বই পেতে তার ওপর চাদর বিছিয়ে শুতাম


বই পেতে তার ওপর চাদর বিছিয়ে শুতাম…” 
বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় সুজিত সরকার।

সুজিত : কৃত্তিবাসএর যে তিন বোহেমিয়ান কবির কথা আমরা শুনেছি আপনি তাঁদের অন্যতম। শক্তি চট্টোপাধ্যায় দীপক মজুমদার অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। আপনার সঙ্গে আমার সেভাবে কখনও যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি, আপনি বাংলাদেশে থাকেন, পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকায় আপনার কিছু কবিতা পড়েছি। উৎপলকুমার বসুর কাছে আপনার সম্পর্কে অনেক মজার মজার কথা শুনেছি, আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী পড়ে আপনার বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছি। আপনি কীভাবে এই কৃত্তিবাস, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবিতা, মধ্যরাত্রির কলকাতা ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হলেন?
বেলাল চৌধুরী : আমি একসময় মাছধরার জাহাজে কাজ করতাম। যাকে বলে ট্রলার। ট্রলারে কাজ করতে করতে আমি কলকাতায় এসে পৌঁছাই। আমার হাতে তখন বেশ কিছু কাঁচা টাকা ছিল। আমার সঙ্গে পুরনো এক বন্ধুর দেখা হয়ে গেল। সে আমাকে কফি হাউসে নিয়ে গেল। বইপত্তর, পত্রপত্রিকা ঘাটাঘাটি করার ব্যাপারে আমার একটু শখ রয়েছে। আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই প’ড়ে আসছি। কবিতা পত্রিকা থেকে শুরু করে বহু পত্রিকাই আমার সংগ্রহে ছিল। দেশ পত্রিকা প্রথম সংখ্যা থেকেই আমার বাড়িতে ছিল। মা-বাবা দুজনেই বইটই পড়তেন। বাবা বাড়িতে বই আনতেন। তিনি রেল কোম্পানিতে চাকরি করতেন। যখনই বাইরে থেকে আসতেন কিছু বই-পত্রপত্রিকা সঙ্গে থাকত। সেই সূত্রে পড়ার চলটা আমাদের বাড়িতে ছিল। তবে লেখালেখি করার কোনো চিন্তা আমার মধ্যে ছিল না। মার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। মাতৃহারা হয়েছিলেন ছোটবেলাতেই। মামার বাড়িতেই মানুষ হয়েছিলেন দিদিমার কাছে। উনি নবীনচন্দ্র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনর্গল মুখস্থ বলতে পারতেন। আত্মীয়স্বজনদের বিয়ে বা জন্মদিন উপলক্ষ্যে কবিতা রচনা করতেন। শুনে বেশ মজা পেতাম। আমার বাবার যে বিপুল বইয়ের সংগ্রহ ছিল, সেখান থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথমা পড়ি, বুদ্ধদেব বসুর হঠাৎ আলোর ঝলকানি। কুমিল্লার সঙ্গে আমাদের একটা যোগ ছিল। আমার জন্ম নোয়াখালির প্রত্যন্ত এক গ্রামে, কিন্তু আমি মানুষ হয়েছি কুমিল্লাতে। সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে কুমিল্লার খুব নাম ছিল। গান-বাজনায় কুমিল্লা ছিল অসাধারণ। শচীন কর্তা ছিলেন, আমার এক কাকা ছিলেন নজরুলের বন্ধু, আর এক কাকার নান মোতাহের হোসেন চৌধুরী, তিনি লেখক ছিলেন। তা আমি যখন গ্রামের বাড়িতে থাকতাম, আমার মা একদিন আমার পকেটে একটা বিড়ির টুকরো আবিষ্কার করেছিলেন। উনি হয়ত আমার ভালোর জন্যই আমাকে পিসিমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, একপ্রকার বনবাসেই। বনবাস বলতে সন্দ্বীপ। আমার পিসেমশায় সন্দ্বীপের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি অসাধারণ পড়ুয়া ছিলেন। এন্ট্রান্স পাশ করা কোনো মানুষের পড়াশোনা এত গভীর হতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বহু মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে ওঁর কথা শুনতো। সবচেয়ে বড় কথা, উনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। সন্দ্বীপে দুটি স্কুল ছিল, একটি কার্গিল হাইস্কুল, আরেকটি সন্দ্বীপ হাইস্কুল। আমি কার্গিল হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। ওখানে আঞ্চলিক লােকেরা তাে ছিলই, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রচুর লােক ওখানে থাকতেন। যে মাস্টারমশাই আমাকে পড়াতেন তিনি ছিলেন যােগেশচন্দ্র পাঠক। উনার সঙ্গে প্রায় একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। উনি আমাকে দিয়ে স্কুলের নাটক করাতেন, এটা করাতেন, সেটা করাতেন। বেশ ভালাে লাগতাে। মা-ভাইবােনদের ছেড়ে আমার যে দুঃখ ভেতরে ভেতরে অনুভব করতাম, উনার সাহচর্যে এসে সেসব ভুলে যেতাম। সন্দ্বীপ শহরটা অতটুকু হলে কী হবে, সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল সাংঘাতিক। সেখানে একজনকে পরবর্তীকালে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। তিনি হলেন পার্থসারথি চৌধুরী। ওঁর বাবা ছিলেন আমাদের মাস্টারমশাই। পার্থকে আমি আবিষ্কার করি কলকাতায় এসে। সন্দ্বীপে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিভেদ নিয়ে উত্তেজনা ছিল। মসজিদে হয়ত নামাজ পড়া চলছে, তখন এদিক থেকে জোরে জোরে ঢাকবাদ্যিও বাজছে। এটা ঘিরে একটা উত্তেজনা ছিল। কিন্তু আমার পিসেমশায় এই সাম্প্রদায়িক বিভেদকে দৃঢ় হস্তে থামিয়েছিলেন। ওঁর মানসিকতায় আমি গড়ে উঠেছি। যার ফলে ইসলামিক শিক্ষাদীক্ষা আমার কখনাে হয়নি। আমার বাবা-মা ধর্মপরায়ণ ছিলেন। কিন্তু উনারা রবীন্দ্রনাথের এত ভক্ত ছিলেন যে ওঁরা মােনাজাত যেটা করতেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। এই পরিবেশের মধ্যে মানুষ হয়েছি। লিখবাে যে কোনােকালে ভাবিনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমি কুমিল্লাতে ছিলাম। আস্তে আস্তে পড়াশােনায় অমনােযােগী হয়ে উঠলাম। তবে কুমিল্লায় লাইব্রেরি প্রচুর ছিল। বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, অমূল্য স্মৃতি পাঠাগার, আরাে অনেক লাইব্রেরি । সব লাইব্রেরি থেকেই আমি বই নিয়ে আসতাম। মনে পড়ে এক বৃষ্টির রাতের কথা। সকাল থেকেই আকাশে ঘন মেঘ, গুড়গুড় করছে। আমি তিন মাইল দৌড়ে তিনটে লাইব্রেরি থেকে তিনটে কিরীটির বই আনলাম। তখন কিরীটির বই পড়ার নেশা ছিল। তাে, সেই রাতে, হ্যারিকেনের আলােয়, তখন তাে ইলেকট্রিসিটি ছিল না, তিনটে বই শেষ করেছিলাম। তখন কলকাতা থেকে অনেক পত্রপত্রিকা ওখানে যেত। তারপর শুরু হলাে আমার ভাসমান জীবন। উল্টোরথ, প্রসাদ, ইদানীং, চতুরঙ্গ সবরকমের পত্রপত্রিকাই যেত। সেই প্রথম সুনীলদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বাঘ’ নামে একটা গল্প পড়ি। পরে শুনেছিলাম, ওটাই সুনীলদার প্রথম গল্প। এইভাবে সাহিত্যরুচি গড়ে ওঠে। বাড়ি পালিয়ে ঢাকা যেতাম। ঢাকায় তখন ভাষা-আন্দোলন চলছে। তাতেও জড়িয়ে গিয়েছিলাম। লােহানী ভাই তখন অগত্যা বের করছেন। এই লােহানী ভাইয়ের কাছেই প্রথম শুনি বিষ্ণু দে-র কথা, কলকাতার কথা। লােহানী ভাই যে কলেজে পড়তেন, বিষ্ণু দে ছিলেন সেই কলেজের মাস্টারমশাই। জীবনানন্দ দাশের কথা প্রথম শুনি। প্রচুর পড়তাম। উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে আশালতা সিংহ কিছুই বাদ দিইনি। তবে লেখার কথা একেবারেই ভাবিনি। এরপর কাজটাজ শিখে টাকা রােজগারের উদ্দেশ্য নিয়ে চট্টগ্রামে মামার কাছে পৌঁছলাম। সেখানে ‘নিউজফ্রন্ট’ নামে একটা বইয়ের দোকান ছিল। সেখান থেকে প্রচুর বই কিনতাম। তখন সুবােধ ঘােষ আমার ফেভারিট লেখক। রাজশেখর বসুর সব বই পড়েছিলাম সেই বয়সে। আমার মতাে সুবােধ ঘােষ পড়েছে কেউ আমার সময়ে, আমার ধারণা নেই। পড়তে পড়তে কমলকুমার মজুমদারকে একদিন আবিষ্কার করি ঢাকাতে, এক বইয়ের দোকানে, অন্তর্জলী যাত্রা। ওঁর ভাষারীতি আমাকে এতটাই মুগ্ধ করল যে আমি ওঁর ভক্ত হয়ে পড়লাম। পুরনাে দেশ-এ ওঁর একটা-দুটো গল্প পেলাম। চতুরঙ্গ-এ পড়লাম ওঁর গল্প ‘মল্লিকাবাহা’। তারপর তাে মাছ ধরার কাজ করতে করতে কলকাতায় আসা। আমার এক দাদু পার্কসার্কাসে থাকতেন। উনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের খুব স্নেহাস্পদ ছিলেন। উনার নাম ছিল খান বাহাদুর আবদুর রশীদ খান। উনি ক্যালকাটা কর্পোরেশনের প্রথম মুসলিম একজিকিউটিভ। সুহরাওয়ার্দিদের বাড়ির পাশেই উনি বাড়ি করেছিলেন। ওই বাড়িতেই আশ্রয় নিলাম। সে সময়েই আমার এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। ওই আমাকে কফি হাউসে নিয়ে গেল।
