অগ্রন্থিত রচনা
হুমায়ুন আহমেদ
সংগ্রহ ও ভূমিকা : পিয়াস মজিদ
আবদুল্লাহ ও শ্রীকান্ত
গ্রন্থসমালোচক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ খুব পরিচিত নন, তবে বাংলা একাডেমির সাহিত্যপত্র উত্তরাধিকার-এর এপ্রিল-জুন ১৯৮৯, বৈশাখ-আষাঢ় ১৯৯৬ (১৭ বর্ষ, ২য় সংখ্যা) সংখ্যায় প্রকাশিত কাজী ইমদাদুল হকের সুখ্যাত আবদুল্লাহ এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী শ্রীকান্ত উপন্যাসের বাংলা একাডেমিকৃত চিরায়ত কিশোর সংস্করণের সমালোচনা সাক্ষ্য দেয় সাহিত্যের এ ক্ষেত্রটিতেও তাঁর স্বাতন্ত্র্যময় পদপাত ছিল। মিতায়তন এ গ্ৰন্থসমালোচনায় দুটাে বিশিষ্ট বাংলা উপন্যাস ছাপিয়ে কথাসাহিত্য বিষয়ে তাঁর একটি সামগ্রিক ধারণাও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় পাঠকের পটে। আবদুল্লার কিশোর সংস্করণ করেছিলেন প্ৰয়াত লেখক যোবায়দা মীর্জা আর শ্রীকান্ত’র কিশোর সংস্করণ ছিল বিশিষ্ট কথাশিল্পী মঈনুল আহসান সাবের সম্পাদিত। উল্লেখ করা যেতে পারে উত্তরাধিকার-এর অব্যবহিত পূর্বের সংখ্যা অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ ১৯৮৯-তে তাঁর অন্যতম আলোচিত গল্প ‘খাদক' প্রকাশিত হয়েছিল। তখন এ পত্রিকার সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও রশীদ হায়দার।
বাংলা একাডেমি বেশ কিছু চমৎকার কাজ অতীতে করেছে। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হলো অমর “চিরায়ত কিশোর গ্রন্থমালা”-কিশোরদের উপযোগী করে লেখা চিরায়ত সাহিত্যের অমর রচনাবলী। কৈশোর হচ্ছে বই পড়ার সবচেয়ে সুন্দর সময়। তখন মন থাকে তাজা । আবেগ ও কল্পনায় হৃদয় থাকে পূর্ণ। সাহিত্যের সুবিশাল উত্তরাধিকার-চিরায়ত সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ের জন্যে এই সময়টাই হচ্ছে মাহেন্দ্ৰক্ষণ। কৈশোরের পর আমরা নিজের সময় নিয়ে বড় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ফিরে তাকানোর অবসর আর হয় না। আমাদের মধ্যে অনেকেই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বইগুলি পড়েছেন কৈশোরে। তারপর আর পড়তে পারেন নি-সময়ের অভাব, সুযোগের অভাব এবং খানিকটা হয়তো সময় হয় তবে তা হয় শেষ জীবনে। তখন চােখের দৃষ্টি হয় ক্ষীণ, নানান আধি-ব্যাধিতে মন থাকে ক্লান্ত-কোনো মহৎ সাহিত্যই তখন আর স্থবির মনকে তেমনভাবে আকৃষ্ট করতে পারে না। চিরায়ত গ্রন্থমালা কিশোরদের উপযোগী করে প্রকাশ-এই কারণেই আমার চোখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলা একাডেমিকে আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে এবং এ দেশের কিশোরকিশোরীদের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি অভিনন্দন।
আমি সিরিজের দুটি বই নিয়ে আলোচনা করব। একটি ‘আবদুল্লাহ’ অন্যটি ‘শ্ৰীকান্ত’। কাজী ইমদাদুল হক এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুটি বিখ্যাত গ্রন্থের কিশোর সংস্করণ-বাংলা একাডেমির ভাষায় সংক্ষেপন তৈরি করেছেন যথাক্ৰমে শ্ৰদ্ধেয়া যোবায়দা মীর্জা ও মঈনুল আহসান সাবের।
মুসলমান রচিত কথাসাহিত্যের সূচনা পর্বের সেরা ফসল হচ্ছে ‘আবদুল্লাহ' আর ‘শ্ৰীকান্ত’ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ। সেই হিসেবে অবশ্যই চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য।
‘আবদুল্লাহ' একটি বিশেষ সময়ের মুসলিম সমাজের ছবি। জীবনচর্যার ইতিকথা। একদিকে আশরাফ-আহতারাফের ভেদাভেদ, শরাফতির অহমিকা, অন্যদিকে আধুনিক যুব সমাজের আবির্ভাদ। হিন্দু ও মুসলিম স্বার্থের বিরোধের পাশাপাশি উদার মানবিক সম্পর্কের দ্যুতি। বইটি এই কারণে ইতিহাসেরও অংশ। আমাদের কিশোরদের এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বেগম যোবায়দা মীর্জা এই কাজটি সুন্দরভাবে পালন করেছেন। দায়িত্ব-চেতনাবোধ তাঁর মধ্যে বিশেষভাবে কাজ করেছে আর হয়তোবা এই কারণেই মাঝে মধ্যেই তিনি গল্পকথকের সীমা ছাড়িয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে পা বাড়িয়েছেন। যার প্রয়োজন না ।
দামি কাগজে-ঝকঝকে ছাপা বলে ছাপার। ভুলগুলি বেশি করে চোখে পড়ে। 'মুরুব্বি’ শব্দটি তিন ধরনের বানানে লেখা। কিছু বাক্য আছে যার অর্থ আসলে কী আমি বুঝতে পারিনি। উদাহরণ দিই। কুড়ি পৃষ্ঠায় আছে—"বন্ধক রেখে ধার নেওয়া যেত। কিন্তু তাতে সুদের কারবারে সাহায্য করা হারাম।” এর অর্থ কী ? মুদ্রণ প্ৰমাদ ?
বইটি যেহেতু কিশোরদের উপযোগী করে লেখা সেহেতু কিছু কিছু প্রসঙ্গ না আসাই উচিত। কিশোর সংস্করণের উদ্দেশ্যও অনেকটা সে রকম। এই বইটিতে সেই উদ্দেশ্য বজায় থাকছে কি ? ‘মীর সাহেব টাকা দিয়ে সাদেককে উদ্ধার করছেন। সবাই ভাবছে আসলে এর পেছনে অন্য কিছু আছে ? অন্য কী আছে তা বলার প্রয়োজন ছিল না-এখানে থামলেই হতো। অথচ এখানে না থেমে সাদেকের স্ত্রীর সৌন্দর্যের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। যা আমার ভালো লাগে নি।
তবু সব বিচার-বিবেচনা করেও বলতে হবে যোবায়দা মীর্জা সংক্ষেপনেও মূলের আবেদন ও আকর্ষণ বজায় রাখতে পেরেছেন।
মঈনুল আহসান সাবের একজন শক্তিমান কথাশিল্পী। কাজেই তার কাছে আমার প্রত্যাশাও বেশি। শ্ৰীকান্তের সংক্ষেপনে তিনি সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছেন তা অবশ্যই বলা যায়। একটি সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন কাজ। মূল শ্ৰীকান্তের আবেদন ও আকর্ষণ এতে আছে। আর এ ধরনের কাজে মূলের চরিত্র বজায় রাখা এবং মূলের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ তৈরি করাই হচ্ছে প্রধান ব্যাপার। তবে একটি বড় বিচ্যুতি উল্লেখ না করে পারছি না। সংক্ষেপনে মূলের আহসান সাবেরের শ্ৰীকান্তে ইন্দ্রের মাসতুতো ভাই হয়ে যায় ইন্দ্রের খালাতো ভাই তখন অবাক লাগে।
মূল বইটিতে ভূতের ভয় কাটানাের জন্যে ইন্দ্র ‘রামনাম’ করত। এখানে সে রাম নাম করে না। সে ‘সৃষ্টিকর্তা’কে ডাকে।
ভূতের সঙ্গে রামনামের একটি সম্পর্ক আছে। রামনামের জায়গায় সৃষ্টিকর্তা ব্যবহার সেই কারণেই মূল রচনার রসভঙ্গ করে।
বইটি কি খুব তাড়াহুড়া করে লেখা ? তাড়ার ছাপ আছে অনেক জায়গায় একটি উদাহরণ দিই। পৃষ্ঠা ১০১।
"প্রায় দশজোড়া ছোট-বড় রুদ্রাক্ষের মালা আর একজোড়া পিতলের তাগা। ওগুলো পরে খানিকটা ধুলোর ছাইও মাথায়-মুখে মেখে ফেললাম।"
ধুলোর ছাই হয় বলে তো জানতাম না। ধুলো আগুনে পুড়ালে যা হয় তার নাম-কাচ। সেই জিনিস মুখে মাখা সম্ভব না।
শেষ কথার আগে এই প্রকাশনার আরেকটি দুর্বলতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। চিরায়ত আখ্যায়িত করে কিশোর সংস্করণের প্রয়োজন অনুভব করা মানেই মূল রচনা এবং কিশোর পাঠকদের মধ্যেও দূরত্ব স্বীকার করে নেওয়া। লেখক এবং মূল বইয়ের পরিচিতি এই কারণেই অপরিহার্য।
মূল 'আবদুল্লাহ' এবং ‘শ্ৰীকান্তে’র সঙ্গে যে কিশোরের পরিচয় আছে। এই বই দুটি নিশ্চয়ই তাদের জন্যে নয়। আর পরিচিতির অভাব এ বইগুলিকে মূলের দিকে আগ্রহী করবে না।
কাজী ইমদাদুল হক বইটি অসম্পূর্ণ রেখে মারা যান, কাজী আনােয়ারুল হক তা শেষ করেন কিংবা শরৎচন্দ্র তার এ-কালজয়ী রচনাটি নিয়ে নিজে খুবই দ্বিধায় ছিলেন, বছরের পরে বছর বিরতি দিয়ে লেখায় ফিরেগেছেন এবং আরও একটি খণ্ড লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত লেখেন নি। এসব তথ্য এমনিতেও তো কম আকর্ষণীয় নয়। এই ব্যাপারগুলি থাকলে ভালো হতো না কি ?
আর একটি ছোট্ট কথা বলে বক্তব্য শেষ করছি। আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত গ্রন্থগুলির কিশোর সংস্করণের চেয়ে জোর দেওয়া উচিত বিদেশি ভাষার রচনাবলীতে। বাংলা গ্রন্থগুলি কিশোররা এমনিতেই পড়তে পারে। আলাদা করে ওদের জন্যে এগুলি লেখানোর তেমন কোনো অর্থ হয় না।
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় উত্তরাধিকার ও পরে অন্যদিন পত্রিকায়।
No comments:
Post a Comment