আমাদের নজরুল ও গর্জে-ওঠা ত্রিমহাদেশীয় কাব্যতত্ত্ব
আজফার হোসেন
তার কবিতা পড়া মানেই উদীপ্ত হওয়া
—নেতাজী সুভাষ বসু
যে সময়ে নজরুল ইসলাম লিখছিলেন — অর্থাৎ গত শতকে বিশের দশক থেকে চল্লিশের
দশকের গোড়া পর্যন্ত — তখন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রবিরোধিতা প্রায় অভ্যেসে পরিণত
হচ্ছিল। তিরিশের দশকের কবিরা আধুনিকতাবাদের দোহাই পেড়ে ভিনদেশি নন্দনতত্ত্বের
উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা ভূতের খপ্পরে পড়ে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই
সাহিত্যের একটা নতুন যুগ তৈরি করার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। আমরা তখন লক্ষ্ করলাম বোদলেয়ার-পাউন্ড-এলিয়ট-লরেন্সের
নাগরিক ও নান্দনিক জ্ঞানভাষ্যকে বিভিন্ন অনুষঙ্গে ও অভিজ্ঞতায় সরাসরি কবিতায়
উপস্থিত করার প্রবণতা। এর একটা ফল দাঁড়ালো এই যে, আমরা এক
আরোপিত নগরের বা এক আরোপিত দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে আমাদের অভ্যেস ও অনুশীলনের নতুন
অভিমুখ তৈরি করায় ব্যস্ত হলাম। না, আমি পশ্চিমা সাহিত্যের
বা জ্ঞানভাষ্যের প্রতি বিদ্বেষ থেকে কথাটা বলছি না মোটেই। তবে আমি যা বোঝাতে চাইছি
তা হলো এই যে, উপনিবেশবাদের হাত ধরে আমাদের সাহিত্যে যে আধুনিকতাবাদের উন্মেষ
ঘটেছে, তার একটা ফলাফল হচ্ছে যাকে ক্যারিবীয় লড়াকু
তাত্ত্বিক ফ্রানৎস ফানোঁ [Franz Fanon] বেশ আগেই বলেছিলেন, ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাস’ (বলা প্রয়োজন,
এই বর্গটি উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক গায়ত্রী স্পিভাক [Gayatri Chakravorty Spivak] বারবার ব্যবহার করলেও তা আসলেই নেওয়া হয়েছে
ফানোঁর কাছ থেকেই।)
এই জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের একটা বিশেষ অর্থ
এভাবে বলে নেওয়া যায়: যখন ভিনদেশি জ্ঞান চড়াও হয় উপনিবেশায়িত অঞ্চলের জ্ঞানের
ওপর এমনি এক মাত্রায় যে, ধরা
যাক, একজন আলাওলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পরিচিত হয়ে ওঠে
একজন চসার [Geoffrey
Chaucer]। আমি মোটেই
দুনিয়াব্যাপী জ্ঞানভাষ্যের বা সাহিত্যের লেনদেনের বিরুদ্ধে নই। আমি এমনকি এও মনে করি যে, প্রভাবিত হওয়াও মাঝে মধ্যে জরুরি বটে। কিন্তু লেনদেনের
নামে কিংবা প্রভাবিত হওয়ার ভেতর দিয়ে যখন আধিপত্যবাদী বা উপনিবেশবাদী
ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে এবং এর ফলে যখন জাতীয় সংস্কৃতি বিপন্ন বা এমনকি
বিলুপ্ত হতে থাকে, তখন জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে
জরুরি হয়ে পড়ে পাল্টা জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই। এ লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার একাধিক লেখক ও
অ্যাকটিভিস্ট: লাতিন আমেরিকার হোসে কার্লোস মালিয়াতেগি [José Carlos
Mariátegui],
ক্যারিবীয় অঞ্চলের কবি এমে সেজেয়ার [Aimé Césaire], ফ্রানৎস
ফানোঁ তো আছেনই এবং আফ্রিকার লেপোন্ড সেডার সেংঘর [Léopold Sédar Senghor] ও নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গো [Ngũgĩ wa Thiong'o] (যার Decolonizing the Mind [মনের বি-উপনিবেশীকরণ] ওই জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইয়ের এক ধরনের
ইশতেহার, যাকে অবশ্যই ফানোঁর রক্ত-বলকানো The Wretched of the Earth
