রাশিয়া ভ্রমণ
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
মস্কো বিমানবন্দরে পা দিলুম খুব ভোরবেলায়। সারা রাত প্রায় জেগেই কাটাতে হয়েছে। কলকাতা থেকে এরোফ্লোট বিমানে চেপেছিলুম বিকেলবেলা, তারপর বোম্বে, করাচি আর তাসকেন্টে বিমানটি মাটি ছুঁয়েছিল, আমাদেরও নামতে হয়েছিল দুবার। তার মধ্যে শেষ রাতে তাসকেন্টে নেমে আমি ঝোলা থেকে একটা সোয়েটার বার করে পরে নিয়েছিলুম। রাশিয়ার ঠান্ডা সম্পর্কে অনেকেই ভয় দেখিয়েছিল আগে থেকে, কিন্তু আমি খুব একটা শীত-কাতুরে নই, তা ছাড়া কিছুদিন আগেই ডিসেম্বর-জানুয়ারির ক্যানাডার তুষারের রাজ্য ঘুরে এসেছি, সুতরাং মে মাসের রাশিয়াকে ডরাব কেন? অবশ্য সঙ্গে একটা পাতলা ওভারকোটও এনেছি।
বিমানে রাত্তিরটা বেশ গল্প-গুজবেই কেটে গেছে। সহযাত্রী পেয়েছিলুম দুই বাঙালি তরুণকে। একজনের নাম সুবোধ রায়, সে মস্কোতে আছে প্রায় সাত-আট বছর, উচ্চশিক্ষার্থে। কিছুদিনের জন্য কলকাতায় ছুটি কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছে আবার। সুবোধ খুব দিলদরিয়া ধরনের, উচ্ছ্বাসপ্রবণ এবং আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। অন্যজনের নাম অসিতবরণ দে, সে প্রায় চোদ্দো বছর বাদে চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে কলকাতা-দর্শনে এসেছিল। সে একটু চাপা ও লাজুক স্বভাবের। আমরা তিনজনে মিলে মস্কো-প্রাহা-কলকাতার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছিলুম। সন্ধে থেকে মাঝেমধ্যেই আমাদের খাদ্য-পানীয় পরিবেশন করা হচ্ছিল, বিমানযাত্রার একঘেয়েমি কাটাবার জন্যই বোধহয় ওরা অত ঘন ঘন খাবার দেয়, কিন্তু অত কি খাওয়া যায়? শেষবারের খাবার আমি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলুম।
মস্কোয় নামার পর অসিতবরণ দে চলে গেল ট্রানজিট লাউঞ্জের দিকে, আমি আর সুবোধ পাশপোর্ট হাতে করে এগোলুম নিষ্ক্রমণের পথে।
সুবোধ জিগ্যেস করল, আপনাকে কি কেউ নিতে আসবে?
আমি বললুম, সেই রকমই তো কথা আছে। কিন্তু এত ভোরে...
সুবোধ বলল, কেউ না এলেও ক্ষতি নেই, আমি তো আছি! আমি আপনাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেব।
মস্কো বিমানবন্দরটি বিশাল, কিন্তু প্রায় নিঝুম। এত সকালে একটিই মাত্র ফ্লাইট এসেছে। ইমিগ্রেশান ও কাস্টমস বেরিয়ার পার হওয়া মাত্রই একটি বাইশ-তেইশ বছরের ছিপছিপে যুবক আমার কাছে এসে পরিষ্কার ইংরিজি উচ্চারণে আমার নাম বলে জিগ্যেস করল, আপনিই কি তিনি?
আমি হ্যাঁ বলতেই সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম সারগেই স্ট্রোকান, আমি আপনার জন্যই এসেছি।
এত লোকজনের মধ্যে সে প্রথমেই আমাকে চিনল কী করে? খুব সম্ভবত ছবি দেখে সে আমার চেহারাটা মুখস্থ করেছে। আমি তার সঙ্গে সুবোধ রায়ের আলাপ করিয়ে দিলুম।
সারগেই স্ট্রোকান একটা ঠেলাগাড়ি জোগাড় করে এনে তাতে আমাদের বাক্স-প্যাঁটরাগুলো চাপাল। তারপর সেটা নিয়ে এগোবার চেষ্টা করতেই উলটে পড়ে গেল সবকিছু। সারগেই স্ট্রোকান লজ্জা পেয়ে সংকুচিতভাবে বলল, আমি খুব দুঃখিত, আমি কোনওরকম গাড়িই ঠিকঠাক চালাতে পারি না!
তাতে আমি খুব আশ্বস্ত বোধ করলুম। যে-খুব তুখোড় ধরনের লোক সবকিছুই নিখুঁতভাবে করতে পারে, কখনও যাদের জীবনে নিজস্ব ভুলের জন্য লজ্জা পাওয়ার অবকাশ ঘটে না, সেই সব মানুষদের আমি বেশ ভয় পাই। এবারে আমরা তিনজনেই হাত লাগিয়ে গাড়িটিকে নিয়ে এলুম বিমানবন্দরের বাইরে। একটা ট্যাক্সি ডেকে মালপত্র তোলা হল।
এবারে আমি ওভারকোটটা গায়ে চাপিয়ে নিলুম। খুব যে শীত করছে তা নয়। জানলা দিয়ে আমি উৎসুকভাবে দেখতে লাগলুম বাইরের দৃশ্য।
যে-কোনও নতুন দেশে এলেই প্রথমটায় একটা রোমাঞ্চ হয়। সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে কৌতূহল, আগ্রহ পুষে রেখেছি কতদিন ধরে। আমরা একটা দেশকে সবচেয়ে ভালো করে চিনি তার সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। এই সেই টলস্টয়, পুশকিন, ডস্টেয়ভস্কি, গোর্কি, মায়াকভস্কি-র দেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি দেশে প্রোলেতারিয়েতরা শোষণমুক্ত সমাজ-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে, এই দেশটি দেখবার জন্য আমি অনেকদিন থেকেই ব্যগ্র হয়েছিলুম, অকস্মাৎ আমন্ত্রণ পেয়ে খুবই পুলকিত বোধ করেছি।
আমি পূর্ব ইউরোপের কোনও দেশেই আগে আসিনি। এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের কতটা তফাত তাও দেখতে চাইছিলুম। এখন অবশ্য সেরকম কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বিমানবন্দর থেকে মস্কো শহর বেশ দূরে, এখন পথের দু-পাশে শুধুই উন্মুক্ত প্রান্তর, মাঝে-মাঝে গাছপালা। আজ এপ্রিল মাসের শেষ দিন, কিন্তু শীতের চিহ্ন এখনও মুছে যায়নি, এখানে সেখানে চোখে পড়ে বরফ-গলা জল।
রাস্তার পাশে একটি ভাস্কর্যের দিকে হাত দেখিয়ে সুবোধ বলল, এই পর্যন্ত হিটলারের বাহিনী এসে থেমে গিয়েছিল।
আমি চমকে উঠলুম। মস্কো নগরীর আশেপাশে কত ঐতিহাসিক স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। ১৯৪১-এর ডিসেম্বর মাসে এই অঞ্চলে কী সাংঘাতিক যুদ্ধ হয়েছিল, সারা পৃথিবী আতঙ্কে ভেবেছিল মস্কো বুঝি যায়-যায়, শেষ পর্যন্ত রেড আর্মির বীরত্বের কাছে দারুণভাবে হেরে যায় নাতসিরা। আজ তার আর কোনও চিহ্নই নেই। কয়েকটি বলিষ্ঠ পুরুষের মূর্তি আকাশের দিকে মুঠি তুলে আছে। তার পেছনেই বড়-বড় গাছ, নিঃশব্দ।
মস্কো শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে মস্কোভা নদী। এমন কিছু বড় নদী নয়। সেই নদী পেরিয়ে পৌঁছে গেলুম আমার জন্য নির্দিষ্ট হোটেলে। এটির নাম হোটেল ইউক্রাইনিয়া। এর ভবনটি যেমন প্রকাণ্ড তেমনি জমকালো ধরনের। নীচের দিকটা অতি প্রশস্ত, তার পর ধাপে-ধাপে ছোট হতে-হতে ওপরের দিকে উঠেছে। একেবারে চূড়োর কাছটা গির্জাশীর্ষের মতন। অবিকল এই এক ডিজাইনের বাড়ি মস্কো শহরে চার-পাঁচটি আছে, অনেক দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়।
সুবোধ রায় এখান থেকে বিদায় নেবে, তাকে যেতে হবে আরও খানিকটা দূরে। সে সেরগেই স্ট্রোকান-কে জিগ্যেস করল, আপনাদের কী প্রোগ্রাম বলুন? আমরা এখানকার বাঙালিরা সুনীলদাকে নিয়ে কয়েকদিন বসতে চাই।
সেরগেই স্ট্রোকান বলল, তা তো সম্ভব হবে না। আমরা ওঁকে ডেকে এনেছি, আমাদের প্রত্যেকদিনের ঠাসা প্রোগ্রাম আছে। তার মধ্যে তো সময় করা যাবে না! আপনারা ইন্ডিয়াতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করবেন।
কিন্তু সুবোধ এত সহজে কিছু মেনে নেবার পাত্র নয়।
সে বলল, সন্ধের পর তো আপনাদের আর কিছু করবার থাকবে না। তখন আমরা এসে ওঁকে নিয়ে যাব, আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব। আজকের দিনটা থাক, কাল সন্ধেবেলা আমি এসে—
সেরগেই স্ট্রোকান বলল, কাল দুপুরেই আমরা লেনিনগ্রাড চলে যাচ্ছি।
যাই হোক, ঠিক হল যে নানা জায়গায় ঘুরে আমি আবার দিন দশেক বাদে ফিরে আসব মস্কোতে। তখন এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে দেখা হবে। সুবোধ আমাদের দু'জনকেই তার কার্ড দিল, যাতে ফিরে এসেই আমরা ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি।
হোটেলের ভেতরে এসে পাসপোর্ট জমা দিয়ে নামটাম লেখাতে খুব বেশি সময় লাগল না। আমার জন্য ঘর নির্ধারিত হল সতেরো তলায়। হোটেলের লাউঞ্জটি পুরোনো আমলের মতন বেশ জমকালোভাবে সাজানো। খুব উঁচু সিলিং, আলোগুলো ঝাড়-লণ্ঠনের মতন। লিফটটি দেখেও আমি চমৎকৃত হলুম, একেবারে আদিকালের ঢাউস লিফট, পেতলের কারুকার্য করা দরজা, ভেতরে অন্তত জনা কুড়ি লোক অনায়াসে এঁটে যায়। এ-রকম লিফট আমি আগে দেখেছিলুম রোমের ভ্যাটিকানে।
সুটকেস সমেত আমাকে আমার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সেরগেই স্ট্রোকান বলল, আপনি এখন একটু বিশ্রাম নিন। আমি আবার সাড়ে নটার সময় আসব।
ওভারকোট ও জুতো-মোজা খুলে ফেললুম তাড়াতাড়ি। বেশিক্ষণ মোজা পরে থাকলে আমার অস্বস্তি লাগে। সেই গতকাল দুপুর থেকে এসব পরে আছি। খালি পায়ে এসে দাঁড়ালুম জানলার ধারে। একটু দূরেই নদী। এই নদীর দু-পার আগাগোড়া পাথর দিয়ে বাঁধানো। জানলার কাচ খুলে বাইরে মুখ ঝুঁকিয়ে টাটকা হাওয়া বুকে টেনে নিলুম অনেকখানি। একটা গভীর বিস্ময়বোধ এখনও আমাকে আপ্লুত করে আছে। সত্যি আমি রাশিয়াতে এসেছি!
মাত্র সাতটা বাজে। কলকাতায় এ সময় ঘুম থেকেই উঠি না। দীর্ঘ বিমানযাত্রা ও রাত্রি জাগরণ সত্বেও শরীরে কোনও ক্লান্তি বোধ নেই। ইচ্ছে করলে এখন ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। ধপধপে সাদা চাদর পাতা নরম বিছানায় শুয়ে পড়লুম বটে, কিন্তু একটা নতুন দেশে এসেই কি ঘুমিয়ে পড়া সম্ভব?
ঘরখানি যে-কোনও দেশের দামি হোটেল ঘরের মতন। টিভি, টেলিফোন, রাইটিং টেবল, ড্রেসিং টেবল, এক পাশে ওয়ার্ডরোব ও সংলগ্ন বাথরুম। উঠে টিভি চালিয়ে দিলুম। রুশ ভাষা এক বর্ণ বুঝি না। মনে হল খবর পড়া হচ্ছে। তার মধ্যে এক জায়গায় ইন্দিরা গান্ধির নাম শুনে চমকে উঠলুম। কী হয়েছে ইন্দিরা গান্ধির? তারপর শুরু হল বাচ্চাদের জন্য অনুষ্ঠান।
আধ ঘণ্টা শুয়ে থেকেও বুঝলুম ঘুম আসবার কোনও আশা নেই। তার চেয়ে বরং দাড়ি কামানো, স্নান ইত্যাদি সেরে ফেলা যাক। এইসব পর্ব চুকিয়ে, পোশাক পালটিয়ে আমি ফিটফাট হয়ে আবার দাঁড়ালুম জানলার ধারে। এত উঁচু থেকে রাস্তার মানুষজনকে ছোট-ছোট দেখায়। নদীর ওপর দিয়ে স্টিম লঞ্চ যাচ্ছে। এখান থেকে যে দৃশ্য আমি দেখছি, তাতে অন্যান্য সাহেবি শহরের সঙ্গে মস্কোর কোনও তফাত নেই।
একটু পরেই সারগেই স্ট্রোকান এসে পড়ল। সে বেশ ব্যস্তভাবে বলল, আপনি তৈরি তো? চলুন, আগে ব্রেক ফাস্ট খেয়ে আসি।
আমি বললুম, আগে একটু বসুন। আপনার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করে নিই।
সারগেই বলল, আপনি যে-ক'দিন আমাদের দেশে থাকবেন, আমিই সব জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাব। সুতরাং আলাপ তো হবেই।
আমি বললুম, তবু একটু বসুন।
যুবকটির চোখের মণি দুটো নীলচে, মুখটি বুদ্ধিদীপ্ত এবং সারল্য মাখানো। তার গায়ে একটা খয়েরি রঙের চামড়ার জ্যাকেট। আমি তাকে একটা সিগারেট দিতে চাইলে বলল যে কিছুদিন আগে সে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে, কারণ সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়। সেই সঙ্গে সে যোগ করল, অবশ্য সোভিয়েত দেশে এখনও অনেকেই সিগারেট খায়।
আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি আমার সম্পর্কে কী কী জানেন?
সে গড়গড় করে অনেক কিছু বলে গেল। বুঝলুম যে কলকাতার কনসুলেট থেকে পাঠানো আমার বায়োডাটা সে ভালো ছাত্রের মতন মুখস্থ করে নিয়েছে।
আমি হেসে বললুম, বাঃ সবই তো জেনে ফেলেছেন দেখছি। এবারে আপনার সম্বন্ধে কিছু বলুন!
সারগেই স্ট্রোকানের জন্ম ইউক্রাইনে, উচ্চশিক্ষার জন্য সে মস্কো চলে আসে। পড়াশুনো শেষ করার পর সে কিছুদিন সামরিক বাহিনীতে ট্রেইনিং নিয়েছে, এখন নভোস্তি প্রেস এজেন্সিতে ইন্ডিয়া ডেস্কে সে অনুবাদকের কাজ নিয়েছে। তার বয়েস বাইশ এবং সে বিবাহিত।
একটু হেসে সে যোগ করল, আমিও কবিতা লিখি। তবে আমার কবিতা বিশেষ কোনও জায়গায় ছাপা হয়নি।
তারপর সে জিগ্যেস করল, আমি আপনাকে কি মিস্টার গঙ্গোপাধ্যায় বলব? কিংবা যদি সুনীলজি বলি? ইন্ডিয়াতে তো অনেকেই এইভাবে ডাকে!
—তুমি জানলে কী করে?
—আমি ইন্ডিয়াতে গেছি। প্রায় এক বছর ছিলাম!
সারগেই স্ট্রোকান ভারত ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হতে চায় বলে সে তামিল ভাষা শিখেছে। এবং সেই ভাষাজ্ঞান ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য সে ভারতবর্ষ ঘুরে এসেছে। সে তামিলনাড়ু, কেরালা, বোম্বাই, দিল্লি দেখেছে, কলকাতার দিকে যায়নি।
আমি মনে-মনে একবার ভাবলুম, ওদের ইন্ডিয়া ডেস্কে নিশ্চয়ই বাংলা জানা ছেলেও আছে। সেরকম একজনকে কেন পাঠাল না আমার সঙ্গী হওয়ার জন্য? পরক্ষণে সেই ভাবনাটা বাতিল করে দিলুম। এই যুবকটিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। বাংলা জানা বা না জানায় কী আসে যায়!
ঠিক হল, সে আমাক সুনীলজি বলবে, আমি তাকে শুধু সারগেই বলে ডাকব। এর পর নীচে নেমে এলুম ব্রেক ফাস্ট খেতে।
এ হোটেলের ডাইনিং হলটাও বিশাল। ব্রেক ফাস্ট খাওয়ার দু-রকম পদ্ধতি। টেবিলে বসে মেনিউ কার্ড দেখে ইচ্ছে মতন অর্ডার দেওয়া যায়। আর একদিকে আছে সেলফ সার্ভিস। আমরা দ্বিতীয় দিকেই গেলুম। এখানে পনেরো-কুড়ি রকম খাবার সাজানো রয়েছে, তিন রুবল দিয়ে টিকিট কাটলে ইচ্ছে মতন যা খুশি নেওয়া যায়।
আমি একটা ডিম সেদ্ধ, একজোড়া সসেজ ও এক পিস টোস্ট নিয়ে টেবিলে বসতেই সারগেই বলল, এ কী সুনীলজি, এত কম নিলেন? আরও কত কী রয়েছে, স্যালামি, বেকন, হ্যাম, মিট বল, ম্যাসড পোটাটো, চিজ, আমাদের অনেকরকম চিজ আছে, ট্রাই করুন!
আমি খুব একটা ভোজনরসিক নই, বিশেষত সকালের দিকে মোটেই বেশি খেতে ইচ্ছে করে না। তবু সারগেই আরও কিছু খাদ্য জোর করে এনে দিল আমার প্লেটে। কাছাকাছি টেবলগুলোতে যারা বসে আছে, তারা অধিকাংশই বিদেশি; ইংরিজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষা শুনতে পাচ্ছি। এই হোটেলটি প্রধানত বিদেশিদেরই জন্য।
দশটার সময় বেরিয়ে এলুম হোটেল থেকে। এবারে আর ট্যাক্সি নয়, সারগেই-র অফিস থেকে গাড়ি এসেছে। এই গাড়ি সারাদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে।
সারগেই বলল, চলুন, সুনীলজি, আগে রেড স্কোয়ার দেখে আসি। রেড স্কোয়ার না দেখলে মস্কো শহর অনুভবই করা যায় না।
আমি তাতে সম্মতি জানালুম।
মস্কো শহরে আধুনিক কায়দায় বিরাট বিরাট বহুতল বাড়ি যেমন উঠেছে, তেমনি পুরোনো আমলের প্রাসাদ রয়ে গেছে অনেক। রাস্তার দু-পাশে বাতিস্তম্ভগুলোতে লোকেরা এক জোড়া করে লাল পতাকা লাগাচ্ছে, দু-দিন মে-ডের উৎসব, সেজন্য। ঝকঝক করছে রোদ। চওড়া চওড়া রাস্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থা অতি সুশৃঙ্খল, কোথাও জ্যামে পড়তে হল না। তবে, পশ্চিমি কোনও বড় শহরের তুলনায় মস্কোতে গাড়ির সংখ্যা যেন কিছু কম। বাস স্টপগুলিতে রয়েছে অপেক্ষমাণ মানুষ, অনেক লোক পায়ে হেঁটেও যাচ্ছে, এটা দেখলে স্বস্তি লাগে। আমেরিকার অনেক শহরে গাড়ি ছাড়া একজনও পথচারী দেখা যায় না, কেন যেন ভূতুড়ে-ভূতুড়ে মনে হয়।
মস্কো শহরটি তেমন ঘিঞ্জি নয়। মাঝে মাঝেই পার্ক রয়েছে, তাতে নানারকম ভাস্কর্য। ব্রোঞ্জ ও পাথরের মূর্তিগুলি দৃষ্টি টেনে নেয়। খুবই বলিষ্ঠ কাজ। লেনিনের মূর্তি ছাড়াও বিখ্যাত সব সাহিত্যিক ও কবিদের মূর্তিও আছে। একটি অতি জীবন্ত মূর্তির নাম, সর্বহারার অস্ত্র ঃ খোয়া পাথর।
যেতে-যেতে বলশয় থিয়েটার দেখে আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠল। এই সেই বিখ্যাত নাট্যশালা! আমি সারগেইকে বললুম, এখানে একটা ব্যালে কিংবা অপেরা দেখার সুযোগ পাব কী?
সারগেই বলল, এখন তো টুরিস্ট সিজন, টিকিট পাওয়া খুব শক্ত, তবু আমি চেষ্টা করব!
রেড স্কোয়ারে যাওয়ার আগে আমরা পুরো ক্রেমলিন এলাকাটায় একটা চক্কর দিলুম। এই অঞ্চলে আধুনিক বাড়ি বেশি চোখে পড়ে না, প্রাচীন ভাবটি অক্ষুণ্ণ আছে। ক্রেমলিন প্রাসাদের পেছন দিকে একটি পার্ক, সেখানে নামলুম আগে। এই পার্কের মধ্যেই একটি ঘেরা জায়গায় জ্বলছে অমর-জ্যোতি। যুদ্ধের সময় দেশকে রক্ষা করার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের স্মরণে জ্বলে এই অনির্বাণ আলোর শিখা। আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়ালুম আমার শ্রদ্ধা জানাতে। অনেকেই এই আলোর শিখা দেখতে এসেছে, তার মধ্যে দেখলুম দু-জোড়া নব-বিবাহিত দম্পতিকে। যুবতী দুটির সাদা পোশাক ও দীর্ঘ ওড়না দেখলেই বোঝা যায় তারা সদ্য বিবাহের অনুষ্ঠান সেরেই এখানে এসেছে। সারগেইকে জিগ্যেস করে জানলুম, অনেক নব-দম্পতিই এখানে আসে। বিবাহের আনন্দ উৎসবের মাঝখানে শহিদ বেদিতে মাল্যদান আমাদের কাছে একুট আশ্চর্য মনে হতে পারে, কিন্তু সোভিয়েত নাগরিকদের কাছে এর বিশেষ তাৎপর্য আছে। গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রায় দু-কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছে, যখন এখানে জনসংখ্যাই ছিল কুড়ি কোটি। অর্থাৎ প্রায় প্রত্যেকটি পরিবার থেকেই একজন দুজন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিংবা পঙ্গু হয়েছে।
আমি সারগেইকে মৃদু গলায় জিগ্যেস করলুম, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় তো তুমি জন্মাওনি। তোমাদের পরিবারের কেউ কি...
সে সংক্ষিপ্তভাবে বলল, হ্যাঁ।
গাড়িতে ফিরে এসে আবার খানিকটা চক্কর দিলুম। চার দিকেই অসংখ্য ফুল। এর মধ্যে বেশি করে চোখে পড়ে টিউলিপ। এত বৈচিত্র্যময় টিউলিপ আমি আগে কখনও দেখিনি। গাঢ় লাল রঙের টিউলিপের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ছিল, এখানে দেখলুম হলুদ এবং তুষার-শুভ্র টিউলিপের ঝাড়ও রয়েছে। বাগানগুলি খুব যত্ন করে সাজানো। ফরাসি দেশের মতন বেশি বেশি যত্নের চিহ্ন প্রকট নয়, বরং বেশ স্বাভাবিক।
সারগেই বলল, আপনি ভাগ্যবান, আপনি খুব ভালো সময়ে এসেছেন। কয়েকদিন আগেও এখানে যখন-তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। দুদিন ধরে আকাশ পরিষ্কার। সেজন্য টিউলিপও এত বেশি ফুটেছে।
রেড স্কোয়ারে যাওয়ার জন্য গাড়িটা বাইরে রেখে খানিকটা হেঁটে যেতে হয়। ঢালু রাস্তা ধরে আমরা ওপরের দিকে উঠে এলুম।
তারপর রেড স্কোয়ারে পা দিয়েই মনে হল, এ জায়গাটা তো আমার খুব চেনা!
২
অসংখ্য ছবিতে এবং চলচ্চিত্রে রেড স্কোয়ার দেখেছি। বিভিন্ন দিক থেকে। সুতরাং রেড স্কোয়ারে প্রথম পা দিয়ে তো খুব চেনা মনে হবেই। সারা বছর ধরেই রেড স্কোয়ারে নানান উৎসব ও জমায়েত হয়। আসন্ন মে দিবসের উৎসবের জন্য আজ রেড স্কোয়ারকে বহু পতাকা ও ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। সারগেই কিছু বলবার আগেই আমি একটি চতুষ্কোণ ভবনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললুম, ওইটা তো সেই মাস্যালিয়াম, যেখানে লেনিনের দেহ রাখা আছে?
ক্রেমলিন প্রাসাদের উত্তর-পূর্ব দিকে এই প্রশস্ত চত্বরের নাম রেড স্কোয়ার। আমরা যেদিক দিয়ে ঢুকলুম, সেদিক দিয়ে প্রথমেই পড়ে সেন্ট বেসিলস ক্যাথিড্রাল। ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি এই বিচিত্র আকারের ও নানা রঙের গির্জাটি রাশিয়ান স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এই গির্জার গম্বুজের সংখ্যা ন'টি, প্রত্যেকটিই বিভিন্ন আকৃতির। চমৎকার দেখতে এই গির্জাটিতে খানিকটা যেন বার্মিজ স্থাপত্যের ছাপ আছে বলে মনে হল, কিংবা আমার ভুলও হতে পারে।
সেই গির্জার পাশ দিয়ে একটু এগোলেই ডান পাশে একটা উঁচু বেদির মতন, জারদের আমলে এটা ছিল বধ্যভূমি, সম্রাটদের ইচ্ছাক্রমে যাকে তাকে ওখানে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হত, এখন সেখানে ফুলের মালার স্তূপ।
ক্রেমলিন প্রাসাদের সিংহদ্বারের কাছেই যে সুউচ্চ গম্বুজ, যার চূড়ায় রয়েছে একটি বিশাল তারা, সেই গম্বুজটিই মস্কো শহরের প্রতীক চিহ্ন বলা যায়। সেই গম্বুজে দিনে দু-বার ঘণ্টাধ্বনি হয়। সেই ধ্বনিতে শোনা যায় 'ইন্টারন্যাশনাল' গানের সুর।
রেড স্কোয়ারে অসংখ্য মানুষ অপেক্ষা করছে সেই ঘণ্টাধ্বনি শোনবার জন্য। অধিকাংশই টুরিস্ট, এদের মধ্যে আমেরিকান টুরিস্টদের আলাদা করে চেনা যায়। অত্যন্ত সুসজ্জিত কয়েকজন পুলিশ সেই ভিড়ের শৃঙ্খলা রক্ষা করছে। সেই পুলিশদের মুখগুলি খুবই গম্ভীর। পুলিশের পোশাক পরে থাকলে বোধহয় হাসি নিষেধ।
লেনিন সমাধিভবনের সামনে বিরাট লম্বা লাইন। সারগেই জিগ্যেস করল, আপনি ভেতরে যেতে চান?
অতবড় লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর বাসনা আমার হল না, আমি বললুম, না, থাক।
সারগেই বলল, এখন শুধু জায়গাটা দেখে নিই, পরে তো এখানে বারবার আসতে হবেই।
রেড স্কোয়ারের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত হেঁটে গেলুম দুজনে। চত্বরটি কবল স্টোন বা খোয়া পাথরে বাঁধানো, প্রাচীন কালে যেমন ছিল, সেইরকমই রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, ছবিতে বা সিনেমায় রেড স্কোয়ারকে যত বিশাল মনে হয়, আসলে কিন্তু তত বড় লাগল না। কল্পনার থেকে বাস্তব সবসময়েই একটু ছোট।
ক্রেমলিন কথাটার মানেই হল দুর্গ। দেয়াল ঘেরা এই অঞ্চলটাই আদি মস্কো, তারপর একে কেন্দ্র করে শহরটা ছড়িয়েছে। এর চারপাশ দিয়েই বেরিয়েছে বড় বড় রাস্তা। এবারে আমরা অন্য একটা রাস্তা ধরে শহর দেখতে দেখতে পৌঁছলুম নভোস্তি প্রেস এজেন্সির কার্যালয়ে।
রাশিয়ান ভাষায় হরফ অনেকগুলিই রোমান হরফের মতন হলেও উচ্চারণে প্রায় কোনও মিলই নেই। রোমান হরফ দেখা চেনা চেনা মনে হলেও রাশিয়ান ভাষা আমরা পড়তে পারি না। সেই জন্যই নভোস্তি প্রেস এজেন্সির আদ্যক্ষর এন পি এ নয়, এ পি এন। এই এ পি এন-এর আমন্ত্রণেই আমি এদেশে অতিথি হয়ে এসেছি।
এ পি এন-এর অফিস ভবনটি প্রকাণ্ড। ঢোকার মুখে কড়া পাহারার ব্যবস্থা। সোভিয়েত দেশ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পরিবেশনের দায়িত্ব এই সংস্থার। সারা পৃথিবীতে রয়েছে এঁদের শাখা, বহু সাময়িক পত্র-পত্রিকা এঁরা পরিচালনা করেন।
সারগেই অনেক সিঁড়ি ঘুরিয়ে আমায় একটি প্রশস্ত কক্ষে এনে বসাল। তারপর পাশের দফতরের এক মহিলা কর্মীকে আমাদের আগমনবার্তা জানিয়ে আমার কাছে এসে বলল, এক্ষুনি যিনি আসবেন, তিনি হলেন ওর বস। তিনি এই দফতরের দণ্ডুমুণ্ডের কর্তা, তিনি স্বয়ং আসছেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। সারগেই-এর গলায় খানিকটা উত্তেজনার আভাস। নতুন চাকরিতে ঢুকেছে, তাই বস সম্পর্কে ওর বেশ একটা ভয়-ভয় সমীহের ভাব আছে বলে মনে হল।
এক মিনিট পরেই যিনি ঘরে ঢুকলেন, তিনি একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। বেশ হাসিখুশি মুখের ভাব, তাঁকে দেখে মোটেই ভয় জাগে না। এঁর নাম সোয়ার্টস ইগর আলেকসেভিচ, ইনি এশিয়া বিভাগের উপ-পরিচালক।
সোয়ার্টস সাহেবকে দেখে আমি সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াতেই তিনি প্রফুল্ল গলায় বললেন, বসুন, বসুন! আপনার বিমানযাত্রা ক্লান্তিকর হয়নি তো? এখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
সোয়ার্টস সাহেব একাধিকবার ভারতে এসেছেন, বেশ কিছুদিন দিল্লিতে থেকে গেছেন, সুতরাং আলাপ-পরিচয়ে প্রাথমিক জড়তাটা সহজেই কাটিয়ে ওঠা গেল।
তিনি আমাকে জিগ্যেস করলেন, আপনি এ দেশে এসে কী কী দেখতে চান বলুন?
আমি বললুম, আমি প্রধানত ভ্রমণকারী, তথ্য সংগ্রাহক নই। আপনাদের দেশে এসেছি, যা যা দেখবার সুযোগ পাব তাই-ই দেখব, আলাদাভাবে কোনও বিশেষ ব্যাপারে কৌতূহল নিয়ে আসিনি।
তিনি বললেন, এক হিসেবে আপনি খুব ভালো সময়েই এসেছেন, আবার খুব খারাপ সময়েও বটে। ভালো, তার কারণ আবহাওয়া এখন চমৎকার। তবে মুশকিল হচ্ছে এখন পরপর ছুটির দিন। তাই অনেক কিছুই বন্ধ থাকবে। তবু যতটা সম্ভব বেশি কিছু দেখাবার জন্য আপনার একটি সফর পরিকল্পনা আমরা তৈরি করে রেখেছি। আপনি ইচ্ছে মতন ঘুরুন, এই সারগেই ছেলেটি আপনার সঙ্গে থাকবে, বিশেষ কিছু ইচ্ছে হলে ওকে জানাবেন। যা জানতে চান জিগ্যেস করবেন। আপনাকে কয়েকটা বইপত্র দিচ্ছি। পড়ে দেখতে পারেন—
মাঝপথে কথা থামিয়ে সোয়ার্টস জিগ্যেস করলেন, চা না কফি খাবেন? চা তো আপনাদের দেশের মতন ভালো নয়।
সকাল থেকে আমি দু-কাপ চা খেয়েছি, তাতে আমি চায়ের কোনও স্বাদই পাইনি। সুতরাং বললুম, কফি!
এ পি এন ভবন থেকে বেরিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মস্কো রাইটার্স ইউনিয়ান।
অনেক কিছু সম্পর্কেই আমাদের একটা পূর্ব ধারণা গড়ে ওঠে। সোভিয়েত দেশের রাইটার্স ইউনিয়ান সম্পর্কে এত বেশি প্রচার ও অপপ্রচার আগে শুনেছি বা পড়েছি যে এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আমার মনে একটা ধাঁধার ভাব ছিল। সরকারি আওতায় কোনও লেখক সমিতি পরিচালনার ব্যাপারটা আমাদের ঠিক যেন মনঃপূত হয় না।
মস্কো লেখক সমিতির কার্যালয়টি কেমন হবে, সে সম্পর্কে আমার মনে আগে থেকেই একটা ছবি আঁকা ছিল। সরকারি বাড়ি, চৌকো চৌকো ঘর, শ্রীহীন দেওয়াল, নেতাদের ছবি, মস্ত বড় টেবিলের চারপাশে শক্ত শক্ত চেয়ার, সব মিলিয়ে গম্ভীর গম্ভীর ব্যাপার। কিন্তু লেখক সমিতি-তে এসে আমি অবাক হলুম। বস্তুত, মস্কোতে পৌঁছে এই প্রথম আমার একটি গভীর বিস্ময় ও আনন্দের ব্যাপার ঘটল।
বিপ্লব-পূর্বকালের কোনও এক ধনাঢ্য মহিলার বিলাস-মহলটিতেই এখন লেখক সমিতির ঘাঁটি। বাড়িটি অপূর্ব। লোহার গেট পেরিয়ে একটি প্রশস্ত চত্বর, পাশে কয়েকটি ছোট-ছোট কটেজ, তারপর সামনের প্রাসাদের মধ্যে অনেকগুলি ঘর, নানারকম গলিপথ ও সুড়ঙ্গ; যেন কোনও গুপ্তপথ দিয়ে আমরা একবার মাটির নীচে নেমে গেলুম আবার ওপরে উঠলুম। একজন মহিলার সঙ্গে আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, তাকে খুঁজে বার করতেই খানিকটা সময় লেগে গেল। আমাদের খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল, তবু তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
দেখামাত্র তিনি হেসে জিগ্যেস করলেন, কেমন আছেন? আবার দেখা হল।
এঁর নাম মারিয়াম সোলগানিক, ইনি একজন নামকরা লেখিকা এবং লেখক সমিতির পরিচালকদের মধ্যে একজন, ঠিক কোন পদ অলংকৃত করেছেন তা আমার জানা হয়নি। ধারালো, ঝকঝকে পাতলা চেহারা, ইংরেজি বলেন অতি মসৃণভাবে। কিছুদিন আগেই উনি কলকাতা ঘুরে গেছেন, তখন একটি চা-চক্রে দেখা হয়েছিল, ওঁকে আমার মনে আছে, কিন্তু আমাকেও যে উনি চিনতে পারবেন, সেটা খুব আশ্চর্য কথা!
শ্রীমতী মারিয়াম সোলগানিক বললেন, চলুন, চা খেতে-খেতে গল্প করা যাক।
সারগেই বলল, আমরা দুপুরে লাঞ্চ খাইনি, আপনাদের এখানে খাওয়াটা সেরে নিতে চাই।
শ্রীমতী মারিয়াম সোলগানিক আবার আমাদের সেই বাড়ির ভেতরকার গুপ্তপথ দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিয়ে চললেন। পুরোনো আমলের বাড়িতে এইরকম পথ থাকে। উনি বললেন, আমরা আসলে পেছন দিক দিয়ে যাচ্ছি, সামনের দিক দিয়ে অনেক সহজে যাওয়া যায়।
কাঠের ফ্লোর লাগানো একটা বড় হলঘরে এসে পৌঁছলুম, যেটা নির্ঘাৎ এক সময়ে নাচ ঘর ছিল। এক পাশ দিয়ে একটা কারুকার্য করা ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। এখানে অনেকগুলো টেবিল সাজানো, কিন্তু সবই শূন্য। দুঃখের বিষয় সেখানে আমাদের খাওয়া হল না, লাঞ্চ আওয়ার পেরিয়ে গেছে বলে সার্ভিস বন্ধ।
শ্রীমতী মারিয়াম সোলগানিক বললেন, তা হলে আর কী করা যাবে, চলুন চা-ই খাওয়া যাক।
আর একটি বড় ঘরে এসে পৌঁছলুম আমরা। এই ঘরখানিও খুব দৃষ্টিনন্দন। সমস্ত দেওয়ালে নানারকম ছবি আঁকা, অধিকাংশই কাঁচা হাতের। লেখকরা আড্ডা দিতে-দিতে যার যা খুশি দেয়ালে আঁকেন। শ্রীমতী সোলগানিক বললেন, এর মধ্যে অনেক ছবিতে উত্তর প্রত্যুত্তর আছে। অর্থাৎ একজন লেখক একটা কিছু ছবি এঁকেছেন, অন্য কোনও লেখক পাশে আর একটা ছবি এঁকে উত্তর দেন তার।
আমি জিগ্যেস করলুম, লেখকদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয় না?
—কেন হবে না? প্রায়ই হয়। সব দেশেই লেখকরা তো একই জাতের।
—এখানে কখনও লেখকদের মধ্যে ঘুসাঘুসি হয়েছে?
উনি হেসে বললেন, না। লেখকদের মধ্যে মতবিরোধটা কাগজে-কলমে হওয়াই ভালো।
লেখক ইউনিয়ান একটি স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান। লেনিন ঠিক করে দিয়েছিলেন যে প্রত্যেক প্রকাশক লেখকদের রয়ালটির একটা অংশ এই ইউনিয়ানকে দিতে বাধ্য থাকবে। এমন সমস্ত প্রকাশনালয়ই সরকার পরিচালিত, তারা প্রত্যেকেই টাকা দেয়। সেই টাকায় এই ইউনিয়ানের খরচ চলে। লেখকরা এখানে আড্ডা, শস্তায় খাওয়া-দাওয়া, সুরাপান ও আলাপ-আলোচনা করতে আসেন। নতুন সদস্য নেওয়ার আগে এখানকার কমিটি সেই লেখকের গুণাগুণ আলোচনা করে দেখে। চেষ্টা করেও কেউ-কেউ এখানকার সদস্য হতে পারেননি, এমন নজিরও আছে। এই লেখক সমিতির পরিচালনায় সারাদেশে আছে অনেকগুলি রাইটার্স হোম, সেগুলি সাধারণত স্বাস্থ্যকর, নিরিবিলি জায়গায়, সদস্য লেখকরা সেই সব রাইটার্স হোমে গিয়ে এক মাস দু-মাস থেকে লিখতে পারেন, নামমাত্র খরচে।
আমি জিগ্যেস করলুম, মনে করুন, কোনও একজন লেখক এই রকম একটা রাইটার্স হোমে গেল, আপনাদের খরচে থেকে এল একমাস, কিন্তু এক লাইনও লিখল না, অর্থাৎ কোনও লেখা তার মাথায় এল না, তা হলে কী হবে?
শ্রীমতী সোলগানিক বললেন, একজন লেখক লিখবেন কি লিখবেন না, সেটা তাঁর ইচ্ছে। তাতে আমাদের কী বলবার আছে?
লেখক সমিতির থেকে লেখকদের আরও নানারকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। তার মধ্যে একটা হল অনুবাদের ব্যবস্থা করা। অনুবাদের ব্যাপারটা সোভিয়েত দেশে একটা এলাহি কারবার।
শ্রীমতী সোলগানিক বললেন, আপনাদের ভারতবর্ষে যেমন ভাষা সমস্যা আছে, আমাদেরও সেইরকম ছিল। আমরা সেই সমস্যা সমাধান করে ফেলেছি অনুবাদের মাধ্যমে।
সোভিয়েত ইউনিয়ানে প্রধান ভাষা ৭৭টি। এই প্রত্যেকটি ভাষায়ই আলাদা সাহিত্য আছে। এই সব ভাষার উল্লেখযোগ্য লেখা অনূদিত হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষায়, আবার রাশিয়ান ভাষায় লেখাও অনূদিত হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষায়। তার ফলে একজন আঞ্চলিক ভাষার লেখকও অনায়াসেই সমস্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় পরিচিত হতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা থেকেও অবিরাম অনুবাদ চলছে। অনেক আমেরিকান লেখক সোভিয়েত রাশিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এক একটি বইয়ের অনুবাদ ছাপা হয় প্রাচ পাঁচ লক্ষ করে। রবীন্দ্র রচনাবলিও পাঁচ লক্ষ ছাপা হয়েছে ও অতি দ্রুত ফুরিয়ে গেছে।
বিপ্লবের আগে থেকেই জাতিগতভাবে রাশিয়ানরা দারুণ পড়ুয়া। সম্প্রতিকালের ইউনেস্কোর রিপোর্টেও প্রকাশ যে সারা পৃথিবীতে সোভিয়েত দেশের নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি বই পড়ে। এক হাজার জন শিক্ষিত লোকের মধ্যে ৯৯০ জনেরই বই কেনার অভ্যেস আছে।
আমি বললুম, রাশিয়ানরা খুব বেশি পড়ে তা জানতুম, কিন্তু তারা যে এত অনুবাদও পড়ে, এটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার!
শ্রীমতী সোলগানিক আমাকে সংশোধন করে দিয়ে বললেন, রাশিয়ান নয়। বলুন সোভিয়েত পিপল!
এ কথা ঠিক। আমরা সবসময় রাশিয়া বা রাশিয়ান বললেও সোভিয়েত ইউনিয়ানে এখন নানান জাতির সমন্বয় এবং এর সীমানাও রাশিয়াকে ছাড়িয়ে অনেকখানি। মূল রুশ ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগ দিয়েছে অন্য অনেকগুলি স্টেট, এখন মোট ১৫টি স্টেট নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ান। এমন অনেক স্টেট আছে, যেমন টাশকেন্ট কিংবা ল্যাটভিয়া, যেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতি রুশদের থেকে অনেক আলাদা। তারা রাশিয়ান নয়, কিন্তু সোভিয়েত নাগরিক।
কিন্তু বাংলায় এখনও আমরা চলিত ভাষায় সোভিয়েত ইউনিয়ানকে রাশিয়া বলি; সোভিয়েত অধিবাসীর বদলে রাশিয়ান।
শ্রীমতী সোলগানিক মৃদু হাস্যে বললেন, মনে করবেন না যে আমাদের এখানে একবারে ব্ল্যাক মার্কেট নেই! আছে। আমাদের দেশে বই আর অপেরার টিকিটের ব্ল্যাক মার্কেট হয়।
কথাটা বলার সময় তাঁর কণ্ঠে বেশ গর্ব মিশে গেল! তা তো হওয়ারই কথা।
শ্রীমতী সোলগানিক আমাকে জিগ্যেস করলেন, কোন কোন সোভিয়েত লেখকের কথা আমি পড়েছি!
আমি লজ্জিতভাবে বললুম, প্রায় কিছুই পড়িনি।
রুশ মহৎ লেখকদের রচনা আমাদের অবশ্য পাঠ্য, টলস্টয়-ডস্টয়েভস্কি-টুর্গেনিভ-এর উপন্যাস আমরা কৈশোর বয়সে থেকে বারবার পড়েছি, গভীর মুগ্ধতা নিয়ে, পুশকিন থেকে ব্লক-মায়াকভস্কির কবিতাও পড়েছি। কিন্তু তারপর সোভিয়েত আমলের লেখকদের সম্পর্কে আমরা, অন্তত আমি, প্রায় অজ্ঞই বলা চলে। সলোকভ ছাড়া আর কোনও নামই চট করে মনে পড়ে না। তার কারণ, আমাদের মিডিয়াগুলি পশ্চিম-শাসিত। ইংরেজি ভাষার প্রতি দাসত্বের জন্য আমরা সবসময় ইংল্যান্ড- আমেরিকার মুখাপেক্ষী। টাইম-নিউজউইক যাকে বিশ্ব সংবাদ বলে সেগুলিকেই আমরা মনে করি সাম্প্রতিক বিশ্বের উল্লেখযোগ্য খবর। ওরা পাস্তেরনাক বা সোলঝেনিৎসিনকে নিয়ে শোরগোল শুরু করলে তারপর আমরা ওই লেখকদের কথা জানতে পারি এবং তাদের লেখা পড়তে আগ্রহী হই। এমনকী ইয়েভতুশেংকো ও ভজনেসেনস্কির মতন আধুনিক কালের কবিদের কথাও জেনেছি ওই একই উপায়ে। ওঁদের মার্কিন দেশ সফরের সময় খুব হই চই হয়েছিল বলে। আধুনিক সোভিয়েত লেখকদের প্রতিনিধিত্বমূলক লেখার ভালো ইংরিজি অনুবাদ আমরা সরাসরি বইয়ের দোকানে পাই না। কনসুলেট থেকে মাঝে মাঝে দু-চারটি বই বাড়িতে পাই, সেগুলিকে মনে হয় প্রচারমূলক, পড়তে ইচ্ছে করে না।
এক কাপ চা আগেই ফুরিয়ে গেছে, এরপর নিলাম এক বোতল করে মিনারাল ওয়াটার। সারগেই আমাকে বোঝাল যে এই মিনারাল ওয়াটার পেটের পক্ষে খুব ভালো। শ্রীমতী সোলগানিক বললেন, বেশি খাবেন না যেন!
আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল। আরও অনেকক্ষণ চলতে পারত। কিন্তু শ্রীমতী সোলগানিকের অন্য কাজ আছে। তিনি বললেন, আবার পরে একদিন আসবেন, আবার গল্প হবে।
বিদায় নেওয়ার সময় তিনি জিগ্যেস করলেন, আপনাদের লেখক সমিতি সম্পর্কে কিছু জানা হল না। আপনাদের সমিতি কীভাবে চলে?
অমি বললুম, আমাদের কোনও লেখক সমিতি নেই।
তিনি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, লেখকদের কোনওরকম ইউনিয়ান নেই?
আমাকে আবার বলতে হল, না। কোনওরকম ইউনিয়ান নেই।
বাঙালি লেখকদের কোনও ইউনিয়নের কথা আমি আগে চিন্তা করিনি। এখন মনে হল, মস্কোর মতন আমাদেরও লেখকদের একটা মিলনস্থান থাকলে বেশ হত! তাহলে মল্লিক প্যালেস কিংবা কুচবিহারের রাজার বাড়ি কিংবা ভাওয়ালের রানির বাড়ি কি সরকার আমাদের দিত? সে আশা দুরাশা! সোভিয়েত ইউনিয়ানের লেখকদের সম্মান অনেক বেশি।
গেটের বাইরে এসে আমাদের গাড়িটি খুঁজে পাওয়া গেল না। সারগেই বলল, আমি তো ভেবেছিলুম আমরা এখানে খেয়ে নেব, তাই ড্রাইভারকেও খেয়ে আসতে বলেছিলুম, সাড়ে চারটের মধ্যে ফেরার কথা। দেখি, গাড়িটা বোধহয় অন্য কোথাও রেখেছে। সুনীলজি, আপনি এই পার্কটায় ততক্ষণ বসুন।
এটাকে ঠিক পার্ক বলা যায় না, রেলিং ঘেরা খানিকটা জায়গা, কয়েকটি বেঞ্চ আর ঘাস-চটা মাটি। দুটি বাচ্চাকে নিয়ে এক বৃদ্ধা বসে আছেন একদিকে। আমি আর একটি বেঞ্চে বসলুম। বাচ্চাগুলি খেলতে-খেলতে একবার আমার কাছে চলে এল। ভাষা জানি না, তাই ওদের সঙ্গে কোনও কথা বলতে পারলুম না, কিন্তু তারা আমায় কী যেন বলছে। বৃদ্ধা দেখছেন আমাকে। মনে হয় দিদিমা এসেছেন তাঁর নাতি-নাতনি নিয়ে। তিনিও আমায় কিছু বললেন, একটি বর্ণও বুঝলুম না। হাত নেড়ে হাসিমুখে আমার অজ্ঞতার কথা জানালুম।
সেই বৃদ্ধ বাচ্চা দুটিকে ডেকে পার্ক থেকে বেরিয়ে যেতেই ঝড় উঠল। প্রথমে ধুলোর ঘূর্ণি, তারপর উড়ে এল অসংখ্য শুকনো পাতা, তারপরই বৃষ্টি।
সারগেই ছুটতে-ছুটতে ফিরে এল। তার উদভ্রান্ত অবস্থা। সে বলল, গাড়িটা খুঁজে পাচ্ছি না! এদিকে বৃষ্টি এসে গেল!