কফি হাউসেই টুকটুক করে কয়েকজন তরুণ লেখকের সঙ্গে আলাপ হলাে। ওদের সঙ্গে বেশ জমে গেলাম। ওই করতে করতে শক্তিদার সঙ্গে আলাপ। শক্তিদা আর আমি যেভাবে কাটিয়েছি, স্বামী-স্ত্রীও বােধহয় ওভাবে জীবন কাটায় না। শক্তিদার বাড়ি যাওয়া, শক্তিদার মা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। শক্তিদা তখন উল্টোডাঙ্গায় অধর দাস লেনে থাকতেন। তিন কামরার একটা বাড়ি। মাঝের কামরায় ওঁরা থাকতেন। শক্তিদার মা, শক্তিদা, শক্তিদার ভাই ভক্তি। শক্তিদাকে একদিন বদ্ধ মাতাল অবস্থায় কফি হাউস থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়লাে আমার ওপর। শক্তিদাকে ট্যাক্সি করে নিয়ে গিয়েছি। গিয়েই শক্তিদা সব জামাকাপড় খুলে ফেললাে। শুধু আন্ডারওয়ার পরা। শক্তিদা সেই অবস্থায় নাচতে শুরু করেছে। ওর একটা টিপিক্যাল নাচ ছিল। মাসিমা বলছে : ‘হাবলা, চুপ করলি, চুপ করলি।’ কে চুপ করে! শক্তিদার আবার সাহেবি চাল ছিল। গরম জল ছাড়া চান করতে পারতাে না। বাড়িওয়ালার দুটি সােমত্ত মেয়ে ছিল। তারা চট করে খাটের নীচে লুকিয়ে পড়লাে। আর শক্তির ভাই বলছে : আজ মেরে ফেলব, কেটে ফেলব, এ আর সহ্য হয় না।
সুজিত : উৎপলকুমার বসুর কাছে শুনেছি, উনি যখন সাহেব পাড়ায় থাকতেন। বেলাল রােজ রাতে একজনকে ধরে আনতাে। তার পয়সায় মদ খেত আর তাকে বােঝাতাে রাত্তিরে থাকার কোনাে অসুবিধে নেই
বেলাল : একবার হলাে কী, আমার কাছে কিছু টাকাপয়সা ছিল, উৎপলদা বললাে কোথাও বেড়াতে গেলে হয়, শক্তিদাও সঙ্গে সঙ্গে বললাে, হ্যাঁ, ভালােই তাে। শক্তিদা তাে মাত্র দশপয়সা নিয়ে সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরােতেন, তারপর সারাদিন কীভাবে কাটবে নিজেও জানতেন না। তাে আমরা ঝাড়গ্রামের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমি, শক্তিদা, উৎপলদা, আর পবিত্র বল্লভ বলে একটি ছেলে। একটা উত্তেজনা নিয়ে আমরা চলে গেছি। এখান থেকে রামের বােতল কিনে খেতে খেতে গাড়িতে উঠেছি। পৌঁছে ট্রেন থেকে নেমে শক্তিদা বললাে, এখানে আমাদের এক বন্ধু আছে, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে দেবীপ্রসাদ পড়ায়। তখন জানতাম না যে শক্তিদা আগে একবার ওখানে গিয়ে গণ্ডগােল করে এসেছে। চানটান করে খেতে বসেছি, দেবীপ্রসাদের মা অর্থাৎ মাসিমা টানা বারান্দায় আমাদের খেতে বসিয়ে দিলেন, পবিত্র বল্লভকে একটু দূরে বসালেন। আমি যে মুসলমান, ভাগ্যিস তিনি জানতেন না। তাে খাওয়াদাওয়ার পর আমি আর শক্তিদা একটা সাঁওতাল বাড়ি গেলাম, উৎপলদা আর পবিত্র বল্লভ স্টেশনের দিকে গেল। আমাদের বন্ধু পার্থসারথি চৌধুরী, যার কথা আগেই বলেছি, সে তখন আই.এ.এস. অফিসার, সে জানতে পেরে আমাদের জন্য একটা বােতল রেখে গেল। শক্তিদার খুব আহ্লাদ হয়েছে। আমরা এত মদ খেয়েছিলাম, আর কিছু মনে নেই। ওই অঞ্চলে আমাদের কথা জানাজানি হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি একটা বারান্দায় আমি আর শক্তিদা শুয়ে আছি। দেবীপ্রসাদ পায়চারি করছে। একটু পরে দেখি, শক্তিদাও উঠে পড়েছে, দেবীর পাশাপাশি হাঁটছে, কেউ কোনাে কথা বলছে না। হঠাৎ দেবী বললাে, আপনারা কী ঠিক করলেন? রাত্তিরে কী হয়েছে আমরা কিছুই জানি না, পরে শুনেছি আমাদের নিয়ে গােটা অঞ্চলে বিশাল হইচই হয়েছে। উৎপলদা আর পবিত্র বল্লভ জিনিসপত্তর বেঁধে নিয়ে ফিরে গেল। আমার কাছে তখনও কিছু পয়সা আছে। আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। তবে ফিরলাম না। রাস্তায় অদ্ভুত পােশাক পরা খালাসি টাইপের একটা লােকের সঙ্গে আলাপ হলাে। সে-ও আমাদের মদের সঙ্গী হলাে। আমাদের নিয়ে গেল নবাববাড়ির ভেতরের একটা জায়গায়। সেখানে সারাদিন মদ খাওয়া হলাে। কিন্তু একটা সময়ে ক্লান্তি আসে। আমরা ঠিক করলাম, রাতে কলকাতা ফিরে যাবাে। দানাপুর এক্সপ্রেস ভিড়ে-ভিড়াক্কার দেশােয়ালি ভাইরা সব এদিকে আসছে। তাে, শক্তিদাকে আমি ‘মা শীতলার দয়া’ বলে জানলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম। আমি কোনােরকমে ভেতরে উঠে চিড়ে চ্যাপটা হয়ে কলকাতা পৌঁছলাম । মেডিক্যাল কলেজের পাশে ডাক্তারদের একটা আস্তানা আছে, তাছাড়া মেথরপট্টি আছে। শক্তিদার এক ডাক্তার বন্ধুর আস্তানায় শক্তিদা আমাকে নিয়ে গিয়ে তুললাে, বললাে, কোনাে চিন্তা করবেন না, রাতটা এখানে কাটান। কাল সকালে আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাবাে। আমি তাে বসে রইলাম। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমার আস্তে আস্তে আলাপ পরিচয় হচ্ছে। মেথরপট্টি থেকে ভেসে আসছে সমস্বরে গান। গঙ্গা-যমুনা বলে দিলীপকুমারের একটা ছবির গান সে সময় অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। সারারাত ধরে প্রবল উৎসাহে ডাক্তারবাবু গল্প করে যাচ্ছেন, আর আমি ঘুমে ট’লে পড়ে যাচ্ছি।
সুজিত : সুনীলদার সঙ্গে আপনার আলাপ কীভাবে হলাে?
বেলাল : সুনীলদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল অনেক পরে। তাে, খালাসীটোলায় গিয়ে একদিন শুনি এখানে কমলদা আসেন, কমলকুমার মজুমদার। আমার তাে আগ্রহ আর বাঁধ মানে না। একদিন সত্যিসত্যি উনাকে পেয়ে গেলাম। উনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন দেখে পাশ থেকে কে যেন বললাে, আপনি ওই ছোঁড়াটার সঙ্গে কী কথা বলছেন। কমলদা বললেন, দূরের ভালােবাসা। এই সময়ে আমার সঙ্গে আরেকটি ছেলের আলাপ হলাে। সুবাে আচার্য। ওরও কোনাে থাকার জায়গা নেই। সুবাে ছিল অসম্ভব সুনীল-ভক্ত। সুনীলদা তখন এখানে নেই, আমেরিকায়। সুনীলদার সঙ্গে আলাপ হলাে বঙ্গ সংস্কৃতির স্টলে, যেটা তখন হ’ত মার্কাস স্কোয়ারে । সুনীলদার কিছু কবিতা আমার পড়া ছিল। তবে প্রথম দিন থেকেই সুনীলদার স্নেহস্পর্শ আমি পেয়েছি। সুনীলদা মাতাল হয়ে গেলে বিরাট বিরাট জাম্প করত, ছট পূজোর মতাে। আজকের সুনীলদার সঙ্গে ওই সুনীলদার কোনাে মিল নেই। তখন ইন্দ্রদার সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়ে গেছে।
সুজিত : ‘সুবর্ণরেখা ইন্দ্রনাথ মজুমদার?
বেলাল : হ্যাঁ, হ্যাঁ, একদিন ব্রাহ্মপুরে শান্তি লাহিড়ীর বাড়ি সারারাত মদ খেয়ে পরদিন সকালে খেয়েদেয়ে ফিরছি আমি আর শক্তিদা। দু’জনেরই ভগ্ন অবস্থা। শক্তিদার চশমা নেই। ছােট ব্রিস্টলের সামনে এসে শক্তিদা বলল : ‘দাঁড়ান, আমি আসছি।” শক্তিদা আমাকে আপনি বলেছে অনেকদিন। ‘তুই’ বলতে শুরু করেছেন অনেক পরে, যখন আমি শক্তিদাকে বলতাম ‘বুড়াে’। তাে, শক্তিদা আমাকে বললাে, আমি আনন্দবাজার থেকে আসছি একটু পরেই। পরে শুনেছিলাম, দেশ পত্রিকায় শক্তিদা একটা নতুন ফিচার লিখবে বলে ঠিক হয়েছে ‘রূপকথার কলকাতা’। ফিরে এসে শক্তিদার চশমা ঠিক করানাে হচ্ছে, সে সময়ে দেখি চারজন লােক ছােট ব্রিস্টলে ঢুকছে। তার মধ্যে ইন্দ্রদা। শক্তিদা বলছে : কী, কোথায় যাচ্ছেন? ইন্দ্রদা বললেন, একটু বিয়ার খেতে চললুম। আমি ভাবলাম, বাপরে, এই দুপুরবেলায় বিয়ার খেতে চললাে, আমাদের একটুও বলছে না। ইন্দ্রদাকে একদিন দেখি, কফি হাউস থেকে নেমে আসছে। সঙ্গে সৌমিত্র, শুভেন্দু। ওরা তখন সিনেমার নায়ক। এক ঝাক মেয়ে ওদের ঘিরে আছে। তাে, ইন্দ্রদার দিকে তাকিয়ে ওরা জানতে চাইলাে, ইনি কে? সেই ইন্দ্রদার সঙ্গে এক অষ্টমীর রাতে খুব ভাবসাব হয়ে গেল। তখন বটুক ঘােষ নামে এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। বটুক ঘােষ খুব মাতৃভক্ত, মা আজ এই বলেছেন, মা আজ এই করেছেন, এইসব বলত। ও নাকি গঙ্গা সাঁতরায়। শুনেছি ওর একটা কোচিং হাউস ছিল। সেখানে মেয়েরা পাশ করুক বা না করুক, গর্ভবতী হয়ে পড়তাে। একটা স্পাের্টসম্যানের মতাে ভঙ্গি করে আসতাে। কফি হাউসের সূত্রে বটুক ঘােষের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তাে, সেই বটুক ঘােষ অষ্টমীর রাতে বললাে, চলাে, ইন্দ্রনাথের কাছে যাই। বারদুয়ারির পাশের গলি থেকে বােতল জোগাড় করলাম। সৌভাগ্যক্রমে একটা ট্যাক্সিওলা পেলাম। সে পাইকপাড়া যাবে। সে আমাদের নিয়ে গেল। বাড়ির সামনে নেমে তাে আমি অবাক। তখন তাে আমি জানি না এটা সত্যেন ঠাকুরের বাড়ি। সেখানে সব মহাপুরুষদের বড় বড় ছবি, বড় বড় তাকিয়া। পরে