[পৃথিবীর হতভাগ্য] -এর সঙ্গে তুলনা করা চলে)। কিন্তু এদের আগেই এই পাল্টা জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইকে
যিনি নিজের কাজ ও জীবনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি হচ্ছেন আমাদের
কবি নজরুল ইসলাম। এমনকি এও বলা যাবে যে, উপনিবেশবাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ শতকের প্রায় গোড়াতেই
সারা এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সবচাইতে গর্জে-ওঠা,
সবচাইতে টগবগ-করা, সবচাইতে বিস্ফোরক কবিতার নাম
‘বিদ্রোহী’। আমার মনে হয় যে, ‘বিদ্রোহী’
কবিতাটি সে সময় এবং পরেও এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হলে কবিতাটি থাকতে পারত
চে গুয়েভারার [Che
Guevara] বুকপকেটে, কিংবা গ্রানাডার বিপ্লবী মরিস বিশপের [Maurice Bishop] হ্যান্ডব্যাগে, কিংবা জেলখানায় ভিয়েতনামের হো চি মিনের [Ho Chi Minh] বালিশের পাশে, কিংবা কেনিয়ার মাউ মাউ আন্দোলনের শেষ নেতা
ডেডান কিমাথির [Dedan
Kimathi] কণ্ঠস্বরে, যে কিমাথি
নজরুলের মতোই গ্রামীণ প্রোলেতারিয়েতকেই ইতিহাসের মঞ্চে হাজির করেছিলেন। এসব
প্রসঙ্গে পরে ফিরব। কিন্তু তার আগে এই তিরিশের আধুনিকতাবাদের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের
প্রধান কর্তাসত্ত্ব হিসেবে বিষয়টি আরেকটু সামনে আনা দরকার।
হ্যাঁ, এর আগে যে জ্ঞানতান্ত্রিক সন্ত্রাসের কথা বলা হলো, তার
এক ধরনের নান্দনিক মধ্যস্থতা করছিলেন তিরিশের একদল কবি। বলা যাবে যে, এরা পশ্চিমা নন্দনতত্ত্বকে জায়গা করে দিতে
গিয়ে তাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার বদলে বরঞ্চ তারাই এই নন্দনতত্ত্বের দখলে চলে
গিয়েছিলেন। আমি একে বলি নান্দনিক নয়া-উপনিবেশবাদ। তবে কবিদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, যার কবিতা বাংলার মাটির অনুপুঙ্খে
তীব্রভাবে জড়িত ও জারিত হয়ে নিজেই তৈরি করছিল ভিন্ন ধরনের এক উপনিবেশিবাদবিরোধী বয়ান
ও আখ্যান। পশ্চিমা আধুনিকতাবাদের সঙ্গে তার একটা তাৎপর্যপূর্ণ টানাপোড়েনেই
চুড়ান্ত দৃষ্টান্ত জীবনানন্দ দাশের কাজে, অন্তত আমার
বিবেচনায় কোনো উদ্ভট, আরোপিত জগৎ প্রশ্রয় পায়নি।
কিন্তু তিরিশের কবিদের খানিকটা আগেই নজরুলেও আমরা
রবীন্দ্রবিরোধিতার আরেকটি মাত্রা লক্ষ করি। তবে তিরিশের দশকের মোহগ্রস্ত রবীন্দ্রবিরোধিতার
সঙ্গে নজরুলের রবীন্দ্রবিরোধিতার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান সময়ে নজরুলকে
আমাদের অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত করার স্বার্থেই এই পার্থক্যটাকে বিশেষভাবে
খেয়াল করা প্রয়োজন। না, রবীন্দ্রনাথকে
জোরেশোরে বর্জন করবেন বলেই নজরুল বোদলেয়ার [Charles Baudelaire] বা এলিয়টকে [T. S. Eliot] পীর মানেননি। কোনো
ভিনদেশি নন্দনতত্ত্বের প্রচারকও সাজেননি তিনি। একেবারে ইতিহাসের ভেতরে থেকেই নিজের
ইতিহাসের তাপে ও চাপে, বা
সেই ইতিহাসের অনিবার্য ছন্দঃস্পন্দে, এক অনায়াস
স্বাচ্ছন্দ্যে, নজরুল কবিতার ভাষায় এবং গানের ভাষায় তৈরি
করেছিলেন এমন এক কণ্ঠস্বর যাকে চট করে চেনা যায়, যাকে
অনায়াসেই আলাদা করা যায় রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর থেকে। সেখানেই শেষ নয়। নজরুলের
এই অনায়াস রবীন্দ্রবিরোধিতা তিরিশের আধুনিকতাবাদী রবীন্দ্রবিরোধিতাকেও বিরোধিতা
করে বটে। এখানে বলা দরকার, রবীন্দ্রনাথেও খানিকটা
উপনিবেশবাদবিরোধিতা ছিল বটে, কিন্তু সে বিরোধিতা তার ওপর
পশ্চিমা উদারনৈতিকতার প্রভাবে মাঝে মধ্যে পিছু হটেছে; এক
ধরনের ঔপনিবেশিক অচেতনও সেখানে কাজ করেছে বটে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে নজরুলই বোধকরি সবচেয়ে লড়াকু
উপনিবেশবাদবিরোধী লেখক যাকে সামান্যতম ঔপনিবেশিক হীনমন্যতা স্পর্শ করেনি, যার স্বার্থতাড়িত ঔপনিবেশিক টানাপোড়েনের
কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
এক সময় ইতালীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনীতিক ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক
আন্তোনিও গ্রামসি [Antonio
Gramsci] বলেছিলেন ‘অর্গানিক’ বুদ্ধিজীবীদের কথা, সনাতন বুদ্ধিজীবীদের বিপরীতেই। গ্রামসীয়
অর্থেই আমরা নজরুলকে বলতে পারি উপনিবেশবাদবিরোধিতার ‘অর্গানিক’ কণ্ঠস্বর, যে কণ্ঠস্বর এখনো আমাদের যে কোন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে ‘গমগম’ করে—পেরুর
সেই তরুণ বিপ্লবী কবি রাউল ব্লাঙ্কো-কথিত [Raul Blanco] মার্কসের কণ্ঠস্বরের মতোই। আর অর্গানিক বলেই নজরুলের
কণ্ঠস্বর মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়েই গমগম করে ওঠে ধুমকেতু
পত্রিকাটির পাতায় পাতায় : ‘সর্বপ্রথম ধুমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।
স্বরাজ টরাজ বুঝি না। কেননা এ কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন।
ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশির অধীনে থাকবে না। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে
তারা শুনবে না... আমাদের এই প্রার্থনা করার ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে
হবে।’ পরিষ্কার যে, শুধু
স্বাধীনতা নয়, দরকার ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’। আর আবেদন-নিবেদনে এই পূর্ণ স্বাধীনতা মোটই সম্ভব নয়। নজরুল
একেবারে খাঁটি সত্যটা চাঁছাছোলা ভাষায় ঘোষণা করেছেন এখানে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা
আইএমএফ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘জ্বি হুজুর জ্বি হুজুর’ বলে তাদের সঙ্গে
ডায়ালগে গিয়ে আজ যারা বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার বা গণতন্ত্রের কথা বলছে
নজরুলের কণ্ঠস্বর তাদের বিরুদ্ধেই এই মহূর্তে গমগম করতে থাকে। আর নজরুলের
কণ্ঠস্বরের একটা প্রতিধ্বনি শুনি মার্কিন উপনিবেশ পুয়ের্তো রিকোর সাম্প্রতিক কালে
নারীবাদী কবি মারথা ভিয়ানুয়েভার [Martha Villanueva] কবিতায়:
“তোমাদের শিক্ষা শেখায় ভিক্ষা
তোমাদের শিক্ষা শেখায় ভিক্ষা
পুঁজি শেখায় ভিক্ষা
উপনিবেশ শেখায় ভিক্ষা”
মারথা ভিয়ানুয়েভা এবং নজরুল ইসলাম উভয়েই ওই ভিক্ষাকে বা
ঔপনিবেশিক নির্ভরশীলতা ও হীনমন্যতাকে সম্পূর্ণ বর্জন করার আহবান জানিয়েছিলেন।
এমনকি সেই বিখ্যাত হেগেলীয় ‘মালিক/ক্রীতদাস’ দ্বান্দ্বিকতা যেন খান
খান
করে ভেঙে ফেলতে চাইছিলেন মারথা ভিয়ানুয়েভা ও আমাদের নজরুল ইসলাম। অর্থাৎ তারা
বুঝাতে চাইলেন এই কথাটা: যেখানে ক্রীতদাস নেই সেখানে মালিকও নেই।
বলা দরকার, যে সময়ে নজরুল ঔপনিবেশিক ভারতের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত
করেছিলেন বা তার জন্য দাবি তুলছিলেন, সে সময়ে ভারতের কোনো
রাজনৈতিক নেতা বা কোনো লেখক সে দাবির ধারে কাছে যাননি। এমনকি মহাত্মা গান্ধীও তখন
মহাত্মা হয়ে ওঠেননি। আর যেভাবে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলেছেন নজরুল,
তার বয়ানই যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন
উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি লড়াইয়ের ময়দানে ময়দানে। আসলে নজরুল যেভাবে কথা
বলেছেন, পরবর্তী সময়ে ঠিক একইভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার কথা
বলেছেন তৃতীয় বিশ্বের দু’জন উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াকু তাত্ত্বিক: একজন হচ্ছেন
ক্যারিবীয় অঞ্চলের ফ্রানৎস ফানোঁ, যার কথা আগেই বলেছি অপরজন আফ্রিকার বা কেপ
ভার্দে ও গিনি-বিসাউ’র কমিউনিস্ট নেতা ও তাত্ত্বিক আমিলকার কাবরাল [Amílcar Cabral]। আর
হ্যাঁ, আজকে আরো জোরেশোরে এই কথাটা
সামনে আনা দরকার: ১৮৫৭ সালে ঘটেছিল ভারতের প্রথম জাতীয় মুক্তির সশস্ত্র লড়াই আর
১৯২২ সালে নজরুলের কণ্ঠেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল ‘ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা’র দাবি।
২
১৯২২ সালে যেখানে ধুমকেতু পত্রিকার পাতায় নজরুল ভারতের
পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন, তার কিছু আগেই, ১৯২১ সালেই, নজরুল এক অর্থে পূর্ণ
স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়ে ফেলেন তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। অবশ্যই বলা যাবে, ওই কবিতাটি বারবারই বুঝিয়ে দেয় যে, ইতিহাস হচ্ছে আমাদের
অনিবার্য ঠিকানা, যেখানে শ্রেণীর টান প্রেমের কিংবা রক্তের
টানের মতোই প্রবল। আর বারবারই তো আমাদেরকে যেতে হয় ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কাছেই। এও
বলা দরকার যে, যেখানে স্বাধীনতা নেই— এবং যে বাংলাদেশে আজ
ঘটে চলেছে অগ্রসর উপনিবেশবারেই নবায়ন— সেখানে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’
কবিতা পড়ার কোনো শেষ নেই। তাহলে পড়া যাক ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবারো।
সৃজনশীল লেখকদের একবার কার্ল মার্কস একটা চমৎকার পরামর্শ
দিয়েছিলেন: ‘তোমার জমাটবাঁধা ধারণাগুলোকে ঘষতে থাকো, যাতে আগুন ধরে।’ উপনিবেশবাদবিরোধী ক্যারিবীয় কবি এমে সেজেয়ার জোর
দিয়েছিলেন কবিতার ‘অগ্নিগুণের’ ওপর।
হ্যাঁ,
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল শব্দের সঙ্গে শব্দ ঘষে আগুন জ্বালান;
সেজেয়ার-কথিত ‘অগ্নিগুণ’ই সেই কবিতার স্পষ্ট বৈশিষ্ট বটে। ভাষায় ও
ছন্দে এমন এক অভূতপূর্ব তেজ ও ঝাঁঝ নিয়ে কবিতাটি উপস্থিত হলো যে, নজরুলকে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে একজন আলাদা শক্তিশালী কবি হিসেবে অনায়াসেই
চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় উঠে এসেছে
নজরুলের অনিবার্য টগবগ-করা ইতিহাস-চেতনা, যে চেতনা প্রকাশ্যেই উস্কে দিয়েছে ‘পুর্ণ
স্বাধীনতা’র জন্য উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াই। এখানেও নজরুলের বিশিষ্ট বিশেষভাবেই চোখে
পড়ে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার শুরুতেই নজরুল একজন বীরকে সামনে এনেছেন
ঠিকই; এই বীর এবং বিদ্রোহী ‘আমি’—এর
বেশে খোদার আরশ ছেদ করে উর্ধ্বমুখী হতে চায় ঠিকই কিন্তু তাকে ঘরেই ফিরে আসতে হয়—ফিরে আসতে হয় ইতিহাসের কাছে, মাটির কাছে, নিজ মানুষের কাছেই, যে কারণে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রবাহ
বা গতি শেষ পর্যন্ত উল্লম্ব থাকে না; তা হয়ে ওঠে স্পষ্টত
আনুভূমিক বা ভূমি-সংলগ্ন। | ইউরোপকেন্দ্রিক
তুলনামূলক সমালোচনা-পদ্ধতির ঘোরে অনেকেই নজরুলকে ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের সঙ্গে,
বিশেষ করে শেলির [P.B. Shelley] সঙ্গে তুলনা করে থাকেন; ভাবটা এমন যে, শেলির
সঙ্গে তুলনা করলেই যেন নজরুল জাতে ওঠে। ‘হায়রে ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা!’ তবে তুলনা
যদি করতেই হয়, তাহলে দেখানো দরকার যে, শেলি তার বিদ্রোহের গতি ও গন্তব্যকে প্রায়ই আকাশমুখী করে রাখেন। যে
শ্রেণীহীন, বৈষম্যহীন, সোনালি, অগ্নিল জগতের রূপরেখা শেলি এঁকেছেন তার কবিতায়, সে
জগৎ কখনো ঝুলে থাকে মেঘে, কখনো আকাশে। এ এক রোমান্টিক
কল্পনার জগৎ, যে জগৎকে শেলির আগেই এমনকি গ্যেটের ‘বিদ্রোহী’
ফাউস্টও সুযোগ পেলেই অন্বেষণ করেছেন। কিন্তু নজরুল? না, তার
অভীষ্ট গন্তব্য আকাশ নয়; শেষ পর্যন্ত মাটিই তার ঠিকানা। তার
বিদ্রোহী বীর ক্ষ্যাপা, বেপরোয়া, মুক্ত
জীবনানন্দ হলেও তার ‘শির’ নতজানু হয় ইতিহাসের কাছেই, মাটি ও
মানুষের কাছে কেননা ইতিহাসের অনিবার্য চাপেই বিদ্রোহীকে তার নিজস্ব ইতিহাসের
প্রতিনিধিত্ব করতে হয় এবং সে কারণেই বলতে হয়,
‘আমি সেইদিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না।’
বলাই বাহুল্য, এখানে যে ইতিহাসের কথা বলছেন নজরুল, তা স্পষ্ট উৎপীড়িতের সাক্ষাৎ ইতিহাস—যে উৎপীড়িতকে ফ্রানৎস ফানোঁ বলেছেন, ‘রেচেড অব দ্য
আর্থ’। আর এই ইতিহাস থেকেই তো তিরিশের আধুনিকতাবাদীদের
অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘সহেনা-জনতার-এ-জন্য-মিতালী’ মার্কা ভিনদেশি নন্দনতত্ত্বের
চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। আবার এও লক্ষ্য করা দরকার, ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজর তার ‘আমি’কে ফার্সি মরমিবাদী কবি জামি-রুমি-একবালের
‘আমি’র মধ্যে কেবল ভগবৎরসে ঈশ্বর প্রেমের শরাবে মশগুল রাখতে চাননি। যে কারণে
নজরুলের ‘আমি’ মোটেই বিচ্ছিন্ন ও বায়বীয় নয়: সে অনিবার্যভাবে এক ইতিহাসের সঙ্গে,
সমষ্টির সঙ্গে, ভূমির সঙ্গে। আর ভূমিই তো হচ্ছে
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার তাবৎ উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ের
মোক্ষম ও মুখ্য এজেন্ডা। ‘ভূমি
আগে, প্যাচাল পরে’-এই স্লোগানটি তো লাতিন
আমেরিকার আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে লড়াইয়ের ভেতর দিয়েই ওঠে এসেছে, যার একটা চমৎকার চিত্র এঁকেছেন আদিবাসী ইন্ডিয়ান ঔপন্যাসিক লেসলি মারমোন
সিল্কো [Leslie
Marmon Silko]
তার মহাকাব্যিক আয়তনের উপন্যাস Almanac of the Dead-এ [মৃতের পঞ্জিকা] ভূমিকে ভাষায় রূপান্তরিত করার
কারণে আর ভাষাকে ভূমি হিসেবে ব্যবহার করার কারণে—আর এই ভাষা-ভূমির ছন্দস্পন্দেই নজরুলের
ইহজাগতিকতা, বাস্তববোধ,
বিদ্রোহের আবেগ, শ্রেণী-চেতনা সবকিছুই তার ইতিহাস
চেতনারই সাক্ষ্য বহন করে, যার প্রমাণ একেবারে শুরু থেকেই অগ্নিবীণা
থেকেই স্পষ্ট হয়ে থাকে।
হ্যাঁ, অবশ্যই বলা যাবে যে, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কোনো উদ্দেশ্যহীন বিদ্রোহের
কবিতা নয়; তা একই সঙ্গে ঘুড়ে যাবার ও ঘরে ফেরার কবিতাই বটে,
যেভাবে ক্যারিবীয় কবি এমে সেযেয়ারের দীর্ঘ কবিতা Notebook of a Return to the Native Land [নিজের দেশে ফিরে আসার জার্নাল] আসলে যুদ্ধে যাবার
ও ঘরে ফেরার কবিতা (যদিও কবিতা দুটির অনেক পার্থক্য চোখে পড়ে, যে পার্থক্যটা, ধরা
যাক, মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আমিলকার কাবরালের পার্থক্যের মতো)। হ্যাঁ, নজরুল তার ঘরকে চিনেছিলেন স্পষ্ট করেই, যেমন তাকে জীবনানন্দও চিনেছিলেন তার মতো করেই,
যদিও ইউরোপকেন্দ্রিক আধুনিকতাবাদের ভূতের আছরে থাকা তিরিশের কবিদের
অনেকেই তা চিনতে পারেননি। তাদের অনেকেই যখন বোদলেয়ার ও এলিয়টের দিকে সেজদা দিয়ে বুঁদ
হয়ে বা ঝিম ধরে নান্দনিক ‘ট্রিপ’ নেয়ায় ব্যস্ত, তখন নজরুল
একেবারে আপন ইতিহাসের ভেতরেই উপনিবেশবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে পূর্ণ স্বাধীনতার
যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ যুদ্ধের ইতিহাস দীর্ঘই বটে।
‘আজ চারিদিক হতে ধনিক-বণিক শোষণকারীর জাত/ ও ভাই জোঁকের মতন
শুষছে রক্ত কাড়ছে থালা ভাত’—এই
দুটি পংক্তিতে যে ইতিহাস মুহূর্তেই ঝলক
দিয়ে
উদ্ভাসিত হয়, তার সঙ্গেই তো ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে আমাদের
ধারাবাহিক মুক্তিযুদ্ধ।
ওই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা নজরুল দিয়েছেন একাধিকবার এবং
বিভিন্নভাবেই। এর অসংখ্য উদাহরণ জড়ো করা সম্ভব। সেই ১৯২২ সালে প্রকাশিত অগ্নিবীণা
থেকে শুরু করে বিষের বাঁশী (১৯২৪), দোলনচাঁপা (১৯২৪), সাম্যবাদী (১৯২৫), সৰ্বহারা (১৯২৬),
জিঞ্জির (১৯৯৮), চক্রবাক
(১৯২৯)-এর ভেতর দিয়ে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত বিভিন্ন কবিতায় ও গানে নজরুলের
মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা স্পষ্ট হয়ে থাকে, পুনরাবৃত্ত হয়, যদিও
আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার শুরুটা ‘বিদ্ৰোহী’ কবিতায়
লক্ষণীয়। ‘স্বাধীনতা’র সঙ্গে ‘মুক্তি’ কথাটার
পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। ‘মুক্তি’ কথাটা ব্যাপক। তবে আমি এথানে নজরুল-কথিত ‘পূর্ণ
স্বাধীনতা’ আর ‘মুক্তি’ একই অর্থে ব্যবহার করছি। অর্থাৎ নজরুল কেবল একটি ভূখণ্ডের
ভৌগোলিক স্বাধীনতার কথাই বলছেন না তিনি, আসলেই জোর দিচ্ছেন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক
মুক্তির ওপর। সে কারণেই তার জন্য জরুরি হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা। বিভিন্ন
গানে, কৃষকের গানে ও শ্রমিকের গানে, মুক্তিযুদ্ধের
ঘোঘণা উচ্চারিত হয় নিঃশ্বাসের মতো এক অনিবার্য স্বাভাবিকতায় :
‘যত শ্রমিক শুষে নিংড়ে প্রজা
রাজা উজির মারছে মজা
আমরা মরি বয়ে তাদের বোঝারে!
এবার জুজুর দল ঐ হুজুর দলে
দলবি রে আয় মজুর দল
ধর হাতুড়ি, তোর কাঁধে শাবল।
দেখা দরকার, নজরুল এই পংক্তিলোতে মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গেই উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয়
মুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে শ্রেণী সংগ্রামকেও সম্পর্কিত করেন বটে।
৩
জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের প্রশ্নটা তখনই ওঠে—যে প্রশ্নটি নজরুল
নিজেই তুলেছিলেন বারবার — যখন
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ তাদের অর্থনৈতিক, মতাদর্শিক ও
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অব্যাহত রাখে। আর যে কোনো শ্রেণী-বিভক্ত সমাজে শ্রেণী-সংগ্রাম
থাকে: তবে তা হতে পারে প্রত্যক্ষ কিংবা প্রচ্ছন্ন। এই দুই
এর
মধ্যেই সম্পর্ক স্থাপনে নজরুল অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন, অর্থাৎ
জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে নজরুল সর্বহারাদের শ্রেণী-স্বার্থকেই কেন্দ্রিকতা
দিয়েছিলেন। এই দিক থেকে নজরুলের সঙ্গে বিশেষভাবে তুলনীয় হচ্ছেন লাতিন আমেরিকার
বা এল সালভাদরের কমিউনিষ্ট কবি রোকে ডালটন [Roque
Dalton], যিনি অবশ্য বয়সে নজরুলের ছোট।
আর নজরুলের মতোই রোকে ডালটন লিখেছেন বেশ কিছু ছেটো ছোট ‘বিদ্ৰোহী’ কবিতা। ডালটনের কয়েকটি নজরুলীয় পঙ্ক্তি:
‘আমি ভয়াল বিক্ষুব্ধ নদী
স্রোতের আঘাতে আঘাতে তোমাদের ধ্বংস করি
আমি ভীষণ ক্ষ্যাপা জনপদ
আমার কণ্ঠস্বরে থরথর কাপে তোমার সিংহাসন
আমি সর্বহারার মারমুখো কবি।’
রোকে ভালটনের নজরুলীর স্বভাবের প্রসঙ্গ ধরেই আমরা ত্রিমহাদেশীয়
লড়াকু কাব্যত্বত্ত্বের কথা বলতে পারি। ‘ত্রিমহাদেশীয়’ বর্গটি প্রথম ব্যবহার
করেছিযেন চে গুয়েভারা, সেই
১৯৬৬ সালে, এটাই বোঝানোর জন্য যে, এশিয়া,
আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার একটি গভীর রাজনৈতিক ঐক্য রয়েছে ওই
জায়গায় যেখানে এই তিনটি মহাদেশই বিভিন্নভাবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণে ও আগ্রাসনে
আক্রান্ত। এ কারণেই চে গুয়েভারা জোর দিয়েছিলেন ওই তিন মহাদেশের জনগোষ্ঠীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী
ঐক্যের ওপর। আর চে গুয়েভারার সঙ্গে তাল মিলিয়েই কবি রোকে ডালটন জোর দিয়েছিলেন
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লড়াকু লেখকদের বিপ্লবী
সংযোগ, সংহতি ও মৈত্রীর ওপর। কিন্তু এই মৈত্রী তো আপনা-আপনি
সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পড়ে লেখকদের সঙ্গে লেখক কিংবা কবিদের সঙ্গে কবিদের
রাজনৈতিক, মতাদর্শিক ও নান্দনিক মিলগুলো খুঁজে বের করার। এই কাজটি করতে পারে তুলনামূলক সাহিত্য নিজেই। কিন্তু তুলনামূলক
সাহিত্য প্রায়ই থেকেছে ইউরোপকেন্দ্রিক। আমরা জানি যে, নজরুলের প্রায়ই তুলনা করা হয় বায়রন, শেলি
ও হুইটম্যানের সঙ্গে। কিন্তু নজরুলের সঙ্গে মিল রয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক বিদ্রোহ কবির। তুলনার ওই উপেক্ষিত বা অকর্ষিত
অঞ্চল ধরেই তো সম্ভব ত্রিমহাদেশীয় কাব্যকে সামনে এনে তুলনামূলক সাহিত্যের বিউপনিবেশিকরন
ঘটানো।
হ্যাঁ, অবশ্যই বলতে হবে যে, একটি গর্জে-ওঠা ত্রিমহাদেশীয় কাব্যতত্ত্বকে
সামনে আনতে গেলে অবশ্য প্রথমেই নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাগুলো পাঠ করতে হয়। আর তার
কাব্যস্বভাব ও বিদ্রোহী চেতনার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে তৃতীয় বিশ্বের আরো অনেক লড়াকু
কবির কাব্যস্বভাবের ও বিদ্রোহী চেতনার। এইসব কবির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তুরস্কের
কবি নাজিম হিকমত, এল সালভাদরের রোকে ভালটন, এছাড়া আছেন গুয়াতেমালার ওতো রেনে কাস্তিও [Otto René Castillo], নিকারাগুয়ার আর্নেস্তো কারদেনাল [Ernesto Cardenal] ও গিয়োকান্দা বেইই [Gioconda Belli], চিলির পাবলো নেরুদা [Pablo Neruda], পুয়ের্তো
রিকোর হুলিয়া দ্য বুরগোজ [Julia de
Burgos] ও পেদ্রো পিয়েত্রি [Pedro
Pietri], মার্তিনিকের এমে সেজায়ার, কালো কবি নিকোলাস দিয়েন, দক্ষিণ আফ্রিকার কুমালো [Kumalo] ও ডেনিস ব্রুটাস [Dennis
Brutus], এ্যাঙ্গোলার ভিরিয়াতো দ্য ক্রুজ
[Viriato da Cruz] ও আন্তোনিও জাসিন্তো
[António Jacinto], সিরিয়ার নিজার কাব্বানি [Nizar
Qabbani], ফিলিস্তিনি কবি রশিদ হোসেন [Rashid Hussain] ও মাহমুদ দারওয়িশ, পাকিস্তানের বালাখ খান [Balakh Khan] এবং কোরিয়ার কবি কিম চি হা [Kim Chi Ha]। তাদের সঙ্গে নজরুলের সুনির্দিষ্ট সাদৃশ্য নিয়ে যে কোনো আলোচনা
আসলেই বিস্তর পরিসর দাবি করে। তবে এখানে এই তথ্যটি সামনে আনা দরকার যে, কিউবার কবি ফার্নান্দেজ শেরিকানের [Fernandez
Cherican] হাতে নজরুলের কবিতার অনুবাদ পৌঁছলে তিনি নিজেই তার সঙ্গে
রাজনৈতিক সংহতি ঘোষণা করে নজরুলের কয়েকটি কবিতা হিস্পানি ভাষায় অনুবাদ করেন।
অন্যদিকে ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক চিকানো (মেক্সিকান-আমেরিকান)
কবি লুইস রডরিগেজ [Luis Rodriguez] ও জিমি সান্তিয়াগো বাকা [Jimmy Santiago Baca] নজরুলের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পাঠ শোনার পর যে উদ্বেলিত ও
অনুপ্রাণিত প্রতিক্রিয়া জনসমক্ষে নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেন, তার মর্মশাস হলো এই: নজরুল আমাদেরও
বিদ্রোহী কবি। বলা দরকার, রাডরিগেজ ও বাকা উভয়েই প্রবলভাবে
মার্কিন-সম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি।
আমি এ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের যে কয়জন কবির নাম দ্রুত
উল্লেখ করেছি, তাদেরকে কেবল বামধারার
রাজনৈতিক কবি বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না মোটেই। ভালো কবিতা এক সঙ্গে জড়ো করলে
অবশ্যই একটি গর্জে-ওঠা ত্রিমহাদেশীয় কাব্যতত্ত্ব দাঁড়িয়ে যায়। এ কাব্যতত্ত্বের
কয়েকটি মূলকথা এভাবে বলে নেওয়া যায় : প্রথমত, কবি অন্তর্নিহিতভাবেই
রাজনৈতিক এই কারণে যে, কবিতা ভাষার সম্ভাবনাকে সম্প্রসারিত করতে
গিয়ে এবং জীবনযাপনের বিভিন্ন উৎসমুখ খুলতে গিয়ে বিরাজমান ভাষিক আধিপত্য ও
প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্য অর্থাৎ ক্ষমতাকেই বারবারই চ্যালেঞ্জ করতে থাকে। দ্বিতীয়ত,
এভাবে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে কবিতা নিজেই হয়ে ওঠে প্র্যাক্সিস।
তৃতীয়ত, সব কবিতা এক সমতলে আসে না: কবিতাতেও থাকে মতাদর্শিক
পক্ষপাত ও অভিক্ষেপ। চতুর্থত, রহস্যময়তাই কবিতার শেষ কথা
নয়। পঞ্চমত, নতুন ভাষা তৈরি করার ভেতর দিয়ে যে কবিতা একটি
জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনের তাবৎ অনুশীলনের সমগ্রকে ধারণ করতে পারে না, সেই কবিতা সেই জনগোষ্ঠীকে নাড়া দিতে পারে না। ষষ্ঠত, কবিরা ঘুমাবার সময় হয়তো ঘুমান, কিন্তু জাগরণের সময় সবাইকে নিয়েই জেগে
থাকেন। সপ্তমত, প্রয়োজন হলে একটি কবিতা নিজেই অত্যাচারীর
বিরুদ্ধে হয়ে উঠতে পারে বুলেট কিংবা বারুদ কিংবা বন্দুক। অষ্টমত কবিতা কোনো ধরনের
পরাধীনতা দাসত্বকে বরদাশত করে না, কেননা কবি মানেই মুক্তিযোদ্ধা।
আর কবিতা মানেই যে মুক্তিযুদ্ধ—এ কথাটি আমাদের
বারবারই বোঝান আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
আজফার হোসেন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে
গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটি-তে লিবারেল স্টাডিজ এবং ইন্টারডিসিপ্লিনারি
স্টাডিজ-এ অধ্যাপনা করছেন। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড্ স্টাডিজ্’-এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট
হিসাবে বর্তমানে কাজ করছেন এবং সেখানে তিনি ইংরেজি, বিশ্বসাহিত্য এবং ইন্টারডিসিপ্লিনারি
স্টাডিজ-এর অধ্যাপকও। এ বছর তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস-বাংলাদেশ
(ইউল্যাব)-এ ‘সামার ডিস্টিংগুইশড্ প্রফেসর অব ইংলিশ অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ’ হিসাবে
চার মাস কাজ করবেন।
No comments:
Post a Comment