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো খুব বড়-বড়। একটুক্ষণ থাকলেই ভিজে যাব। পার্ক থেকে বেরিয়ে আমি পাশের একটা বাড়ির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দাঁড়ালুম। অত্যন্ত শীতের দেশ বলে এসব জায়গায় প্রায় সব বাড়িতেই দুটো করে দরজা থাকে। প্রথমে একটা ভারী কাঠের দরজা। তারপর একটু ফাঁক দিয়ে একটা কাচের দরজা। আমি ওই মাঝখানের জায়গাটায় দাঁড়ালুম। কার বাড়ি জানি না। কাচের দরজা দিয়ে দেখে মনে হয় কোনও ডাক্তারের চেম্বার। কাচের দরজাটা তালাবন্ধ, ভেতরে কেউ নেই।
সারগেই আবার গাড়ি খুঁজতে গেছে। খানিকক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি আবার বাইরে বেরুতেই শীতের চাবুক খেলুম। বৃষ্টি এবং শনশনে হাওয়ায় তাপমাত্রা হঠাৎ অনেক নেমে গেছে, আমি তাড়াতাড়ি আবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এলুম। আমাদের দেশে এইরকমভাবে কারুর বাড়িতে ঢুকলে নিশ্চয়ই কেউ এসে কড়া গলায় বলত, কী চাই মশাই? এখানে কী করছেন? এদেশে এরকম কেউ বলে না। তবু অস্বস্তি বোধহয়।
সারগেই আবার এসে খুবই লজ্জিতভাবে কাঁচুমাচু গলায় জানাল যে গাড়িটা কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ গাড়িটাকে সে এখানেই রাখতে বলেছে...।
আমি তাকে বললুম, তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ কেন? তুমি এখানে দাঁড়াও আমার সঙ্গে। গাড়িটা এসে পড়বে নিশ্চয়ই।
সারগেই সে কথা শুনল না। বৃষ্টি মাথায় করে সে আবার ছুটে গেল। আমি শীত কাটাবার জন্য একটার পর একটা সিগারেট টানতে লাগলুম।
গাড়িটা এল প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে। সারগেই-এর এত বেশি ব্যস্ততার কারণ, কোনও একটা জায়গায় গিয়ে খোঁজ নিতে হবে যে আজ সন্ধেবেলা কোনও ব্যালে বা অপেরার থিয়েটারের টিকিট পাওয়া যাবে কি না, সেখানে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
গাড়ি চলবার পর সারগেই বলল, ড্রাইভার দেরি করে আসার যে কারণ জানাল, তা প্রায় একটা ডিটেকটিভ বই-এর মতন!
আমি বললুম, তাই নাকি?
সারগেই বলল, ড্রাইভার খেয়ে ফিরে আসছিল...এমন সময় রাস্তায় একটা ঘটনা ঘটে। একটা চোর চুরি করে দৌড়ে পালাচ্ছিল, এমন সময় পুলিশ এই গাড়িটাকে থামিয়ে উঠে পড়ে সেই চোরটাকে ধরবার জন্য।
—তারপর চোরটা ধরা পড়েছে?
—বলছে তো ধরা পড়েছে।
ড্রাইভার ইংরেজি বোঝে না। তবু এখন সে ঘাড় ফিরিয়ে রুশ ভাষায় অনেক কিছু বলতে লাগল সারগেইকে।
সারগেই আমাকে বলল, তা হলেই বুঝতে পারছেন, সুনীলজি। আমাদের দেশেও চোর আছে!
ওর বলার ভঙ্গিতে হো-হো করে হেসে উঠলুম।
নির্দিষ্ট স্থানটিতে এ পি এন-এর একজন প্রতিনিধি তখনও অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। ব্যালের টিকিট পাওয়া যায়নি। অপেরার টিকিট পাওয়া গেছে। তবে বলশয় থিয়েটারে নয়, ক্রেমলিন থিয়েটারে।
প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। মাঝখানে এক ঘণ্টা সময় আছে। সারগেই প্রস্তাব জানাল, এই সময়টায় আমরা কিছু খেয়ে নিতে পারি। সকালে ব্রেক ফাস্ট বেশ হেভি হয়েছিল বলে আমার তখনও খিদে পায়নি। সারগেই বলল যে, অপেরা দেখে বেরুবার পর অনেক দেরি হয়ে যাবে, তখন খাবার পাওয়া যাবে না। তাতেও আমি তখন খেতে রাজি হলুম না। পেট ভরতি থাকলে ঘোরাঘুরি করতে মন লাগে না।
হোটেলে ফিরে মুখ-হাত ধুয়ে এক পেয়ালা করে কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়লুম দুজনে। আসলে সময় বেশি হাতে নেই। ক্রেমলিন থিয়েটার ক্রেমলিন প্রাসাদের মধ্যে, সেদিকে ঢুকতে হয় অন্য এক রাস্তা দিয়ে। এবং গেটের সামনে লম্বা লাইন। কোনওরকম হ্যান্ড-ব্যাগ বা ছাতা-টাতা নিয়ে ভেতরে ঢোকার নিয়ম নেই। সারগেই-এর হাতে একটা ব্যাগ ছিল, দ্বাররক্ষী তাকে আটকাল। সেই ব্যাগটা তাকে জমা রেখে আসতে হল বেশ খানিকটা দূরে।
ক্রেমলিন এলাকার মধ্যে অনেকগুলি প্রাসাদ ও গির্জা আছে। থিয়েটার বাড়িটি নতুন। একেবারে অত্যাধুনিক কায়দায় তৈরি। নতুনত্বের একটা দীপ্তি ঠিকরে বেরুচ্ছে। শ্বেত পাথরের মেঝে যেন কাচের মতন স্বচ্ছ। মার্কিন দেশে আমি অনেক বড় থিয়েটার হল দেখেছি, তবুও আমি এই থিয়েটার হলটি দেখে মুগ্ধ হলুম।
আমরা ভেতরে ঢুকে আসন খুঁজে বসবার সঙ্গে-সঙ্গে অপেরা শুরু হয়ে গেল।
৩
অপেরাটির নাম, অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, 'রাজার নব বধূ'। ষোড়শ শতকের আইভান দা টেরিবল-এর আমলের ঘটনা, একটি বিয়োগান্তক প্রণয় কাহিনি। সারগেই আমাকে সংক্ষেপে বিষয়টি বুঝিয়ে দিল, যদিও অপেরা-তে কাহিনির ভূমিকা যৎসামান্য।
আমি প্রথমেই সবিস্ময়ে লক্ষ করলুম মঞ্চসজ্জা। প্রোসেনিয়ামটি প্রকাণ্ড, ধরা যাক আমাদের রবীন্দ্র সদনের প্রায় আড়াই গুণ, মাঝে মাঝেই প্রায় শ' খানেক অভিনেতা-অভিনেত্রী এক সঙ্গে মঞ্চে থাকছেন, তবু মঞ্চটিকে ভিড়ে ভারাক্রান্ত মনে হচ্ছে না। মঞ্চের ঠিক মাঝখানে একটি মহীরুহ। অসংখ্য ডালপালা ছড়ানো আস্ত একখানা জলজ্যান্ত গাছকে কী করে মঞ্চের ওপরে স্থাপন করা গেল তা ভেবে আমি অবাক হচ্ছিলুম, তারপর খুব নজর করে বুঝলুম, গাছটি সত্যিকারের না, সিনথেটিক, অতি সূক্ষ্ম মাকড়সার জালের মতন তার দিয়ে ডালগুলো ওপর থেকে বাঁধা, তবে তা বোঝা খুবই শক্ত। মঞ্চে এত বড় গাছ আমি আগে কখনও দেখিনি।
মঞ্চের পেছনে বাঁ-দিকে একটা রাস্তা, মনে হয় অনেক দূর থেকে লোকেরা হেঁটে আসছে। মঞ্চের ডেপথ সত্যিই অতখানি না কোনও মায়া সৃষ্টি করা হয়েছে তা আমি ঠিক ধরতে পারলুম না।
আমরা বসেছি সামনের দিকে দামি আসনে। প্রেক্ষাগৃহটি পরিপূর্ণ। মনে হয় যেন পুরুষের চেয়ে মহিলা-দর্শকের সংখ্যা অনেক বেশি। তিন-চারজন করে মহিলা এক সঙ্গে এসে বসেছেন, সঙ্গে কোনও পুরুষ নেই। এমনকী কোনও-কোনও মহিলা একাও এসেছেন বোঝা যায়, কেন না, বিরতির সময়েও কারুর সঙ্গে কোনও কথা বলছেন না। আমাদের পাশেই বসেছেন দুই অসম বয়েসের নারী, ওঁরা এক সঙ্গে এসেছেন, খুব সম্ভবত মাসি-বোনঝির মতন সম্পর্ক। এই ব্যাপারটি একটু অভিনব লাগল, কেন-না, পশ্চিমি দেশগুলিতে দেখেছি, পুরুষ-বন্ধু বা স্বামী ছাড়া মেয়েদের একা-একা সিনেমা-থিয়েটার দেখার প্রথা নেই।
অপেরাটির নট-নটী বা গায়ক-গায়িকাদের নাম আমি জানি না, সারগেই একটা স্মারক পুস্তিকা এনে দিয়েছে বটে, কিন্তু তা সবই রুশ ভাষায় লেখা। তবে সারগেই জানাল, রানির ভূমিকায় যিনি গাইছেন, তিনি খুবই বিখ্যাত এবং এই অপেরাটি খুব জনপ্রিয়, কয়েকশো রাত চলছে।
প্রথম অঙ্কের বিরতির সময় আমি বাইরে গেলুম সিগারেট টানতে। প্যাকেটটি খোলা মাত্র একজন লোক এসে হাত বাড়িয়ে কিছু বললেন। বুঝলুম সিগারেট চাইছেন। আমি ভারতীয় সিগারেট নিয়ে গেছি, সাগ্রহে প্যাকেটটি বাড়িয়ে দিয়ে বললুম, দেখুন, আপনার ভালো লাগে কি না। ভদ্রলোক ইংরিজি জানেন না, তবে সিগারেট ধরিয়ে তিনি তাঁর মাতৃভাষায় যা বললেন, তাতে অনুমান করলুম তার পছন্দ হয়েছে।
দ্বিতীয় অঙ্কের বিরতির সময় সারগেই আমাকে নিয়ে এল দোতলায়। এখানে রয়েছে একটি ছোট রেস্তোরাঁ, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। এখানে পাওয়া যায় কয়েক রকমের স্যান্ডউইচ আর গরম-গরম সসেজ ভাজা, বিয়ার আর ছোট-ছোট ওয়াইনের বোতল। ভাগ্যিস আগেই ডিনার খেয়ে নিইনি, তাই এখন এই হালকা ধরনের সুখাদ্য দিয়ে নৈশভোজ সেরে নেওয়া গেল।
তৃতীয় অঙ্কটি আমি আর তেমন উপভোগ করতে পারলুম না, আমার ঘুম এসে গেল। ক্রেমলিন প্রাসাদের অভ্যন্তরে সুরম্য থিয়েটার হলে বিখ্যাত রুশ অপেরা দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে পড়া খুবই লজ্জার কথা! এরকম সুযোগ ক'জন পায়? কিন্তু ঘুম এসে গেলে আমি কী করব? ভাষা এক বর্ণ বুঝছি না, অপেরার হাই-পিচের গান বেশিক্ষণ উপভোগ করার মতন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের জ্ঞানও আমার নেই। ক'জন সাহেব ভীমসেন যোশীর গান ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনতে পারে? আমি থুতনিতে চিমটি কাটলুম, হাতের লোম টানলুম, বাঁ-হাতের কড়ে আঙুল বেঁকিয়ে ফেললুম, কিছুতেই কিছু হয় না। ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন, এইরকম অবস্থায় ঘুম তাড়ানো কত শক্ত। আশেপাশের লোকরা হয়তো আমাকে দেখছে ঢুলে-ঢুলে পড়তে। শেষ পর্যন্ত মাথা হেলান দিয়ে দু-হাতের তালুতে মুখ অনেকখানি ঢেকে গভীর মনোযোগের ভঙ্গি করে রইলুম। কে জানে নাক ডেকেছিল কি না!
আশ্চর্য ব্যাপার, শো শেষ হওয়ার পর বাইরে আসতেই ঘুম একেবারে হাওয়া।
গাড়িটা আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সারগেই জিগ্যেস করলো, সুনীলজি, হেঁটে যাবেন? এখান থেকে হোটেল খুব দূর নয়।
আমি তক্ষুনি রাজি। হেঁটে না ঘুরলে কোনও শহরই ভালো করে চেনা যায় না। রাত মোটে পৌনে দশটা। টিপি-টিপি বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু শীত খুব বেশি নয়। ওভারকোটের পকেটে দু-হাত ভরে সাহেবি কায়দায় হাঁটতে লাগলুম।
অন্যান্য পশ্চিমি বড় শহরের তুলনায় মস্কোর রাত্তিরের রাস্তার চাকচিক্য, স্বাভাবিক কারণেই, অনেক কম। রাস্তায় আলো যথেষ্ট আছে, কিন্তু প্যারিস-লন্ডন-নিউ ইয়র্কের রাস্তায় যে অসংখ্য দোকানপাট আর বিজ্ঞাপনের রঙিন ঝলমলে আলো, তা এখানে নেই। সোভিয়েত দেশে কোথাও বিজ্ঞাপন নেই, কারণ সমস্ত ব্যাবসাই এদেশে সরকার-পরিচালিত, সুতরাং পণ্যদ্রব্যের ভালো-মন্দ প্রমাণ করার বিজ্ঞাপন-প্রতিযোগিতার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
মিনিট কুড়ির মধ্যেই পৌঁছে গেলুম হোটেলে। দরজার কাছ থেকে সারগেই বিদায় নিল। তাকে যেতে হবে অনেক দূরে।
হোটেলের প্রত্যেক তলায় একজন করে মহিলা বসে থাকেন। হোটেল থেকে আমাকে একটা কার্ড দেওয়া হয়েছে, সেটা জমা দিলে ঘরের চাবি পাওয়া যায়। আমার হাতে চাবিটি তুলে দেওয়ার সময় প্রবীণ মহিলাটি মিষ্টি হেসে কত কী বললেন, হায়, কিছুই বুঝতে পারলুম না। আমি ঘাড় নেড়ে বললুম, পাসিবো, পাসিবো, অর্থাৎ ধন্যবাদ, ধন্যবাদ!
ঘরে এসে জামা-কাপড় ছাড়ার পর বেশ চাঞ্চল্য বোধ করলুম। এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব? মাত্র রাত দশটায় ঘুমোনো আমার পক্ষে অসম্ভব। অপেরা দেখতে-দেখতে যে ঘুম ভর করেছিল, তা একেবারে উপে গেছে! বাইরের আকাশ পুরোপুরি অন্ধকার নয়। এখন আড্ডা মারতে ইচ্ছে করছে। ঘরে একটা টেলিফোন আছে, তারও তো ব্যবহার করা দরকার। দেশ থেকে মণীন্দ্র রায় লিখে দিয়েছেন ননী ভৌমিকের ঠিকানা। কিন্তু ফোন নাম্বার দেননি। নবনীতা দেবসেন তাঁর এক বান্ধবীর জন্য একটি উপহারের পুঁটুলি পাঠিয়ে দিয়েছেন, সঙ্গে আছে সেই বান্ধবীর ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার। বান্ধবীর নাম সায়েলা।
অপারেটরকে প্রথমে জিগ্যেস করলুম, তিনি আমাকে ননী ভৌমিকের ফোন নাম্বার জোগাড় করে দিতে পারেন কি না। তিনি বোধহয় আমার ইংরেজি বুঝতে পারলেন না। তারপর আমি সায়েলার টেলিফোন নাম্বার দিয়ে লাইন ধরে দিতে বললুম।
ওপাশে শোনা গেল একটি পুরুষকণ্ঠ। তিনি বললেন যে সায়েলা এখন একটু ব্যস্ত আছেন, তাঁর সঙ্গে আমার কী দরকার এবং আমি কে?
সায়েলা-কে আমি কখনও চোখে দেখিনি, শুধু এইটুকু জানি, তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা শ্রীপাদ অমৃতপাদ ডাঙ্গে-র কন্যা। আমি পুরুষকণ্ঠটিকে নবনীতা দেবসেন-এর উপহার বিষয়ে জানালুম। তিনি প্রথমে একটুক্ষণ নবনীতা দেবসেন কে তা চিনতে পারলেন না। আমি নানারকম উচ্চারণে নবনীটা, নবওনী-ই-টা এইরকমভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলুম। তাতে বিশেষ কিছু সুবিধে হল না। আমি কালই লেনিনগ্রাড চলে যাব, ফিরব দশদিন বাদে, সুতরাং উপহারটা কাল সকালের মধ্যেই পৌঁছে দিলে আমার পক্ষে সুবিধে হয়। তখন তিনি বললেন যে তাঁর বাড়ি আমার হোটেলের খুবই কাছে, এই রাত্তিরেই তিনি এলে আমার কোনও আপত্তি আছে কি না।
আমি শুনে উৎফুল্ল হলুম। যাক তবু একজনের সঙ্গে গল্প করা যাবে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনি পৌঁছে গেলেন, পুরোদস্তুর সাহেবি কেতায় সজ্জিত একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। তাঁর নাম রাজা আলি। তিনি বললেন যে তাঁর স্ত্রী নবনীতা দেবসেনকে খুব ভালোই চেনেন, তিনিও এখন মনে করতে পেরেছেন, নবনীতা এই তো কিছুদিন আগে মস্কো ঘুরে গেলেন।
পুঁটুলিটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি এদেশে কতদিন আছেন?
তিনি আঠারো...কুড়ি বছর, কী জানি, আই লস্ট কাউন্ট!
কিন্তু রাজা আলির সঙ্গে আমার আড্ডা জমল না। তিনি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, আমিও তেমন তুখোড় কথাবাজ নই। তিনি একবার শুধু জিগ্যেস করলেন, আমি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে চিনি কি না। তারপর চুপ। আমি কোনও প্রশ্ন করলে উনি মনোসিলেবলে উত্তর দেন। কিন্তু আমি তো ওঁর ইন্টারভিউ নিতে আসিনি। তা ছাড়া ডাঙ্গে সাহেবের জামাই-কে ঠিক কী কী প্রশ্ন করা যায়, তাও মনে এল না। সুতরাং উনি নিঃশব্দে বসে পাইপ টানতে লাগলেন, আমি টেবিলের কাচটি দেখতে লাগলুম গভীর মনোযোগ দিয়ে।
এক সময় উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা, এবার আমি চলি।
আমি বললুম, শুভ রাত্রি।
হোটেলের অত কাছে ওঁদের বাড়ি অথচ আমাকে একবার চা খাওয়ারও নেমন্তন্ন করলেন না। এটা একটু অস্বাভাবিক, সাধারণত সবাই বলেন। অবশ্য রাজা আলি কুড়ি বছর ধরে মস্কোতে কী করেন তাও আমার জানা হয়নি।
তারপর বিছানায় শুয়েও আর ঘুম আসে না। আলো নিভিয়ে ছটফট করতে লাগলুম। ঘুম না-আসার একটা কারণ হল বালিশ। এমন পেল্লায় বালিশ আমি জীবনে দেখিনি। আমাদের সাধারণ ব্যবহার্য বালিশ তিনখানা জোড়া দিলে যা হয়। যেমন মোটা, তেমনি চওড়া। এ শুধু মাথায় দেওয়ার বালিশ নয়, কাঁধ পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। বালিশ বাদ দিয়ে শুলেও ফাঁকাফাঁকা লাগে। চোখ মেলে রেখে অনুভব করতে লাগলুম, পৃথিবীর ঘূর্ণন, রাত্রি গড়িয়ে যাচ্ছে গভীরতর রাত্তিরের দিকে।
শেষ রাতে নিশ্চয়ই ঘুম এসেছিল, তবু জেগে উঠলুম বেশ সকাল সকাল। উঠেই চায়ের অভাব বোধ করলুম। আমরা সবাই অভ্যেসের দাস, ঘুম থেকে উঠেই এক কাপ চা না পেলে সারাদিনের জীবনযাত্রা শুরু করতে পারি না। চা পাব কোথায়? আমার কাছে এক কোপেকও নেই। যখন যা দরকার তা সারগেই কিনে দিচ্ছে। এ দেশের হোটেলে রুম সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে কি না জানি না। নিজের ইচ্ছে মতন হোটেল থেকে কিছু কিনে তারপর বিলে সই করার অধিকার আমার আছে কি না তা-ই বা কে জানে!
সেরকম স্মার্ট লোক হলে নিশ্চয়ই হোটেলের রিসেপশানে ফোন করে একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলত। কিন্তু আমি এসব ব্যাপারে একেবারেই তৎপর নই। মুখটুখ ধুয়ে একখানা বই হাতে করে সারগেই-এর প্রতীক্ষা করতে লাগলুম।
ন'টা আন্দাজ দরজায় করাঘাত। দরজা খুলেই দেখি তিন বঙ্গীয় যুবক-যুবতী। এদের মধ্যে একজন আমার সেই বিমানযাত্রার সঙ্গী সুবোধ রায়, অন্য দুজনের নাম সুজিত বসু ও সঙ্ঘমিত্রা দাশগুপ্ত। আমি একলা রয়েছি বলে ওরা সঙ্গ দিতে এসেছে।
সুবোধ জিগ্যেস করল, আপনার ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়েছে?
আমি বললুম, ব্রেকফাস্টের জন্য ব্যস্ততা নেই, তবে এক কাপ চা জোগাড় করতে পারলে মন্দ হত না।
সুবোধ শুধু যে খুব বিদ্বান তাই-ই নয়, তার ব্যবহারও খুব ব্যক্তিত্বপূর্ণ। সে বলল, শুধু চা কেন, এই ঘরে বসেই আমরা ব্রেকফাস্ট খাব, আমরাও খেয়ে আসিনি। হাঁকডাক দিয়ে তক্ষুনি সেসব ব্যবস্থা করে ফেলল। এক গাদা হ্যামবার্গার ও স্যান্ডউইচ এবং চায়ের অর্ডার দেওয়ার পর দ্বিতীয় চিন্তায় সে আবার বলল, আপনি রাশিয়ান শ্যাম্পেন খাননি তো? এক বোতল শ্যাম্পেনেরও অর্ডার দেওয়া যাক।
সকাল বেলাতে শ্যাম্পেন? আমি ক্ষীণ আপত্তি জানালেও সুবোধ পাত্তাই দিল না।
সুজিত বসু কবিতা লেখে এবং ফিজিকসে পি-এইচ ডি করছে। সঙ্ঘমিত্রাও পি-এইচ ডি করছে সাইকোলজিতে, সাহিত্য খুব ভালোবাসে। লাজুকতা ভাঙতে একটু সময় লাগল। তারপরেই আড্ডা জমে গেল।
শ্যাম্পেনের বোতল খোলার কায়দাটা রপ্ত করতে হয়। আনাড়ি হাতে ছুটন্ত ছিপি জানলার কাচ ভাঙতে পারে, কারুর চোখেটোখে লাগলে গুরুতর ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। সুতরাং শ্যাম্পেনের বোতল খোলার সম্মান ওরা আমাকে দিতে চাইলেও আমি তা প্রত্যাখ্যান করলুম। সুবোধ নিজেই খুলল খুব সাবলীলভাবে। সকালবেলা চা-পানের আগেই সুরার গেলাসে চুমুক দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম।
আমাদের খাওয়াদাওয়ার মধ্য পথে সারগেই এসে হাজির। আমি তখনই বাইরে বেরুবার পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে নেই দেখে সারগেই বেশ ব্যস্তভাবে বলল, এ কী! আপনি এখনও তৈরি হননি? আমাদের যে সাড়ে দশটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে!
সুবোধ আড্ডার মেজাজে বলল, বসুন, বসুন, সাড়ে দশটার এখন অনেক দেরি।
সুবোধ, সুজিত, সঙ্ঘমিত্রা তিনজনই রুশ ভাষা বেশ ভালো জানে। আমাদের ক্রেমলিন যেতে হবে শুনে ওরা বলল, সে তো গাড়িতে মাত্র আট-দশ মিনিটের রাস্তা। মস্কোতে ট্রাফিক জ্যাম প্রায় হয় না বললেই চলে, সুতরাং ব্যস্ত হওয়ার কী আছে?
সারগেই তবু ছটফট করতে লাগল। অতএব আমি তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে নিয়ে কোট-প্যান্টালুন পরে নিলুম। সারগেই-এর আপত্তি সত্বেও খাদ্য-পানীয়র সব দাম মিটিয়ে দিল সুবোধ। লেনিনগ্রাড থেকে ফিরে ওদের সঙ্গে আবার দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়ে পড়লুম আমরা দুজনে।
আজ অন্য গাড়ি, যিনি চালাচ্ছেন, তাঁর ফরসা, গোলগাল হাসি-খুশি চেহারা, অনেকটা অভিনেতা পিটার উস্তিনভের মতন। সারগেই এঁর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল, ইনি এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না, করমর্দনের পর আমাকে একটি রুশ সিগারেট দিলেন, বিনিময়ে আমিও উপহার দিলুম এক প্যাকেট ভারতীয় সিগারেট।
গাড়ি চলতে শুরু করার পর সারগেই আমাকে জিগ্যেস করল, সুনীলজি, কাল রাত্তিরে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
আমি মজা করার জন্য বললুম, কাল রাত্তিরে আমার ঘরে একজন অতিথি এসেছিল।
সারগেই রীতিমতন চমকে গেল। জিগ্যেস করল, অতিথি এসেছিল, আপনার হোটেলের ঘরে? কী করে এল?
আমি বললুম, সম্ভবত হেঁটেই এসেছিল।
—আপনার চেনা কেউ?
—না। জীবনে আগে কখনও দেখিনি।
—সে কি? কে এসেছিল? কেন এসেছিল?
তখন আমি হাসতে-হাসতে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলুম। ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা এস এ ডাঙ্গের নাম সারগেই শুনেছে।
আমরা আজ ক্রেমলিনের প্রধান প্রবেশ পথের বাইরে একটা শিকল-ঘেরা জায়গায় এসে দাঁড়ালুম। এখানে খুব কড়া সিকিউরিটি ব্যবস্থা। এর ভেতরেই সোভিয়েত সরকারি দফতর। এখানে দাঁড়িয়েই ১৯১৮ সালের ১২ মার্চ লেনিন মস্কোকে বিশ্বের প্রথম শ্রমিক-কৃষক রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
ঠিক সাড়ে দশটায় ভেতর থেকে দুজন লোক বেরিয়ে এসে আঙুলের ইশারায় আমাদের ডাকল। সারগেই বলল, দেখলেন তো, সুনীলজি, ঠিক ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে সাড়ে দশটায় আমাদের ডাকা হল। এক মিনিট দেরি হলে ওঁরা ফিরে যেতেন, আমাদের আর ঢোকা হত না। সেই জন্যই আমি আপনাকে তাড়া দিচ্ছিলুম।
সিকিউরিটির দুই ব্যক্তি আমাদের নিয়ে চলল ভেতরে। আমরা যাচ্ছি লেনিনের বাসভবন দেখতে। বিপ্লবের আগে দুশো বছর অবশ্য মস্কো রাশিয়ার রাজধানী ছিল না, তাহলেও ক্রেমলিনের প্রাসাদই ছিল চিরকাল রাজ-ক্ষমতার প্রতীক। এই প্রাসাদের একটি অংশে লেনিন তাঁর এক বোন ও স্ত্রী স্ক্রুপকায়াকে নিয়ে থাকতেন।
লেনিনের জীবনযাত্রা ছিল সাদামাটা। তাঁর ব্যবহৃত থালা-বাসন, পোশাক-পরিচ্ছদ, চেয়ার-টেবিল সবই অবিকল রাখা আছে। রয়েছে লেনিনের পুস্তক-সংগ্রহ। রান্নাঘর ও শয়নকক্ষ ছাড়া বসবার ঘর তিনখানি। লেনিনের লেখার টেবিলের ওপর রয়েছে একটি মূর্তি, এটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। ডারউইন সাহেবের ইভোলিউশান তত্ব বিষয়ক বইয়ের ওপর বসে অছে একটি বাঁদর, তাঁর হাতে একটি মানুষের মাথার খুলি, বাঁদরটি খুব চিন্তিতভাবে সেদিকে চেয়ে আছে।
লেনিনের বাসস্থানে ঘুরতে-ঘুরতে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক এইচ জি ওয়েলস এইখানে এসেছিলেন লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে। লেনিন তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে যুদ্ধবিধ্বস্ত সোভিয়েত দেশের দ্রুত উন্নতি ঘটাবার একমাত্র উপায় সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। Goelro নামে যে বিদ্যুৎ পরিকল্পনা হয়েছিল তার লক্ষ্য ছিল বিদ্যুতের উৎপাদন আগামী দশ বছরের মধ্যে দশ গুণ বাড়িয়ে ফেলা, বড়-বড় নদীগুলোর ওপর নতুন তিরিশটি পাওয়ার স্টেশন স্থাপন করা।
লেনিনের এই পরিকল্পনাকে এইচ জি ওয়েলসের মনে হয়েছিল অসম্ভব; তিনি লেনিনকে আখ্যা দিয়েছিলেন, ''দা ড্রিমার ইন দা ক্রেমলিন''। লেনিনের স্বপ্ন কিন্তু সফল হয়েছিল। বলশয় থিয়েটারে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ''কমিউনিজম ইজ সোভিয়েট পাওয়ার প্লাস দা ইলেকট্রিফিকেশন অফ দা হোল কান্ট্রি।'' হায়, আমাদের পশ্চিমবাংলা তথা ভারতবর্ষে বিদ্যুতের কী অবস্থা! উৎপাদন বৃদ্ধির বদলে ক্রমশই আরও কমে যাচ্ছে।
ক্রেমলিন প্রাসাদের এই অংশে যখন লেনিন বাস করতে আসেন, তখনই তার স্বাস্থ্য ভালো নয়। ১৯১৮ সালে তাকে মেরে ফেলার একটা চেষ্টা হয়েছিল, সেই আঘাত পুরোপুরি সারেনি। তাই নিয়েই তিনি নতুন রাষ্ট্র গড়ার প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন, তার ফলে বিপ্লবের পর ছ'বছরের মধ্যেই তিনি মারা যান।
ক্রেমলিন থেকে বেরিয়ে আমরা গেলুম মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছুটি, তাই ভেতরে যাওয়া হল না। গাড়িতে চার দিকটা একটা চক্কর দিয়ে এলুম। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবনটি বিশাল ও সুদৃশ্য, আধুনিক স্থাপত্যের একটা উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যেসব রাস্তা, তাতে রয়েছে সার-সার আপেল গাছ, এখন ছোট-ছোট আপেল ফলে আছে। আমাদের স্কুল-কলেজগুলোর পাশে অন্তত পেয়ারা গাছ লাগাবার কথাও কেউ চিন্তা করে না কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাটি সুবিশাল। সামনে মস্ত বড় চত্বর। তার পরে মস্কোভা নদী। অনেকগুলি টুরিস্ট বাস এসেছে, অর্থাৎ মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ও রীতিমতন একটি দ্রষ্টব্য ব্যাপার।
আমরা নদীর ধারে এসে দাঁড়ালুম। এই জায়গাটি বেশ উঁচু, এখান থেকে মস্কো শহর অনেকখানি দেখা যায়। নদীর পার ঢালু হয়ে অনেকখানি নেমে গেছে, মাঝে-মাঝে বেশ জঙ্গলের মতন। স্বাস্থ্য-উন্নতিকামীরা অনেকে সেখানে গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া পরে দৌড়চ্ছে। কয়েক জোড়া নব-বিবাহিত দম্পতিকে দেখলুম, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আবহাওয়া ভালো বলে বোধহয় এখন বিয়ের ধূম পড়ে গেছে। বরযাত্রীরা এখানে সঙ্গে করে এনেছে শ্যাম্পেনের বোতল, গেলাস ছাড়াই সবাই বোতল থেকে চুমুক দিচ্ছে। এরই মধ্যে দু-এক জনের অবস্থা বেশ টলটলায়মান মতন মনে হল।
নদীর ধার দিয়ে হাঁটলুম খানিকক্ষণ। এক সময়ে চোখে পড়ল একটি ছোট, পরিত্যক্ত গির্জা। গেটে তালা বন্ধ, বোঝা যায়, বহুদিন অব্যবহৃত।
আরও একটু বেড়াবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময় নেই। লেনিনগ্রাডের প্লেন ধরতে হবে।
হোটেলে ফিরে এসে আমরা লাঞ্চ সেরে নিলুম। সারগেই নিজে ইউক্রাইনের ছেলে। ও বলল, সুনীলজি, আপনি ইউক্রাইনিয়ান বর্স খেয়েছেন? খেয়ে দেখবেন?
আমি সবরকম খাবারই চেখে দেখতে রাজি। বেশ একখানা বড় জামবাটি ভরতি সুপ এল, তার মধ্যে নানারকম মাংসের টুকরো ও সবজি। এইরকম একটু সুপ খেলেই পেট ভরে যায়।
খাওয়া সেরেই সুটকেস নিয়ে ছুট দিলুম এয়ারপোর্টের দিকে। এটা ইন্টারনাল এয়ারপোর্ট। ছুটির মরশুম বলে প্রচণ্ড ভিড়। মস্কো ছেড়ে অনেকেই এখন বেড়াতে যাচ্ছে। সারগেই এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আমাকে ভি আই পি লাউঞ্জে নিয়ে গিয়ে বসাল। সেখানে মাত্র আমরা দুজন। এরকম জায়গায় বসতে কীরকম অস্বস্তি লাগে!
আরও খাতির করে আমাদের দুজনকেই প্রথমে তোলা হল বিমানে। আমার সুটকেসটা বুক না করিয়ে রেখে দেওয়া হল এয়ার হোস্টেসদের হেপাজতে, যাতে পৌঁছবার পর মাল খালাসের জন্য অপেক্ষা করতে না হয়। সিকিউরিটি চেকের সময় একটা বেশ মজা হল। পৃথিবীর সব বিমান বন্দরেই আজকাল এই ব্যবস্থা আছে। একটা মেটাল ডেটেকটার যন্ত্র সারা গায়ে বুলোয় অথবা একটা জায়গা পার হয়ে যেতে হয়, সন্দেহজনক কিছু থাকলে প্যাঁক-প্যাঁক শব্দ হতে থাকে। একজন মহিলা এখানে সিকিউরিটি চেক করছেন। আমার গায়ে যন্ত্রটা ছোঁয়াতেই প্যাঁক-প্যাঁক শব্দ করে উঠল। পকেটে খুচরো পয়সা কিংবা কোমরের বেল্টের মুখটার জন্যও অনেক সময় এই শব্দ হয়। আমার পকেটে পয়সা নেই, বেল্টটা খুলে ফেললুম, তবু যন্ত্রটা ছোঁয়াতেই আবার সেই শব্দ। আমি গায়ের কোটটা খুলে ফেললুম, তবুও শব্দ থামে না। এবারে মহিলাটি হাত দিয়ে আমার গা টিপেটুপে দেখলেন, সন্দেহজনক কিছু নেই। তবে কি যন্ত্রটা খারাপ হয়ে গেল? তিনি নিজের গায়ে যন্ত্রটা বোলালেন, কোনও শব্দ নেই, সারগেই-এর শরীরে বোলালেন, তখনও নিঃশব্দ। কিন্তু আমার গায়ে ছোঁয়াতেই আবার বেশ জোরে প্যাঁক-প্যাঁক করে ডাকতে লাগল।
একে কী বলা যায়, যন্ত্রের কৌতুক ছাড়া?
৪
মস্কো থেকে লেনিনগ্রাড দু-ঘণ্টার বিমান পথ। ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে এসে দেখলুম লবিতে প্রচণ্ড ভিড়, নানারকম ভাষায় কলস্বর। আমাদের জন্য দুটি ঘর অবশ্য আগে থেকেই বুক করা ছিল, ভিড় ঠেলে কাউন্টারে পৌঁছতেই ব্যবস্থা হয়ে গেল।
বিখ্যাত নেভা নদীর ধারেই এই হোটেল লেনিনগ্রাড। খুবই বড় হোটেল এবং অত্যাধুনিক কায়দার। অর্থাৎ সবকিছুই চৌকো কিংবা রেকটানগুলার। গত শতাব্দী পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় সব দেশেরই স্থাপত্যে গম্বুজ, খিলান, গোল গোল থাম দেখা যেত, আধুনিক স্থাপত্যে এসবের কোনও স্থান নেই। মস্কোর হোটেলটিতে তবু খানিকটা পুরোনো-পুরোনো ভাব ছিল, কিছু এই হোটেলটি একেবারে ঝকঝকে সাম্প্রতিক ধরনের। এখানকার লিফটগুলি স্বয়ংক্রিয়।
আট তলার ওপর সারগেই আর আমি পাশাপাশি দুটো ঘর পেয়েছি। সামনের জানলাটার পরদা সরাতেই অপূর্ব দৃশ্য। নেভা নদীর দু-পাশে সুন্দর গড়নের সব প্রাসাদের সারি। দূরে-দূরে দেখা যায় গির্জার চূড়া। নেভা নদী বেশ প্রশস্ত, অনায়াসেই জাহাজ যেতে পারে। এখান থেকে সমুদ্র বেশি দূরে নয়।
নিজের ঘরে জিনিসপত্র রেখে এসে সারগেই আমাকে জিগ্যেস করল, সুনীলজি, ক্লান্ত?
মাত্র দু-ঘণ্টা প্লেন জার্নিতে ক্লান্ত হব কেন? তা ছাড়া শীতের দেশে এমনিতেই ক্লান্তি বোধ কম হয়।
আমি বললুম, না, না, চলো, বেরুবে নাকি?
সারগেই বলল, আমি লেনিনগ্রাডে আগে আসিনি। চলুন, খানিকটা হেঁটে শহরটাকে অনুভব করে আসি।
পোশাক না বদলেই বেরিয়ে পড়লুম। হোটেলের গেটের সামনে ভিড় আরও বেড়েছে। অনেকেই বোধহয় জায়গা পায়নি। আগামীকাল মে-দিবসের মিছিল দেখবার জন্যই বাইরে থেকে বহু টুরিস্ট আসছে।
নেভা নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে একটা ছোট ব্রিজ পেরিয়ে এলুম। এই শহরের মধ্যে দিয়ে অনেকগুলি খাল এসে নেভা নদীতে পড়েছে। আমাদের হোটেলটি সেরকম একটি মোহানার কাছেই। বিশাল বিশাল বারোক স্টাইলের অট্টালিকা দেখলেই বোঝা যায়, এগুলি জার-এর আমলে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়ি ছিল, এখন বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়।
লেনিনগ্রাডের ইতিহাস আমরা সবাই কিছু-কিছু জানি। এই শহরের বয়েস কলকাতার চেয়েও কিছু কম। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পিটার দা গ্রেট এখানে এই বন্দর-শহরটির পত্তন করে রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। তখন এর নাম ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ। সুপরিকল্পিতভাবে অভিজাতদের জন্যই গড়া হয়েছিল নগরীটি। ডেকে আনা হয়েছিল ইউরোপের বিখ্যাত স্থপতিদের। চওড়া চওড়া রাস্তা, বড়-বড় পার্ক ঘিরে জমকালো সব বাড়ি। মাঝে-মাঝে খাল কেটে জলপথেরও ব্যবস্থা। এই শহরের পথে-পথে ঘুরে বেড়ালে চোখের আরাম হয়।
প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় এই শহরটির নাম পালটে যায়। সেন্ট পিটার্সবার্গের বার্গ অংশটুকু জার্মান ভাষা, তার মানে দুর্গ। সুতরাং এ শহরের নতুন নাম হল পেট্রোগ্রাড। বিপ্লবের প্রধান কেন্দ্রও ছিল এই শহর। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য পেট্রোগ্রাড নাম আবার বদল করা হয়।
হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে, শীত বেশি নেই। এইসব শীতের দেশে সন্ধ্যাগুলো খুব লম্বা হয়। এখন সাড়ে সাতটা বাজে, কলকাতায় এখন রীতিমতন অন্ধকার, লোডশেডিং হলে তো কথাই নেই, আর এখানে বেশ পরিষ্কার আলো। এইরকমই চলবে প্রায় ন'টা পর্যন্ত।
মোহানার মুখে একটা থেমে-থাকা জাহাজ দেখিয়ে সারগেই জিগ্যেস করল, সুনীলজি, এই জাহাজটার কথা জানেন? এই হচ্ছে বিখ্যাত অরোরা।
আমি ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের কথা জানি, অরোরার নাম আগে শুনিনি।
সারগেই জানাল যে, এই অরোরা থেকেই বিপ্লবের সংকেত দিয়ে প্রথম তোপধ্বনি হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সব স্কুলের ছেলে-মেয়েরাও এর নাম জানে। এখন জাহাজটিকে একটি মিউজিয়াম হিসেবে এখানে রাখা হয়েছে। যে-কেউ ভেতরে ঢুকে দেখতে পারে। তবে পাঁচটার মধ্যে আসতে হবে।
আমি সারগেইকে সামনে দাঁড় করিয়ে অরোরার একটি ছবি তুললুম। তারপর আর একটু বেড়িয়ে ফিরে এলুম হোটেলে। সারগেইকে এখন কিছু ফোনটোন করতে হবে। এখানকার এ পি এন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা, কাল সকালে মে-দিবস প্যারেড দেখতে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ঠিক করা ইত্যাদির ব্যবস্থা করবার জন্য সে চলে গেল। আমি জানলার কাছে চেয়ার টেনে বসে রইলুম চুপচাপ। নদীতীরের বাড়িগুলিতে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে আলোকসজ্জা।
হঠাৎ এক সময় আমার শরীরে রোমাঞ্চ হল। এই সেই সেন্ট পিটাসবার্গ, এখানকার রাস্তা দিয়ে ডস্টয়েভস্কি হেঁটেছেন! নিকোলাই গোগোল এখানে ইতিহাসের মাস্টারি করতে-করতে একদিন বুঝেছিলেন, সাহিত্যই তাঁর মুক্তির পথ; পুশকিন লিখেছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস, একটি নিগ্রোকে নিয়ে। সাহিত্য জগতের বিশাল বিশাল বনস্পতিদের স্মৃতিজড়িত সেই শহরে আমি বসে আছি?
অনেকক্ষণ বসে রইলুম জানলার ধারে। যেন একটা ঘোরের মধ্যে। খানিকবাদে ফিরে এল সারগেই। কাঁচুমাচু মুখে জানাল, ট্যাক্সি জোগাড় করা গেল না কিছুতেই। কাল মে ডে'র প্যারেডের জন্য অনেক রাস্তাতেই ট্রাফিক বন্ধ থাকবে, কোনও ট্যাক্সিই উইনটার প্যালেসে পৌঁছতে পারবে না। সুনীলজি, আপনি হেঁটে যেতে পারবেন তো?
সারগেই-এর মুখে সুনীলজি ডাক শুনে প্রত্যেকবারই আমার মজা লাগে। বাঙালিদের মধ্যে জি ব্যবহার করার রেওয়াজ নেই। উত্তর ভারত ও পশ্চিম ভারতে ওই ডাক চলে। আমি অবশ্য সারগেইকে নিরস্ত করি না। ওর মুখে ওই ডাক বেশ মিষ্টি লাগে, আমার এক মহারাষ্ট্রীয় বন্ধুর কথা মনে পড়ে।
হোটেল লেনিনগ্রাডের বিভিন্ন তলায় টুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য নানা ধরনের রেস্তোরাঁ আছে। তার মধ্যে দু-একটিতে গান-বাজনা, নাচেরও ব্যবস্থা রয়েছে, আমরা ঘুরে ঘুরে সব ক'টি দেখে নিয়ে মাঝারি ধরনের একটিতে নৈশভোজ সেরে নিলুম।
আমার দরজার কাছে এসে যখন শুভরাত্রি বলে বিদায় নিতে গেল সারগেই, আমি ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললুম, আমায় কিছু পয়সা দেবে?
সারগেই অবাক।
আমি হাসতে-হাসতে বললুম, সকালবেলা তোমার আগেই যদি আমার ঘুম ভাঙে তাহলে আমি এক কাপ চা কিনে খেতে চাই!
সারগেই ব্যস্ত হয়ে বললেন, আপনার যখনই দরকার হবে আমাকে ডাকবেন। এমনকী মাঝরাত্তিরেও দরকার হলে ডাকবেন বিনাদ্বিধায়।
তবু আমি নাছোড়বান্দার মতন ওর কাছ থেকে এক রুবল আদায় করলুম।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমার সহজে ঘুম এল না। কাল রাতে মস্কো ছিল নতুন জায়গা, আজ আবার নতুন জায়গায় এসেছি. বিছানার সঙ্গে দু-এক রাত্তির ভাব না জমলে ভালো ঘুম হয় না। আমার এই ঘরটি ডাবল বেড। ঘরের দুপাশে দুটি বিছানা পাতা। আমি একবার এক বিছানায় আর একবার অন্য বিছানায় শুতে লাগলুম। যেন আমি একাই দুজন মানুষ।
কাচের জানালায় পরদা টানিনি বলে ভোরের প্রথম আলো চোখে পড়ামাত্র ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে অবশ্য খুব ভোর নয়, পৌনে আটটা বাজে, কিন্তু বাইরে আবছা আবছা অন্ধকার রয়েছে এখনও। পাজামা-পাঞ্জাবি আর চটি পরেই বেরিয়ে এলুম ঘরের বাইরে। আমাদের ফ্লোরের এক প্রান্তে একটি ছোট রেস্তোরাঁ আগেই দেখে রেখেছিলুম, সেখানে এসে দেখলুম, সেটি সদ্য খুলেছে, একজন বৃদ্ধা বসে আছেন কাউন্টারে। আমিই প্রথম খদ্দের।
বৃদ্ধা মহিলা হেসে রাশিয়ান ভাষায় আমায় সুপ্রভাত জানালেন, আমি জানালুম ইংরেজিতে। প্রথমে এক কাপ চা নিলুম, তার স্বাদ আমার মনঃপূত হল না, তারপর এক কাপ কফি নিয়ে স্বাদটা বেশ ভালো লাগল।
ফিরে এসে দিনের প্রথম সিগারেটটি উপভোগ করার পর বেজে উঠল টেলিফোন। সারগেই বলল, সুনীলজি, এবার বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ুন, আমাদের সাড়ে আটটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে। ব্রেকফাস্ট বাইরে কোথাও খেয়ে নেব।
আমি বললুম, আমি তো তৈরি!
আজ আকাশ সামান্য মেঘলা। গরম জলে স্নান সেরে নেওয়ার ফলে শরীরটা বেশ তরতাজা লাগছে। এখন আমি পাঁচ-দশ মাইল অনায়াসে হেঁটে যেতে পারি।
নেভা নদী পার হওয়ার সময় ব্রিজের মাঝখানে একবার দাঁড়ালুম। যে-কোনও নতুন নদী প্রথমবার পার হওয়ার সময় বেশ কিছুক্ষণ নদীর সৌন্দর্য না দেখে আমার যেতে ইচ্ছে করে না। তাড়াহুড়ো করে, অন্যমনস্কভাবে কোনও নদী পার হওয়া উচিত নয়। সমস্ত জলেরই চরিত্র আলাদা।
আমরা ছেলেবেলায় ভূগোলে পড়েছিলুম যে এই নেভা নদীর জল বছরে চার-পাঁচ মাস জমাট বরফ হয়ে থাকে। নদীর মোহানাতেও এত বরফ জমে যে জাহাজ ঢুকতে পারে না। এখন কিন্তু জলের প্রবাহ বেশ স্বাস্থ্যবান।
সারগেই জিগ্যেস করল, আপনি জলের দিকে তাকিয়ে কী দেখছেন?
আমি বললুম, কিছুই না। এমনিই, জল দেখতে আমার ভালো লাগে।
সারগেই বললেন, নদীর স্রোতের সঙ্গে মানুষের জীবনের একটা মিল আছে, না? দুটোই বয়ে চলেছে, আমরা শুধু ওপরের দিকটা দেখতে পাই, গভীরতা চোখে পড়ে না—
আমি হাসলুম। আমার অবশ্য এরকম কোনও কথা মনে পড়ে না। সারগেই এখনও ছেলেমানুষ, ও বোধহয় সবকিছুই উপমা দিয়ে দেখতে ভালোবাসে।
ব্রিজ পার হওয়ার পর বড় একটা স্কোয়ার। রাস্তা চলে গেছে নানা দিকে। সারগেই নিজের রাস্তা চেনে না। পুলিশদের জিগ্যেস করে করে এগুতে লাগলুম। ক্রমেই দেখা গেল, রাস্তার দু-পাশে বহু গাড়ি থেমে আছে, কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝখানে বড় বড় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ট্রাফিক চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দলে দলে মিলিশিয়া পাহারা দিচ্ছে সেখানে। আমরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে এক একটা বাধা পার হতে লাগলুম।
মস্কোয় যেমন ক্রেমলিন, লেনিনগ্রাডে প্রায় সেই রকমই হচ্ছে উইন্টার প্যালেস। এক সময় আমরা সেখানে পৌঁছে গেলুম। একটি বিশাল চত্বরের চার পাশ ঘিরেই সুরম্য সব প্রাসাদ। এইখান থেকেই মে দিবসের শোভাযাত্রা শুরু হবে। একদিকে কাঠের গ্যালারি করা আছে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। ঠিক দশটার সময় উৎসব শুরু হবে, গ্যালারির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বহু মানুষ। দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে অনেক ছোট ছোট দোকান। কফি, চা, ঠান্ডা পানীয়, স্যান্ডউইচ, সসেজ, আলুর চপ, ডোনাট ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। এইসব টুকিটাকি খাবার খেয়ে আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিলুম। হঠাৎ টিপি টিপি বৃষ্টি হতেই শীত বেড়ে গেল। শীত তাড়াবার জন্য কফি খেতে লাগলুম ঘন-ঘন।
একটা জিনিস লক্ষ করলুম, সমবেত দর্শকদের মধ্যে প্রায় সবাই বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা, সঙ্গে বাচ্চা বা কিশোর-কিশোরীরাও আছে, কিন্তু যুবক-যুবতী একজনও নেই। একটু পরেই এর কারণ বুঝেছিলুম।
গ্যালারিতে ভিড় হয়ে যাচ্ছে দেখে আমরা আমাদের আমন্ত্রণপত্র দেখিয়ে নির্দিষ্ট গেট দিয়ে ঢুকে এলুম ভেতরে। যে অংশটায় আমাদের আসন, সেখানে সবাই মনে হল বিদেশি। অনেকেরই হাতে টিভি ক্যামেরা, মুভি ক্যামেরা। পৃথিবীর বহুদেশের মানুষ রয়েছে, কিন্তু ভারতীয় আর একজনও চোখে পড়ল না।
মাঝে এক পশলা বেশ জোর বৃষ্টি হয়ে গেল। আমি ওভারকোট এনেছি বটে, কিন্তু মাথার টুপি কিংবা দস্তানা আনিনি। এত ঠান্ডা লাগছে যে কোটের পকেট থেকে হাত বার করতে পারছি না। অন্য সকলেরই গলায় টাই বা স্কার্ফ জড়ানো। ১৯৬৩ সালে মার্কিন দেশের একটি ছোট শহরে আমি গলা থেকে টাই খুলে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, জীবনে আর কখনও টাই পরব না। এখন মনে হল, একটা অন্তত মাফলার আনলে মন্দ হত না!
