আমাদের নজরুল ও গর্জে-ওঠা ত্রিমহাদেশীয় কাব্যতত্ত্ব
আজফার হোসেন
তার কবিতা পড়া মানেই উদীপ্ত হওয়া
—নেতাজী সুভাষ বসু
যে সময়ে নজরুল ইসলাম লিখছিলেন — অর্থাৎ গত শতকে বিশের দশক থেকে চল্লিশের
দশকের গোড়া পর্যন্ত — তখন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রবিরোধিতা প্রায় অভ্যেসে পরিণত
হচ্ছিল। তিরিশের দশকের কবিরা আধুনিকতাবাদের দোহাই পেড়ে ভিনদেশি নন্দনতত্ত্বের
উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা ভূতের খপ্পরে পড়ে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই
সাহিত্যের একটা নতুন যুগ তৈরি করার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। আমরা তখন লক্ষ্ করলাম বোদলেয়ার-পাউন্ড-এলিয়ট-লরেন্সের
নাগরিক ও নান্দনিক জ্ঞানভাষ্যকে বিভিন্ন অনুষঙ্গে ও অভিজ্ঞতায় সরাসরি কবিতায়
উপস্থিত করার প্রবণতা। এর একটা ফল দাঁড়ালো এই যে, আমরা এক
আরোপিত নগরের বা এক আরোপিত দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে আমাদের অভ্যেস ও অনুশীলনের নতুন
অভিমুখ তৈরি করায় ব্যস্ত হলাম। না, আমি পশ্চিমা সাহিত্যের
বা জ্ঞানভাষ্যের প্রতি বিদ্বেষ থেকে কথাটা বলছি না মোটেই। তবে আমি যা বোঝাতে চাইছি
তা হলো এই যে, উপনিবেশবাদের হাত ধরে আমাদের সাহিত্যে যে আধুনিকতাবাদের উন্মেষ
ঘটেছে, তার একটা ফলাফল হচ্ছে যাকে ক্যারিবীয় লড়াকু
তাত্ত্বিক ফ্রানৎস ফানোঁ [Franz Fanon] বেশ আগেই বলেছিলেন, ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাস’ (বলা প্রয়োজন,
এই বর্গটি উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক গায়ত্রী স্পিভাক [Gayatri Chakravorty Spivak] বারবার ব্যবহার করলেও তা আসলেই নেওয়া হয়েছে
ফানোঁর কাছ থেকেই।)
এই জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের একটা বিশেষ অর্থ
এভাবে বলে নেওয়া যায়: যখন ভিনদেশি জ্ঞান চড়াও হয় উপনিবেশায়িত অঞ্চলের জ্ঞানের
ওপর এমনি এক মাত্রায় যে, ধরা
যাক, একজন আলাওলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পরিচিত হয়ে ওঠে
একজন চসার [Geoffrey
Chaucer]। আমি মোটেই
দুনিয়াব্যাপী জ্ঞানভাষ্যের বা সাহিত্যের লেনদেনের বিরুদ্ধে নই। আমি এমনকি এও মনে করি যে, প্রভাবিত হওয়াও মাঝে মধ্যে জরুরি বটে। কিন্তু লেনদেনের
নামে কিংবা প্রভাবিত হওয়ার ভেতর দিয়ে যখন আধিপত্যবাদী বা উপনিবেশবাদী
ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে এবং এর ফলে যখন জাতীয় সংস্কৃতি বিপন্ন বা এমনকি
বিলুপ্ত হতে থাকে, তখন জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে
জরুরি হয়ে পড়ে পাল্টা জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই। এ লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার একাধিক লেখক ও
অ্যাকটিভিস্ট: লাতিন আমেরিকার হোসে কার্লোস মালিয়াতেগি [José Carlos
Mariátegui],
ক্যারিবীয় অঞ্চলের কবি এমে সেজেয়ার [Aimé Césaire], ফ্রানৎস
ফানোঁ তো আছেনই এবং আফ্রিকার লেপোন্ড সেডার সেংঘর [Léopold Sédar Senghor] ও নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গো [Ngũgĩ wa Thiong'o] (যার Decolonizing the Mind [মনের বি-উপনিবেশীকরণ] ওই জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইয়ের এক ধরনের
ইশতেহার, যাকে অবশ্যই ফানোঁর রক্ত-বলকানো The Wretched of the Earth
[পৃথিবীর হতভাগ্য] -এর সঙ্গে তুলনা করা চলে)। কিন্তু এদের আগেই এই পাল্টা জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইকে
যিনি নিজের কাজ ও জীবনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি হচ্ছেন আমাদের
কবি নজরুল ইসলাম। এমনকি এও বলা যাবে যে, উপনিবেশবাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ শতকের প্রায় গোড়াতেই
সারা এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সবচাইতে গর্জে-ওঠা,
সবচাইতে টগবগ-করা, সবচাইতে বিস্ফোরক কবিতার নাম
‘বিদ্রোহী’। আমার মনে হয় যে, ‘বিদ্রোহী’
কবিতাটি সে সময় এবং পরেও এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হলে কবিতাটি থাকতে পারত
চে গুয়েভারার [Che
Guevara] বুকপকেটে, কিংবা গ্রানাডার বিপ্লবী মরিস বিশপের [Maurice Bishop] হ্যান্ডব্যাগে, কিংবা জেলখানায় ভিয়েতনামের হো চি মিনের [Ho Chi Minh] বালিশের পাশে, কিংবা কেনিয়ার মাউ মাউ আন্দোলনের শেষ নেতা
ডেডান কিমাথির [Dedan
Kimathi] কণ্ঠস্বরে, যে কিমাথি
নজরুলের মতোই গ্রামীণ প্রোলেতারিয়েতকেই ইতিহাসের মঞ্চে হাজির করেছিলেন। এসব
প্রসঙ্গে পরে ফিরব। কিন্তু তার আগে এই তিরিশের আধুনিকতাবাদের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের
প্রধান কর্তাসত্ত্ব হিসেবে বিষয়টি আরেকটু সামনে আনা দরকার।