জানলাম, এটা বিধান ছাত্রাবাস, ইন্দ্রদা হচ্ছে বিধান ছাত্রাবাসের ওয়ার্ডেন। মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্রেরা ওখানে থেকে পড়াশােনা করে। অসীম চ্যাটার্জী, সন্তোষ রানা যারা পরবর্তীকালে নকশাল নেতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, সব ওখানে থেকে পড়াশােনা করত। তাে, সেই বাড়ির ছাদে খাওয়া-দাওয়া হলাে। ওখানেই শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে উঠে দেখি, ইন্দ্রদা বাজার যাচ্ছে। বললাে, খাওয়াদাওয়া করে যাবি। ইন্দ্রদার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা বাড়ার ফলে আমি ক্রমশ কমলদার ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। কমলদা ইন্দ্রনাথকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। এই হলাে কমলদার সঙ্গে পরিচয়ের একটা দিক। পরে কমলদা আমাকে ওর অঙ্ক ভাবনা পত্রিকায় কাজে লাগিয়ে দিলেন। অঙ্ক ভাবনা আবার লীলাবতী থেকে শুরু করে সব অনুবাদ। অসীম ও বিধান ছাত্রাবাসের অনেকেই অনুবাদ করত। আমি প্রায় দশ ফর্মা পর্যন্ত টানা অনুবাদ করেছি। প্রুফ দেখার কাজ চলতাে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে একটা প্রেসে। সেখানে আবার পাখিদার দোকান ছিল। স্যাঙ্গু ভ্যালির মালিক ছিলেন পাখিদা, উনি আগে পূর্ববঙ্গে ছিলেন, আমার সঙ্গে চেনা-পরিচয় ছিল। ওয়েলিংটন থেকে যেতাম খালাসীটোলা। সেখানে বেশিক্ষণ বসতাম না। কমলদার জন্য ছিল স্পেশাল এক নম্বর বােতল। উনি আঙুলে করে প্রথমে একটু ছিটে দিতেন, তারপর সবাই একগ্লাস করে। সেখান থেকে সবাই চলে যেতাম ‘ক্যাভেন্ডার্স। সেখানে হ্যাম স্যান্ডউইচ খেয়ে আবার ফিরতাম ওয়েলিংটন। অনেকক্ষণ প্রুফ দেখা চলতাে অঙ্ক ভাবনা-র।
সুজিত : এর মাঝখানে তাে আপনি কৃত্তিবাসএর সম্পাদনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল?
বেলাল : না, তখনও লিখিনি। শরৎদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা হয়নি। তাছাড়া, আমার একটা আইডেনটিটি ক্রাইসিস ছিল। কে আমি, লিখি না যখন এদের দলে কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার আড়ালে বলতাে, ব্যাটা পাকিস্তানের স্পাই। আমি তখন কবরখানায় থাকতাম। সেখানে ঋত্বিক ঘটক গিয়েছিলেন, সুনীলদা গিয়েছিলেন, সুনীলদা তাে আবার এক রাত্তির কাটিয়েছিলেন।
সুজিত : ‘আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম’- লাইনটি সুনীলদা বােধহয় এই অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছিলেন
বেলাল : হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক্কেবারে ঠিক। কবরখানার পাশেই ছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস হােম’। তার ওয়ার্ডেন ছিলেন সুকমল দত্ত। পূৰ্বাশা-র সত্যপ্রসন্ন দত্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে যিনি থাকতেন, তাঁর ছােট ভাই। সুকমলদা ছিলেন কুমিল্লার লােক। হােস্টেলের পাঁচতলায় থাকতেন। কবরখানার বস্তিতে যদিও আমার একটা ঘর ছিল, ঘর মানে কি, হসপিটাল থেকে আমাকে একজন একটা খাট দিয়েছিল, তাে আমার বালিশ-বিছানা কিছুই ছিল না, কিন্তু প্রচুর বই ছিল। ওই বইগুলাে পেতে তার ওপর