মানুষটা খুন হয়ে যাচ্ছে - হাসান আজিজুল হক

হাসান আজিজুল হকের
ছোটগল্প
মানুষটা খুন হয়ে যাচ্ছে


আজকাল প্রায়ই লক্ষ করি আমি বাসা থেকে বেরিয়ে এলেই বাসার পিছনদিকে দেয়ালের ছায়ার আড়ালে একটা মুখ লুকিয়ে পড়ে। একতলা বাড়ির ওদিকটা নির্জন, অনেকটা ঘুরে না গেলে ওখানে যাওয়া যায় না। বড়ো বড়ো কটা আম-জাম গাছে অন্ধকারও বটে জায়গাটা।

আজও বেরিয়ে আসার পরে আমার মনে হলো ওখানে চোখ পড়ার আগেই একটা মুখ টুক করে ছায়ার মধ্যে সরে গেল। বাড়ির সীমানার পাঁচিলটা ভাঙা, সেদিক দিয়ে গেলে সহজেই বড়ো রাস্তায় রোদে অন্য মানুষদের সঙ্গে মিশে যাওয়া চলে। আমি তাড়াতাড়ি হেঁটে বড়ো রাস্তায় পড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বেশ ভালো করে দেখি। নাঃ, কাউকে দেখা যায় না। তাহলে সাঁৎ করে সরে গেল কে? একদিন দেখি বাসায় ঢোকার দরজাটার ঠিক পাশে চকখড়ি দিয়ে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা রয়েছে : ‘হারামজাদা গণআদালতী’। আমাকে শাসানোর জন্যই লেখা বুঝতে পারি। আমি জানি আমার পিছু পিছু সব সময়েই কেউ-না-কেউ হাঁটছে। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে চাইলে কাউকেই দেখি না। যে পিছনে হাঁটছিলো সে কি থেমে গেল? আমি চলতে শুরু করলেই সে আবার চলতে থাকবে আমার পিছু পিছু? ভালো চাকরি নিয়েছে লোকটা। এর চেয়ে আমাকে মেরে ফেলা অনেক সহজ। পাশ দিয়ে চলতে চলতে কিংবা সামনাসামনি থমকে দাঁড়িয়ে ঝোলা থেকে বোমাটা বের করে ছুঁড়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। এ রকম তো রাতদিন করছে ওরা। আমাকে চিঠিতে লেখেও তো সেইরকম : ‘হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা গোলাম আযম কি তোমার পাকা ধানে মই দিয়েছে? ওর তো একটা ... ও ছিঁড়তে পারবি না, গণআদালত মারিয়ে বেড়াচ্ছিস। তোর দিন শেষ।’ কিন্তু কিছুই তো করে না ওরা। সুতোর মতো শুধু লেগে আছে। আলো অন্ধকারের মধ্যে, রাস্তায় হাটে বাজারে। গায়ের উপর দিয়ে চলা ছিনেজোঁকের মতো।


আমি এত বেপরোয়া যে ভয়-টয়ের ধার ধারি না বলা ভুল হবে। যায় যাবে প্রাণ এ কথাও ঠিক নয়। তবে ভয়েরও সীমা আছে। আমি ভয়কেও বলতে পারি, ব্যস, ঐ পর্যন্তই, আর এগিয়ো না। আর তোমার কয়েদ খাটতে পারব না। জীবনের সবচেয়ে বড় আদর্শ কি আমি একটুও জানি না। তা নিয়ে মাথাও ঘামাই না। কিন্তু প্রত্যেক দিনের জীবনটা কাটানোর জন্য কিছু মূল সিদ্ধান্ত তো নিতেই হবে, সেগুলোকে কাজে খাটাতেও হবে। এর নিচে নামলেই আমি আর মানুষ থাকি না। বোধহয় কেউই থাকে না। মানুষ থাকা-না-থাকাটাই হচ্ছে ভয়ের সীমা। ব্যস, ঐ পর্যন্তই, ভয়, আর এগোতে পারছো না তুমি। পঞ্চাশ হাজার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। ঐ পঞ্চাশ হাজার যখন রাস্তা ধরে প্রচণ্ড রাগে গর্জন করতে করতে এগোয় ‘ফাঁসি দাও, ফাঁসি দাও, ঐ লোকটাকে ফাঁসি দাও, দেশের বুকের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে যে, যে বিশ্বাসঘাতক এদেশে বিশ্বাস করে না তাকে ফাঁসি দাও’—তখন যে প্রচণ্ড শক্তি সাগরের ঢেউয়ের মতো ফুলে ফেঁপে ওঠে তা চোখে দেখে আমি আমার মাথা আকাশ পর্যন্ত তুলতে পারি ঠিকই, পঞ্চাশ হাজারের সামনে আমি যখন কথা বলতে পারি, তখন আমার রক্তে বিদ্যুতের চলাচল টের পাই, তবু সেটাই শেষ হিশেব নয়। একেবারে একা যখন নিজের মধ্যে আমি কাঁদি, তখনও আমাকে ভাবতে হয়, আমি একা এই মানুষ, অসহায়, দুর্বল, কোনো প্রত্যাশা না রেখে, সবচেয়ে ভঙ্গুর মুহূর্তটিতেও মানুষ থাকা-না-থাকার ফায়সালা করার জন্য একাই রুখে দাঁড়াবো।

পিছন থেকে সাইকেলে চেপে একটা লোক আমার গায়ের উপর পড়তে পড়তে কোনো রকমে সামলে নিয়ে মুখটা আমার কানের কাছে এনে বলে গেল, কিছু ফেলে গেলেন কি! রাস্তার উপরে খুব বড়ো একটা ছায়া। সেটাকে আমি কোনোক্রমেই ছাড়িয়ে যেতে পারছি না। ছায়া আমার সামনে ক্রমেই লম্বা হয়ে পড়ছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, ভঙ্গুর মুহূর্তটি এসে গেছে। ভিতরে ভিতরে একা কেঁপে ওঠার মুহূর্তটি। আমি খুব তাড়াতাড়ি হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে এসে বাসার সামনে দেখতে পাই, আমার মেয়ে দুটি খোলা মাঠে, কখনও ছায়ার মধ্যে কখনও রোদের মধ্যে খেলছে। ছোট বোন একটি মাত্র ফুটে-ওঠা ফুল নিয়ে চন্দ্রমল্লিকার চারার মতো। ভালো করে হাঁটতে শেখে নি, খঞ্জনার মতো লাফাচ্ছে শুধু বড়ো বোনের চার পাশে। ভঙ্গুর মুহূর্তটি আমার জন্য এসে গেল। বুনো মোষের খুরের নিচে পুরো দৃশ্যটি চাপা পড়ে যায়। আমি বড়ো মেয়েটির কাঁধে দুহাত দিয়ে তার দু চোখের দিকে চেয়ে বলি, কি করছো মাগো?

প্রজাপতি ধরি।

প্রজাপতি ধরছো? কই প্রজাপতি?

ওই যে—আঙুল তুলে সে ঘাড়-ভাঙা শুকনো চন্দ্রমল্লিকার গাছটির দিকে দেখায়। খুব সাধারণ ছোটো শাদা একটি প্রজাপতি সেখানে বসে আছে।

প্রজাপতি ধরে কি করবে?

মারবো।

ছিঃ, প্রজাপতি কি কেউ মারে?

প্রজাপতি ধরে ডানা ছিঁড়বো। মেয়ের ঠোঁটের কোণ বেয়ে লালা ঝরে পড়ে।

প্রজাপতি কেউ ধরে না, প্রজাপতি কেউ মারে না। যাও, বাসার ভিতরে যাও। খুব কঠিন শোনালো আমার গলা। আমি আবার বড়ো রাস্তার দিকে পা বাড়িয়েছি, কাঁধে-ঝোলা একটি লোক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কালো কাপড়ের ঝোলা, অনেক কিছু ভরা আছে তাতে, লোকটার একটা কাঁধ ঝুঁকে আছে। থমকে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে কিছু খুঁজছে সে।

আমি ঠাণ্ডা পাথুরে গলায় বলি, কাকে চাই ভাই আপনার?

আপনাকে।

আমাকে? আমাকে চেনেন আপনি? তা বলুন কি দরকার আপনার।

আপনি খুললের লোক না? ডুমুরে না আপনার বাড়ি?

আপনার দরকার কি বলুন না।

বলবানে, বলবানে, নিশ্চয়ই বলবানে। বলবার জন্যিই তো আইছি। আপনি খুলনের লোক আমি জানি। এত বড়ো একডা ব্যক্তি কোয়ান থে আসবে? আমাদের খুলনে ছাড়া!

আপনার ঝোলাটা খুব ভারি। কাধ বাঁকে গেল আপনার। হাতে নেন। আমি একটু হেসে বললাম।

লোকটা ঝপ করে ঝোলাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে ডান হাতে ঝুলিয়ে নেয়।

এইবার বলুন আপনার কথা।

ভারি বিপদে পড়িছি। একটু বসতি পারলি হতো। এক কাপ চা খাতি খাতি—আপনার বাসা তো কাছেই শুনিছি।

আমি এই চালাক লোকটির দিকে ভালো করে চেয়ে দেখি। ঝোলার মুখটা সে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। না, এ বোধহয় সে নয়, না, এখুনি কিছু নয়। পরনে আধ ময়লা পাজামা, নীল রঙের ফুলশার্ট। পায়ে ধুলোভরা হাওয়াই চপ্পল, মুখে সপ্রতিভ হাসি, চোখ দুটো তার চেয়েও বেশি হাসছে, ফেন কতোদিনের পরিচিত ইয়ার।

বাসায়? আচ্ছা, চলুন আমার বাসায়। এই যে দরজা। ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। কে সন্ধান দিল বলুন তো?

বড়ো মেয়েটি দু হাত মেলে প্রজাপতির মতোই একটি শাদা প্রজাপতির পিছনে পিছনে দৌড়ুচ্ছে। ছোট মেয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মনের আনন্দে খিল খিল করে হাসছে। বাসায় বসার ঘরে ঢুকেই লোকটা ধপ্‌ করে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়ে বলল, আঃ, হাঁটতি হাঁটতি হাফসায়ে গিইছি। আপনের সন্ধান আবার কার কাছে নিতি হবে? আমি শহরে পা দিয়েই বুঝিচি—অসম্ভব ধড়িবাজ লোকটিকে আমার ঘাড় ধরে বাসা থেকে বের করে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু যে কাজটি তার এতক্ষণে করে ফেলা উচিত ছিল বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম, সে যে তা এখনও করে নি তাতে হঠাৎ মজায়-কৌতুকে আমার মন ভরে উঠল। আমি বললাম, দাঁড়ান, আপনার চায়ের কথা বলে আসি ভিতরে, তারপরে আপনার কথা শুনব।

আরে না না, বসেন আপনি। চায়ের কথা কেডা কইছে? আমি কইছি? তা হতি পারে। চা আমি খাইনে—এমনি কইছি। বসেন আপনি।

আপনার নামটা এইবার বলুন তো।

আমি কাজি বাড়ির ছেলে। বাঘডাশার কাজি বাড়ি। নিশ্চয় চেনেন না কবেন না। সগীর কাজি—আমার নাম—বড়ো তরফের নাতি—

আমি ওকে চিনে ফেলাই মনস্থ করলাম, চিনিছি, কন—আমাদের এলাকার ভাষাতেই ওকে বলি, আর কথা না কয়ে আপনের কথাডা কন!

হইছে কি জানেন, ঠেহিছি, সামান্য কিছু টাকার জন্যি ঠেহিছি।

কতো টাকা? আমি একটু শক্ত হয়ে বলি।

কিছু না, কিছু না, ও কোনো টাকা না। আপনের হাতের ময়লা, শ তিনেক মাত্র।

এই দ্যাখেন ভাই—আমি দুই হাত তার দিকে মেলে দিয়ে বললাম, আমার হাতে এক পয়সার ময়লা নেই। ময়লা যা পাই চাল-ডাল কিনতেই শেষ হয়ে যায়।

যাঃ, কি যে বলেন, সগীর কাজি ঘাড় বেঁকিয়ে, চোখ ট্যারা করে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকে।

এডা তো আমাকে না দিলেই চলতিছে না।

আমি এবার স্পষ্ট করে বলি, শোনেন সগীর মিয়া। তিনশো টাকা আপনাকে দিতি পারলিও দিতাম না। কিন্তু কথা হচ্ছে দেবার আমার ক্ষমতাই নেই। আমি আপনার জন্যি যা করতি পারি—কথা বলতে বলতে ঝোলাটার দিকে নজর রাখি আমি, দেখি, লোকটা শক্ত মুঠোয় ঝোলার মুখটা ধরে আছে। আমি কথাটা শেষ করি, হ্যাঁ, আমি আপনের জন্যি কি করতি পারি কচ্ছি। কাল ভোরে খুলনের ট্রেন আছে, আমি আপনার সঙ্গে কাল স্টেশনে যাবানে, আপনাকে একটা খুলনের টিকিট কেটে দেবানে, মনের আনন্দে আপনি খুলনে ফিরে যাবেন। আজ রাতে আমার এখানে খাবেন, থাকবেন, কোনো চিন্তা নেই। হবে?

আমার কথা শুনে লোকটার চেহারা একটুও টসকালো না, ঠিক তেমনি হাসিমুখে ঝোলাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, মাত্তর তিনশো টাকার জন্যি আমি এমন আটক হয়ে পড়বানে চিন্তা করি নি। কাল সকালে ফিরতি আমাকে হবেই—তবে এই সামান্য টাকাটা জোগাড় না হলি তো হচ্ছে না। আপনি আর একবার চিন্তা করে দেখেন।

চিন্তা আমি করিছি। আমি পারতিছি না। কি, আপনি রাতে আমার এখানে খাবেন তো? দেখেন, ইস্ত্রিকে বলে আসি। একজনের রান্না করা ভাত নষ্ট করবার পয়সা নেই আমার, বুঝিছেন?

সগীর মিয়া ঝোলা হাতে উঠে পড়ল। একগাদা ভাঁজ পড়লো চোখে-মুখে। ছড়িয়ে পড়া কান এঁটো-করা হাসিটা ফালি ফালি হয়ে মুখের ভাঁজে ভাঁজে বসে গেল, রাতে খাবানি বই কি? খাতি তো হবেই। তবে আমি একবার এট্টু ঘুরে আসতিছি, দেহি, দু একজন পরিচিত ব্যক্তি আছেন আমার এহানে। খুলনের লোক, বুঝিছেন না। আসতিছি আমি, আলাম বলে, রাতে গপ্পো-সপ্পো হবেনে—খুলনে নিয়ে কিছু চিন্তাভাবনা আছে আমার, গভমেন্টের ভাব-সাব তো দেহিছেন। বলে ঝোলাটা হাতে নিয়ে, আসতিছি, আস্‌সালামালেকুম বলে লোকটা রোদের মধ্যে নেমে গেল।

রাতে লোকটা এলো না। আমি জানতাম সে আর আসবে না। তিনশো টাকা আমি দিলাম না, কিছুতেই দিলাম না, নিজের ব্যর্থতায় রাগে সে কি আর এলো না, প্রবঞ্চনা ব্যবসার যোগ্য সে নয় এই ধরে নিয়ে, নাকি নিজের দায়িত্বটুকু কিছুতেই পালন করতে না পেরে লোকটা নিজের ভিতরে জ্বলছে, আমি জানি না। ঝোলাটা সে শুধুই নাড়াচাড়া করেছে, কাঁধ থেকে হাতে নিয়েছে, মেঝেতে নামিয়ে রেখে বার বার শক্ত মুঠোয় মুখটা চেপে চেপে ধরেছে।

সে রাতে ঘরের মধ্যে বড়ো বড়ো হালকা ছায়া, স্ত্রী ঘুমের মধ্যে গুমরে উঠে একটু পরে করুণ গলায় কাঁদতে শুরু করলেন। জানালা দিয়ে দুটি চোখ একদৃষ্টিতে আমাদের বিছানার দিকে চেয়ে আছে আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারি, ফিরে তাকালেই অতি দ্রুত সরে যাবে ঐ দৃষ্টি। চারদিকে অনেক ছায়া।


শক্ত মোটা খামটা আমি যেদিন পাই সেদিন আমার অনেক কাজ। চিঠি খোলার সময়ই মেলে না, বুক পকেটে খামটা রেখে দিয়ে আমি ওটার কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাই। বাড়ির চিঠি, আমার ভাইয়ের লেখা, বাড়িতে মা আছেন, চিঠিটা সঙ্গে সঙ্গে পড়া দরকার এসব কিছুই আমার মনে থাকে না। তবে খুলনার সগীর মিয়ার কথা যে আমার কখনোই মনে পড়ে নি তা নয়। দু একজনের কাছে আমি ওর গল্পও করেছি। নীল শার্ট, ময়লা পাজামা, ঝোলার মধ্যে বোমা। লোকটা সেটা ফাটানোর সময় পাচ্ছে না। তিনশো টাকার গল্পটা একটু বেশি লম্বা হয়ে গেল বলে কি? গল্পটা সে আদৌ শুরু করতে যায় কেন? বাসাতেই-বা তার ঢোকার দরকার কি? পথে যখন তার শিকার বাঁক নিচ্ছে, একটু অন্যমনস্ক, ঘাড়ের পিছন দিকটা দেখা যাচ্ছে, ভিড়ের লোকেরা একেবারে বিশৃঙ্খল, ঝোলা থেকে ওটা বের করে ছুঁড়ে দিলেই তো কাজ শেষ হয়ে যায়—তা না করে বাসায় ঢুকে গল্প জমাতে যায় কেন? না কি ওর ঝোলায় ছিল বাদা অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখের কবিতা—নোনা গন্ধ মাখানো—ঘরে বসে হারিকেনের আলোয় লেখা, নোনা পানি ঠেকানোর বাঁধের কথা, চিংড়ির ঘেরের মধ্যে আটকানো লবণ জলের হাহাকারের কেচ্ছা। নাকি লোকটা সত্যিই শাদামাঠা ঠক—সব জায়গাতেই তিনশো টাকার জন্য আটকে যাচ্ছে।

ভাইয়ের চিঠি যেদিন পাই সেদিন আমি ভয়ানক ব্যস্ত। রিকশা আর স্কুটারে করে ছেলেরা শহরের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমার কথা হলো শহরের প্রত্যেকটি মানুষ তো বটেই, শহরের বাইরের দশ মাইলের মধ্যে এমন একজনও থাকবে না যে জনসভার কথা জানবে না। ছেলেরা গত দুতিন দিনে ধুলোভরা গাঁয়ের পাথরগুলোকে পর্যন্ত জাগিয়ে তুলেছে।

মানুষজন জমায়েত হতে শুরু করেছে দুপুরের অনেক আগে থেকে। বেলা চারটের সময় আমি উঁচু মঞ্চ থেকে দেখতে পাই—মানুষের সংখ্যার আন্দাজ আমি কোনোদিন পাই না— আমার ধারণা হলো এক লাখ লোক এখানে এসেছে। রাস্তার উপরে যারা বসেছে, তারা যেন লেপ্টে গেছে রাস্তার সঙ্গে, এমন গাদাগাদি লাগালাগি বসেছে যেন মানুষের লেই রাস্তার উপরে পুরু হয়ে জমেছে পিচের মতো। যেন জ্যান্ত একটা তরল, বড়ো বড়ো বোতলে, বয়ামে, ড্রামে সংগ্রহ করে রাখা যায়। রাস্তার দুপাশে মানুষের এই তরল জমে কঠিন দেয়াল তৈরি করেছে। সেখান দিয়ে কিছুই ঢুকতে-বেরুতে পারবে না। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেদিকে চেয়ে আমি সিংহের পিঙ্গল একজোড়া চোখ পেয়ে যাই।

বেলা পাঁচটার সময় মা কথা বলতে শুরু করলে পশ্চিমের সূর্যের রোদটা সরাসরি তাঁর মুখে এসে পড়েছিল। আমি দেখলাম আর একটি সূর্য। আকাশ থেকে নেমে এসেছে বা মায়ের মুখটাই সূর্য হয়ে গেছে। মা কথা বন্ধ করে একটুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন—ডান হাতের তর্জনি তোলা, ধপধপে শাদা শাড়ি পরনে, একটু সময় চুপ করে থেকে তিনি শান্তকণ্ঠে বললেন, আমি মা, আমি বিচার চাই, আমি বাংলাদেশের সমস্ত মায়ের পক্ষ থেকেই বিচার চাই। বলে তিনি থেমে গেলেন। ঠিক তক্ষুনি আমি আর একবার সভার দিকে চেয়ে মানুষে-লেপা পথঘাট, আকাশ-মাটি দেখতে দেখতে ভাবি, হ্যাঁ, বাংলাদেশ এই রকমই তো!

মা চলে যাওয়ার একটু পরে—আর একজন কেউ তখন উত্তেজিত বক্তৃতা করছিলেন—মঞ্চের পিছন দিক দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওরা উঠে এলো। একপাশে চুপ করে দাঁড়াই, একটুও উত্তেজনা হয় না আমার। ওরা এত ছটফট করছিল যে কারও চেহারা খেয়াল করা যাচ্ছিল না। মাথা ন্যাড়া, দাড়ি আছে, কিন্তু টুপি নেই, টুপিও নেই দাড়িও নেই, জিনস্‌ আর গেঞ্জি পরা, টুপিও আছে দাড়িও আছে, শাদা আলখাল্লাও পরা আছে—এই রকম সব পোশাক ওদের। মাইক্রোফোনগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে মঞ্চের বাইরে ফেলে দিল। মঞ্চের নিচে ফাঁকা জায়গাটায় ছুঁড়লো একটা হাতবোমা। তার প্রচণ্ড আওয়াজে কানে তালা লেগে গেল। ধোঁয়ায় ভরে গেল জায়গাটা। একটা উড়ন্ত গোড়ালি, শাদা নিষ্ঠুর একটি চোখ, কালো রঙের একটি কব্জি এইসব আমার চারদিকে ছুটে বেড়াতে লাগল। বক্তারা যতোদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছেন। একেবারে পিছনে ছিলেন যিনি, যাঁর টাক মাথাটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, তিনি সিঁড়ির একটি ধাপ নেমেছেন, বিদ্যুতের মতো একটি লাঠি পড়লো সেই মাথায়। একটা বিশ্রী অস্বস্তিকর চাপা শব্দ হলো। আমি দেখতে পেলাম, সিঁড়ির ধাপগুলো বেয়ে গড়িয়ে তিনি পড়ে যাচ্ছেন, টকটকে লাল রক্ত তাঁর ফর্সা ঘাড় বেয়ে নিচের দিকে নামছে আর জবজবে হয়ে ভিজে যাচ্ছে তাঁর পাঞ্জাবি। তারপর আর কিছুই মনে করতে পারি না।

আজ দশদিন পরে হাসপাতালের বিছানার বালিশের নিচে রক্তমাখা খামটা পাই। মনে পড়ে না কিছুই। শক্ত খড়মড়ে খামটা হাতে নিয়ে দু একটি টোকা দিতেই মনে পড়ে গেল খামের মধ্যে চিঠি আছে আমার ভাইয়ের। হাত কাঁপতে থাকে আমার, কিছুতেই খামের ভিতর থেকে চিঠিটা আর বের করতে পারি না। শুকনো রক্তের মধ্যে আটক হয়ে আছে চিঠি, টানাটানি করতে ফ্যাঁশ করে মাঝ বরাবর ছিঁড়ে গেল, ধুলোর মতো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়লো গুঁড়ো রক্তের ধুলো। তাড়াতাড়ি ছেঁড়া কাগজ একসাথে করে এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলি চিঠি। চিঠি লিখেছে মা, ভাই লিখে দিয়েছে মার কথা, মা যা যা বলেছে তাই : মা বাঁচে থাহে ক্যানো বাবা যদি ছাওয়াল থাহে দূর দেশে, যদি ছাওয়ালকেই না দেখতি পায় তালি মা চোহে দ্যাহে ক্যানো এই কথার ভেদ জানিনে। সগীর কাজি ও কথা কলো ক্যানো? সগীর কাজির আচ্চার্য কথা কি শুনিছো? একদিন সন্ধেবেলায় কেচ্ছা শোনাব বলে নিজির বাড়িতি লোক ডাকে নিয়ে কইছে, তুমি নাকি খুন হয়ে গিইছো—এ আমারে কি কথা শুনাইচে রে? সেই রাতে আমি মরি নাই ক্যানো কে জানে। সকালে আমি নিজি যাই সগীর কাজির বাড়ি—দেহি কি নিজির দুই ছাওয়াল মিয়েরে সে নিজি কুপোয়ে কাটিছে, বউ তো নেই তার অনেকদিন—তারপর ছাওয়াল মিয়ের রগ কাটিছে রে বাপ—তারপর নিজি গলায় গরুর দড়ির ফাঁশ লাগায়ে ঝুলে রইছে।

এসব কথার পরে মা আমাকে শেষ কথা লিখেছে : এর ভেদ তুমি আমারে বুঝায়ে কবা।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট