ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ - পর্ব ০২ (শেষ) - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১
ঠিক সাড়ে সাত বছর পর আমি আবার পা দিলাম মস্কো শহরে। এর মধ্যে কী চমকপ্রদ পালাবদল ঘটে গেছে এই পৃথিবীতে! ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এক মহা শক্তিশালী বিশাল সাম্রাজ্য। বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে এমন এক সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার মতন ঘটনা মানুষের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি।
সাড়ে সাত বছর আগে এরকম পট পরিবর্তনের সামান্যতম সম্ভাবনাও ছিল না কারুর সুদূর কল্পনায়। মস্কো তখন সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার রাজধানী। অন্যান্য অনেক দরিদ্র দেশের বহু মানুষ, যারা সমাজ ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চায়, তারা প্রেরণার জন্য তাকিয়ে থাকে মস্কোর দিকে। আমেরিকা পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা নিয়ে যেতে চাইছে মহাকাশে, সেখান থেকে পেশি আস্ফালন করবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে আমেরিকা এক হাতে দান-খয়রাত করে, অন্য হাতটা যে-কোনও সময় থাপ্পড় মারার জন্য উদ্যত রাখে। মাও-এর পরবর্তী চিন অবশ্য ততদিনে আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেলেছে। মার্কিন দেশের বড়-বড় ব্যবসায়ীরা ভারতের প্রতি নাক কুঁচকে চিনে গিয়ে কারখানা স্থাপনের উপযুক্ত স্থান খুঁজছে। চিনের বড়-বড় হোটেলের পরিচারকরা পর্যন্ত থ্যাংক ইউ-এর বদলে ইউ আর ওয়েলকাম বলতে শিখে গেছে।
আমেরিকান ইগলকে তখন বাধা দিতে পারে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল পতাকা। ওয়াশিংটন থেকে কোনও হুঙ্কার উঠলে মস্কো থেকে পাল্টা হুঁশিয়ারি যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নতুন এক শব্দ তৈরি হয়েছে, কোলড ওয়র, ঠান্ডা যুদ্ধ। এক অদৃশ্য দাঁড়িপাল্লায় দু-দিকেই দু-পক্ষ নিযুত অর্বুদ টাকা দামের অস্ত্র বাড়িয়ে চলেছে। ঠান্ডা যুদ্ধ যে-কোনও সময়ে পরিণত হতে পারে সর্ব-বিধ্বংসী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে। সেরকম কোনও যুদ্ধ শুরু হলে আমি এবং আমার মতন অজস্র মানুষ নিশ্চয়ই সোভিয়েত পক্ষকেই সমর্থন করত। কারণ তখন পর্যন্ত আমাদের মনে হত, আমেরিকা নামের দেশটা চালায় বড়-বড় ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত এক স্বার্থপর সরকার আর সোভিয়েত ইউনিয়ান তথা সমাজতান্ত্রিক জোট এক বৃহৎ আদর্শের প্রতিভু। ধনতান্ত্রিক দেশগুলি অস্ত্র বিক্রেতা, তাই তারা যুদ্ধের উস্কানিদাতা, আর সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া শান্তিবাদী।
রাজনীতি বা কূটনীতি অবশ্য এমন সরল অঙ্কের নিয়মে চলে না।
সাড়ে সাত বছর আগে আমি এসেছিলাম শক্তিশালী, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোটের রাজধানী মস্কোতে। সেবারে আমি ছিলাম সরকারি অতিথি। দলের সঙ্গে নয়, একা। আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল সেরগেই নামে এক যুবক। বেশ হাসিখুশি, সুন্দর স্বভাব, সে ছিল আমার দোভাষী, পথ প্রদর্শক ও সব কিছুর ব্যবস্থাপক। আমার ওপর নজরদারি করাও ছিল তা দায়িত্বের অঙ্গ, তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। আমি একটুক্ষণ তার চোখের আড়ালে গেলেই সে অতিশয় ব্যস্ত হয়ে উঠত। অবশ্য সোভিয়েত দেশের কোনও ছিদ্র অনুসন্ধান করার কোনও উদ্দেশ্যেই আমার ছিল না, আমি গিয়েছিলাম মুক্ত মন নিয়ে। তার আগে অনেকগুলি ধনতান্ত্রিক দেশ আমার ঘোরা হয়ে গেছে, সমাজতন্ত্রের বাস্তব প্রয়োগ নিজের চোখে দেখার আগ্রহ ছিল খুব।
সরকারি আমন্ত্রণের ভ্রমণসূচি সব আগে থেকে নির্দিষ্ট থাকে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সাক্ষাৎকার ও পরিদর্শনের প্রোগ্রামে ঠাসা। মস্কো, লেনিনগ্রাড, রিগা ও কিয়েভ এই চারটি শহরেই সেরগেই আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। পরে আমি চিনে গিয়ে দেখেছি, সেখানেও বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন সরকারি প্রতিনিধি নয়, একই দোভাষী গাইড সব ক'টি শহরে সঙ্গী। এর কারণ বোধ হয় এই যে, এক শহর থেকে অন্য শহরে যাতায়াতের পথে, ট্রেনে বা বিমানে সরকারি অতিথি যাতে হারিয়ে না যান, কিংবা অন্য লোকদের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় আড্ডা জুড়ে না দেন, সেটা দেখা।
সেবারে চারটি শহরেই যা যা আমাকে দেখানো হয়েছে, তা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। যা যা দেখানো হয়নি, সে বিষয়ে কিছু জানি না। লেনিনগ্রাড শহরটি অতি সুদৃশ্য, সেখানে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত হারমিটেজ মিউজিয়াম, রিগা শহরের কোথাও কোথাও রয়েছে প্রায় অবিস্মৃত মধ্যযুগীয় রূপ, কিয়েভ শহরে সবুজের অপূর্ব সমারোহ, এসব দেখে কার না ভালো লাগবে! দেখেছি, উন্নত ধরনের যৌথ খামার, সারা দেশে নির্দিষ্ট ও সস্তা দামে খাদ্যদ্রব্য ও যানবাহন ব্যবস্থা, শুনেছি সমস্ত নাগরিকদের বাসস্থান ও জীবিকার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কথা। ফিরে এসে ভ্রমণকাহিনিতে সেই সবই লিখেছি। কেউ-কেউ বলেছেন, এদেশে এবং মস্কোতেও, এই ব্যবস্থার অনেক দুর্বলতা, গলদ ও অন্যায় আছে, সেসব আপনি কিছুই লেখেননি কেন? আমি বলেছি, যা দেখিনি, তা আমি লিখব কেন? আমি ভ্রমণকাহিনিতে উপন্যাস ঢোকাতে চাই না, অনুমান বা শোনা-কথা একপাশে সরিয়ে রাখি।
সেবারে সোভিয়েত দেশে সমাজতন্ত্রের বহিরঙ্গ দেখে আমি মুগ্ধই হয়েছিলাম। আমাদের মতন দরিদ্র দেশের পক্ষে তো আদর্শ বটেই! কয়েকটি ব্যাপারে শুধু খটকা লেগেছিল। যৌথ খামারটিকে মনে হয়েছিল মডেল খামার, বড় বেশি সাজানো, ওটা যেন বিদেশিদের দেখাবার জন্যই। সারা দেশে সমান দামে সমস্ত খাদ্য সরবরাহের প্রচারটাও বোধহয় ঠিক নয়। খাদ্যের বেশ অভাব আছে। সরকারি অতিথি হিসেবে আমাকে ভালোই খাওয়ানো দাওয়ানো হচ্ছে বটে, কিন্তু অনেক রেস্তোরাঁতেই একটু দেরি করে গেলেই কিছু পাওয়া যায় না, বাজারে তরিতরকারি ফলমূল বলতে শুধু কিছু আলু আর বিট-গাজর, মাখন আর মাংসের অভাবের কথা লোকের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। আর, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রত্যেক সাক্ষাৎকারেই যেন হুবহু এক কথা শুনতে হয়েছে, বন্ধুত্ব, শান্তি ও সাম্যের জয়গান, কথাগুলো যেন মুখস্থ করা, একেবারে বাঁধা ধরা সরকারি ভাষ্য, বলতে বলতে ওঁরা বারবার হাই-তোলা গোপন করেছেন। তার কারণ কি কে জি বি'র অদৃশ্য ছায়া?
আমেরিকাকে পৃথিবীর সব দেশ গালমন্দ করে। আমেরিকার মধ্যে বসেও সে দেশের সরকারের যদৃচ্ছ সমালোচনা করার কোনও বাধা নেই, এমনকি বিদেশিরাও তা পারে। ওদেশের রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে হাসি-মসকরা চলে অবাধে। কেনেডি হতার পর পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জনসনকে হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে একটা নাটকের অভিনয় আমি দেখেছিলাম ওদেশে, মার্কিন সরকার সে নাটকের মঞ্চানুষ্ঠান বন্ধ করতে পারেনি। সেরকম কোনও আইনের ক্ষমতা সরকারের নেই।
সোভিয়েত ইউনিয়ান, তথা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে সমালোচনার কোনও স্থানই ছিল না। ব্যবস্থার কোনওরকম ত্রুটি সম্পর্কে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করার অধিকার ছিল না সাধারণ মানুষের। কেউ কিছু বলার চেষ্টা করলেই তাকে অদৃশ্য করে দেওয়া হত। স্টালিনের সময় এরকম কোটি কোটি মানুষকে যখন তখন মনুষ্য জন্ম শেষ করে চলে যেতে হয়েছে। বাড়ির মধ্যে বসে স্বামী-স্ত্রী সরকারের কোনও গলদ নিয়ে আলোচনা করতে পারবে না, ছেলেমেয়েদের দিয়ে তাদের ওপর নজর রাখার নজির আছে। সব মিলিয়ে একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
ওইসব দেশের বাইরে যারা সমাজতন্ত্রের সমর্থক কিংবা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা তথাকথিত কমিউনিস্ট বা আরামের জীবনযাপনে অভ্যস্ত, ক্ষমতাভোগী দলের কমিউনিস্ট, তারাও সহ্য করতে পারে না কোনও সমালোচনা। যারা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কোনও বৈপরীত্য নির্দেশ করে কিংবা গোষ্ঠীচক্রের প্রতিবাদ জানায়, অমনি তাদের প্রতি বর্ষিত হয় অজস্র গালি-গালাজ, তারা সমাজতন্ত্রের শত্রু, তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল, তারা ধনতন্ত্রের উচ্ছিষ্টভোজী, তারা স্বার্থপর ও লোভী ইত্যাদি। যুক্তি নয়, শুধু গর্জন। যারা প্রকৃত আদর্শবাদী, তারা সমালোচনাকে এত ভয় পাবে কেন, তাদের মুখের ভাষা এত খারাপ হবে কেন? শাখারভের মতন বৈজ্ঞানিক, পাস্তেরনাক কিংবা সোলঝেনিৎসিনের মতন লেখক, এঁদের বক্তব্য শোনা ও বোঝার বদলে যারা শুধু গালাগালি দেয়, তাদের মনুষ্যত্ব সম্পর্কেই সন্দেহ করা উচিত নয় কি?
যেসব শিল্পী বা লেখক নিজেদের দলভুক্ত নয়, কিংবা পার্টির নির্দেশে চলে না, কিংবা মানবতাবাদকেই একমাত্র অনুসরণযোগ্য মনে করে, তাদের একেবার নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। তাদের রচনায় কোনও গুণই নেই বলে দেগে দেওয়া হয়। শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে এরকম অদ্ভুত বিচারবোধের ফলে এই সব গোঁড়াদের শিল্পসাহিত্যের বোধই নষ্ট হয়ে যায়।
যারা সমালোচনাকে এত ভয় পায় তাদের নিশ্চয়ই গোপন করার অনেক কিছু থাকে। সেই সব বহু গোপন কেলেঙ্কারি এখন ফাঁস হয়ে গেছে। যদি আগে থেকেই সাধারণ মানুষের সব কিছু জানার ও মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকবে, তা হলে এসব কেলেঙ্কারি হয়তো ঘটতেই পারত না। নিজ দেশবাসীর রক্তের সমুদ্রে স্নান করেছেন যে স্টালিন, তার দাপট খর্ব করে কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেতে পারত, চাউসেস্কু হয়ে উঠতে পারত না সমাজতান্ত্রিক দেশে এক স্বৈরাচারী রাজা।
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতা দিয়েও কেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, তা আমি আজও বুঝতে পারিনি। কেন মার্কসবাদীরা ব্যক্তি স্বাধীনতার এমন ঘোরতর বিরোধী? পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে গিয়ে আমি দেখেছি, সেই সব দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের মূলে যে দুটি প্রধান কারণ, তার প্রথমটি অবশ্যই খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব, দ্বিতীয়টি ওই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতার অনধিকার। এতদিন পর যেন মাথার ওপর থেকে বিরাট ঢাকনা তুলে নেওয়ার পর সকলের মুখে খই ফুটছে। কবি ইয়েফতুশেঙ্কো সেইজন্যই বলেছেন, বাক-স্বাধীনতার বদলে আমরা যেন পেয়ে গেছি বকবকানির স্বাধীনতা! প্রথম প্রথম তো এরকম হতেই পারে।
আধুনিক পৃথিবীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তির একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত তো বটেই, এমনকি চাঁদের অভিযাত্রীদের সঙ্গেও টেলিফোনে কথা বলা যায়। বেতারে ও টেলিভিশানে শোনা ও দেখা যায় এক রাষ্ট্র থেকে অন্যান্য রাষ্ট্রের সংবাদ ও সমাজচিত্র। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে সাধারণ মানুষদের এই রকম যোগাযোগের তো সুযোগ দেওয়াই হয়নি, সবরকম যাতায়াতের পথ রুদ্ধ করে তুলে দেওয়া হয়েছে কঠিন দেওয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া, যেখানে পাহারা দিয়েছে হিংস্র কুকুর ও মারাত্মক অস্ত্রধারী সৈনিকরা। দেশের মানুষকে সব সময় ভয় দেখিয়ে এ কীরকম সাম্যবাদ!
লেনিন নাকি বলেছিলেন, বাড়ির বাইরের কোনও দিক থেকে যদি দুর্গন্ধ আসে, তা হলে সেদিকের জানলাটা বন্ধ করে রাখতে হয়। মনে হয়, কথাটায় আপাত যুক্তি আছে, লেনিনের সময় সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রকে বহুরকম শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এরকমভাবে পশ্চিমের জানলা কিছুদিন বন্ধ করে রাখার প্রয়োজনীয়তাও হয়তো ছিল। কিন্তু সত্তর বছর ধরে কোনও জানলা বন্ধ রাখা যায়? সত্যিই দুর্গন্ধ আসছে কি না তা বাড়ির মালিক একবার জানলা খুলে দেখতে পারবে না? রাজধানী থেকে কয়েকজন নেতা তা ঠিক করে দেবে! হাঙ্গেরি কিংবা চেকোস্লোভাকিয়াতে কেউ জানলা খুলতে চাইলে মস্কোর নির্দেশে ট্যাংক পাঠিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে!
লেনিনের পরবর্তী নেতারা দেখলেন, এরকম জোর-জবরদস্তি করে দেশের সাধারণ মানুষকে কূপমণ্ডূক অবস্থায় রাখতে পারলে নিজেদের ক্ষমতায় টিঁকে থাকা নির্বিঘ্ন হবে। স্টালিন যে অজস্র নরহত্যা করিয়েছিলেন, তা কি সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য, না ক্রেমলিনে নিজের আসনটি পাকা করার জন্য? দেশত্যাগী ট্রটস্কিকে নৃশংসভাবে খুন করাবার আর কী কারণ থাকতে পারে!
জানলা বন্ধ রাখার এতরকম কলাকৌশল যারা করেছিল, তারা অন্য দিকটা ভেবেও দেখেনি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি / সত্য বলে আমি তবে কোথা গিয়ে ঢুকি?' কিংবা তারা আসলে সত্যকেই ভয় পেত?