চাদর বিছিয়ে আমি শুতাম। তবে বেশির ভাগ সময় থাকতাম সুকমলদা অর্থাৎ ছােটকুদার কাছে। ছােটকুদা আবার সুনীলদাদের সবাইকে চিনতেন। কৃত্তিবাস-এ এরপর লিখলাম। কৃত্তিবাস-এ লেখার আগে আমাকে লিখতে হয়েছে শান্তি লাহিড়ীর বাংলা কবিতায়। তো ভাবলাম, এত তাে পড়েছি, একটু লিখতে পারবাে না? বাঙালির ছেলে। তাে, একটা কবিতা কৃত্তিবাস-এ লিখলাম। সেই কবিতার প্রথম প্রশংসা আমাকে করলেন উৎপলদা। উৎপলদা আমাকে ভীষণভাবে উৎসাহ দিলেন। সেই একটা জোর পেলাম। আসলে কবিতার প্রস্তুতি তাে ভেতরে ভেতরে থাকেই। কবিতা তাে বহু স্তরের বহুমাত্রিক ব্যাপার। সঞ্জয় ভট্টাচার্য পূৰ্বাশা-র জন্য লেখা চাইলেন। লেখা দিলাম। পূৰ্বাশা-য় আমার লেখা ছাপা হলাে। কৃত্তিবাস-এর লেখাটায় দাঁড়ি-কমা ব্যবহার করিনি। গদ্যের ভঙ্গিতে লেখা। সমীর সেনগুপ্ত বলেছিলেন, কমল মজুমদার পড়তে আমাদের জান বেরিয়ে যায়। তার তুলনায় বেলাল চৌধুরীর লেখাটা সহজে পড়ে ফেলা যায়। এইভাবে বন্ধুত্ব বিস্তৃত হতে হতে একটা সময়ে কলকাতা আমার কাছে ছােট্ট হয়ে গিয়েছিল। যে কোনাে পাড়ায়, যে কোনাে জায়গায় লােকে আমাকে চিনতাে। ভ্রাম্যমান, ভাসমান জীবনে যা হয়। ছােট ছােট কাগজে লিখতে শুরু করলাম। সুনীলদা বিদেশ থেকে ফিরে আনন্দবাজারে ‘দেশে বিদেশে’ বলে একটা পাতা দেখতেন। সেই পাতাতে লিখতাম। ওখানে লিখে কিছু টাকা পাওয়া যেত। তারপর সুনীলদা যখন ‘কলকাতার কড়চা’ দেখতেন, ওখানে আমরা লেখা শুরু করি। মহীদা ছিলেন ক্যাশিয়ার। ইন্দ্রদার বিশেষ পরিচিত। তাে মহীদাকে বললে সঙ্গে সঙ্গে টাকা পাওয়া যেত। অ্যাডডান্সও নিয়েছি। আমার সঙ্গে এসে জুটলাে পাপ্পা, বুদ্ধদেব বসুর ছেলে শুদ্ধশীল বসু। পাপ্পা আমাকে কিছুতে ছাড়ে না। ওর সঙ্গে ওদের বাড়ি চলে যেতাম। বুদ্ধদেব বসু তাে আমাকে সাহিত্যিক হিসেবেই ভাবতেন না। কেনই বা ভাববেন, আমি তাে তেমন কিছু লিখিনি-টিখিনি। দেখলাম উনি একটা বিদেশি সিগারেট খাচ্ছেন। আমি তাে আমার ভাসমান জীবনের জন্য প্রচুর বিদেশি সিগারেট খেয়েছি। তাে বাইরে বেরিয়ে এসে দোকান থেকে ওই সিগারেট-এর একটা প্যাকেট কিনলাম। বুদ্ধদেব বসু খাচ্ছেন বলে কথা। দাম নিল, পাঁচ আনা। তখনকার দিনে পাঁচআনা কিন্তু অনেক। তাে, টেনে দেখলাম, যাচ্ছেতাই সিগারেট। বুদ্ধদেব বসু ওঁর ছেলেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ভাবতেন, পাপ্পা বুঝি উচ্ছন্নে যাচ্ছে। প্রতিভা বসুর সঙ্গে কিন্তু সহজেই মিশে গেলাম। উনি কথায় কথায় বলতেন, আমি ঢাকার মাইয়া। আমিও তাে পূর্ববঙ্গের লােক। মানে, উনি ছিলেন একটা খােলা জানালার মতাে। তো, ওদের বাড়িতে যাতায়াত করতে করতে মীনাক্ষী আর জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেল। এসময়ে ঘুরতে ঘুরতে আমি একটা চাকরিও পেয়ে গেলাম। পত্রিকা সিন্ডিকেট-এ। সেখানে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পত্রিকাটা রাখা হত। দেখতাম প্রেমেন্দ্র মিত্র এসে ওই পত্রিকাটা খুব মনােযােগ দিয়ে পড়তেন। উনি ঘনাদা নিয়ে যেসমস্ত আসাধারণ গল্প লিখতেন, তার সাের্স মেটিরিয়ালটা ছিল ওই ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিন। শক্তিদা তখন একটা কাগজ বের করছে।
সুজিত : সাপ্তাহিক বাংলা কবিতা?
বেলাল : হ্যাঁ। শক্তিদার কাগজের জন্য ফিন্যান্স করত মৃণাল দেব নামে একজন ব্যবসাদার। খুব বড় বড় কথা বলত। পরিপাটি সেজে শ্যামবাজার কফি-হাউসে আসত। ওকে সুনীলদা চিনতেন। তো সে আবার কমলদার বিরােধী ছিল। একদিন কমলদার বিরুদ্ধে কথা বলছে, সুনীলদা ঠাস করে গালে মারলেন। মুখের মধ্যে পান পােরা ছিল। মারতেই পানটা গালের একদিক থেকে অন্যদিকে চলে গেল। আবার সেই গালে একটা ঠাস করে মারলেন। পানটা মুখ থেকে বেরিয়ে এল। সে এক মজার ব্যাপার। তো, তখন সুনীলদা আস্তে আস্তে লেখাটাকেই প্রধান জীবিকা হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। গল্প-উপন্যাস লেখার কথা ভাবছেন। মাঝে মাঝেই বলতেন, কৃত্তিবাস বন্ধ করে দেবাে। আমরা বললাম, বন্ধ করবেন কেন, আমরাই বের করার একটা চেষ্টা করি। কয়েকজন হাততালি দিয়ে আমাদের উৎসাহ দিলাে। আমি নিমাই চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এলাম। সে কর্পোরেশনে কাজ করত।
সুজিত : কৃত্তিবাসএর টা সংখ্যা আপনি সম্পাদনা করেছিলেন?
বেলাল : তিনটে। লাস্ট সংখ্যাটায় সুনীলদা আশি টাকা দিয়েছিলেন। পৃথ্বীশ গাঙ্গুলি অসাধারণ প্রচ্ছদ এঁকেছিল। প্রায় ন’ফর্মার মতাে ছাপা হয়ে গেছে। কিন্তু টাকার অভাবে শেষ পর্যন্ত আর বেরােল না, তারপর সমরেন্দ্র দায়িত্ব নিল। আমার সম্পাদিত কৃত্তিবাস-এ প্রচুর মহিলা কবির কবিতা আছে। যেমন বসন্ত চৌধুরীর স্ত্রী অলকা চৌধুরী, তার সঙ্গে আমার খুব আলাপ ছিল, মতি নন্দীর স্ত্রী ইতি নন্দী; এরকম এমন অনেকে যারা জীবনে ওই একবারই কবিতা লিখেছে এবং কৃত্তিবাস-এ। একসময় হিন্দুস্থান পার্কে থাকতাম, একটা বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে। উল্টোদিকের বাড়িতে থাকতেন পাহাড়ী সান্যাল। ক্যামাক স্ট্রিটে থেকেছি, কুমারটুলিতে থেকেছি, কলকাতার কতাে জায়গায় যে থেকেছি তার কোনাে শেষ। নেই।
সুজিত : বাংলাদেশ হওয়ার পরে আপনি আবার ফিরে গেলেন?
বেলাল : না, ঠিক তখনই ফিরিনি। ফিরেছি তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সাল নাগাদ।
সুজিত : বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে আপনি আপনার লােকজনদের সব খুঁজে পেয়েছিলেন?
বেলাল : হ্যাঁ, সবাইকেই খুঁজে পেয়েছিলাম। বাবা-মা তখনও বেঁচে ছিলেন। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমরা নয় ভাইবােন। আমি বড়াে। তা, আমি হলাম কুলাঙ্গার ছেলে। এই দীর্ঘদিন যে বাড়ি ছিলাম না, বাড়িতে কতাে উৎসব, অনুষ্ঠান হয়ে গেছে, মা চোখের জল ফেলতেন। আমাকে নিয়ে তাঁর কত যে কবিতা আছে! আমাদের বাড়িটা ছিল বিশাল। সতেরাে একর জমির ওপরে। সে বাড়িতে গৌরদা, সুনীলদা, শক্তিদা সবাই গেছে। বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে একটা অয়েল কোম্পানিতে চাকরি পাই। সেটা পরে উঠে গেল। এরপর একটা পত্রিকায় চাকরি করি। পত্রিকাটার নাম সচিত্র সন্ধানী। এটা সাগরদা, সুনীলদা খুব প্রশংসা করেছিলেন। একবার সাগরদা, সুনীলদাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে। সাগরদাকে তাে আটকে দিলাে। দেশের বাড়ি দেখা হলাে না। কী লজ্জার ব্যাপার, সাগরদার মতাে মানুষ। আমি তখন বললাম, ভাই, সৌভাগ্যক্রমে আপনি এখানে জন্মেছেন, কিন্তু যদি ওখানে জন্মাতেন, তাহলে কি দেশের বাড়ি দেখার ইচ্ছে একবারও হত না? ওরা বললেন, এগুলাে রুটিন-ওয়ার্ক। ওদের বড়াে সাহেবকে ফোন করেছিলাম। উনি সাগরদাকে ওঁর বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
সুজিত : এটা কতাে সালের ব্যাপার? বাংলাদেশ তাে তখন স্বাধীন হয়ে গেছে?
বেলাল : হ্যাঁ আশি সালের কথা বলছি। যুদ্ধের পরেও ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানি মানসিকতা তখনও যায়নি।
সুজিত : আচ্ছা বেলালদা, ভারত বিচিত্রা, যাতে সুনীলদারা সবাই লিখেছেন, এটা কি হাইকমিশনের কাগজ ছিল? এই কাগজটার উদ্দেশ্য কী ছিল?
বেলাল : হ্যাঁ, হাইকমিশনের কাগজ। এর উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে সম্প্রীতি। আমার সেই ভারত বিচিত্রা-র অফিসে কে না এসেছেন! গুন্টার গ্রাস থেকে সবাই। আমার সেই ভারত বিচিত্রা-র ঘরটা ছিল একটা বিরাট ব্যাপার । ওরা আমাকে খুব সম্মানের সঙ্গে রেখেছিল, যতদিন ছিলাম, এয়ারকন্ডিশনড ঘর দিয়েছে, যা চেয়েছি সব দিয়েছে।
সুজিত : এখন কীভাবে সময় কাটান?
বেলাল : এখনও তাে ভ্রাম্যমান জীবন চলছে বলা যায়। কলকাতায় আসার এক সপ্তাহ আগে লন্ডন থেকে ফিরেছি। কবিতা পড়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিল ।
সুজিত : ‘বেলাল কথার অর্থ কী?
বেলাল : আমি তখন এখানে। জ্যোতিদা দেশ-এ কাজ করতেন। রিটায়ার করার পর উনি একটা প্রেস করেছিলেন, রিপন স্ট্রিটে। ওর ছেলেরা সেটা চালাতাে। তো ওরা কাগজ বের করবে। সাগরদা বললেন, বেলালকে নাও। আর রবি বসু ছিলেন। তাে, সেই কাগজের জন্য লেখা আনতে গেছি বিখ্যাত সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছে, বিশ্বাস করুন মনে হলাে সারা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। ঘণ্টা বাজছে, ‘কাকাবাবু’ ‘কাকাবাবু’ চিৎকার।
সুজিত : কেন, কী হয়েছিল?
বেলাল : মুজতবা আলী শেষজীবনে অ্যালকোহলিক হয়ে গিয়েছিলেন। মদ ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতেন না। তাে, মদ শেষ হয়ে গেছে, উনি ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছেন। ‘কাকাবাবু’ ছিল ওঁর কাছের লােক, ওঁর দেখাশােনা করত। তো, আমি গিয়ে বললাম, সাগরদা পাঠিয়েছেন। উনি বললেন, ও, তা কী, কী, কী? আমি বললাম, আপনার একটা লেখা চাই। উনি বললেন, কী লেখা? আমি বললাম সেটা আপনি ঠিক করবেন। সামনে একজন পুলিশের সার্জেন্ট বসেছিল। তাকে বললেন, বুঝলে মুখুজ্জে এই সাগর যখন ছােট ছিল, শান্তিনিকেতনে আমাকে বলতাে, সৈয়দদা, হিসু করবাে। নানারকমের গল্প করছেন। তারপর আমাদের বললেন আমার পারিশ্রমিক জানাে তাে? একটা পাণ্ডুলিপির সবুজ কালিতে লেখা একটা পাতা দেখিয়ে বললেন, প্রতিপৃষ্ঠার জন্য তিন হাজার টাকা, চার হাজার টাকা। তা আমাকে কী লিখতে হবে? আমি বললাম, সেটা আপনি ঠিক করবেন। উনি চিৎকার করে উঠলেন, কচু লিখব, ঘেঁচু লিখব। আমি বললাম, তা আপনার লেখা আপনি লিখুন, আমি উঠি । উনি বললেন, এই নাম কী? আমি বললাম বেলাল চৌধুরী । উনি বললেন, এই জন্য তােমার রক্ত গরম। তুমি তাে বড়াে প্রাণী খাও। তারপর দেখি, আবার ঘণ্টা বাজাচ্ছেন। বিয়ার এল। ভাবলাম, আমাকেও বােধহয় খাওয়াবেন। তা দেখি নিজেই খেতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ আমাকে বললেন, ঘণ্টা, ঘণ্টা, ঘণ্টা। তারপর আরবি-ফারসি অনেক কিছু বলে শেষে বললেন, ‘বেলাল’ মানে সুরভি। বড়াে লেখকের কাছে যখন লেখা চাইতে আসবে- না, থাক, ফুল নয়, এক হাঁড়ি গরম রসগােল্লা নিয়ে আসবে। বলবে, আপনার লেখা পেলে আমরা ধন্য হব। বললাম, আগে জানলে নিয়ে আসতাম। উনি মুখ বিকৃত করে বললেন, সবই আগে জানলে হত! তারপর সেই সার্জেন্টের দিকে চেয়ে বললেন, জানাে মুখুজ্জে, সাগর আমাকে নিয়ে দেশ-এর একটা সংখ্যা করবে। আমার ওপর কে লিখছে জানাে তাে? সেই অরবিন্দ গুহ, যে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লিখেছে করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, তাহলে বুঝতে পারছ, বিদ্যাসাগর আর সৈয়দ মুজতবা আলী।
সুজিত : নতুনদের কবিতা পড়েন?
বেলাল : ভীষণভাবে পড়ি। পিনাকীর কবিতা, বিভাস রায়চৌধুরীর কবিতা, আরাে অনেকের কবিতা পড়ি। একটা জিনিস বুঝতে পারি, ওদের লেখায় এখনও তেমন বলবার মতাে হয়ত বিশেষ কিছু গড়ে ওঠেনি, কিন্তু ওরা কবিতাটাকে একটা নতুন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারি, আমাদের সময়, আমাদের যুগ শেষ হয়ে গেছে।
সূত্র : কৃত্তিবাস নব পর্যায়, ঊনত্রিশ সংখ্যা জানুয়ারিমার্চ ২০০৯

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট