আটলান্টার জর্জিয়া টেক-এ নজরুলকে নিয়ে সারাদিনব্যাপী সাহিত্য ওয়ার্কশপ
অনুষ্ঠিত
আশফাক স্বপন
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি, কিন্তু এই বহুমুখী প্রতিভার
শিল্পকৃতির যথাযথ মূল্যায়ন বা সমাদর যে হয়নি, এই কথাটা স্পষ্ট হয়ে গেল ২৪ মার্চ
আটলান্টার জর্জিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সারাদিনব্যাপী সাহিত্য ওয়ার্কশপে।
ওয়ার্কশপের শিরোনাম: কাজী নজরুল ইসলামের
শিল্পসৃষ্টি: বৈচিত্র ও আন্তর্জাতিকতা। বক্তা মিশিগ্যান অঙ্গরাজ্যের গ্র্যাণ্ড
ভ্যালি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আজফার হোসেন। আয়োজক অনলাইন বইপ্রেমীর সংগঠন
বইয়ের হাট (boierhut.com/group) ও জর্জিয়া টেক বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন।
সকাল ও অপরাহ্ন মোট
দুটি দীর্ঘ আলোচনায় আজফারের বক্তব্য রাখেন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আন্তর্জাতিকতা, প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে
ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দেবার ঐতিহাসিক কৃতিত্ব, আরবী-ফারসী একাধিক ভাষার
ব্যুৎপত্তি ও বাংলা সাহিত্যে তার সূত্র ধরে তার নানান পরীক্ষা নীরিক্ষা – এসব
নানান বিষয়ে আলোচনা করলেন আজফার।
আজফার বলেন ‘বিদ্রোহী’
কবিতায় নিপীড়িত-শোষিত মানুষের প্রতি যে গভীর একাত্মতা ঘোষিত হয়েছে, সেটা উত্তরকালে
এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও অত্যাচারীর
শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে, তার মর্মবাণীকে অসামান্য কুশলতা ও
দৃঢ়তার সাথে ধারণ করেছে।
আজফার গভীর দুঃখ প্রকাশ করলেন, যথাসময় – এমনকি আজও –
নজরুলের সৃষ্টি ভালভাবে বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়নি বলে নজরুলের কবিতার গভীর
আন্তর্জাতিক প্রাসঙ্গিকতা থাকা সত্ত্বেও নজরুল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন না।
আজফার বললেন, যথাযথভাবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার পেলে এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা থাকতে
পারত চে গুয়েভারার বুকপকেটে, জেলখানায় ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিন-এর বালিশের পাশে
বা কেনিয়ার মাউ মাউ আন্দোলনের নেতে ডেডান কিমাথ-এর কণ্ঠস্বরে।
আজফার ইংরেজি
সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা সমাপ্ত করেন বহুবছর আগে। জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, এদেশে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্য স্নাতকোত্তর
পড়াশোনা করেন। ইংরেজি সাহিত্যে ডক্টরেট পাবার পর এদেশে অধ্যাপনার শুরু। বর্তমানে মিশিগান লিবারেল স্টাডিজ ও
ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ-এ অধ্যাপনা করছেন। দেশে থাকতে লেখকদের সাংগঠনিক
আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন, বাংলাদেশ লেখক শিবিরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক
ছিলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন, সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন।
নিজে প্রচণ্ড
দারিদ্রে বড় হয়েছেন বলেই প্রান্তিক মানুষের কষ্ট ও ক্ষোভটা বোঝেন, আর তাই নজরুলের
সত্ত্বার সাথে একাত্মতা অনুভব করেন – কারণ বাংলা সাহিত্যে শীর্ষস্থানীয়
সাহিত্যিকদের মধ্যে একমাত্র নজরুলই বৃহত্তর প্রান্তিক সমাজ থেকে উঠে এসেছেন।
মার্ক্সবাদী চিন্তায়
বিশ্বাসী আজফার ক্লাসে বললেন, বাংলা সাহিত্যে গত শতাব্দীর ৩০ দশকে যে
রবীন্দ্রনাথ-বিরোধী আধুনিকতার ঊন্মেষ, সেটা হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের ছত্রছায়ায়। এই
ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তাও-ভাবনাও দাসসুলভ মনোবৃত্তি থেকে মুক্ত হতে পারে না – একে
নজরুল অভিহিত করেছিলেন ‘গোলামী মন’ বলে। আজফার বললেন যেই পরিস্থিতি এই মানসিক
পরাধীনতার মনোবৃত্তির জন্ম দেয়, তাকে ক্যারিবীয় বিপ্লবী তাত্ত্বিক ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক
সন্ত্রাস’ নামে অভিহিত করেছিলেন। দেশে দেশে সাহিত্যের লেনদেনে আজফারের আপত্তি নেই,
তবে তিনি বললেন উপনিবেশবাদী ক্ষমতা-সম্পর্কপ্রসূত জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের ফলে
যখন জাতীয় সংস্কৃতি বিপন্ন হয় তখন প্রয়োজন হয় পালটা জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইয়ের।
আজফারের মতে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় নানান দেশের সংগ্রামী সাহিত্যিকরা যে
জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইয়ের বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন, তার বহু বহু বছর আগে নজরুল নিজে
পালটা জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইয়ে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন।
দীর্ঘ আলোচনার শেষ
পর্যায়ে অংশগ্রহণকারীদের সাথে চলে আজফারের অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক প্রশ্নোত্তর পর্ব।
নজরুলের ভাল অনুবাদ কোথায় পাওয়া যায় এই প্রশ্নটি এলো, কারণ এদেশে বড় হওয়া দ্বিতীয়
প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নজরুলের রচনা বাংলায় পড়ে তা বোঝার সম্ভাবনা কম।
মাত্র গোটা দশেক
অংশগ্রহণকারী থাকায় খুব নিবিড় পরিবেশে ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক বইয়ের হাট
অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা সীমিত রাখার পক্ষপাতী ছিল, ফলে অবশ্য কোর্সের ফি বেশ
উচ্চমূল্য রাখতে হয়।
আয়োজকরা
অংশগ্রহণকারীদের অকুণ্ঠ সাধুবাদ জানালেন। উচ্চ কোর্স ফি দিয়ে, সারাদিন ধরে সাহিত্য
ওয়ার্কশপে অংশ নিয়ে অংশগ্রহণকারীরা প্রমাণ করে দিলেন, এই দূরদেশে অসাধ্য সাধন
সম্ভব, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বাংলাভাষায় নিবিড়ভাবে বিদ্যায়তনের ধরণে
সাহিত্য-বিষয়ক কর্মশালা আয়োজন সম্ভব।
বইয়ের হাটের আয়োজকরা
জানালেন, সংগঠনের উদ্দেশ্য বাংলা ভাষায় বিদ্যার্জন অবারিত করে দেওয়া, এবং সেই কথা
মনে রেখেই কর্মশালার ভিডিও, পাঠ্য প্রবন্ধ, ইত্যাদি সব অনলাইনে তুলে দেবার কাজ
চলছে।
No comments:
Post a Comment