অনলাইন যোগাযোগের যুগান্তকারী পরিবর্তনে বইয়ের প্রসার বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পাঠযজ্ঞে বাংলা বই যেন ব্রাত্য। একদল বাংলা বইপ্রেমী অনলাইন বাংলা বই পঠন-পাঠনে বিপ্লব সাধন করেছে। ২০১২ সালে ‘বইয়ের হাট’-এর যাত্রা শুরু। আজ সারা বিশ্বে ১২০,০০০ বইপ্রেমী এর সদস্য। ৬০,০০০-এর বেশি বই অনলাইনে। সেই চমকপ্রদ গল্প শুনুন অন্যতম পরিচালক এমরান হোসেন রাসেল-এর কাছে।
বইয়ের হাট
আমরা বলি ‘বই পড়লেই মানুষ মননশীল হয়।’ বলা উচিৎ ‘মননশীল বই পড়লে মানুষ মননশীল হতে পারে’। বইয়ের হাট হলো এমনই মননশীল বইয়ের আধার। শুধুমাত্র বাংলায় মননশীল বইয়ের আধার।
আজ মানুষ কংক্রিটময় পৃথিবীতে যান্ত্রিকতা, হিংসা, ঈর্ষায়, স্বার্থপরতায় কাতর, জীবন-দর্শন এখন স্বার্থ আর ধর্ষণে, সাম্রাজ্যবাদ রাষ্ট্রীয় আঙ্গিনা পেরিয়ে গ্রাম্য কুটিরে, ধর্মগুলো আত্মোন্নয়নের খোলস ছেড়ে অপরাধের বর্ম — তখন মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচতে হলে মননশীল হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
যখন রাষ্ট্রনায়কের হীন স্বার্থে ফরমায়েশি অছিয়তনামা হয় ইতিহাস, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে বলা হয় উন্নয়ন, কোমলমতি শিশু-কিশোরদের কলহাস্য-কৈশোর ধর্মীয় উন্মাদনায় বা টিকে থাকার অসম প্রতিযোগিতায় ধ্বংস হয়, প্রকৃতির উদার উপহার সবুজ বনানি কেটে তৈরী হয় পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ঘরের বাইরে বের হলে ঘরে-ফেরা অনিশ্চিত— তখন মানুষকে মানবিক হতে হলে মননশীল হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
সাহিত্য মানুষকে ভেতর থেকে গড়ে তোলে, এটাই সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য; মানব মনের ভেতরে প্রণোদনার সৃষ্টি করে। ‘সবকিছুর পরেও যে জীবন অমূল্য জিনিস’— এই বোধ জন্মাতে, জন্মানো বোধে শান দিতেই সাহিত্য।
জগতের ছড়িয়ে থাকা ইন্টারনেট-সেবী বাঙালি আর ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা বাংলা বইয়ের মেলবন্ধন বইয়ের হাট। সাহিত্য নিয়েই বইয়ের হাট-এর যাবতীয় কর্মকাণ্ড; নির্দিষ্ট করে বললে ভিন্ন-ভাষার সাহিত্য বাংলায় অনূদিত এবং বাংলা-সাহিত্যের আধারই বইয়ের হাট। সাহিত্য বুঝতে হলে বিজ্ঞান, অংক, দর্শন, সংগীত, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, পুরাণ, মিথের উপযোগিতা অপরিহার্য, বইয়ের হাট-এ এসব বিষয়ভিত্তিক বইয়ের চর্চা হলেও সাহিত্যই প্রধান। মূলত বই দেওয়া-নেওয়া দিয়ে শুরু হলেও, বইয়ের হাট এখন সাহিত্য-নির্ভর আরও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত।
ফেসবুকে বাংলা-ভাষী সাহিত্যপ্রেমীদের গ্রুপরূপে বইয়ের হাট-এর পথ চলা শুরু। ২০১২ সালের ২৮সেপ্টেম্বর রিটন খানের হাতে বইয়ের হাট ফেসবুক গ্রুপটির সৃষ্টি। গ্রুপ তৈরি হলো বটে কিন্তু তেমন একটা সক্রিয় হলোনা। ২০১৫ সালের জানুয়ারির দিকে আমার সাধারণ সদস্য হিসেবে বইয়ের হাটে যুক্ত হওয়া। তখন মাত্র ১,০০০ কি ১,২০০ সদস্য নিয়ে গ্রুপ, পরিচালকদের মধ্যে রিটন খান ছাড়া তেমন কেউ সক্রিয় ছিলেন বলে মনে করতে পারি