ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প
- শহীদুল জহির
বই আলোচনা: নায়লা নাজনীন (পরিচালক ‘বইয়ের হাট’)
জাদুবাস্তবতাকে অনেকে গোলমেলে মনে করেন। জাদুবাস্তবতাবাদে উনি ওস্তাদ যিনি বাস্তবকে করে তোলেন অবাস্তব। আরও ভালোভাবে বললে বলতে হয়, অবাস্তব কে করে তোলেন প্রচন্ড রকমের বাস্তব।
বাংলা সাহিত্যজগতের ব্যতিক্রমী স্রষ্টা শহীদুল জহির অকালপ্রয়াত। বিগত শতাব্দী সত্তরের দশকে সৃজনশীল সাহিত্য অঙ্গনে তার আগমন ঘটেছিল। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশােনা করছিলেন। তাঁর সাহিত্য-সৃষ্টি আমৃত্যু (২০০৮) বহমান ছিল। তাঁর সৃষ্টির পরিমাণগত দিক খুব বেশি না হলেও গুণগত দিক অসাধারণ । অসাধারণত্বের বিষয়টি নানা দিক থেকে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ঘটনার বহুরৈখিক বর্ণনা, বুননশৈলী, শেকড়স্পর্শী অনুসন্ধান, প্রতিটি বিষয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে উপলব্ধিপূর্বক তা সুসংগঠিত করা, পূর্ণাঙ্গতা- এ সবই তাঁর সৃষ্টিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
ঔপন্যাসিক ও গল্পকার শহীদুল জহির (১৯৫৩ - ২০০৮) বাংলা সাহিত্য জগতের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ধারার স্রষ্টা। তথাকথিত জনপ্রিয় লেখক তিনি ছিলেন না। অত্যন্ত যত্নশীল ভাবে লেখালেখিতে জনচিত্ত জয় করার মত হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপন ভঙ্গী পরিহার করে তিনি উজ্জ্বল ছিলেন স্বমহিমায়। নিরাসক্ত সংলাপ, ঘটনার বহুরৈখিক বর্ণনা, শেকড়স্পর্শী অনুসন্ধান, সুক্ষ্ম বুননশৈলি, দারুণ বৈচিত্রময় ভাষার ব্যবহার যা একই সাথে জটিল এবং আকর্ষক, তাঁর সৃষ্টিকে দিয়েছে এক আলাদা উচ্চতা। তাঁর রচনার শ্লেষাত্মক কৌতুকাবহ বা অধিবাস্তব /পরাবাস্তব অনুভব পাঠককে হাজির করে এক গোলকধাঁধায়। গল্পের সমাপ্তির পরেও পাঠক আবর্তিত হতে থাকে সেই অদৃশ্য ধাঁধাঁয়।
'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যন্য গল্প' বইটিতে মোট ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের সাতটি গল্প রয়েছে। গল্পগুলোর বুননে রয়েছে প্রেম বা প্রেমের সন্ধান, আছে জীবনের আখ্যান নয়ত মরণের খেরোখাতা, আনন্দ, পীড়ন ও পতনের বিস্বাদ, বা হয়ত আছে কিছুই না থাকার মাধুরী, আছে আমাদের পার্থিব জীবনের বাস্তবতা। লেখকের অসাধারণ এবং তুলনারহিত প্রকাশভঙ্গি গল্পগুলোকে দিয়েছে অভিনবত্ব, একটি বিশেষ মাত্রা।
'ডলু নদীর হাওয়া' গল্পে মগবালিকা সমর্তবানু ওরফে এলাচিং এর রুপে মুগ্ধ, প্রেমে পাগল তৈমুর আলী একটি উদ্ভট শর্ত মেনে তাকে বিয়ে করে। সমর্তবানুর শর্ত থাকে যে, সে বিয়ের পর তৈমুর কে বিষ (জহর) প্রয়োগে মারবে। এবং এটা যে শুধু কথার কথা নয় তা সে বিয়ের রাতেই প্রমাণ করে। দুটো বিড়াল কে পায়েস খেতে দিলে তার মধ্যে একটি বিড়াল মারা যায়। (অর্থাৎ যে বাটিতে বিষ মেশানো ছিলো)। প্রথমে ততটা গুরুত্ব না দিলেও পরে জেদের বশেই হোক বা ঠান্ডা মাথায়ই হোক তৈমুর এই 'খেলাটি' মেনে নেয়।
সমর্তবানু প্রতিদিন তাকে নাস্তার পাতে দুটো পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়, যার একটিতে থাকে বিষ মেশানো পানি এবং অন্যটিতে বিশুদ্ধ পানি। চল্লিশ বছর ধরে এই ভয়ংকর খেলাটি চলতে থাকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এবং তৈমুর আলী প্রতিদিনই নির্ভুলভাবে বিশুদ্ধ পানির গ্লাসটিই তুলে নেয়।