে পুরোনো সেই কবির সঙ্গে আজকের কবির নিবিড় কোনো যোগ৷