আমার জীবনবোধ
তসলিমা নাসরিন
কিছুটা পারিবারিক এবং সামাজিক পরিমণ্ডল, কিছুটা পড়াশোনা, কিছুটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার জন্য স্বতন্ত্র একটি বোধ গড়ে তোলায় সাহায্য করেছে। আমি লক্ষ করেছি দিন দিন আমার এই বোধটি সমৃদ্ধ হয়েছে। জীবন একটিই এবং এই জীবনটি খুব ছোটো— এই সত্যটি আমি কখনো ভুলে থাকতে চাই না। খুব সহজে এই সত্যটি অনেকে ভুলে থাকে বলে জীবন যেভাবে কাটাতে ইচ্ছে, সেভাবে কাটানোর চেষ্টা তারা করে না। আমি জীবনের রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ সব অকুণ্ঠচিত্তে আকণ্ঠ পান করতে চাই। করিও। জীবনে যা উপার্জন করি, ভবিষ্যতের জন্য কিছুই আমি জমিয়ে রাখি না। বর্তমানেই তা খরচা করি। বর্তমানের মূল্যই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি। প্রতিটি মুহূর্তই তো অমূল্য। যে-মুহূর্তটি আমি যাপন করছি, সেই মুহূর্তটি আনন্দময় অর্থময় হচ্ছে কি না সেটিই বড়ো।
কার্পে ডিয়েমে গভীর বিশ্বাস আমার। কার্পে ডিয়েম ল্যাটিন শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে, সিজ দ্য ডে। দিনটাকে লুঠ করো। অথবা দিনটাকে উপভোগ করো। কার্পে ডিয়েমে বিশ্বাস যাঁরা করতেন, পশ্চিমের প্রচুর লেখক কবি লিখে গেছেন এ নিয়ে, প্রতিটি মুহূর্তে সবটুকু আনন্দকে উপভোগ করার কথা।
জীবন একটিই, এ জীবন, এই সময় যত বড়ো মানুষই হোক না কেন, কেউ দ্বিতীয়বার পাবে না। আমার কী নেই, তা নিয়ে আফশোস করে সময় নষ্ট করার আমি কোনো মানে দেখি না। বরং যা আছে, তা নিয়েই কেন তুষ্ট থাকি না! লোভ মানুষকে হিংস্র করে এবং একই সঙ্গে খুব বেদনাদায়ক বটে যে, অসুখী করে। লোভের তো শেষ নেই। আজ এ হলে কাল ও চাই। চাই-এর শেষ কখনো কোনোদিন হতে পারে না। বস্তুর চাওয়াই মানুষের বেশি। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চাই না তা নয়। চাই। আমার প্রচুর চাই চাই আছে। আমি সবার আগে ভালোবাসা চাই। ভালোবাসার চেয়ে মূল্যবান অন্য কিছু আমার কাছে নেই। অবিশ্বাস্য ধন সম্পত্তির মালিক হয়েও একাকিত্বে ভুগতে দেখেছি মানুষকে, তাদের আত্মহত্যা করতে দেখেছি। ভালোবাসা পেলে, আমি বিশ্বাস করি, গাছের তলায় কাটিয়েও সুখ আছে।
এনজয় শব্দটি ইংরেজি ভাষাতে খুব পজিটিভ। ভোগ বা উপভোগ বাংলায় কিন্তু পজিটিভ নয়। আমি জীবনকে এনজয় করি, এর মানে কিন্তু এই নয় আমি স্থূল ভোগবিলাস নিয়ে আছি এবং একজন স্বার্থপর মানুষ আমি। সত্যি কথা বলতে কী, আমি নিজের জন্য যা করি, তার চেয়ে বেশি অন্যের জন্য করি। নিজের জন্য এক ভাগ হলে অন্যের জন্য নভাগ। এই যে দেওয়া অন্যকে, ভালোবাসা অন্যকে, তা আমাকে অসম্ভব ভালো লাগার বোধ দেয়। অন্যের কীসে ভালো হবে, অন্যে কীসে সুখী হবে, খুশি হবে তা ভেবে করার চেষ্টা করে আমার যদি আনন্দ হয়, সে আনন্দ আমি নেব না কেন! তবে, তেলা মাথায় তেল দিতে আমি কখনো পছন্দ করি না। আমি তাদেরই দিতে চেষ্টা করি, যাদের প্রয়োজন। কোনো সুখ যদি একা আমার জন্য জোটে, একা একা সে সুখ ভোগ করতে আর যেই পারুক, আমি পারি না। দুঃখ ভাগ করে ভোগ করা হয় না, কিন্তু সুখ তো হয়। আমি সুখটুকু তাই ভোগ করি।
অস্তিত্ববাদীদের মতো আমিও অস্তিত্বে বিশ্বাসী। জীবন অর্থহীন কিন্তু এই জীবনকে অর্থ দিতে আমরাই পারি। আমি যা করেছি, জীবনকে অর্থময় করার উদ্দেশ্য নিয়ে কিন্তু কিছু করছি না। করি, ভিতর থেকে তাগিদ অনুভব করি বলে। এই যে অন্যায় অত্যাচার আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি, সে না করে পারি না বলেই করি। জীবনকে কখনো কি সত্যিকার অর্থে অর্থ দেওয়া যায়? অনেকে অমরত্বের কথা বলে। আমার এতে এক তিলও বিশ্বাস নেই। অমর হয়ে কার কী লাভ? আমি মরে যাবার পর আমার লেখা লোকে পড়বে, আমার জন্য এই হবে সেই হবে ইত্যাদিতে আমার মোটেও আকর্ষণ নেই। যা পাবার, তা আমি এখনই পেতে চাই। মৃত্যুর পরও মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকব, এই ভেবে পুলকিত আমি কখনোই হই না। এ আমার কাছে বেশরম বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়।
আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ হল, সততা আর সারল্য। এ দুটো সম্পদ আমার ভিতরের ভিত থেকে জন্ম নিয়েছে। এ শত চেষ্টা করেও কেউ কখনো উপড়ে ফেলতে পারবে না। আমি পারি না। মানুষকে বিশ্বাস করে প্রতিদিনই ঠকছি, কিন্তু তারপরও বিশ্বাস করা আমি বন্ধ করি না। বন্ধ করি না কারণ বন্ধ করতে পারি না। যে পারে না, সে পারে না। ঠকি, তাতে কী! কষ্ট পাই, কী-ই বা হল। কষ্ট তো কত কিছুতে পাই। কিন্তু মানুষকে বিশ্বাস করায় যে শান্তি, যে আনন্দ, সে আনন্দ থেকে নিজেকে আমি বঞ্চিত করতে চাই না।
ভালোবাসা যদি পাই, সে ভালো। কিন্তু যদি না পাই! আমি কি হৃদয়ের দরজায় খিল দিয়ে বসে থাকব? ভালোবাসতে আমাকে কেউ যদি না পারে, সে মানুষের অক্ষমতা। কিন্তু ভালোবাসতে তো আমি পারি। আমার ক্ষমতার বুঝি দাম নেই!
No comments:
Post a Comment