না। সম্ভবত ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে রিটন খান ছাড়া আগের সব পরিচালক পরিবর্তন হয়ে পল্লব সরকার (ফেসবুকে ‘শিশির শুভ্র’ নামে পরিচিত)-কে নিয়ে নব কলেবরে পরিচালনা পর্ষদ গঠন হয়। শিশিরকে প্রচুর পরিশ্রম করতে দেখেছি। তার কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়েছে ছেলেটির সারাদিনের একমাত্র কাজ গ্রুপ চালানো, এর বাইরে অন্য কোন কাজ নেই। গ্রুপে সদস্য ক্রমে বাড়তে লাগল। ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক পছন্দ না, কিন্তু এই বইয়ের হাটের নেশায় প্রথম প্রথম দিনে দশ-পনের মিনিটের জন্য এক-আধবার, পরে দিনে দু’তিন ঘন্টা কেটে যেতে লাগল। নতুন নতুন বন্ধু হলো। বইয়ের আদান-প্রদানের সাথে সাথে, বিচিত্র অথচ মনোগ্রাহী সব তথ্যের কারণে অবসর পাওয়া মাত্রই বইয়ের হাট-এ চলে আসি। অনেক নতুন লেখকের লেখার সাথে পরিচিত হতে থাকি; অল্প-সল্প পড়া অনেক লেখককে বিস্তারিত জানতে, তাঁদের লেখা পড়তে বইয়ের হাট সুযোগ করে দিতে থাকে। যেখানে ২০১৫ সনের জানুয়ারীতে প্রতি পোস্টে সদস্যদের সক্রিয়তা অতি নগণ্য, সেখানে ২০১৫ সনের মাঝামাঝি গিয়ে সক্রিয়তা বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট দেখা গেল।
সম্ভবত ২০১৫ সনের আগস্ট মাসে কোন একদিন— তখন গ্রুপে সদস্য সংখ্যা বড়জোর দু’হাজার কি দু’হাজার দু-একশ’; সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ফেসবুক মেসেঞ্জারে রিটন খানের নোটিফিকেশন: ‘আপনাকে বইয়ের হাট গ্রুপে এ্যাডমিন করতে চাই, আপত্তি থাকলে জানান’ এবং এর পরের নোটিফিকেশনটাই এ্যডমিন হয়ে যাওয়ার । ততদিন গ্রুপটাকে বেশ ভালোবেসে ফেলেছি, গ্রুপের বহু বন্ধু-বান্ধবের (ফেসবুক-বন্ধু) সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি—সবই বই সম্পর্কিত নানান বিষয়ে। গ্রুপে ঢুকে দেখলাম আমার মত আরো দু’জন নতুন পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে। একজন মলয় দেবনাথ, অন্যজন মালিহা নাজরানা। কীভাবে গ্রুপ চালাতে হয়, সদস্য নির্বাচন কীভাবে করতে হয়, পোস্টগুলো অনুমোদন দেওয়ার ভিত্তিই বা কি — কিছুই জানি না। তখনই যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। সে রাতেই সবার সাথে মেসেঞ্জারে পরিচয় ও আলাপ হলো— ধীরে ধীরে সবকিছুই জানা হয়ে গেল, বলা যায় বইয়ের হাটের আসক্ত হয়ে গেলাম।
চলছে বইয়ের হাট, দিনরাত ২৪ ঘন্টা, সপ্তাহে ৭ দিন। মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত এই স্থানটি বহু মানুষের বাঁচার প্রেরণা, নিজেকে জানা-বোঝার পীঠস্থান, জ্ঞানার্জনের পাঠশালা, মুক্তালোচনার আনন্দ-নিকেতন।
অল্পকিছু দিন হলো চার নতুনমুখ বইয়ের হাটের পরিচালক নিযুক্ত হয়েছেন: সুমন বিশ্বাস, নায়লা নাজনীন, মধুমন্তী সাহা আর দিব্যজ্যোতি চক্রবর্তী। আচ্ছা, একটি কথা বলতে ভুলেই গেছি — গ্রুপের সব কর্মকাণ্ডই বাংলা-সাহিত্যকে ভালোবেসে আর স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে। গ্রুপ আজ এক লক্ষ বাইশ/তেইশ হাজার বাঙালির প্রাণের স্থান, যেখানে প্রতিদিন গড়ে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার বাঙালি পদচিহ্ন রাখেন; কোন কোন দিন আরো বেশি। এই কর্মযজ্ঞে প্রত্যেক পরিচালক তাঁর দৈনন্দিন জীবন থেকে সময় বের করে হাসিমুখে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে গ্রুপকে সচল রাখতে সহায়তা করে যাচ্ছেন। এই মহতী কর্মকাণ্ডে আরেক জন নিরলস, হাসিমুখ আর প্রাণবন্ত মানুষ আছেন, যিনি পরিচালকমণ্ডল’র বাইরে থেকেও গ্রুপকে সন্তানের মতভালোবাসেন, তিনি আশফাক স্বপন। তাঁর স্বেচ্ছাশ্রম আর বৌদ্ধিক ভাবনা গ্রুপের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বিস্তারে প্রভূত সাহায্য করেছে।
২০১৬ সাল — গ্রুপে তখনও প্রতিদিন বই আদান-প্রদানই প্রধান আর একমাত্র কাজ। সাধারণ সদস্য থাকা অবস্থায় অনেককেই রোমান হরফে বাংলায় মন্তব্য করতে, পোস্ট করতে দেখেছি। অথচ বইয়ের হাট বাংলা বইপ্রেমী একটি গ্রুপ, যেখানে সবার বাংলা বই নিয়েই যত সব কার্যক্রম সেখানের অবস্থাটি এমন— কেমন যেন খাপছাড়া মনে হয়। সদস্যদের বাংলা বর্ণে লেখার অনুরোধ করা শুরু করলাম; এই কাজে অনেকেই সহমত হলেন, তাঁদের মধ্যে একজন সদস্য— ‘বন্দন কুমার বড়ুয়া’ অন্য সবার চেয়ে সক্রিয় হয়ে এগিয়ে এলেন। কীভাবে কম্পিউটারে/মোবাইলে বাংলা লিখতে হয় তিনি এমন একটি ডক তৈরি করলেন। শুধু তাই না। তিনি প্রায় পোস্টে গিয়ে বেহায়ার মতো যাঁরাই রোমান হরফে বাংলায় পোস্ট বা মন্তব্য করেন তাদের বাংলা বর্ণে ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করা শুরু করে দিলেন, এতে অনেকেই কম্পিউটারে/মোবাইলে বাংলা বর্ণ লেখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন। কাজ হলো বটে— সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়; বাংলা টাইপ করা তো শুরু হলো কিন্তু অনেকেই যুক্তবর্ণের ব্যবহার জানেন না বা ভুলে গেছেন। হায়াৎ মামুদ মহাশয়ের বহুল চর্চিত ‘বাংলা লেখার নিয়মকানুন’ বইটি থেকে যুক্তবর্ণের ব্যবহার, কোন কোন বর্ণ মিলে কোন যুক্তবর্ণ হয় ইত্যাদি গ্রুপে প্রতিদিন একটি করে পোস্ট দিয়ে গেলে অনেকেরই বাংলা টাইপে স্বচ্ছন্দ ও অভ্যস্ত হয়ে পড়েন । একটা সময় এমন দাঁড়াল যে, গ্রুপের সদস্যরা বাংলা ভিন্ন অন্য বর্ণ বা হরফে মন্তব্য করা ছেড়ে দিলেন। এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো বইয়ের হাট শুধুমাত্র বাংলা বই আদান-প্রদানের ছাড়াও ভিন্ন কিছু করার প্রয়াস পায়।
এতক্ষণ নিজের সম্পৃক্ততার কথাই বললাম; এখন বইয়ের হাটের কিছু কর্মকাণ্ডের কথা বলি। তখনও গ্রুপে বই দেওয়া-নেওয়াই প্রধান কাজ। ২০১৭ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে বইমেলায় বইয়ের হাটের কিছু সদস্য নিয়ে পরিচালকদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে একত্র হওয়ার চেষ্টা করি। অনেকই আসবেন জানালেও, শেষে আগ্রহীদের উপস্থিতির সংখ্যা নগণ্য। তবে যে কয়জন বন্ধু এসেছিলেন প্রাণ খুলে মত বিনিময় হয়েছে; প্রত্যেকের চোখ-মুখে বইয়ের হাটের ভালোবাসার উচ্ছ্বাস ঠিকরে পড়ছিল। মিলনটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাসে বসে সামান্য কফি পানে উদ্যাপিত হলেও, একটি বার্তা নিয়ে এলো— এখন আমাদের ইন্টারনেটের বায়বীয় জগৎ থেকে বেরিয়ে বাস্তব জগতে কিছু করতে হবে।
এই ভাবনাটি বাস্তবায়ন করতে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ নিতেই প্রায় দেড়-দু’বছর অপেক্ষা করতে হয়। মাঝে আমরা একটি সাহিত্য-মনোভাবাপন্ন সংগঠনের সাথে মিলে কাজ করতে গিয়ে সেখানে সময় ব্যয় করে ফেলি। তবে সেই সময়ে কিছুই যে হয়নি এমন নয়— লেখক স্বত্ব নেই এমন প্রচুর বইয়ের ই-পাব করা হয়েছে; শিশু-কিশোরদের কথা ভেবে ‘শিশু-কিশোর ডট অরগ’ নামে একটি ওয়েবসাইট করা হয়েছে, সেখানে প্রচুর বাংলা শিশু-সাহিত্যের সাথে ভিন্ন ভাষার শিশু-সাহিত্যের বঙ্গানুবাদও আছে; ‘ই-বাংলাসাহিত্য ডট কম’ নামে ক্লাসিক বাংলা-সাহিত্যের ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের সুপণ্ডিত অধ্যাপক ড. আজফার হোসেনের বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার বইয়ের হাট-এর ব্যানারে নেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে সাংবাদিক, প্রবন্ধকার ও কবি জ্যোতির্ময় দত্ত এক বৈঠকী-আলাপে বইয়ের হাটকে ভালোবেসে বলেন — ‘কিচ্ছু না জেনে কম্পিউটারে দু’চারটি বোতাম টিপলেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাচলী; রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী; কত অখ্যাত লোকের লেখা; যেসব বই শুধু দূরে থেকে বাঁশি শুনেছি, নাম জেনেছি; তারা এখন আমার ইঙ্গিতে শরীর পাচ্ছেন। এই যুগের সূচনায় আমি যে আছি তাতে সৌভাগ্যবান মনে করি। ...’
আমাদের সফলতার মুকুটে এটি একটি মূল্যবান পালক বলে বইয়ের হাট সশ্রদ্ধচিত্তে মনে করে।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা বইমেলা — বইয়ের হাটের জন্য একটি পয়মন্ত কাল। ওয়েবজিন ‘গল্পপাঠ’ সহযোগী ‘গুরুচন্ডা৯’-কে নিয়ে নির্বাচিত গল্পসংকলন ১ম ও ২য় খণ্ড বের করে। গল্পসংকলনের ২য় খণ্ডটি বইয়ের হাটের পরিচালকদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। অনলাইনে বাংলা-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার মতো কাজে অবদান রাখায় বইয়ের হাটকে এই সম্মাননায় ভূষিত করা হয় এবং মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বইয়ের হাটকে আমন্ত্রণ জানান হয়। বইয়ের হাটের পক্ষ থেকে রিটন খান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সাহিত্যিক পরিবার থেকেও বইয়ের হাট সম্মানিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় কবি ও কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় বইয়ের হাটের কর্মকাণ্ড এবং বাংলা সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় মুগ্ধ হন এবং বইয়ের হাটকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আনন্দ পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশ ব্যতিত অন্যান্য কিছু বইয়ের বৈদ্যুতিন সংস্করণের অনুমতি প্রদান করেন।
২০১৮ সালের ৭ই জানুয়ারি বুদ্ধদেব বসুর কন্যা মিনাক্ষী দত্ত বইয়ের হাটকে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির দৈনিক ‘আজকাল’-এর মাধ্যমে অভিনন্দন জানান। তিনি বইয়ের হাটের জন্মপূর্ব ইতিহাস সবিস্তারে প্রকাশ করেন, বইয়ের হাটের সংগ্রহকে বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন গ্রন্থাগারের সাথে তুলনা করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা বিশ্ববাসীর জন্য মূল্যবান ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উন্মুক্ত করার কাজে নিয়োজিত ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’-এর সাথে প্রথম থেকেই বইয়ের হাট যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক বইয়ের সরবরাহ, স্ক্যান করার মতো কঠিন কাজগুলো করে গেছে। তাঁদের বিভিন্ন লেখা, সাক্ষাৎকার এবং মুক্তিযুদ্ধের বইগুলো বইয়ের হাটের সদস্যদের সাথে ভাগাভাগি করে বইয়ের হাট মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে।
এভাবে বইয়ের হাট তার নিজের ছন্দে চলতে থাকল, একসময় দেখলাম অনেক স্বনামধন্য লেখক/কবি/নাট্যকার/প্রাবন্ধিক/অন-লাইন ব্লগার/চলচ্চিত্র পরিচালক/বিভিন্ন সাহিত্য-সংগঠক/ প্রকাশক/প্রচ্ছদ শিল্পীর পদচারণা; এদের অনেকেই গ্রুপে সক্রিয়, অনেকে আবার নিষ্ক্রিয়। সক্রিয়রা মাঝে মাঝে তাঁদের পোস্ট, মতামত দিয়ে আমাদের প্রভূত সমৃদ্ধ করেছেন, আমাদের ভুল-ভ্রান্তি দেখিয়েছেন এবং মানুষের হৃদদ্বারে বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছানোর সহজ-সঠিক পথটি বাৎলে দিয়েছেন।
বইয়ের হাট ২০১৮ সালের ২৪শে মার্চে আটলান্টার জর্জিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের ওপর ‘কাজী নজরুল ইসলামের শিল্পসৃষ্টি: বৈচিত্র্য ও আন্তর্জাতিকতা’ শীর্ষক দিনব্যাপী এক কর্মশালা অনুষ্ঠান করে, সহযোগিতায় ছিল জর্জিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। সমস্ত দিন প্রাণচঞ্চল কর্মশালার প্রাণপুরুষ ছিলেন মিশিগান লিবারেল স্টাডিজ ও ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজের অধ্যাপক ড. আজফার হোসেন। সকাল-বিকেল দু’ভাগে অনুষ্ঠিত এই কর্মশালাটির উত্কর্ষ ঠিক রাখতে মোট দশজনের অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। আমেরিকার বিভিন্ন বাংলা পত্র-পত্রিকায় কর্মশালার খবরটি প্রচারিত হয়। সেই বিবেচনায় একে একে কর্মশালার ভিডিও, পাঠ্য-প্রবন্ধ সবার জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে ।
২০১৮ সনের মার্চ মাসেই পশ্চিমবঙ্গের লিটল ম্যাগাজিনের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র আতিথেয়তায় গ্রহণ করে বইয়ের হাটকে সম্মানিত করেন। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি সাহিত্য, ভারত-বিভাজন, দু’বাংলার সাহিত্যিক সম্পর্ক, নিজের লেখা এবং পাঠক সম্পর্কে অনেক কথাই আলোচনা করেন। বইয়ের হাটের লেখক যশোপ্রার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন: ‘...উপদেশ দেওয়ার অধিকার তো আমার কিছু নেই, আমার যেটা মনে হয় যে, লেখাটা একটা সাধনার জায়গা। একজন লেখককে নিজেকে তৈরী করতে হয়, প্রচুর পড়তে হয়, বারবার লিখতে হয়। আগে যখন আমরা প্রথম বয়সে একটা লেখা কতবার করে লিখেছি, লিখে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি, লেখা ফেরত এসেছে, আবার লিখেছি দাঁতে দাঁত চেঁপে। এই সমস্ত করেই লেখক হয়।’
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক নিয়ে বাঙালি সমাজ এবং বাঙালি লেখক সমাজে আগ্রহ সবসময়ই ছিল; এ বিষয়ে বাদ-বিবাদের কোন রকম কমতি ছিল না, এখনও নেই। বইয়ের হাট আলোচ্য বিষয়ে সুমিত্রা দত্তের লেখা পাঠকপ্রিয় বই ‘নতুন বৌঠান, রবীন্দ্রজীবন ও মননে’ নিয়ে আলোচনার আয়োজন করে। বৈঠকে বইটির লেখক সুমিত্রা দত্তের মেয়ে শুভশ্রী নন্দী (রাই)— রবীন্দ্রনাথ, কাদম্বরী দেবী, উভয়ের সম্পর্ক, এ বিষয়ে বিভিন্ন লেখকের মনোভাব এবং তাঁর মা অর্থাৎ লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন। বাংলা সাহিত্যের এমন গুরুতর বিষয়ের আলোচনায় বইয়ের হাট সবসময় এগিয়ে আসতে আগ্রহী । আমাদের এসব আলোচনা আমরা ইন্টারনেটে তুলে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছি, আর অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক সাড়া পাচ্ছি।
বাংলা বইয়ের এই আধারের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৬০,০০০ (ষাট হাজার)-এর মতো বই আছে, গ্রুপের সদস্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াসে আজ বইয়ের সংগ্রহ এই পরিমাণ। বেশির ভাগ বইয়ের লেখকস্বত্ব বা কপিরাইট আজ আর নেই, সংগ্রহের বিশাল একটি অংশ digital library of india থেকে পাওয়া। গ্রুপের সদস্য এমন অনেক লেখক তাঁর লেখা বই স্বপ্রণোদিত হয়েই গ্রুপে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, এমনও ঘটনা আছে যে, লেখক বাবা/মার বই তাঁর ছেলে-মেয়ে গ্রুপে বিনামূল্যে সবার জন্য পাঠোপযোগী করেছেন। ইন্টারনেটে সহজলভ্য বিভিন্ন জায়গা থেকে বাকি বইগুলোর সংস্থান হয়েছে।
এ নিয়েই চলছে বইয়ের হাট, দিনরাত ২৪ ঘন্টা, সপ্তাহে ৭ দিন। মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত এই স্থানটি বহু মানুষের বাঁচার প্রেরণা, নিজেকে জানা-বোঝার পীঠস্থান, জ্ঞানার্জনের পাঠশালা, মুক্তালোচনার আনন্দ-নিকেতন। মননশীল বই যে মানুষকে মানবিক করে তোলে, তার লক্ষণীয় উদাহরণ আজ বইয়ের হাট। বাঙালির ইতিহাসে এমন মননশীল ক্ষেত্র আরো বহু আগেই প্রয়োজন ছিল, যা বহু দেরিতে হলেও শুরু হয়েছে, শুরু হয়ে এখনও সুস্থ-স্বাভাবিক-ছন্দময় গতিতেই বেগবান রয়েছে। বইয়ের হাটের শুরুটা ইন্টারনেটের বায়বীয় জগতে হলেও, এখন বায়বীয় ও কঠিন বাস্তব উভয়ক্ষেত্রেই সমান গতিতে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। এ সবই সম্ভব হয়েছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলা-সাহিত্যপ্রেমী বাঙালির ভালোবাসায় আর তাঁদের আস্থায়। আমাদের এমন ক্ষুদ্র প্রয়াস একদিন প্রতিটি বাঙালিকে মননশীলরূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবার আগে উচ্চারিত হবে কিনা, সেই উত্তর ভাবীকালের গহ্বরেই থাকল।
এমরান হোসেন (রাসেল) -এর সম্পাদনায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভালোবাসা, প্রেম নয়’, বেলাল চৌধুরীর ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’ বৈদ্যুতিন সংস্করণ ও ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদারের আত্মজীবনী ‘প্রকাশিত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment