রবীন্দ্র প্রবন্ধ প্রসঙ্গ
রবিশঙ্কর মৈত্রী
রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ না পড়লে
তার সামাজিক মানবিক দায়বদ্ধতার একটি বিশেষ দিক পাঠকের আড়ালে থেকে যাওয়া
স্বাভাবিক। কবি রবীন্দ্রনাথ যে কীভাবে সরাসরি সমাজকর্মে নেমে পড়েছিলেন তা তার সব
ধরনের প্রবন্ধ না পড়লে জানা অসম্ভব।
প্রবন্ধ সম্পর্কে তাঁর, বিশেষ করে তার নিজের প্রবন্ধ সম্পর্কে তিনি বলেন :
“ছবিতে যেমন চৌকা
জিনিসের চারিটা পাশই একসঙ্গে দেখানো যায় না, তেমনি প্রবন্ধেও
একসঙ্গে একটা বিষয়ের একটি, বড়োজোর দুইটি দিক দেখানো চলে।” “নিজের নাসাগ্রভাগের সমসূত্র ধরে
ভূমিকা থেকে উপসংহার পর্যন্ত একেবারে সাজো লাইনে চললে নিতান্ত কলে তৈরি প্রবন্ধের সৃষ্টি হয়, মানুষের হাতের কাজের মতো হয়। সেরকম আঁটাআঁটি প্রবন্ধের বিশেষ আবশ্যক আছে এ কথা কেউ অস্বীকার
করিতে পারে না; কিন্তু সর্বত্র
তাহারই বড়ো বাহুল্য দেখা যায়। সেগুলো পড়লে মনে হয় যেন সত্য তার সমস্ত সুসংলগ্ন যুক্তি পরম্পরা নিয়ে একেবারে
সম্পূর্ণভাবে কোথা থেকে আবির্ভূত হল। মানুষের মনের মধ্যে সে যে মানুষ হয়েছে, সেখানে তার যে আরও অনেকগুলি সমবয়সী সহদোর ছিল, একটি বৃহৎ বিস্তৃত মানসপুরে যে তার একটি বিচিত্র বিহারভূমি ছিল, লেখকের প্রাণের মধ্যে থেকেই সে যে প্রাণ লাভ করেছে, তা তাকে দেখে মনে হয় না; এমন মনে হয় যেন কোন ইচ্ছাময় দেবতা যেমন বললেন, ‘অমুক প্রবন্ধ হউক’ অমনি অমুক প্রবন্ধ হল : ‘লেট দেয়ার বি লাইট অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাই।”
মানুষের জ্ঞানের জগৎ দিনে দিনে
প্রসার লাভ করেছে। জ্ঞানের জগৎটা আয়তনে যেমন বেড়েছে তেমনি আবার আগের চাইতে অনেক
বেশি কাছে এসেছে। এখন আর তেমন কিছুই অনায়ত্তের বাইরে নয়।
বিশ শতকের জগতের সঙ্গে আমাদের
পরিচয় ক্রমেই নিবিড় হয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়ে। বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের অসামান্য প্রতিভা সত্ত্বেও বাংলাসাহিত্য তখনো বিশ্বসাহিত্যের ভুবনে আসন লাভ করেনি। সে আসন লাভ হল
রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে।
“বঙ্কিমচন্দ্র
যেমন বাংলাসাহিত্যের একতারাতে একটি একটি করে তার সংযোজিত করে তাকে একটি বীণাযন্ত্রে পরিণত করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তেমনি বঙ্কিমের সেই বীণাযন্ত্রে নব নব তার যাজোনা করে তাকে বিশ্ববাণীয় পরিণত করলেন। বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন
মোহিত হল। প্রমাণ পাওয়া গেল যখন নোবেল
পুরস্কারের সম্মান লাভ করলেন । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাংলাভাষা এবং সাহিত্য
বিশ্বসাহিত্যের আসরে সমাদরে আমন্ত্রিত হল। সাহিত্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে উদ্দেশ্য
করে বাংলা সাহিত্য এবারে মুক্তকণ্ঠে বলতে পারল বিশ্ব সাথে যাগো যেথায় বিহারে..."
বাংলাভাষা এখন কেবল বাঙালির ভাষা
নয়,
কেবল বাঙালি ভাবাপন্ন নয়; পৃথিবীর আর সব উন্নত ভাষার সঙ্গে তার সমান তালে চলার মতো সাহস অর্জিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে।
“রবীন্দ্রনাথ
প্রবন্ধ রচনার প্রথম তাগিদ বোধ করেছিলেন
স্বদেশী আন্দোলনের যুগে। স্বদেশী আন্দোলনের প্রাক্কালে ১৯০৪ সালে স্বদেশী সমাজ' নামক প্রবন্ধ রচনা থেকে শুরু করে দেশের নানা সমস্যা
সম্পর্কে যখন যা ভেবেছেন তাই প্রবন্ধাকারে লিখে কলকাতার নানা সভায় পাঠ করে
শুনিয়েছেন। বলাবাহুল্য স্বদেশ চিন্তা স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় নি।
অসহযোগ আন্দোলনের যুগে গান্ধীজীর সঙ্গে নানা
বিষয়ে মতানৈক্য হয়েছে। কোনো কোনো বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তীব্র
ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সেসব প্রবন্ধ এখন ইতিহাসের সামগ্রী।”
রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন দেশের
মানুষের কথা ভেবেছেন। সে ভাবনা কবির ভাবনা নয়, সে ভাবনা একজন রক্তমাংসের সামাজিক দায়িত্বশীল মানুষের ভাবনা। কালান্তর’-এ তিনি দূর কালকেও স্পষ্টত প্রত্যক্ষ
করেছেন। কালান্তরের বিষয় এখনো প্রাসঙ্গিক। তার
সভ্যতার সংকট শুধু দেশের নয়, বিশ্বব্যাপী মহাসংকটের আর্তি উৎকণ্ঠা। মানবসভ্যতার সেই সংকট আজ আরো প্রবল। রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যৎ সভ্যতাঋদ্ধ বিশ্বের যে স্বপ্ন
দেখেছিলেন সে সভ্য বিশ্ব থেকে আমরা এখন আরো দূরে সরে পড়ছি।
“কবি মাত্রই
শিক্ষক;
তাঁরা লোকরঞ্জন
শিক্ষক। রামায়ণের কবি, মহাভারতের কবির
চাইতে বড় শিক্ষক দেশে আর কে আছেন? কবি হিসাবে রবীন্দ্রনাথও স্বভাব-শিক্ষক। | কিন্তু এ ছাড়াও লৌকিক অর্থে শিক্ষক বলতে আমরা যা বুঝি রবীন্দ্রনাথ সেই
শিক্ষকও |
ছিলেন। নিজেই একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন এবং সেখানে
শিক্ষকের কাজ করেছেন। তাঁর জীবনের এবং চিন্তার অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছিল এই
শিক্ষা এ সমস্যা।”
দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে তিনি শিক্ষা
সম্পর্কে ভেবেছেন। তিনি তাঁর আদর্শে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন।
রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনে পঠিত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের নিরন্তর
শিক্ষানুরাগ সুস্পষ্ট :
“আমাদের
বঙ্গসাহিত্যে নানা অভাব আছে সন্দেহ নাই; দর্শন বিজ্ঞান এবং বিবিধ শিক্ষণীয় বিষয় এ পর্যন্ত বঙ্গভাষায় যথেষ্ট পরিমাণে
প্রকাশিত হয় নাই; এবং সেই কারণে
রীতিমত শিক্ষালাভ করিতে হইলে বিদেশীয় ভাষায় সাহায্য গ্রহণ করা ব্যতীত উপায়ান্তর
দেখা যায় না। কিন্তু আমার অনেক সময় মনে হয় সেজন্য আক্ষেপ পরে করিলেও চলে, আপাতত শিশুদের পাঠ্যপুস্তক দুই চারিখানি না পাইলে নিতান্ত
অচল হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
বর্ণবোধে,
শিশুশিক্ষা এবং নীতিপুস্তকের অভাব নাই, কিন্তু তাহাকে আমি শিশুদিগের পাঠ্যপুস্তক বলি না।
পৃথিবীর পুস্তকসাধারণকে
পাঠ্যপুস্তক এবং অপাঠ্যপুস্তক, প্রধানত এই দুই
ভাগে বিভক্ত না করা যাইতে পারে । টেক্সট বুক কমিটি হইতে যে-সকল গ্রন্থ নির্বাচিত
হয় তাহাকে শেষাক্তো শ্রেণীতে গণ্য
করিলে অন্যায় বিচার করা হয় না।”
পাঠ্যপুস্তকের অভাবের কথা বলে
তিনি সে অভাব দূর করতে নিজেই কলম ধরেছেন, রচনা করেছেন-সহজপাঠ', ইংরেজি সোপান ইত্যাদি। নানা উপলক্ষে শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্ভাষণে শিক্ষা
বিষয়ে অনেক কথা তিনি বলেছেন। শিক্ষা বলতে তিনি শুধু বিদ্যাচর্চা বোঝেননি। শিক্ষাকে তিনি অনেক ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন
প্রকৃত শিক্ষা হল জীবনচর্চা। সেজন্যে তাঁর শিক্ষাভাবনা তাঁর জীবনদর্শনেরই এক
অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা সম্বন্ধে যেমন
দায়িত্বপূর্ণ বাস্তবসম্মত, তেমনি ধর্ম
সম্বন্ধেও তিনি স্বচ্ছ। তিনি যেভাবে ধর্মকথা বলেছেন কোনো ধর্মপ্রচারকের মুখে সে কথা শোনা যায়
না। তাঁর ধর্মে দেবতা নেই, পূজার্চনা নেই, নামজপের তাগিদ নেই, তিলকের গন্ধও অনুপস্থিত। ধর্মকে তিনি সব ধরনের বিধিবিধান থেকে মুক্ত করেছিলেন।
তার ধর্ম,
মানুষের ধর্ম'।
রবীন্দ্রনাথ বললেন :
“মানুষের বাইরে
আমার কোন দেবতা নেই।...মানুষের ধর্ম প্রকৃতপক্ষে কবির ধর্ম। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মাপোলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌচেছে বিশ্বমানসলোকে- যে লোকে তার বাণী, তার শ্ৰী, তার মুক্তি।
সফলতালাভের জন্যে সে মন্ত্রতন্ত্র ক্রিয়াকর্ম নিয়ে বাহ্য পরীক্ষায় প্রবৃত্ত
হয়েছিল অবশেষে সার্থকতালাভের জন্যে একদিন সে বললে, তপস্যা বাহ্যানুষ্ঠানে নয়, সত্যই তপস্যা; গীতার ভাষায় ঘোষণা করলে, দ্রব্যময়
যজ্ঞের চেয়ে জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেয়; খ্রীস্টের
বাণীতে শুনলে, বাহ্য বিধিনিষেধে পবিত্রতা নয়, পবিত্রতা চিত্তের নির্মলতায়। তখন মানবের রুদ্ধমনে
বিশ্বমানবচিত্তের উদৃবধোন হল। এই তার
আন্তর সত্তার বোধ দৈহিক সত্তার ভেদসীমা ছাড়িয়ে দেশে কালে
সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যের দিকে প্রসারিত। এই বোধেরই শেষ কথা
এই যে, যে মানুষ আপনার আত্মার মধ্যে
অন্যের আত্মাকে ও অন্যের আত্মার মধ্যে আপনার আত্মাকে জানে, সেই জানে সত্যকে।
মানুষ আছে তার দুই ভাবকে নিয়ে, একটা তার জীবভাব, আর-একটা বিশ্বভাব। জীব আছে আপন উপস্থিতকে আঁকড়ে, জীব চলছে আশু প্রয়োজনের কেন্দ্র প্রদক্ষিণ করে। মানুষের মধ্যে সেই জীবকে পেরিয়ে গেছে যে সত্তা
সে আছে আদর্শকে নিয়ে। এই আদর্শ অন্নের মতো নয়, বস্ত্রের মতো নয়। এ
আদর্শ একটা আন্তরিক আহ্বান, এ আদর্শ একটা নিগূঢ় নির্দেশ। কোন দিকে নির্দেশ। যে দিকে সে বিচ্ছিন্ন নয়, যে দিকে তার পূর্ণতা, যে দিকে ব্যক্তিগত সীমাকে সে ছাড়িয়ে চলেছে, যে দিকে বিশ্বমানব। ঋগবেদে সেই বিশ্বমানবের কথা বলেছেন,
“পাদোহস্য বিশ্বা
ভূতানি ত্রিপাদম্ব্যামৃতং দিবি"
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে আমাদের
চিন্তাধারার গতানুগতিক পথকে নতুন পথে চালিত করেছেন। তিনি আমাদের নতুন করে ভাবতে
শিখিয়েছেন, নতুন চোখে দেখতে শিখিয়েছেন।
তাঁর প্রবন্ধ সংখ্যায় আর
বৈচিত্র্যে অন্তহীন। সাহিত্য সমালোচনায়
তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি বিস্ময়কর। আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর দায়িত্বপূর্ণ
মতামত চির-অনুসরণীয়।
“রবীন্দ্রনাথ
আমাদের প্রবন্ধ সাহিত্যকে এমন এক স্তরে এনে পৌছিয়ে দিয়েছেন যেখানে সমস্ত পথই তার
কাছে উন্মুক্ত। কিছুই আর তার পক্ষে অসাধ্য নয়, কিছুই তার নাগালের বাইরে নয়। সকল সাহিত্যেরই শক্তি নিহিত থাকে তাঁর ভাষায়।
ভাষার প্রকাশশক্তি যদি যথেষ্ট পরিমাণে বিকাশলাভ না করে তা হলে সাহিত্যের আশানুরূপ
বিকাশ কখনই সম্ভব নয়। ভাষা যতদিন না সাবালক হচ্ছে সাহিত্যকে ততদিন নাবালকই থাকতে
হবে। মুখে যদি কথা না যোগায় তা হলে পদে
পদে অপ্রতিভ হতে হয়। অপরিপুষ্ট ভাষার সেই দশা। ভাষাকে সপ্রতিভ হতে হবে। যখন যেমন প্রয়োজন সারাক্ষণ তেমনভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখাকে দিকে মনের সূক্ষ্মতম অনুভূতি
প্রকাশে সক্ষম হবে, অপর দিকে
বুদ্ধির পরীক্ষায় জটিলতম প্রশ্নেরও জট ছাড়ানো সম্ভব হবে।”
রবীন্দ্রনাথের বিশেষ পাঠ্যবিষয়ক
এবং ভ্রমণাশ্রিত রচনা ছাড়া প্রায় সব প্রবন্ধ এই সংকলনে সংকলিত হল ।
রবীন্দ্রপ্রবন্ধ সমগ্র প্রকাশের এটাই প্রথম প্রয়াস। রবীন্দ্রানুরাগীদের কাছে এই
গ্রন্থ সমাদৃত হবে আশা রাখি।
২২ শ্রাবণ ১৪০৭
No comments:
Post a Comment