পশ্চিমের দুর্গন্ধের অপর নাম ভোগ্যপণ্য। এই ভোগ্যপণ্য শব্দটি হচ্ছে ভাষার চাতুরি, মিথ্যেকে ঢাকার প্রয়াস। দাঁত মাজার টুথপেস্ট, গায়ে মাখার সাবান, পায়ে দেওয়ার জুতো, টয়লেটের কাগজ, এগুলি কি ভোগ্যপণ্য না নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস? সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি এগুলোও কেন ঠিকঠাক দিতে পারেনি সমস্ত নাগরিকদের? বড় বড় মার্কসবাদী তাত্বিকরা এই ত্রুটি লক্ষ করেননি! পাউরুটির সঙ্গে মাখন আমাদের মতন দেশে এখনও বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে বটে, কিন্তু ইউরোপে বহু যুগ ধরে এটা সাধারণ মানুষের অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। তা থেকে তাদের বঞ্চিত করা যায় না। বরং বলা যেতে পারে যে মিসাইল, রকেট, মহাকাশযান এই সবগুলোই সমাজতান্ত্রিক দেশের শাসকদের ভোগ্যপণ্য, বিলাসিতার দ্রব্য।
পোল্যান্ডের সাধারণ মানুষ যদি জানতে পারে যে পাশের দেশ ফ্রান্স গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও সে দেশের সমস্ত মানুষই রুটির সঙ্গে মাখন মাংস খেতে পায়, তা হলে তারা সমাজতন্ত্রের ওপর শ্রদ্ধা রাখবে কী করে? মার্কসবাদ তো মানুষকে দুঃখে-কষ্টে-নিপীড়নের মধ্যে রাখার কথা বলেনি, মার্কসবাদ তো এক সুখী সমৃদ্ধ সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছে।
মাত্র দু-বছরের বিপরীত ধরনের ঘটনা ও ওলোটপালট দিয়ে ইতিহাসের বিচার করা যায় না। সমাজতন্ত্রকে নস্যাৎ করা যায় না। কিন্তু এইসব প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যায়।
মনের মধ্যে এমন ধরনের অনেক প্রশ্ন নিয়েই আমি দ্বিতীয়বার উপস্থিত হলাম মস্কো শহরে। আগেরবার আমাকে রাখা হয়েছিল অতিকায় সুরম্য হোটেল ইউক্রানিয়ায়। এবারও উঠলাম সেই একই হোটেলে। আগেরবার বিমানের মধ্যেই সুবোধ রায় নামে এক যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এই সাড়ে সাত বছরে তার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা জন্মে গেছে। এবারে বিমানবন্দরে কোনও সরকারি প্রতিনিধি নেই, কিন্তু উপস্থিত রয়েছে সুবোধ এবং তার ছোট ভাই সমর রায়।
খুব সম্ভবত সুবোধ রায়ই একমাত্র বাঙালি, যে গত অগাস্ট মাসের আড়াই দিনের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, রাশিয়ার পার্লামেন্টের সামনে ট্যাংক বাহিনী, ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ সব কিছু নিজের চোখে দেখেছে। গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য দিনরাত পাহারা দিয়েছে যে অতন্দ্র জনতা, সুবোধ ছিল সেই জনতার একজন।
২
একটা বড় রকমের পরিবর্তনের দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে নেওয়ার আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গরবাচেভ বিশ্রাম নিতে গিয়েছিলেন তাঁর বাগানবাড়িতে। কৃষ্ণ সাগরের নিকটবর্তী ক্রিমিয়ার এই ডাচা-তে তাঁর পরিবারের সকলেই উপস্থিত। দু-দিন বাদেই মস্কোতে ফিরে কাজাকাস্তানের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর নতুন এক চুক্তি স্বাক্ষর করার কথা, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলিকে অনেকখানি স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিয়ে দেওয়া হবে। রবিবার, ১৮ অগাস্ট, ১৯৯১, বিকেলবেলা গরবাচেভ বসে বসে সেই চুক্তি সম্পাদনের সময় কী বক্তৃতা দেবেন তার খসড়া তৈরি করছেন। কাছাকাছি আর একটি ছুটি ভবনে রয়েছেন জর্জি শাখলাঝারভ নামে একজন পরামর্শদাতা ও বন্ধু, গরবাচেভ তাঁকে টেলিফোন করে গল্প করলেন কিছুক্ষণ। মনোরম পরিবেশে এক শান্ত অপরাহ্ন। কোথাও কোনওরকম অস্বাভাবিকতার ছায়া নেই।
ঘণ্টাখানেক বাদে সেই বাড়ির বাইরে শোনা গেল গাড়ি থামার শব্দ, জুতোর আওয়াজ করে একদল লোক ঢুকে এল ভেতরে। গরবাচেভ-এর নিরাপত্তারক্ষীদের প্রধান হন্তদন্ত হয়ে প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষে এসে জানাল যে কয়েকটি ব্যক্তি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চায়। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এমনভাবে যখন তখন দেখা করা যায় না, নিরাপত্তা রক্ষীরা থাকতেও তারা ভেতরে ঢুকল কী করে? ওরা কারা? রক্ষীদের প্রধান জানালো যে ওই দলটিতে রয়েছে ইউরি প্লেখানভ, সমস্ত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষীদের সে প্রধান, তাকে বাধা দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। হঠাৎ সাংঘাতিক কিছু না ঘটলে এরকম বেয়াদপি দেখানো অসম্ভব, তাই প্রকৃত ব্যাপার জানবার জন্য গরবাচেভ মস্কোতে টেলিফোন করতে গেলেন। প্রথম ফোনটি বিকল। বাড়িতে মোট পাঁচটি টেলিফোন, একে একে তুলে দেখা গেল, সব ক'টিই নিঃশব্দ। অর্থাৎ লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে।
বাইরের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার একটাই অর্থ হয়। তিনি আর প্রেসিডেন্ট নেই। এক সময় প্রেসিডেন্ট ত্রুশ্চেভের হাত থেকে টেলিফোন কেড়ে নেওয়ার ঘটনা সকলেরই জানা। গরবাচেভ অন্দর মহলে গিয়ে স্ত্রী ও মেয়েজামাইদের ডেকে বললেন, তোমরা মন শক্ত করো, আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এরা আমাকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করবে কিংবা অজানা কোনও জায়গায় সরিয়ে ফেলবে।
এরপর তিনি এলেন অফিস ঘরে। অনাহূত অতিথিরা সেখানে আগেই চেয়ার দখল করে বসে আছে। তাদের মধ্যে রয়েছে প্রেসিডেন্টের নিজস্ব বাহিনীর প্রধান ভালেরি বলডিন, এবং আরও কয়েকজন সরকার ও পার্টির হোমরা-চোমরা। এরা অনেকেই গরবাচেভ-এর বিশ্বস্ত বলে পরিচিত ছিল। ভালেরি বলডিনকে গরবাচেভ নিজে বেছে নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়েছেন। এই আগন্তুক দলটি দাবি জানালো যে, গরবাচেভকে জরুরি অবস্থা ঘোষণাপত্রে সই করতে হবে এবং উপরাষ্ট্রপতি গেন্নাদি ইয়ানাইয়েভ-এর হাতে সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে।
গরবাচেভ বললেন, তোমরা গোল্লায় যাও!
এরপর বিদ্রোহীদের মধ্যে কোনও একজনের একটা রিভলবার বার করে রাষ্ট্রপতির বুকে পরপর ছ'টা গুলি দেগে দেওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিংবা তাঁর চোখ-মুখ বেঁধে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া উচিত ছিল কোনও গুপ্ত স্থানে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। কে জি বি-র একটি বাহিনী ঘিরে রইল সেই বাড়ি, নিকটবর্তী বিমানবন্দরটির রানওয়ে খুঁড়ে দেওয়া হল, যাতে গরবাচেভ কোনওক্রমে প্লেনে না পালাতে পারেন।
পরদিন সকালে সোভিয়েত দেশের প্রধান সংবাদ সংস্থা তাস জানাল যে প্রেসিডেন্ট গরবাচেভ অসুস্থ, তাই তিনি তাঁর সমস্ত ক্ষমতা ইয়ানাইয়েভ-এর ওপর হস্তান্তর করেছেন এবং আট সদস্য বিশিষ্ট এক কমিটির নেতৃত্বে সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সমস্ত মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ। গরবাচেভ-এর অসুস্থতার কথা কেউ বিশ্বাস করল না, অনেকেই ধরে নিল, গরবাচেভ এর মধ্যেই নিকেশ হয়ে গেছেন। মস্কোর রাস্তায় তখন শোনা যাচ্ছে ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দ। রেড স্কোয়ার-এর সেই বেসিলস ক্যাথিড্রাল-এর পাশে, বলশয় থিয়েটারের সামনে স্থাপিত হয়েছে রায়ট পুলিশ ভরতি বহু ট্রাক। স্পষ্টই এক অভ্যুত্থান। গরবাচেভ গেছেন, এবার ইয়েলেৎসিনের পালা। হয় হত্যা, অথবা নির্বাসন। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটবার আগেই ইয়েলেৎসিন বাড়ি ছেড়ে দ্রুত চলে এলেন রুশ পার্লামেন্ট ভবনে। সেখানে ততক্ষণে তার কিছু সমর্থকও জমায়েত হয়েছে। এ এমনই এক অভ্যুত্থান যে, যারা এর পক্ষে এবং যারা এক বিপক্ষে, দু-দলেরই বিমূঢ় অবস্থা। যারা পক্ষে তারা ভাবছে যে কোনওরকম বাধা না পেয়েও অভ্যুত্থানের নায়করা সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব নিতে পারছে না কেন? যারা বিপক্ষে, তারা ভাবছে, এ ধরনের অভ্যুত্থানের পর যেসব সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটবার কথা, তা কেন ঘটছে না? যারা সংবিধান ও আইনসঙ্গত উপায় বর্জন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে, তাদের খানিকটা বিবেকহীন নিষ্ঠুরতা দেখাতেই হয়। কিন্তু ইয়েনাইয়েভ ও তার সহচররা এখনও এত দুর্বলতা দেখাচ্ছে কেন? সোভিয়েত ইউনিয়ানের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রজাতন্ত্র রাশিয়া, তার প্রেসিডেন্ট ইয়েলেৎসিন এককালের কমিউনিস্ট নেতা হয়েও এখন ঘোর কমিউনিস্ট বিরোধী, সেই লোকটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, দর্পিত, বিলাসী, স্পষ্টত পশ্চিম-ঘেঁষা। কিন্তু ইয়েলেৎসিন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত, বিপুল জনসমর্থন পেয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন, রুশ প্রজাতন্ত্রের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁর হাতে। একে না সরিয়ে ফেললে কোনও অভ্যুত্থান সার্থক হতে পারে না।
মস্কোভা নদীর তীরে ট্যাংক বাহিনী এসে উপস্থিত, কিন্তু ইয়েলেৎসিনের ওপর কোনও আঘাত হানার চেষ্টা হল না। ইয়েলেৎসিন নিজেও যেন এটা বিশ্বাস করতে পারেননি। সকাল সাতটার মধ্যে তিনি রাশিয়ান পার্লামেন্ট ভবনে পৌঁছে গিয়েছিলেন কিন্তু কীভাবে পাল্টা আক্রমণ করবেন, তা বুঝে উঠতে পারেননি দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। ইয়েলেৎসিন-এর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, পালাবদল ঘটছে সোভিয়েত নেতৃত্বে, কিন্তু রুশ প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে, রাশিয়ান ভূমিতে অধিষ্ঠিত সেনা বাহিনী ও কে জি বি-র আইনসঙ্গত সর্বাধিনায়ক তিনি, এই অধিকারের কথা ঘোষণা করলে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত হবে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে ইয়েলেৎসিন দ্বিধা ও সংশয়ের মধ্যে ছিলেন। রুশ বাহিনী ও সোভিয়েত বাহিনীর মধ্যে ভাগাভাগির প্রশ্ন এনে ফেললে যে-কোনও মুহূর্তে গৃহযুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা। যুগোশ্লাভিয়ায় যেমন ঘটছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে এই গৃহযুদ্ধ অনেক বেশি রক্তাক্ত হবে।
শেষ পর্যন্ত মনঃস্থির করে, সোমবার দুপুর সাড়ে বারোটার সময় ইয়েলেৎসিন বেরিয়ে এলেন রুশ পার্লামেন্ট ভবন থেকে। একটা সাঁজোয়া গাড়ির ওপর উঠে দাঁড়িয়ে ইয়েলেৎসিন ঘোষণা করলেন যে এই অভ্যুত্থান অবৈধ। ইয়েনাইয়েভ-এর রাষ্ট্রপতিত্বে কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। রুশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি জরুরি অবস্থা জারির নির্দেশ মানছেন না। প্রতিবাদ হিসেবে তিনি দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিচ্ছেন।
ইয়েলেৎসিনের সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাতটি দশকের ইতিহাস রূপান্তরিত হয়ে গেল।
এইসব ঘটনার বিবরণ আমরা সংবাদপত্রে পাঠ করেছি, দূরদর্শনে জ্যান্ত দেখেছি। তবু আমি সুবোধ রায়ের মুখে আবার শুনছিলাম। হোটেল ইউক্রানিয়ার পাশেই মস্কোভা নদী। তার ওপাশেই রুশ পার্লামেন্ট ভবন, সাদা রঙের ওই প্রাসাদটির ডাক নাম হোয়াইট হাউজ। ওই বাড়িটির সিঁড়ি, নদীর ওপরে ব্রিজ, তার নীচের এবং পাশের রাস্তা, এই এলাকাটুকুই এখানকার পানিপথ। হোটেলের জানলা দিয়েই সব দেখা যায়।
ইয়েলেৎসিন যখন তাঁর প্রথম বক্তৃতাটি দেন, তখন সুবোধ সেখানে যায়নি। মস্কোর অগণ্য নাগরিকরাও সেখানে গিয়ে ভিড় জমায়নি। ইয়েলিৎসিন প্রথম থেকেই যে বিরাট জনসমর্থন পেয়েছিলেন, তা ঠিক নয়। সোভিয়েত দেশের মানুষ অনেককাল ধরেই সরকারের সবরকম ডিক্রি মানতে অভ্যস্ত, কে জি বি-র ভয় পদে পদে। ইদানীং গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রাইকার খানিকটা খোলামেলা হাওয়া বইলেও তা দিয়ে কামান-বন্দুকের গোলাগুলি যে আটকানো যাবে, সে ভরসা কোথায়! অভ্যুত্থান ঘটিয়ে যারা সরকারি ক্ষমতা নিয়েছে, কামান-বন্দুক সবই তো তাদের দখলে।
সেইজন্যই ইয়েলেৎসিনের প্রথম বক্তৃতার সময় সেখানে সর্ব সাকুল্যে দুশোর বেশি শ্রোতা ছিল না। কয়েকটা গোলা ছুড়েই ভয় দেখিয়ে এই জনতা ছত্রভঙ্গ করা যেতে পারত, ইয়েলেৎসিনকে বন্দি করা সহজ ছিল। কিন্তু কেন অভ্যুত্থানের নেতারা দ্বিধা করতে লাগলেন, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। দেশের অভ্যন্তরে কোনও বড় রকম প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি, বিদেশেও কোনও তীব্র প্রতিক্রিয়া ছিল না। ব্রিটেন, আমেরিকা সমেত পশ্চিমি দেশগুলি দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় কিছু মন্তব্য করলেও সরাসরি বিরুদ্ধাচরণের কোনও হুমকি আসেনি। অভ্যুত্থান, রাষ্ট্রপতি বদল এ সব প্রত্যেক দেশেরই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, তাতে অন্য দেশের মাথা গলানোর নজির নেই। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনও রাষ্ট্রনায়ককে খুন করে কোনও সামরিক শাসক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও কিছুদিনের মধ্যেই সে দেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে যায়। পরে জানা গেছে, পশ্চিমি দেশগুলি ইয়ানাইয়েভ-এর নেতৃত্বকে মেনে নেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। অভ্যুত্থানকারীরা এসব সুযোগ নিতে পারল না।
সোমবার বিকেল পাঁচটায় অভ্যুত্থানকারীরা ডাকল প্রেস কনফারেন্স। সেখানেও তাদের বক্তব্য অত্যন্ত অস্পষ্ট। তারা জানাল যে, গরবাচেভ অত্যন্ত অসুস্থ বলে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নিতে অক্ষম, তাই সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইয়ানাইয়েভ-কে। তারা সোভিয়েত ইউনিয়ানকে দুর্বল হতে দেবে না, সংস্কারের কাজগুলোও চালিয়ে যাবে। তাদের এই ক্ষমতাগ্রহণ সংবিধানসম্মত ইত্যাদি।
দেশের মানুষ এতে কী বুঝবে? রাষ্ট্রপতি গরবাচেভ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে উপরাষ্ট্রপতির কাজ চালিয়ে যাবেন, এ তো স্বাভাবিক। তার জন্য অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে কেন, জরুরি অবস্থাই বা জারি করতে হবে কেন? গরবাচেভকে বাদ দিয়ে যদি নতুন সরকার গড়া হয়, তা হলে ইয়ানাইয়েভের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন হল কখন সুপ্রিম সোভিয়েতে? কী করে এই পালাবদল সংবিধানসম্মত হয়?
ততক্ষণে ইয়েলেৎসিনের প্রতিবাদী ঘোষণার কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে। রুশ পার্লামেন্ট ভবন ঘিরে অনেক ট্যাংক জমায়েত হয়েছে বটে কিন্তু গুলি গোলার শব্দ নেই। আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে লাগল, ক্রমে সহস্র থেকে তা পরিণত হল লক্ষে লক্ষে। একবার ভয় ভেঙে গেলে আর কোনও বাধাকেই বাধা বলে মনে হয় না। যে-কোনও মূল্যে এই অভ্যুত্থানকে রোখার জন্য শপথের গর্জন শোনা গেল, অনেকে ট্যাংকের ওপর উঠে নাচানাচি শুরু করল। এতকালের পরিচিত কাস্তে-হাতুড়ি লাঞ্ছিত রক্ত পতাকার বদলে এসে গেল রুশ প্রজাতন্ত্রের পুরোনো আমলের ত্রিবর্ণ পতাকা।
লেনিনগ্রাডেও একই অবস্থা। সেখানকার নির্বাচিত মেয়র আনাতোলি সোবচাক প্রথম থেকেই অভ্যুত্থানের ক্ষমতা দখলকে সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সমবেত হল অসংখ্য মানুষ। যে সেনাবাহিনী সিটি কাউন্সিল দখল করতে আসছিল, তারা জনতার প্রতিরোধে লেনিনগ্রাড শহরে ঢুকতেই পারল না। লেনিনগ্রাডের বিখ্যাত উইন্টার প্যালেস, যার সামনে ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে প্রথম বিপ্লব শুরু হয়েছিল, এখন সেখানেই অজস্র মানুষ অস্বীকার করল লেনিনবাদ। ইতিহাসের কী বিচিত্র নিয়তি!
এর মধ্যে বালটিক রাষ্ট্রগুলি তো বটেই, তা ছাড়াও ইউক্রাইন, মালডাভিয়া, বেলোরাশিয়া, উজবেকিস্তান ইত্যাদি অন্যান্য রাষ্ট্রও এই অভ্যুত্থানকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করল, তাদের কোনও নির্দেশই মানতে সম্মত হল না। সাইবেরিয়ার খনি শ্রমিকরা ধর্মঘটের হুমকি দিল।
মস্কোয় যখন জনসাধারণ সমস্ত ভয় ঝেড়ে ফেলে সেনাবাহিনীকেও তুচ্ছ করে দিয়েছে, প্রতিবাদ নিয়েছে এক উৎসবের রূপ, তখন সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছে সুবোধ রায়, ইতিহাসের এক বিরাট সন্ধিক্ষণের সে সাক্ষী। তার হোটেলের সামনেই রয়েছে কয়েকটা ট্যাঙ্ক। সেই ট্যাঙ্কগুলি চালিয়ে এনেছে তরুণ সৈনিকেরা। তাদের মুখগুলি উদভ্রান্তের মতন। তাদের একজনকে সুবোধ জিগ্যেস করেছিল, তুমি কি নিজের দেশের মানুষের ওপর গুলি চালাবে? সে প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলেছিল, না। তারপর তাকে জিগ্যেস করা হল, তবে তুমি এখানে এসেছ কেন? সে বলেছিল, তা তো জানি না। আমাকে আসতে বলা হয়েছে...।
চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেলেও সেই ট্যাংক চালকরা কোনও খাবার পায়নি। এমনই অব্যবস্থা যে, রুশ পার্লামেন্ট ঘিরে রাখার জন্য সেনা পাঠানো হল, কিন্তু তারা কী খাবে তা নিয়ে চিন্তা করেনি কেউ। শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদকারী জনতাই তাদের হাতে রুটি তুলে দিয়েছে।
এত বড় একটা পরিবর্তন ঘটে গেল সোভিয়েত ইউনিয়নে, তথা পৃথিবীতে, বিনা রক্তপাতে। কালিনিস্কি ব্রিজের কাছে যে তিনজন মানুষ নিহত হল, তা নিছক দুর্ঘটনা। তারা ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ ট্যাংকের মুখ ঘোরাতেই তাদের আঘাত লাগে।
পৌনে তিনদিনের এই অভ্যুত্থান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেল কেন? এ রকম একটা দুর্বল, অপটু অভ্যুত্থানেরও কারণ বোঝা যায় না। ক্ষমতা যারা দখল করতে চায়, তারা দখলের প্রক্রিয়াগুলো পালন করবে না! ভয় ও সন্ত্রাস সৃষ্টিই তো প্রধান অস্ত্র। কিছু রক্তস্রোত গড়াবেই, সোভিয়েত ইউনিয়নে মানুষ মারা তো নতুন কথা নয়! যারা দেশটাকে আবার স্তালিন জমানায় ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল, তারা ভয় পেয়েছিল জনসাধারণ নামে এক বস্তুপিণ্ডকে? কিংবা সেনাবাহিনী তাদের বশ্যতা স্বীকার করবে কিনা, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত ছিল না? বিমানবাহিত বাহিনী তুলস্কায়া এবং ট্যাংকবাহিনীর কিছু অংশ তো ইয়েলেৎসিনের দিকেই চলে গিয়েছিল। সৈন্যবাহিনীকে গুলি চালাতে বললে তারা অস্বীকার করত? চিনে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে দু বছর আগের ছাত্র বিপ্লবের সময় বেশ কয়েক ঘণ্টা চিনা শাসকদের ভাগ্য অনিশ্চিত ছিল। সেনাবাহিনী নিজেদের পুত্র ও ভাইয়ের মতন ছাত্রদের হত্যা করতে রাজি হবে কি না। সেবার ট্যাংকের কামানের নলগুলি মুখ ঘোরালেই চিন সরকারের পতন ঘটত। শেষ পর্যন্ত সৈন্যবাহিনী অবাধ্য হয়নি, তারা কর্তব্যের খাতিরে তিন হাজার ছাত্রকে গুলি করে ও ট্যাংকের তলায় পিষে মেরেছে। কিন্তু প্রাচ্য দেশগুলিতে প্রাণ দেওয়া ও নেওয়া এখনও যত সহজ, ইউরোপে আর তেমন পরিবেশ নেই। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জনসাধারণ যখন রাস্তায় নেমেছে, তখন সেনাবাহিনী তাদের ওপর গুলি চালাতে প্রত্যাখ্যান করেছে। সাধারণ মানুষ কোনও কোনও দেশে ট্যাংকের কামানোর ডগায় পরিয়ে দিয়েছে ফুলের মালা।
সোভিয়েত সৈন্যরাও তাদের স্বদেশবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করতে এখনও রাজি কি না, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন।
এত সহজে অভ্যুত্থানের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে গেল বলে অনেকের সন্দেহ জেগেছে যে পুরো ব্যাপারটাই সাজানো নয় তো? স্বয়ং গরবাচেভই কলকাঠি নেড়েছেন পেছন থেকে? এই সন্দেহের কথা অনেকে প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন, আমি গিয়েও শুনেছি। ক্রিমিয়ার বিশ্রাম-ভবনে সত্যি কী ঘটেছিল, তা সকলে জেনেছে গরবাচেভের মুখ থেকেই। কেন তাঁকে বন্দি করা হল না? তা হলে কি তিনি নিজেই এই নকল অভ্যুত্থানের উস্কানি দিয়ে আবার তার পতন ঘটালেন। এতে সুকৌশলে পার্জিং হল, জনসাধারণের প্রকৃত মনোভাবও জেনে নেওয়া হল। পুরোটাই যেন একটা নাটক, এর শেষে নায়ক হিসেবে ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করে নিলেন গরবাচেভ।
এই সন্দেহও সত্যি না মিথ্যে, তা জানতে হয়তো আরও ঢের দিন লেগে যাবে। আমরা অনেকেই নাটক পছন্দ করি, কিন্তু এই নাটকটিও তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়। গরবাচেভ একা সবাইকে বোকা বানালেন, তিনি এত বুদ্ধিমান আর বাকিরা সবাই নির্বোধ? অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারীরা পরে দু-একজন আত্মহত্যা করেছে, বাকিরা ধরা পড়েছে। তারা গরবাচেভ-এর চক্রান্ত কেন ফাঁস করে দিচ্ছে না? এদেশে সংবাদপত্র এখন স্বাধীন, তারা খুঁজে বার করতে পারছে না প্রমাণ? তা ছাড়া, নাটকের শেষে ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হল এবং ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেল ইয়েলেৎসিনের, গরবাচেভের তো নয়! তিনি যেন অনেকটাই করুণার পাত্র।
ষড়যন্ত্রকারীরা যে স্বার্থান্বেষী ও দুর্বল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে এদের অনেকেরই চাকরি যাবে কিংবা পদমর্যাদা অকিঞ্চিৎকর হয়ে যাবে, এই আশঙ্কাতেই তারা যে-কোনও উপায়ে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। সে যোগ্যতা তাদের আছে কি না বুঝে দেখেনি। গরবাচেভ-ইয়েলেৎসিনকে বন্দি করার বদলে তারা নিজেরাই বিপদের ভয়ে কাঁপছিল। সবাই দেখেছে যে প্রেস কনফারেন্সের সময় ইয়ানাইয়েভের মুখ ছিল পাণ্ডুর বর্ণ এবং হাত কাঁপছিল সত্যিই। পরে গরবাচেভ বলেছেন, ওরা প্রচার করেছিল যে, আমি অসুস্থ, কিন্তু আসলে অসুস্থ ছিল তো ওরাই।
এই এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ফলে সত্যিই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। নিষিদ্ধ হল কমিউনিস্ট পার্টি। বিশ্বের প্রথম ও সর্ববৃহৎ সমাজতান্ত্রিক দেশে সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা অসফল বলে গণ্য হল। ফাঁস হয়ে গেল যে দেশের মানুষকে না খাইয়ে রাখা এবং নানাভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে সমাজতন্ত্রের নামে।
সোভিয়েত পার্লামেন্টের সাদা ধপধপে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমি বেশ বিষণ্ণ বোধ করলাম। মাত্র কিছুদিন আগে এখানে এক বিপ্লব ঘটে গেছে, এখন তার কোনও চিহ্নমাত্র নেই। কোনও পাহারা নেই, কোথাও মিলিটারি বা পুলিশ চোখে পড়ে না, অনেকে ব্যস্তভাবে যাতায়াত করছে, আমরাও যদৃচ্ছ ঘুরছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় একজন ভারতীয় হিসেবে আমার খুশি হওয়ার কোনও কারণ নেই। এ দেশের অভ্যন্তরে কতরকম অনাচার ঘটেছে তা আমাদের অজানা ছিল বটে, কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবরই ভারতবন্ধু। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ান যে কোনো সঙ্কটের সময় ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীর প্রশ্নে আমরা সব সময় সোভিয়েত দেশের সমর্থন পেয়েছি। আমি আগের বার এসে যখন এ দেশে ঘুরেছি, তখন সর্বত্র সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার পেয়েছি। রাস্তার লোক এসে ভারতীয় বলে চিনতে পেরে খাতির করেছে, এমনটি আর কোনও দেশে ঘটে না। সেই দেশের রূপ বদলে গেল, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেল? ভারত কি এবার হারাবে তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধুকে!
আর একটি প্রশ্নও অনবরত ঘুরতে থাকে মাথার মধ্যে। এত সহজে কী করে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল এ দেশে? সি পি এস ইউ, দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি, দারুণ তার প্রতিপত্তি, একটি মাত্র নিষেধাজ্ঞায় সেই পার্টি একেবারে স্তব্ধ? কোনও প্রতিবাদ হল না? এখানকার মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, মিছিল-সমাবেশে কোনও বারণ নেই। কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে হাজার হাজার ক্যাডাররা রাস্তায় নেমে এল না কেন? এই পার্টির ক্যাডাররা সব দেশেই লড়াকু হয়, তারা ভয় পাবে কেন, বিশেষত যখন লাঠি-গুলির আশঙ্কাও নেই? কমিউনিস্ট পার্টির ওপর মহলের নেতারা না হয় অভ্যুত্থান সমর্থন করার লজ্জায় কিংবা নিজেদের নানারকম দুষ্কর্ম গোপন করার জন্য আড়ালে রয়ে গেছে, কিন্তু ক্যাডারা কেন পার্টির সমর্থনে প্রকাশ্যে দেখা দিল না?
তা হলে কি এত বড় সি পি এস ইউ নিছক একটা মাথা ভারী পার্টি হয়ে গিয়েছিল, যার শুধু এক গুচ্ছ নেতা আছে ক্যাডার নেই?
৩
মস্কোয় পৌঁছোবার আগে আমাকে জার্মানির অনেকগুলো শহর ঘুরতে হয়েছে। ভারত উৎসব চলছে সে দেশে, সেই সূত্রে আমন্ত্রণ। এর আগে জার্মানির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে দেখার সুযোগ আমার হয়নি, এখন পূর্ব-পশ্চিম একাকার, দুই দিকের মিলনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। দেওয়াল ভাঙার উদ্মাদনা ও উল্লাস থিতিয়ে গেছে অনেকখানি, লাভ-লোকসান নিয়ে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। এত বড় একটা পরিবর্তনের পর কিছু বিশৃঙ্খলা ও সমস্যার সৃষ্টি হবেই। পূর্ব জার্মানির মানুষ স্বাধীন হয়েছে বটে কিন্তু পশ্চিম জার্মানির মতন যে তাৎক্ষণিক সমৃদ্ধি আশা করেছিল, তা জোটেনি। পশ্চিমেও কর-বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য জমা হয়েছে কিছু কিছু ক্ষোভ। কিন্তু জার্মানির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমনই সুদৃঢ় যে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও কোনও কিছুই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়নি, পাওয়া যায় সব কিছুই, কালোবাজারির প্রশ্নই ওঠে না, দরবৃদ্ধিও বেসামাল রকমের নয়।
পূর্ব দিকে অনাধুনিক কলকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে, চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতার আশঙ্কায় তুর্কি ও ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশি ও শ্রীলঙ্কার ইমিগ্রান্টসদের ওপর হামলা চলছে কোনও কোনও জায়গায়, উগ্রপন্থী নব-নাতসি দলেরও সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের দেশে এসব কোনও কিছুই লুকিয়ে রাখা যায় না। দুই জার্মানির মিলনের এমন তাড়াহুড়োর কী দরকার ছিল, এ প্রশ্ন অনেক জায়গাতেই শোনা যায়। পূর্ব জার্মানির দিকে কেউ কেউ তিক্তভাবে বলে, দুই জার্মানির মিলনের ফলে আমরা কী পেলাম? এর চেয়ে আগের অবস্থাটাই বা মন্দ ছিল কী? ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর যখন নানারকম ডামাডোল শুরু হয়েছিল, চাল-চিনি-কাপড়-কয়লার জন্য রেশনের লাইনে দাঁড়াতে হত, তখনও কিছু বয়স্ক লোক বলত, এর থেকে ইংরেজ রাজত্ব ভালো ছিল!
পশ্চিম দিকের লোকদের কাছে পূর্ব দিকের লোকরা এখনও অনেকটা গরিব আত্মীয়ের মতন। ট্রেনে যাওয়ার সময় এক পূর্ব দিকের সহযাত্রী এই সব প্রসঙ্গ তুলে আলোচনা করতে-করতে বলল, বহু বছর আমরা দেওয়ালের ওপাশে ছিলাম, দেওয়াল ভাঙার জন্য ব্যাকুলতা ছিল ঠিকই, কিন্তু এখন দেখছি, ওদের সঙ্গে আমাদের মানসিক ব্যবধান এতটাই তৈরি হয়ে গেছে যে, একমাত্র ভাষার মিল ছাড়া আমাদের দু'দিকের জার্মানদের আর কী মিল আছে?
একজন বঙ্গবাসী ও ভুক্তভোগী হিসেবে আমি মনে-মনে বললাম, ভাগ্যিস তোমাদের ধর্মের অমিল নেই! তা হলে নিশ্চিত এতদিনে মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে যেত।
দুই অসম দিকের মিলনের ফলে বেশ কিছু বিক্ষোভ, হতাশা, তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু গোটা জার্মানির জীবনযাত্রায় তার প্রভাব বিশেষ পড়েনি। বেকাররা যা ভাতা পায়, তাতে তাদের খাদ্য-বস্ত্র পানীয় ঠিক জুটে যায়। মিটিং-মিছিল হয়, কিন্তু তার জন্য যানবাহন বা উৎপাদন বন্ধ থাকে না। এশিয়ান ইমিগ্রান্টসদের ওপর হামলা হচ্ছে বটে, আবার বহু জার্মান তার প্রতিবাদও জানাচ্ছে। জার্মান মুদ্রা বিশ্বের বাজারে এখনও অত্যন্ত সুদৃঢ়। ডলারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার দাম বাড়ছে।
জার্মানি থেকে মস্কোয় এসে প্রথমেই যেটা চোখে বিসদৃশ লাগে, তা হল রাস্তাঘাটের অবস্থা এবং সোভিয়েত মুদ্রা রুবলের হেনস্থা।
জার্মানির পশ্চিম অঞ্চলের রাস্তা একেবারে একঘেয়ে রকমের নিখুঁত। রেসশাইড থেকে বার্লিনে ফিরেছিলাম গাড়িতে বেশ কয়েকশো কিলোমিটার, কোথাও একটা গর্ত নেই, উঁচু-নীচু নেই। সেই তুলনায় মস্কোর রাস্তায় অনেক ফাটল ও খন্দ। সাড়ে সাত বছর আগেও এরকম দেখিনি। সরাসরি কলকাতা থেকে গেলে হয়তো এসব চোখে পড়ত না। কলকাতার সঙ্গে কোনও জায়গারই তুলনা হয় না, কলকাতা সত্যিই অতুলনীয়, এত খারাপ রাস্তা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। মস্কোর রাস্তা কলকাতার তুলনায় অবশ্যই ভালো, কলকাতার মতন এত নোংরা আবর্জনা সেখানে নেই।
আগে এক রুবলের সরকারি মূল্য ছিল দেড় ডলারের কাছাকাছি। আগেও ডলারের ব্ল্যাক মার্কেট ছিল অবশ্যই। কিন্তু আমি সরকারি অতিথি হিসেবে এসে সে ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। গত দু-তিন বছরে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে স্থানীয় মুদ্রার সঙ্গে ডলারের সরকারি ও বেসরকারি মূল্যমানের ব্যবধান প্রকটভাবে চোখে পড়েছে। কিন্তু রাশিয়ায় বর্তমানের অবস্থাটা অবিশ্বাস্য রকমের। হাঙ্গেরি, রুমানিয়ায় দেখেছি এক ডলারে সাত গুণ, দশ গুণ বেশি স্থানীয় টাকা পাওয়া যায়। আর মস্কোতে? এক ডলারের চল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ গুণ! প্রতিদিনই সেটা বাড়ছে। দশটা ডলার ভাঙালে রাশি রাশি রুবল পাওয়া যায়। যার কাছে ডলার আছে, তার কাছে মস্কো এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা শহর!
তার কারণ, অনেক কিছুরই দাম বাঁধা আছে আগেকার মতন। যেমন ট্রেন ভাড়া। মস্কো থেকে লেনিনগ্রাডের (সেন্ট পিটার্সবার্গের) প্রথম শ্রেণির ট্রেন ভাড়া। সারারাত গরম বিছানায় শুয়ে আরামের যাত্রা। এই দীর্ঘপথের ভাড়া ২৪ রুবল। ডলারের হিসেবে মাত্র আধ ডলার, আমাদের টাকার হিসেবেও বারো-চোদ্দ টাকা। এটা হাস্যকর না। রুবলের এই করুণ পরিণামের ফলেই ব্ল্যাক মার্কেট ও ঘুষের রাজত্ব চলছে চারদিকে। ওখানকার ঘুষের সঙ্গে আমাদের ঘুষের কোনও তুলনাই চলে না।
মস্কোর ট্যাক্সি কলকাতাকে বহু গুণ হার মানিয়ে দিয়েছে। ট্যাক্সিচালকরা সরকারি কর্মচারী, ভাড়ার রেটও বাঁধা। সেই জন্য কোনও ট্যাক্সিচালকই বাঁধা রেটে যেতে রাজি নয়। চলন্ত ট্যাক্সি হাত দেখালে গ্রাহ্যই করে না। স্ট্যান্ডের টাক্সি আগে দরাদরি করে, বিদেশি দেখলে সরাসরি ডলারে ভাড়া দাবি করে। কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালা কুড়ি টাকা মিটার উঠলে যদি চল্লিশ টাকা চায় আমরা আঁতকে উঠি, মস্কোর ট্যাক্সি কুড়ি রুবলের জায়গায় চাইবে পাঁচশো রুবল। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় একটা সগর্ব ঘোষণা ছিল যে সেখানে জিনিসপত্রের কোনও দাম বাড়ে না!
মস্কোর রাস্তায় যখন তখন দেখা যায় বহু নারী-পুরুষ চলন্ত গাড়িগুলির দিকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। ট্যাক্সি থামে না, কিন্তু অনেক প্রাইভেট গাড়ি বুড়ো আঙুল দেখলে থামে। যাত্রীদের তুলে নেয়। বিনা পয়সায় লিফট দেয় না অবশ্য, প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। গরবাচেভ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর গাড়ির মালিকদের এই ব্যবসায়ের আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছেন।
সরকারি বাঁধা দামের দোকানগুলিতে এখনও কোনও জিনিসের দাম বাড়েনি। এটা এখন বেশ কৌতুকের ব্যাপার। দাম বাড়বে কীসের, কোনও জিনিসই তো নেই! সমস্ত সরকারি দোকান খালি। রেড স্কোয়ারের পাশে একটা সুপার মার্কেট আছে, এত বড় মার্কেট খুব কমই দেখা যায়। বহু দোকান, তার অধিকাংশই বন্ধ, যে দু-একটা খোলা আছে, তাদের অবস্থা করুণ। একটা দোকানে ঢুকে বেশ মজার ব্যাপার হল। সে দোকানটি সরকারি ঘড়ির দোকান, কিন্তু তাতেও একটাও ঘড়ি নেই। রয়েছে কিছু সাবান। তাও ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। আমরা জিগ্যেস করলাম, ঘড়ির দোকানে ঘড়ি নেই কেন? তখন কর্মচারীটি একটি শো-কেস দেখিয়ে দিল। তাতে রয়েছে কিছু হাতঘড়ির ব্যান্ড! অর্থাৎ এখন শুধু ব্যান্ড কিনে নিয়ে যান, পরে কখনও ঘড়ি কিনবেন। এই নিয়ে মস্কোতে, অনেক রসিকতা চালু আছে। একজন কেউ এক শিশি রান্নার তেল কিনতে গিয়েছিল, কিনে আনল এক জোড়া জুতো। কারণ, তেল নেই, জুতো আছে। এরপরে যখন তার জুতো কেনার দরকার হবে, তখন জুতো পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে টুথ ব্রাশ!
এই নিয়ে একটি বেশ মজার গল্প শুনেছি। মস্কো অলিম্পিকের সময় একটি হোটেল ঘোষণা করেছিল যে সেখানে বিশ্বের সবরকম খাবার পাওয়া যায়। যে কেউ যে-কোনও খাবারের অর্ডার দিলে তা পাওয়া যাবে আধঘণ্টার মধ্যে। যদি আধঘণ্টার মধ্যে দেওয়া না যায়, তা হলে হোটেল কর্তৃপক্ষ সেই খরিদ্দারকে দশ হাজার রুবল দেবে। একজন খরিদ্দার সেই হোটেলে এসে জিগ্যেস করল, আমাকে কচি উটের মাংস আর আলুর ঝোল খাওয়াতে পারবে? ম্যানেজার সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ। খদ্দেরটি বসল টেবিলে, অপেক্ষা করতে লাগল। একটু বাদে সে জানলা দিয়ে দেখতে পেল, একটা বাচ্চা উটকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পেছন দিকে। তা হলে তার মনোমতন খাবার আসবেই। কিন্তু আধঘণ্টা কেটে গেল, ম্যানেজার কাঁচুমাচু মুখে এসে বলল যে, স্যার আপনার খাবারটা দেওয়া যাচ্ছে না, আপনি দশ হাজার রুবল নিন। খরিদ্দারটি অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, কেন পাওয়া যাবে না? ওই যে একটা উটকে নিয়ে যেতে দেখলাম? ম্যানেজার বলল, হ্যাঁ, উট জোগাড় হয়েছে বটে, কিন্তু আলু নেই!
সরকারি দোকানগুলোর পাশাপাশি এখন অনেক লোক পশরা সাজিয়ে বসে। কিছু কিছু ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারি দোকানে হয় কিছুই নেই অথবা পড়ে আছে দু-চারটে পচা-ধচা জিনিস, আর পাশের দোকানগুলিতে বিক্রি হচ্ছে টাটকা সবজি ও মাংস। সরকারি বাঁধা রেটের চেয়ে অনেক গুণ বেশি মূল্যে। মাংসের সরকারি রেট আট রুবল, অন্য ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে ষাট রুবল দরে। ভর্তুকি দিয়ে সস্তায় খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার এই অবস্থা! সোভিয়েত ইউনিয়নে মাঝারি ধরনের চাকুরিজীবীদের মাইনে গড়ে তিনশো রুবল। তারা ষাট রুবল কিলো দরে ক'দিন মাংস খাবে? বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পেনশান মাসে চল্লিশ-পঞ্চাশ রুবল, এক কিলো মাংসের দামের চেয়েও কম।
রেড স্কোয়ারের পাশের সুপার মার্কেটটির অনেক ঘর এখন ভাড়া দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিতে। সরকারের ওই বাজার চালাবার সাধ্য নেই। ইতালিয়ান, বেলজিয়ান অনেক কোম্পানি বেশ কিছু দোকানঘর কিনে নিয়ে নিজেদের মতন করে সাজাচ্ছে। কোন মুদ্রায় জিনিসপত্র বিক্রি হবে সেখানে? বিদেশি ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই রুবলকে বেয়াত করবে না।
সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির কলঙ্ক হল বিরোউস্কা অর্থাৎ বিদেশি মুদ্রার দোকান। চিনেও এরকম দোকান আছে। এইসব দোকানে ভালো ভালো বাছাই করা সব বিদেশি দ্রব্য থাকে কিন্তু দেশীয় মুদ্রায় কিছুই কেনা যাবে না, ডলার, পাউন্ড লাগে। এই সব কোনও দেশেরই সাধারণ মানুষের কাছে ডলার-পাউন্ড থাকা আইনসঙ্গত নয়। সুতরাং সাধারণ মানুষার পথে যেতে-যেতে জানলার কাচ দিয়ে এইসব লোভনীয় দ্রব্যগুলি দেখবে কিন্তু কিনতে পারবে না। একটা দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি এটা চরম অপমান। বিদেশি মুদ্রার কালোবাজারের উৎসও এইসব দোকান।
এখন বিদেশি মুদ্রার দোকান অনেক গজিয়ে উঠেছে মস্কো শহরে। এক আইরিশ কোম্পানি রীতিমতন একটা সুপার মার্কেট বসিয়েছে, তার মধ্যে ঢুকলে কে বলবে যে মস্কোতে খাবারদাবারের অভাব, পৃথিবীর সব কিছুই পাওয়া যায়, যেমন ইউরোপ-আমেরিকার সুপার মার্কেট হয়, ট্রলি ভরতি করে যা খুশি নেওয়া যায়, দাম দিতে হবে শক্ত কারেন্সিতে। এখানকার খরিদ্দার কারা? শুধু বিদেশিদের দিয়ে তো আর সুপার মার্কেট চলে না! অর্থাৎ ডলারের চোরাকারবারের প্রতি এখন চোখ বুজে থাকা হচ্ছে। সাধারণ রাশিয়ানরা যদি কোনও উপায়ে ডলার জোগড় করতে পারে তো কিনুক।
যারা হতভাগ্য, যাদের ডলার নেই, তারা খাদ্য-নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সন্ধানে সারা দিন ব্যস্ত। রাস্তার যে-কোনও মানুষকে যদি জিগ্যেস করা যায়, এই দেশটা ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, তা নিয়ে তুমি কী ভাবছ? সে বিরক্ত হয়ে উত্তর দেবে, ওসব ভাবার সময় নেই, আজকের জন্য রুটি-আলু-মাখন পাওয়া যাবে কি না সেটাই আমার প্রধান চিন্তা।
ভবিষ্যৎ বলতে আগামী শীত। ভয়াবহ শীত। অনেকেই বলাবলি করছে যে এবারের শীতে খাদ্যসংকট আরও বাড়বে এবং জ্বালানির অভাবে ঘর গরম করা যাবে না।
মস্কো শহরে ঘুরে বেড়ালে এখন চোখে পড়ে শুধু চিন্তিত ও নিরানন্দ মানুষের মুখ। আমার পূর্ব-পরিচিতরা অনেকেই শহরে নেই। যে যুবকটি আমার আগেরবারের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল, তার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না, সে ইউক্রাইনের লোক। ইউক্রাইন এখন সোভিয়েত সংঘে থাকতে চায় না। আগেরবার রাইটার্স ইউনিয়ানে আড্ডা দিতে গেছি কয়েকবার। এবার শোনা গেল, কট্টরপন্থীদের তিনদিনের অভ্যুত্থানের সময় কোনও কোনও লেখক তাড়াহুড়ো করে সেই অভ্যুত্থান সমর্থন করে ফেলেছিল। এখন তারা লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে। অভ্যুত্থানের সমর্থকদের প্রতি এই মুহূর্তে জনরোষ প্রচণ্ড। লেখকদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেছে, তাই রাইটার্স ইউনিয়ন বন্ধ। প্রোগ্রেসিভ পাবলিশিং হাউজ, যেখান থেকে বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হত, আমাদেরও কিছু কিছু অনুবাদ বেরিয়েছে, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। যারা অনুবাদকের চাকরি করত, তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
আবহাওয়া বেশ মনোরম, মস্কো শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগে। এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য স্থান অবশ্যই রেড স্কোয়ার। সেখানে ভিড় তেমন নেই। লেলিনের মরদেহ দেখতে দর্শনার্থীদের লম্বা লাইন দেখেছি আগেরবার, এখন সে দিকটা ফাঁকা। এই দেহ সরিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। লেনিনগ্রাড অর্থাৎ সেন্ট পিটার্সবার্গের মেয়র আনাতোলি সোবচাক বলেছেন, লেনিনকে তো সরানো হচ্ছে না। লেনিনের ইচ্ছে ছিল, তাঁর জন্মস্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হোক। এতকাল আমরা সেই ইচ্ছের মূল্য দিইনি। এবার তাঁকে রেড স্কোয়ার থেকে সরিয়ে এনে যথারীতি তাঁর জন্মস্থানে কবর দেওয়া হবে।
মস্কো শহরে স্টালিন বহুকাল নিশ্চিহ্ন, কিন্তু লেনিনের মূর্তি কেউ ভাঙেনি। বলটিক রাষ্ট্রগুলিতে লেনিনকেও সরিয়ে ফেলা হয়েছে শুনেছি, কিন্তু এখানে আমি দেখলাম, কার্ল মার্কসের একটা মূর্তির গায়ে অনেক হাবিজাবি লিখে রেখেছে কেউ, কিন্তু লেনিনের মূর্তিগুলি অবিকৃত। তবে সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে লেনিন সম্পর্কেও। বাক-স্বাধীনতা পাওয়ার পর এখন কেউই সমালোচনার ঊর্ধে নন। আমাদের দেশে অনেকে মহাত্মা গান্ধিকে কুৎসিত ভাষায় গালমন্দ করেছেন, তাঁর তুলনায় লেনিন নিশ্চয়ই দেবতা নন। অনেকে বলছে যে, এই যে সাধারণ মানুষকে যখন তখন ধরপাকড় ও পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থা, লেনিনই তো তার প্রবক্তা। কেউ কেউ আবার লেনিনকে বাঁচিয়ে এমন কথাও বলছেন যে একেবারে শেষের দিকে লেনিন তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, এই ব্যবস্থা বদলাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন আর তাঁর ক্ষমতা ছিল না, স্টালিন কার্যত সমস্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে লেনিনকে প্রায় গৃহবন্দি করে রেখেছিল। এসব কথা আমি আগে কখনও শুনিনি। লেনিনের ব্যক্তিগত জীবন থেকেও অনেক কিছু খুঁড়ে বার করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তা ধর্তব্যের বিষয় নয়।
রেড স্কোয়ারে এখন প্রধান দ্রষ্টব্য একটি লাল পতাকা। মস্কো থেকে লাল রং একেবারে মুছে গেছে বলা যায়। আমি আগেরবার এসেছিলাম মে-দিবসের ঠিক আগে, তখন সর্বত্র ছিল লালে লাল, সমস্ত ল্যাম্পপোস্টে লাল পতাকা, মোড়ে মোড়ে সংগ্রামী শ্রমিকদের বড় বড় লাল রঙের কাটআউট ছবি। বস্তুত অত লাল দেখে গা শিরশির করত। লাল রং রক্তের রং তা চক্ষের পক্ষে প্রীতিপ্রদ নয়। বড় বড় শিল্পীরা পারতপক্ষে লাল রং ব্যবহার করেন না। মিছিল-টিছিলে খুব বেশি লাল রং মানুষের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়।
এখন সব লাল যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। রাশিয়াতে ফিরে এসেছে তেরঙা ঝাণ্ডা, তারও ব্যবহার সর্বত্র নেই। পতাকার বাহুল্যই নেই। গোটা মস্কো শহরে এখন একটি মাত্র কাস্তে-হাতুড়ি মার্কা লাল পতাকা আমার চোখে পড়েছে ক্রেমলিনের একটি অংশে। সেখানে গরবাচেভ বসেন, সোভিয়েত ইউনিয়ানের রাষ্ট্রপতির দপ্তর। তার কাছেই আর এক জায়গায় উড়ছে তেরঙা পতাকা। সেটা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়েলেৎসিনের এলাকা। ক্রেমলিনে এখন এই দুটি পতাকা উড়ছে। তবে গরবাচেভ-এর কক্ষের ওই সবেধন নীলমণি লাল পতাকাটিরও দিন ঘনিয়ে এসেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ান বলে আর কিছু থাকছে না, কয়েকটি রাজ্য মিলে যদি একটি আলাদা ধরনের জোট বেঁধে থাকতে রাজিও হয়, তার পতাকা কী হবে কে জানে! ওই লাল পতাকা টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা খুবই কম।
৪
পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলির তুলনায় মস্কো শহর সন্ধের পর বেশ নিষ্প্রভ। শহরের রাস্তাকে উজ্জ্বল করে দোকানপাটের চাকচিক্য এবং বিজ্ঞাপনের আলো। এতকাল এখানে দোকানগুলিকে মনোহারী করে সাজাবার প্রয়োজনীয়তা ছিল না, কারণ কোনওরকম প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিল না। আর প্রতিযোগিতা না থাকলে বিজ্ঞাপনেরও প্রশ্ন নেই।
আমরা যে, সব সময় বিজ্ঞাপন পছন্দ করি, তা নয়। অনেক বিজ্ঞাপনের ছবি ও গালভরা মিথ্যে রীতিমতন কুৎসিত লাগে, অনেক পশ্চিমি দেশে বিজ্ঞাপনে আলোর জাঁকজমক দেখে মনে হয় বিদ্যুতের অপচয়। তবু আমরা বিজ্ঞাপনে অনেকটা অভ্যস্তও হয়ে গেছি। নাগরিক জীবনের অঙ্গ হিসেবে নানা ধরনের দোকানপাট জড়িয়ে থাকবেই। পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না থাকলে বর্ণহীন মনে হয়। বিজ্ঞাপনের মধ্যে মুনাফার গন্ধ এবং ভাবী ক্রেতাদের ছেলেমানুষ ঠাওরাবার ব্যাপার থাকলেও আর একটা অন্য দিকও আছে। মানুষ সবসময় বৈচিত্র্য সন্ধানী এবং বিজ্ঞাপনদাতারা সেই সুযোগ নেয়। শুধু প্রয়োজনীয় দ্রব্যে মনের ক্ষুধা মেটে না। কিংবা এমনও বলা যায়, অনেক অপ্রয়োজনীয় বৈচিত্র্য সুন্দর জিনিস আসলে মানুষের খুবই প্রয়োজনীয়। সামান্য এক টুকরো ন্যাকড়া পকেটে রাখলেই মুখ মোছা যায়, তবু মানুষ নানারকম নকশা কাটা রুমাল ব্যবহার করে। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় উৎপন্ন দ্রব্যের সেই বৈচিত্র্য নেই, তাই বিজ্ঞাপনও নেই। মানুষের পছন্দের কোনও অধিকার থাকবে না, সরকার যা বানাবে, সকলে তাই নিতে বাধ্য। সরকার লাভ করতে চায় না। দেশের সকলকে সমান মূল্যে উৎকৃষ্ট দ্রব্য সরবরাহ করবে, এই নীতি শুনতে খুবই ভালো। কিন্তু প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, তা অবাস্তব। মূল্য কম হলেও সরকারি দ্রব্য সবসময় উৎকৃষ্ট হয় না। বৈচিত্র্যহীন বস্তু কম দামে পেলেও মানুষ পছন্দ করে না, এবং সবচেয়ে বড় কথা, সরকার অতি প্রয়োজনীয় বস্তুও সরবরাহ করতে না পারলে পাশের দোকান থেকে কিনে নেওয়ার উপায় নেই। টুথপেস্ট কিংবা টয়লেট পেপার পাওয়া যায় না, এমনও হয়।
এখন অবশ্য মস্কোতে কিছু কিছু বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের দোকানও খুলছে ক্রমে ক্রমে। তবে দু'রকম মুদ্রার ব্যবহার ন্যক্কারজনক লাগে। বাইরের লোকের কাছে ডলার থাকলে যা খুশি কিনতে পারবে, আর মস্কোর নাগরিকরা রুবল দিয়ে অনেক কিছুই কিনতে পারবে না, এই অপমানজনক ব্যবস্থাটা এখন সর্বত্র প্রকট। এমনকি, মস্কোতে 'দিল্লি' নামে যে ভারতীয় রেস্তোরাঁটি খোলা হয়েছে, সেখানেও দু'টি ভাগ। একদিকে ডলারের খরিদ্দার, অন্যদিকে রুবলের। বলাই বাহুল্য, রুবলের দিকটা অনেক মলিন এবং সেখানে সব কিছু পাওয়া যায় না।
সন্ধের পর মস্কোতে যাওয়ার জায়গা বিশেষ নেই। একদিন রাত এগারোটার পর আমরা এমনিই শহর ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। সি পি এস ইউ-র বিরাট ভবনের সামনের রাস্তাটা খাঁ খাঁ করছে। সদর দরজায় তালা বন্ধ, পুরো বাড়ি অন্ধকার শুধু আলো জ্বলছে একতলার একটি ঘরে, বোধহয় সেখানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রহরীরা। শোনা যায় যে, এই কমিউনিস্ট পার্টির উঁচু দিকের নেতারা একশো বিলিয়ান ডলার গোপন রেখেছে বিভিন্ন জায়গায়। এখন ইয়েলেৎসিনের সরকার সেই বিপুল অর্থ উদ্ধার করবার চেষ্টা করছে।
ঝারঝিনস্কি স্কোয়ারে আমরা নামলাম গাড়ি থেকে। এককালে এই জায়গাটার নাম শুনলেই অনেকের ভয়ের শিহরণ হত, অসময়ে কেউ এদিক দিয়ে হাঁটত না। এখানেই কে জি বি-র হেড কোয়ার্টার। ওই প্রকাণ্ড বাড়িটিতে বহু মানুষের আয়ু হারিয়ে গেছে। পুরো এলাকাটা জুড়েই মাটির তলায় রয়েছে জেরা কক্ষ। সেখানে আমরা হাঁটছি রাত সাড়ে এগারোটায়। আমার সঙ্গী সুবোধ ও সমর রায় বলল, কিছুদিন আগেও এটা ছিল অবিশ্বাস্য। আমাদের অবশ্যই গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হত। এখন শুনলাম, শুধু কিছু কিছু গাড়ি ছুটে যাচ্ছে।
চৌরাস্তার মাঝখানে উঁচু বেদির ওপর ছিল ঝারঝিনস্কির দীর্ঘ প্রস্তরমূর্তি। লেনিনের সহচর এই ঝারঝিনস্কি বলশেভিক বিপ্লবের ঠিক পরেই গুপ্ত পুলিশবাহিনী সৃষ্টি করেছিল। এতদিন যারা কে জি বি-র ভয়ে মুখ খোলেনি, তারা এখন বলছে যে বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে জারের আমলের পুলিশি ব্যবস্থাই আবার চালু করা হয়েছিল। জারের আমলেও গুপ্ত পুলিশ যে-কোনও মানুষকে সামান্য সন্দেহে ধরে নিয়ে যেত, তারপর তাদের অনেকেরই আর হদিশ পাওয়া যেত না। ডস্টয়েভস্কিকে কত তুচ্ছ কারণে গুলি করে মারার জন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা আমরা জানি। বিপ্লবের পরেও সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা পায়নি। স্তালিনের আমলে নাকি মাসে অন্তত দশটা অভিযোগ দায়ের করতে না পারলে শাস্তি পেতে হবে এই ভয়ে গুপ্তচররা নিরীহ পাড়াপ্রতিবেশীদের নামে চুকলি কেটে আসত কে জি বি-র কাছে। এরকম ভীতির আবহাওয়া তৈরি করা কি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? সমাজতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে যে ব্যক্তিটি সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, সেই জোসেফ স্তালিনই আসলে সমাজতন্ত্রের এমন ব্যর্থতার জন্য দায়ী। এদেশে এখনও মুষ্টিমেয় সংখ্যক যারা কমিউনিজমে বিশ্বাসী, যারা মনে করে যে সমাজতন্ত্রের পথে কিছু ভুলভ্রান্তি ঘটলেও আদর্শটা মিথ্যে হতে পারে না, তারাও কিন্তু, ঘৃণার সঙ্গে ছাড়া, কখনও উচ্চারণ করে না স্তালিনের নাম।
ঝারঝিনস্কির মূর্তিটা উপড়ে ফেলা সেই ঘৃণারই প্রকাশ। স্তালিন আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, ওই মূর্তিটা ছিল সমস্ত অত্যাচারের প্রতীক। ওই মূর্তির মাথায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন নামহীন মানুষ, এই ছবি ছাপা হয়েছে বিশ্বের সমস্ত সংবাদপত্রে। দেশ-বিদেশের বহু সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিল। আমরা তিনজনে এখন সেই শূন্য বেদিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কী মজবুত করে বানানো হয়েছিল এই পাথরের মঞ্চ, আরও দু-এক শতাব্দীতে ওই মূর্তির ক্ষতির কোনও সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু মানুষের ঘৃণার কাছে পাথর-বন্দুক-ট্যাংক-মেশিনগান সবই শেষ পর্যন্ত হার মেনে যায়।
আর কোনও পথচারী নেই, তবু ভারী জুতোর শব্দ শুনে আমরা মুখ ফিরিয়ে তাকাই। অদূরে রাস্তার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে আছে তিন-চারজন পুলিশ। তারা আমাদের কিছু বলবে কি না এই কৌতূহল নিয়ে আমরা অপেক্ষা করি। কিন্তু তারা কিছুই বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে। একটু পরে আমরাই এগিয়ে যাই ওদের দিকে।
আমরা তিনজনই চেহারায় বিদেশি হলেও সুবোধ ও সমর ওই পুলিশদের মাতৃভাষা জানে জলের মতন। সুবোধ যেই জিগ্যেস করল, কেমন ঠান্ডা পড়েছে, স্বদেশিভাষা শুনে তারা উৎসাহিত হয়ে উঠল। ওরা তিনজনই বেশ তরুণ, সারল্য মাখা মুখ, ওরা মিলিশিয়ার অন্তর্গত, ওদের কাজ সারারাত রাস্তায় পাহারা দেওয়া। আমাদের দেখে ওরা অবাক হয়েছে, বেদিটার ওপর উঠে আমরা এত রাতে কেন গল্প করছি, তার কারণ বুঝতে পারছে না। সত্যিই তো কোনও কারণও নেই, আমরা এমনিই এসেছি ঘুরতে-ঘুরতে। ওরা বলল, ঝারঝিনস্কির মূর্তিটা আছে একটা মিউজিয়ামের পাশের বাগানে, আমরা ইচ্ছে করলে যেতে পারি সেখানে।
আমাদের পেয়ে ওরা খুশিই হয়েছে মনে হল, গল্প করতে লাগল নানারকম। আমি ওদের ভাষা জানি না, আমাকে বোঝানো হচ্ছে অনুবাদে। আমি প্রকৃতই বিদেশি এবং এই দ্বিতীয়বার মস্কো এসেছি শুনে ওরা সুবোধকে বলল, আমাদের এই অতিথিটিকে জিগ্যেস করুন তো, এই যে আমাদের দেশে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেল, এতে আমাদের ভালো হবে, না আরও খারাপ হবে?
আমি উলটে জিগ্যেস করলাম, তোমরাই বলো না, তোমাদের কী মনে হয়।
তিনজন তরুণ পুলিশই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলল, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।
এটা রাশিয়ার অধিকাংশ সাধারণ মানুষেরই প্রতীক প্রশ্ন বলা যায়। সব দেশেই সাধারণ মানুষ সমাজ, সরকার বা বিশ্ব নিয়ে মাথা ঘামায় না, নিজস্ব রুজি-রোজগার, খাদ্য-বস্ত্র-গৃহের সংস্থান আর নিজের পরিবারের নিরাপত্তার চিন্তায় দিন কাটিয়ে দেয়। এতদিন এরা একটা ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, ভালো-মন্দ যাই-ই হোক সেটা জানা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আকস্মিকভাবে সেই ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যৎ অজানা। সেই অজানা সম্পর্কে সংশয় থাকাও স্বাভাবিক। তা ছাড়া, এতদিন ওপর থেকে যা চাপিয়ে দেওয়া হত, তাই মান্য করতে সবাই বাধ্য ছিল। এখন ওপর থেকে সেই চাপ সরে গেছে, তার ফলে এসেছে এক শূন্যতা। মানুষ একমাত্র শূন্যতার কাছেই হতবুদ্ধি হয়ে যায়।
পরদিন আমরা মস্কোর নতুন মিউজিয়ামটি দেখতে গিয়েছিলাম। ভেতরটা এখনও সম্পূর্ণ সাজানো হয়নি, ভেতরে দ্রষ্টব্য খুবই কম। তবু টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। বাইরে বাগানের এক পাশে খানিকটা জায়গাকে বলা যায় মূর্তির কবরখানা। সদ্য উৎপাটিত ঝারঝিনস্কির লম্বা মূর্তিটা পড়ে আছে মাটিতে। চিৎ ও উপুড় অবস্থায় একাধিক স্তালিন। আরও কয়েকটি মূর্তি ঠিক কাদের তা চেনা গেল না। আমাদের সঙ্গে একজন জর্জিয়ার যুবক ছিল। সে একটা দাড়িওয়ালা মূর্তি দেখিয়ে বলল, ওই তো লেনিন! আমি খুব কাছে গিয়ে ভালো করে দেখলাম, না, লেনিন নন, অন্য কেউ। অত্যুৎসাহী জর্জিয়ানটির বোধ হয় লেনিনকেও ধরাশায়ী করার ইচ্ছে। এখন উগ্র জাতীয়তাবাদের সময়, জর্জিয়ানরা লেনিনকে নস্যাৎ করে স্তালিনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চায় কি না, তাই-ই বা কে জানে। ওদের কথাবার্তায় সেরকম আভাস যেন মাঝে মাঝে পাওয়া যায়।
জাতীয়তাবাদের এই উগ্রতাও অদ্ভুত। সারা বিশ্বের মার্কসবাদীরা ইংরেজ ঐতিহাসিক টয়েনবিকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু টয়েনবি অনেক দিন আগেই বলে গিয়েছিলেন যে কমিউনিজমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবে ন্যাশনালিজম। এখন তো দেখা যাচ্ছে, সেই দ্বন্দ্ব যুদ্ধে জাতীয়তাবাদই জয়ী হল। মার্কসবাদে যেমন শ্রেণিবৈষম্য কিংবা ধর্মের স্থান নেই, সেইরকম জাতীয়তাবাদেরও স্থান নেই। সারা বিশ্বের সর্বহারা শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির ঐক্যের ডাক দিয়েছে মার্কসবাদ, কিন্তু এই 'সারা বিশ্ব' নিছক কথার কথা, কোনও এক দেশের বঞ্চিত শ্রমিকদের নিয়ে অন্য দেশের শ্রমিকরা মাথা ঘামায় না। প্রবল স্বাজাত্যাভিমান সমাজতন্ত্রী দেশগুলিতেও আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে আছে। আমাদের দেশ যেমন ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষিত হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও শিক্ষা দেওয়া হয়নি সাধারণ মানুষকে, ধর্মের অরাজকতা চলছে যথেষ্টভাবে। সমাজতন্ত্রী দেশগুলিতেও শুধু কিছু বুলি শোনানো হয়েছে, স্লোগান দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে মানুষের মনের ভাষা, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে ওঠার কোনও শিক্ষাই দেওয়া হয়নি। যুগোশ্লাভিয়ার রাশ একটু আলগা হতেই সার্বিয়ান আর ক্রোয়েশিয়ানরা খুনোখুনি শুরু করেছে। এতকাল সাম্যবাদের নামে তারা পাশাপাশি ছিল অথচ, তাদের ভেতরে-ভেতরে পরস্পরের প্রতি এমন তীব্র বিদ্বেষ জমে ছিল? চিন ও সোভিয়েত দেশের সীমান্ত সংঘর্ষের সময় প্রকট হয়ে উঠেছিল ভিন্ন জাতিতত্ব। সমাজতন্ত্র গ্রহণ করলেও শ্বেতাঙ্গ ও পীতাঙ্গ মানুষ হাতে হাত মিলিয়ে শান্তির পথে এগোতে পারে না। শুধু গায়ের রং নয়, ভাষাও মিলনের অন্তরায়। রুমানিয়ানরা দু'চক্ষে দেখতে পারে না হাঙ্গেরিয়ানদের। চেকোশ্লোভাকিয়ায় চেক ও শ্লোভাক এই দুই আলাদা ভাষাভাষীদের মধ্যে বিরূপতা রয়ে গেছে। আলবেনিয়ানরা অন্য সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে মিশতে চায় না। পোল্যান্ডের মানুষ রাশিয়ানদের সম্পর্কে তিক্ত সুরে কথা বলে। পূর্ব জার্মানিতে কালো ভিয়েতনামিদের অবজ্ঞা দেখানো হত!
সোভিয়েত রিপাবলিক যে ভেঙে গেল। এর অন্তর্গত প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই যে স্বাধীন হতে চাইছে, এই ঘটনা থেকে আর একটি সত্য বেরিয়ে আসছে। এতকাল তা হলে এদের জোর করে ধরে রাখা হয়েছিল? সমাজতন্ত্র কিংবা সাম্যবাদের দীক্ষা হয়নি, নিছক জোর জবরদস্তি! আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, এই শুনতে-শুনতে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আমেরিকা যে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তা অস্বীকারও করা যায় না। কিন্তু রাশিয়াও যে সোভিয়েত ইউনিয়নের নামে এতকাল এক সাম্রাজ্যবাদ চালিয়ে গেছে, তা গোপন করে যাওয়া হয়েছিল কেন? নিজেরা সাম্রাজ্যবাদী হয়ে অন্যকে সেই একই অভিযোগে গালমন্দ করা যায়?
আমাদের সঙ্গে সদ্য পরিচিত জর্জিয়ান যুবকটি সেখানকার এক মন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারি। বুদ্ধিমান, ঝকমকে চেহারা, দায়িত্বপূর্ণ পদে আছে। তার মুখে সাংঘাতিক এক চমকপ্রদ কথা শুনলাম। কথায়-কথায় সে বলল, তোমরা ভারতীয়রা দুশো বছর ইংরেজদের অধীনে ছিলে, তবু আমি বলব, তোমরা ভাগ্যবান। এ কথার তাৎপর্য বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাতেই সে আবার বলল, তোমরা পরাধীন ছিলে বটে, তা হলেও তোমরা ছিলে ব্রিটিশদের মতন এক সভ্য জাতের অধীনে। আমাদের মতন বর্বর রাশিয়ানদের অধীনে তোমাদের থাকতে হয়নি।
আমি একেবারে স্তম্ভিত। আমি এ পর্যন্ত যত রাশিয়ান দেখেছি, তারা সকলেই ভদ্র, সভ্য, উদার, অনেকেরই বেশ রসিকতা জ্ঞান আছে। কিন্তু জাতিগতভাবে তারা জর্জিয়ানদের চোখে বর্বর? একেই বলে জাতি-বৈর। আমি জর্জিয়ায় কখনও যাইনি বটে, কিন্তু আগে ল্যাটভিয়া এবং ইউক্রাইনে গেছি। সেখানে যাদের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেওয়া হয়েছিল, সকলের মুখেই মহান সোভিয়েত ইউনিয়ানের জয়গান শুনেছি। এখন ল্যাটভিয়ার এবং ইউক্রাইনের যেরকম ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে রাশিয়া থেকে বিযুক্ত হওয়ার, তাতে বোঝা যাচ্ছে, সেইসব জয়গান ছিল নিতান্ত মুখস্থ বুলি!
আমাদের দেশেও যাঁরা সোভিয়েত ইউনিয়ানের প্রদর্শিত পথকে আদর্শ পথ ভেবে এসেছেন, তাঁরাও কি বুঝতে পারেননি যে জোর-জুলুম করে, কামান-ট্যাংকের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন জাতিকে এক পতাকার নীচে মেলাবার চেষ্টা চলেছে? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে স্তালিন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে গ্রাস করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন, আগেকার রাশিয়ান সাম্রাজ্যেরই একটা অন্য রূপ। সমাজতন্ত্র একটা ছুতো। হাঙ্গেরি-পোল্যান্ড-চেকোশ্লোভাকিয়ার মতন দেশগুলির শাসকদের মস্কোর অঙ্গুলি হেলনে পুতুলের মতন উঠতে-বসতে হত। সোভিয়েত ইউনিয়ানের অন্তর্গত রাষ্ট্রগুলির তো আলাদাভাবে কোনও কণ্ঠস্বরই ছিল না। সর্বত্র চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাশিয়ান ভাষা। যুগোশ্লোভিয়ায় গিয়ে দেখেছি, সেখানে অনেকগুলি ভাষা এবং তা নিয়ে রেষারেষি আছে বটে, কিন্তু প্রত্যেকেই রুশ ভাষা শিখতে বাধ্য।
বছরের পর বছর, দশকের পর দশক এতগুলি রাষ্ট্রের ওপর ডান্ডা ঘুরিয়েও রাশিয়া তাদের অধীনস্থ রাখতে পারল না। তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি আর চাইল না চাটুকার হয়ে থাকতে। চোখ রাঙিয়ে, হাতে অস্ত্র নিয়ে ভয় দেখিয়ে কোনও আদর্শ প্রচার করা যায়? মার্কসবাদ যদি সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ হয়, তা হলে এতগুলি বছর ধরে সেই পথে থেকেও আর কোনও রাষ্ট্র তা মানতে চাইছে না কেন? ভুল হয়েছিল কোথায়? মার্কসবাদের বিরুদ্ধাচারীরা নয়, প্রকৃত মার্কসবাদীদের মনেই তো এই প্রশ্ন জাগা উচিত। শুধু গরবাচেভ বা ইয়েলেৎসিন বা দু-তিনজনের ভুলের জন্য এতবড় একটা আদর্শ, এতবড় একটা সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতন ভেঙে পড়ল, এটা শিশুর যুক্তি। অতিসরলীকরণ।
কেউ কেউ অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে জোর জবরদস্তি কিংবা মগজ ধোলাই করে রাশিয়ান সমাজতন্ত্র বেশিদিন টিঁকিয়ে রাখা যাবে না। তাঁদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। খুবই বিস্ময়কর লাগে, বহুকাল আগে, উনিশশো বাইশ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ইতিহাসের গতি সম্পর্কে এক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। গয়া কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন ঃ
The recent revolution in Russia is very interesting study. The Shape which it has now assumed is due to the attempt to force Marxian doctrines and dogmas on the unwilling genius of Russia. Violence will again fail. If I have read the situation accurately, I except a counter revolution. The soul of Russia must struggle to free herself from the socialism of Karl Marx.
রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া পরিদর্শনে গিয়ে অনেক প্রশংসার কথা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রশংসার ব্যাপারে ছিলেন অকৃপণ। জীবনে কি তিনি কখনও কারুর নিন্দে করেছেন? যাদের পছন্দ করতেন না (যেন, আধুনিক কবিদের), তাদেরও তিনি প্রশংসার সার্টিফিকেট দিতে দ্বিধা করতেন না। ইতালিতে গিয়ে আতিথ্যের বহর দেখে তিনি মুসোলিনিরও প্রশংসা করে ফেলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া সফর ছিল ১৪ দিনের। সমস্ত বিদেশি অতিথিদেরই দু'সপ্তাহের ভিসা দেওয়া হত। এবং আগে থেকে নির্দিষ্ট, সাজানো গোছানো জায়গাগুলিই দেখানো হত তাঁদের। রাশিয়ায় প্রশংসনীয় অনেক কিছুই ছিল অবশ্যই এবং রবীন্দ্রনাথ যথার্থ আন্তরিকতার সঙ্গেই তার প্রশংসা করেছেন। সংস্কার থেকে মুক্তি, দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার দমন, মানুষে মানুষে সম-ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা, এসব কোন কবি না চায়? কিন্তু এই মহৎ আদর্শের নামে জোর জবরদস্তি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার বিলোপ, এসবও সেই দূরদর্শী কবির নজরে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথের 'রাশিয়ার চিঠি' থেকে উদ্ধৃতি যারা প্রচারের কাজে লাগায়, তারা রবীন্দ্রনাথের ওইসব মন্তব্যের উল্লেখও করে না। 'রাশিয়ার চিঠি'র রুশ অনুবাদে ওইসব অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সামান্য বিকৃতি হলেই আমরা হইচই তুলি। ইন্দিরা গান্ধির এমার্জেন্সির আমলে কোনও কোনও নির্বোধ প্রশাসক রবীন্দ্রনাথের দু-একটি কবিতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চেয়েছিল। সে জন্য ইন্দিরা গান্ধির কংগ্রেস দল অবশ্যই ধিক্কারযোগ্য। কিন্তু সোভিয়েত দেশে রবীন্দ্রনাথের লেখার ওপর কাঁচি চালিয়ে যখন প্রকাশ করা হল, তখন আমরা উচ্চবাচ্য করিনি।
৫
মস্কো থেকে লেনিনগ্রাড ট্রেনে এক রাত্রির পথ। আমি এ দেশে এসে পৌঁছোবার মাত্র কয়েকদিন আগেই লেনিনগ্রাড শহরের নাম বদলের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। লেনিনের দুটো-একটা মূর্তি ভাঙা কিংবা সরিয়ে ফেলার চেয়েও অনেক মর্মান্তিক এই নাম পরিবর্তন। এই শহরের সঙ্গে লেনিনের স্মৃতি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। শ্রমিক অসন্তোষ এবং জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ শুরু হয় এখানেই। শ্রমিক সংঘ ও সৈন্যবাহিনী হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে জারকে এই শহরে প্রবেশ করতেই দেওয়া হয়নি, তেসরা এপ্রিল জার সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন, কেরেনস্কির প্রধানমন্ত্রিত্বে গঠিত হয়েছিল জাতীয় সরকার। লেনিন অবশ্য সে সময় এখানে উপস্থিত ছিলেন না। জারের পতনের খবর পেয়ে তিনি সুইজারল্যান্ড থেকে দ্রুত চলে আসেন, তারপর ২৫ অক্টোবর (এখনকার পরিবর্তিত ক্যালেন্ডারে ৭ নভেম্বর) বোলশেভিক বিপ্লবের শুরু। সম্রাটদের বিখ্যাত শীতপ্রাসাদ দখল করে নিয়ে লেনিন কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেন। নিঃসন্দেহে এ এক বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনা। একটা রাজবংশকে চিরকালের মতন মুছে দিয়ে ক্ষমতায় এল সাধারণ মানুষ।
লেনিনের আমলে এই শহরের নাম ছিল পেট্রোগ্রাড। শহরের নাম বদল করার রীতি রাশিয়ায় অনেক দিনের। ব্যক্তিবিশেষের নামে শহরের নামকরণও এদেশে প্রচলিত। অন্যান্য দেশে সাধারণত এরকম ঘটনা ঘটে না, একটা শহরের নাম ইতিহাসের পৃষ্ঠায় একবার স্থান করে নিলে তার পরিবর্তন না করাই সংগত। এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট পিটার দা গ্রেট সম্ভবত চক্ষুলজ্জায় নিজের নামে এই নতুন শহরের নামকরণ করেননি, কিন্তু খুঁজে খুঁজে এমন এক সন্তের নাম বার করেছিলেন, যাঁর সঙ্গে নিজের নামের মিল আছে। সেন্ট পিটার্সবার্গ নামটি বদলে ফেলা হয় প্রথম মহাযুদ্ধের সময়। বার্গ কথাটায় জার্মান গন্ধ আছে, তাই নতুন নাম হল পেট্রোগ্রাড। এই নাম অবশ্য দশ বছরের বেশি টেঁকেনি। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর তাঁর নামে সম্মানিত হল এই শহর। কিন্তু নাম একবার বদলালে যেন বারবার বদলাবার ঝোঁক এসে যায়। কয়েক দশক আগে এ দেশে স্তালিনগ্রাড নামেও একটা শহর ছিল, স্তালিনের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হওয়ার ফলে সেই শহরেরও নাম বদলেছে। এবার, সর্বকালের ইতিহাসে বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে লেনিন সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে, তাঁর নামাঙ্কিত শহর আবার রূপান্তরিত হল। প্রথমে শোনার পর কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। এত বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেল বিনা প্রতিবাদে? কোনও আপত্তি উচ্চারিত হল না!
লেনিনগ্রাড সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে গেল কেন পেট্রোগ্রাডে কেন নয়, তাও বোঝা যায় না। সেন্ট পিটার্সবার্গে ধর্মীয় গন্ধ আছে, পেট্রোগ্রাড ধর্মনিরপেক্ষ।
কাগজে কলমে পরিবর্তন ঘটলেও মানুষের মন থেকে পুরোনো নাম সহজে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। অনেকেই এখনও লেনিনগ্রাড বলে, শুধু দু-চারজন সরকারি কর্মচারী সে নাম বলে ফেললেও শুধরে নেয়।
মস্কো থেকে ট্রেনে চাপার সময় আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল ঘুষের। এখানে এখন কী ধরনের ঘুষের কারবার যে চলছে, তা বর্ণনা করলেও অবিশ্বাস্য মনে হবে। চতুর্দিকে ঘুষ। যে-কোনও কাজে ঘুষ। এক টাকার কাজের জন্য দশ টাকা ঘুষ। সরকার এখন শিথিল বলে লোকে বেপরোয়া। ট্রেনের টিকিট কাটা থেকে ঘুষের শুরু। সারা রাতের জন্য ফাস্ট ক্লাস স্লিপারের ভাড়া চব্বিশ রুবল, আগেকার হিসেবে চব্বিশ রুবল ছিল অনেক টাকা, এখনকার বাজারদরে টাকা দশেক মাত্র। কিন্তু এত সস্তায় টিকিট পাওয়া যাবে কেন, সব টিকিট অদৃশ্য, দালালদের কাছ থেকে কিনতে হল পাঁচগুণ দামে। তারপর রাত্রিবেলা ট্রেনে ওঠার সময় কন্ডাকটর গার্ড আমাদের দরজার কাছে আটকাল। আমাদের তিনজনের দলটিতে একজন রুশী, দু'জন বঙ্গসন্তান। আমরা কোনও রকম মুখ খোলার আগেই সে বলল, তোমাদের মধ্যে দু'জন বিদেশি, বিদেশিদের ডলারে টিকিট কেনার কথা, তোমাদের এ টিকিট চলবে না। আমরা যে বিদেশি, তা সে চিনল কী করে, নিশ্চয়ই গায়ের রঙ কালো দেখে। কোনও শ্বেতাঙ্গ জার্মান বা ফরাসি অবশ্যই অবলীলাক্রমে পার হয়ে যেত, কারণ, ট্রেনে চাপার সময় তো পাসপোর্ট দেখাতে হয় না।
যাই হোক, ট্রেন প্রায় ছাড়ার মুখে। গার্ডটি বলল, ঠিক আছে, তোমরা উঠে সিট খুঁজে বসো, আমি দেখছি কী করতে পারি। ট্রেন চলতে শুরু করার পর গার্ডটি আমাদের কুপেতে প্রবেশ করল। কোনও দরাদরির প্রশ্নই নেই। সে ব্যস্তভাবে বলল, তোমরা প্রত্যেকে একশো রুবল করে দিয়ে দাও। যেন এটা তার নায্য দাবি। টাকাগুলো নিয়ে সে বেরিয়ে গেল, আর একবারও তার দেখা পাওয়া যায়নি। আগেরবার দেখেছিলাম, ভোরবেলা কন্ডাকটর গার্ড প্রত্যেক কুপেতে এসে চা দিয়ে যায়, এবার অনেক ডাকাডাকি করেও চা পাওয়া গেল না। সে ব্যবস্থা উঠে গেছে।
লেনিনগ্রাড রেল স্টেশনের মতন এতবড় একটা স্টেশনে একটা খাবারের দোকান নেই! সব বন্ধ। একটি মাত্র দোকানের সামনে লম্বা লাইন, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে অতি বিস্বাদ ট্যালটেলে কফি এবং ততোধিক খারাপ একটা বিস্কুট। আমাদের খিদে পেয়েছে, পকেটে পয়সা আছে, তবু আর কিছু কেনার উপায় নেই।
ট্রেনে যেমন ঘুষের অভিজ্ঞতা হল, স্টেশনে সেরকম অভিজ্ঞতা হল ভিক্ষার। এদেশে এখন ভিখারি এমন কিছু দুর্লভ নয়। মস্কোর রাস্তায় ভিখারি ও আঁস্তাকুড়-কুড়ানি দেখেনি বটে কিন্তু লেনিনগ্রাডের রেল স্টেশনের ভিখারিটি মনে ছাপ ফেলে দিয়ে গেল।
আমাদের রুশী বন্ধুটি গেছে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করতে। ট্যাক্সি সংগ্রহ করা অতি কঠিন কাজ। বাইরে অনেক ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে বটে কিন্তু কেউ নির্দিষ্ট ভাড়ায় যাবে না, পঁচিশগুণ, তিরিশগুণ বেশি চায়। আমাদের দেখে বিদেশি বলে চিনতে পেরে তারা আরও বেশি দর হাঁকবে, তাই আমাদের আড়ালে দাঁড় করিয়ে রেখে রুশী বন্ধুটি একা গেছে।
এই সময় একজন লোক এসে সুবোধের সঙ্গে কী যেন কথা বলতে লাগলেন। লোকটির চেহারা পর্বত-অভিযাত্রীদের মতন, সারা মুখে অবিন্যস্ত দাড়ি, মাথায় বাবরি চুল, গায়ে একটা তালিমারা ওভার কোট। লোকটির ডান হাতের তিনটি আঙুল নেই, তার কথা বলার ভঙ্গিতে কিছুটা যেন লজ্জা লজ্জা ভাব। কী বলছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তাকে ভিখিরি বলে আমি বিন্দুমাত্র সন্দেহ করিনি, একটু পরে সুবোধ তাকে একটা বড় সংখ্যার রুবলের নোট দিল। তখন লোকটি সুবোধের হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল আর সুবোধ নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।
শেষ পর্যন্ত লোকটিকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে হল। আমি জিগ্যেস করলাম, কী ব্যাপার বলো তো সুবোধ!
সুবোধ বলল, এই লোকটি আগে আর্মিতে ছিল। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আর্মির হয়ে লড়তে গিয়েছিল, সেখানে আঙুলগুলো কাটা গেছে। ওই হাত দিয়ে বিশেষ কোনও কাজ করতে পারে না, কিন্তু সরকার ওর জন্য কোনও ব্যবস্থা করেনি। যা সামান্য পেনসন পায়, তাতে এই ইনফ্লেশানের বাজারে দু-বেলা খাওয়া জোটে না। ভিক্ষে করার ব্যাপারে এখনও পাক্কা হয়ে ওঠেনি। এখনও লজ্জা পায়।
তোমার হাত ধরে টানছিল কেন?
কিছু বেশি টাকা পেয়েছে বোধ হয়। যা আশা করেনি। তাই আমার হাতে চুমু খেতে চাইছিল। আমি আবার ওসব আদিখ্যেতা পছন্দ করি না।
লোকটি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে লজ্জা, দুঃখ, কৃতজ্ঞতা সব মিলেমিশে একটা অদ্ভুত রূপ নিয়েছে।
লেনিনগ্রাড তথা সেন্ট পিটার্সবার্গে আরও কয়েকটি মুখের কথা ভোলা যায় না।
এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্যই হচ্ছে হারমিটের মিউজিয়াম। বিশ্ববিখ্যাতএই মিউজিয়ামে ইম্প্রেশনিস্টদের ছবির দারুণ সংগ্রহে আছে। টিকিট কেটে ঢুকতে যাচ্ছি, সিঁড়ির মুখে এক বৃদ্ধা বাধা দিয়ে বলল, তোমরা তো বিদেশি, তোমাদের দুটো করে টিকিট কাটতে হবে।
কেন এই অদ্ভুত নিয়ম? অন্য কোথাও তো দেখিনি!
বৃদ্ধা বলল, তোমরা তো আমাদের দেশে অতিথি, তাই তোমাদের কাছে থেকে বেশি পয়সা চাইছি।
অতিথিপরায়ণতার এমন বিচিত্র ব্যাখ্যা কখনও শুনিনি। সুবোধ বিদ্রুপের সুরে বলল, অতিথি বলে তো আমাদের বিনা পয়সায় ঢুকতে দেওয়া উচিত!
বৃদ্ধা আঙুল তুলে বলল, ওপরওয়ালারা এই নিয়ম করেছে, আমি তো করিনি। আসলে আমাদের সরকারের এখন টাকা নেই।
সুবোধ বলল, সরকারকে দিতে চাই না, বেশি পয়সাটা বরং তুমি নাও!
বৃদ্ধা মুখ নীচু করল। নিদারুণ লজ্জায় সেই মুখখানা কুঁকড়ে গেছে।
আরও কয়েকটা মুখ দেখেছিলাম একটা হোটেলের দরজার বাইরে। দশ-বারোটি যুবতী, প্রত্যেকেই সাদা পোশাক পরা, কারুরই বয়েস তিরিশের বেশি নয়। সন্ধে আটটা, এমন ফিনফিনে হাওয়া দিচ্ছে যে, ওভারকোটের তলায়ও কেঁপে উঠছে আমাদের শরীর। সেই যুবতীদের অঙ্গে কিন্তু পাতলা পোশাক।
হোটেলটি নতুন ও পাঁচতারা। তার দরজার বাইরে অতগুলি সুশ্রী মেয়ে ভেতরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? হোটেলের ভেতরে ঢোকার তো কোনও নিষেধ নেই। আমরা সে হোটেলের বাসিন্দা নই, ভেতরে গিয়েছিলাম বাথরুম ব্যবহার করার জন্য। ওই নারীরা বাইরে কেন?
আমাদের রুশী বন্ধুটিকে এ প্রশ্ন করতে সে একটু দ্বিধা করে উত্তর দিল, বুঝতে পারছ না? ওরা দাঁড়িয়ে আছে ডাক পাওয়ার জন্য।
এরা পণ্যা নারী? এত ঠান্ডার মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, কখন কোন মাংসলোভী হাতছানি দেবে, সেই অপেক্ষায়? ওভারকোট পরেনি, কারণ বেশি বস্ত্র থাকলে শরীরের গড়ন বোঝা যাবে না। কিছুক্ষণের জন্য এই শরীরের বিনিময়ে পাবে কিছু টাকা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে এসব কথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। টকটকে লাল ঠোঁট, গালে গোলাপি রং, গাঢ় করে আঁকা ভুরু, চুড়ো করে বাঁধা চুল, জ্বলজ্বলে পোশাক, এইরকম চেহারা হয় বারবণিতাদের। কিন্তু এই মেয়েগুলি সেরকম কোনও সাজপোশাক পরেনি, সারল্য মাখা সুন্দর মুখ, মনে হয় যেন কোনও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। এরা প্রত্যেকেই উৎসুক যুবকদের প্রেমিকা হতে পারত, বিমান-সেবিকা হতে পারত, শিল্পীরা এরকম মডেল পেলে ধন্য হত, এরা কবিদের প্রেরণা দিতে পারত, কিংবা সুন্দর একটা সংসার গড়তে পারত। তার বদলে এই ঠান্ডার মধ্যে স্বল্পবেশে কাঙালিপনার মতন দাঁড়িয়ে আছে কোনও একজন অচেনা মানুষের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার জন্য। প্রত্যেকের দৃষ্টি একেবারে স্থির, তাতে কোনও ভাষা নেই। ক্ষুধা নেই, লোভ নেই, ব্যাকুলতা নেই, এমনকি লজ্জাও অনুপস্থিত। এই দৃষ্টি কি ভোলা যায়? সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ সেই দৃশ্যটি আমার চোখে ভাসে, এখনও যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কতখানি অসহায়তার জন্য এইসব মেয়েরা পুরুষদের লোভের সামগ্রী হতে চায়? পৃথিবীর সব দেশেই বড়-বড় হোটেলের ধারে-কাছে বেশ্যাদের ঘোরাঘুরি নতুন কিছু নয়, এমনকি চিনেও দেখেছি, কিন্তু লেনিনগ্রাডের ওই দৃশ্যটি আমার খুবই করুণ লেগেছিল।
মস্কোর তুলনায় লেনিনগ্রাড শহরটি অনেক সুন্দর। আগেকার তুলনায় চেহারাটা এখন কিছুটা মলিন। এখানকার মেয়র মহোদয় খুবই জনপ্রিয়, তাঁর চেষ্টায় গত অগাস্টের ব্যর্থ বিপ্লবের সময় লাল ফৌজ এই শহরে ঢুকতেই পারেনি, কৌশলে ট্যাংকগুলিকে ভুল রাস্তায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মেয়র মহোদয় রাজনীতিতে যতটা উৎসাহী, শহরের রাস্তা সারাবার দিকে তেমন মন নেই মনে হল। বড় বড় শহরের মেয়রদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে, এই পদ থেকে তাঁরা মন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি হওয়ার দিকে ঝোঁকেন। কিন্তু নগরপ্রধান হওয়ার জন্য কি রাজনৈতিক নেতা অপরিহার্য? বরং এমন যোগ্য ব্যক্তিকেই কি নির্বাচন করা উচিত নয়, যিনি নগর সম্পর্কে বেশি চিন্তা করবেন, নগর-পরিকল্পনায় অভিজ্ঞ হবেন? কিন্তু আজকাল রাজনীতি বিনা কথা নেই, দল ছাড়া রাজনীতি হয় না, নির্দলীয় গুণী-জ্ঞানীরা থাকেন আড়ালে।
স্টেশনে কিংবা রাস্তার ফলকে এখনও লেনিনগ্রাড নাম পালটে সেন্ট পিটার্সবার্গে লেখা হয়নি, তবে এরই মধ্যে সেন্ট পিটার্সবার্গ নামে শহরের ম্যাপ ছাপা হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গী রুশী বন্ধুটি মস্কোয় সরকারি অফিসার, কিন্তু তাঁর নিজের বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়ি এই শহরে, এখানেই তিনি বর্ধিত হয়েছেন। তাঁরও নাম সের্গেই, মনে রাখা সহজ। আমি জিগ্যেস করলাম, এই যে আপনার বাল্যকাল থেকে পরিচিত শহরটার নাম বদলে গেল, এটা কি আপনার পছন্দ হয়েছে?
সের্গেই বললেন, এটা একটা জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত, সবাই মেনে নিয়েছে, এ বিষয়ে আমার মতামত দেওয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না!
আমি বললাম, আপনার কূটনীতি অবলম্বন করার দরকার নেই, সোজাসুজি আপনার মনের কথাটা বলুন না। আপনার পছন্দ-অপছন্দের কথা জানতে চাই।
সের্গেই কিছুক্ষণ আমতা আমতা করলেন, তারপর বলেই ফেললেন, আমার লেনিনগ্রাড নামটাই পছন্দ! বদলাবার কোনও প্রয়োজন ছিল না বোধহয়।
আমি লেনিনগ্রাড শহরের কেউ নই, আমার মতামতেরও কোনও মূল্য নেই। কিন্তু এই ডামাডোলের মধ্যে অকস্মাৎ লেনিনগ্রাড থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যাওয়াটা আমারও মতে ঠিক হয়নি। লেনিনের ভূমিকা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ চলতে পারে, কিন্তু বিশ্ব-ইতিহাসে লেনিনের নাম চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। এমন এক বিপ্লবের তিনি নায়ক, যা সত্যিই দুনিয়া কাঁপিয়েছে। যারা ঝটপট শহরের নাম বদলায়, তারা ভুলে যায় যে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়, ইতিহাসের একটা নিজস্ব গতি আছে, জোর করে ইতিহাস বদলানো যায় না, আজকের নাম বদল এক যুগ বাদে আবার অন্য নাম বদলের পালা আনতে পারে।
৬
মানুষকে শোষণ ও বঞ্চনা করা যেন অন্যায়, মানুষকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়াও একই রকমের অন্যায়। মানুষকে দুর্দশায় ঠেলে দেওয়া যেমন অমানবিক, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে কপট আশ্বাস দেওয়াও একইরকম অমানবিক। যে সমাজ সমস্ত মানুষকে খাদ্য-বস্ত্রের অধিকার দেয় না, সেই সমাজ যেমন অপরাধী, তেমনই যে সমাজ সমস্ত মানুষকে সমান খাদ্য-বস্ত্রের অধিকার দেওয়ার নামেই গড়ে ওঠে ও এক শ্রেণির সুবিধাভোগীকে প্রশ্রয় দেয়, সেই সমাজও অপরাধী।
পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখেছি, শাসনব্যবস্থা কিংবা সমাজব্যবস্থাই ত্রুটিমুক্ত নয়। এক শ্রেণির ওপর আর এক শ্রেণির আধিপত্য চলতেই থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতেও প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রয়োগ আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কারের বাধা তো আছেই, ধনী-নির্ধনের সমান অধিকারও অবাস্তব। আজকের পৃথিবীতে কোনও গরিব মানুষের পক্ষে সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া অসম্ভব। দলীয় রাজনীতিতে দলনেতাই যে দেশের সেরা মানুষ হবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনেক সময়েই দেশের সমস্ত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেন না। গণতন্ত্রে শাসক দলের পরিবর্তনের সুযোগ আছে, এটাই প্রধান কথা।
মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র শুধু আধুনিক চিন্তাই নয়, তাতে প্রকৃত পক্ষেই অনেক আশার বাণী আছে। শ্রেণি বিলোপ, উৎপাদনের সমবন্টন, দেশের সম্পদের অধিকার থাকবে রাষ্ট্রের হাতে, রাষ্ট্রই সব মানুষের জীবিকা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে, এসব প্রতিশ্রুতি তো আছেই, তা ছাড়া ধর্মীয় প্রভেদ একেবারে মুছে দিতে চেয়েছে। সমাজ জীবনে ধর্মের ভূমিকা একেবারে মুছে দেওয়ার এই চেষ্টা পৃথিবীর ইতিহাসে অভিনব। ধর্মীয় মূর্খতার জন্য মানুষের যে কত ক্ষতি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ধর্ম তো নিছক একটা রূপকথা, তা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা হয়েছে বিশ্বের কোটি-নিযুত-অর্বুদ সংখ্যক মানুষকে। আমাদের ভারতে এবং ভারতীয় উপ-মহাদেশে ধর্ম-রেষারেষি না থাকলে সাধারণ মানুষের উন্নতি যে অন্তত দ্বিগুণ হতো, তাতে কোনও সন্দেহ আছে কী? সীমান্তের বিপুল প্রহরা, গ্রাসাচ্ছাদনের বদলে কামান-বন্দুকের উৎপাদন এবং মাঝে-মাঝে ছেলেমানুষি যুদ্ধে আমরা যে বিপুল অর্থব্যয় করেছি, সবই আসলে গেছে ধর্মের আগুনে।
মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রের এই উচ্চ আদর্শ মানুষের ওপর প্রয়োগ করা যায় কি না এবং ঠিক কোন পথে প্রয়োগ করা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে অনেক নিদারুণ বিপর্যয় ঘটে গেছে। যাদের ওপর প্রয়োগের ভার, তারা ধরেই নিয়েছে যে মানুষ হচ্ছে ভেড়ার পাল। দেশে একটিই পার্টি থাকবে, যার নাম কমিউনিস্ট পার্টি, সেই পার্টির রাখালরা লাঠি উঁচিয়ে তাড়ালেই ভেড়ার পাল এদিকে ছুটবে।
সমাজতন্ত্রের এই দুঃখজনক ব্যর্থতার প্রধান কারণ হল ব্যর্থতার কথা গোপন করার চেষ্টা। মাঝে-মাঝে ভুল-ত্রুটি স্বীকার এবং সংশোধনের পথে গেলে হয়তো গতিটা মন্থর হত, কিন্তু এমন বিপর্যয় ঘটত না। তার বদলে তৈরি করা হল মিথ্যার বাতাবরণ।
সমাজতান্ত্রের অগ্রগতি সম্পর্কে মস্কোতে একটা প্রতীকী গল্প প্রচলিত আছে। ধরা যাক, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে একটা ট্রেন। লেনিন এই ট্রেনটা চালাতে চেষ্টা করলেন। এত বড় একটা ট্রেন চালাবার জন্য প্রচুর জ্বালানি দরকার, লেনিন বললেন, মানুষের বাড়ির দরজা-জানলা ভেঙে আনো, বন-জঙ্গল কাটো, যে-ভাবে হোক এ ট্রেন চালাতেই হবে। এরপর স্তালিন হলেন সেই ট্রেনের চালক। তখন লোকের বাড়ির দরজা-জানলা আর নেই, বন-জঙ্গলও সাফ হয়ে গেছে, স্তালিন বললেন, মানুষ ধরে ধরে এনে ইঞ্জিনে ভরে দাও। মানুষ বেশ ভালো জ্বালানি। কয়েক কোটি মানুষকে সমাজতন্ত্রের শত্রু বলে দেগে দিলেই হবে। তারপর এল ত্রুশ্চেভের আমল। তখন দেখা গেল, ট্রেন যে চলবে, সামনের দিকে আর লাইন পাতা নেই, লাইন পাতার মতন ইস্পাতও নেই। তবু সমাজতন্ত্রের ট্রেন চালাতেই হবে। ত্রুশ্চেভ বললেন, পেছন দিককার রেল লাইন উপড়ে এনে সামনের দিকে পাত, এইভাবে পাততেই থাক। এরপর এলেন ব্রেজনেভ। তখন জ্বালানি নেই, লাইন পাতা যাচ্ছে না তো বটেই, তা ছাড়াও সামনে এক বিশাল পাহাড়। ট্রেন এগুবে কী করে? ব্রেজনেভ বললেন, এক কাজ করা যাক। সমস্ত কামরার দরজা-জানলা বন্ধ করে দাও, ভেতরে সারা দেশের মানুষ থাকুক, পার্টি মেম্বাররা শুধু নেমে দাঁড়াও। তারপর পার্টি মেম্বাররা সবাই মিলে ট্রেনটাকে ঝাঁকাতে থাক, তা হলে ভেতরের লোকগুলো ভাববে, ট্রেন ঠিকই চলছে। এরপর গরবাচেভ এসে বললেন, ভেতরে অন্ধকারে লোকগুলো যে কাতরাচ্ছে। দরজা-জানলা সব খুলে দাও। ভেতরের লোকগুলো বাইরের আসল চেহারাটা দেখুক। তারপর যা হওয়ার হোক!
এটা একটা মর্মান্তিক রসিকতা! সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থা নিশ্চয়ই এতটা খারাপ হয়নি, কিন্তু দেশের অবস্থা কতটা খারাপ হলে সাধারণ মানুষ নিজের দেশ সম্পর্কে এরকম গল্প ছড়াতে পারে?
কী পরিমাণ প্রচার চালানো হয়েছে সমাজতন্ত্রের সার্থকতার সপক্ষে! প্রচারের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশ-বিদেশে যত খরচ করেছে, ততটা কি করছে উৎপাদন বাড়াবার জন্য? পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্তের আগে পর্যন্ত অনেকের ধারণা ছিল, পশ্চিমের দেশগুলি সব নরক, আর সমাজতান্ত্রিক জোট একেবারে স্বর্গরাজ্য।
অনেকেই এখন বলছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্য সব ইন্ড্রাস্ট্রি (আমরা ইন্ড্রাস্ট্রির বাংলা করেছি শিল্প, কিন্তু সব জায়গায় শিল্প কথাটা খাটে না) উন্নত হতে না পারলেও একমাত্র যে ইন্ড্রাস্ট্রি খুব সার্থক হয়েছিল, তার নাম মিথ্যে প্রচারের উৎপাদন।
কিছুদিন আগেও অনেকের ধারণা ছিল, সোভিয়েত দেশ পৃথিবীর দুই বৃহত্তম শক্তির অন্যতম। কে প্রথম, কে দ্বিতীয় বলা দুষ্কর। আমেরিকা যত অণু-পরমাণু অস্ত্র বানাচ্ছে, সোভিয়েত দেশও তা বানাচ্ছে, এদের মিসাইল আছে, ওদেরও আছে। এরা মহাকাশযান পাঠাচ্ছে, ওরাও পাঠাচ্ছে। দু'দিকে চলেছে সমান টক্কর, তাহলে সোভিয়েত দেশ দুর্বল হবে কেন? কিন্তু এর মধ্যেও প্রচুর মিথ্যে আছে। আমেরিকা কতবার রকেট পাঠাতে ব্যর্থ হয়, কোনটা ভেঙে পড়ে, তা জানতে কারুর বাকি থাকে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন কত বার ব্যর্থ হয় তা কেউ জানে? আমেরিকা তারকা-যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার খরচ করে। কিন্তু সে জন্য কি সে দেশের মাংসের উৎপাদন কম পড়ে? আমেরিকা চাঁদে রকেট পাঠায় কিন্তু সে জন্য দেশের সাধারণ মানুষের খাদ্যে টান পড়ে না। আর সোভিয়েত দেশে? এখন জানা যাচ্ছে যে, অস্ত্র কিংবা মহাকাশযানের কোনও যন্ত্র বানাতে গিয়ে আমেরিকা যদি তিনবারের পরীক্ষায় সার্থক হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের লাগে কুড়িবার। আমেরিকার কোনও টেকনিশিয়ান দু-তিনবারের বেশি ব্যর্থ হলে তাকে চাকরি ছাড়িয়ে দেওয়া হবে, আর সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনও সরকারি কর্মী কুড়িবার ভুল করলেও তার কোনও শাস্তি নেই। এর ফলে, একই ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমে আমেরিকার তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের খরচ হয়েছে অনেক গুণ বেশি। অস্ত্র ও মহাকাশযান নির্মাণে এই বিপুল অপচয়ে সেখানকার অর্থনীতি ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সাধারণত পণ্যদ্রব্যের উৎপাদনের কল-কারখানাগুলি পুরোনো, ঝরঝরে অবস্থা, অথচ সে দেশের সরকার মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার রকেট বানিয়েছে। দেশের মানুষকে খাদ্য, বস্ত্র, টুথপেস্ট, সাবান না দিয়ে এই সব খেলনা বানানোর উদ্দেশ্যও নিছক মিথ্যে প্রচার। বাইরের পৃথিবীকে জানানো যে সে দেশ কত শক্তিমান! এ যেন আধখানা জানলার কাছে দাঁড়ানো কোনও সুসজ্জিত মানুষ, যে কোমরের তলা থেকে উলঙ্গ।
পশ্চিমি দেশগুলির অবস্থাও এমন কিছু আহামরি নয়। নিখুঁত ব্যবস্থা কোথাও নেই। আমেরিকা যতটা সর্বশক্তিমানের ভাব দেখায়, ততটা শক্তিমান নয় সে দেশ। এত শক্তি নিয়েও তো আমেরিকা কানমলা খেয়েছে ভিয়েতনামের কাছে! উপসাগরীয় যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনকে জব্দ করে জিতেছে বটে, আর কোনও দেশ থেকে বাধা অসেনি, মনে হয় যেন আমেরিকা এখন পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি, তা আসলে নয়, আমেরিকার অর্থনীতি একটা বিপুল ধাক্কা খেয়েছে। উনিশশো একানব্বই সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় আমেরিকার লাভ হয়নি কিছুই। ভূতপূর্ব সোভিয়েতের বিভিন্ন স্বাধীন দেশগুলিতে ছড়িয়ে থাকা সাতাশ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে আমেরিকাকে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে। ধনতান্ত্রিক দেশের বাণিজ্য এক এক সময় যেমন উত্তুঙ্গ হয়, তেমনি এক এক সময় ঝপ করে পড়েও যায়। আমেরিকায় এত বড় জেনারেল মোটরস কোম্পানি ধুঁকছে আই বি এম লোকসান করছে। প্যানাম-এর মতন বিশাল বিমান সংস্থা বন্ধ হয়ে গেল। বহু সহস্র মানুষ বেকার। আমেরিকার বাজারে এমন হতাশার অবস্থা বহুদিন দেখা যায়নি। ও দেশের মানুষ সঞ্চয় শেখে না। ভোগ্যপণ্যের এমনই তীব্র আকর্ষণ ও প্রচার যে অধিকাংশ মানুষই আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে। হঠাৎ উপার্জন বন্ধ হয়ে গেলে তাদের বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়। ব্যাংকের কাছ থেকে উদার ঋণ নিয়ে সবাই বাড়ি কেনে, কিন্তু ঋণ শোধের কিস্তি বন্ধ হলেই ব্যাংক টুঁটি চেপে ধরে। ওদেশের পথে পথে এখন বেকারের ভিড়। সবচেয়ে শক্তিশালী ধনতান্ত্রিক দেশ এখন একা আমেরিকা নয়, জাপান। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় আমেরিকা এখন জাপানের থেকে পিছিয়ে। ওদিকে সংযুক্ত জার্মানি গোকুলে বাড়ছে। ইউরোপের দেশগুলি জোটবদ্ধ হয়েছে। পৃথিবীতে আমেরিকার একাধিপত্যের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।
অনেকে এখন ঠাট্টা করে বলছে যে, এরপর আমেরিকা হয়ে যাবে কমিউনিস্ট দেশ, আর রাশিয়া হবে ক্যাপিট্যালিস্ট। রাজনীতির খেলায় কিছুই অসম্ভব নয়।
আমাদের দেশে অনেকে বলেন যে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে যতই গণ্ডগোল থাক, ওসব দেশের সমস্ত মানুষ মোটামুটি খেতে পরতে পেত এবং কিছু না কিছু জীবিকার নিশ্চয়তা ছিল, এখন সেই ব্যবস্থা বদলের পর সকলকেই ঠেলে দেওয়া হল অনিশ্চয়তার দিকে।
এই কথার মধ্যে অনেকখানি যুক্তির ফাঁক আছে। চোখে ধুলো দেওয়ার ব্যাপার আছে। আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা আছে। আমাদের দেশের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ মানুষই সারা বছর দু'বেলা খেতে পায় না। কোটি কোটি শহুরে বেকার তো আছেই, তা ছাড়া গ্রামের ভূমিহীন, কৃষক-মজুররা বছরের কিছু সময় কাজ পায়, অন্য সময় তাদের কোনও ক্রয় ক্ষমতাই থাকে না। বহু মানুষের মাথা গোঁজার জায়গা নেই। এই ব্যবস্থার তুলনায় যেখানে মানুষ দু'বেলা কিছু না কিছু খেতে পাচ্ছে, যে-কোনও রকম একটা বাসস্থান আছে এবং সরকার প্রত্যেকেরই কিছু একটা জীবিকার ব্যবস্থা করে দেয়, সে দেশের ব্যবস্থা নিশ্চিত অনেক ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই, আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা করা হবে কেন?
মধ্য এশিয়ার কিছু অংশ বাদ দিলে, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি সবই ইউরোপে। সমাজতন্ত্র বর্জিত বাকি ইউরোপের অবস্থা কী? সোভিয়েত দেশের সঙ্গে আমেরিকার তুলনা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তুলনা দিতে হবে ইউরোপের সঙ্গে। যেমন ভারতের সঙ্গে তুলনা দেওয়া চলে চিনের।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপের যে পরিবর্তন ঘটেছে, এর আগে কোনওকালে তেমনটি হয়নি। এককালে ইউরোপেও এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে চরম দারিদ্র্য ও অশিক্ষা ছিল, গৃহহীন-উপবাসীও ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলি গত পঁয়তাল্লিশ বছর যুদ্ধ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে, এমন বিশ্রাম তারা আগে কখনও পায়নি। এই সব দেশের অর্থনীতি এমন একটা রূপ নিয়েছে, যাতে অতি ধনী হয়েছে কিছু লোক। আর আছে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আমরা যাকে দরিদ্র শ্রেণি বলি, সেই শ্রেণিটা মুছে গেছে ওইসব দেশ থেকে। দু-বেলা খেতে পায় না কিংবা বাড়িঘর নেই কিংবা শীতবস্ত্র নেই, নিছক পাগল-মাতাল ছাড়া এমন মানুষ নেই ওসব দেশে। বেকারদেরও ওইসব দেশের সরকার না খেয়ে মরতে দেয় না। সোশাল সিকিউরিটির ওপর যারা নির্ভর করে, তাদের অবস্থা আমাদের দেশের অনেক চাকরি পাওয়া লোকের চেয়ে ভালো। কারখানা থেকে যে শ্রমিকটির চাকরি যায়, সে পেট্রোল পাম্পের তেল দেওয়ার একটা কাজ পেয়ে যেতে পারে, এবং তার উপার্জন তুচ্ছ নয়। ওইসব দেশের শতকরা আশিজনের অবস্থা সমাজতান্ত্রিক দেশের মানুষদের তুলনায় অনেক বেশি সচ্ছল। ওইসব দেশ গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অনেকটা ঘুচিয়ে ফেলেছে। আমি ইউরোপের বহু গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখেছি, প্রকৃত গ্রাম বলতে আর কিছু নেই। সর্বত্রই পাকা রাস্তা, জরাজীর্ণ বাড়ি চোখে পড়ে না, জীবন যাপনের সব রকম উপকরণ সারা দেশে একইরকম ভাবে পাওয়া যায়। ধনতন্ত্রের তুলনায় সমাজতন্ত্র অনেক মহত্তর আদর্শ নিয়েও এইখানে ধাক্কা খেয়েছে।
পোল্যান্ড-হাঙ্গেরি-চেকোশ্লোভাকিয়ার মানুষ কখনও ভাবেনি যে তারা গরিব ভারতীয়দের তুলনায় ভালো আছে। তাদের ক্ষোভ জমা হয়েছে এই কারণে যে তারা ফ্রান্স-জার্মানি-ইংল্যান্ডের চেয়ে কেন খারাপ আছে? প্রতিযোগী রাষ্ট্রের মানুষ যদি ভালো খেতে পরতে পায়, তাদের বাসস্থান যদি উন্নতমানের হয়, তারা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসগুলি যদি নিয়মিত পায়, তাহলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় থাকবে কতদিন? সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান প্রকট। শহরে তবু যা পাওয়া যায়, গ্রামে সেসবও দুর্লভ। লোক দেখানোর জন্য শহরে ঢাউস ঢাউস বাড়ি বানানো হয়েছে, অথচ সেগুলি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই। সবাইকে চাকরি দেওয়ার নামে মানুষগুলির ইচ্ছে-অনিচ্ছে কিংবা যোগ্যতার মূল্য না দিয়ে যে-কোনও একটা কাজে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। চাকরির ক্ষেত্রে এরকম বহু বিক্ষুব্ধ ব্যক্তির দেখা পেয়েছি আমি ওই দেশগুলিতে। গ্রামের মানুষ শহরে যেতে পারে না ইচ্ছেমতন, দেশের যে-কোনও জায়গায় জীবিকা খুঁজে নেওয়ার অধিকার নেই তার। সমাজতন্ত্রের আসল প্রতিযোগিতা ছিল অন্য ইউরোপের সঙ্গে, কিন্তু সেদিক থেকে দৃষ্টি ফেরাবার জন্য সমাজতন্ত্রের কর্তা ও তাত্বিকেরা আমেরিকা আমেরিকা বলে চিৎকার করেছেন।
এখন সমাজতন্ত্রের এই পতন থেকে আমরা কী শিক্ষা নেব? এই পতন সাময়িক কিনা সে বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। ওই দেশগুলি ঘুরে আমার মনে হয়েছে, অন্তত এই শতাব্দীর মধ্যে ইউরোপের ভূখণ্ডে ওই ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের সম্ভাবনা নেই। সকলেই তো স্বার্থপর বা ভণ্ড নয়, মস্কোতে এমন কিছু কিছু মানুষের দেখা পেয়েছি, যাঁরা প্রকৃত আদর্শবাদী, মার্কসবাদে দৃঢ় বিশ্বাসী, মার্কস-লেনিন প্রদর্শিত সমাজব্যবস্থার পতনে মর্মাহত কিন্তু ঠিক কোথায় কোথায় ভুল হয়েছিল, কিংবা ভবিষৎ রূপ কী হতে পারে সে বিষয়ে বিভ্রান্ত। একজন বেশ উঁচু পদের ব্যক্তি আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, আমরা রাজনীতি নিয়ে যতটা মাতামাতি করেছি, ততটা মন দিয়ে অর্থনীতি বোঝার চেষ্টা করিনি। মানুষের মনস্তত্বও বুঝিনি। আগামী দশ বছর এইসব শিখতে হবে।
আমাদের বিভ্রান্তি আরও বেশি। আমরা ইউরোপ-আমেরিকার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার করি কিন্তু নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে প্রায় অন্ধ। আমাদের অবনতির মূল কারণ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ক্লেদ। বহু বছরের পরাধীনতায় যে সব দূষিত চিন্তা ও আবর্জনা জমেছিল, সে সব সাফ করার উদ্যোগই নেওয়া হল না। সাউথ আফ্রিকাতেও সাদা-কালোর ব্যবধান ঘুচতে চলল, কিন্তু আমাদের দেশে বর্ণবিদ্বেষ ঘোচাবার কোনও চেষ্টা হয়েছে; ধর্মীয় গোঁড়ামি বাড়ছে দিন দিন। বিবাহের নামে মেয়ে কেনাবেচা হয়। নামে ভারতীয় হলেও ভারতীয়ত্ব বলে কিছু নেই। জাতি হিসেবে কী আমাদের পরিচয়? কোন বৈশিষ্ট্যে হবে এই জাতির মর্যাদা? জাতি গড়ার কাজে মনই দেওয়া হল না। বরং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গটাই একটা নিন্দনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। আমরা মনে-মনে বিশ্ব নাগরিক, কিন্তু বিশ্বের কাছে আমরা উপহাসের পাত্র।
এ দেশের দারিদ্র্য দূর করার জন্য সমবন্টন ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখা অসংগত নয়। কেন্দ্রের সরকার সমাজতন্ত্রের পথে এক ধাপ এগিয়ে আবার দু-ধাপ পিছিয়ে যায়। যেহেতু পুরোপুরি সমাজতন্ত্র আসেনি, তাই অনেকের বিশ্বাস ছিল সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বামপন্থীরা এই বিশ্বাসে উস্কানি দিয়ে এসেছেন। তাতে ফল হয়েছে এই যে, অন্য অনেক ব্যাধি, অনেক কুসংস্কার, অনেক জঞ্জাল, অনেক অনুদ্যম ধামা চাপা দিয়ে রাখা গেছে, পুরোপুরি সমাজব্যবস্থা বদলালে ওই সব ঠিক হয়ে যাবে! পানের পিক ফেলে দেওয়াল নোংরা করা উচিত নয়, এই কথাটা বলার জন্যও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বদলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এখন কেউ কি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে যে সমাজব্যবস্থা বদলালেই এ দেশের নব্বই কোটি মানুষকে উপযুক্ত খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হবে? ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরলে, খোলা বাজারের অর্থনীতিতে কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র থেকে যাবে নিঃসন্দেহে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও কি এই নব্বই কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। আমার সন্দেহ হয়, এ দেশের বামপন্থীরাও এখন আর তা বিশ্বাস করেন না। সেইজন্য মুখে তারা যতই সমাজতন্ত্রের জয়গান করুন, সেদিকে এগোবার কোনও উদ্যমই আর চোখে পড়ে না। বরং যেন তাঁরা অন্য পথ খোঁজাখুঁজি করছেন।
পূর্ব ইউরোপ আর সোভিয়েত দেশে যাই-ই ঘটুক, আমাদের তাকাতেই হবে চিনের দিকে। অনেক বিষয়েই এই দুই দেশের মিল আছে। এবং চিন আমাদের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে আছে। চিনের শহরগুলি এবং রাস্তাঘাট আমাদের চেয়ে উন্নত। মোটামুটি দু'বেলার অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু চিনের সমাজতন্ত্র বহু সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। গ্রামের লোকদের জীবিকার সংস্থান করতে পারেননি সরকার। যুব সমাজকে বলা হচ্ছে, তোমরা কাজ তৈরি করে নাও! গ্রামের মানুষ শহরে ঢুকতে এলে তাদের জোর করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এ দৃশ্য আমি নিজের চোখে দেখেছি। এক শহর থেকে অন্য শহরেও যাতায়াত করা যায় না বিনা অনুমতিতে। ছেলেমেয়ে বিক্রি, বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ হয়নি। সেখানকার সমাজতন্ত্রের রং বদল হচ্ছে অতি দ্রুত, কমিউনিস্ট পার্টি নেহাত নিজেদের নামটা বজায় রেখেছে কিন্তু ধনতন্ত্রের অনেক রীতিনীতি তারা মেনে নিচ্ছে স্বেচ্ছায়। সাম্যের কথা ঘুচে গেছে, কিছুদিন আগে চিনা সরকার ঘোষণা করেছে যে বৈদেশিক সাহায্যে উপকূল অঞ্চলের অগ্রগতি হবে আগে, সেখানকার তুলনায় অন্য অঞ্চলের মানুষকে আপাতত পিছিয়ে থাকতে হবে। চিনেরা আমাদের মতন কথার ফুলঝুরি নয়, তারা অনেক বেশি বাস্তববাদী। চিন দেশে সত্যিই কথা কম, কাজ বেশি।
নব্বই কোটির জায়গায় আমাদের জনসংখ্যা অবিলম্বেই হবে একশো কোটি। মার্কসবাদে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা নেই, তাই আমাদের মার্কসবাদীরা তা নিয়ে মাথা ঘামান না। পূর্ব ইউরোপে বা সোভিয়েত দেশে সে সমস্যাও ছিল না। দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার চাপ সহ্য করতে হয়নি, বহিরাগতদেরও গ্রহণ করা হয়নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ভারতের মতন চিনেরও সমস্যা, তাই চিন সরকার এই ক্ষেত্রে মার্কসবাদের তোয়াক্কা না করে কঠোরভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ বিধি চাপিয়েছে। সাংহাই শহরে আমাদের তরুণী গাইডকে জিগ্যেস করেছিলাম, তোমার ছেলেমেয়ে ক'টি? সে বলেছিল, একটির বেশি হলে আমার চাকরি যাবে এবং জেল খাটতে হবে! ভারতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস সীমাবদ্ধ নিছক কিন্তু পোস্টারে-হোর্ডিংএ। শহরের বস্তিতে এবং গ্রামের গরিব পরিবারেই সন্তানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমাদের পাশের রাজ্যে পৌনে এক ডজন সন্তানের পিতা মুখ্যমন্ত্রী হয়!
আমাদের জনসংখ্যা একশো কোটি ছাড়াবে, দারিদ্র্য এবং সেই অনুষঙ্গের অন্যান্য সমস্যা বেড়েই চলবে। এ যাবৎ অন্য কোনও ব্যবস্থাতেই এই অবস্থার বদল হয়নি। সমাজতন্ত্র নামে চমৎকার একটি স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নে আমাদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির একটা স্থির চিত্র আঁকা ছিল। এখন সেই স্বপ্ন, সেই ছবিও অলীক হয়ে গেল? এটাই খুব বেদনার। পূর্ব ইউরোপের পট পরিবর্তন আসলে এক শোকাবহ ঘটনা। এক মহৎ আদর্শের পরাজয়। আমাদের দেশের সামনে কি তা হলে আর কোনও আশাই রইল না। দিন দিন আমাদের আরও অবনতি হবে এবং জনসাধারণকে মিথ্যে স্তোকবাক্য শুনিয়ে যাওয়া হবে? এ দেশের ভূমি বহু ব্যবহৃত, খনিজ ও বনজ সম্পদ যথেষ্ট নয়, তাহলে একশো কোটি মানুষের ক্ষুধা মিটবে কীসে? একমাত্র বিজ্ঞানই ভরসা। বিজ্ঞানের কোনও নতুন আবিষ্কার হয়তো মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণার সমাধান করে দিতে পারে। ম্যাজিকের মতো চমকপ্রদ কিন্তু বাস্তব সত্য কোনও পথ উপহার দেবে বিজ্ঞান, আমাদের দেশটা উদ্ধার পেয়ে যাবে। আমি আশাবাদী, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এই আশা করে যাব।
No comments:
Post a Comment