ঠিক দশটার সময় দেখা গেল ময়দানের এক প্রান্ত দিয়ে একটি শোভাযাত্রা ঢুকছে। তাদের হাতে নানারকম পতাকা ও ছবি। কয়েক মিনিটের মধ্যে চত্বরটি পূর্ণ হয়ে গেল। শোনা গেল অনেক ধরনের যন্ত্র-সঙ্গীত। চতুর্দিক থেকে মাইক্রোফোনে ধ্বনি উঠল, রুশ ভাষায়, শ্রমিক ও কৃষক ঐক্য, হু-র-রা! অমনি সমবেত কণ্ঠ বলে উঠল, হু-র-রা!
তারপর শোভাযাত্রার স্রোত বইতেই লাগল। অতি সুন্দর বর্ণময় দৃশ্য! প্রথম দিকে এল সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান-বাহিনীর প্রতিনিধিরা, তারপর নানারকম কল-কারখানার কর্মী, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক, বুদ্ধিজীবী। এরা প্রায় সবাই তরুণ-তরুণী। প্রান্তর পূর্ণ হয়ে গেলে একদল গান গাইতে-গাইতে বেরিয়ে যাচ্ছে, বিপরীত দিক থেকে ঢেউ-এর পর ঢেউ আসছে। মাইক্রোফোনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করে বলা হচ্ছে হু-র-রা!
মে-দিবসের মিছিল সম্পর্কে আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। আমি ভেবেছিলুম এখানে কামান-বন্দুক-মিসাইলেরও প্রদর্শনী হয়। সেসব কিছু না! সকলে একরকম পোশাক পরেও আসেনি, সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা ছাড়া। এখানে এসেছে সবাই ছুটির উৎসবের মেজাজে, পোশাকেও নানারকম বৈচিত্র্য। অনেকেই বেশ সাজগোজ করে এসেছে।
যৌবনের এই আনন্দময় দৃশ্যের তুলনা হয় না। এই মিছিলে কোনও ধরাবাঁধা নিয়মের কড়াকড়ি নেই। হাস্যময় তরুণ-তরুণীরা গান গাইতে-গাইতে আসছে, জয়ধ্বনি দিচ্ছে, আবার চলে যাচ্ছে। এই যৌবন জলতরঙ্গের যেন শেষ নেই।
শীতের মধ্যে টানা দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম। আরও কতক্ষণ চলবে কে জানে!
সারগেই একসময় জিগ্যেস করল, সুনীলজি, এবারে যাবেন, না আরও দেখবেন?
শেষ হওয়ার আগেই চলে যাওয়া উচিত কি না আমি মনে-মনে ভাবছিলুম। সারগেই-র প্রশ্ন শুনে বললুম, এবারে গেলে মন্দ হয় না।
গ্যালারি থেকে নেমে আমরা চলে এলুম রাস্তায়। এখান দিয়েও মিছিল চলছে। একই মিছিল ভেদ করে অন্যদিকে যাওয়ার উপায় নেই, তা সঙ্গতও নয়। একমাত্র উপায় এই মিছিল যোগ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া। তাই করলুম।
ছাত্রজীবনে আমি কলকাতায় কয়েকবার মে-দিবসের মিছিলে যোগ দিয়েছিলুম বটে, কিন্তু কোনওদিন কি স্বপ্নেও ভেবেছি যে একদিন রাশিয়ায় মে-দিবসের মিছিলে আমি অংশগ্রহণ করব? এ এক বিচিত্র অনুভূতি! কেউ আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে না, দু-একটা বাচ্চা ছেলে ছাড়া।
সেই মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে চলে এলুম নেভা নদী পর্যন্ত। এবারে দেখলুম, এক একটা দল মিছিল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে যার যার বাড়ির দিকে। সুতরাং আমরাও যেতে পারি।
আমাদের পাশে পাশে একটা ছোট দল যেতে লাগল নানারকম গান গাইতে-গাইতে ও হাসাহাসি করতে-করতে। গানের সুর শুনে মনে হয় কোনও পল্লিগীতি। মনে হয় খুব চেনা।
দুপুরে খেয়েদেয়ে একখানা ঘুম দেওয়ার জন্য খুব মন কেমন করছিল। কিন্তু তার উপায় নেই। তিনটের সময়েই আর একটা প্রোগ্রাম আছে। এখন বাসে করে যেতে হবে মাইল তিরিশেক দূরে, পুশকিন শহরে।
৫
আমাদের হোটেলের ব্যবস্থাপনাতেই তিন-চারটি বাস ছাড়ল পুশকিন শহরের উদ্দেশ্যে। আমি আর সারগেই আমাদের জন্য নির্দিষ্ট বাসে উঠে বসলুম। একটি ফুটফুটে তরুণী মেয়ে আমাদের গাইড। সে একটি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে রাস্তার দু-ধারের বর্ণনা দিতে লাগল। আমি কিছুক্ষণ নিসর্গ দেখায় মন দিলুম। খুব একটা দেখবার কিছু নেই। মস্কোতে যেমন, লেনিনগ্রাডেও তাই, শহরের উপান্তে অসংখ্য ফ্ল্যাট বাড়ি। সোভিয়েত দেশের নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিককে বাসস্থান দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এখানে নাকি প্রতি পাঁচ মিনিটে একটা করে নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
শহর ছাড়াবার পর বৃক্ষবিরল সমতলভূমি। মাঝে-মাঝে ছোট-ছোট বসতি ও কল-কারখানা। এমন কোনও সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ল না, যার কথা বাড়িতে চিঠি লিখে জানানো যায়। বাইরের থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি বাসের যাত্রীদের লক্ষ করতে লাগলুম।
প্রায় সকলেই বিদেশি ভ্রমণকারী। বুলগেরিয়ান, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, আমেরিকান। এর মধ্যে একজন আমেরিকান ভদ্রলোক বিশেষ দ্রষ্টব্য। এই প্রৌঢ় লোকটি লম্বায় সাড়ে ছ'ফিটের বেশি তো হবেনই, বসা-অবস্থাতেই তাঁকে গাইড-মেয়েটির সমান মনে হচ্ছে। এক একজন দুর্ভাগা মানুষের ফিসফিস করে কথা বলার ক্ষমতা থাকে না, এই ব্যক্তিটি সেরকম। ইনি এঁর স্ত্রীর সঙ্গে যে নিভৃত আলাপ করছেন, তাও যেন মাইক্রোফোনে প্রচারিত হচ্ছে। এই কন্বুকণ্ঠ ব্যক্তিটির নাম, আমি মনে মনে রাখলুম, মিঃ গোলায়াথ। ওল্ড টেস্টামেন্টের ডেভিড যার সঙ্গে লড়াই করেছিল। মিঃ গোলায়াথের নাক, ঠোঁট, চোখ সবই বড়-বড়, ভুরু দুটি এত মোটা যে মুখখানাকে সবসময়েই বিস্মিত মনে হয়। এঁর স্ত্রী বেশ ছোট্টখাট্টো এবং মৃদুভাষী। আমার ঠিক সামনেই বসে আছে এক ফরাসি দম্পতি, তবে আজকালকার কেতা অনুযায়ী ওদের বোধহয় বিয়ে হয়নি, তাই প্রেম খুব গভীর, অন্য কারুর দিকে তাকাবার ফুরসত পর্যন্ত নেই। অন্যান্য যাত্রীরা সাধারণ টুরিস্টের মতন, আমি ছাড়া আর সবাই বেশ সুসজ্জিত।
মিঃ গোলায়াথ গাইড-মেয়েটিকে নানান প্রশ্ন করছেন। বাসে ওঠবার পরেই তিনি আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, আটাশ বছর আগে তিনি একবার লেনিনগ্রাডে এসেছিলেন, সেই স্মৃতি তাঁর কিছু-কিছু মনে আছে। গাইড-মেয়েটির বয়েস আটাশের অনেক কম, অত আগের কথা তার জানবার কথা নয়। তা ছাড়া উত্তর দেওয়ার সময় ঠিক ইংরিজি শব্দটা খোঁজবার জন্য সে প্রায়ই মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে ফেলছে, অন্য কোনও যাত্রী তাকে সাহায্য করছে বাক্যটি শেষ করতে। মিঃ গোলায়াথের কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গি দেখে অনেকেই মজা পাচ্ছে বেশ।
মিনিট চল্লিশেক-এর মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলুম পুশকিনে। বাস থেকে নেমেই বোঝা গেল এটি একটি প্রাসাদপুরী। এককালের রাজা-রাজড়াদের বিলাস ভবন। পিটার দা গ্রেট এবং বিখ্যাত রানি ক্যাথরিনের-স্মৃতি-বিজড়িত। আগে এই জায়গাটির অন্য নাম ছিল; পুশকিন এখানে লেখাপড়া করেছেন এবং তাঁর কৈশোর ও প্রথম যৌবন এখানে কাটিয়েছেন বলে এখন তাঁর নামেই শহরটি নামাঙ্কিত। রাশিয়ায় কবি-সাহিত্যিকদের নামে অনেক শহরেরই নাম রাখা হয়েছে।
পুশকিনের কথা ভাবলেই আমার বায়রনের কথা মনে পড়ে। রোমান্টিকতায় ও জীবনযাপনে দুজনের অনেকটা মিল আছে। দুজনেই লিখেছেন গাথাকাব্য। অবশ্য লেখক হিসেবে পুশকিনের প্রভাব অনেক ব্যাপক। অভিজাত ঘরের সন্তান হয়েও পুশকিন অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতার সপক্ষে কলম ধরেছেন। এজন্য তাঁকে নির্বাসনের যাতনা সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর লেখা 'ইউজেন ওনেজেন'-কে বলা হয় রুশ ভাষার প্রথম উপন্যাস। পুশকিনের 'ইস্কাবনের রানি' নামের গল্পটি অনেক বাঙালি পাঠকের কাছেই পরিচিত। পুশকিনের অপূর্ব কাব্যময় ভাষায় আমি মুগ্ধ হয়েছি এক সময়।
প্রেমের ব্যাপারেও পুশকিন বায়রনকে টেক্কা দিয়েছিলেন। বত্রিশ বছর বয়েসে পুশকিন এক অসাধারণ রূপসি মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন, যে পুশকিনের নিজের ভাষাতেই তাঁর জীবনের ১১৩ নম্বর নারী। সেই নারীও তার চরিত্র নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসত, এবং, এবং সেই কারণেই কয়েক বছরের মধ্যেই এক ডুয়েল লড়তে গিয়ে পুশকিন প্রাণ হারান।
আমরা অপেক্ষা করতে লাগলুম রাজপ্রাসাদটির সামনে। কুড়ি-পঁচিশ জনের এক একটি ব্যাচকে ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে। বাইরে থেকেই প্রাসাদটিকে বেশ জমকালো দেখায়, মিশ্রিত রাশিয়ান বারোক স্থাপত্যের একটি বৃহৎ নিদর্শন। ক্যামেরা বার করে ছবি তুলে ফেললুম কয়েকটা।
ভেতরে ঢুকে আমাদের আর এক জোড়া করে জুতো পরতে হল। প্রতিটি কক্ষের মেঝেতেই অতি মূল্যবান সব কাঠের কাজ আছে, বাইরের জুতো পরে তার ওপর দিয়ে এত লোক হাঁটলে সেসব অচিরেই নষ্ট হয়ে যাবে। আবার এদেশে খালি পায়ে হাঁটার কথা কল্পনাও করা যায় না, সেই জন্য এখানে আলাদা কাপড়ের জুতো রাখা আছে অনেক। সেইগুলো পায়ে গলিয়ে নিতে হবে। আমার কৌতূহল হল, আমাদের মিঃ গোলায়াথের পায়ের মাপের জুতো পাওয়া যাবে কি? তাও পাওয়া গেল এক জোড়া।
প্রাসাদটির প্রতিটি কক্ষের বর্ণনা আমি দেব না। সম্রাট-বাদশাদের বিলাস ভবন যে-রকম হয় এটিও প্রায় সেইরকমই। এই প্রাসাদের মধ্যেই রয়েছে দুটি গির্জা, অসংখ্য ঘরের মধ্যে কোনওটি রাজা-রানির শয়নঘর, কোনওটি বিকেলে বসবার ঘর, কোনওটি সকালের, কোনওটি বিদেশি অতিথিদের জন্য, কোনওটি একলা একলা খাওয়ার জন্য, কোনওটি বেশি লোকের সঙ্গে ভোজসভার জন্য, কোনওটি আকাশ দেখবার জন্য, কোনওটি বই পড়বার জন্য ইত্যাদি। এ ছাড়া চোখ ধাঁধানো নাচঘর।
এখানকার দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমি বলব। প্রজাদের শোষণ করা টাকায় এক সময় রাজা-বাদশাদের হুকুমে অনেক প্রাসাদ এবং শিল্পকীর্তি রচিত হয়েছে। কিন্তু সেজন্য রাজা-বাদশাদের আলাদা কোনও কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব হচ্ছে সেইসব স্থপতি ও শিল্পীদের, যাঁরা ওইসবের পরিকল্পনা ও নির্মাণ করেছেন। তাজমহলের জন্য শাজাহান শুধু হুকম দিয়েছেন আর রাজকোষ খুলে দিয়েছেন। তাঁর কি স্থাপত্য সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল? সেইরকম খাজুরাহো বা কোনারক দেখতে গিয়েও আমরা শুধু শুনি সেগুলি কোন রাজার আমলে তৈরি, শিল্পীদের নাম কেউ মনেও রাখেনি। এখানে কিন্তু রুশ গবেষকরা খুঁজে-খুঁজে বার করেছেন শিল্পীদের নাম, গাইডরা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে যখন আমাদের বিভিন্ন শিল্প-সৌন্দর্য দেখাচ্ছিলেন, তখন প্রতিটি ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছিলেন আসল শিল্পীদের নাম। মূল প্রাসাদটির স্থপতি বারতোলোমিও রাস্টভেল্লি। নাম শুনে মনে হয় ইটালিয়ান।
আর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল সোভিয়েত সরকারের ঐতিহ্যপ্রীতি। এ দেশের অভিজাততন্ত্র একেবারে মুছে ফেলা হলেও আগেকার দিনের প্রাসাদ, মূর্তি, স্তম্ভ কিছুও নষ্ট করা হয়নি, সব অবিকৃত রাখা হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, এই প্রাসাদটিও অর্ধেকটা নাতসিরা ধ্বংস করে দিয়েছিল, নাতসিরা এই শহরটি অধিকার করে এখানে থেকেও গেছে অনেকদিন, তখন যা খুশি ভাঙচুর করেছে। এখানকার মানুষ আবার পরম যত্নে সেইসব ভাঙা অংশের পুনরুদ্ধার করছে। যেমন তেমন মেরামত নয়, হুবহু আগের মতন। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, আমরা দেখলুম, এখনও শিল্পীরা ছবি দেখে-দেখে এক-একটা ঘর ঠিক আগের মতন অবস্থায় ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে আটত্রিশ বছর আগে।
ঘুরতে-ঘুরতে আরও একটি ব্যাপারে চমকিত হলুম। আমাদের সহযাত্রী মিঃ গোলায়াথের কথাবার্তা শুনে বাসের মধ্যে অনেকেই মুখ টিপে হাসছিলুম, কিন্তু এখন দেখা গেল, ওই দৈত্যকারের লোকটি কিন্তু একজন শিল্প-বিশেষজ্ঞ! বিভিন্ন ঘরে যেসব ছবি আছে, অনেক শিল্পীর নামই অপরিচিত, সেসব ছবি দেখে কিন্তু ওই ভদ্রলোক শিল্পীদের নাম, রঙের ব্যবহারের বিশেষত্ব, রীতি, শিল্প-ইতিহাস বলে যাচ্ছিলেন গড়-গড় করে, গাইডরাও অতশত জানে না।
প্রাসাদ সফর শেষ হওয়ার পর অনেকেই গেল পার্শ্ববর্তী পুশকিন-সংগ্রহশালা দেখতে। আমার আর ইচ্ছে হল না। মিউজিয়ম বা এই ধরনের বড়-বড় বাড়ি হেঁটে-হেঁটে ঘুরতে বেশ ক্লান্তি লাগে। সামনের বাগানে একটা বেঞ্চে বসে পড়ে আমি সারগেইকে জিগ্যেস করলুম, আজ আর কোথাও যাওয়ার নেই তো?
সারগেই বলল, নাঃ, আজ আর কিছু নেই। ছুটির দিন বলে এখানকার এ পি এন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি, জানি না ওর কিছু ঠিক করে রেখেছিল কি না!
আমি বললুম, আর কিছু থাকলেও আজ আর আমি যেতুম না।
বলেই আমি দুবার হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে উঠলুম। সকালে বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে গেছে।
বাস ছাড়ার সময়টা আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ে সবাই সেখানে জড় হয়ে গেল। বাসটা চলতে শুরু করার খানিকক্ষণ পরে কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগতে লাগল, কীসের যেন অভাব বোধ করছি। আরও একটু পরে একজন যাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে গাইড মেয়েটিকে কী যেন বললে। মেয়েটিও খুব বিচলিতভাবে কথা বলতে লাগল ড্রাইভারের সঙ্গে। কিছু যেন একটা ঘটেছে।
আমি সারগেইকে জিগ্যেস করলুম, কী ব্যাপার?
সারগেই হাসতে-হাসতে বলল, সেই লম্বা আমেরিকান ভদ্রলোক মিসিং। তিনি আর তাঁর স্ত্রী বাসে ওঠেননি!
সেইজন্যই এতক্ষণ এত নিস্তব্ধ মনে হচ্ছিল বাসটাকে।
এখন কী করা যাবে, তাই নিয়ে একটা সংশয় দেখা দিল। বাসটা প্রায় দশ-বারো মাইল চলে এসেছে, এদিকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অনেকেই ক্লান্ত, এখন আবার বাসটা অতদূরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? একজন বলল, আরও তো কয়েকটি বাস রয়েছে, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই অন্য বাসে চলে আসবেন। গাইড মেয়েটি বলল, সবক'টি বাসই তো ভরতি, অন্য কোনও বাস ওঁদের নেবে কিনা সন্দেহ! একজন বললে, কেউ বিপদে পড়লেও নেবে না? আর একজন বলল, অন্য বাসও তো ছেড়ে দেবে, উনি যদি কোথাও ঘুমিয়ে পড়ে থাকেন? পরে আর ফেরবার উপায় নেই। আর একজন বলল, আমি ভদ্রলোককে একবার দেখেছিলুম, একটা সুভেনিরের দোকানে কেনাকাটা করতে।
শেষ পর্যন্ত গাইড-মেয়েটি বলল, আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। বাসটির মুখ ফেরানো হল।
আবার সেই প্রাসাদের কাছাকাছি এসে দেখা গেল সস্ত্রীক মিঃ গোলায়াথ রাস্তায় একটি স্টেশন ওয়াগনের ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। সম্ভবত উনি গাড়িটি ভাড়া করতে চাইছেন, কিংবা গাড়িটা একেবারে কিনে ফেলার প্রস্তাব দেওয়াও বিচিত্র নয়।
আমাদের বাসের একজন যাত্রীও ভদ্রলোককে কোনও অভিযোগ জানাল না। গাইড-মেয়েটি হাসিমুখে বলল, আমরাই ভুল করে আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম।
বাসে উঠে সেই দৈত্যাকার, বজ্রকণ্ঠ মানুষটি শিশুর মতন সরল মুখ করে অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন, আপনাদের অসুবিধে ঘটাবার জন্য আমি দুঃখিত। দোষ আমারই।
এই ছোট্ট ঘটনাটি দেখে আমার মনে হল, সোভিয়েত দেশের সাধারণ মানুষ আমেরিকার সাধারণ মানুষের প্রতি কোনও বিদ্বেষ ভাব পোষণ করে না। সব দেশের সাধারণ মানুষই তো সমান।
সন্ধেবেলা হোটেলে ফিরে আমি আরও কয়েকবার হাঁচতে লাগলুম। সারগেই বলল, দাঁড়ান, আপনার জন্য ওষুধ আনছি।
সে এনে হাজির করল এক বোতল ভদকা।
এ দেশে এসে এখনও এ দেশের জাতীয় পানীয় আস্বাদ করা হয়নি বটে। আমি গেলাস ধুয়ে নিয়ে এলুম। ভদকার জন্য খুব ছোট-ছোট গেলাস লাগে, কিন্তু তা আর পাচ্ছি কোথায়? সারগেই আমাকে বোঝাতে লাগল ভদকা জিনিসটা কী ও কতরকম হয়। আমি শুনে গেলুম বাধা না দিয়ে। রাশিয়ান ও পোলিশ ভদকা ইউরোপের সব জায়গাতেই পাওয়া যায়, আমেরিকাতেও পাওয়া যায়, এমনকী কলকাতাতেও জোগাড় করা অসম্ভব কিছু না। ও আমার অনেকবার চেখে দেখা আছে।
ভদকা এক ঢোঁকে গলায় ঢেলে দেওয়ার নিয়ম। প্রথম গেলাসটি নেওয়ার পর সারগেই আমাকে বলল, সুনীলজি, সাবধানে খাবেন, এ জিনিস খুব কড়া। আমি তো ইন্ডিয়াতে গেছি, আমি দেখেছি ইন্ডিয়ানরা বেশি ড্রিংক করতে পারে না।
আমি সুন্দরবনের হাঁড়িয়া, সাঁওতাল পরগনার মহুয়া, খালাসি-টোলার এক নম্বর, পার্বত্য চট্টগ্রামের চার চোঁয়ানি, মেক্সিকোর টাকিলা, গ্রিসের উজো খেয়ে দেখেছি, সেই সবের তুলনায় এই ভদকা আমার তেমন কড়া মনে হল না।
সারগেই অবশ্য বেশ সাবধানী সুরাপায়ী। একটা দুটো খেয়েই বলল, আমার যথেষ্ট হয়েছে। সারগেই-এর খানিকটা স্বাস্থ্যবাতিক আছে। ও আমাকে বলল, এক সময় আমি খুব সিগারেট খেতুম, খুব ড্রিংক করতুম, এখন ছেড়ে দিয়েছি। সে কথা শুনে আমি হেসে খুন। বাইশ বছরের ছেলে, কবেই বা ধরল, কবেই বা ছাড়ল?
গেলাসের পর গেলাস উড়িয়ে আমি বোতলটা শেষ করে ফেললুম এক সময়। খুব একটা বেশি কিছু নয়। এইসব ভদকার বোতলের ছিপি খুব পাতলা। একবার খুললে আর লাগাবার ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ এই বোতল খুলে একবারেই শেষ করে দেওয়া নিয়ম!
সারগেই বিদায় নেওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ বইটই পড়লুম। আজও সহজে ঘুম এল না। ঘুমের আবার এ কী ব্যাপার হল? অবশ্য রাত্তিরে ঘুম না হলে আমি ব্যতিব্যস্ত হই না, বরং নিজেকে নিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটানো যায়।
মে-দিবস উপলক্ষে এখানে পর পর দুদিন ছুটি। সারগেই এ পি এন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না, তবে আগে থেকেই আজকের অন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে আছে।
হোটেল থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে মাত্র পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গিয়ে বুঝলুম, ট্যাক্সি না নিলেও চলত। এটির নাম ফিনল্যান্ড স্টেশন, এখান থেকে সরাসরি ট্রেন ফিনল্যান্ড যায়। সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে আত্মগোপন করতে হলে লেনিন ফিনল্যান্ডে চলে যেতেন। আমরা অবশ্য ততদূর যাব না, আমাদের গন্তব্য পঁচিশ মাইল দূরে কোমারোয়া নামে একটা ছোট্ট জায়গা।
এখন বেলা এগারোটা, লোকাল ট্রেনে বেশি ভিড় নেই। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও বোধ হয় ট্রেন আজকাল জনপ্রিয় নয়। আমরা একটা ফাঁকা কামরায় উঠে বসলুম। সারগেই শোনাল তার ভারতীয় রেলযাত্রার অভিজ্ঞতার কাহিনি। একবার তাকে বোম্বে থেকে নাগপুর যেতে হয়েছিল, হঠাৎ সেই সময় তার খুব জ্বর হয়েছে। ট্রেনে রিজার্ভেশন নেই। অসহ্য ভিড়ের মধ্যে সারারাত কাটাবার সময় তার মনে হয়েছিল, সে বুঝি হঠাৎ মরেই যাবে।
অবশ্য সারগেই-এর বর্ণনার মধ্যে কোনও তিক্ততা ছিল না। সে জানে, ভারতবর্ষ অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে ভুগছে। সেই তুলনায় সোভিয়েত রাশিয়ায় জনসংখ্যা কমতির দিকে।
চলন্ত ট্রেনে হঠাৎ এক সময় মাইক্রোফোনে অনেকক্ষণ ধরে কী সব ঘোষণা হতে লাগল। আমি সারগেইকে জিগ্যেস করলুম, কী বলছে? সারগেই বলল, ও চাকরির খবর। রেলে কতগুলো চাকরি খালি আছে, কত মাইনে, কী কী সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে তাই জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যদি যাত্রীদের মধ্যে কেউ ওইসব চাকরি নিতে উৎসাহিত হয়।
আমি হতবাক! রেলে চাকরি খালি? লোক পাওয়া যাচ্ছে না, যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে? আমাদের দেশে রেলের চাকরিতে দশটা পোস্ট-এর জন্য বিজ্ঞাপন দিলে অন্তত দশ হাজার দরখাস্ত পড়ে না? আমরা সবাই একই পৃথিবীর মানুষ?
কাল রাত্তিরেই আমি একবার ১৯৮৩ সালের ইয়ার-বুকে সোভিয়েত নাগরিকদের চাকরির অবস্থার কথা পড়ছিলুম। এ দেশের প্রত্যেক মানুষের কাজ পাওয়ার অধিকার আছে। নতুন সংবিধান অনুযায়ী ইচ্ছে মতন চাকরি বেছে নেওয়ার অধিকারও হয়েছে। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর প্রত্যেকের চাকরি বাঁধা। ১৯৩০ সালের পর থেকে এদেশে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ উঠে গেছে। ইদানীং পনেরো থেকে পঁচিশ লাখ চাকরি খালি যায়, লোক পাওয়া যায় না।
এটা একটা দারুণ উন্নতির প্রমাণ। যে-সমাজে প্রতিটি মানুষই কাজের অধিকার পায়, সে সমাজে সবাই সসম্মানে বাঁচতে পারে। ইংল্যান্ড-আমেরিকাতে এখন বেকারিত্ব প্রকট। আমেরিকায় বর্তমানে বেকারের সংখ্যা শতকরা ১৬ জনের বেশি। অবশ্য, এই সঙ্গে এ কথাও বলা দরকার, ইংল্যান্ড-আমেরিকা-কানাডার মতন সোভিয়েত রাশিয়াকে বহিরাগতদের চাপ সহ্য করতে হয় না। বহিরাগতদের জন্যই ইংল্যান্ডে বর্ণ-সমস্যা এবং বেকার সমস্যা পাশাপাশি চলছে। আমেরিকা বা কানাডার যে-কোনও ছোট শহরেও কালো মানুষ, চিনে, আরব, ভারতীয় চেহারার নতুন নাগরিক দেখা যায়। রাশিয়ায় সে সমস্যা নেই।
ছোট-ছোট স্টেশন আসছে যাচ্ছে, লোকজনের ওঠা-নামা খুবই কম। খানিকবাদেই আমাদের জায়াগাটায় পৌঁছে গেলুম। বেশ একটা পরিচ্ছন্ন গ্রামের মতন। আমরা যাব এখানকার একটি রাইটার্স হোমে। স্টেশনের একজনকে জিগ্যেস করে সারগেই পথ-নির্দেশ জেনে নিল।
গাছের ছায়া-ফেলা পথ ধরে আমরা হাঁটতে লাগলুম। দুপাশে শান্ত-নির্জন বাড়ি। অধিকাংশ বাড়িই তালা দেওয়া, কোনও-কোনও বাড়িতে কুকুর রয়েছে দেখলুম, অর্থাৎ মানুষও রয়েছে। নিজস্ব ব্যবহারের জন্য এদেশে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখা নিষিদ্ধ নয়। গ্রামের দিকে অনেকেরই ডাচাউ বা কানট্রি হাউস থাকে। ছুটিছাটায় বেড়াতে আসে।
আমরা যে-লেখকের সঙ্গে দেখা করতে চলেছি, তাঁর পরিচয় বেশ অভিনব। সোভিয়েত দেশের উত্তরাঞ্চলে, আর্কটিক ওশানের কাছে, বরফের রাজ্যে, চুকচা নামে একটি উপজাতির বাস। জনসংখ্যা মাত্র পনেরো হাজার। কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই চুকচাদের কোনও লিখিত ভাষা ছিল না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন যেহেতু মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে বিশ্বাসী, তাই চুকচাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য তাদের ভাষার একটা লিখিত রূপ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এবং এক জেনারেশনেই তাদের মধ্যে একজন লেখক সারাদেশে যশস্বী হয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলনেও আমি এঁর লেখা দেখেছি।
মধ্যবয়স্ক এই লেখকটির নাম রিথিউ ইউরি সারগেইভিচ। ইনি পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন, কলকাতাতেও এসেছেন।
রাইটার্স হোম একটি বেশ বড় বাড়ি। তাতে আলাদা আলাদা অ্যাপার্টমেন্ট, সেখানে এসে লেখকরা থাকতে পারেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, টাইপ-রাইটার ও টেলিফোন আছে, খরচ নামমাত্র। রিথিউ সারগেইভিচ আমাদের নিয়ে তাঁর লেখার ঘরে বসিয়ে বললেন, হ্যাঁ, কলকাতার কথা আমার মনে আছে, কলকাতায় বেশ প্রাণ আছে!
ইনি ইংরিজি জানেন না। সারগেই আমাদের দো-ভাষী। নিজের মাতৃভাষা ছাড়াও ইনি অবশ্য রুশ ভাষা ভালোই জানেন, ইচ্ছে করলেই রুশ ভাষায় লিখতেও পারেন, কিন্তু নিজেদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য সেই ভাষাতেই লিখে যেতে চান। তাতে অবশ্য প্রচারের অসুবিধে কিছু নেই। কারণ লেখামাত্র অনুবাদ হয়ে যায়। যে-ভাষার সমগ্র জনসংখ্যাই মাত্র পনেরো হাজার, সেই ভাষার একজন লেখক হয়েও ইনি লেখাটাকেই জীবিকা করতে পেরেছেন, লেনিনগ্রাড শহরে এঁর নিজস্ব একটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে। সংসার-খরচের জন্য চিন্তা করতে হয় না। ইচ্ছেমতন ভ্রমণ করতে পারেন।
বিদেশি কোনও লেখকের সঙ্গে কথা বলতে আমার অনেক ক্ষেত্রেই বেশ অসুবিধে হয়। ওঁরা আমাদের লেখাটেখা সম্পর্কে কিছুই জানেন না, বাংলা ভাষার অস্তিত্ব সম্পর্কেই অনেকের স্পষ্ট ধারণা নেই। অথচ আমরা ওদের সম্পর্কে মোটামুটি জানি। রিথিউ সারগেইভিচেরও একটি ছোট গল্প অন্তত আমার আগেই পড়া আছে। একটি ছেলেকে নিয়ে গল্প, তারা বাবা নৌকো নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেত, ছেলেটি অপেক্ষা করত কবে বাবা আসবে, কবে বাবা আসবে। একবার বাবা ফিরে এল না। সবাই ধরে নিল সে সমুদ্রে নৌকোডুবি হয়ে মারা গেছে। কয়েক বছর পরে ছেলেটি তার বাবাকে অন্য একটি শহরে দেখতে পায়, কিন্তু সে কথা সে তার মাকে জানাল না। সেটাই তার জীবনের প্রথম গোপন কথা।
একটি গল্প পড়েই সেই লেখকের রচনাভঙ্গি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা করা যায়। কিন্তু আমার সম্পর্কে উনি কী ধারণা করবেন?
যাই হোক, খানিকক্ষণ গল্প-টল্প হল। আমি ওঁকে ওঁর লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে টুকিটাকি কয়েকটা প্রশ্ন করলুম। উনি ওঁর স্বজাতির নানান লোক-কাহিনি, গ্রাম্য জীবন বিষয়েই বেশি লিখতে চান। অবশ্য আধুনিক শহুরে জীবন নিয়েও কিছু-কিছু লিখেছেন। রুশ ক্লাসিকাল সাহিত্য ওঁর বেশ ভালোই পড়া আছে।
এক সময় উনি নিজেই চা তৈরি করে খাওয়ালেন।
আমি জিগ্যেস করলুম, এইরকম নির্জনবাসে কি আপনার লেখার বেশি সুবিধে হয়?
উনি বললেন, শহরে অনেক লোকজন, নানারকম আকর্ষণ। বাড়ির লোকজনের জন্যও সময় দিতে হয়। এরকম কোনও ফাঁকা জায়গায় বেশ কয়েকদিন থাকলে কল্পনাশক্তি বাড়ে। এই জায়গাটা বেশ সুন্দর। খুব কাছেই সমুদ্র। লেখায় মন না বসলে আমি সমুদ্রের ধারে হাঁটতে যাই।
আমি চমকে উঠে বললুম, কাছেই সমুদ্র? আমরা ঘুরে আসতে পারি?
উনি কোট ও টুপি পরে বাইরে এসে আমাদের সমুদ্রের দিকের পথটা দেখিয়ে দিলেন। দু-একটা ছবি তোলার পর আমরা উষ্ণ করমর্দন করে বিদায় নিলুম।
দুপাশে প্রায় বনের মতন। রাস্তাটা এক জায়গায় অনেকখানি ঢালু হয়ে নীচে নেমে গেছে। সারগেই জিগ্যেস করলো, সুনীলজি, আর যাবেন? ফেরার সময় কিন্তু এতখানি খাড়া উঠতে হবে!
আমি বললুম, এত কাছে সমুদ্র, তবু দেখব না? চলো, চলো!
সেই ঢালু পথ ধরে প্রায় ছুটতে-ছুটতে নেমে এসেই দেখতে পেলাম বেলাভূমি। অনেকদিন বাদে সমুদ্র দর্শন হল। আমার অভিজ্ঞতায় আর একটি নতুন সমুদ্র, এর নাম বালটিক উপসাগর।
দুপুরবেলা সমুদ্র তীর একেবারে নির্জন। আমি এগিয়ে গিয়ে জলে হাত রাখলুম। অচেনা জল সব সময়েই ছুঁতে ভালো লাগে।
৬
একে ছুটির দিন, তার ওপর বৃষ্টি পড়ছে। এখন কোথাও যাওয়ার নেই, বসে-বসে আলস্য করতেই ইচ্ছে করে। বেশ বেলা করে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে আমি আর সারগেই বসে আছি হোটেলের দোতলার লবিতে। সামনের দেওয়ালটি পুরো কাচের তৈরি। সেই জন্য এখানে বসে-বসেই নিভা নদীর ওপর বৃষ্টিপাতের দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
বৃষ্টির জন্য অনেকেই বাইরে বেরুতে পারেনি। এখানকার আবহাওয়া বেশ উপভোগ্য হলেও বৃষ্টি পড়লেই কনকনে শীত পড়ে। এখন মে মাস। কলকাতায় অসহ্য গরম, আর এখানে আমি কোট, সোয়েটার পরে বসে আছি।
সারগেই জিগ্যেস করল, সুনীলজি, বৃষ্টি থামলে বিকেলে কোথায় যাওয়া যায়?
আমি বললুম, লেনিনগ্রাডে এসে আমি আর যাই দেখি বা না দেখি, হারমিটেজ মিউজিয়াম দেখবই!
সারগেই বলল, হ্যাঁ, ওই মিউজিয়াম তো নিশ্চয়ই দেখব। কালকেও সময় আছে।
লবিতে আর যে ক'জন লোক বসে আছে, তাদের মধ্যে একজন ভারতীয়। সেই দিকে আঙুল তুলে সারগেই জিগ্যেস করল, ওই ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক কি বেঙ্গলি?
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আগে দু-একবার চোখাচোখি হয়েছে, উনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক। প্রবাসে সবসময় বিদেশি ভাষা বলতে-বলতে কখনও হঠাৎ মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ পেলে বেশ আরাম হয়। কিন্তু একজন ভারতীয়ের সঙ্গে আর একজন ভারতীয়ের দেখা হলেই সে সুখ পাওয়া যায় না। ওই ভদ্রলোকটি দক্ষিণ ভারতের কোনও রাজ্যের, আমরা পরস্পরের ভাষা একবর্ণ বুঝব না। কথা বলতে হবে কষ্টকল্পিত ইংরিজিতেই।
আমি সারগেইকে বললুম, উনি দক্ষিণ ভারতীয়, তবে কোন রাজ্যের তা জানি না।
সারগেই উঠে গিয়ে ভদ্রলোককে তামিল ভাষায় কী যেন জিগ্যেস করল। তিনি প্রায় ভূত দেখার মতন চমকে উঠলেন।
সারগেই ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে এল আমাদের টেবিলে। আনন্দের আতিশয্যে ভদ্রলোক অনেক গল্প জুড়ে দিলেন সারগেই-এর সঙ্গে। আমি বোবা হয়ে বসে রইলুম।
তারপর সারগেই আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ করিয়ে দিল। ভদ্রলোকের নাম শ্রীযুক্ত সুব্রহ্মণ্যীয়ম, তিনি অঙ্কের পণ্ডিত, ক্যানাডার কোনও শহরে অধ্যাপনা করেন। লেনিনগ্রাডের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় মাসের জন্য একটি সেমিনারে যোগ দিতে এসেছেন। তিনি নিরামিষ খান বলে খাবারদাবারে কিছু অসুবিধে হচ্ছে এবং একাতিত্ব ভোগ করছেন। সারগেইকে পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত।
সারগেই-এর মুখে আমার পরিচয় শুনে তিনি জানালেন যে তিনিও কবিতা লেখেন। তাঁর তামিল ভাষায় লেখা কবিতার ইংরেজি অনুবাদও তাঁর সঙ্গেই আছে। হাত-ব্যাগ খুলে তিনি সাইক্লোস্টাইল করা কবিতা বার করে দিলেন।
সেই কবিতা কয়েক লাইন পড়েই আমি চোখ তুলে নিলুম। ধর্মীয় বিষয়বস্তু ও উচ্চ দার্শনিকভাবের ব্যাপার, খটোমটো ইংরেজিতে লেখা। এই ধরনের রচনা সম্পর্কে আমি কোনও আগ্রহ বোধ করি না।
সারগেই ও শ্রীযুক্ত সুব্রহ্মণ্যীয়ম গল্প করতে লাগলেন। আমি চুপ করে বসে রইলুম খানিক্ষণ। তারপর ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলুম নিজের ঘরে।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়েই চলেছে। নিভা নদীটি বেশ চওড়া, বৃষ্টিতে তাকে বেশ উচ্ছল দেখাচ্ছে। সব নদীই নিশ্চয়ই বৃষ্টি পছন্দ করে। বৃষ্টি তো নদীর খাদ্য। মাঝে মাঝে লঞ্চ যাচ্ছে। এসব দেশে কাঠের নৌকো উঠে গেছে বহুদিন, তবু কল্পনায় আমি যেন একটা নিঃসঙ্গ পাল তোলা নৌকো দেখতে পাই। এই পাশ্চাত্য নগরীতে বসেও আমার মন চলে যায় পদ্মানদীর প্রান্তে।
প্রকৃতির কোনও সুন্দর দৃশ্য পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি দেখা ঠিক নয়। তাতে সমগ্রের বদলে অংশের দিকে চোখ চলে যায়। জানলার কাছ থেকে সরে এসে আমি টিভি খুললুম। মোট তিনটি চ্যানেল। একটিতে হচ্ছে একটি ছোটদের ফিলম। একটিতে হচ্ছে কনসার্ট, আর একটিতে খেলাধুলো। এরা গান-বাজনা খুব ভালোবাসে। যখনই টিভি খুলি, তখনই কোনও-কোনও চ্যানেলে উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত শুনতে পাই। রুশ ভাষায় যখন খবর হয়, তখন ভাষা বুঝতে না পারলেও মাঝে-মাঝে ইন্ডিয়া, ইন্দিরা গান্ধি, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব এইসব শব্দ কানে আছে। প্রায় প্রতিদিনই ভারতের উল্লেখ, এটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার। পশ্চিমি দেশগুলিতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ টিভি খবর শুনলে মনে হয় ভারত নামে কোনও দেশেরই অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে।
হঠাৎ মনে হল তিন-চারদিন আমি কোনও খবরের কাগজ পড়িনি। ইংরিজি কাগজ এখানে বেশ দুর্লভ, খোঁজও করিনি আমি। কিন্তু কয়েকদিন খবরের কাগজ না পড়ায় আমার শরীর বা আত্মার কোনও ক্ষতি হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
খানিকবাদে সারগেই এসে দুষ্টু হেসে বলল, ওই দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোক সন্ধেবেলা আপনার ঘরে এসে কিছু কবিতা পড়ে শোনাতে চান। আপনি কি ইন্টারেস্টেড?
আমি বললুম, সন্ধেবেলা তো আমরা হোটেলে থাকব না!
—সন্ধেবেলা কোথায় যাব?
—কোনও পার্কে বসে আকাশ দেখব!
সারগেই হো-হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, তামিল ভাষাতে এখন অনেক ভালো কবিতা লেখা হয়। কিন্তু এই ভদ্রলোক খুব প্রাচীনপন্থী।
আমি বললুম, বহুদিন দেশের বাইরে আছেন, তাই আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে যোগ নেই।
তখন সারগেই আমায় কিছু-কিছু আধুনিক তামিল কবিতা তর্জমা করে শোনাল। সেগুলো বেশ লাগল আমার।
আমি বললুম, তুমিও তো কবিতা লেখো। এবারে কিছু কবিতা শোনাও!
প্রথমে বেশ লজ্জা পেয়ে গেল সারগেই। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু আমি ছাড়ব কেন? শেষ পর্যন্ত কিছু-কিছু লাইন শোনাতে লাগল। ওর বেশ কল্পনাশক্তি আছে। ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েও কিছু কবিতা লিখেছে সারগেই। তার মধ্যে একটি কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে ঘুঁটে। ভারতের গ্রামে-গঞ্জে-শহরের দেওয়ালে-দেওয়ালে দেখতে পাওয়া যায় ঘুঁটে। সেইসব ঘুঁটের মধ্যে যে পাঁচটা আঙুলের ছাপ পড়ে, সেটাই আকৃষ্ট করেছে সারগেইকে। যেন ওপরের দিকে বাড়ানো হাজার-হাজার হাত। নীরব, অথচ কিছু বলতে চায়।
সারগেই-এর কবিতা কয়েকটি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, এখনও কোনও বই বেরোয়নি। বই বার করা সহজ নয়। আমাদের দেশে তরুণ কবিরা অনেকেই নিজের খরচে বই ছাপে। কিংবা অনেক ছোট প্রকাশক আছে, তাদের মধ্যে যদি কেউ ইচ্ছে করে তো ছাপিয়ে দিতে পারে। এ দেশে ব্যক্তিগত মালিকানায় কোনও প্রকাশনালয় নেই। কবিরা তাদের পাণ্ডুলিপি জমা দেয় সরকারি প্রকাশনালয়ে। সেখানকার বিশেষজ্ঞরা যদি মনোনীত করেন, তবে বই ছাপা হয়। সেজন্য সময় লাগে। অবশ্য পত্র-পত্রিকাতে লেখার সময়ই যদি কারুর কবিতা খুব বিখ্যাত হয়ে যায়, তবে তার বই নিশ্চয়ই ছাপা হয় তাড়াতাড়ি। ইয়েফতুশেংকোর খ্যাতি যখন আমাদের কাছে পৌঁছেছে তখন তার বয়েস কুড়ি-একুশ।
পরদিন আমরা গেলুম একটি যুব পত্রিকার দফতরে। ঠিকানা খুঁজে পেতে খানিকটা ঝামেলা হল। তার ফলে অবশ্য লেনিনগ্রাড শহরটি অনেকখানি দেখা হয়ে গেল।
গত মহাযুদ্ধে এই লেনিনগ্রাড শহরে যে সাংঘাতিক লড়াই হয়েছিল এবং এখানকার নাগরিকরা অসীম সাহস আর মনোবল দেখিয়েছিল, তা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরকাল লেখা থাকবে। নাতসি বাহিনী এই শহরটি অবরুদ্ধ করে রেখেছিল ৯০০ দিন, তবু লেনিনগ্রাডের পতন হয়নি। নিয়মিত বোমা ও কামানের গোলা বর্ষণ হয়েছে, স্থলপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ফলে খাদ্যদ্রব্য ফুরিয়ে গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত অনেকে নাকি কুকুর-বেড়াল পর্যন্ত খেয়েছে, তবু এখানকার নাগরিকরা নাতসি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। শুধু অনাহারেই সেবার ছ'লক্ষ নারী-পুরুষের মৃত্যু হয়েছিল।
সেই যুদ্ধের কোনও চিহ্নই এখন নেই। কোনও ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে না। বড়-বড় পার্ক, সুন্দর সুন্দর বাড়ি, চওড়া রাস্তা ও মাঝে-মাঝেই দৃষ্টি কেড়ে নেবার মতন ভাস্কর্য। লেনিনগ্রাডের নাগরিকরাও বেশ সুসজ্জিত, অনেক মহিলার অঙ্গে ফ্যাসনেবল পোশাক, জিনস পরিহিত যুবকদেরও দেখা যায়।
লেনিনগ্রাডে কিছু কিছু পুরোনো পাড়াও রয়েছে। এখানকার বাড়িগুলো ব্যারাকবাড়ির মতন; রাস্তা দিয়ে ট্রাম চলে, ট্রাম লাইন থাকলেই সেইসব রাস্তা কিছুটা ভাঙা ভাঙা হয়। এখানে সেখানে জল জমে থাকে। এই এলাকায় বেশ একটা কলকাতার সঙ্গে মিল খুঁজে পেলুম। নিউ ইয়র্ক শহরেও বেশ কয়েকটা রাস্তা আছে এরকম, ভাঙা-ভাঙা, পাশে জঞ্জাল জমে থাকা, ও মানুষের ভিড় দেখে কলকাতার কথা মনে পড়েছিল আমার। পৃথিবীর যেখানেই যাই, কলকাতার সঙ্গে মিল খুঁজি।
যুব পত্রিকাটির অফিস কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিক রাস্তায় এসেছি, ঠিক নম্বরের বাড়ির সামনে এসেছি, কিন্তু সেখানে কোনও পত্রিকা অফিস নেই। সারগেই একটুতেই নার্ভাস হয়ে যায়, সে ছোটাছুটি করতে লাগল। এদেশে সবাই খুব ঘড়ির কাঁটা মেনে চলে। আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। সারগেই একটা টেলিফোন বুথে ঢুকে টেলিফোন গাইড দেখে ঠিকানাটা চেক করে এল। ঠিকই আছে, তা হলে পত্রিকার অফিসটা গেল কোথায়? রাস্তায় দু-একজন পথচারীকে জিগ্যেস করা হল, তাঁরা কোনও সাহায্য করতে পারলেন না। দু-একজন মনে হল পত্রিকাটির নামই শোনেননি। রাস্তায় এ সময় অধিকাংশই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তারা যুব-পত্রিকা পড়েন না!
শেষ পর্যন্ত হদিশ পাওয়া গেল। আমাদের কাছে যে ঠিকানা লেখা আছে, ঠিক তার পাশের বাড়িতেই পত্রিকা অফিসটি কিছুদিন আগে উঠে গেছে। আমরা সে বাড়ির সামনে দিয়েই কয়েকবার ঘুরে গেছি। শীতের মধ্যেই সারগেই-এর কপালে প্রায় ঘাম জমে গিয়েছিল, এবারে সে নিশ্চিন্ত হল।
পত্রিকাটির নাম ''অরোরা''। সারা দেশের স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা এখানে লেখা পাঠাতে পারে। এইরকম পত্রিকা থেকেই নতুন-নতুন সাহিত্য-প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায়। এঁদের নিজস্ব প্রেস আছে, প্রচার সংখ্যা আড়াই লক্ষ'র বেশি।
কলেজ জীবনে আমিও কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা-পত্রিকা সম্পাদনা করেছি, প্রথম দিকে বেশ কয়েক বছর তাতে শুধু তরুণ লেখকদের রচনা ছাপা হত, এবং আমাদের মুদ্রণ সংখ্যা কোনওক্রমে টেনেটুনে এক সময় আড়াই হাজার পর্যন্ত উঠেছিল। সে পত্রিকা চালাবার জন্য আমাদের কখনও কখনও ভিক্ষে পর্যন্ত করতে হত। বন্ধু-বান্ধবরাই ঘাড়ে করে সে পত্রিকা পৌঁছে দিত স্টলে স্টলে, লেখকদের সম্মান-দক্ষিণা দেওয়ার প্রশ্নই ছিল না। শিল্পীরাও বিনা পয়সায় এঁকে দিতেন মলাট। সেই জন্যই এখানকার যুব পত্রিকার পরিচালনা ব্যবস্থা জানবার জন্য আমার আগ্রহ ছিল।
এ দেশে পত্রিকার খরচ তোলার ব্যাপারে বিজ্ঞাপনের জন্য ঘোরাঘুরি ও হ্যাংলামির প্রয়োজন হয় না, ছাপার খরচ জোগাড় করার দুশ্চিন্তা নেই। কারণ সরকারই এর পৃষ্ঠপোষক। সোভিয়েত ইউনিয়ানে যে-কোনও পত্র-পত্রিকায় কোনও লেখা ছাপা হলেই লেখককে টাকা দেওয়া হয়। পত্রিকার প্রচার সংখ্যা অনুযায়ী টাকার অঙ্ক বাড়ে কমে। এদেশের একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় একটি মাত্র ছোট গল্প লিখে সাত-আট হাজার টাকা (আমাদের হিসেবে) পাওয়া আশ্চর্য কিছু নয়। পত্র-পত্রিকার সংখ্যা অনেক, সেই জন্য যার কিছুমাত্র সাহিত্য-প্রতিভা আছে, তার পক্ষেই আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাওয়া সহজ।
অরোরা পত্রিকার সম্পাদক কিন্তু অল্পবয়েসি যুবক নয়। টাক-মাথা একজন ভদ্রলোক। তিনি ইংরিজি জানেন না, কথাবার্তা চলছিল সারগেই-এর মাধ্যমে। নানান আলাপ-আলোচনার পর আমি জিগ্যেস করলুম, আপনারা যে রচনা নির্বাচন করেন, তার কি কোনও গাইড লাইন আছে? আপনারা কি বিষয়বস্তু ঠিক করে দেন?
তিনি হেসে বললেন, না, যার যা খুশি লিখতে পারে। তবে, আমাদের তরুণ লেখকরা সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য, শ্রমিক-কৃষক ঐক্য, সম-ভ্রাতৃত্ব, বিশ্বশান্তি এসব বিষয়েই লেখে।
আমি বললুম, সে তো বটেই। সব কবিই এসব চায়। কিন্তু তরুণ বয়েসে একটা বিদ্রোহের মনোভাব থাকে, বিশেষত আগেকার লেখকরা যা লিখেছেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থাকে, কোনও-কোনও মূল্যবোধকে ভাঙতেও চায়।
তিনি বললেন, সেরকম কেউ এখানে লেখে না।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, সে কী! এখানে তরুণ লেখকদের মধ্যে অন্য কোনও বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা, কিংবা ফর্ম ভাঙার ঝোঁক নেই?
তিনি বললেন, কেউ সেরকম লিখলে আমরা তাদের চিঠি লিখে জানাই কোথায় কোথায় ভুল হচ্ছে, তাদের পরামর্শ দিই।
আমি বললুম, কাল রাত্রেই আমি বেল্লা আখমাদুলিনা-র একটি কবিতা পড়েছি, তার নাম 'সামথিং এলস', চমৎকার কবিতা! এই কবিতাটির সেরকম কোনও বিষয়বস্তুই নেই, কবিতা লিখতে না পারার দুঃখ নিয়ে লেখা। এটাই তো একটা নতুন ফর্ম, পুরোনো ফর্মের প্রতিবাদ!
সম্পাদক মশাই আবার জোর দিয়ে বললেন, আমাদের নতুন লেখকরা যাতে আদর্শবাদ, সম-ভ্রাতৃত্ব, বিশ্বশান্তি নিয়ে লেখে, সেটাই আমরা চাই...
সম্পাদক মশাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি আমার ঠিক মনঃপূত হল না। যেন তিনি একটি উঁচু আসনে বসে তরুণ লেখকদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। অবশ্য এমনও হতে পারে, ভাষার ব্যবধানের জন্য আমরা পরস্পরের বক্তব্য ঠিক বোঝাতে পারিনি।
চা খেয়ে আমরা বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালুম। আমাদের পাশেই আর একজন অত্যন্ত রূপবান যুবক আগাগোড়া চুপ করে বসেছিল। আমি ভেবেছিলুম সে ইংরেজি জানে না। তার সঙ্গে করমর্দন করতে যেতেই সে নিখুঁত ইংরেজি উচ্চারণে বলল, চলুন, আমি আপনাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছি।
এই যুবকটি এখানকার এ পি এন অফিসের একজন কর্মী। এত সুন্দর চেহারা, ওকে চলচ্চিত্রের নায়ক হলেই যেন মানাত। ওর ব্যবহারও খুবই ভদ্র। সে আমাকে জিগ্যেস করল, লেনিনগ্রাড আপনার কেমন লাগল?
আমি বললুম, খুবই তো ভালো লাগছে। মে-দিবসের প্যারেড দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু এত বড় শহর, এখানে কত কী দেখার আছে, কিন্তু অনেক কিছুই দেখা হল না। তাই একটা অতৃপ্তি থেকে যাচ্ছে।
যুবকটি বলল, নিশ্চয়ই এখানে অনেক কিছু দেখবার আছে। তবে এখন ছুটির সময় চলছে, তা ছাড়া বৃষ্টি পড়ছে।
সারগেই বলল, আজ সন্ধেবেলাতেই আমাদের চলে যেতে হবে।
আমি বললুম, হারমিটেজ মিউজিয়াম কিন্তু দেখতেই হবে।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করা সম্ভব নয়। আমরা একটা ট্যাক্সি ধরে নিলুম।
হারমিটেজ মিউজিয়ামটিকে কেউ-কেউ ফরাসি কায়দায় 'অ্যারমিতাঝ' বলে। আমি 'অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী' স্মরণ করে চট করে বিদেশি উচ্চারণের অনুকরণে সাহস পাই না, ইংরিজিতে সন্তুষ্ট থাকি।
এই হারমিটেজ মিউজিয়াম উইন্টার প্যালেসের সংলগ্ন, সেটাও এখন মিউজিয়াম। এই দুটি প্রাসাদ মিলে যে মিউজিয়াম তা বিশ্বে বৃহত্তম। এর পুরোটা সাতদিনেও দেখে শেষ করা বোধহয় সম্ভব নয়, আমাদের হাতে আছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা।
সারগেই বলল, এই মিউজিয়ামে অনেক ভারতীয় ঐতিহাসিক জিনিসপত্তর আছে শুনেছি, চলুন আগে সেগুলো দেখে নিই।
আমি বললুম, সারগেই, আমি ইন্ডোলজিস্ট নই। আমাদের দেশেই যা ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি আছে, তার অনেক কিছুই এখনও দেখা হয়নি। বিদেশে এসে ভারতীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার আগ্রহ আমার নেই। এত বড় মিউজিয়ামে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে গেলে ক্লান্ত হয়ে যাব। আমি কি দেখব তা আগেই ঠিক করে রেখেছি। আমি জানি, ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের কিছু ভালো কালেকশান আছে এখানে, আমি শুধু সেগুলিই দেখতে চাই, যা পৃথিবীর আর অন্য কোথাও দেখা যাবে না।
সারগেই একটু কৌতূহলী চোখে তাকাল আমার দিকে। তারপর জিগ্যেস করল, ফরাসি ছবি সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহ হল কী করে? আপনারা কি আপনাদের দেশে ওরিজিনাল ছবি দেখতে পান?
আমি হেসে বললুম, না, আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। আমাদের দেশে যারা ফিলমে উৎসাহী, বার্গমান, ফেলিনি, গদার, বনুয়েল, ওয়াইদা, কুরোশোওয়া-র নাম তাদের মুখে-মুখে, তাদের সব ছবির কাহিনি ও ট্রিটমেন্টের অভিনবত্ব তাদের মুখস্থ, যদিও ওঁদের ফিলম দেখার সুযোগ নেই। কালেভদ্রে যে দু-চারটি ছবি দেখানো হয় তাও দশ-পনেরো বছরের পুরোনো। যারা শিল্প ভালোবাসে, তারা মাতিস, পিকাসো, ব্রাক, রুয়ো, মার্ক শাগাল-এর নামে প্রায় উন্মাদ, যদিও ওঁদের ওরিজিনাল ছবি প্রায় কেউ-ই দেখেনি। কিন্তু সেটা কি দোষের? আমাদের গরিব দেশ বলে পৃথিবীর শিল্প-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ ফসলগুলি আমাদের কাছে পৌঁছয় না। কিন্তু শ্রেষ্ঠ জিনিস সম্পর্কে আমাদের যে আগ্রহ ও কৌতূহল আছে, সেটা কি কম কথা?
সারগেই বলল, সত্যি খুব আশ্চর্য ব্যাপার!
মিউজিয়ামে ঢুকে অন্যান্য ভালো ভালো জিনিস বাদ দিয়ে আমরা চলে এলুম ছবির ঘরের দিকে।
জারদের আমলেই মূল্যবান ছবির সংগ্রহ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাতসিরা তস্করবৃত্তি করে নানান দেশ থেকে যেসব বিখ্যাত ছবি নিজেরা কুক্ষিগত করে রেখেছিল, বার্লিন জয়ের পর রেড আর্মি তার অনেকগুলি দখল করে নেয়। সব মিলিয়ে এখানে বহু ছবির দুর্লভ সমাবেশ।
ঘুরতে-ঘুরতে আমি চমৎকৃত হয়ে গেলুম সারগেই-এর ছবি সম্পর্কে জ্ঞান দেখে। মাত্র বাইশ বছর তার বয়েস, কিন্তু সে গত শতাব্দীর ছবির জগতের নানান আন্দোলন, প্রত্যেক শিল্পীর আলাদা বৈশিষ্ট্যের কথা জানে। আমার থেকে অনেক বেশিই জানে। আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছিল, সে আমাকে ডেকে দুই দেয়াল ভরতি দেগা-র অনেকগুলি ছবি দেখাল। মোনে ও মানে-র ছবি বোঝাল আলাদা করে। আমি দেখতে চাইছিলুম ক্যান্ডিনস্কির ছবি, তার খোঁজে সে ঘুরতে লাগল এঘর ওঘর।
এইসব ছবি বিশেষ মূল্যবান এই কারণে যে এইসব ছবির প্রিন্টও খুব দুর্লভ।
সারগেই একবার আমাকে ডেকে জিগ্যেস করল, আপনার টিনটেরেট্টোর ছবি ভালো লাগে না? এই দেখুন—
আমার মজা লাগল। একটি কিশোরপাঠ্য গোয়েন্দা কাহিনি লিখে আমাদের দেশে টিনটেরোট্টোকে নতুন করে জনপ্রিয় করেছেন সত্যজিৎ রায়। এখানে টিনটেরেট্টোর একাধিক ছবি আছে। তার মধ্যে একটি আবার যিশুর!
কখন দু-ঘণ্টা পার হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। সারগেই আমাকে মাঝে মাঝে তাড়া দিচ্ছে, আমাদের সন্ধের সময় ট্রেন ধরতে হবে। আরও অনেক ছবি দেখা বাকি, সেইজন্য একটু দ্রুত পা চালাতে হল। এক সময় একটি নারীর ভাস্কর্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম। শিল্পীর নাম আমার চেনা নয়। কিন্তু মূর্তিটি অপূর্ব!
তারপর এক সময় আমি সারগেইকে হারিয়ে ফেললুম।
৭
এত বড় মিউজিয়ামের মধ্যে কাউকে হারিয়ে ফেললে খুঁজে বার করা শক্ত। সারগেইকে দেখতে না পেয়ে আমি ভাবলুম এই সুযোগে আরও বেশি করে হারিয়ে যাওয়া যাবে, তাহলে আরও বেশিক্ষণ ছবি দেখা যাবে। সন্ধেবেলা ট্রেন ধরতে হবে বলে সারগেই তাড়া দিচ্ছিল, ঠিক ক'টার সময় ট্রেন তা আমি জানি না।
আর দু-একটা ঘর ঘোরার পর আমার মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। সারগেই একটুতেই নার্ভাস হয়ে যায়। এতক্ষণ ও আমায় কোথায় খোঁজাখুঁজি করছে কে জানে! আমাদের বেরিয়ে পড়বার কথা ছিল, ও নিশ্চয়ই আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে।
মিউজিয়াম থেকে বাইরে এসে দেখি সেখানেও সারগেই নেই। ফাঁকা রাস্তা, শন-শন করে হাওয়া দিচ্ছে। ওভারকোটের কলার তুলে পকেটে দু-হাত গুঁজে আমি পায়চারি করতে লাগলুম। অচিরেই আমি অন্তর্হিত হয়ে গেলুম লেনিনগ্রাড থেকে। এখন আমি কায়রোর রাস্তায়। কেন হঠাৎ কায়রোর কথা মনে পড়ল তা কে জানে, কায়রোতে আমি গেছি অনেককাল আগে, এবং লেনিনগ্রাডের সঙ্গে কায়রোর কোনওরকম মিল নেই।
কায়রোতে একদিন আমি হোটেলের রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলুম, ঠিকানাটাও মনে ছিল না। একজন ট্রাফিক কনস্টেবলের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করেছিলুম সে আমায় কোনও সাহায্য করতে পারবে কি না! পুলিশটি কোনও উত্তর না দিয়ে আমার হাত ধরে টানতে-টানতে নিয়ে চলল। আমি তো হতভম্ব। ডিউটির সময় তার সঙ্গে কথা বলে আমি অপরাধ করে ফেলেছি? সেইজন্য সে আমায় গ্রেপ্তার করল? পুলিশটি আমায় নিয়ে এল একটি দর্জির দোকানের সামনে এবং দর্জিকে ডেকে কী সব বলল। তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হল, ওই দর্জি ইংরিজি জানে, সে আমায় সাহায্য করবে। ততক্ষণে সে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়ে গেছে।
আমি আবার লেনিনগ্রাডে ফিরে এলুম। এখানে রাস্তা হারাবার কোনও আশঙ্কা নেই। নদীর ধার দিয়ে হেঁটে গেলে আমার হোটেল খুঁজে পাবই। কিন্তু সারগেই গেল কোথায়?
মিনিট দশেক বাদে সারগেই বেরিয়ে এল। উদভ্রান্তের মতন চেহারা, রীতিমতন হাঁপাচ্ছে সে। আমার কাছে এসে ফুঃ করে মুখ দিয়ে বিরাট নিশ্বাস ছেড়ে সে বলল, সুনীলজি, কী হয়েছিল! আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
আমি মুচকি হেসে বললুম, আমি ইচ্ছে করেই তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে পড়েছিলুম। তোমার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ পর দেখা হলে আমরা ট্রেন মিস করতুম, তা হলে ভালোই হত, আরও দু-একদিন থেকে যাওয়া যেত লেনিনগ্রাডে। আমার আজই লেনিনগ্রাড ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
সারগেই বলল, আমাদের যেসব প্রোগ্রাম করা আছে। ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং, অ্যাপয়েন্টমেন্টস!
আমি বললুম, চলো।
সারগেই একবার মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে দেখতে না পেয়ে আবার ভেতরে ঢুকেছিল, তারপর প্রায় দৌড়ে গোটা মিউজিয়ামটাতেই আমাকে খুঁজে দেখে এসেছে।
হোটেলে ফিরে আমরা তৈরি হয়ে নিলুম তাড়াতাড়ি।
শীতের দেশে এলে মোটাসোটা জামাকাপড় আনতে হয়, তাই আমার সুটকেসটি বেশ ভারী। যাতে বইতে না হয় সেজন্য তলায় চাকা লাগানো। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দিয়ে আমি সুটকেসটার টিকি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছি আর ঘর্ঘর-ঘর্ঘর শব্দ হচ্ছে, লোকজনরা ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। যদি অন্যদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, তা হলে আর চাকা লাগাবার মানে কী? সুটকেসটা আমি তুলে নিলাম।
আমাদের দেশের রেল স্টেশনগুলিতে মৌমাছির ভনভনের মতন সবসময় একটানা একটা আওয়াজ শোনা যায়। শ্বেতাঙ্গ জাতিরা প্রকাশ্য স্থানে নীরবতা পছন্দ করে। এত বড় স্টেশন, এত মানুষ, অথচ প্রায় কোনও শব্দই নেই। হকারদের চ্যাঁচামেচির তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
কিছু-কিছু মানুষ স্বভাবেই ব্যস্তবাগীশ। ট্রেন বা প্লেন ধরতে হলে সারাদিন ধরে তাদের উৎকণ্ঠা থাকে। যদি ঠিক সময় পৌঁছনো না যায়, রাস্তা জ্যাম হয়, এইজন্য তারা রওনা হয় অনেক আগে। সারগেইও অনেকটা সেইরকমের। আমাদের ট্রেন ছাড়তে এখনও পুরো এক ঘণ্টা বাকি।
রাত্রির ট্রেনে সকলেরই শুয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। আমাদের কুপেতে চারটে বার্থ। অন্য দুজন এখনও এসে পৌঁছয়নি। প্রতিটি বার্থেই রয়েছে বেশ পুরু তোষকের বিছানা ও কম্বল। এই কুপের মধ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ, তার জন্য বাইরে আলাদা জায়গা আছে।
ট্রেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে অন্য দুজন যাত্রী এসে পৌঁছল। যাত্রী নয়, যাত্রিনী, দুজনেরই বয়েস তিরিশের মধ্যে, বেশ সুসজ্জিত। এরা কি দুই বোন, না দুই বান্ধবী? বোঝবার কোনও উপায় নেই। সারগেই-এর সঙ্গে তারা রুশ ভাষায় মামুলি দু-একটা কথা বলল মাত্র, গল্প করার কোনও উৎসাহ দেখাল না, দুজনে দুটি বই খুলে বসল।
চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে আমি তাকিয়ে রইলুম বাইরে। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, কিন্তু বাইরে কোনও অন্ধকার নেই। লেনিনগ্রাড শহর হোয়াইট নাইটসের জন্য বিখ্যাত, যে সময় সারা রাতে অন্ধকার নামে না। এখন অবশ্য সে সময় আসেনি।
একটু বাদে একজন যুবতী সারগেইকে কিছু বলতেই সারগেই আমাকে জানাল, চলুন সুনীলজি, আমরা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।
আমরা বাইরে যেতেই মেয়ে দুটি দরজা বন্ধ করে দিল। বুঝলুম ওরা রাত্রির জন্য পোশাক বদলে নিচ্ছে। আমাদের অবশ্য পোশাক বদলাবার প্রশ্ন নেই, যা পরে আছি, সেই সুদ্ধুই শুয়ে পড়ব। সারগেইকে প্রথম দিন যে চামড়ার কোটটা পরতে দেখেছি সেটা আর সে ছাড়েনি।
বাইরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাতেই অন্য একজন লোক এসে আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট চাইল। আগেও কয়েকবার আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এটা বেশ মজার লাগে। আমার সিগারেট ফুরিয়ে গেল আমিও নিশ্চয় যেকোনও একজনের কাছ থেকে সিগারেট চাইতে পারি বিনা দ্বিধায়।
লোকটি কিছু জিগ্যেস করল আমাকে। সারগেই অনুবাদ করে বোঝাল যে, লোকটি জানতে চাইছে, আমি কি এদেশে নতুন এসেছি, আমার এ দেশ কেমন লাগছে?
অনুবাদে আড্ডা জমে না, কুপের দরজা খুলতেই আমরা চলে এলুম ভেতরে। যুবতী দুটি পোশাক বদল করে আবার বই খুলে বসেছে। আমার হ্যান্ডব্যাগে কোনও বই নেই। এখন সুটকেস খোলা এক বিড়ম্বনা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। তারপর এক সময় একটি মেয়ে সারগেইকে কিছু বলতেই সে আমায় জানাল, সুনীলজি, এখন আলো নিবিয়ে দিলে আপনার কোনও আপত্তি আছে?
আমি বললুম, না, না, আপত্তি কেন থাকবে?
যদিও এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার কোনও বাসনা আমার ছিল না। ইচ্ছে করছিল কিছুটা গল্পগুজব করতে। মেয়ে দুটির সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই। ভাষা জানি না। সারগেই নব বিবাহিত যুবক, অন্য মেয়েদের প্রতি তার বোধহয় কোনও ঔৎসুক্য নেই এখান।
ট্রেনে আমার ভালো ঘুম আসে না। সারারাত ধরে আমি প্রায় তিনশো স্বপ্ন দেখলুম। একটি প্রকাণ্ড স্বপ্নমালা বলা যায়।
সকাল বেলা কোনও স্টেশন থেকে চা বা কফি কেনার দরকার হয় না। যে মহিলা কন্ডাকটর গার্ড কাল রাত্রে আমাদের টিকিট পরীক্ষা করতে এসেছিলেন, তিনিই সকালবেলা নিজে হাতে করে আমাদের জন্য কফি নিয়ে এলেন। এই কফির দাম বোধহয় টিকিটের মধ্যেই ধরা থাকে।
সকাবেলা যুবতী দুটি মুখ খুলল, টুকিটাকি প্রশ্ন করতে লাগল আমাদের। দেখা গেল, এদের মধ্যে একজন ইংরিজি জানে। যাঃ, তা হলে তো এর সঙ্গে অনায়াসেই ভাব জমানো যেত। কিন্তু এখন আর সময় নেই, রিগা স্টেশন প্রায় এসে গেছে।
এক একজন লোককে দেখলেই মনে হয় বেশ সুরসিক। এ পি এন-এর যে প্রতিনিধি আমাদের রিসিভ করতে এসেছেন স্টেশনে, তাঁর মুখখানাও সেরকম। ছাতা হাতে ছিপছিপে চেহারার ভদ্রলোক আমাকে বললেন, আপনি যে ক'দিন এখানে থাকবেন, আপনার খুব টাইট প্রোগ্রাম, সব জায়গাতেই যেতে হবে, বিশ্রামের সুযোগ পাবেন না। এখন হোটেলে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিন, দশটার সময় আমরা আবার আসব।
আমি কিন্তু ক্লান্ত বোধ করছি না একটুও। শরীরটা বেশ হালকা হালকা লাগছে। গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা মিহি বাতাসের স্পর্শ, তার আমেজই আলাদা।
হোটেল ল্যাটভিয়া বেশ আধুনিক কায়দার হোটেল, কিন্তু এর সামনে নদী নেই। সাততলার ওপরের ঘর থেকে দেখতে পাওয়া যায় সামনের ব্যস্ত রাস্তা ও একটি বিশাল গির্জার অঙ্গন।
ল্যাটভিয়া রাশিয়ার মধ্যে নয়, একটি স্বতন্ত্র রাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি রাষ্ট্র। অবশ্য রাশিয়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক খুবই নিবিড়, এখানকার প্রধান কবি জ্যানিস রেইনিস-এর ভাষায় ''মুক্ত রাশিয়ার মধ্যে মুক্ত ল্যাটভিয়া।''
ল্যাটভিয়ার জনসংখ্যা মাত্র পঁচিশ লক্ষ, আমাদের পশ্চিমবাংলার অনেক জেলার জনসংখ্যাই এর চেয়ে বেশি। তবু এই ছোট রাজ্যটি নিয়েই ইতিহাসে অনেক রকম রাজনৈতিক খেলা চলেছে। মধ্য শতাব্দীতে এই ল্যাটভিয়া ছিল জার্মান ফিউডালদের শাসনে। তখন দমন ও অত্যাচার ছিল চরম। ল্যাটভিয়ানরা মূলত ছিল লুথেরান, তাদের ওপর জোর করে ক্যাথলিক মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হত। দোম ক্যাথিড্রালের সামনের ময়দানে ক্যাথলিক সাধুরা শত-শত লোককে ধর্মদ্বেষের নামে পুড়িয়ে মেরেছে। সেই সময় জার্মানদের চোখে ল্যাটভিয়ানরা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাশিয়ান সম্রাট পিটার দা গ্রেট-এর বিজয়ীবাহিনী ল্যাটভিয়াকে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করে নেয়। সেই সময় রিগা হয়ে ওঠে রাশিয়ার একটি প্রধান বন্দর। জারদের আমলে ল্যাটভিয়ার ব্যবসায়ী শ্রেণির সমৃদ্ধি হয়েছিল বটে, কিন্তু শ্রমিক-কৃষকদের অবস্থা বিশেষ কিছু বদলায়নি।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জার্মান সম্রাট কাইজার ল্যাটভিয়াকে আবার দখল করে নেবার লোভ করেছিল। ব্যাবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র এবং কাঁচা মাল সরবরাহের জন্য ল্যাটভিয়ার গুরুত্ব ছিল। এখানকার বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলের টান ছিল রুশ বিপ্লবীদের দিকে। অক্টোবর রিভোলিউশানে অনেক ল্যাটভিয়ান যুবকও অংশগ্রহণ করেছিল। সামরিক জার্মান অবরোধের বিরুদ্ধে ল্যাটভিয়ান রাইফেলম্যানরা বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে ল্যাটভিয়া নিজেকে স্বাধীন সোভিয়েত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।
কিন্তু পাঁচ মাস পরেই ল্যাটভিয়াতে আবার পালা বদল শুরু হয়। জার্মানির সহযোগিতায় ল্যাটভিয়ার সোভিয়েত-বিরোধী হোয়াইট গার্ডরা আবার ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারপর সুদীর্ঘকাল ধরে ল্যাটভিয়াতে বিপর্যয় চলতে থাকে, এই রাজ্যটি আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ফিরে আসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, সে ইতিহাস অনেকেরই জানা।
একটা জিনিস এখানে এসে বারবার মনে হচ্ছে, পুরোনো ঐতিহ্য রক্ষায় সোভিয়েত নাগরিকরা খুবই তৎপর। লেনিনগ্রাডের মতন রিগা শহরেও প্রচণ্ড তাণ্ডব চলেছিল, এখন তার কোনও চিহ্নই নেই। শুধু তাই নয়, বোমার আঘাতে যেসব ঐতিহাসিক অট্টালিকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেখানে কিন্তু নতুন বাড়ি ওঠেনি, অবিকল আগের বাড়িটাই পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
রিগা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন সুদৃশ্য শহর। হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা প্রথমে শহরটা ঘুরে দেখতে বেরুলুম, শহরটা দেখতে তো সুন্দর বটেই, তা ছাড়া আমার আর একটা অনুভূতিও হল, আমি এখানে খুব সহজ ও সাবলীল বোধ করছি। কোনও নতুন জায়গায় গেলে কাঁধ দুটো একটু উঁচু হয়ে থাকে। কে কী ভাবছে, কেউ আমাকে লক্ষ করছে কি না, কোনও আদবকায়দায় ভুল করে ফেললুম কি না, এইসব ভেবে সবসময় একটা সতর্ক ভাব বজায় রাখতে হয়। এখানে সেই ব্যাপারটা নেই। যে-কোনও অচেনা লোকের সামনে দাঁড়ালেই একটা পারস্পরিক তরঙ্গ বিনিময় হয়। অর্থাৎ সে আমাকে প্রথম দর্শনেই অপছন্দ করছে কি না তা আমরা বুঝে যাই। এখানে শুধু রিগায় নয়, লেনিনগ্রাড ও মস্কোতেও সেই তরঙ্গ বিনিময় বেশ সন্তোষজনক। যে-কোনও লোকের সঙ্গেই কথা বললে বোঝা যায়, ভারতীয়দের সম্পর্কে এখানে কোনও বিরূপ মনোভাব বা অবজ্ঞার ভাব নেই।
রিগা শহরের কেন্দ্রে রয়েছে তিন ল্যাটভিয়ান রাইফেলম্যান-এর ভাস্কর্য। বিপ্লবের সময়ে এরাই প্রথমে এগিয়ে যায়, সেই সম্মানে এদের মূর্তি বসানো রয়েছে। শহরের যে-কোনও জায়গা থেকে দেখা যায় প্রাচীন দোম ক্যাথিড্রালের চূড়া। এখন এই ক্যাথিড্রালটিকে অর্গান রিসাইটালের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
শহরের মাঝখানে একটি খুব পুরোনো পাড়াকে অবিকৃত রাখা হয়েছে। সরু সরু গলি, ছোট ছোট দোতলা বাড়ি, খোয়া পাথরের চত্বর। আমার সঙ্গীদের কাছে শুনলুম, পুরোনো ইউরোপের পট-ভূমিকায় যেসব সিনেমা তোলা হয় তার অনেকগুলিরই শুটিং-এর জন্য পরিচালকরা রিগা শহরে আসেন।
এই পাড়ারই একটি ছোট রেস্তোরাঁয় আমরা গেলুম কফি খেতে। এই রেস্তোরাঁর নাম 'ড্রপ', গেটের কাছে কোট জমা রাখতে হয়, ভেতরটা অন্ধকার-অন্ধকার। টেবিলে টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। এই দোকানটির কফি নাকি খুব বিখ্যাত, ছেলে-ছোকরারা খুব আসে এখানে।
কালো গাউন পরা দীর্ঘকায়া এক যুবতী এল আমাদের কাছে অর্ডার নিতে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা। আমি যদি এই শহরের নাগরিক হতুম, তা হলে ওই রেস্তোরাঁয় নিশ্চয়ই রোজ কফি খেতে আসতুম।
সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলুম নদীর ধারে। যে-কোনও শহরে এলেই আমার একবার নদী দেখে নিতে ইচ্ছে করে। এখানকার নদীর নাম ডাংগোভা। নদীটি তেমন প্রশস্ত নয়, তবু এর ওপরে একাধিক সেতু, দূরের একটি সেতু বেশ আধুনিক কায়দার।
এই নদীর ধার থেকে শহরটাকে অনেকখানি দেখা যায়। শুধু প্রাচীন বাড়ি নয়, নতুন বাড়িও উঠেছে অনেক। মস্কোতে হোটেল ইউক্রাইনের বাড়িটি যেরকম, সেরকম একটি বাড়ি এই শহরেও দূর থেকে চোখে পড়ে। স্তালিন আমলে এই ধরনের কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছিল।
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আমরা এলুম একটি হোটেলে, দুপুরের আহার সেরে নেবার জন্য। হোটেলটির নাম 'ব্লু উইন্ড'। এখানে আমরা এ পি এন-এর নিমন্ত্রিত অতিথি। এ পি এন-এর স্থানীয় শাখার কর্তা এবং আরও কয়েকজন এসেছেন।
এই হোটেলটিও পুরোনো কায়দায় সজ্জিত। চাপা আলো। বড়-বড় পিঠ-উঁচু চেয়ার। চেয়ারগুলি ঠিকমতন সাজাতে গিয়ে একাট চেয়ার উলটে পড়ে গেল সশব্দে। এই ব্যাপারটা বেশ পছন্দ হল আমার। সবকিছু ঠিকঠাক চলার মধ্যে একটা কিছু হঠাৎ গণ্ডগোল হয়ে গেলে বেশ হয়। সবাই আমরা ভদ্র-মার্জিত ব্যবহার করছিলুম, এর মধ্যে একটা চেয়ার পড়ে যাওয়ায় সবাই একসঙ্গে চুপ।
সব সাজিয়ে ঠিকঠাক করে বসা হল। তবু তক্ষুনি খাবারের অর্ডার দেওয়া যাচ্ছে না। নিমন্ত্রণ কর্তাদের একজন বললেন, আমরা আর একজনের জন্য অপেক্ষা করছি, তিনি এক্ষুনি এসে যাবেন।
তখনও আমি জানি না, একটা বেশ চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
৮
একজন শীর্ণকায় প্রৌঢ় ব্যক্তি এলেন একটু পরে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় অধ্যাপক। গাড়ি-ঘটিত কারণে দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য সকলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি আমার দিকে ফিরে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, নমস্কার, কেমন আছেন?
সুদূর রিগা শহরে বসে একজন ল্যাটভিয়ান অধ্যাপকের মুখে বাংলা ভাষা শুনলে রোমাঞ্চিত হতেই হয়।
এঁর নাম ভিকটর ইভবুলিস, ইনি ল্যাটভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কোনও সরকারি প্রয়োজনে বাংলা শেখেননি। শিখেছেন নিজের আগ্রহে, মূল বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ পড়বার জন্য।
আলেকজান্ডারের গুরু তাঁকে বলেছিলেন, তুমি যেখানেই যাও, যত কিছুই দেখো, শেষ পর্যন্ত দেখবে মানুষের চেয়ে বিস্ময়কর আর কিছুই নেই! ছোট্ট দেশ ল্যাটভিয়া, যার জনসংখ্যাই মাত্র পঁচিশ লাখ, সেখানকার একজন মানুষ প্রাচ্যের কবি রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ করবার জন্য বাংলার মতন একটি দুরূহ ভাষা শিখেছেন নিজের চেষ্টায়, এটা বিস্ময়কর নয়?
খাওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে নানারকম গল্প হতে লাগল। আজ একেবারে ফুল কোর্স লাঞ্চ। সুপ দিয়ে আরম্ভ, সুইট ডিস দিয়ে শেষ, সঙ্গে ওয়াইন। এখানকার খাবারে প্রথম দিকে থাকে দু-একটি কোল্ড ডিস, অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের চিজ, হ্যাম, স্মোকড ফিস, কয়েক রকমের স্যালাড। তারপর আসে মেইন ডিস বা হট ডিস, রোস্ট চিকেন বা বিফের নানারকম রূপান্তর, বড়-বড় মাছও পাওয়া যায়।
অধ্যাপক ইভবুলিস মাঝে-মাঝে আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলছেন, অন্যদের সঙ্গে কখনও ইংরিজিতে, কখনও রাশিয়ানে; এ ছাড়া তিনি ফরাসি ও জার্মান জানেন, তাঁর মাতৃভাষা ল্যাটভিয়ান। ইনি মাতৃভাষায় রবীন্দ্রনাথের ওপর বই লিখেছেন, পরে তা রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কিছুদিনের জন্য শান্তিনিকেতনেও থেকে গেছেন কয়েক বছর আগে, কলকাতা সম্পর্কে ওঁর অভিজ্ঞতা বেশ মজার। উনি যখন কলকাতায় আসেন, সেই বছরেই কলকাতায় বন্যা হয়েছিল, তিন-চারদিন পথ-ঘাট ও অনেক বাড়িই বেশ খানিকটা জলের তলায় ছিল।
অন্যরা আমাদের কথাবার্তা কৌতূহলের সঙ্গে শুনছিলেন, একজন জানতে চাইলেন, আচ্ছা, তোমাদের কলকাতাতেই তো মেট্রো-রেল হচ্ছে?
এই নিয়ে এই প্রশ্ন আমি তিনবার শুনলুম বিভিন্ন জায়গায়। কলকাতার উল্লেখ শুনেই কেউ কেউ এই কথাটা জিগ্যেস করেন। যেন এটাই কলকাতার একমাত্র পরিচয়। পৃথিবীর বহু শহরেই মেট্রো রেল আছে, সুতরাং কলকাতায় মেট্রো-রেল হওয়া এমনকী বিশেষ সংবাদ?
পালটা প্রশ্ন করে আমি ব্যাপারটা জেনে নিলুম। আসলে, কলকাতা সম্পর্কে বিশেষ কিছুই কেউ জানে না। তবে আমাদের মেট্রো রেলের প্রাথমিক স্তরে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা এসে নানারকম সুপরিশ করেছেন, মস্কো শহরের মাটির সঙ্গে কলকাতার মাটির খানিকটা মিল আছে বলে কোন ধরনের পাতাল রেল এখানে উপযোগী হবে, সে ব্যাপারে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা পরিকল্পনায় সাহায্যে করেছেন, সেই খবর এখানকার পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সুতরাং কলকাতা সম্পর্কে অনেকে শুধু ওই সংবাদটাই জানে।
আমি বললুম, কলকাতায় বন্যা হয়েছিল শুনে আপনারা ভাবছেন পাতাল রেল চালু হওয়ার পর আবার যদি বন্যা হয়, তখন কী হবে? তখন কী যে হবে, তা আমিও জানি না!
অধ্যাপক ইভবুলিস বললেন, কলকাতার যানবাহনে অনেক গোলমাল, আলোর ব্যবস্থা বড়ই খারাপ...।
বাংলাভাষা-প্রেমিক এই ল্যাটভিয়ান অধ্যাপক কলকাতায় এসে যে অনেক অসুবিধে ভোগ করেছেন তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে দুঃখের সুর ছিল, অভিযোগের নয়।
আমাকে আরও চমকে দিয়ে তিনি এরপরেই বললেন, আপনাদের 'দেশ' পত্রিকা আমি মাঝে মাঝে পড়ি। দেশ পত্রিকায় আমার সম্পর্কে লেখা হয়েছে, সে সংখ্যাটিও আমার কাছে আছে।
বেশ কয়েক বছর আগে অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী এসেছিলেন এই রিগা শহরে, অধ্যাপক ইভবুলিসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। রিগা-র অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন দেশ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায়, সে লেখাটি আমিও পড়েছিলাম, তবে অনেকদিন আগের কথা, ভালো মনে নেই।
অধ্যাপক ইভবুলিস তাঁর বাড়িতে সন্ধেবেলা আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন। দুপুরে হোটেলে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে এবং বিকেলবেলা শহরটায় খানিকটা ঘোরাঘুরি করে তারপর যখন নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, তখন সারগেই বলল, একটু দাঁড়ান, সুনীলজি!
দৌড়ে সে কোথায় চলে গেল, একটু বাদেই সে ফিরে এল কয়েকটি ফুল নিয়ে। তুষারশুভ্র কয়েকটি টিউলিপ ফুল, সেলোফিন কাগজে সুন্দর করে মোড়া। সারগেই বলল, অধ্যাপকের স্ত্রীর হাতে আপনি এটা দেবেন।
এর আগে রাস্তায় অনেককেই আমি এরকম ফুল হাতে নিয়ে যেতে দেখেছি। বড় বড় মোড়ে ফুলের দোকান। এদেশে কারুর বাড়িতে দেখা করতে গেলেই ফুল নিয়ে যাওয়া প্রথা। বিমান-যাত্রীদেরও আমি ফুল নিয়ে নামতে দেখেছি, প্রিয়জনের সঙ্গে প্রথম দেখা হতেই আগে তার হাতে ফুল তুলে দেয়। গাদাগুচ্ছের ফুল নয়, একটি বা দুটি বা তিনটি।
সোভিয়েত দেশে প্রত্যেক শহরেরই বাইরের দিকে প্রচুর ফ্ল্যাট বাড়ি উঠছে। প্রায় একই রকম চেহারা। সারা দেশের প্রতিটি পরিবারকে ফ্ল্যাট দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন সরকার, সে তো এক বিস্ময়কর, বিরাট কর্মযজ্ঞের ব্যাপার।
সারগেই আগে কখনও রিগা শহরে আসেনি, তার পক্ষে ঠিকানা খুঁজে বার করা কঠিন হত, তাই এ পি এন-এর একজন প্রতিনিধি নিয়ে এলেন আমাদের। তবু যাতে আমাদের চিনতে অসুবিধে না হয় সেইজন্য অধ্যাপক ইভবুলিস নিজেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তায়।
স্বাভাবিক কারণেই এইসব ফ্ল্যাটবাড়িগুলি বহুতল। ছোট-ছোট লিফট, এক সঙ্গে তিনজনের বেশি ধরে না। একজনকে অপেক্ষা করতে হবে, অধ্যাপক ইভবুলিস নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের আগে তুলে দিলেন।
আগেই জেনেছিলুম, অধ্যাপকের স্ত্রী মাদাম আর্তা দুমপেই একজন নামকরা ভাস্কর। দরজা যিনি খুললেন, তিনি একজন সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী রমণী, যৌবন এখনও উত্তীর্ণ হয়নি। আমি তাঁর হাতে ফুল তুলে দিতেই তিনি সহাস্যে আমাদের ভেতরে আহ্বান জানালেন।
প্রথমেই আমরা দেখতে গেলুম তাঁর স্টুডিও। সেখানে পা দেওয়া মাত্র ডানদিকের একটি মূর্তি দেখিয়ে অধ্যাপক ইভবুলিস জিগ্যেস করলেন, এটা কার, চিনতে পারেন?
আর একটি চমক। মূর্তিটি রবীন্দ্রনাথের।
ঘরে ছোট-বড় অনেক ভাস্কর্যের প্লাস্টার কাস্টিং রয়েছে, কিছু-কিছু মূর্তি অসমাপ্ত। বাস্তবানুগ কাজও যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক বিমূর্ত কাজ, নানান আকারের নারী মূর্তিও রয়েছে অনেক। কাজগুলির মধ্যে বলিষ্ঠতার সঙ্গে মিশে আছে কাব্য সুষমা। বেশ বড় একটা হল ভরতি মূর্তিগুলি ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগলুম আমরা।
ঘরটির ছাদ সাধারণ ঘরের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ উঁচুতে, ওপরের স্কাই লাইট দিয়ে আসছে প্রচুর আলো। একজন শিল্পীর স্টুডিও-র পক্ষে একেবারে আদর্শ। সাধারণ ফ্ল্যাট বাড়ির কোনও অ্যাপার্টমেন্ট কি এই রকম হয়!
এ বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করতেই অধ্যাপক ইভবুলিস বললেন, তাঁদের সরকার তাঁদের জন্য বিশেষ সুবিধে দিয়েছে, স্বামী ও স্ত্রীর জন্য দুটি আলাদ অ্যাপার্টমেন্ট বরাদ্দ করে তারপর দুটিকে একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এত বড় একটি অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া পঁচিশ রুবল। টাকার হিসেবে সাড়ে তিনশো টাকার কাছাকাছি। কলকাতায় এরকম একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া হবে অন্তত তিন হাজার টাকা, আমেরিকার কোনও ছোটখাটো শহরে আট-ন'শো ডলার তো হবেই। সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯২৮ সাল থেকে নাকি বাড়ি ভাড়া বাড়েনি। সরকারি ফ্ল্যাটের ভাড়া লাগে মাইনের শতকরা তিন টাকা। গ্যাসের জন্য খরচ ষোলো কোপেক। টেলিফোনের জন্য প্রতি মাসে বাঁধা দু-রুবল পঞ্চাশ কোপেক, তাতে যত ইচ্ছে লোকাল কল করা যায়। এক রুবলের ক্রয়-ক্ষমতার আন্দাজ খানিকটা এই ভাবে বোঝা যেতে পারে, এক রুবলে দশ কিলো আলু কিংবা এগারোটা ডিম কিনতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ এক কিলো আলু আর একটা ডিমের দাম প্রায় সমান। সরকার নিয়ন্ত্রিত বলে সারা বছরের জিনিসপত্রের দাম কখনও বাড়ে-কমে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে যে-কোনও ব্যক্তির নিম্নতম আয় দুশো রুবলের কিছু কম, মার্কিন দেশে সাড়ে আটশো ডলার, আর আমাদের দেশে নিম্নতম আয় বলে তো কিছুই নেই, শতকরা পঞ্চাশ জনেরই তো সারা বছরে রোজগারের কোনও ঠিক-ঠিকানাই থাকে না—তবু তারা বেঁচে থাকে।
মাদাম আর্তা দুমপেই খুবই খ্যাতনাম্নী ভাস্কর। তিনি বড় বড় মূর্তি গড়ার জন্য সরকারের কাছ থেকে ডাক পেয়েছেন অনেকবার। রিগা শহরের কোথায় কোন মূর্তি বসানো হবে, সে ব্যাপারে যে উপদেষ্টা কমিটি আছে, তিনি তার সদস্যা। এসব ছাড়াও তিনি নিজের শখেই ভাস্কর্যের কাজ করেছেন অনেক, তার নিয়মিত প্রদর্শনী হয় স্বদেশে ও বিদেশে। উনি ব্রোঞ্জ এবং পাথরের কাজ করেন। ওঁর কবজিতে নিশ্চয়ই খুব জোর আছে, কিন্তু মুখের হাসিটি বড় সরল।
ওঁদের একটি সন্তান। ষোলো-সতেরো বছরের সেই ছেলেটিকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে। মাদাম আর্তা দুমপেই নিজে ইংরেজি জানেন না। তবে ওঁদের ছেলে ইংরিজি শিখছে। তিনি ছেলেকে বললেন, খোকা, তুই এঁর সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বল-না!
কিন্তু ছেলেটি বেশ লাজুক, এই বয়েসের ছেলেরা যেমন হয়, সে দু-একটা কথা বলে ঘাড় নীচু করে রইল। এঁদের সংসারটি দেখে বেশ ভালো লাগে, স্বামী পণ্ডিত ও অধ্যাপক, সবসময় বইপত্তরের মধ্যে ডুবে আছেন, স্ত্রী কঠিন পাথর কেটে সৃষ্টি করছেন শিল্প, একটিমাত্র ছেলে এখন পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত।
ভিক্টর ইভবুলিস রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে বিশেষ খবর রাখেন না। অবশ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে চেনেন। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে ওঁর যথেষ্ট জ্ঞান আছে। এবং এ বিষয়ে ওঁর একটি থিয়োরিও আছে। ওঁর ধারণা ভারতী সাহিত্য ইওরোপীয় সাহিত্যকে নানাভাবে যথেষ্ট প্রভাবান্বিত করেছে। ইন্ডিয়ান ইনফ্লুয়েন্স অন ওয়েস্টার্ন লিটারেচার, এই শিরোনামে ওঁর বিস্তৃত প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আছে। অথচ, আমরা এর উলটোটাই ভাবি।
'দেশ' পত্রিকার সেই পুরোনো সাহিত্য সংখ্যাটি তিনি জমিয়ে রেখেছেন সযত্নে। ভূদেব চৌধুরীর প্রবন্ধটি দেখিয়ে আপশোশ করে উনি বললেন, এই দেখুন, আমার স্ত্রীর করা রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটির একটি ছবি এতে ছাপা হয়েছিল, কিন্তু পুরোটা নয়। অর্ধেক। এতে মূর্তিটি ঠিক বোঝা যায় না।
আমারও আপশোশ হল, আমি ক্যামেরাটা ভুল করে ফেলে এসেছি হোটেলে। এই মূর্তিগুলির এবং এই সুন্দর পরিবারটির অনেক ছবি তোলা যেত।
স্বামী-স্ত্রী মিলে আমাকে অনেকগুলি ছবি, বই ও নানান লেখার জেরক্স কপি উপহার দিলেন।
মাদাম আর্তা দুমপেই আমাদের খাওয়ালেনও খুব। ইনি একজন রন্ধন শিল্পীও বটে। নানান রকম খাবার করেছেন, তার মধ্যে মাংসের টুকরো, সবজি ও চিজ ফুটিয়ে একটা রান্নার স্বাদ অতি অপূর্ব।
বিদায় নেবার সময় ভিক্টর ইভবুলিস আমাকে বললেন, আমার এই ফ্ল্যাটে আপনিই দ্বিতীয় বাঙালি এলেন। এর আগে যিনি এসেছিলেন, তাঁকে আপনি নিশ্চয়ই চিনবেন না। তিনি লেখক নন, কিন্তু আমার খুব বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন।
যে-কোনও বাঙালিকে আমার পক্ষে চেনা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়, তবু আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই প্রথম বাঙালিটিকে আমি চিনতে পারলুম। এঁর নাম উদয় চট্টোপাধ্যায়, খড়গপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক, সাহিত্যপ্রেমিক, নিজেও কবিতা লেখেন। প্রবাসে এসে চেনা কারুর কথা শুনলে ভালো লাগে।
রাত্তিরে হোটেলে ফিরে সারগেই-এর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ এক সময় সে লাফিয়ে উঠল। এই যাঃ, দারুণ ভুল হয়ে গেছে তো!
আমি জিগ্যেস করলুম, কী হল?
দারুণ চিন্তিতভাবে সারগেই বলল, আমাকে এক্ষুনি একবার রেল স্টেশনে যেতে হবে। ট্রেনে কন্ডাকটর গার্ড আমাদের টিকিট পরীক্ষা করতে নিয়েছিল, সেই টিকিট তো আর ফেরত দেয়নি! আমাকে টাকা-পয়সার হিসেব রাখতে হবে, টিকিটের কাউন্টার পার্ট না দেখালে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট আমাকে ধরবে!
আমি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলুম, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ কালো। বললুম, এই রাত্তিরে তোমাকে আবার দৌড়োতে হবে স্টেশনে? সে তো বেশ দূরে!
সারগেই ক্ষুণ্ণভাবে বলল, যেতেই হবে, সুনীলজি। মহিলাটির উচিত ছিল না নিজে থেকেই আমাদের টিকিট ফেরত দেওয়া? সেটাই তো নিয়ম।
আমি জিগ্যেস করলুম, আমি যাব তোমার সঙ্গে?
সারগেই বলল, না, না, আপনি গিয়ে কী করবেন? আমার কতক্ষণ লাগবে তার ঠিক নেই। আজ রাত্তিরের ট্রেন যদি ছেড়ে চলে যায়, তাহলে হয়তো ওই মহিলাকে আর পাবই না।
সারগেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।
তারপর আমি ঘণ্টাখানেক বই পড়লুম। ভিক্টর ইভবুলিসের বাড়িতে খানিকটা ভদকা ও ব্র্যান্ডি পান করেছিলুম, তার প্রভাবেই কিনা জানি না, বেশ গরম লাগছে। উঠে খুলে দিলুম সব জানলা।
রিগা শহরে লেনিনগ্রাদের চেয়ে শীত অনেক কম। তবু বাইরে বেরুবার সময় গরম কোট সঙ্গে রাখতে হয়, এখানে যখন-তখন বৃষ্টি নামে, বৃষ্টির পর শীত-শীত লাগে বেশ। মাঝে-মাঝে বেশ অসুবিধে হয়। রাস্তায় শীত, সেজন্য ফুলহাতা জামা, সোয়েটার, কোট ইত্যাদি পরে বেরুতে হয়, তারপর কোনও হোটেল বা অফিস বা বাড়িতে ঢুকলেই গরম লাগে, কারণ সেসব জায়গাতে সেন্ট্রাল হিটিং। ওভারকোট খুলে রাখা যায়, কিন্তু সোয়েটার ইত্যাদি তো খোলা যায় না। এক এক সময় আমার কপালে ঘাম বেরিয়ে যায়। সারগেই-এর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, সেই যে চামড়ার জ্যাকেটটা তাকে প্রথম দিন পরতে দেখেছি, তারপর সেটা আর ও একদিনও খোলেনি।
সারগেই এখনও ফেরেনি? বেরিয়ে গিয়ে পাশের ঘরে টোকা মারলুম। কোনও সাড়া নেই।
আবার খানিকটা বই পড়ার চেষ্টা করলুম, কিন্তু মন বসছে না। এখনও গরম লাগছে। সেন্ট্রাল হিটিং কমানো-বাড়ানোর ব্যবস্থা এক এক জায়গায় এক এক রকম। এ ঘরে সেই ব্যবস্থাটা যে ঠিক কোথায় খুঁজে পেলুম না। জানলা দিয়ে কোনও হাওয়া আসছে না।
এক এক সময় হোটেলের বন্ধ ঘরের মধ্যে বড় অস্থির লাগে। শুধু বই পড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ঘুমও আসছে না। আমি ভাবলুম, এখন টাটকা বাতাসের মধ্যে খানিকক্ষণ ঘুরে এলে কেমন হয়?
শার্ট-প্যান্ট পরাই ছিল, ওভারকোট নিয়ে, পায়ে জুতো গলিয়ে বেরিয়ে পড়লুম হোটেল থেকে। রাস্তায় কিছু লোকজন এখনও হাঁটাহাঁটি করছে। আমি গির্জার বাগানটা কোনাকুনি পার হয়ে চলে এলুম অন্য রাস্তায়। আমার ইচ্ছে নদীর ধারে যাওয়া। হোটেলের রাস্তা হারিয়ে ফেলার কোনও সম্ভাবনা নেই। রিগা শহরে উঁচু বাড়ির সংখ্যা খুব কম, পেছন ফিরে তাকালেই আমাদের হোটেলের আলো দেখতে পাওয়া যায়।
অচেনা শহর, এখানকার ভাষাও আমার সম্পূর্ণ অজানা। এখানে ইংরিজি জানা লোকের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু আমার আড়ষ্ট বোধ হচ্ছে না, গা ছমছম করছে না। সহজাত অনুভূতি দিয়েই ভয়কে টের পাওয়া যায়। আজকাল পশ্চিমের অধিকাংশ শহরই খুব হিংস্র, রাত্তিরবেলা একা একা চলাফেরা করা রীতিমতন বিপজ্জনক। কিন্তু সকাল থেকে রিগা শহরে কয়েকবার ঘুরেই আমার মনে হয়েছে, এখানে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ চিন্তার প্রয়োজন নেই।
যে পথ দিয়ে আমি এখন হাঁটছি, সে পথটি রীতিমতন জনবিরল। মাঝে-মাঝে দু-একটি লোক আমার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। একটু বাদে আমি পরিবেশের কথা ভুলে গেলুম। ওভারকোটের পকেটে এক হাত, অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, মাথা নীচু, গুনগুন করে সুর ভাঁজছি, ''আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন, বাতাসে...''।
এখন আমি পৃথিবীর যে-কোনও শহরের, যে-কোনও রাস্তার, যে-কোনও একজন মানুষ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
মস্কো বিমানবন্দরে পা দিলুম খুব ভোরবেলায়। সারা রাত প্রায় জেগেই কাটাতে হয়েছে। কলকাতা থেকে এরোফ্লোট বিমানে চেপেছিলুম বিকেলবেলা, তারপর বোম্বে, করাচি আর তাসকেন্টে বিমানটি মাটি ছুঁয়েছিল, আমাদেরও নামতে হয়েছিল দুবার। তার মধ্যে শেষ রাতে তাসকেন্টে নেমে আমি ঝোলা থেকে একটা সোয়েটার বার করে পরে নিয়েছিলুম। রাশিয়ার ঠান্ডা সম্পর্কে অনেকেই ভয় দেখিয়েছিল আগে থেকে, কিন্তু আমি খুব একটা শীত-কাতুরে নই, তা ছাড়া কিছুদিন আগেই ডিসেম্বর-জানুয়ারির ক্যানাডার তুষারের রাজ্য ঘুরে এসেছি, সুতরাং মে মাসের রাশিয়াকে ডরাব কেন? অবশ্য সঙ্গে একটা পাতলা ওভারকোটও এনেছি।
বিমানে রাত্তিরটা বেশ গল্প-গুজবেই কেটে গেছে। সহযাত্রী পেয়েছিলুম দুই বাঙালি তরুণকে। একজনের নাম সুবোধ রায়, সে মস্কোতে আছে প্রায় সাত-আট বছর, উচ্চশিক্ষার্থে। কিছুদিনের জন্য কলকাতায় ছুটি কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছে আবার। সুবোধ খুব দিলদরিয়া ধরনের, উচ্ছ্বাসপ্রবণ এবং আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। অন্যজনের নাম অসিতবরণ দে, সে প্রায় চোদ্দো বছর বাদে চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে কলকাতা-দর্শনে এসেছিল। সে একটু চাপা ও লাজুক স্বভাবের। আমরা তিনজনে মিলে মস্কো-প্রাহা-কলকাতার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছিলুম। সন্ধে থেকে মাঝেমধ্যেই আমাদের খাদ্য-পানীয় পরিবেশন করা হচ্ছিল, বিমানযাত্রার একঘেয়েমি কাটাবার জন্যই বোধহয় ওরা অত ঘন ঘন খাবার দেয়, কিন্তু অত কি খাওয়া যায়? শেষবারের খাবার আমি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলুম।
মস্কোয় নামার পর অসিতবরণ দে চলে গেল ট্রানজিট লাউঞ্জের দিকে, আমি আর সুবোধ পাশপোর্ট হাতে করে এগোলুম নিষ্ক্রমণের পথে।
সুবোধ জিগ্যেস করল, আপনাকে কি কেউ নিতে আসবে?
আমি বললুম, সেই রকমই তো কথা আছে। কিন্তু এত ভোরে...
সুবোধ বলল, কেউ না এলেও ক্ষতি নেই, আমি তো আছি! আমি আপনাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেব।
মস্কো বিমানবন্দরটি বিশাল, কিন্তু প্রায় নিঝুম। এত সকালে একটিই মাত্র ফ্লাইট এসেছে। ইমিগ্রেশান ও কাস্টমস বেরিয়ার পার হওয়া মাত্রই একটি বাইশ-তেইশ বছরের ছিপছিপে যুবক আমার কাছে এসে পরিষ্কার ইংরিজি উচ্চারণে আমার নাম বলে জিগ্যেস করল, আপনিই কি তিনি?
আমি হ্যাঁ বলতেই সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম সারগেই স্ট্রোকান, আমি আপনার জন্যই এসেছি।
এত লোকজনের মধ্যে সে প্রথমেই আমাকে চিনল কী করে? খুব সম্ভবত ছবি দেখে সে আমার চেহারাটা মুখস্থ করেছে। আমি তার সঙ্গে সুবোধ রায়ের আলাপ করিয়ে দিলুম।
সারগেই স্ট্রোকান একটা ঠেলাগাড়ি জোগাড় করে এনে তাতে আমাদের বাক্স-প্যাঁটরাগুলো চাপাল। তারপর সেটা নিয়ে এগোবার চেষ্টা করতেই উলটে পড়ে গেল সবকিছু। সারগেই স্ট্রোকান লজ্জা পেয়ে সংকুচিতভাবে বলল, আমি খুব দুঃখিত, আমি কোনওরকম গাড়িই ঠিকঠাক চালাতে পারি না!
তাতে আমি খুব আশ্বস্ত বোধ করলুম। যে-খুব তুখোড় ধরনের লোক সবকিছুই নিখুঁতভাবে করতে পারে, কখনও যাদের জীবনে নিজস্ব ভুলের জন্য লজ্জা পাওয়ার অবকাশ ঘটে না, সেই সব মানুষদের আমি বেশ ভয় পাই। এবারে আমরা তিনজনেই হাত লাগিয়ে গাড়িটিকে নিয়ে এলুম বিমানবন্দরের বাইরে। একটা ট্যাক্সি ডেকে মালপত্র তোলা হল।
এবারে আমি ওভারকোটটা গায়ে চাপিয়ে নিলুম। খুব যে শীত করছে তা নয়। জানলা দিয়ে আমি উৎসুকভাবে দেখতে লাগলুম বাইরের দৃশ্য।
যে-কোনও নতুন দেশে এলেই প্রথমটায় একটা রোমাঞ্চ হয়। সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে কৌতূহল, আগ্রহ পুষে রেখেছি কতদিন ধরে। আমরা একটা দেশকে সবচেয়ে ভালো করে চিনি তার সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। এই সেই টলস্টয়, পুশকিন, ডস্টেয়ভস্কি, গোর্কি, মায়াকভস্কি-র দেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি দেশে প্রোলেতারিয়েতরা শোষণমুক্ত সমাজ-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে, এই দেশটি দেখবার জন্য আমি অনেকদিন থেকেই ব্যগ্র হয়েছিলুম, অকস্মাৎ আমন্ত্রণ পেয়ে খুবই পুলকিত বোধ করেছি।
আমি পূর্ব ইউরোপের কোনও দেশেই আগে আসিনি। এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের কতটা তফাত তাও দেখতে চাইছিলুম। এখন অবশ্য সেরকম কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বিমানবন্দর থেকে মস্কো শহর বেশ দূরে, এখন পথের দু-পাশে শুধুই উন্মুক্ত প্রান্তর, মাঝে-মাঝে গাছপালা। আজ এপ্রিল মাসের শেষ দিন, কিন্তু শীতের চিহ্ন এখনও মুছে যায়নি, এখানে সেখানে চোখে পড়ে বরফ-গলা জল।
রাস্তার পাশে একটি ভাস্কর্যের দিকে হাত দেখিয়ে সুবোধ বলল, এই পর্যন্ত হিটলারের বাহিনী এসে থেমে গিয়েছিল।
আমি চমকে উঠলুম। মস্কো নগরীর আশেপাশে কত ঐতিহাসিক স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। ১৯৪১-এর ডিসেম্বর মাসে এই অঞ্চলে কী সাংঘাতিক যুদ্ধ হয়েছিল, সারা পৃথিবী আতঙ্কে ভেবেছিল মস্কো বুঝি যায়-যায়, শেষ পর্যন্ত রেড আর্মির বীরত্বের কাছে দারুণভাবে হেরে যায় নাতসিরা। আজ তার আর কোনও চিহ্নই নেই। কয়েকটি বলিষ্ঠ পুরুষের মূর্তি আকাশের দিকে মুঠি তুলে আছে। তার পেছনেই বড়-বড় গাছ, নিঃশব্দ।
মস্কো শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে মস্কোভা নদী। এমন কিছু বড় নদী নয়। সেই নদী পেরিয়ে পৌঁছে গেলুম আমার জন্য নির্দিষ্ট হোটেলে। এটির নাম হোটেল ইউক্রাইনিয়া। এর ভবনটি যেমন প্রকাণ্ড তেমনি জমকালো ধরনের। নীচের দিকটা অতি প্রশস্ত, তার পর ধাপে-ধাপে ছোট হতে-হতে ওপরের দিকে উঠেছে। একেবারে চূড়োর কাছটা গির্জাশীর্ষের মতন। অবিকল এই এক ডিজাইনের বাড়ি মস্কো শহরে চার-পাঁচটি আছে, অনেক দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়।
সুবোধ রায় এখান থেকে বিদায় নেবে, তাকে যেতে হবে আরও খানিকটা দূরে। সে সেরগেই স্ট্রোকান-কে জিগ্যেস করল, আপনাদের কী প্রোগ্রাম বলুন? আমরা এখানকার বাঙালিরা সুনীলদাকে নিয়ে কয়েকদিন বসতে চাই।
সেরগেই স্ট্রোকান বলল, তা তো সম্ভব হবে না। আমরা ওঁকে ডেকে এনেছি, আমাদের প্রত্যেকদিনের ঠাসা প্রোগ্রাম আছে। তার মধ্যে তো সময় করা যাবে না! আপনারা ইন্ডিয়াতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করবেন।
কিন্তু সুবোধ এত সহজে কিছু মেনে নেবার পাত্র নয়।
সে বলল, সন্ধের পর তো আপনাদের আর কিছু করবার থাকবে না। তখন আমরা এসে ওঁকে নিয়ে যাব, আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব। আজকের দিনটা থাক, কাল সন্ধেবেলা আমি এসে—
সেরগেই স্ট্রোকান বলল, কাল দুপুরেই আমরা লেনিনগ্রাড চলে যাচ্ছি।
যাই হোক, ঠিক হল যে নানা জায়গায় ঘুরে আমি আবার দিন দশেক বাদে ফিরে আসব মস্কোতে। তখন এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে দেখা হবে। সুবোধ আমাদের দু'জনকেই তার কার্ড দিল, যাতে ফিরে এসেই আমরা ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি।
হোটেলের ভেতরে এসে পাসপোর্ট জমা দিয়ে নামটাম লেখাতে খুব বেশি সময় লাগল না। আমার জন্য ঘর নির্ধারিত হল সতেরো তলায়। হোটেলের লাউঞ্জটি পুরোনো আমলের মতন বেশ জমকালোভাবে সাজানো। খুব উঁচু সিলিং, আলোগুলো ঝাড়-লণ্ঠনের মতন। লিফটটি দেখেও আমি চমৎকৃত হলুম, একেবারে আদিকালের ঢাউস লিফট, পেতলের কারুকার্য করা দরজা, ভেতরে অন্তত জনা কুড়ি লোক অনায়াসে এঁটে যায়। এ-রকম লিফট আমি আগে দেখেছিলুম রোমের ভ্যাটিকানে।
সুটকেস সমেত আমাকে আমার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সেরগেই স্ট্রোকান বলল, আপনি এখন একটু বিশ্রাম নিন। আমি আবার সাড়ে নটার সময় আসব।
ওভারকোট ও জুতো-মোজা খুলে ফেললুম তাড়াতাড়ি। বেশিক্ষণ মোজা পরে থাকলে আমার অস্বস্তি লাগে। সেই গতকাল দুপুর থেকে এসব পরে আছি। খালি পায়ে এসে দাঁড়ালুম জানলার ধারে। একটু দূরেই নদী। এই নদীর দু-পার আগাগোড়া পাথর দিয়ে বাঁধানো। জানলার কাচ খুলে বাইরে মুখ ঝুঁকিয়ে টাটকা হাওয়া বুকে টেনে নিলুম অনেকখানি। একটা গভীর বিস্ময়বোধ এখনও আমাকে আপ্লুত করে আছে। সত্যি আমি রাশিয়াতে এসেছি!
মাত্র সাতটা বাজে। কলকাতায় এ সময় ঘুম থেকেই উঠি না। দীর্ঘ বিমানযাত্রা ও রাত্রি জাগরণ সত্বেও শরীরে কোনও ক্লান্তি বোধ নেই। ইচ্ছে করলে এখন ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। ধপধপে সাদা চাদর পাতা নরম বিছানায় শুয়ে পড়লুম বটে, কিন্তু একটা নতুন দেশে এসেই কি ঘুমিয়ে পড়া সম্ভব?
ঘরখানি যে-কোনও দেশের দামি হোটেল ঘরের মতন। টিভি, টেলিফোন, রাইটিং টেবল, ড্রেসিং টেবল, এক পাশে ওয়ার্ডরোব ও সংলগ্ন বাথরুম। উঠে টিভি চালিয়ে দিলুম। রুশ ভাষা এক বর্ণ বুঝি না। মনে হল খবর পড়া হচ্ছে। তার মধ্যে এক জায়গায় ইন্দিরা গান্ধির নাম শুনে চমকে উঠলুম। কী হয়েছে ইন্দিরা গান্ধির? তারপর শুরু হল বাচ্চাদের জন্য অনুষ্ঠান।
আধ ঘণ্টা শুয়ে থেকেও বুঝলুম ঘুম আসবার কোনও আশা নেই। তার চেয়ে বরং দাড়ি কামানো, স্নান ইত্যাদি সেরে ফেলা যাক। এইসব পর্ব চুকিয়ে, পোশাক পালটিয়ে আমি ফিটফাট হয়ে আবার দাঁড়ালুম জানলার ধারে। এত উঁচু থেকে রাস্তার মানুষজনকে ছোট-ছোট দেখায়। নদীর ওপর দিয়ে স্টিম লঞ্চ যাচ্ছে। এখান থেকে যে দৃশ্য আমি দেখছি, তাতে অন্যান্য সাহেবি শহরের সঙ্গে মস্কোর কোনও তফাত নেই।
একটু পরেই সারগেই স্ট্রোকান এসে পড়ল। সে বেশ ব্যস্তভাবে বলল, আপনি তৈরি তো? চলুন, আগে ব্রেক ফাস্ট খেয়ে আসি।
আমি বললুম, আগে একটু বসুন। আপনার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করে নিই।
সারগেই বলল, আপনি যে-ক'দিন আমাদের দেশে থাকবেন, আমিই সব জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাব। সুতরাং আলাপ তো হবেই।
আমি বললুম, তবু একটু বসুন।
যুবকটির চোখের মণি দুটো নীলচে, মুখটি বুদ্ধিদীপ্ত এবং সারল্য মাখানো। তার গায়ে একটা খয়েরি রঙের চামড়ার জ্যাকেট। আমি তাকে একটা সিগারেট দিতে চাইলে বলল যে কিছুদিন আগে সে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে, কারণ সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়। সেই সঙ্গে সে যোগ করল, অবশ্য সোভিয়েত দেশে এখনও অনেকেই সিগারেট খায়।
আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি আমার সম্পর্কে কী কী জানেন?
সে গড়গড় করে অনেক কিছু বলে গেল। বুঝলুম যে কলকাতার কনসুলেট থেকে পাঠানো আমার বায়োডাটা সে ভালো ছাত্রের মতন মুখস্থ করে নিয়েছে।
আমি হেসে বললুম, বাঃ সবই তো জেনে ফেলেছেন দেখছি। এবারে আপনার সম্বন্ধে কিছু বলুন!
সারগেই স্ট্রোকানের জন্ম ইউক্রাইনে, উচ্চশিক্ষার জন্য সে মস্কো চলে আসে। পড়াশুনো শেষ করার পর সে কিছুদিন সামরিক বাহিনীতে ট্রেইনিং নিয়েছে, এখন নভোস্তি প্রেস এজেন্সিতে ইন্ডিয়া ডেস্কে সে অনুবাদকের কাজ নিয়েছে। তার বয়েস বাইশ এবং সে বিবাহিত।
একটু হেসে সে যোগ করল, আমিও কবিতা লিখি। তবে আমার কবিতা বিশেষ কোনও জায়গায় ছাপা হয়নি।
তারপর সে জিগ্যেস করল, আমি আপনাকে কি মিস্টার গঙ্গোপাধ্যায় বলব? কিংবা যদি সুনীলজি বলি? ইন্ডিয়াতে তো অনেকেই এইভাবে ডাকে!
—তুমি জানলে কী করে?
—আমি ইন্ডিয়াতে গেছি। প্রায় এক বছর ছিলাম!
সারগেই স্ট্রোকান ভারত ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হতে চায় বলে সে তামিল ভাষা শিখেছে। এবং সেই ভাষাজ্ঞান ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য সে ভারতবর্ষ ঘুরে এসেছে। সে তামিলনাড়ু, কেরালা, বোম্বাই, দিল্লি দেখেছে, কলকাতার দিকে যায়নি।
আমি মনে-মনে একবার ভাবলুম, ওদের ইন্ডিয়া ডেস্কে নিশ্চয়ই বাংলা জানা ছেলেও আছে। সেরকম একজনকে কেন পাঠাল না আমার সঙ্গী হওয়ার জন্য? পরক্ষণে সেই ভাবনাটা বাতিল করে দিলুম। এই যুবকটিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। বাংলা জানা বা না জানায় কী আসে যায়!
ঠিক হল, সে আমাক সুনীলজি বলবে, আমি তাকে শুধু সারগেই বলে ডাকব। এর পর নীচে নেমে এলুম ব্রেক ফাস্ট খেতে।
এ হোটেলের ডাইনিং হলটাও বিশাল। ব্রেক ফাস্ট খাওয়ার দু-রকম পদ্ধতি। টেবিলে বসে মেনিউ কার্ড দেখে ইচ্ছে মতন অর্ডার দেওয়া যায়। আর একদিকে আছে সেলফ সার্ভিস। আমরা দ্বিতীয় দিকেই গেলুম। এখানে পনেরো-কুড়ি রকম খাবার সাজানো রয়েছে, তিন রুবল দিয়ে টিকিট কাটলে ইচ্ছে মতন যা খুশি নেওয়া যায়।
আমি একটা ডিম সেদ্ধ, একজোড়া সসেজ ও এক পিস টোস্ট নিয়ে টেবিলে বসতেই সারগেই বলল, এ কী সুনীলজি, এত কম নিলেন? আরও কত কী রয়েছে, স্যালামি, বেকন, হ্যাম, মিট বল, ম্যাসড পোটাটো, চিজ, আমাদের অনেকরকম চিজ আছে, ট্রাই করুন!
আমি খুব একটা ভোজনরসিক নই, বিশেষত সকালের দিকে মোটেই বেশি খেতে ইচ্ছে করে না। তবু সারগেই আরও কিছু খাদ্য জোর করে এনে দিল আমার প্লেটে। কাছাকাছি টেবলগুলোতে যারা বসে আছে, তারা অধিকাংশই বিদেশি; ইংরিজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষা শুনতে পাচ্ছি। এই হোটেলটি প্রধানত বিদেশিদেরই জন্য।
দশটার সময় বেরিয়ে এলুম হোটেল থেকে। এবারে আর ট্যাক্সি নয়, সারগেই-র অফিস থেকে গাড়ি এসেছে। এই গাড়ি সারাদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে।
সারগেই বলল, চলুন, সুনীলজি, আগে রেড স্কোয়ার দেখে আসি। রেড স্কোয়ার না দেখলে মস্কো শহর অনুভবই করা যায় না।
আমি তাতে সম্মতি জানালুম।
মস্কো শহরে আধুনিক কায়দায় বিরাট বিরাট বহুতল বাড়ি যেমন উঠেছে, তেমনি পুরোনো আমলের প্রাসাদ রয়ে গেছে অনেক। রাস্তার দু-পাশে বাতিস্তম্ভগুলোতে লোকেরা এক জোড়া করে লাল পতাকা লাগাচ্ছে, দু-দিন মে-ডের উৎসব, সেজন্য। ঝকঝক করছে রোদ। চওড়া চওড়া রাস্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থা অতি সুশৃঙ্খল, কোথাও জ্যামে পড়তে হল না। তবে, পশ্চিমি কোনও বড় শহরের তুলনায় মস্কোতে গাড়ির সংখ্যা যেন কিছু কম। বাস স্টপগুলিতে রয়েছে অপেক্ষমাণ মানুষ, অনেক লোক পায়ে হেঁটেও যাচ্ছে, এটা দেখলে স্বস্তি লাগে। আমেরিকার অনেক শহরে গাড়ি ছাড়া একজনও পথচারী দেখা যায় না, কেন যেন ভূতুড়ে-ভূতুড়ে মনে হয়।
মস্কো শহরটি তেমন ঘিঞ্জি নয়। মাঝে মাঝেই পার্ক রয়েছে, তাতে নানারকম ভাস্কর্য। ব্রোঞ্জ ও পাথরের মূর্তিগুলি দৃষ্টি টেনে নেয়। খুবই বলিষ্ঠ কাজ। লেনিনের মূর্তি ছাড়াও বিখ্যাত সব সাহিত্যিক ও কবিদের মূর্তিও আছে। একটি অতি জীবন্ত মূর্তির নাম, সর্বহারার অস্ত্র ঃ খোয়া পাথর।
যেতে-যেতে বলশয় থিয়েটার দেখে আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠল। এই সেই বিখ্যাত নাট্যশালা! আমি সারগেইকে বললুম, এখানে একটা ব্যালে কিংবা অপেরা দেখার সুযোগ পাব কী?
সারগেই বলল, এখন তো টুরিস্ট সিজন, টিকিট পাওয়া খুব শক্ত, তবু আমি চেষ্টা করব!
রেড স্কোয়ারে যাওয়ার আগে আমরা পুরো ক্রেমলিন এলাকাটায় একটা চক্কর দিলুম। এই অঞ্চলে আধুনিক বাড়ি বেশি চোখে পড়ে না, প্রাচীন ভাবটি অক্ষুণ্ণ আছে। ক্রেমলিন প্রাসাদের পেছন দিকে একটি পার্ক, সেখানে নামলুম আগে। এই পার্কের মধ্যেই একটি ঘেরা জায়গায় জ্বলছে অমর-জ্যোতি। যুদ্ধের সময় দেশকে রক্ষা করার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের স্মরণে জ্বলে এই অনির্বাণ আলোর শিখা। আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়ালুম আমার শ্রদ্ধা জানাতে। অনেকেই এই আলোর শিখা দেখতে এসেছে, তার মধ্যে দেখলুম দু-জোড়া নব-বিবাহিত দম্পতিকে। যুবতী দুটির সাদা পোশাক ও দীর্ঘ ওড়না দেখলেই বোঝা যায় তারা সদ্য বিবাহের অনুষ্ঠান সেরেই এখানে এসেছে। সারগেইকে জিগ্যেস করে জানলুম, অনেক নব-দম্পতিই এখানে আসে। বিবাহের আনন্দ উৎসবের মাঝখানে শহিদ বেদিতে মাল্যদান আমাদের কাছে একুট আশ্চর্য মনে হতে পারে, কিন্তু সোভিয়েত নাগরিকদের কাছে এর বিশেষ তাৎপর্য আছে। গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রায় দু-কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছে, যখন এখানে জনসংখ্যাই ছিল কুড়ি কোটি। অর্থাৎ প্রায় প্রত্যেকটি পরিবার থেকেই একজন দুজন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিংবা পঙ্গু হয়েছে।
আমি সারগেইকে মৃদু গলায় জিগ্যেস করলুম, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় তো তুমি জন্মাওনি। তোমাদের পরিবারের কেউ কি...
সে সংক্ষিপ্তভাবে বলল, হ্যাঁ।
গাড়িতে ফিরে এসে আবার খানিকটা চক্কর দিলুম। চার দিকেই অসংখ্য ফুল। এর মধ্যে বেশি করে চোখে পড়ে টিউলিপ। এত বৈচিত্র্যময় টিউলিপ আমি আগে কখনও দেখিনি। গাঢ় লাল রঙের টিউলিপের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ছিল, এখানে দেখলুম হলুদ এবং তুষার-শুভ্র টিউলিপের ঝাড়ও রয়েছে। বাগানগুলি খুব যত্ন করে সাজানো। ফরাসি দেশের মতন বেশি বেশি যত্নের চিহ্ন প্রকট নয়, বরং বেশ স্বাভাবিক।
সারগেই বলল, আপনি ভাগ্যবান, আপনি খুব ভালো সময়ে এসেছেন। কয়েকদিন আগেও এখানে যখন-তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। দুদিন ধরে আকাশ পরিষ্কার। সেজন্য টিউলিপও এত বেশি ফুটেছে।
রেড স্কোয়ারে যাওয়ার জন্য গাড়িটা বাইরে রেখে খানিকটা হেঁটে যেতে হয়। ঢালু রাস্তা ধরে আমরা ওপরের দিকে উঠে এলুম।
তারপর রেড স্কোয়ারে পা দিয়েই মনে হল, এ জায়গাটা তো আমার খুব চেনা!
২
অসংখ্য ছবিতে এবং চলচ্চিত্রে রেড স্কোয়ার দেখেছি। বিভিন্ন দিক থেকে। সুতরাং রেড স্কোয়ারে প্রথম পা দিয়ে তো খুব চেনা মনে হবেই। সারা বছর ধরেই রেড স্কোয়ারে নানান উৎসব ও জমায়েত হয়। আসন্ন মে দিবসের উৎসবের জন্য আজ রেড স্কোয়ারকে বহু পতাকা ও ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। সারগেই কিছু বলবার আগেই আমি একটি চতুষ্কোণ ভবনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললুম, ওইটা তো সেই মাস্যালিয়াম, যেখানে লেনিনের দেহ রাখা আছে?
ক্রেমলিন প্রাসাদের উত্তর-পূর্ব দিকে এই প্রশস্ত চত্বরের নাম রেড স্কোয়ার। আমরা যেদিক দিয়ে ঢুকলুম, সেদিক দিয়ে প্রথমেই পড়ে সেন্ট বেসিলস ক্যাথিড্রাল। ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি এই বিচিত্র আকারের ও নানা রঙের গির্জাটি রাশিয়ান স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এই গির্জার গম্বুজের সংখ্যা ন'টি, প্রত্যেকটিই বিভিন্ন আকৃতির। চমৎকার দেখতে এই গির্জাটিতে খানিকটা যেন বার্মিজ স্থাপত্যের ছাপ আছে বলে মনে হল, কিংবা আমার ভুলও হতে পারে।
সেই গির্জার পাশ দিয়ে একটু এগোলেই ডান পাশে একটা উঁচু বেদির মতন, জারদের আমলে এটা ছিল বধ্যভূমি, সম্রাটদের ইচ্ছাক্রমে যাকে তাকে ওখানে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হত, এখন সেখানে ফুলের মালার স্তূপ।
ক্রেমলিন প্রাসাদের সিংহদ্বারের কাছেই যে সুউচ্চ গম্বুজ, যার চূড়ায় রয়েছে একটি বিশাল তারা, সেই গম্বুজটিই মস্কো শহরের প্রতীক চিহ্ন বলা যায়। সেই গম্বুজে দিনে দু-বার ঘণ্টাধ্বনি হয়। সেই ধ্বনিতে শোনা যায় 'ইন্টারন্যাশনাল' গানের সুর।
রেড স্কোয়ারে অসংখ্য মানুষ অপেক্ষা করছে সেই ঘণ্টাধ্বনি শোনবার জন্য। অধিকাংশই টুরিস্ট, এদের মধ্যে আমেরিকান টুরিস্টদের আলাদা করে চেনা যায়। অত্যন্ত সুসজ্জিত কয়েকজন পুলিশ সেই ভিড়ের শৃঙ্খলা রক্ষা করছে। সেই পুলিশদের মুখগুলি খুবই গম্ভীর। পুলিশের পোশাক পরে থাকলে বোধহয় হাসি নিষেধ।
লেনিন সমাধিভবনের সামনে বিরাট লম্বা লাইন। সারগেই জিগ্যেস করল, আপনি ভেতরে যেতে চান?
অতবড় লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর বাসনা আমার হল না, আমি বললুম, না, থাক।
সারগেই বলল, এখন শুধু জায়গাটা দেখে নিই, পরে তো এখানে বারবার আসতে হবেই।
রেড স্কোয়ারের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত হেঁটে গেলুম দুজনে। চত্বরটি কবল স্টোন বা খোয়া পাথরে বাঁধানো, প্রাচীন কালে যেমন ছিল, সেইরকমই রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, ছবিতে বা সিনেমায় রেড স্কোয়ারকে যত বিশাল মনে হয়, আসলে কিন্তু তত বড় লাগল না। কল্পনার থেকে বাস্তব সবসময়েই একটু ছোট।
ক্রেমলিন কথাটার মানেই হল দুর্গ। দেয়াল ঘেরা এই অঞ্চলটাই আদি মস্কো, তারপর একে কেন্দ্র করে শহরটা ছড়িয়েছে। এর চারপাশ দিয়েই বেরিয়েছে বড় বড় রাস্তা। এবারে আমরা অন্য একটা রাস্তা ধরে শহর দেখতে দেখতে পৌঁছলুম নভোস্তি প্রেস এজেন্সির কার্যালয়ে।
রাশিয়ান ভাষায় হরফ অনেকগুলিই রোমান হরফের মতন হলেও উচ্চারণে প্রায় কোনও মিলই নেই। রোমান হরফ দেখা চেনা চেনা মনে হলেও রাশিয়ান ভাষা আমরা পড়তে পারি না। সেই জন্যই নভোস্তি প্রেস এজেন্সির আদ্যক্ষর এন পি এ নয়, এ পি এন। এই এ পি এন-এর আমন্ত্রণেই আমি এদেশে অতিথি হয়ে এসেছি।
এ পি এন-এর অফিস ভবনটি প্রকাণ্ড। ঢোকার মুখে কড়া পাহারার ব্যবস্থা। সোভিয়েত দেশ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পরিবেশনের দায়িত্ব এই সংস্থার। সারা পৃথিবীতে রয়েছে এঁদের শাখা, বহু সাময়িক পত্র-পত্রিকা এঁরা পরিচালনা করেন।
সারগেই অনেক সিঁড়ি ঘুরিয়ে আমায় একটি প্রশস্ত কক্ষে এনে বসাল। তারপর পাশের দফতরের এক মহিলা কর্মীকে আমাদের আগমনবার্তা জানিয়ে আমার কাছে এসে বলল, এক্ষুনি যিনি আসবেন, তিনি হলেন ওর বস। তিনি এই দফতরের দণ্ডুমুণ্ডের কর্তা, তিনি স্বয়ং আসছেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। সারগেই-এর গলায় খানিকটা উত্তেজনার আভাস। নতুন চাকরিতে ঢুকেছে, তাই বস সম্পর্কে ওর বেশ একটা ভয়-ভয় সমীহের ভাব আছে বলে মনে হল।
এক মিনিট পরেই যিনি ঘরে ঢুকলেন, তিনি একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। বেশ হাসিখুশি মুখের ভাব, তাঁকে দেখে মোটেই ভয় জাগে না। এঁর নাম সোয়ার্টস ইগর আলেকসেভিচ, ইনি এশিয়া বিভাগের উপ-পরিচালক।
সোয়ার্টস সাহেবকে দেখে আমি সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াতেই তিনি প্রফুল্ল গলায় বললেন, বসুন, বসুন! আপনার বিমানযাত্রা ক্লান্তিকর হয়নি তো? এখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
সোয়ার্টস সাহেব একাধিকবার ভারতে এসেছেন, বেশ কিছুদিন দিল্লিতে থেকে গেছেন, সুতরাং আলাপ-পরিচয়ে প্রাথমিক জড়তাটা সহজেই কাটিয়ে ওঠা গেল।
তিনি আমাকে জিগ্যেস করলেন, আপনি এ দেশে এসে কী কী দেখতে চান বলুন?
আমি বললুম, আমি প্রধানত ভ্রমণকারী, তথ্য সংগ্রাহক নই। আপনাদের দেশে এসেছি, যা যা দেখবার সুযোগ পাব তাই-ই দেখব, আলাদাভাবে কোনও বিশেষ ব্যাপারে কৌতূহল নিয়ে আসিনি।
তিনি বললেন, এক হিসেবে আপনি খুব ভালো সময়েই এসেছেন, আবার খুব খারাপ সময়েও বটে। ভালো, তার কারণ আবহাওয়া এখন চমৎকার। তবে মুশকিল হচ্ছে এখন পরপর ছুটির দিন। তাই অনেক কিছুই বন্ধ থাকবে। তবু যতটা সম্ভব বেশি কিছু দেখাবার জন্য আপনার একটি সফর পরিকল্পনা আমরা তৈরি করে রেখেছি। আপনি ইচ্ছে মতন ঘুরুন, এই সারগেই ছেলেটি আপনার সঙ্গে থাকবে, বিশেষ কিছু ইচ্ছে হলে ওকে জানাবেন। যা জানতে চান জিগ্যেস করবেন। আপনাকে কয়েকটা বইপত্র দিচ্ছি। পড়ে দেখতে পারেন—
মাঝপথে কথা থামিয়ে সোয়ার্টস জিগ্যেস করলেন, চা না কফি খাবেন? চা তো আপনাদের দেশের মতন ভালো নয়।
সকাল থেকে আমি দু-কাপ চা খেয়েছি, তাতে আমি চায়ের কোনও স্বাদই পাইনি। সুতরাং বললুম, কফি!
এ পি এন ভবন থেকে বেরিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মস্কো রাইটার্স ইউনিয়ান।
অনেক কিছু সম্পর্কেই আমাদের একটা পূর্ব ধারণা গড়ে ওঠে। সোভিয়েত দেশের রাইটার্স ইউনিয়ান সম্পর্কে এত বেশি প্রচার ও অপপ্রচার আগে শুনেছি বা পড়েছি যে এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আমার মনে একটা ধাঁধার ভাব ছিল। সরকারি আওতায় কোনও লেখক সমিতি পরিচালনার ব্যাপারটা আমাদের ঠিক যেন মনঃপূত হয় না।
মস্কো লেখক সমিতির কার্যালয়টি কেমন হবে, সে সম্পর্কে আমার মনে আগে থেকেই একটা ছবি আঁকা ছিল। সরকারি বাড়ি, চৌকো চৌকো ঘর, শ্রীহীন দেওয়াল, নেতাদের ছবি, মস্ত বড় টেবিলের চারপাশে শক্ত শক্ত চেয়ার, সব মিলিয়ে গম্ভীর গম্ভীর ব্যাপার। কিন্তু লেখক সমিতি-তে এসে আমি অবাক হলুম। বস্তুত, মস্কোতে পৌঁছে এই প্রথম আমার একটি গভীর বিস্ময় ও আনন্দের ব্যাপার ঘটল।
বিপ্লব-পূর্বকালের কোনও এক ধনাঢ্য মহিলার বিলাস-মহলটিতেই এখন লেখক সমিতির ঘাঁটি। বাড়িটি অপূর্ব। লোহার গেট পেরিয়ে একটি প্রশস্ত চত্বর, পাশে কয়েকটি ছোট-ছোট কটেজ, তারপর সামনের প্রাসাদের মধ্যে অনেকগুলি ঘর, নানারকম গলিপথ ও সুড়ঙ্গ; যেন কোনও গুপ্তপথ দিয়ে আমরা একবার মাটির নীচে নেমে গেলুম আবার ওপরে উঠলুম। একজন মহিলার সঙ্গে আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, তাকে খুঁজে বার করতেই খানিকটা সময় লেগে গেল। আমাদের খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল, তবু তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
দেখামাত্র তিনি হেসে জিগ্যেস করলেন, কেমন আছেন? আবার দেখা হল।
এঁর নাম মারিয়াম সোলগানিক, ইনি একজন নামকরা লেখিকা এবং লেখক সমিতির পরিচালকদের মধ্যে একজন, ঠিক কোন পদ অলংকৃত করেছেন তা আমার জানা হয়নি। ধারালো, ঝকঝকে পাতলা চেহারা, ইংরেজি বলেন অতি মসৃণভাবে। কিছুদিন আগেই উনি কলকাতা ঘুরে গেছেন, তখন একটি চা-চক্রে দেখা হয়েছিল, ওঁকে আমার মনে আছে, কিন্তু আমাকেও যে উনি চিনতে পারবেন, সেটা খুব আশ্চর্য কথা!
শ্রীমতী মারিয়াম সোলগানিক বললেন, চলুন, চা খেতে-খেতে গল্প করা যাক।
সারগেই বলল, আমরা দুপুরে লাঞ্চ খাইনি, আপনাদের এখানে খাওয়াটা সেরে নিতে চাই।
শ্রীমতী মারিয়াম সোলগানিক আবার আমাদের সেই বাড়ির ভেতরকার গুপ্তপথ দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিয়ে চললেন। পুরোনো আমলের বাড়িতে এইরকম পথ থাকে। উনি বললেন, আমরা আসলে পেছন দিক দিয়ে যাচ্ছি, সামনের দিক দিয়ে অনেক সহজে যাওয়া যায়।
কাঠের ফ্লোর লাগানো একটা বড় হলঘরে এসে পৌঁছলুম, যেটা নির্ঘাৎ এক সময়ে নাচ ঘর ছিল। এক পাশ দিয়ে একটা কারুকার্য করা ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। এখানে অনেকগুলো টেবিল সাজানো, কিন্তু সবই শূন্য। দুঃখের বিষয় সেখানে আমাদের খাওয়া হল না, লাঞ্চ আওয়ার পেরিয়ে গেছে বলে সার্ভিস বন্ধ।
শ্রীমতী মারিয়াম সোলগানিক বললেন, তা হলে আর কী করা যাবে, চলুন চা-ই খাওয়া যাক।
আর একটি বড় ঘরে এসে পৌঁছলুম আমরা। এই ঘরখানিও খুব দৃষ্টিনন্দন। সমস্ত দেওয়ালে নানারকম ছবি আঁকা, অধিকাংশই কাঁচা হাতের। লেখকরা আড্ডা দিতে-দিতে যার যা খুশি দেয়ালে আঁকেন। শ্রীমতী সোলগানিক বললেন, এর মধ্যে অনেক ছবিতে উত্তর প্রত্যুত্তর আছে। অর্থাৎ একজন লেখক একটা কিছু ছবি এঁকেছেন, অন্য কোনও লেখক পাশে আর একটা ছবি এঁকে উত্তর দেন তার।
আমি জিগ্যেস করলুম, লেখকদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয় না?
—কেন হবে না? প্রায়ই হয়। সব দেশেই লেখকরা তো একই জাতের।
—এখানে কখনও লেখকদের মধ্যে ঘুসাঘুসি হয়েছে?
উনি হেসে বললেন, না। লেখকদের মধ্যে মতবিরোধটা কাগজে-কলমে হওয়াই ভালো।
লেখক ইউনিয়ান একটি স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান। লেনিন ঠিক করে দিয়েছিলেন যে প্রত্যেক প্রকাশক লেখকদের রয়ালটির একটা অংশ এই ইউনিয়ানকে দিতে বাধ্য থাকবে। এমন সমস্ত প্রকাশনালয়ই সরকার পরিচালিত, তারা প্রত্যেকেই টাকা দেয়। সেই টাকায় এই ইউনিয়ানের খরচ চলে। লেখকরা এখানে আড্ডা, শস্তায় খাওয়া-দাওয়া, সুরাপান ও আলাপ-আলোচনা করতে আসেন। নতুন সদস্য নেওয়ার আগে এখানকার কমিটি সেই লেখকের গুণাগুণ আলোচনা করে দেখে। চেষ্টা করেও কেউ-কেউ এখানকার সদস্য হতে পারেননি, এমন নজিরও আছে। এই লেখক সমিতির পরিচালনায় সারাদেশে আছে অনেকগুলি রাইটার্স হোম, সেগুলি সাধারণত স্বাস্থ্যকর, নিরিবিলি জায়গায়, সদস্য লেখকরা সেই সব রাইটার্স হোমে গিয়ে এক মাস দু-মাস থেকে লিখতে পারেন, নামমাত্র খরচে।
আমি জিগ্যেস করলুম, মনে করুন, কোনও একজন লেখক এই রকম একটা রাইটার্স হোমে গেল, আপনাদের খরচে থেকে এল একমাস, কিন্তু এক লাইনও লিখল না, অর্থাৎ কোনও লেখা তার মাথায় এল না, তা হলে কী হবে?
শ্রীমতী সোলগানিক বললেন, একজন লেখক লিখবেন কি লিখবেন না, সেটা তাঁর ইচ্ছে। তাতে আমাদের কী বলবার আছে?
লেখক সমিতির থেকে লেখকদের আরও নানারকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। তার মধ্যে একটা হল অনুবাদের ব্যবস্থা করা। অনুবাদের ব্যাপারটা সোভিয়েত দেশে একটা এলাহি কারবার।
শ্রীমতী সোলগানিক বললেন, আপনাদের ভারতবর্ষে যেমন ভাষা সমস্যা আছে, আমাদেরও সেইরকম ছিল। আমরা সেই সমস্যা সমাধান করে ফেলেছি অনুবাদের মাধ্যমে।
সোভিয়েত ইউনিয়ানে প্রধান ভাষা ৭৭টি। এই প্রত্যেকটি ভাষায়ই আলাদা সাহিত্য আছে। এই সব ভাষার উল্লেখযোগ্য লেখা অনূদিত হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষায়, আবার রাশিয়ান ভাষায় লেখাও অনূদিত হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষায়। তার ফলে একজন আঞ্চলিক ভাষার লেখকও অনায়াসেই সমস্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় পরিচিত হতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা থেকেও অবিরাম অনুবাদ চলছে। অনেক আমেরিকান লেখক সোভিয়েত রাশিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এক একটি বইয়ের অনুবাদ ছাপা হয় প্রাচ পাঁচ লক্ষ করে। রবীন্দ্র রচনাবলিও পাঁচ লক্ষ ছাপা হয়েছে ও অতি দ্রুত ফুরিয়ে গেছে।
বিপ্লবের আগে থেকেই জাতিগতভাবে রাশিয়ানরা দারুণ পড়ুয়া। সম্প্রতিকালের ইউনেস্কোর রিপোর্টেও প্রকাশ যে সারা পৃথিবীতে সোভিয়েত দেশের নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি বই পড়ে। এক হাজার জন শিক্ষিত লোকের মধ্যে ৯৯০ জনেরই বই কেনার অভ্যেস আছে।
আমি বললুম, রাশিয়ানরা খুব বেশি পড়ে তা জানতুম, কিন্তু তারা যে এত অনুবাদও পড়ে, এটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার!
শ্রীমতী সোলগানিক আমাকে সংশোধন করে দিয়ে বললেন, রাশিয়ান নয়। বলুন সোভিয়েত পিপল!
এ কথা ঠিক। আমরা সবসময় রাশিয়া বা রাশিয়ান বললেও সোভিয়েত ইউনিয়ানে এখন নানান জাতির সমন্বয় এবং এর সীমানাও রাশিয়াকে ছাড়িয়ে অনেকখানি। মূল রুশ ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগ দিয়েছে অন্য অনেকগুলি স্টেট, এখন মোট ১৫টি স্টেট নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ান। এমন অনেক স্টেট আছে, যেমন টাশকেন্ট কিংবা ল্যাটভিয়া, যেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতি রুশদের থেকে অনেক আলাদা। তারা রাশিয়ান নয়, কিন্তু সোভিয়েত নাগরিক।
কিন্তু বাংলায় এখনও আমরা চলিত ভাষায় সোভিয়েত ইউনিয়ানকে রাশিয়া বলি; সোভিয়েত অধিবাসীর বদলে রাশিয়ান।
শ্রীমতী সোলগানিক মৃদু হাস্যে বললেন, মনে করবেন না যে আমাদের এখানে একবারে ব্ল্যাক মার্কেট নেই! আছে। আমাদের দেশে বই আর অপেরার টিকিটের ব্ল্যাক মার্কেট হয়।
কথাটা বলার সময় তাঁর কণ্ঠে বেশ গর্ব মিশে গেল! তা তো হওয়ারই কথা।
শ্রীমতী সোলগানিক আমাকে জিগ্যেস করলেন, কোন কোন সোভিয়েত লেখকের কথা আমি পড়েছি!
আমি লজ্জিতভাবে বললুম, প্রায় কিছুই পড়িনি।
রুশ মহৎ লেখকদের রচনা আমাদের অবশ্য পাঠ্য, টলস্টয়-ডস্টয়েভস্কি-টুর্গেনিভ-এর উপন্যাস আমরা কৈশোর বয়সে থেকে বারবার পড়েছি, গভীর মুগ্ধতা নিয়ে, পুশকিন থেকে ব্লক-মায়াকভস্কির কবিতাও পড়েছি। কিন্তু তারপর সোভিয়েত আমলের লেখকদের সম্পর্কে আমরা, অন্তত আমি, প্রায় অজ্ঞই বলা চলে। সলোকভ ছাড়া আর কোনও নামই চট করে মনে পড়ে না। তার কারণ, আমাদের মিডিয়াগুলি পশ্চিম-শাসিত। ইংরেজি ভাষার প্রতি দাসত্বের জন্য আমরা সবসময় ইংল্যান্ড- আমেরিকার মুখাপেক্ষী। টাইম-নিউজউইক যাকে বিশ্ব সংবাদ বলে সেগুলিকেই আমরা মনে করি সাম্প্রতিক বিশ্বের উল্লেখযোগ্য খবর। ওরা পাস্তেরনাক বা সোলঝেনিৎসিনকে নিয়ে শোরগোল শুরু করলে তারপর আমরা ওই লেখকদের কথা জানতে পারি এবং তাদের লেখা পড়তে আগ্রহী হই। এমনকী ইয়েভতুশেংকো ও ভজনেসেনস্কির মতন আধুনিক কালের কবিদের কথাও জেনেছি ওই একই উপায়ে। ওঁদের মার্কিন দেশ সফরের সময় খুব হই চই হয়েছিল বলে। আধুনিক সোভিয়েত লেখকদের প্রতিনিধিত্বমূলক লেখার ভালো ইংরিজি অনুবাদ আমরা সরাসরি বইয়ের দোকানে পাই না। কনসুলেট থেকে মাঝে মাঝে দু-চারটি বই বাড়িতে পাই, সেগুলিকে মনে হয় প্রচারমূলক, পড়তে ইচ্ছে করে না।
এক কাপ চা আগেই ফুরিয়ে গেছে, এরপর নিলাম এক বোতল করে মিনারাল ওয়াটার। সারগেই আমাকে বোঝাল যে এই মিনারাল ওয়াটার পেটের পক্ষে খুব ভালো। শ্রীমতী সোলগানিক বললেন, বেশি খাবেন না যেন!
আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল। আরও অনেকক্ষণ চলতে পারত। কিন্তু শ্রীমতী সোলগানিকের অন্য কাজ আছে। তিনি বললেন, আবার পরে একদিন আসবেন, আবার গল্প হবে।
বিদায় নেওয়ার সময় তিনি জিগ্যেস করলেন, আপনাদের লেখক সমিতি সম্পর্কে কিছু জানা হল না। আপনাদের সমিতি কীভাবে চলে?
অমি বললুম, আমাদের কোনও লেখক সমিতি নেই।
তিনি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, লেখকদের কোনওরকম ইউনিয়ান নেই?
আমাকে আবার বলতে হল, না। কোনওরকম ইউনিয়ান নেই।
বাঙালি লেখকদের কোনও ইউনিয়নের কথা আমি আগে চিন্তা করিনি। এখন মনে হল, মস্কোর মতন আমাদেরও লেখকদের একটা মিলনস্থান থাকলে বেশ হত! তাহলে মল্লিক প্যালেস কিংবা কুচবিহারের রাজার বাড়ি কিংবা ভাওয়ালের রানির বাড়ি কি সরকার আমাদের দিত? সে আশা দুরাশা! সোভিয়েত ইউনিয়ানের লেখকদের সম্মান অনেক বেশি।
গেটের বাইরে এসে আমাদের গাড়িটি খুঁজে পাওয়া গেল না। সারগেই বলল, আমি তো ভেবেছিলুম আমরা এখানে খেয়ে নেব, তাই ড্রাইভারকেও খেয়ে আসতে বলেছিলুম, সাড়ে চারটের মধ্যে ফেরার কথা। দেখি, গাড়িটা বোধহয় অন্য কোথাও রেখেছে। সুনীলজি, আপনি এই পার্কটায় ততক্ষণ বসুন।
এটাকে ঠিক পার্ক বলা যায় না, রেলিং ঘেরা খানিকটা জায়গা, কয়েকটি বেঞ্চ আর ঘাস-চটা মাটি। দুটি বাচ্চাকে নিয়ে এক বৃদ্ধা বসে আছেন একদিকে। আমি আর একটি বেঞ্চে বসলুম। বাচ্চাগুলি খেলতে-খেলতে একবার আমার কাছে চলে এল। ভাষা জানি না, তাই ওদের সঙ্গে কোনও কথা বলতে পারলুম না, কিন্তু তারা আমায় কী যেন বলছে। বৃদ্ধা দেখছেন আমাকে। মনে হয় দিদিমা এসেছেন তাঁর নাতি-নাতনি নিয়ে। তিনিও আমায় কিছু বললেন, একটি বর্ণও বুঝলুম না। হাত নেড়ে হাসিমুখে আমার অজ্ঞতার কথা জানালুম।
সেই বৃদ্ধ বাচ্চা দুটিকে ডেকে পার্ক থেকে বেরিয়ে যেতেই ঝড় উঠল। প্রথমে ধুলোর ঘূর্ণি, তারপর উড়ে এল অসংখ্য শুকনো পাতা, তারপরই বৃষ্টি।
সারগেই ছুটতে-ছুটতে ফিরে এল। তার উদভ্রান্ত অবস্থা। সে বলল, গাড়িটা খুঁজে পাচ্ছি না! এদিকে বৃষ্টি এসে গেল!
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো খুব বড়-বড়। একটুক্ষণ থাকলেই ভিজে যাব। পার্ক থেকে বেরিয়ে আমি পাশের একটা বাড়ির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দাঁড়ালুম। অত্যন্ত শীতের দেশ বলে এসব জায়গায় প্রায় সব বাড়িতেই দুটো করে দরজা থাকে। প্রথমে একটা ভারী কাঠের দরজা। তারপর একটু ফাঁক দিয়ে একটা কাচের দরজা। আমি ওই মাঝখানের জায়গাটায় দাঁড়ালুম। কার বাড়ি জানি না। কাচের দরজা দিয়ে দেখে মনে হয় কোনও ডাক্তারের চেম্বার। কাচের দরজাটা তালাবন্ধ, ভেতরে কেউ নেই।
সারগেই আবার গাড়ি খুঁজতে গেছে। খানিকক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি আবার বাইরে বেরুতেই শীতের চাবুক খেলুম। বৃষ্টি এবং শনশনে হাওয়ায় তাপমাত্রা হঠাৎ অনেক নেমে গেছে, আমি তাড়াতাড়ি আবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এলুম। আমাদের দেশে এইরকমভাবে কারুর বাড়িতে ঢুকলে নিশ্চয়ই কেউ এসে কড়া গলায় বলত, কী চাই মশাই? এখানে কী করছেন? এদেশে এরকম কেউ বলে না। তবু অস্বস্তি বোধহয়।
সারগেই আবার এসে খুবই লজ্জিতভাবে কাঁচুমাচু গলায় জানাল যে গাড়িটা কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ গাড়িটাকে সে এখানেই রাখতে বলেছে...।
আমি তাকে বললুম, তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ কেন? তুমি এখানে দাঁড়াও আমার সঙ্গে। গাড়িটা এসে পড়বে নিশ্চয়ই।
সারগেই সে কথা শুনল না। বৃষ্টি মাথায় করে সে আবার ছুটে গেল। আমি শীত কাটাবার জন্য একটার পর একটা সিগারেট টানতে লাগলুম।
গাড়িটা এল প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে। সারগেই-এর এত বেশি ব্যস্ততার কারণ, কোনও একটা জায়গায় গিয়ে খোঁজ নিতে হবে যে আজ সন্ধেবেলা কোনও ব্যালে বা অপেরার থিয়েটারের টিকিট পাওয়া যাবে কি না, সেখানে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
গাড়ি চলবার পর সারগেই বলল, ড্রাইভার দেরি করে আসার যে কারণ জানাল, তা প্রায় একটা ডিটেকটিভ বই-এর মতন!
আমি বললুম, তাই নাকি?
সারগেই বলল, ড্রাইভার খেয়ে ফিরে আসছিল...এমন সময় রাস্তায় একটা ঘটনা ঘটে। একটা চোর চুরি করে দৌড়ে পালাচ্ছিল, এমন সময় পুলিশ এই গাড়িটাকে থামিয়ে উঠে পড়ে সেই চোরটাকে ধরবার জন্য।
—তারপর চোরটা ধরা পড়েছে?
—বলছে তো ধরা পড়েছে।
ড্রাইভার ইংরেজি বোঝে না। তবু এখন সে ঘাড় ফিরিয়ে রুশ ভাষায় অনেক কিছু বলতে লাগল সারগেইকে।
সারগেই আমাকে বলল, তা হলেই বুঝতে পারছেন, সুনীলজি। আমাদের দেশেও চোর আছে!
ওর বলার ভঙ্গিতে হো-হো করে হেসে উঠলুম।
নির্দিষ্ট স্থানটিতে এ পি এন-এর একজন প্রতিনিধি তখনও অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। ব্যালের টিকিট পাওয়া যায়নি। অপেরার টিকিট পাওয়া গেছে। তবে বলশয় থিয়েটারে নয়, ক্রেমলিন থিয়েটারে।
প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। মাঝখানে এক ঘণ্টা সময় আছে। সারগেই প্রস্তাব জানাল, এই সময়টায় আমরা কিছু খেয়ে নিতে পারি। সকালে ব্রেক ফাস্ট বেশ হেভি হয়েছিল বলে আমার তখনও খিদে পায়নি। সারগেই বলল যে, অপেরা দেখে বেরুবার পর অনেক দেরি হয়ে যাবে, তখন খাবার পাওয়া যাবে না। তাতেও আমি তখন খেতে রাজি হলুম না। পেট ভরতি থাকলে ঘোরাঘুরি করতে মন লাগে না।
হোটেলে ফিরে মুখ-হাত ধুয়ে এক পেয়ালা করে কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়লুম দুজনে। আসলে সময় বেশি হাতে নেই। ক্রেমলিন থিয়েটার ক্রেমলিন প্রাসাদের মধ্যে, সেদিকে ঢুকতে হয় অন্য এক রাস্তা দিয়ে। এবং গেটের সামনে লম্বা লাইন। কোনওরকম হ্যান্ড-ব্যাগ বা ছাতা-টাতা নিয়ে ভেতরে ঢোকার নিয়ম নেই। সারগেই-এর হাতে একটা ব্যাগ ছিল, দ্বাররক্ষী তাকে আটকাল। সেই ব্যাগটা তাকে জমা রেখে আসতে হল বেশ খানিকটা দূরে।
ক্রেমলিন এলাকার মধ্যে অনেকগুলি প্রাসাদ ও গির্জা আছে। থিয়েটার বাড়িটি নতুন। একেবারে অত্যাধুনিক কায়দায় তৈরি। নতুনত্বের একটা দীপ্তি ঠিকরে বেরুচ্ছে। শ্বেত পাথরের মেঝে যেন কাচের মতন স্বচ্ছ। মার্কিন দেশে আমি অনেক বড় থিয়েটার হল দেখেছি, তবুও আমি এই থিয়েটার হলটি দেখে মুগ্ধ হলুম।
আমরা ভেতরে ঢুকে আসন খুঁজে বসবার সঙ্গে-সঙ্গে অপেরা শুরু হয়ে গেল।
৩
অপেরাটির নাম, অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, 'রাজার নব বধূ'। ষোড়শ শতকের আইভান দা টেরিবল-এর আমলের ঘটনা, একটি বিয়োগান্তক প্রণয় কাহিনি। সারগেই আমাকে সংক্ষেপে বিষয়টি বুঝিয়ে দিল, যদিও অপেরা-তে কাহিনির ভূমিকা যৎসামান্য।
আমি প্রথমেই সবিস্ময়ে লক্ষ করলুম মঞ্চসজ্জা। প্রোসেনিয়ামটি প্রকাণ্ড, ধরা যাক আমাদের রবীন্দ্র সদনের প্রায় আড়াই গুণ, মাঝে মাঝেই প্রায় শ' খানেক অভিনেতা-অভিনেত্রী এক সঙ্গে মঞ্চে থাকছেন, তবু মঞ্চটিকে ভিড়ে ভারাক্রান্ত মনে হচ্ছে না। মঞ্চের ঠিক মাঝখানে একটি মহীরুহ। অসংখ্য ডালপালা ছড়ানো আস্ত একখানা জলজ্যান্ত গাছকে কী করে মঞ্চের ওপরে স্থাপন করা গেল তা ভেবে আমি অবাক হচ্ছিলুম, তারপর খুব নজর করে বুঝলুম, গাছটি সত্যিকারের না, সিনথেটিক, অতি সূক্ষ্ম মাকড়সার জালের মতন তার দিয়ে ডালগুলো ওপর থেকে বাঁধা, তবে তা বোঝা খুবই শক্ত। মঞ্চে এত বড় গাছ আমি আগে কখনও দেখিনি।
মঞ্চের পেছনে বাঁ-দিকে একটা রাস্তা, মনে হয় অনেক দূর থেকে লোকেরা হেঁটে আসছে। মঞ্চের ডেপথ সত্যিই অতখানি না কোনও মায়া সৃষ্টি করা হয়েছে তা আমি ঠিক ধরতে পারলুম না।
আমরা বসেছি সামনের দিকে দামি আসনে। প্রেক্ষাগৃহটি পরিপূর্ণ। মনে হয় যেন পুরুষের চেয়ে মহিলা-দর্শকের সংখ্যা অনেক বেশি। তিন-চারজন করে মহিলা এক সঙ্গে এসে বসেছেন, সঙ্গে কোনও পুরুষ নেই। এমনকী কোনও-কোনও মহিলা একাও এসেছেন বোঝা যায়, কেন না, বিরতির সময়েও কারুর সঙ্গে কোনও কথা বলছেন না। আমাদের পাশেই বসেছেন দুই অসম বয়েসের নারী, ওঁরা এক সঙ্গে এসেছেন, খুব সম্ভবত মাসি-বোনঝির মতন সম্পর্ক। এই ব্যাপারটি একটু অভিনব লাগল, কেন-না, পশ্চিমি দেশগুলিতে দেখেছি, পুরুষ-বন্ধু বা স্বামী ছাড়া মেয়েদের একা-একা সিনেমা-থিয়েটার দেখার প্রথা নেই।
অপেরাটির নট-নটী বা গায়ক-গায়িকাদের নাম আমি জানি না, সারগেই একটা স্মারক পুস্তিকা এনে দিয়েছে বটে, কিন্তু তা সবই রুশ ভাষায় লেখা। তবে সারগেই জানাল, রানির ভূমিকায় যিনি গাইছেন, তিনি খুবই বিখ্যাত এবং এই অপেরাটি খুব জনপ্রিয়, কয়েকশো রাত চলছে।
প্রথম অঙ্কের বিরতির সময় আমি বাইরে গেলুম সিগারেট টানতে। প্যাকেটটি খোলা মাত্র একজন লোক এসে হাত বাড়িয়ে কিছু বললেন। বুঝলুম সিগারেট চাইছেন। আমি ভারতীয় সিগারেট নিয়ে গেছি, সাগ্রহে প্যাকেটটি বাড়িয়ে দিয়ে বললুম, দেখুন, আপনার ভালো লাগে কি না। ভদ্রলোক ইংরিজি জানেন না, তবে সিগারেট ধরিয়ে তিনি তাঁর মাতৃভাষায় যা বললেন, তাতে অনুমান করলুম তার পছন্দ হয়েছে।
দ্বিতীয় অঙ্কের বিরতির সময় সারগেই আমাকে নিয়ে এল দোতলায়। এখানে রয়েছে একটি ছোট রেস্তোরাঁ, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। এখানে পাওয়া যায় কয়েক রকমের স্যান্ডউইচ আর গরম-গরম সসেজ ভাজা, বিয়ার আর ছোট-ছোট ওয়াইনের বোতল। ভাগ্যিস আগেই ডিনার খেয়ে নিইনি, তাই এখন এই হালকা ধরনের সুখাদ্য দিয়ে নৈশভোজ সেরে নেওয়া গেল।
তৃতীয় অঙ্কটি আমি আর তেমন উপভোগ করতে পারলুম না, আমার ঘুম এসে গেল। ক্রেমলিন প্রাসাদের অভ্যন্তরে সুরম্য থিয়েটার হলে বিখ্যাত রুশ অপেরা দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে পড়া খুবই লজ্জার কথা! এরকম সুযোগ ক'জন পায়? কিন্তু ঘুম এসে গেলে আমি কী করব? ভাষা এক বর্ণ বুঝছি না, অপেরার হাই-পিচের গান বেশিক্ষণ উপভোগ করার মতন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের জ্ঞানও আমার নেই। ক'জন সাহেব ভীমসেন যোশীর গান ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনতে পারে? আমি থুতনিতে চিমটি কাটলুম, হাতের লোম টানলুম, বাঁ-হাতের কড়ে আঙুল বেঁকিয়ে ফেললুম, কিছুতেই কিছু হয় না। ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন, এইরকম অবস্থায় ঘুম তাড়ানো কত শক্ত। আশেপাশের লোকরা হয়তো আমাকে দেখছে ঢুলে-ঢুলে পড়তে। শেষ পর্যন্ত মাথা হেলান দিয়ে দু-হাতের তালুতে মুখ অনেকখানি ঢেকে গভীর মনোযোগের ভঙ্গি করে রইলুম। কে জানে নাক ডেকেছিল কি না!
আশ্চর্য ব্যাপার, শো শেষ হওয়ার পর বাইরে আসতেই ঘুম একেবারে হাওয়া।
গাড়িটা আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সারগেই জিগ্যেস করলো, সুনীলজি, হেঁটে যাবেন? এখান থেকে হোটেল খুব দূর নয়।
আমি তক্ষুনি রাজি। হেঁটে না ঘুরলে কোনও শহরই ভালো করে চেনা যায় না। রাত মোটে পৌনে দশটা। টিপি-টিপি বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু শীত খুব বেশি নয়। ওভারকোটের পকেটে দু-হাত ভরে সাহেবি কায়দায় হাঁটতে লাগলুম।
অন্যান্য পশ্চিমি বড় শহরের তুলনায় মস্কোর রাত্তিরের রাস্তার চাকচিক্য, স্বাভাবিক কারণেই, অনেক কম। রাস্তায় আলো যথেষ্ট আছে, কিন্তু প্যারিস-লন্ডন-নিউ ইয়র্কের রাস্তায় যে অসংখ্য দোকানপাট আর বিজ্ঞাপনের রঙিন ঝলমলে আলো, তা এখানে নেই। সোভিয়েত দেশে কোথাও বিজ্ঞাপন নেই, কারণ সমস্ত ব্যাবসাই এদেশে সরকার-পরিচালিত, সুতরাং পণ্যদ্রব্যের ভালো-মন্দ প্রমাণ করার বিজ্ঞাপন-প্রতিযোগিতার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
মিনিট কুড়ির মধ্যেই পৌঁছে গেলুম হোটেলে। দরজার কাছ থেকে সারগেই বিদায় নিল। তাকে যেতে হবে অনেক দূরে।
হোটেলের প্রত্যেক তলায় একজন করে মহিলা বসে থাকেন। হোটেল থেকে আমাকে একটা কার্ড দেওয়া হয়েছে, সেটা জমা দিলে ঘরের চাবি পাওয়া যায়। আমার হাতে চাবিটি তুলে দেওয়ার সময় প্রবীণ মহিলাটি মিষ্টি হেসে কত কী বললেন, হায়, কিছুই বুঝতে পারলুম না। আমি ঘাড় নেড়ে বললুম, পাসিবো, পাসিবো, অর্থাৎ ধন্যবাদ, ধন্যবাদ!
ঘরে এসে জামা-কাপড় ছাড়ার পর বেশ চাঞ্চল্য বোধ করলুম। এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব? মাত্র রাত দশটায় ঘুমোনো আমার পক্ষে অসম্ভব। অপেরা দেখতে-দেখতে যে ঘুম ভর করেছিল, তা একেবারে উপে গেছে! বাইরের আকাশ পুরোপুরি অন্ধকার নয়। এখন আড্ডা মারতে ইচ্ছে করছে। ঘরে একটা টেলিফোন আছে, তারও তো ব্যবহার করা দরকার। দেশ থেকে মণীন্দ্র রায় লিখে দিয়েছেন ননী ভৌমিকের ঠিকানা। কিন্তু ফোন নাম্বার দেননি। নবনীতা দেবসেন তাঁর এক বান্ধবীর জন্য একটি উপহারের পুঁটুলি পাঠিয়ে দিয়েছেন, সঙ্গে আছে সেই বান্ধবীর ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার। বান্ধবীর নাম সায়েলা।
অপারেটরকে প্রথমে জিগ্যেস করলুম, তিনি আমাকে ননী ভৌমিকের ফোন নাম্বার জোগাড় করে দিতে পারেন কি না। তিনি বোধহয় আমার ইংরেজি বুঝতে পারলেন না। তারপর আমি সায়েলার টেলিফোন নাম্বার দিয়ে লাইন ধরে দিতে বললুম।
ওপাশে শোনা গেল একটি পুরুষকণ্ঠ। তিনি বললেন যে সায়েলা এখন একটু ব্যস্ত আছেন, তাঁর সঙ্গে আমার কী দরকার এবং আমি কে?
সায়েলা-কে আমি কখনও চোখে দেখিনি, শুধু এইটুকু জানি, তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা শ্রীপাদ অমৃতপাদ ডাঙ্গে-র কন্যা। আমি পুরুষকণ্ঠটিকে নবনীতা দেবসেন-এর উপহার বিষয়ে জানালুম। তিনি প্রথমে একটুক্ষণ নবনীতা দেবসেন কে তা চিনতে পারলেন না। আমি নানারকম উচ্চারণে নবনীটা, নবওনী-ই-টা এইরকমভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলুম। তাতে বিশেষ কিছু সুবিধে হল না। আমি কালই লেনিনগ্রাড চলে যাব, ফিরব দশদিন বাদে, সুতরাং উপহারটা কাল সকালের মধ্যেই পৌঁছে দিলে আমার পক্ষে সুবিধে হয়। তখন তিনি বললেন যে তাঁর বাড়ি আমার হোটেলের খুবই কাছে, এই রাত্তিরেই তিনি এলে আমার কোনও আপত্তি আছে কি না।
আমি শুনে উৎফুল্ল হলুম। যাক তবু একজনের সঙ্গে গল্প করা যাবে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনি পৌঁছে গেলেন, পুরোদস্তুর সাহেবি কেতায় সজ্জিত একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। তাঁর নাম রাজা আলি। তিনি বললেন যে তাঁর স্ত্রী নবনীতা দেবসেনকে খুব ভালোই চেনেন, তিনিও এখন মনে করতে পেরেছেন, নবনীতা এই তো কিছুদিন আগে মস্কো ঘুরে গেলেন।
পুঁটুলিটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি এদেশে কতদিন আছেন?
তিনি আঠারো...কুড়ি বছর, কী জানি, আই লস্ট কাউন্ট!
কিন্তু রাজা আলির সঙ্গে আমার আড্ডা জমল না। তিনি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, আমিও তেমন তুখোড় কথাবাজ নই। তিনি একবার শুধু জিগ্যেস করলেন, আমি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে চিনি কি না। তারপর চুপ। আমি কোনও প্রশ্ন করলে উনি মনোসিলেবলে উত্তর দেন। কিন্তু আমি তো ওঁর ইন্টারভিউ নিতে আসিনি। তা ছাড়া ডাঙ্গে সাহেবের জামাই-কে ঠিক কী কী প্রশ্ন করা যায়, তাও মনে এল না। সুতরাং উনি নিঃশব্দে বসে পাইপ টানতে লাগলেন, আমি টেবিলের কাচটি দেখতে লাগলুম গভীর মনোযোগ দিয়ে।
এক সময় উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা, এবার আমি চলি।
আমি বললুম, শুভ রাত্রি।
হোটেলের অত কাছে ওঁদের বাড়ি অথচ আমাকে একবার চা খাওয়ারও নেমন্তন্ন করলেন না। এটা একটু অস্বাভাবিক, সাধারণত সবাই বলেন। অবশ্য রাজা আলি কুড়ি বছর ধরে মস্কোতে কী করেন তাও আমার জানা হয়নি।
তারপর বিছানায় শুয়েও আর ঘুম আসে না। আলো নিভিয়ে ছটফট করতে লাগলুম। ঘুম না-আসার একটা কারণ হল বালিশ। এমন পেল্লায় বালিশ আমি জীবনে দেখিনি। আমাদের সাধারণ ব্যবহার্য বালিশ তিনখানা জোড়া দিলে যা হয়। যেমন মোটা, তেমনি চওড়া। এ শুধু মাথায় দেওয়ার বালিশ নয়, কাঁধ পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। বালিশ বাদ দিয়ে শুলেও ফাঁকাফাঁকা লাগে। চোখ মেলে রেখে অনুভব করতে লাগলুম, পৃথিবীর ঘূর্ণন, রাত্রি গড়িয়ে যাচ্ছে গভীরতর রাত্তিরের দিকে।
শেষ রাতে নিশ্চয়ই ঘুম এসেছিল, তবু জেগে উঠলুম বেশ সকাল সকাল। উঠেই চায়ের অভাব বোধ করলুম। আমরা সবাই অভ্যেসের দাস, ঘুম থেকে উঠেই এক কাপ চা না পেলে সারাদিনের জীবনযাত্রা শুরু করতে পারি না। চা পাব কোথায়? আমার কাছে এক কোপেকও নেই। যখন যা দরকার তা সারগেই কিনে দিচ্ছে। এ দেশের হোটেলে রুম সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে কি না জানি না। নিজের ইচ্ছে মতন হোটেল থেকে কিছু কিনে তারপর বিলে সই করার অধিকার আমার আছে কি না তা-ই বা কে জানে!
সেরকম স্মার্ট লোক হলে নিশ্চয়ই হোটেলের রিসেপশানে ফোন করে একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলত। কিন্তু আমি এসব ব্যাপারে একেবারেই তৎপর নই। মুখটুখ ধুয়ে একখানা বই হাতে করে সারগেই-এর প্রতীক্ষা করতে লাগলুম।
ন'টা আন্দাজ দরজায় করাঘাত। দরজা খুলেই দেখি তিন বঙ্গীয় যুবক-যুবতী। এদের মধ্যে একজন আমার সেই বিমানযাত্রার সঙ্গী সুবোধ রায়, অন্য দুজনের নাম সুজিত বসু ও সঙ্ঘমিত্রা দাশগুপ্ত। আমি একলা রয়েছি বলে ওরা সঙ্গ দিতে এসেছে।
সুবোধ জিগ্যেস করল, আপনার ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়েছে?
আমি বললুম, ব্রেকফাস্টের জন্য ব্যস্ততা নেই, তবে এক কাপ চা জোগাড় করতে পারলে মন্দ হত না।
সুবোধ শুধু যে খুব বিদ্বান তাই-ই নয়, তার ব্যবহারও খুব ব্যক্তিত্বপূর্ণ। সে বলল, শুধু চা কেন, এই ঘরে বসেই আমরা ব্রেকফাস্ট খাব, আমরাও খেয়ে আসিনি। হাঁকডাক দিয়ে তক্ষুনি সেসব ব্যবস্থা করে ফেলল। এক গাদা হ্যামবার্গার ও স্যান্ডউইচ এবং চায়ের অর্ডার দেওয়ার পর দ্বিতীয় চিন্তায় সে আবার বলল, আপনি রাশিয়ান শ্যাম্পেন খাননি তো? এক বোতল শ্যাম্পেনেরও অর্ডার দেওয়া যাক।
সকাল বেলাতে শ্যাম্পেন? আমি ক্ষীণ আপত্তি জানালেও সুবোধ পাত্তাই দিল না।
সুজিত বসু কবিতা লেখে এবং ফিজিকসে পি-এইচ ডি করছে। সঙ্ঘমিত্রাও পি-এইচ ডি করছে সাইকোলজিতে, সাহিত্য খুব ভালোবাসে। লাজুকতা ভাঙতে একটু সময় লাগল। তারপরেই আড্ডা জমে গেল।
শ্যাম্পেনের বোতল খোলার কায়দাটা রপ্ত করতে হয়। আনাড়ি হাতে ছুটন্ত ছিপি জানলার কাচ ভাঙতে পারে, কারুর চোখেটোখে লাগলে গুরুতর ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। সুতরাং শ্যাম্পেনের বোতল খোলার সম্মান ওরা আমাকে দিতে চাইলেও আমি তা প্রত্যাখ্যান করলুম। সুবোধ নিজেই খুলল খুব সাবলীলভাবে। সকালবেলা চা-পানের আগেই সুরার গেলাসে চুমুক দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম।
আমাদের খাওয়াদাওয়ার মধ্য পথে সারগেই এসে হাজির। আমি তখনই বাইরে বেরুবার পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে নেই দেখে সারগেই বেশ ব্যস্তভাবে বলল, এ কী! আপনি এখনও তৈরি হননি? আমাদের যে সাড়ে দশটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে!
সুবোধ আড্ডার মেজাজে বলল, বসুন, বসুন, সাড়ে দশটার এখন অনেক দেরি।
সুবোধ, সুজিত, সঙ্ঘমিত্রা তিনজনই রুশ ভাষা বেশ ভালো জানে। আমাদের ক্রেমলিন যেতে হবে শুনে ওরা বলল, সে তো গাড়িতে মাত্র আট-দশ মিনিটের রাস্তা। মস্কোতে ট্রাফিক জ্যাম প্রায় হয় না বললেই চলে, সুতরাং ব্যস্ত হওয়ার কী আছে?
সারগেই তবু ছটফট করতে লাগল। অতএব আমি তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে নিয়ে কোট-প্যান্টালুন পরে নিলুম। সারগেই-এর আপত্তি সত্বেও খাদ্য-পানীয়র সব দাম মিটিয়ে দিল সুবোধ। লেনিনগ্রাড থেকে ফিরে ওদের সঙ্গে আবার দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়ে পড়লুম আমরা দুজনে।
আজ অন্য গাড়ি, যিনি চালাচ্ছেন, তাঁর ফরসা, গোলগাল হাসি-খুশি চেহারা, অনেকটা অভিনেতা পিটার উস্তিনভের মতন। সারগেই এঁর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল, ইনি এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না, করমর্দনের পর আমাকে একটি রুশ সিগারেট দিলেন, বিনিময়ে আমিও উপহার দিলুম এক প্যাকেট ভারতীয় সিগারেট।
গাড়ি চলতে শুরু করার পর সারগেই আমাকে জিগ্যেস করল, সুনীলজি, কাল রাত্তিরে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
আমি মজা করার জন্য বললুম, কাল রাত্তিরে আমার ঘরে একজন অতিথি এসেছিল।
সারগেই রীতিমতন চমকে গেল। জিগ্যেস করল, অতিথি এসেছিল, আপনার হোটেলের ঘরে? কী করে এল?
আমি বললুম, সম্ভবত হেঁটেই এসেছিল।
—আপনার চেনা কেউ?
—না। জীবনে আগে কখনও দেখিনি।
—সে কি? কে এসেছিল? কেন এসেছিল?
তখন আমি হাসতে-হাসতে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলুম। ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা এস এ ডাঙ্গের নাম সারগেই শুনেছে।
আমরা আজ ক্রেমলিনের প্রধান প্রবেশ পথের বাইরে একটা শিকল-ঘেরা জায়গায় এসে দাঁড়ালুম। এখানে খুব কড়া সিকিউরিটি ব্যবস্থা। এর ভেতরেই সোভিয়েত সরকারি দফতর। এখানে দাঁড়িয়েই ১৯১৮ সালের ১২ মার্চ লেনিন মস্কোকে বিশ্বের প্রথম শ্রমিক-কৃষক রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
ঠিক সাড়ে দশটায় ভেতর থেকে দুজন লোক বেরিয়ে এসে আঙুলের ইশারায় আমাদের ডাকল। সারগেই বলল, দেখলেন তো, সুনীলজি, ঠিক ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে সাড়ে দশটায় আমাদের ডাকা হল। এক মিনিট দেরি হলে ওঁরা ফিরে যেতেন, আমাদের আর ঢোকা হত না। সেই জন্যই আমি আপনাকে তাড়া দিচ্ছিলুম।
সিকিউরিটির দুই ব্যক্তি আমাদের নিয়ে চলল ভেতরে। আমরা যাচ্ছি লেনিনের বাসভবন দেখতে। বিপ্লবের আগে দুশো বছর অবশ্য মস্কো রাশিয়ার রাজধানী ছিল না, তাহলেও ক্রেমলিনের প্রাসাদই ছিল চিরকাল রাজ-ক্ষমতার প্রতীক। এই প্রাসাদের একটি অংশে লেনিন তাঁর এক বোন ও স্ত্রী স্ক্রুপকায়াকে নিয়ে থাকতেন।
লেনিনের জীবনযাত্রা ছিল সাদামাটা। তাঁর ব্যবহৃত থালা-বাসন, পোশাক-পরিচ্ছদ, চেয়ার-টেবিল সবই অবিকল রাখা আছে। রয়েছে লেনিনের পুস্তক-সংগ্রহ। রান্নাঘর ও শয়নকক্ষ ছাড়া বসবার ঘর তিনখানি। লেনিনের লেখার টেবিলের ওপর রয়েছে একটি মূর্তি, এটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। ডারউইন সাহেবের ইভোলিউশান তত্ব বিষয়ক বইয়ের ওপর বসে অছে একটি বাঁদর, তাঁর হাতে একটি মানুষের মাথার খুলি, বাঁদরটি খুব চিন্তিতভাবে সেদিকে চেয়ে আছে।
লেনিনের বাসস্থানে ঘুরতে-ঘুরতে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক এইচ জি ওয়েলস এইখানে এসেছিলেন লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে। লেনিন তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে যুদ্ধবিধ্বস্ত সোভিয়েত দেশের দ্রুত উন্নতি ঘটাবার একমাত্র উপায় সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। Goelro নামে যে বিদ্যুৎ পরিকল্পনা হয়েছিল তার লক্ষ্য ছিল বিদ্যুতের উৎপাদন আগামী দশ বছরের মধ্যে দশ গুণ বাড়িয়ে ফেলা, বড়-বড় নদীগুলোর ওপর নতুন তিরিশটি পাওয়ার স্টেশন স্থাপন করা।
লেনিনের এই পরিকল্পনাকে এইচ জি ওয়েলসের মনে হয়েছিল অসম্ভব; তিনি লেনিনকে আখ্যা দিয়েছিলেন, ''দা ড্রিমার ইন দা ক্রেমলিন''। লেনিনের স্বপ্ন কিন্তু সফল হয়েছিল। বলশয় থিয়েটারে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ''কমিউনিজম ইজ সোভিয়েট পাওয়ার প্লাস দা ইলেকট্রিফিকেশন অফ দা হোল কান্ট্রি।'' হায়, আমাদের পশ্চিমবাংলা তথা ভারতবর্ষে বিদ্যুতের কী অবস্থা! উৎপাদন বৃদ্ধির বদলে ক্রমশই আরও কমে যাচ্ছে।
ক্রেমলিন প্রাসাদের এই অংশে যখন লেনিন বাস করতে আসেন, তখনই তার স্বাস্থ্য ভালো নয়। ১৯১৮ সালে তাকে মেরে ফেলার একটা চেষ্টা হয়েছিল, সেই আঘাত পুরোপুরি সারেনি। তাই নিয়েই তিনি নতুন রাষ্ট্র গড়ার প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন, তার ফলে বিপ্লবের পর ছ'বছরের মধ্যেই তিনি মারা যান।
ক্রেমলিন থেকে বেরিয়ে আমরা গেলুম মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছুটি, তাই ভেতরে যাওয়া হল না। গাড়িতে চার দিকটা একটা চক্কর দিয়ে এলুম। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবনটি বিশাল ও সুদৃশ্য, আধুনিক স্থাপত্যের একটা উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যেসব রাস্তা, তাতে রয়েছে সার-সার আপেল গাছ, এখন ছোট-ছোট আপেল ফলে আছে। আমাদের স্কুল-কলেজগুলোর পাশে অন্তত পেয়ারা গাছ লাগাবার কথাও কেউ চিন্তা করে না কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাটি সুবিশাল। সামনে মস্ত বড় চত্বর। তার পরে মস্কোভা নদী। অনেকগুলি টুরিস্ট বাস এসেছে, অর্থাৎ মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ও রীতিমতন একটি দ্রষ্টব্য ব্যাপার।
আমরা নদীর ধারে এসে দাঁড়ালুম। এই জায়গাটি বেশ উঁচু, এখান থেকে মস্কো শহর অনেকখানি দেখা যায়। নদীর পার ঢালু হয়ে অনেকখানি নেমে গেছে, মাঝে-মাঝে বেশ জঙ্গলের মতন। স্বাস্থ্য-উন্নতিকামীরা অনেকে সেখানে গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া পরে দৌড়চ্ছে। কয়েক জোড়া নব-বিবাহিত দম্পতিকে দেখলুম, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আবহাওয়া ভালো বলে বোধহয় এখন বিয়ের ধূম পড়ে গেছে। বরযাত্রীরা এখানে সঙ্গে করে এনেছে শ্যাম্পেনের বোতল, গেলাস ছাড়াই সবাই বোতল থেকে চুমুক দিচ্ছে। এরই মধ্যে দু-এক জনের অবস্থা বেশ টলটলায়মান মতন মনে হল।
নদীর ধার দিয়ে হাঁটলুম খানিকক্ষণ। এক সময়ে চোখে পড়ল একটি ছোট, পরিত্যক্ত গির্জা। গেটে তালা বন্ধ, বোঝা যায়, বহুদিন অব্যবহৃত।
আরও একটু বেড়াবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময় নেই। লেনিনগ্রাডের প্লেন ধরতে হবে।
হোটেলে ফিরে এসে আমরা লাঞ্চ সেরে নিলুম। সারগেই নিজে ইউক্রাইনের ছেলে। ও বলল, সুনীলজি, আপনি ইউক্রাইনিয়ান বর্স খেয়েছেন? খেয়ে দেখবেন?
আমি সবরকম খাবারই চেখে দেখতে রাজি। বেশ একখানা বড় জামবাটি ভরতি সুপ এল, তার মধ্যে নানারকম মাংসের টুকরো ও সবজি। এইরকম একটু সুপ খেলেই পেট ভরে যায়।
খাওয়া সেরেই সুটকেস নিয়ে ছুট দিলুম এয়ারপোর্টের দিকে। এটা ইন্টারনাল এয়ারপোর্ট। ছুটির মরশুম বলে প্রচণ্ড ভিড়। মস্কো ছেড়ে অনেকেই এখন বেড়াতে যাচ্ছে। সারগেই এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আমাকে ভি আই পি লাউঞ্জে নিয়ে গিয়ে বসাল। সেখানে মাত্র আমরা দুজন। এরকম জায়গায় বসতে কীরকম অস্বস্তি লাগে!
আরও খাতির করে আমাদের দুজনকেই প্রথমে তোলা হল বিমানে। আমার সুটকেসটা বুক না করিয়ে রেখে দেওয়া হল এয়ার হোস্টেসদের হেপাজতে, যাতে পৌঁছবার পর মাল খালাসের জন্য অপেক্ষা করতে না হয়। সিকিউরিটি চেকের সময় একটা বেশ মজা হল। পৃথিবীর সব বিমান বন্দরেই আজকাল এই ব্যবস্থা আছে। একটা মেটাল ডেটেকটার যন্ত্র সারা গায়ে বুলোয় অথবা একটা জায়গা পার হয়ে যেতে হয়, সন্দেহজনক কিছু থাকলে প্যাঁক-প্যাঁক শব্দ হতে থাকে। একজন মহিলা এখানে সিকিউরিটি চেক করছেন। আমার গায়ে যন্ত্রটা ছোঁয়াতেই প্যাঁক-প্যাঁক শব্দ করে উঠল। পকেটে খুচরো পয়সা কিংবা কোমরের বেল্টের মুখটার জন্যও অনেক সময় এই শব্দ হয়। আমার পকেটে পয়সা নেই, বেল্টটা খুলে ফেললুম, তবু যন্ত্রটা ছোঁয়াতেই আবার সেই শব্দ। আমি গায়ের কোটটা খুলে ফেললুম, তবুও শব্দ থামে না। এবারে মহিলাটি হাত দিয়ে আমার গা টিপেটুপে দেখলেন, সন্দেহজনক কিছু নেই। তবে কি যন্ত্রটা খারাপ হয়ে গেল? তিনি নিজের গায়ে যন্ত্রটা বোলালেন, কোনও শব্দ নেই, সারগেই-এর শরীরে বোলালেন, তখনও নিঃশব্দ। কিন্তু আমার গায়ে ছোঁয়াতেই আবার বেশ জোরে প্যাঁক-প্যাঁক করে ডাকতে লাগল।
একে কী বলা যায়, যন্ত্রের কৌতুক ছাড়া?
৪
মস্কো থেকে লেনিনগ্রাড দু-ঘণ্টার বিমান পথ। ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে এসে দেখলুম লবিতে প্রচণ্ড ভিড়, নানারকম ভাষায় কলস্বর। আমাদের জন্য দুটি ঘর অবশ্য আগে থেকেই বুক করা ছিল, ভিড় ঠেলে কাউন্টারে পৌঁছতেই ব্যবস্থা হয়ে গেল।
বিখ্যাত নেভা নদীর ধারেই এই হোটেল লেনিনগ্রাড। খুবই বড় হোটেল এবং অত্যাধুনিক কায়দার। অর্থাৎ সবকিছুই চৌকো কিংবা রেকটানগুলার। গত শতাব্দী পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় সব দেশেরই স্থাপত্যে গম্বুজ, খিলান, গোল গোল থাম দেখা যেত, আধুনিক স্থাপত্যে এসবের কোনও স্থান নেই। মস্কোর হোটেলটিতে তবু খানিকটা পুরোনো-পুরোনো ভাব ছিল, কিছু এই হোটেলটি একেবারে ঝকঝকে সাম্প্রতিক ধরনের। এখানকার লিফটগুলি স্বয়ংক্রিয়।
আট তলার ওপর সারগেই আর আমি পাশাপাশি দুটো ঘর পেয়েছি। সামনের জানলাটার পরদা সরাতেই অপূর্ব দৃশ্য। নেভা নদীর দু-পাশে সুন্দর গড়নের সব প্রাসাদের সারি। দূরে-দূরে দেখা যায় গির্জার চূড়া। নেভা নদী বেশ প্রশস্ত, অনায়াসেই জাহাজ যেতে পারে। এখান থেকে সমুদ্র বেশি দূরে নয়।
নিজের ঘরে জিনিসপত্র রেখে এসে সারগেই আমাকে জিগ্যেস করল, সুনীলজি, ক্লান্ত?
মাত্র দু-ঘণ্টা প্লেন জার্নিতে ক্লান্ত হব কেন? তা ছাড়া শীতের দেশে এমনিতেই ক্লান্তি বোধ কম হয়।
আমি বললুম, না, না, চলো, বেরুবে নাকি?
সারগেই বলল, আমি লেনিনগ্রাডে আগে আসিনি। চলুন, খানিকটা হেঁটে শহরটাকে অনুভব করে আসি।
পোশাক না বদলেই বেরিয়ে পড়লুম। হোটেলের গেটের সামনে ভিড় আরও বেড়েছে। অনেকেই বোধহয় জায়গা পায়নি। আগামীকাল মে-দিবসের মিছিল দেখবার জন্যই বাইরে থেকে বহু টুরিস্ট আসছে।
নেভা নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে একটা ছোট ব্রিজ পেরিয়ে এলুম। এই শহরের মধ্যে দিয়ে অনেকগুলি খাল এসে নেভা নদীতে পড়েছে। আমাদের হোটেলটি সেরকম একটি মোহানার কাছেই। বিশাল বিশাল বারোক স্টাইলের অট্টালিকা দেখলেই বোঝা যায়, এগুলি জার-এর আমলে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়ি ছিল, এখন বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়।
লেনিনগ্রাডের ইতিহাস আমরা সবাই কিছু-কিছু জানি। এই শহরের বয়েস কলকাতার চেয়েও কিছু কম। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পিটার দা গ্রেট এখানে এই বন্দর-শহরটির পত্তন করে রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। তখন এর নাম ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ। সুপরিকল্পিতভাবে অভিজাতদের জন্যই গড়া হয়েছিল নগরীটি। ডেকে আনা হয়েছিল ইউরোপের বিখ্যাত স্থপতিদের। চওড়া চওড়া রাস্তা, বড়-বড় পার্ক ঘিরে জমকালো সব বাড়ি। মাঝে-মাঝে খাল কেটে জলপথেরও ব্যবস্থা। এই শহরের পথে-পথে ঘুরে বেড়ালে চোখের আরাম হয়।
প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় এই শহরটির নাম পালটে যায়। সেন্ট পিটার্সবার্গের বার্গ অংশটুকু জার্মান ভাষা, তার মানে দুর্গ। সুতরাং এ শহরের নতুন নাম হল পেট্রোগ্রাড। বিপ্লবের প্রধান কেন্দ্রও ছিল এই শহর। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য পেট্রোগ্রাড নাম আবার বদল করা হয়।
হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে, শীত বেশি নেই। এইসব শীতের দেশে সন্ধ্যাগুলো খুব লম্বা হয়। এখন সাড়ে সাতটা বাজে, কলকাতায় এখন রীতিমতন অন্ধকার, লোডশেডিং হলে তো কথাই নেই, আর এখানে বেশ পরিষ্কার আলো। এইরকমই চলবে প্রায় ন'টা পর্যন্ত।
মোহানার মুখে একটা থেমে-থাকা জাহাজ দেখিয়ে সারগেই জিগ্যেস করল, সুনীলজি, এই জাহাজটার কথা জানেন? এই হচ্ছে বিখ্যাত অরোরা।
আমি ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের কথা জানি, অরোরার নাম আগে শুনিনি।
সারগেই জানাল যে, এই অরোরা থেকেই বিপ্লবের সংকেত দিয়ে প্রথম তোপধ্বনি হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সব স্কুলের ছেলে-মেয়েরাও এর নাম জানে। এখন জাহাজটিকে একটি মিউজিয়াম হিসেবে এখানে রাখা হয়েছে। যে-কেউ ভেতরে ঢুকে দেখতে পারে। তবে পাঁচটার মধ্যে আসতে হবে।
আমি সারগেইকে সামনে দাঁড় করিয়ে অরোরার একটি ছবি তুললুম। তারপর আর একটু বেড়িয়ে ফিরে এলুম হোটেলে। সারগেইকে এখন কিছু ফোনটোন করতে হবে। এখানকার এ পি এন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা, কাল সকালে মে-দিবস প্যারেড দেখতে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ঠিক করা ইত্যাদির ব্যবস্থা করবার জন্য সে চলে গেল। আমি জানলার কাছে চেয়ার টেনে বসে রইলুম চুপচাপ। নদীতীরের বাড়িগুলিতে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে আলোকসজ্জা।
হঠাৎ এক সময় আমার শরীরে রোমাঞ্চ হল। এই সেই সেন্ট পিটাসবার্গ, এখানকার রাস্তা দিয়ে ডস্টয়েভস্কি হেঁটেছেন! নিকোলাই গোগোল এখানে ইতিহাসের মাস্টারি করতে-করতে একদিন বুঝেছিলেন, সাহিত্যই তাঁর মুক্তির পথ; পুশকিন লিখেছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস, একটি নিগ্রোকে নিয়ে। সাহিত্য জগতের বিশাল বিশাল বনস্পতিদের স্মৃতিজড়িত সেই শহরে আমি বসে আছি?
অনেকক্ষণ বসে রইলুম জানলার ধারে। যেন একটা ঘোরের মধ্যে। খানিকবাদে ফিরে এল সারগেই। কাঁচুমাচু মুখে জানাল, ট্যাক্সি জোগাড় করা গেল না কিছুতেই। কাল মে ডে'র প্যারেডের জন্য অনেক রাস্তাতেই ট্রাফিক বন্ধ থাকবে, কোনও ট্যাক্সিই উইনটার প্যালেসে পৌঁছতে পারবে না। সুনীলজি, আপনি হেঁটে যেতে পারবেন তো?
সারগেই-এর মুখে সুনীলজি ডাক শুনে প্রত্যেকবারই আমার মজা লাগে। বাঙালিদের মধ্যে জি ব্যবহার করার রেওয়াজ নেই। উত্তর ভারত ও পশ্চিম ভারতে ওই ডাক চলে। আমি অবশ্য সারগেইকে নিরস্ত করি না। ওর মুখে ওই ডাক বেশ মিষ্টি লাগে, আমার এক মহারাষ্ট্রীয় বন্ধুর কথা মনে পড়ে।
হোটেল লেনিনগ্রাডের বিভিন্ন তলায় টুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য নানা ধরনের রেস্তোরাঁ আছে। তার মধ্যে দু-একটিতে গান-বাজনা, নাচেরও ব্যবস্থা রয়েছে, আমরা ঘুরে ঘুরে সব ক'টি দেখে নিয়ে মাঝারি ধরনের একটিতে নৈশভোজ সেরে নিলুম।
আমার দরজার কাছে এসে যখন শুভরাত্রি বলে বিদায় নিতে গেল সারগেই, আমি ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললুম, আমায় কিছু পয়সা দেবে?
সারগেই অবাক।
আমি হাসতে-হাসতে বললুম, সকালবেলা তোমার আগেই যদি আমার ঘুম ভাঙে তাহলে আমি এক কাপ চা কিনে খেতে চাই!
সারগেই ব্যস্ত হয়ে বললেন, আপনার যখনই দরকার হবে আমাকে ডাকবেন। এমনকী মাঝরাত্তিরেও দরকার হলে ডাকবেন বিনাদ্বিধায়।
তবু আমি নাছোড়বান্দার মতন ওর কাছ থেকে এক রুবল আদায় করলুম।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমার সহজে ঘুম এল না। কাল রাতে মস্কো ছিল নতুন জায়গা, আজ আবার নতুন জায়গায় এসেছি. বিছানার সঙ্গে দু-এক রাত্তির ভাব না জমলে ভালো ঘুম হয় না। আমার এই ঘরটি ডাবল বেড। ঘরের দুপাশে দুটি বিছানা পাতা। আমি একবার এক বিছানায় আর একবার অন্য বিছানায় শুতে লাগলুম। যেন আমি একাই দুজন মানুষ।
কাচের জানালায় পরদা টানিনি বলে ভোরের প্রথম আলো চোখে পড়ামাত্র ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে অবশ্য খুব ভোর নয়, পৌনে আটটা বাজে, কিন্তু বাইরে আবছা আবছা অন্ধকার রয়েছে এখনও। পাজামা-পাঞ্জাবি আর চটি পরেই বেরিয়ে এলুম ঘরের বাইরে। আমাদের ফ্লোরের এক প্রান্তে একটি ছোট রেস্তোরাঁ আগেই দেখে রেখেছিলুম, সেখানে এসে দেখলুম, সেটি সদ্য খুলেছে, একজন বৃদ্ধা বসে আছেন কাউন্টারে। আমিই প্রথম খদ্দের।
বৃদ্ধা মহিলা হেসে রাশিয়ান ভাষায় আমায় সুপ্রভাত জানালেন, আমি জানালুম ইংরেজিতে। প্রথমে এক কাপ চা নিলুম, তার স্বাদ আমার মনঃপূত হল না, তারপর এক কাপ কফি নিয়ে স্বাদটা বেশ ভালো লাগল।
ফিরে এসে দিনের প্রথম সিগারেটটি উপভোগ করার পর বেজে উঠল টেলিফোন। সারগেই বলল, সুনীলজি, এবার বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ুন, আমাদের সাড়ে আটটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে। ব্রেকফাস্ট বাইরে কোথাও খেয়ে নেব।
আমি বললুম, আমি তো তৈরি!
আজ আকাশ সামান্য মেঘলা। গরম জলে স্নান সেরে নেওয়ার ফলে শরীরটা বেশ তরতাজা লাগছে। এখন আমি পাঁচ-দশ মাইল অনায়াসে হেঁটে যেতে পারি।
নেভা নদী পার হওয়ার সময় ব্রিজের মাঝখানে একবার দাঁড়ালুম। যে-কোনও নতুন নদী প্রথমবার পার হওয়ার সময় বেশ কিছুক্ষণ নদীর সৌন্দর্য না দেখে আমার যেতে ইচ্ছে করে না। তাড়াহুড়ো করে, অন্যমনস্কভাবে কোনও নদী পার হওয়া উচিত নয়। সমস্ত জলেরই চরিত্র আলাদা।
আমরা ছেলেবেলায় ভূগোলে পড়েছিলুম যে এই নেভা নদীর জল বছরে চার-পাঁচ মাস জমাট বরফ হয়ে থাকে। নদীর মোহানাতেও এত বরফ জমে যে জাহাজ ঢুকতে পারে না। এখন কিন্তু জলের প্রবাহ বেশ স্বাস্থ্যবান।
সারগেই জিগ্যেস করল, আপনি জলের দিকে তাকিয়ে কী দেখছেন?
আমি বললুম, কিছুই না। এমনিই, জল দেখতে আমার ভালো লাগে।
সারগেই বললেন, নদীর স্রোতের সঙ্গে মানুষের জীবনের একটা মিল আছে, না? দুটোই বয়ে চলেছে, আমরা শুধু ওপরের দিকটা দেখতে পাই, গভীরতা চোখে পড়ে না—
আমি হাসলুম। আমার অবশ্য এরকম কোনও কথা মনে পড়ে না। সারগেই এখনও ছেলেমানুষ, ও বোধহয় সবকিছুই উপমা দিয়ে দেখতে ভালোবাসে।
ব্রিজ পার হওয়ার পর বড় একটা স্কোয়ার। রাস্তা চলে গেছে নানা দিকে। সারগেই নিজের রাস্তা চেনে না। পুলিশদের জিগ্যেস করে করে এগুতে লাগলুম। ক্রমেই দেখা গেল, রাস্তার দু-পাশে বহু গাড়ি থেমে আছে, কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝখানে বড় বড় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ট্রাফিক চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দলে দলে মিলিশিয়া পাহারা দিচ্ছে সেখানে। আমরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে এক একটা বাধা পার হতে লাগলুম।
মস্কোয় যেমন ক্রেমলিন, লেনিনগ্রাডে প্রায় সেই রকমই হচ্ছে উইন্টার প্যালেস। এক সময় আমরা সেখানে পৌঁছে গেলুম। একটি বিশাল চত্বরের চার পাশ ঘিরেই সুরম্য সব প্রাসাদ। এইখান থেকেই মে দিবসের শোভাযাত্রা শুরু হবে। একদিকে কাঠের গ্যালারি করা আছে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। ঠিক দশটার সময় উৎসব শুরু হবে, গ্যালারির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বহু মানুষ। দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে অনেক ছোট ছোট দোকান। কফি, চা, ঠান্ডা পানীয়, স্যান্ডউইচ, সসেজ, আলুর চপ, ডোনাট ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। এইসব টুকিটাকি খাবার খেয়ে আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিলুম। হঠাৎ টিপি টিপি বৃষ্টি হতেই শীত বেড়ে গেল। শীত তাড়াবার জন্য কফি খেতে লাগলুম ঘন-ঘন।
একটা জিনিস লক্ষ করলুম, সমবেত দর্শকদের মধ্যে প্রায় সবাই বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা, সঙ্গে বাচ্চা বা কিশোর-কিশোরীরাও আছে, কিন্তু যুবক-যুবতী একজনও নেই। একটু পরেই এর কারণ বুঝেছিলুম।
গ্যালারিতে ভিড় হয়ে যাচ্ছে দেখে আমরা আমাদের আমন্ত্রণপত্র দেখিয়ে নির্দিষ্ট গেট দিয়ে ঢুকে এলুম ভেতরে। যে অংশটায় আমাদের আসন, সেখানে সবাই মনে হল বিদেশি। অনেকেরই হাতে টিভি ক্যামেরা, মুভি ক্যামেরা। পৃথিবীর বহুদেশের মানুষ রয়েছে, কিন্তু ভারতীয় আর একজনও চোখে পড়ল না।
মাঝে এক পশলা বেশ জোর বৃষ্টি হয়ে গেল। আমি ওভারকোট এনেছি বটে, কিন্তু মাথার টুপি কিংবা দস্তানা আনিনি। এত ঠান্ডা লাগছে যে কোটের পকেট থেকে হাত বার করতে পারছি না। অন্য সকলেরই গলায় টাই বা স্কার্ফ জড়ানো। ১৯৬৩ সালে মার্কিন দেশের একটি ছোট শহরে আমি গলা থেকে টাই খুলে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, জীবনে আর কখনও টাই পরব না। এখন মনে হল, একটা অন্তত মাফলার আনলে মন্দ হত না!
ঠিক দশটার সময় দেখা গেল ময়দানের এক প্রান্ত দিয়ে একটি শোভাযাত্রা ঢুকছে। তাদের হাতে নানারকম পতাকা ও ছবি। কয়েক মিনিটের মধ্যে চত্বরটি পূর্ণ হয়ে গেল। শোনা গেল অনেক ধরনের যন্ত্র-সঙ্গীত। চতুর্দিক থেকে মাইক্রোফোনে ধ্বনি উঠল, রুশ ভাষায়, শ্রমিক ও কৃষক ঐক্য, হু-র-রা! অমনি সমবেত কণ্ঠ বলে উঠল, হু-র-রা!
তারপর শোভাযাত্রার স্রোত বইতেই লাগল। অতি সুন্দর বর্ণময় দৃশ্য! প্রথম দিকে এল সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান-বাহিনীর প্রতিনিধিরা, তারপর নানারকম কল-কারখানার কর্মী, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক, বুদ্ধিজীবী। এরা প্রায় সবাই তরুণ-তরুণী। প্রান্তর পূর্ণ হয়ে গেলে একদল গান গাইতে-গাইতে বেরিয়ে যাচ্ছে, বিপরীত দিক থেকে ঢেউ-এর পর ঢেউ আসছে। মাইক্রোফোনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করে বলা হচ্ছে হু-র-রা!
মে-দিবসের মিছিল সম্পর্কে আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। আমি ভেবেছিলুম এখানে কামান-বন্দুক-মিসাইলেরও প্রদর্শনী হয়। সেসব কিছু না! সকলে একরকম পোশাক পরেও আসেনি, সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা ছাড়া। এখানে এসেছে সবাই ছুটির উৎসবের মেজাজে, পোশাকেও নানারকম বৈচিত্র্য। অনেকেই বেশ সাজগোজ করে এসেছে।
যৌবনের এই আনন্দময় দৃশ্যের তুলনা হয় না। এই মিছিলে কোনও ধরাবাঁধা নিয়মের কড়াকড়ি নেই। হাস্যময় তরুণ-তরুণীরা গান গাইতে-গাইতে আসছে, জয়ধ্বনি দিচ্ছে, আবার চলে যাচ্ছে। এই যৌবন জলতরঙ্গের যেন শেষ নেই।
শীতের মধ্যে টানা দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম। আরও কতক্ষণ চলবে কে জানে!
সারগেই একসময় জিগ্যেস করল, সুনীলজি, এবারে যাবেন, না আরও দেখবেন?
শেষ হওয়ার আগেই চলে যাওয়া উচিত কি না আমি মনে-মনে ভাবছিলুম। সারগেই-র প্রশ্ন শুনে বললুম, এবারে গেলে মন্দ হয় না।
গ্যালারি থেকে নেমে আমরা চলে এলুম রাস্তায়। এখান দিয়েও মিছিল চলছে। একই মিছিল ভেদ করে অন্যদিকে যাওয়ার উপায় নেই, তা সঙ্গতও নয়। একমাত্র উপায় এই মিছিল যোগ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া। তাই করলুম।
ছাত্রজীবনে আমি কলকাতায় কয়েকবার মে-দিবসের মিছিলে যোগ দিয়েছিলুম বটে, কিন্তু কোনওদিন কি স্বপ্নেও ভেবেছি যে একদিন রাশিয়ায় মে-দিবসের মিছিলে আমি অংশগ্রহণ করব? এ এক বিচিত্র অনুভূতি! কেউ আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে না, দু-একটা বাচ্চা ছেলে ছাড়া।
সেই মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে চলে এলুম নেভা নদী পর্যন্ত। এবারে দেখলুম, এক একটা দল মিছিল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে যার যার বাড়ির দিকে। সুতরাং আমরাও যেতে পারি।
আমাদের পাশে পাশে একটা ছোট দল যেতে লাগল নানারকম গান গাইতে-গাইতে ও হাসাহাসি করতে-করতে। গানের সুর শুনে মনে হয় কোনও পল্লিগীতি। মনে হয় খুব চেনা।
দুপুরে খেয়েদেয়ে একখানা ঘুম দেওয়ার জন্য খুব মন কেমন করছিল। কিন্তু তার উপায় নেই। তিনটের সময়েই আর একটা প্রোগ্রাম আছে। এখন বাসে করে যেতে হবে মাইল তিরিশেক দূরে, পুশকিন শহরে।
৫
আমাদের হোটেলের ব্যবস্থাপনাতেই তিন-চারটি বাস ছাড়ল পুশকিন শহরের উদ্দেশ্যে। আমি আর সারগেই আমাদের জন্য নির্দিষ্ট বাসে উঠে বসলুম। একটি ফুটফুটে তরুণী মেয়ে আমাদের গাইড। সে একটি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে রাস্তার দু-ধারের বর্ণনা দিতে লাগল। আমি কিছুক্ষণ নিসর্গ দেখায় মন দিলুম। খুব একটা দেখবার কিছু নেই। মস্কোতে যেমন, লেনিনগ্রাডেও তাই, শহরের উপান্তে অসংখ্য ফ্ল্যাট বাড়ি। সোভিয়েত দেশের নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিককে বাসস্থান দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এখানে নাকি প্রতি পাঁচ মিনিটে একটা করে নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
শহর ছাড়াবার পর বৃক্ষবিরল সমতলভূমি। মাঝে-মাঝে ছোট-ছোট বসতি ও কল-কারখানা। এমন কোনও সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ল না, যার কথা বাড়িতে চিঠি লিখে জানানো যায়। বাইরের থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি বাসের যাত্রীদের লক্ষ করতে লাগলুম।
প্রায় সকলেই বিদেশি ভ্রমণকারী। বুলগেরিয়ান, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, আমেরিকান। এর মধ্যে একজন আমেরিকান ভদ্রলোক বিশেষ দ্রষ্টব্য। এই প্রৌঢ় লোকটি লম্বায় সাড়ে ছ'ফিটের বেশি তো হবেনই, বসা-অবস্থাতেই তাঁকে গাইড-মেয়েটির সমান মনে হচ্ছে। এক একজন দুর্ভাগা মানুষের ফিসফিস করে কথা বলার ক্ষমতা থাকে না, এই ব্যক্তিটি সেরকম। ইনি এঁর স্ত্রীর সঙ্গে যে নিভৃত আলাপ করছেন, তাও যেন মাইক্রোফোনে প্রচারিত হচ্ছে। এই কন্বুকণ্ঠ ব্যক্তিটির নাম, আমি মনে মনে রাখলুম, মিঃ গোলায়াথ। ওল্ড টেস্টামেন্টের ডেভিড যার সঙ্গে লড়াই করেছিল। মিঃ গোলায়াথের নাক, ঠোঁট, চোখ সবই বড়-বড়, ভুরু দুটি এত মোটা যে মুখখানাকে সবসময়েই বিস্মিত মনে হয়। এঁর স্ত্রী বেশ ছোট্টখাট্টো এবং মৃদুভাষী। আমার ঠিক সামনেই বসে আছে এক ফরাসি দম্পতি, তবে আজকালকার কেতা অনুযায়ী ওদের বোধহয় বিয়ে হয়নি, তাই প্রেম খুব গভীর, অন্য কারুর দিকে তাকাবার ফুরসত পর্যন্ত নেই। অন্যান্য যাত্রীরা সাধারণ টুরিস্টের মতন, আমি ছাড়া আর সবাই বেশ সুসজ্জিত।
মিঃ গোলায়াথ গাইড-মেয়েটিকে নানান প্রশ্ন করছেন। বাসে ওঠবার পরেই তিনি আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, আটাশ বছর আগে তিনি একবার লেনিনগ্রাডে এসেছিলেন, সেই স্মৃতি তাঁর কিছু-কিছু মনে আছে। গাইড-মেয়েটির বয়েস আটাশের অনেক কম, অত আগের কথা তার জানবার কথা নয়। তা ছাড়া উত্তর দেওয়ার সময় ঠিক ইংরিজি শব্দটা খোঁজবার জন্য সে প্রায়ই মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে ফেলছে, অন্য কোনও যাত্রী তাকে সাহায্য করছে বাক্যটি শেষ করতে। মিঃ গোলায়াথের কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গি দেখে অনেকেই মজা পাচ্ছে বেশ।
মিনিট চল্লিশেক-এর মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলুম পুশকিনে। বাস থেকে নেমেই বোঝা গেল এটি একটি প্রাসাদপুরী। এককালের রাজা-রাজড়াদের বিলাস ভবন। পিটার দা গ্রেট এবং বিখ্যাত রানি ক্যাথরিনের-স্মৃতি-বিজড়িত। আগে এই জায়গাটির অন্য নাম ছিল; পুশকিন এখানে লেখাপড়া করেছেন এবং তাঁর কৈশোর ও প্রথম যৌবন এখানে কাটিয়েছেন বলে এখন তাঁর নামেই শহরটি নামাঙ্কিত। রাশিয়ায় কবি-সাহিত্যিকদের নামে অনেক শহরেরই নাম রাখা হয়েছে।
পুশকিনের কথা ভাবলেই আমার বায়রনের কথা মনে পড়ে। রোমান্টিকতায় ও জীবনযাপনে দুজনের অনেকটা মিল আছে। দুজনেই লিখেছেন গাথাকাব্য। অবশ্য লেখক হিসেবে পুশকিনের প্রভাব অনেক ব্যাপক। অভিজাত ঘরের সন্তান হয়েও পুশকিন অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতার সপক্ষে কলম ধরেছেন। এজন্য তাঁকে নির্বাসনের যাতনা সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর লেখা 'ইউজেন ওনেজেন'-কে বলা হয় রুশ ভাষার প্রথম উপন্যাস। পুশকিনের 'ইস্কাবনের রানি' নামের গল্পটি অনেক বাঙালি পাঠকের কাছেই পরিচিত। পুশকিনের অপূর্ব কাব্যময় ভাষায় আমি মুগ্ধ হয়েছি এক সময়।
প্রেমের ব্যাপারেও পুশকিন বায়রনকে টেক্কা দিয়েছিলেন। বত্রিশ বছর বয়েসে পুশকিন এক অসাধারণ রূপসি মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন, যে পুশকিনের নিজের ভাষাতেই তাঁর জীবনের ১১৩ নম্বর নারী। সেই নারীও তার চরিত্র নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসত, এবং, এবং সেই কারণেই কয়েক বছরের মধ্যেই এক ডুয়েল লড়তে গিয়ে পুশকিন প্রাণ হারান।
আমরা অপেক্ষা করতে লাগলুম রাজপ্রাসাদটির সামনে। কুড়ি-পঁচিশ জনের এক একটি ব্যাচকে ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে। বাইরে থেকেই প্রাসাদটিকে বেশ জমকালো দেখায়, মিশ্রিত রাশিয়ান বারোক স্থাপত্যের একটি বৃহৎ নিদর্শন। ক্যামেরা বার করে ছবি তুলে ফেললুম কয়েকটা।
ভেতরে ঢুকে আমাদের আর এক জোড়া করে জুতো পরতে হল। প্রতিটি কক্ষের মেঝেতেই অতি মূল্যবান সব কাঠের কাজ আছে, বাইরের জুতো পরে তার ওপর দিয়ে এত লোক হাঁটলে সেসব অচিরেই নষ্ট হয়ে যাবে। আবার এদেশে খালি পায়ে হাঁটার কথা কল্পনাও করা যায় না, সেই জন্য এখানে আলাদা কাপড়ের জুতো রাখা আছে অনেক। সেইগুলো পায়ে গলিয়ে নিতে হবে। আমার কৌতূহল হল, আমাদের মিঃ গোলায়াথের পায়ের মাপের জুতো পাওয়া যাবে কি? তাও পাওয়া গেল এক জোড়া।
প্রাসাদটির প্রতিটি কক্ষের বর্ণনা আমি দেব না। সম্রাট-বাদশাদের বিলাস ভবন যে-রকম হয় এটিও প্রায় সেইরকমই। এই প্রাসাদের মধ্যেই রয়েছে দুটি গির্জা, অসংখ্য ঘরের মধ্যে কোনওটি রাজা-রানির শয়নঘর, কোনওটি বিকেলে বসবার ঘর, কোনওটি সকালের, কোনওটি বিদেশি অতিথিদের জন্য, কোনওটি একলা একলা খাওয়ার জন্য, কোনওটি বেশি লোকের সঙ্গে ভোজসভার জন্য, কোনওটি আকাশ দেখবার জন্য, কোনওটি বই পড়বার জন্য ইত্যাদি। এ ছাড়া চোখ ধাঁধানো নাচঘর।
এখানকার দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমি বলব। প্রজাদের শোষণ করা টাকায় এক সময় রাজা-বাদশাদের হুকুমে অনেক প্রাসাদ এবং শিল্পকীর্তি রচিত হয়েছে। কিন্তু সেজন্য রাজা-বাদশাদের আলাদা কোনও কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব হচ্ছে সেইসব স্থপতি ও শিল্পীদের, যাঁরা ওইসবের পরিকল্পনা ও নির্মাণ করেছেন। তাজমহলের জন্য শাজাহান শুধু হুকম দিয়েছেন আর রাজকোষ খুলে দিয়েছেন। তাঁর কি স্থাপত্য সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল? সেইরকম খাজুরাহো বা কোনারক দেখতে গিয়েও আমরা শুধু শুনি সেগুলি কোন রাজার আমলে তৈরি, শিল্পীদের নাম কেউ মনেও রাখেনি। এখানে কিন্তু রুশ গবেষকরা খুঁজে-খুঁজে বার করেছেন শিল্পীদের নাম, গাইডরা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে যখন আমাদের বিভিন্ন শিল্প-সৌন্দর্য দেখাচ্ছিলেন, তখন প্রতিটি ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছিলেন আসল শিল্পীদের নাম। মূল প্রাসাদটির স্থপতি বারতোলোমিও রাস্টভেল্লি। নাম শুনে মনে হয় ইটালিয়ান।
আর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল সোভিয়েত সরকারের ঐতিহ্যপ্রীতি। এ দেশের অভিজাততন্ত্র একেবারে মুছে ফেলা হলেও আগেকার দিনের প্রাসাদ, মূর্তি, স্তম্ভ কিছুও নষ্ট করা হয়নি, সব অবিকৃত রাখা হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, এই প্রাসাদটিও অর্ধেকটা নাতসিরা ধ্বংস করে দিয়েছিল, নাতসিরা এই শহরটি অধিকার করে এখানে থেকেও গেছে অনেকদিন, তখন যা খুশি ভাঙচুর করেছে। এখানকার মানুষ আবার পরম যত্নে সেইসব ভাঙা অংশের পুনরুদ্ধার করছে। যেমন তেমন মেরামত নয়, হুবহু আগের মতন। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, আমরা দেখলুম, এখনও শিল্পীরা ছবি দেখে-দেখে এক-একটা ঘর ঠিক আগের মতন অবস্থায় ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে আটত্রিশ বছর আগে।
ঘুরতে-ঘুরতে আরও একটি ব্যাপারে চমকিত হলুম। আমাদের সহযাত্রী মিঃ গোলায়াথের কথাবার্তা শুনে বাসের মধ্যে অনেকেই মুখ টিপে হাসছিলুম, কিন্তু এখন দেখা গেল, ওই দৈত্যকারের লোকটি কিন্তু একজন শিল্প-বিশেষজ্ঞ! বিভিন্ন ঘরে যেসব ছবি আছে, অনেক শিল্পীর নামই অপরিচিত, সেসব ছবি দেখে কিন্তু ওই ভদ্রলোক শিল্পীদের নাম, রঙের ব্যবহারের বিশেষত্ব, রীতি, শিল্প-ইতিহাস বলে যাচ্ছিলেন গড়-গড় করে, গাইডরাও অতশত জানে না।
প্রাসাদ সফর শেষ হওয়ার পর অনেকেই গেল পার্শ্ববর্তী পুশকিন-সংগ্রহশালা দেখতে। আমার আর ইচ্ছে হল না। মিউজিয়ম বা এই ধরনের বড়-বড় বাড়ি হেঁটে-হেঁটে ঘুরতে বেশ ক্লান্তি লাগে। সামনের বাগানে একটা বেঞ্চে বসে পড়ে আমি সারগেইকে জিগ্যেস করলুম, আজ আর কোথাও যাওয়ার নেই তো?
সারগেই বলল, নাঃ, আজ আর কিছু নেই। ছুটির দিন বলে এখানকার এ পি এন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি, জানি না ওর কিছু ঠিক করে রেখেছিল কি না!
আমি বললুম, আর কিছু থাকলেও আজ আর আমি যেতুম না।
বলেই আমি দুবার হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে উঠলুম। সকালে বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে গেছে।
বাস ছাড়ার সময়টা আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ে সবাই সেখানে জড় হয়ে গেল। বাসটা চলতে শুরু করার খানিকক্ষণ পরে কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগতে লাগল, কীসের যেন অভাব বোধ করছি। আরও একটু পরে একজন যাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে গাইড মেয়েটিকে কী যেন বললে। মেয়েটিও খুব বিচলিতভাবে কথা বলতে লাগল ড্রাইভারের সঙ্গে। কিছু যেন একটা ঘটেছে।
আমি সারগেইকে জিগ্যেস করলুম, কী ব্যাপার?
সারগেই হাসতে-হাসতে বলল, সেই লম্বা আমেরিকান ভদ্রলোক মিসিং। তিনি আর তাঁর স্ত্রী বাসে ওঠেননি!
সেইজন্যই এতক্ষণ এত নিস্তব্ধ মনে হচ্ছিল বাসটাকে।
এখন কী করা যাবে, তাই নিয়ে একটা সংশয় দেখা দিল। বাসটা প্রায় দশ-বারো মাইল চলে এসেছে, এদিকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অনেকেই ক্লান্ত, এখন আবার বাসটা অতদূরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? একজন বলল, আরও তো কয়েকটি বাস রয়েছে, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই অন্য বাসে চলে আসবেন। গাইড মেয়েটি বলল, সবক'টি বাসই তো ভরতি, অন্য কোনও বাস ওঁদের নেবে কিনা সন্দেহ! একজন বললে, কেউ বিপদে পড়লেও নেবে না? আর একজন বলল, অন্য বাসও তো ছেড়ে দেবে, উনি যদি কোথাও ঘুমিয়ে পড়ে থাকেন? পরে আর ফেরবার উপায় নেই। আর একজন বলল, আমি ভদ্রলোককে একবার দেখেছিলুম, একটা সুভেনিরের দোকানে কেনাকাটা করতে।
শেষ পর্যন্ত গাইড-মেয়েটি বলল, আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। বাসটির মুখ ফেরানো হল।
আবার সেই প্রাসাদের কাছাকাছি এসে দেখা গেল সস্ত্রীক মিঃ গোলায়াথ রাস্তায় একটি স্টেশন ওয়াগনের ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। সম্ভবত উনি গাড়িটি ভাড়া করতে চাইছেন, কিংবা গাড়িটা একেবারে কিনে ফেলার প্রস্তাব দেওয়াও বিচিত্র নয়।
আমাদের বাসের একজন যাত্রীও ভদ্রলোককে কোনও অভিযোগ জানাল না। গাইড-মেয়েটি হাসিমুখে বলল, আমরাই ভুল করে আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম।
বাসে উঠে সেই দৈত্যাকার, বজ্রকণ্ঠ মানুষটি শিশুর মতন সরল মুখ করে অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন, আপনাদের অসুবিধে ঘটাবার জন্য আমি দুঃখিত। দোষ আমারই।
এই ছোট্ট ঘটনাটি দেখে আমার মনে হল, সোভিয়েত দেশের সাধারণ মানুষ আমেরিকার সাধারণ মানুষের প্রতি কোনও বিদ্বেষ ভাব পোষণ করে না। সব দেশের সাধারণ মানুষই তো সমান।
সন্ধেবেলা হোটেলে ফিরে আমি আরও কয়েকবার হাঁচতে লাগলুম। সারগেই বলল, দাঁড়ান, আপনার জন্য ওষুধ আনছি।
সে এনে হাজির করল এক বোতল ভদকা।
এ দেশে এসে এখনও এ দেশের জাতীয় পানীয় আস্বাদ করা হয়নি বটে। আমি গেলাস ধুয়ে নিয়ে এলুম। ভদকার জন্য খুব ছোট-ছোট গেলাস লাগে, কিন্তু তা আর পাচ্ছি কোথায়? সারগেই আমাকে বোঝাতে লাগল ভদকা জিনিসটা কী ও কতরকম হয়। আমি শুনে গেলুম বাধা না দিয়ে। রাশিয়ান ও পোলিশ ভদকা ইউরোপের সব জায়গাতেই পাওয়া যায়, আমেরিকাতেও পাওয়া যায়, এমনকী কলকাতাতেও জোগাড় করা অসম্ভব কিছু না। ও আমার অনেকবার চেখে দেখা আছে।
ভদকা এক ঢোঁকে গলায় ঢেলে দেওয়ার নিয়ম। প্রথম গেলাসটি নেওয়ার পর সারগেই আমাকে বলল, সুনীলজি, সাবধানে খাবেন, এ জিনিস খুব কড়া। আমি তো ইন্ডিয়াতে গেছি, আমি দেখেছি ইন্ডিয়ানরা বেশি ড্রিংক করতে পারে না।
আমি সুন্দরবনের হাঁড়িয়া, সাঁওতাল পরগনার মহুয়া, খালাসি-টোলার এক নম্বর, পার্বত্য চট্টগ্রামের চার চোঁয়ানি, মেক্সিকোর টাকিলা, গ্রিসের উজো খেয়ে দেখেছি, সেই সবের তুলনায় এই ভদকা আমার তেমন কড়া মনে হল না।
সারগেই অবশ্য বেশ সাবধানী সুরাপায়ী। একটা দুটো খেয়েই বলল, আমার যথেষ্ট হয়েছে। সারগেই-এর খানিকটা স্বাস্থ্যবাতিক আছে। ও আমাকে বলল, এক সময় আমি খুব সিগারেট খেতুম, খুব ড্রিংক করতুম, এখন ছেড়ে দিয়েছি। সে কথা শুনে আমি হেসে খুন। বাইশ বছরের ছেলে, কবেই বা ধরল, কবেই বা ছাড়ল?
গেলাসের পর গেলাস উড়িয়ে আমি বোতলটা শেষ করে ফেললুম এক সময়। খুব একটা বেশি কিছু নয়। এইসব ভদকার বোতলের ছিপি খুব পাতলা। একবার খুললে আর লাগাবার ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ এই বোতল খুলে একবারেই শেষ করে দেওয়া নিয়ম!
সারগেই বিদায় নেওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ বইটই পড়লুম। আজও সহজে ঘুম এল না। ঘুমের আবার এ কী ব্যাপার হল? অবশ্য রাত্তিরে ঘুম না হলে আমি ব্যতিব্যস্ত হই না, বরং নিজেকে নিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটানো যায়।
মে-দিবস উপলক্ষে এখানে পর পর দুদিন ছুটি। সারগেই এ পি এন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না, তবে আগে থেকেই আজকের অন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে আছে।
হোটেল থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে মাত্র পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গিয়ে বুঝলুম, ট্যাক্সি না নিলেও চলত। এটির নাম ফিনল্যান্ড স্টেশন, এখান থেকে সরাসরি ট্রেন ফিনল্যান্ড যায়। সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে আত্মগোপন করতে হলে লেনিন ফিনল্যান্ডে চলে যেতেন। আমরা অবশ্য ততদূর যাব না, আমাদের গন্তব্য পঁচিশ মাইল দূরে কোমারোয়া নামে একটা ছোট্ট জায়গা।
এখন বেলা এগারোটা, লোকাল ট্রেনে বেশি ভিড় নেই। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও বোধ হয় ট্রেন আজকাল জনপ্রিয় নয়। আমরা একটা ফাঁকা কামরায় উঠে বসলুম। সারগেই শোনাল তার ভারতীয় রেলযাত্রার অভিজ্ঞতার কাহিনি। একবার তাকে বোম্বে থেকে নাগপুর যেতে হয়েছিল, হঠাৎ সেই সময় তার খুব জ্বর হয়েছে। ট্রেনে রিজার্ভেশন নেই। অসহ্য ভিড়ের মধ্যে সারারাত কাটাবার সময় তার মনে হয়েছিল, সে বুঝি হঠাৎ মরেই যাবে।
অবশ্য সারগেই-এর বর্ণনার মধ্যে কোনও তিক্ততা ছিল না। সে জানে, ভারতবর্ষ অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে ভুগছে। সেই তুলনায় সোভিয়েত রাশিয়ায় জনসংখ্যা কমতির দিকে।
চলন্ত ট্রেনে হঠাৎ এক সময় মাইক্রোফোনে অনেকক্ষণ ধরে কী সব ঘোষণা হতে লাগল। আমি সারগেইকে জিগ্যেস করলুম, কী বলছে? সারগেই বলল, ও চাকরির খবর। রেলে কতগুলো চাকরি খালি আছে, কত মাইনে, কী কী সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে তাই জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যদি যাত্রীদের মধ্যে কেউ ওইসব চাকরি নিতে উৎসাহিত হয়।
আমি হতবাক! রেলে চাকরি খালি? লোক পাওয়া যাচ্ছে না, যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে? আমাদের দেশে রেলের চাকরিতে দশটা পোস্ট-এর জন্য বিজ্ঞাপন দিলে অন্তত দশ হাজার দরখাস্ত পড়ে না? আমরা সবাই একই পৃথিবীর মানুষ?
কাল রাত্তিরেই আমি একবার ১৯৮৩ সালের ইয়ার-বুকে সোভিয়েত নাগরিকদের চাকরির অবস্থার কথা পড়ছিলুম। এ দেশের প্রত্যেক মানুষের কাজ পাওয়ার অধিকার আছে। নতুন সংবিধান অনুযায়ী ইচ্ছে মতন চাকরি বেছে নেওয়ার অধিকারও হয়েছে। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর প্রত্যেকের চাকরি বাঁধা। ১৯৩০ সালের পর থেকে এদেশে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ উঠে গেছে। ইদানীং পনেরো থেকে পঁচিশ লাখ চাকরি খালি যায়, লোক পাওয়া যায় না।
এটা একটা দারুণ উন্নতির প্রমাণ। যে-সমাজে প্রতিটি মানুষই কাজের অধিকার পায়, সে সমাজে সবাই সসম্মানে বাঁচতে পারে। ইংল্যান্ড-আমেরিকাতে এখন বেকারিত্ব প্রকট। আমেরিকায় বর্তমানে বেকারের সংখ্যা শতকরা ১৬ জনের বেশি। অবশ্য, এই সঙ্গে এ কথাও বলা দরকার, ইংল্যান্ড-আমেরিকা-কানাডার মতন সোভিয়েত রাশিয়াকে বহিরাগতদের চাপ সহ্য করতে হয় না। বহিরাগতদের জন্যই ইংল্যান্ডে বর্ণ-সমস্যা এবং বেকার সমস্যা পাশাপাশি চলছে। আমেরিকা বা কানাডার যে-কোনও ছোট শহরেও কালো মানুষ, চিনে, আরব, ভারতীয় চেহারার নতুন নাগরিক দেখা যায়। রাশিয়ায় সে সমস্যা নেই।
ছোট-ছোট স্টেশন আসছে যাচ্ছে, লোকজনের ওঠা-নামা খুবই কম। খানিকবাদেই আমাদের জায়াগাটায় পৌঁছে গেলুম। বেশ একটা পরিচ্ছন্ন গ্রামের মতন। আমরা যাব এখানকার একটি রাইটার্স হোমে। স্টেশনের একজনকে জিগ্যেস করে সারগেই পথ-নির্দেশ জেনে নিল।
গাছের ছায়া-ফেলা পথ ধরে আমরা হাঁটতে লাগলুম। দুপাশে শান্ত-নির্জন বাড়ি। অধিকাংশ বাড়িই তালা দেওয়া, কোনও-কোনও বাড়িতে কুকুর রয়েছে দেখলুম, অর্থাৎ মানুষও রয়েছে। নিজস্ব ব্যবহারের জন্য এদেশে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখা নিষিদ্ধ নয়। গ্রামের দিকে অনেকেরই ডাচাউ বা কানট্রি হাউস থাকে। ছুটিছাটায় বেড়াতে আসে।
আমরা যে-লেখকের সঙ্গে দেখা করতে চলেছি, তাঁর পরিচয় বেশ অভিনব। সোভিয়েত দেশের উত্তরাঞ্চলে, আর্কটিক ওশানের কাছে, বরফের রাজ্যে, চুকচা নামে একটি উপজাতির বাস। জনসংখ্যা মাত্র পনেরো হাজার। কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই চুকচাদের কোনও লিখিত ভাষা ছিল না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন যেহেতু মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে বিশ্বাসী, তাই চুকচাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য তাদের ভাষার একটা লিখিত রূপ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এবং এক জেনারেশনেই তাদের মধ্যে একজন লেখক সারাদেশে যশস্বী হয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলনেও আমি এঁর লেখা দেখেছি।
মধ্যবয়স্ক এই লেখকটির নাম রিথিউ ইউরি সারগেইভিচ। ইনি পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন, কলকাতাতেও এসেছেন।
রাইটার্স হোম একটি বেশ বড় বাড়ি। তাতে আলাদা আলাদা অ্যাপার্টমেন্ট, সেখানে এসে লেখকরা থাকতে পারেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, টাইপ-রাইটার ও টেলিফোন আছে, খরচ নামমাত্র। রিথিউ সারগেইভিচ আমাদের নিয়ে তাঁর লেখার ঘরে বসিয়ে বললেন, হ্যাঁ, কলকাতার কথা আমার মনে আছে, কলকাতায় বেশ প্রাণ আছে!
ইনি ইংরিজি জানেন না। সারগেই আমাদের দো-ভাষী। নিজের মাতৃভাষা ছাড়াও ইনি অবশ্য রুশ ভাষা ভালোই জানেন, ইচ্ছে করলেই রুশ ভাষায় লিখতেও পারেন, কিন্তু নিজেদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য সেই ভাষাতেই লিখে যেতে চান। তাতে অবশ্য প্রচারের অসুবিধে কিছু নেই। কারণ লেখামাত্র অনুবাদ হয়ে যায়। যে-ভাষার সমগ্র জনসংখ্যাই মাত্র পনেরো হাজার, সেই ভাষার একজন লেখক হয়েও ইনি লেখাটাকেই জীবিকা করতে পেরেছেন, লেনিনগ্রাড শহরে এঁর নিজস্ব একটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে। সংসার-খরচের জন্য চিন্তা করতে হয় না। ইচ্ছেমতন ভ্রমণ করতে পারেন।
বিদেশি কোনও লেখকের সঙ্গে কথা বলতে আমার অনেক ক্ষেত্রেই বেশ অসুবিধে হয়। ওঁরা আমাদের লেখাটেখা সম্পর্কে কিছুই জানেন না, বাংলা ভাষার অস্তিত্ব সম্পর্কেই অনেকের স্পষ্ট ধারণা নেই। অথচ আমরা ওদের সম্পর্কে মোটামুটি জানি। রিথিউ সারগেইভিচেরও একটি ছোট গল্প অন্তত আমার আগেই পড়া আছে। একটি ছেলেকে নিয়ে গল্প, তারা বাবা নৌকো নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেত, ছেলেটি অপেক্ষা করত কবে বাবা আসবে, কবে বাবা আসবে। একবার বাবা ফিরে এল না। সবাই ধরে নিল সে সমুদ্রে নৌকোডুবি হয়ে মারা গেছে। কয়েক বছর পরে ছেলেটি তার বাবাকে অন্য একটি শহরে দেখতে পায়, কিন্তু সে কথা সে তার মাকে জানাল না। সেটাই তার জীবনের প্রথম গোপন কথা।
একটি গল্প পড়েই সেই লেখকের রচনাভঙ্গি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা করা যায়। কিন্তু আমার সম্পর্কে উনি কী ধারণা করবেন?
যাই হোক, খানিকক্ষণ গল্প-টল্প হল। আমি ওঁকে ওঁর লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে টুকিটাকি কয়েকটা প্রশ্ন করলুম। উনি ওঁর স্বজাতির নানান লোক-কাহিনি, গ্রাম্য জীবন বিষয়েই বেশি লিখতে চান। অবশ্য আধুনিক শহুরে জীবন নিয়েও কিছু-কিছু লিখেছেন। রুশ ক্লাসিকাল সাহিত্য ওঁর বেশ ভালোই পড়া আছে।
এক সময় উনি নিজেই চা তৈরি করে খাওয়ালেন।
আমি জিগ্যেস করলুম, এইরকম নির্জনবাসে কি আপনার লেখার বেশি সুবিধে হয়?
উনি বললেন, শহরে অনেক লোকজন, নানারকম আকর্ষণ। বাড়ির লোকজনের জন্যও সময় দিতে হয়। এরকম কোনও ফাঁকা জায়গায় বেশ কয়েকদিন থাকলে কল্পনাশক্তি বাড়ে। এই জায়গাটা বেশ সুন্দর। খুব কাছেই সমুদ্র। লেখায় মন না বসলে আমি সমুদ্রের ধারে হাঁটতে যাই।
আমি চমকে উঠে বললুম, কাছেই সমুদ্র? আমরা ঘুরে আসতে পারি?
উনি কোট ও টুপি পরে বাইরে এসে আমাদের সমুদ্রের দিকের পথটা দেখিয়ে দিলেন। দু-একটা ছবি তোলার পর আমরা উষ্ণ করমর্দন করে বিদায় নিলুম।
দুপাশে প্রায় বনের মতন। রাস্তাটা এক জায়গায় অনেকখানি ঢালু হয়ে নীচে নেমে গেছে। সারগেই জিগ্যেস করলো, সুনীলজি, আর যাবেন? ফেরার সময় কিন্তু এতখানি খাড়া উঠতে হবে!
আমি বললুম, এত কাছে সমুদ্র, তবু দেখব না? চলো, চলো!
সেই ঢালু পথ ধরে প্রায় ছুটতে-ছুটতে নেমে এসেই দেখতে পেলাম বেলাভূমি। অনেকদিন বাদে সমুদ্র দর্শন হল। আমার অভিজ্ঞতায় আর একটি নতুন সমুদ্র, এর নাম বালটিক উপসাগর।
দুপুরবেলা সমুদ্র তীর একেবারে নির্জন। আমি এগিয়ে গিয়ে জলে হাত রাখলুম। অচেনা জল সব সময়েই ছুঁতে ভালো লাগে।
৬
একে ছুটির দিন, তার ওপর বৃষ্টি পড়ছে। এখন কোথাও যাওয়ার নেই, বসে-বসে আলস্য করতেই ইচ্ছে করে। বেশ বেলা করে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে আমি আর সারগেই বসে আছি হোটেলের দোতলার লবিতে। সামনের দেওয়ালটি পুরো কাচের তৈরি। সেই জন্য এখানে বসে-বসেই নিভা নদীর ওপর বৃষ্টিপাতের দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
বৃষ্টির জন্য অনেকেই বাইরে বেরুতে পারেনি। এখানকার আবহাওয়া বেশ উপভোগ্য হলেও বৃষ্টি পড়লেই কনকনে শীত পড়ে। এখন মে মাস। কলকাতায় অসহ্য গরম, আর এখানে আমি কোট, সোয়েটার পরে বসে আছি।
সারগেই জিগ্যেস করল, সুনীলজি, বৃষ্টি থামলে বিকেলে কোথায় যাওয়া যায়?
আমি বললুম, লেনিনগ্রাডে এসে আমি আর যাই দেখি বা না দেখি, হারমিটেজ মিউজিয়াম দেখবই!
সারগেই বলল, হ্যাঁ, ওই মিউজিয়াম তো নিশ্চয়ই দেখব। কালকেও সময় আছে।
লবিতে আর যে ক'জন লোক বসে আছে, তাদের মধ্যে একজন ভারতীয়। সেই দিকে আঙুল তুলে সারগেই জিগ্যেস করল, ওই ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক কি বেঙ্গলি?
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আগে দু-একবার চোখাচোখি হয়েছে, উনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক। প্রবাসে সবসময় বিদেশি ভাষা বলতে-বলতে কখনও হঠাৎ মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ পেলে বেশ আরাম হয়। কিন্তু একজন ভারতীয়ের সঙ্গে আর একজন ভারতীয়ের দেখা হলেই সে সুখ পাওয়া যায় না। ওই ভদ্রলোকটি দক্ষিণ ভারতের কোনও রাজ্যের, আমরা পরস্পরের ভাষা একবর্ণ বুঝব না। কথা বলতে হবে কষ্টকল্পিত ইংরিজিতেই।
আমি সারগেইকে বললুম, উনি দক্ষিণ ভারতীয়, তবে কোন রাজ্যের তা জানি না।
সারগেই উঠে গিয়ে ভদ্রলোককে তামিল ভাষায় কী যেন জিগ্যেস করল। তিনি প্রায় ভূত দেখার মতন চমকে উঠলেন।
সারগেই ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে এল আমাদের টেবিলে। আনন্দের আতিশয্যে ভদ্রলোক অনেক গল্প জুড়ে দিলেন সারগেই-এর সঙ্গে। আমি বোবা হয়ে বসে রইলুম।
তারপর সারগেই আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ করিয়ে দিল। ভদ্রলোকের নাম শ্রীযুক্ত সুব্রহ্মণ্যীয়ম, তিনি অঙ্কের পণ্ডিত, ক্যানাডার কোনও শহরে অধ্যাপনা করেন। লেনিনগ্রাডের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় মাসের জন্য একটি সেমিনারে যোগ দিতে এসেছেন। তিনি নিরামিষ খান বলে খাবারদাবারে কিছু অসুবিধে হচ্ছে এবং একাতিত্ব ভোগ করছেন। সারগেইকে পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত।
সারগেই-এর মুখে আমার পরিচয় শুনে তিনি জানালেন যে তিনিও কবিতা লেখেন। তাঁর তামিল ভাষায় লেখা কবিতার ইংরেজি অনুবাদও তাঁর সঙ্গেই আছে। হাত-ব্যাগ খুলে তিনি সাইক্লোস্টাইল করা কবিতা বার করে দিলেন।
সেই কবিতা কয়েক লাইন পড়েই আমি চোখ তুলে নিলুম। ধর্মীয় বিষয়বস্তু ও উচ্চ দার্শনিকভাবের ব্যাপার, খটোমটো ইংরেজিতে লেখা। এই ধরনের রচনা সম্পর্কে আমি কোনও আগ্রহ বোধ করি না।
সারগেই ও শ্রীযুক্ত সুব্রহ্মণ্যীয়ম গল্প করতে লাগলেন। আমি চুপ করে বসে রইলুম খানিক্ষণ। তারপর ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলুম নিজের ঘরে।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়েই চলেছে। নিভা নদীটি বেশ চওড়া, বৃষ্টিতে তাকে বেশ উচ্ছল দেখাচ্ছে। সব নদীই নিশ্চয়ই বৃষ্টি পছন্দ করে। বৃষ্টি তো নদীর খাদ্য। মাঝে মাঝে লঞ্চ যাচ্ছে। এসব দেশে কাঠের নৌকো উঠে গেছে বহুদিন, তবু কল্পনায় আমি যেন একটা নিঃসঙ্গ পাল তোলা নৌকো দেখতে পাই। এই পাশ্চাত্য নগরীতে বসেও আমার মন চলে যায় পদ্মানদীর প্রান্তে।
প্রকৃতির কোনও সুন্দর দৃশ্য পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি দেখা ঠিক নয়। তাতে সমগ্রের বদলে অংশের দিকে চোখ চলে যায়। জানলার কাছ থেকে সরে এসে আমি টিভি খুললুম। মোট তিনটি চ্যানেল। একটিতে হচ্ছে একটি ছোটদের ফিলম। একটিতে হচ্ছে কনসার্ট, আর একটিতে খেলাধুলো। এরা গান-বাজনা খুব ভালোবাসে। যখনই টিভি খুলি, তখনই কোনও-কোনও চ্যানেলে উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত শুনতে পাই। রুশ ভাষায় যখন খবর হয়, তখন ভাষা বুঝতে না পারলেও মাঝে-মাঝে ইন্ডিয়া, ইন্দিরা গান্ধি, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব এইসব শব্দ কানে আছে। প্রায় প্রতিদিনই ভারতের উল্লেখ, এটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার। পশ্চিমি দেশগুলিতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ টিভি খবর শুনলে মনে হয় ভারত নামে কোনও দেশেরই অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে।
হঠাৎ মনে হল তিন-চারদিন আমি কোনও খবরের কাগজ পড়িনি। ইংরিজি কাগজ এখানে বেশ দুর্লভ, খোঁজও করিনি আমি। কিন্তু কয়েকদিন খবরের কাগজ না পড়ায় আমার শরীর বা আত্মার কোনও ক্ষতি হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
খানিকবাদে সারগেই এসে দুষ্টু হেসে বলল, ওই দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোক সন্ধেবেলা আপনার ঘরে এসে কিছু কবিতা পড়ে শোনাতে চান। আপনি কি ইন্টারেস্টেড?
আমি বললুম, সন্ধেবেলা তো আমরা হোটেলে থাকব না!
—সন্ধেবেলা কোথায় যাব?
—কোনও পার্কে বসে আকাশ দেখব!
সারগেই হো-হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, তামিল ভাষাতে এখন অনেক ভালো কবিতা লেখা হয়। কিন্তু এই ভদ্রলোক খুব প্রাচীনপন্থী।
আমি বললুম, বহুদিন দেশের বাইরে আছেন, তাই আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে যোগ নেই।
তখন সারগেই আমায় কিছু-কিছু আধুনিক তামিল কবিতা তর্জমা করে শোনাল। সেগুলো বেশ লাগল আমার।
আমি বললুম, তুমিও তো কবিতা লেখো। এবারে কিছু কবিতা শোনাও!
প্রথমে বেশ লজ্জা পেয়ে গেল সারগেই। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু আমি ছাড়ব কেন? শেষ পর্যন্ত কিছু-কিছু লাইন শোনাতে লাগল। ওর বেশ কল্পনাশক্তি আছে। ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েও কিছু কবিতা লিখেছে সারগেই। তার মধ্যে একটি কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে ঘুঁটে। ভারতের গ্রামে-গঞ্জে-শহরের দেওয়ালে-দেওয়ালে দেখতে পাওয়া যায় ঘুঁটে। সেইসব ঘুঁটের মধ্যে যে পাঁচটা আঙুলের ছাপ পড়ে, সেটাই আকৃষ্ট করেছে সারগেইকে। যেন ওপরের দিকে বাড়ানো হাজার-হাজার হাত। নীরব, অথচ কিছু বলতে চায়।
সারগেই-এর কবিতা কয়েকটি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, এখনও কোনও বই বেরোয়নি। বই বার করা সহজ নয়। আমাদের দেশে তরুণ কবিরা অনেকেই নিজের খরচে বই ছাপে। কিংবা অনেক ছোট প্রকাশক আছে, তাদের মধ্যে যদি কেউ ইচ্ছে করে তো ছাপিয়ে দিতে পারে। এ দেশে ব্যক্তিগত মালিকানায় কোনও প্রকাশনালয় নেই। কবিরা তাদের পাণ্ডুলিপি জমা দেয় সরকারি প্রকাশনালয়ে। সেখানকার বিশেষজ্ঞরা যদি মনোনীত করেন, তবে বই ছাপা হয়। সেজন্য সময় লাগে। অবশ্য পত্র-পত্রিকাতে লেখার সময়ই যদি কারুর কবিতা খুব বিখ্যাত হয়ে যায়, তবে তার বই নিশ্চয়ই ছাপা হয় তাড়াতাড়ি। ইয়েফতুশেংকোর খ্যাতি যখন আমাদের কাছে পৌঁছেছে তখন তার বয়েস কুড়ি-একুশ।
পরদিন আমরা গেলুম একটি যুব পত্রিকার দফতরে। ঠিকানা খুঁজে পেতে খানিকটা ঝামেলা হল। তার ফলে অবশ্য লেনিনগ্রাড শহরটি অনেকখানি দেখা হয়ে গেল।
গত মহাযুদ্ধে এই লেনিনগ্রাড শহরে যে সাংঘাতিক লড়াই হয়েছিল এবং এখানকার নাগরিকরা অসীম সাহস আর মনোবল দেখিয়েছিল, তা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরকাল লেখা থাকবে। নাতসি বাহিনী এই শহরটি অবরুদ্ধ করে রেখেছিল ৯০০ দিন, তবু লেনিনগ্রাডের পতন হয়নি। নিয়মিত বোমা ও কামানের গোলা বর্ষণ হয়েছে, স্থলপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ফলে খাদ্যদ্রব্য ফুরিয়ে গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত অনেকে নাকি কুকুর-বেড়াল পর্যন্ত খেয়েছে, তবু এখানকার নাগরিকরা নাতসি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। শুধু অনাহারেই সেবার ছ'লক্ষ নারী-পুরুষের মৃত্যু হয়েছিল।
সেই যুদ্ধের কোনও চিহ্নই এখন নেই। কোনও ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে না। বড়-বড় পার্ক, সুন্দর সুন্দর বাড়ি, চওড়া রাস্তা ও মাঝে-মাঝেই দৃষ্টি কেড়ে নেবার মতন ভাস্কর্য। লেনিনগ্রাডের নাগরিকরাও বেশ সুসজ্জিত, অনেক মহিলার অঙ্গে ফ্যাসনেবল পোশাক, জিনস পরিহিত যুবকদেরও দেখা যায়।
লেনিনগ্রাডে কিছু কিছু পুরোনো পাড়াও রয়েছে। এখানকার বাড়িগুলো ব্যারাকবাড়ির মতন; রাস্তা দিয়ে ট্রাম চলে, ট্রাম লাইন থাকলেই সেইসব রাস্তা কিছুটা ভাঙা ভাঙা হয়। এখানে সেখানে জল জমে থাকে। এই এলাকায় বেশ একটা কলকাতার সঙ্গে মিল খুঁজে পেলুম। নিউ ইয়র্ক শহরেও বেশ কয়েকটা রাস্তা আছে এরকম, ভাঙা-ভাঙা, পাশে জঞ্জাল জমে থাকা, ও মানুষের ভিড় দেখে কলকাতার কথা মনে পড়েছিল আমার। পৃথিবীর যেখানেই যাই, কলকাতার সঙ্গে মিল খুঁজি।
যুব পত্রিকাটির অফিস কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিক রাস্তায় এসেছি, ঠিক নম্বরের বাড়ির সামনে এসেছি, কিন্তু সেখানে কোনও পত্রিকা অফিস নেই। সারগেই একটুতেই নার্ভাস হয়ে যায়, সে ছোটাছুটি করতে লাগল। এদেশে সবাই খুব ঘড়ির কাঁটা মেনে চলে। আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। সারগেই একটা টেলিফোন বুথে ঢুকে টেলিফোন গাইড দেখে ঠিকানাটা চেক করে এল। ঠিকই আছে, তা হলে পত্রিকার অফিসটা গেল কোথায়? রাস্তায় দু-একজন পথচারীকে জিগ্যেস করা হল, তাঁরা কোনও সাহায্য করতে পারলেন না। দু-একজন মনে হল পত্রিকাটির নামই শোনেননি। রাস্তায় এ সময় অধিকাংশই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তারা যুব-পত্রিকা পড়েন না!
শেষ পর্যন্ত হদিশ পাওয়া গেল। আমাদের কাছে যে ঠিকানা লেখা আছে, ঠিক তার পাশের বাড়িতেই পত্রিকা অফিসটি কিছুদিন আগে উঠে গেছে। আমরা সে বাড়ির সামনে দিয়েই কয়েকবার ঘুরে গেছি। শীতের মধ্যেই সারগেই-এর কপালে প্রায় ঘাম জমে গিয়েছিল, এবারে সে নিশ্চিন্ত হল।
পত্রিকাটির নাম ''অরোরা''। সারা দেশের স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা এখানে লেখা পাঠাতে পারে। এইরকম পত্রিকা থেকেই নতুন-নতুন সাহিত্য-প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায়। এঁদের নিজস্ব প্রেস আছে, প্রচার সংখ্যা আড়াই লক্ষ'র বেশি।
কলেজ জীবনে আমিও কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা-পত্রিকা সম্পাদনা করেছি, প্রথম দিকে বেশ কয়েক বছর তাতে শুধু তরুণ লেখকদের রচনা ছাপা হত, এবং আমাদের মুদ্রণ সংখ্যা কোনওক্রমে টেনেটুনে এক সময় আড়াই হাজার পর্যন্ত উঠেছিল। সে পত্রিকা চালাবার জন্য আমাদের কখনও কখনও ভিক্ষে পর্যন্ত করতে হত। বন্ধু-বান্ধবরাই ঘাড়ে করে সে পত্রিকা পৌঁছে দিত স্টলে স্টলে, লেখকদের সম্মান-দক্ষিণা দেওয়ার প্রশ্নই ছিল না। শিল্পীরাও বিনা পয়সায় এঁকে দিতেন মলাট। সেই জন্যই এখানকার যুব পত্রিকার পরিচালনা ব্যবস্থা জানবার জন্য আমার আগ্রহ ছিল।
এ দেশে পত্রিকার খরচ তোলার ব্যাপারে বিজ্ঞাপনের জন্য ঘোরাঘুরি ও হ্যাংলামির প্রয়োজন হয় না, ছাপার খরচ জোগাড় করার দুশ্চিন্তা নেই। কারণ সরকারই এর পৃষ্ঠপোষক। সোভিয়েত ইউনিয়ানে যে-কোনও পত্র-পত্রিকায় কোনও লেখা ছাপা হলেই লেখককে টাকা দেওয়া হয়। পত্রিকার প্রচার সংখ্যা অনুযায়ী টাকার অঙ্ক বাড়ে কমে। এদেশের একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় একটি মাত্র ছোট গল্প লিখে সাত-আট হাজার টাকা (আমাদের হিসেবে) পাওয়া আশ্চর্য কিছু নয়। পত্র-পত্রিকার সংখ্যা অনেক, সেই জন্য যার কিছুমাত্র সাহিত্য-প্রতিভা আছে, তার পক্ষেই আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাওয়া সহজ।
অরোরা পত্রিকার সম্পাদক কিন্তু অল্পবয়েসি যুবক নয়। টাক-মাথা একজন ভদ্রলোক। তিনি ইংরিজি জানেন না, কথাবার্তা চলছিল সারগেই-এর মাধ্যমে। নানান আলাপ-আলোচনার পর আমি জিগ্যেস করলুম, আপনারা যে রচনা নির্বাচন করেন, তার কি কোনও গাইড লাইন আছে? আপনারা কি বিষয়বস্তু ঠিক করে দেন?
তিনি হেসে বললেন, না, যার যা খুশি লিখতে পারে। তবে, আমাদের তরুণ লেখকরা সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য, শ্রমিক-কৃষক ঐক্য, সম-ভ্রাতৃত্ব, বিশ্বশান্তি এসব বিষয়েই লেখে।
আমি বললুম, সে তো বটেই। সব কবিই এসব চায়। কিন্তু তরুণ বয়েসে একটা বিদ্রোহের মনোভাব থাকে, বিশেষত আগেকার লেখকরা যা লিখেছেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থাকে, কোনও-কোনও মূল্যবোধকে ভাঙতেও চায়।
তিনি বললেন, সেরকম কেউ এখানে লেখে না।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, সে কী! এখানে তরুণ লেখকদের মধ্যে অন্য কোনও বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা, কিংবা ফর্ম ভাঙার ঝোঁক নেই?
তিনি বললেন, কেউ সেরকম লিখলে আমরা তাদের চিঠি লিখে জানাই কোথায় কোথায় ভুল হচ্ছে, তাদের পরামর্শ দিই।
আমি বললুম, কাল রাত্রেই আমি বেল্লা আখমাদুলিনা-র একটি কবিতা পড়েছি, তার নাম 'সামথিং এলস', চমৎকার কবিতা! এই কবিতাটির সেরকম কোনও বিষয়বস্তুই নেই, কবিতা লিখতে না পারার দুঃখ নিয়ে লেখা। এটাই তো একটা নতুন ফর্ম, পুরোনো ফর্মের প্রতিবাদ!
সম্পাদক মশাই আবার জোর দিয়ে বললেন, আমাদের নতুন লেখকরা যাতে আদর্শবাদ, সম-ভ্রাতৃত্ব, বিশ্বশান্তি নিয়ে লেখে, সেটাই আমরা চাই...
সম্পাদক মশাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি আমার ঠিক মনঃপূত হল না। যেন তিনি একটি উঁচু আসনে বসে তরুণ লেখকদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। অবশ্য এমনও হতে পারে, ভাষার ব্যবধানের জন্য আমরা পরস্পরের বক্তব্য ঠিক বোঝাতে পারিনি।
চা খেয়ে আমরা বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালুম। আমাদের পাশেই আর একজন অত্যন্ত রূপবান যুবক আগাগোড়া চুপ করে বসেছিল। আমি ভেবেছিলুম সে ইংরেজি জানে না। তার সঙ্গে করমর্দন করতে যেতেই সে নিখুঁত ইংরেজি উচ্চারণে বলল, চলুন, আমি আপনাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছি।
এই যুবকটি এখানকার এ পি এন অফিসের একজন কর্মী। এত সুন্দর চেহারা, ওকে চলচ্চিত্রের নায়ক হলেই যেন মানাত। ওর ব্যবহারও খুবই ভদ্র। সে আমাকে জিগ্যেস করল, লেনিনগ্রাড আপনার কেমন লাগল?
আমি বললুম, খুবই তো ভালো লাগছে। মে-দিবসের প্যারেড দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু এত বড় শহর, এখানে কত কী দেখার আছে, কিন্তু অনেক কিছুই দেখা হল না। তাই একটা অতৃপ্তি থেকে যাচ্ছে।
যুবকটি বলল, নিশ্চয়ই এখানে অনেক কিছু দেখবার আছে। তবে এখন ছুটির সময় চলছে, তা ছাড়া বৃষ্টি পড়ছে।
সারগেই বলল, আজ সন্ধেবেলাতেই আমাদের চলে যেতে হবে।
আমি বললুম, হারমিটেজ মিউজিয়াম কিন্তু দেখতেই হবে।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করা সম্ভব নয়। আমরা একটা ট্যাক্সি ধরে নিলুম।
হারমিটেজ মিউজিয়ামটিকে কেউ-কেউ ফরাসি কায়দায় 'অ্যারমিতাঝ' বলে। আমি 'অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী' স্মরণ করে চট করে বিদেশি উচ্চারণের অনুকরণে সাহস পাই না, ইংরিজিতে সন্তুষ্ট থাকি।
এই হারমিটেজ মিউজিয়াম উইন্টার প্যালেসের সংলগ্ন, সেটাও এখন মিউজিয়াম। এই দুটি প্রাসাদ মিলে যে মিউজিয়াম তা বিশ্বে বৃহত্তম। এর পুরোটা সাতদিনেও দেখে শেষ করা বোধহয় সম্ভব নয়, আমাদের হাতে আছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা।
সারগেই বলল, এই মিউজিয়ামে অনেক ভারতীয় ঐতিহাসিক জিনিসপত্তর আছে শুনেছি, চলুন আগে সেগুলো দেখে নিই।
আমি বললুম, সারগেই, আমি ইন্ডোলজিস্ট নই। আমাদের দেশেই যা ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি আছে, তার অনেক কিছুই এখনও দেখা হয়নি। বিদেশে এসে ভারতীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার আগ্রহ আমার নেই। এত বড় মিউজিয়ামে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে গেলে ক্লান্ত হয়ে যাব। আমি কি দেখব তা আগেই ঠিক করে রেখেছি। আমি জানি, ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের কিছু ভালো কালেকশান আছে এখানে, আমি শুধু সেগুলিই দেখতে চাই, যা পৃথিবীর আর অন্য কোথাও দেখা যাবে না।
সারগেই একটু কৌতূহলী চোখে তাকাল আমার দিকে। তারপর জিগ্যেস করল, ফরাসি ছবি সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহ হল কী করে? আপনারা কি আপনাদের দেশে ওরিজিনাল ছবি দেখতে পান?
আমি হেসে বললুম, না, আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। আমাদের দেশে যারা ফিলমে উৎসাহী, বার্গমান, ফেলিনি, গদার, বনুয়েল, ওয়াইদা, কুরোশোওয়া-র নাম তাদের মুখে-মুখে, তাদের সব ছবির কাহিনি ও ট্রিটমেন্টের অভিনবত্ব তাদের মুখস্থ, যদিও ওঁদের ফিলম দেখার সুযোগ নেই। কালেভদ্রে যে দু-চারটি ছবি দেখানো হয় তাও দশ-পনেরো বছরের পুরোনো। যারা শিল্প ভালোবাসে, তারা মাতিস, পিকাসো, ব্রাক, রুয়ো, মার্ক শাগাল-এর নামে প্রায় উন্মাদ, যদিও ওঁদের ওরিজিনাল ছবি প্রায় কেউ-ই দেখেনি। কিন্তু সেটা কি দোষের? আমাদের গরিব দেশ বলে পৃথিবীর শিল্প-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ ফসলগুলি আমাদের কাছে পৌঁছয় না। কিন্তু শ্রেষ্ঠ জিনিস সম্পর্কে আমাদের যে আগ্রহ ও কৌতূহল আছে, সেটা কি কম কথা?
সারগেই বলল, সত্যি খুব আশ্চর্য ব্যাপার!
মিউজিয়ামে ঢুকে অন্যান্য ভালো ভালো জিনিস বাদ দিয়ে আমরা চলে এলুম ছবির ঘরের দিকে।
জারদের আমলেই মূল্যবান ছবির সংগ্রহ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাতসিরা তস্করবৃত্তি করে নানান দেশ থেকে যেসব বিখ্যাত ছবি নিজেরা কুক্ষিগত করে রেখেছিল, বার্লিন জয়ের পর রেড আর্মি তার অনেকগুলি দখল করে নেয়। সব মিলিয়ে এখানে বহু ছবির দুর্লভ সমাবেশ।
ঘুরতে-ঘুরতে আমি চমৎকৃত হয়ে গেলুম সারগেই-এর ছবি সম্পর্কে জ্ঞান দেখে। মাত্র বাইশ বছর তার বয়েস, কিন্তু সে গত শতাব্দীর ছবির জগতের নানান আন্দোলন, প্রত্যেক শিল্পীর আলাদা বৈশিষ্ট্যের কথা জানে। আমার থেকে অনেক বেশিই জানে। আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছিল, সে আমাকে ডেকে দুই দেয়াল ভরতি দেগা-র অনেকগুলি ছবি দেখাল। মোনে ও মানে-র ছবি বোঝাল আলাদা করে। আমি দেখতে চাইছিলুম ক্যান্ডিনস্কির ছবি, তার খোঁজে সে ঘুরতে লাগল এঘর ওঘর।
এইসব ছবি বিশেষ মূল্যবান এই কারণে যে এইসব ছবির প্রিন্টও খুব দুর্লভ।
সারগেই একবার আমাকে ডেকে জিগ্যেস করল, আপনার টিনটেরেট্টোর ছবি ভালো লাগে না? এই দেখুন—
আমার মজা লাগল। একটি কিশোরপাঠ্য গোয়েন্দা কাহিনি লিখে আমাদের দেশে টিনটেরোট্টোকে নতুন করে জনপ্রিয় করেছেন সত্যজিৎ রায়। এখানে টিনটেরেট্টোর একাধিক ছবি আছে। তার মধ্যে একটি আবার যিশুর!
কখন দু-ঘণ্টা পার হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। সারগেই আমাকে মাঝে মাঝে তাড়া দিচ্ছে, আমাদের সন্ধের সময় ট্রেন ধরতে হবে। আরও অনেক ছবি দেখা বাকি, সেইজন্য একটু দ্রুত পা চালাতে হল। এক সময় একটি নারীর ভাস্কর্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম। শিল্পীর নাম আমার চেনা নয়। কিন্তু মূর্তিটি অপূর্ব!
তারপর এক সময় আমি সারগেইকে হারিয়ে ফেললুম।
৭
এত বড় মিউজিয়ামের মধ্যে কাউকে হারিয়ে ফেললে খুঁজে বার করা শক্ত। সারগেইকে দেখতে না পেয়ে আমি ভাবলুম এই সুযোগে আরও বেশি করে হারিয়ে যাওয়া যাবে, তাহলে আরও বেশিক্ষণ ছবি দেখা যাবে। সন্ধেবেলা ট্রেন ধরতে হবে বলে সারগেই তাড়া দিচ্ছিল, ঠিক ক'টার সময় ট্রেন তা আমি জানি না।
আর দু-একটা ঘর ঘোরার পর আমার মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। সারগেই একটুতেই নার্ভাস হয়ে যায়। এতক্ষণ ও আমায় কোথায় খোঁজাখুঁজি করছে কে জানে! আমাদের বেরিয়ে পড়বার কথা ছিল, ও নিশ্চয়ই আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে।
মিউজিয়াম থেকে বাইরে এসে দেখি সেখানেও সারগেই নেই। ফাঁকা রাস্তা, শন-শন করে হাওয়া দিচ্ছে। ওভারকোটের কলার তুলে পকেটে দু-হাত গুঁজে আমি পায়চারি করতে লাগলুম। অচিরেই আমি অন্তর্হিত হয়ে গেলুম লেনিনগ্রাড থেকে। এখন আমি কায়রোর রাস্তায়। কেন হঠাৎ কায়রোর কথা মনে পড়ল তা কে জানে, কায়রোতে আমি গেছি অনেককাল আগে, এবং লেনিনগ্রাডের সঙ্গে কায়রোর কোনওরকম মিল নেই।
কায়রোতে একদিন আমি হোটেলের রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলুম, ঠিকানাটাও মনে ছিল না। একজন ট্রাফিক কনস্টেবলের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করেছিলুম সে আমায় কোনও সাহায্য করতে পারবে কি না! পুলিশটি কোনও উত্তর না দিয়ে আমার হাত ধরে টানতে-টানতে নিয়ে চলল। আমি তো হতভম্ব। ডিউটির সময় তার সঙ্গে কথা বলে আমি অপরাধ করে ফেলেছি? সেইজন্য সে আমায় গ্রেপ্তার করল? পুলিশটি আমায় নিয়ে এল একটি দর্জির দোকানের সামনে এবং দর্জিকে ডেকে কী সব বলল। তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হল, ওই দর্জি ইংরিজি জানে, সে আমায় সাহায্য করবে। ততক্ষণে সে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়ে গেছে।
আমি আবার লেনিনগ্রাডে ফিরে এলুম। এখানে রাস্তা হারাবার কোনও আশঙ্কা নেই। নদীর ধার দিয়ে হেঁটে গেলে আমার হোটেল খুঁজে পাবই। কিন্তু সারগেই গেল কোথায়?
মিনিট দশেক বাদে সারগেই বেরিয়ে এল। উদভ্রান্তের মতন চেহারা, রীতিমতন হাঁপাচ্ছে সে। আমার কাছে এসে ফুঃ করে মুখ দিয়ে বিরাট নিশ্বাস ছেড়ে সে বলল, সুনীলজি, কী হয়েছিল! আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
আমি মুচকি হেসে বললুম, আমি ইচ্ছে করেই তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে পড়েছিলুম। তোমার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ পর দেখা হলে আমরা ট্রেন মিস করতুম, তা হলে ভালোই হত, আরও দু-একদিন থেকে যাওয়া যেত লেনিনগ্রাডে। আমার আজই লেনিনগ্রাড ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
সারগেই বলল, আমাদের যেসব প্রোগ্রাম করা আছে। ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং, অ্যাপয়েন্টমেন্টস!
আমি বললুম, চলো।
সারগেই একবার মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে দেখতে না পেয়ে আবার ভেতরে ঢুকেছিল, তারপর প্রায় দৌড়ে গোটা মিউজিয়ামটাতেই আমাকে খুঁজে দেখে এসেছে।
হোটেলে ফিরে আমরা তৈরি হয়ে নিলুম তাড়াতাড়ি।
শীতের দেশে এলে মোটাসোটা জামাকাপড় আনতে হয়, তাই আমার সুটকেসটি বেশ ভারী। যাতে বইতে না হয় সেজন্য তলায় চাকা লাগানো। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দিয়ে আমি সুটকেসটার টিকি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছি আর ঘর্ঘর-ঘর্ঘর শব্দ হচ্ছে, লোকজনরা ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। যদি অন্যদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, তা হলে আর চাকা লাগাবার মানে কী? সুটকেসটা আমি তুলে নিলাম।
আমাদের দেশের রেল স্টেশনগুলিতে মৌমাছির ভনভনের মতন সবসময় একটানা একটা আওয়াজ শোনা যায়। শ্বেতাঙ্গ জাতিরা প্রকাশ্য স্থানে নীরবতা পছন্দ করে। এত বড় স্টেশন, এত মানুষ, অথচ প্রায় কোনও শব্দই নেই। হকারদের চ্যাঁচামেচির তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
কিছু-কিছু মানুষ স্বভাবেই ব্যস্তবাগীশ। ট্রেন বা প্লেন ধরতে হলে সারাদিন ধরে তাদের উৎকণ্ঠা থাকে। যদি ঠিক সময় পৌঁছনো না যায়, রাস্তা জ্যাম হয়, এইজন্য তারা রওনা হয় অনেক আগে। সারগেইও অনেকটা সেইরকমের। আমাদের ট্রেন ছাড়তে এখনও পুরো এক ঘণ্টা বাকি।
রাত্রির ট্রেনে সকলেরই শুয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। আমাদের কুপেতে চারটে বার্থ। অন্য দুজন এখনও এসে পৌঁছয়নি। প্রতিটি বার্থেই রয়েছে বেশ পুরু তোষকের বিছানা ও কম্বল। এই কুপের মধ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ, তার জন্য বাইরে আলাদা জায়গা আছে।
ট্রেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে অন্য দুজন যাত্রী এসে পৌঁছল। যাত্রী নয়, যাত্রিনী, দুজনেরই বয়েস তিরিশের মধ্যে, বেশ সুসজ্জিত। এরা কি দুই বোন, না দুই বান্ধবী? বোঝবার কোনও উপায় নেই। সারগেই-এর সঙ্গে তারা রুশ ভাষায় মামুলি দু-একটা কথা বলল মাত্র, গল্প করার কোনও উৎসাহ দেখাল না, দুজনে দুটি বই খুলে বসল।
চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে আমি তাকিয়ে রইলুম বাইরে। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, কিন্তু বাইরে কোনও অন্ধকার নেই। লেনিনগ্রাড শহর হোয়াইট নাইটসের জন্য বিখ্যাত, যে সময় সারা রাতে অন্ধকার নামে না। এখন অবশ্য সে সময় আসেনি।
একটু বাদে একজন যুবতী সারগেইকে কিছু বলতেই সারগেই আমাকে জানাল, চলুন সুনীলজি, আমরা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।
আমরা বাইরে যেতেই মেয়ে দুটি দরজা বন্ধ করে দিল। বুঝলুম ওরা রাত্রির জন্য পোশাক বদলে নিচ্ছে। আমাদের অবশ্য পোশাক বদলাবার প্রশ্ন নেই, যা পরে আছি, সেই সুদ্ধুই শুয়ে পড়ব। সারগেইকে প্রথম দিন যে চামড়ার কোটটা পরতে দেখেছি সেটা আর সে ছাড়েনি।
বাইরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাতেই অন্য একজন লোক এসে আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট চাইল। আগেও কয়েকবার আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এটা বেশ মজার লাগে। আমার সিগারেট ফুরিয়ে গেল আমিও নিশ্চয় যেকোনও একজনের কাছ থেকে সিগারেট চাইতে পারি বিনা দ্বিধায়।
লোকটি কিছু জিগ্যেস করল আমাকে। সারগেই অনুবাদ করে বোঝাল যে, লোকটি জানতে চাইছে, আমি কি এদেশে নতুন এসেছি, আমার এ দেশ কেমন লাগছে?
অনুবাদে আড্ডা জমে না, কুপের দরজা খুলতেই আমরা চলে এলুম ভেতরে। যুবতী দুটি পোশাক বদল করে আবার বই খুলে বসেছে। আমার হ্যান্ডব্যাগে কোনও বই নেই। এখন সুটকেস খোলা এক বিড়ম্বনা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। তারপর এক সময় একটি মেয়ে সারগেইকে কিছু বলতেই সে আমায় জানাল, সুনীলজি, এখন আলো নিবিয়ে দিলে আপনার কোনও আপত্তি আছে?
আমি বললুম, না, না, আপত্তি কেন থাকবে?
যদিও এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার কোনও বাসনা আমার ছিল না। ইচ্ছে করছিল কিছুটা গল্পগুজব করতে। মেয়ে দুটির সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই। ভাষা জানি না। সারগেই নব বিবাহিত যুবক, অন্য মেয়েদের প্রতি তার বোধহয় কোনও ঔৎসুক্য নেই এখান।
ট্রেনে আমার ভালো ঘুম আসে না। সারারাত ধরে আমি প্রায় তিনশো স্বপ্ন দেখলুম। একটি প্রকাণ্ড স্বপ্নমালা বলা যায়।
সকাল বেলা কোনও স্টেশন থেকে চা বা কফি কেনার দরকার হয় না। যে মহিলা কন্ডাকটর গার্ড কাল রাত্রে আমাদের টিকিট পরীক্ষা করতে এসেছিলেন, তিনিই সকালবেলা নিজে হাতে করে আমাদের জন্য কফি নিয়ে এলেন। এই কফির দাম বোধহয় টিকিটের মধ্যেই ধরা থাকে।
সকাবেলা যুবতী দুটি মুখ খুলল, টুকিটাকি প্রশ্ন করতে লাগল আমাদের। দেখা গেল, এদের মধ্যে একজন ইংরিজি জানে। যাঃ, তা হলে তো এর সঙ্গে অনায়াসেই ভাব জমানো যেত। কিন্তু এখন আর সময় নেই, রিগা স্টেশন প্রায় এসে গেছে।
এক একজন লোককে দেখলেই মনে হয় বেশ সুরসিক। এ পি এন-এর যে প্রতিনিধি আমাদের রিসিভ করতে এসেছেন স্টেশনে, তাঁর মুখখানাও সেরকম। ছাতা হাতে ছিপছিপে চেহারার ভদ্রলোক আমাকে বললেন, আপনি যে ক'দিন এখানে থাকবেন, আপনার খুব টাইট প্রোগ্রাম, সব জায়গাতেই যেতে হবে, বিশ্রামের সুযোগ পাবেন না। এখন হোটেলে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিন, দশটার সময় আমরা আবার আসব।
আমি কিন্তু ক্লান্ত বোধ করছি না একটুও। শরীরটা বেশ হালকা হালকা লাগছে। গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা মিহি বাতাসের স্পর্শ, তার আমেজই আলাদা।
হোটেল ল্যাটভিয়া বেশ আধুনিক কায়দার হোটেল, কিন্তু এর সামনে নদী নেই। সাততলার ওপরের ঘর থেকে দেখতে পাওয়া যায় সামনের ব্যস্ত রাস্তা ও একটি বিশাল গির্জার অঙ্গন।
ল্যাটভিয়া রাশিয়ার মধ্যে নয়, একটি স্বতন্ত্র রাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি রাষ্ট্র। অবশ্য রাশিয়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক খুবই নিবিড়, এখানকার প্রধান কবি জ্যানিস রেইনিস-এর ভাষায় ''মুক্ত রাশিয়ার মধ্যে মুক্ত ল্যাটভিয়া।''
ল্যাটভিয়ার জনসংখ্যা মাত্র পঁচিশ লক্ষ, আমাদের পশ্চিমবাংলার অনেক জেলার জনসংখ্যাই এর চেয়ে বেশি। তবু এই ছোট রাজ্যটি নিয়েই ইতিহাসে অনেক রকম রাজনৈতিক খেলা চলেছে। মধ্য শতাব্দীতে এই ল্যাটভিয়া ছিল জার্মান ফিউডালদের শাসনে। তখন দমন ও অত্যাচার ছিল চরম। ল্যাটভিয়ানরা মূলত ছিল লুথেরান, তাদের ওপর জোর করে ক্যাথলিক মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হত। দোম ক্যাথিড্রালের সামনের ময়দানে ক্যাথলিক সাধুরা শত-শত লোককে ধর্মদ্বেষের নামে পুড়িয়ে মেরেছে। সেই সময় জার্মানদের চোখে ল্যাটভিয়ানরা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাশিয়ান সম্রাট পিটার দা গ্রেট-এর বিজয়ীবাহিনী ল্যাটভিয়াকে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করে নেয়। সেই সময় রিগা হয়ে ওঠে রাশিয়ার একটি প্রধান বন্দর। জারদের আমলে ল্যাটভিয়ার ব্যবসায়ী শ্রেণির সমৃদ্ধি হয়েছিল বটে, কিন্তু শ্রমিক-কৃষকদের অবস্থা বিশেষ কিছু বদলায়নি।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জার্মান সম্রাট কাইজার ল্যাটভিয়াকে আবার দখল করে নেবার লোভ করেছিল। ব্যাবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র এবং কাঁচা মাল সরবরাহের জন্য ল্যাটভিয়ার গুরুত্ব ছিল। এখানকার বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলের টান ছিল রুশ বিপ্লবীদের দিকে। অক্টোবর রিভোলিউশানে অনেক ল্যাটভিয়ান যুবকও অংশগ্রহণ করেছিল। সামরিক জার্মান অবরোধের বিরুদ্ধে ল্যাটভিয়ান রাইফেলম্যানরা বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে ল্যাটভিয়া নিজেকে স্বাধীন সোভিয়েত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।
কিন্তু পাঁচ মাস পরেই ল্যাটভিয়াতে আবার পালা বদল শুরু হয়। জার্মানির সহযোগিতায় ল্যাটভিয়ার সোভিয়েত-বিরোধী হোয়াইট গার্ডরা আবার ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারপর সুদীর্ঘকাল ধরে ল্যাটভিয়াতে বিপর্যয় চলতে থাকে, এই রাজ্যটি আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ফিরে আসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, সে ইতিহাস অনেকেরই জানা।
একটা জিনিস এখানে এসে বারবার মনে হচ্ছে, পুরোনো ঐতিহ্য রক্ষায় সোভিয়েত নাগরিকরা খুবই তৎপর। লেনিনগ্রাডের মতন রিগা শহরেও প্রচণ্ড তাণ্ডব চলেছিল, এখন তার কোনও চিহ্নই নেই। শুধু তাই নয়, বোমার আঘাতে যেসব ঐতিহাসিক অট্টালিকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেখানে কিন্তু নতুন বাড়ি ওঠেনি, অবিকল আগের বাড়িটাই পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
রিগা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন সুদৃশ্য শহর। হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা প্রথমে শহরটা ঘুরে দেখতে বেরুলুম, শহরটা দেখতে তো সুন্দর বটেই, তা ছাড়া আমার আর একটা অনুভূতিও হল, আমি এখানে খুব সহজ ও সাবলীল বোধ করছি। কোনও নতুন জায়গায় গেলে কাঁধ দুটো একটু উঁচু হয়ে থাকে। কে কী ভাবছে, কেউ আমাকে লক্ষ করছে কি না, কোনও আদবকায়দায় ভুল করে ফেললুম কি না, এইসব ভেবে সবসময় একটা সতর্ক ভাব বজায় রাখতে হয়। এখানে সেই ব্যাপারটা নেই। যে-কোনও অচেনা লোকের সামনে দাঁড়ালেই একটা পারস্পরিক তরঙ্গ বিনিময় হয়। অর্থাৎ সে আমাকে প্রথম দর্শনেই অপছন্দ করছে কি না তা আমরা বুঝে যাই। এখানে শুধু রিগায় নয়, লেনিনগ্রাড ও মস্কোতেও সেই তরঙ্গ বিনিময় বেশ সন্তোষজনক। যে-কোনও লোকের সঙ্গেই কথা বললে বোঝা যায়, ভারতীয়দের সম্পর্কে এখানে কোনও বিরূপ মনোভাব বা অবজ্ঞার ভাব নেই।
রিগা শহরের কেন্দ্রে রয়েছে তিন ল্যাটভিয়ান রাইফেলম্যান-এর ভাস্কর্য। বিপ্লবের সময়ে এরাই প্রথমে এগিয়ে যায়, সেই সম্মানে এদের মূর্তি বসানো রয়েছে। শহরের যে-কোনও জায়গা থেকে দেখা যায় প্রাচীন দোম ক্যাথিড্রালের চূড়া। এখন এই ক্যাথিড্রালটিকে অর্গান রিসাইটালের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
শহরের মাঝখানে একটি খুব পুরোনো পাড়াকে অবিকৃত রাখা হয়েছে। সরু সরু গলি, ছোট ছোট দোতলা বাড়ি, খোয়া পাথরের চত্বর। আমার সঙ্গীদের কাছে শুনলুম, পুরোনো ইউরোপের পট-ভূমিকায় যেসব সিনেমা তোলা হয় তার অনেকগুলিরই শুটিং-এর জন্য পরিচালকরা রিগা শহরে আসেন।
এই পাড়ারই একটি ছোট রেস্তোরাঁয় আমরা গেলুম কফি খেতে। এই রেস্তোরাঁর নাম 'ড্রপ', গেটের কাছে কোট জমা রাখতে হয়, ভেতরটা অন্ধকার-অন্ধকার। টেবিলে টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। এই দোকানটির কফি নাকি খুব বিখ্যাত, ছেলে-ছোকরারা খুব আসে এখানে।
কালো গাউন পরা দীর্ঘকায়া এক যুবতী এল আমাদের কাছে অর্ডার নিতে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা। আমি যদি এই শহরের নাগরিক হতুম, তা হলে ওই রেস্তোরাঁয় নিশ্চয়ই রোজ কফি খেতে আসতুম।
সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলুম নদীর ধারে। যে-কোনও শহরে এলেই আমার একবার নদী দেখে নিতে ইচ্ছে করে। এখানকার নদীর নাম ডাংগোভা। নদীটি তেমন প্রশস্ত নয়, তবু এর ওপরে একাধিক সেতু, দূরের একটি সেতু বেশ আধুনিক কায়দার।
এই নদীর ধার থেকে শহরটাকে অনেকখানি দেখা যায়। শুধু প্রাচীন বাড়ি নয়, নতুন বাড়িও উঠেছে অনেক। মস্কোতে হোটেল ইউক্রাইনের বাড়িটি যেরকম, সেরকম একটি বাড়ি এই শহরেও দূর থেকে চোখে পড়ে। স্তালিন আমলে এই ধরনের কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছিল।
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আমরা এলুম একটি হোটেলে, দুপুরের আহার সেরে নেবার জন্য। হোটেলটির নাম 'ব্লু উইন্ড'। এখানে আমরা এ পি এন-এর নিমন্ত্রিত অতিথি। এ পি এন-এর স্থানীয় শাখার কর্তা এবং আরও কয়েকজন এসেছেন।
এই হোটেলটিও পুরোনো কায়দায় সজ্জিত। চাপা আলো। বড়-বড় পিঠ-উঁচু চেয়ার। চেয়ারগুলি ঠিকমতন সাজাতে গিয়ে একাট চেয়ার উলটে পড়ে গেল সশব্দে। এই ব্যাপারটা বেশ পছন্দ হল আমার। সবকিছু ঠিকঠাক চলার মধ্যে একটা কিছু হঠাৎ গণ্ডগোল হয়ে গেলে বেশ হয়। সবাই আমরা ভদ্র-মার্জিত ব্যবহার করছিলুম, এর মধ্যে একটা চেয়ার পড়ে যাওয়ায় সবাই একসঙ্গে চুপ।
সব সাজিয়ে ঠিকঠাক করে বসা হল। তবু তক্ষুনি খাবারের অর্ডার দেওয়া যাচ্ছে না। নিমন্ত্রণ কর্তাদের একজন বললেন, আমরা আর একজনের জন্য অপেক্ষা করছি, তিনি এক্ষুনি এসে যাবেন।
তখনও আমি জানি না, একটা বেশ চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
৮
একজন শীর্ণকায় প্রৌঢ় ব্যক্তি এলেন একটু পরে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় অধ্যাপক। গাড়ি-ঘটিত কারণে দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য সকলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি আমার দিকে ফিরে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, নমস্কার, কেমন আছেন?
সুদূর রিগা শহরে বসে একজন ল্যাটভিয়ান অধ্যাপকের মুখে বাংলা ভাষা শুনলে রোমাঞ্চিত হতেই হয়।
এঁর নাম ভিকটর ইভবুলিস, ইনি ল্যাটভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কোনও সরকারি প্রয়োজনে বাংলা শেখেননি। শিখেছেন নিজের আগ্রহে, মূল বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ পড়বার জন্য।
আলেকজান্ডারের গুরু তাঁকে বলেছিলেন, তুমি যেখানেই যাও, যত কিছুই দেখো, শেষ পর্যন্ত দেখবে মানুষের চেয়ে বিস্ময়কর আর কিছুই নেই! ছোট্ট দেশ ল্যাটভিয়া, যার জনসংখ্যাই মাত্র পঁচিশ লাখ, সেখানকার একজন মানুষ প্রাচ্যের কবি রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ করবার জন্য বাংলার মতন একটি দুরূহ ভাষা শিখেছেন নিজের চেষ্টায়, এটা বিস্ময়কর নয়?
খাওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে নানারকম গল্প হতে লাগল। আজ একেবারে ফুল কোর্স লাঞ্চ। সুপ দিয়ে আরম্ভ, সুইট ডিস দিয়ে শেষ, সঙ্গে ওয়াইন। এখানকার খাবারে প্রথম দিকে থাকে দু-একটি কোল্ড ডিস, অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের চিজ, হ্যাম, স্মোকড ফিস, কয়েক রকমের স্যালাড। তারপর আসে মেইন ডিস বা হট ডিস, রোস্ট চিকেন বা বিফের নানারকম রূপান্তর, বড়-বড় মাছও পাওয়া যায়।
অধ্যাপক ইভবুলিস মাঝে-মাঝে আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলছেন, অন্যদের সঙ্গে কখনও ইংরিজিতে, কখনও রাশিয়ানে; এ ছাড়া তিনি ফরাসি ও জার্মান জানেন, তাঁর মাতৃভাষা ল্যাটভিয়ান। ইনি মাতৃভাষায় রবীন্দ্রনাথের ওপর বই লিখেছেন, পরে তা রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কিছুদিনের জন্য শান্তিনিকেতনেও থেকে গেছেন কয়েক বছর আগে, কলকাতা সম্পর্কে ওঁর অভিজ্ঞতা বেশ মজার। উনি যখন কলকাতায় আসেন, সেই বছরেই কলকাতায় বন্যা হয়েছিল, তিন-চারদিন পথ-ঘাট ও অনেক বাড়িই বেশ খানিকটা জলের তলায় ছিল।
অন্যরা আমাদের কথাবার্তা কৌতূহলের সঙ্গে শুনছিলেন, একজন জানতে চাইলেন, আচ্ছা, তোমাদের কলকাতাতেই তো মেট্রো-রেল হচ্ছে?
এই নিয়ে এই প্রশ্ন আমি তিনবার শুনলুম বিভিন্ন জায়গায়। কলকাতার উল্লেখ শুনেই কেউ কেউ এই কথাটা জিগ্যেস করেন। যেন এটাই কলকাতার একমাত্র পরিচয়। পৃথিবীর বহু শহরেই মেট্রো রেল আছে, সুতরাং কলকাতায় মেট্রো-রেল হওয়া এমনকী বিশেষ সংবাদ?
পালটা প্রশ্ন করে আমি ব্যাপারটা জেনে নিলুম। আসলে, কলকাতা সম্পর্কে বিশেষ কিছুই কেউ জানে না। তবে আমাদের মেট্রো রেলের প্রাথমিক স্তরে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা এসে নানারকম সুপরিশ করেছেন, মস্কো শহরের মাটির সঙ্গে কলকাতার মাটির খানিকটা মিল আছে বলে কোন ধরনের পাতাল রেল এখানে উপযোগী হবে, সে ব্যাপারে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা পরিকল্পনায় সাহায্যে করেছেন, সেই খবর এখানকার পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সুতরাং কলকাতা সম্পর্কে অনেকে শুধু ওই সংবাদটাই জানে।
আমি বললুম, কলকাতায় বন্যা হয়েছিল শুনে আপনারা ভাবছেন পাতাল রেল চালু হওয়ার পর আবার যদি বন্যা হয়, তখন কী হবে? তখন কী যে হবে, তা আমিও জানি না!
অধ্যাপক ইভবুলিস বললেন, কলকাতার যানবাহনে অনেক গোলমাল, আলোর ব্যবস্থা বড়ই খারাপ...।
বাংলাভাষা-প্রেমিক এই ল্যাটভিয়ান অধ্যাপক কলকাতায় এসে যে অনেক অসুবিধে ভোগ করেছেন তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে দুঃখের সুর ছিল, অভিযোগের নয়।
আমাকে আরও চমকে দিয়ে তিনি এরপরেই বললেন, আপনাদের 'দেশ' পত্রিকা আমি মাঝে মাঝে পড়ি। দেশ পত্রিকায় আমার সম্পর্কে লেখা হয়েছে, সে সংখ্যাটিও আমার কাছে আছে।
বেশ কয়েক বছর আগে অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী এসেছিলেন এই রিগা শহরে, অধ্যাপক ইভবুলিসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। রিগা-র অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন দেশ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায়, সে লেখাটি আমিও পড়েছিলাম, তবে অনেকদিন আগের কথা, ভালো মনে নেই।
অধ্যাপক ইভবুলিস তাঁর বাড়িতে সন্ধেবেলা আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন। দুপুরে হোটেলে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে এবং বিকেলবেলা শহরটায় খানিকটা ঘোরাঘুরি করে তারপর যখন নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, তখন সারগেই বলল, একটু দাঁড়ান, সুনীলজি!
দৌড়ে সে কোথায় চলে গেল, একটু বাদেই সে ফিরে এল কয়েকটি ফুল নিয়ে। তুষারশুভ্র কয়েকটি টিউলিপ ফুল, সেলোফিন কাগজে সুন্দর করে মোড়া। সারগেই বলল, অধ্যাপকের স্ত্রীর হাতে আপনি এটা দেবেন।
এর আগে রাস্তায় অনেককেই আমি এরকম ফুল হাতে নিয়ে যেতে দেখেছি। বড় বড় মোড়ে ফুলের দোকান। এদেশে কারুর বাড়িতে দেখা করতে গেলেই ফুল নিয়ে যাওয়া প্রথা। বিমান-যাত্রীদেরও আমি ফুল নিয়ে নামতে দেখেছি, প্রিয়জনের সঙ্গে প্রথম দেখা হতেই আগে তার হাতে ফুল তুলে দেয়। গাদাগুচ্ছের ফুল নয়, একটি বা দুটি বা তিনটি।
সোভিয়েত দেশে প্রত্যেক শহরেরই বাইরের দিকে প্রচুর ফ্ল্যাট বাড়ি উঠছে। প্রায় একই রকম চেহারা। সারা দেশের প্রতিটি পরিবারকে ফ্ল্যাট দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন সরকার, সে তো এক বিস্ময়কর, বিরাট কর্মযজ্ঞের ব্যাপার।
সারগেই আগে কখনও রিগা শহরে আসেনি, তার পক্ষে ঠিকানা খুঁজে বার করা কঠিন হত, তাই এ পি এন-এর একজন প্রতিনিধি নিয়ে এলেন আমাদের। তবু যাতে আমাদের চিনতে অসুবিধে না হয় সেইজন্য অধ্যাপক ইভবুলিস নিজেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তায়।
স্বাভাবিক কারণেই এইসব ফ্ল্যাটবাড়িগুলি বহুতল। ছোট-ছোট লিফট, এক সঙ্গে তিনজনের বেশি ধরে না। একজনকে অপেক্ষা করতে হবে, অধ্যাপক ইভবুলিস নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের আগে তুলে দিলেন।
আগেই জেনেছিলুম, অধ্যাপকের স্ত্রী মাদাম আর্তা দুমপেই একজন নামকরা ভাস্কর। দরজা যিনি খুললেন, তিনি একজন সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী রমণী, যৌবন এখনও উত্তীর্ণ হয়নি। আমি তাঁর হাতে ফুল তুলে দিতেই তিনি সহাস্যে আমাদের ভেতরে আহ্বান জানালেন।
প্রথমেই আমরা দেখতে গেলুম তাঁর স্টুডিও। সেখানে পা দেওয়া মাত্র ডানদিকের একটি মূর্তি দেখিয়ে অধ্যাপক ইভবুলিস জিগ্যেস করলেন, এটা কার, চিনতে পারেন?
আর একটি চমক। মূর্তিটি রবীন্দ্রনাথের।
ঘরে ছোট-বড় অনেক ভাস্কর্যের প্লাস্টার কাস্টিং রয়েছে, কিছু-কিছু মূর্তি অসমাপ্ত। বাস্তবানুগ কাজও যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক বিমূর্ত কাজ, নানান আকারের নারী মূর্তিও রয়েছে অনেক। কাজগুলির মধ্যে বলিষ্ঠতার সঙ্গে মিশে আছে কাব্য সুষমা। বেশ বড় একটা হল ভরতি মূর্তিগুলি ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগলুম আমরা।
ঘরটির ছাদ সাধারণ ঘরের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ উঁচুতে, ওপরের স্কাই লাইট দিয়ে আসছে প্রচুর আলো। একজন শিল্পীর স্টুডিও-র পক্ষে একেবারে আদর্শ। সাধারণ ফ্ল্যাট বাড়ির কোনও অ্যাপার্টমেন্ট কি এই রকম হয়!
এ বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করতেই অধ্যাপক ইভবুলিস বললেন, তাঁদের সরকার তাঁদের জন্য বিশেষ সুবিধে দিয়েছে, স্বামী ও স্ত্রীর জন্য দুটি আলাদ অ্যাপার্টমেন্ট বরাদ্দ করে তারপর দুটিকে একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এত বড় একটি অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া পঁচিশ রুবল। টাকার হিসেবে সাড়ে তিনশো টাকার কাছাকাছি। কলকাতায় এরকম একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া হবে অন্তত তিন হাজার টাকা, আমেরিকার কোনও ছোটখাটো শহরে আট-ন'শো ডলার তো হবেই। সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯২৮ সাল থেকে নাকি বাড়ি ভাড়া বাড়েনি। সরকারি ফ্ল্যাটের ভাড়া লাগে মাইনের শতকরা তিন টাকা। গ্যাসের জন্য খরচ ষোলো কোপেক। টেলিফোনের জন্য প্রতি মাসে বাঁধা দু-রুবল পঞ্চাশ কোপেক, তাতে যত ইচ্ছে লোকাল কল করা যায়। এক রুবলের ক্রয়-ক্ষমতার আন্দাজ খানিকটা এই ভাবে বোঝা যেতে পারে, এক রুবলে দশ কিলো আলু কিংবা এগারোটা ডিম কিনতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ এক কিলো আলু আর একটা ডিমের দাম প্রায় সমান। সরকার নিয়ন্ত্রিত বলে সারা বছরের জিনিসপত্রের দাম কখনও বাড়ে-কমে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে যে-কোনও ব্যক্তির নিম্নতম আয় দুশো রুবলের কিছু কম, মার্কিন দেশে সাড়ে আটশো ডলার, আর আমাদের দেশে নিম্নতম আয় বলে তো কিছুই নেই, শতকরা পঞ্চাশ জনেরই তো সারা বছরে রোজগারের কোনও ঠিক-ঠিকানাই থাকে না—তবু তারা বেঁচে থাকে।
মাদাম আর্তা দুমপেই খুবই খ্যাতনাম্নী ভাস্কর। তিনি বড় বড় মূর্তি গড়ার জন্য সরকারের কাছ থেকে ডাক পেয়েছেন অনেকবার। রিগা শহরের কোথায় কোন মূর্তি বসানো হবে, সে ব্যাপারে যে উপদেষ্টা কমিটি আছে, তিনি তার সদস্যা। এসব ছাড়াও তিনি নিজের শখেই ভাস্কর্যের কাজ করেছেন অনেক, তার নিয়মিত প্রদর্শনী হয় স্বদেশে ও বিদেশে। উনি ব্রোঞ্জ এবং পাথরের কাজ করেন। ওঁর কবজিতে নিশ্চয়ই খুব জোর আছে, কিন্তু মুখের হাসিটি বড় সরল।
ওঁদের একটি সন্তান। ষোলো-সতেরো বছরের সেই ছেলেটিকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে। মাদাম আর্তা দুমপেই নিজে ইংরেজি জানেন না। তবে ওঁদের ছেলে ইংরিজি শিখছে। তিনি ছেলেকে বললেন, খোকা, তুই এঁর সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বল-না!
কিন্তু ছেলেটি বেশ লাজুক, এই বয়েসের ছেলেরা যেমন হয়, সে দু-একটা কথা বলে ঘাড় নীচু করে রইল। এঁদের সংসারটি দেখে বেশ ভালো লাগে, স্বামী পণ্ডিত ও অধ্যাপক, সবসময় বইপত্তরের মধ্যে ডুবে আছেন, স্ত্রী কঠিন পাথর কেটে সৃষ্টি করছেন শিল্প, একটিমাত্র ছেলে এখন পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত।
ভিক্টর ইভবুলিস রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে বিশেষ খবর রাখেন না। অবশ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে চেনেন। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে ওঁর যথেষ্ট জ্ঞান আছে। এবং এ বিষয়ে ওঁর একটি থিয়োরিও আছে। ওঁর ধারণা ভারতী সাহিত্য ইওরোপীয় সাহিত্যকে নানাভাবে যথেষ্ট প্রভাবান্বিত করেছে। ইন্ডিয়ান ইনফ্লুয়েন্স অন ওয়েস্টার্ন লিটারেচার, এই শিরোনামে ওঁর বিস্তৃত প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আছে। অথচ, আমরা এর উলটোটাই ভাবি।
'দেশ' পত্রিকার সেই পুরোনো সাহিত্য সংখ্যাটি তিনি জমিয়ে রেখেছেন সযত্নে। ভূদেব চৌধুরীর প্রবন্ধটি দেখিয়ে আপশোশ করে উনি বললেন, এই দেখুন, আমার স্ত্রীর করা রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটির একটি ছবি এতে ছাপা হয়েছিল, কিন্তু পুরোটা নয়। অর্ধেক। এতে মূর্তিটি ঠিক বোঝা যায় না।
আমারও আপশোশ হল, আমি ক্যামেরাটা ভুল করে ফেলে এসেছি হোটেলে। এই মূর্তিগুলির এবং এই সুন্দর পরিবারটির অনেক ছবি তোলা যেত।
স্বামী-স্ত্রী মিলে আমাকে অনেকগুলি ছবি, বই ও নানান লেখার জেরক্স কপি উপহার দিলেন।
মাদাম আর্তা দুমপেই আমাদের খাওয়ালেনও খুব। ইনি একজন রন্ধন শিল্পীও বটে। নানান রকম খাবার করেছেন, তার মধ্যে মাংসের টুকরো, সবজি ও চিজ ফুটিয়ে একটা রান্নার স্বাদ অতি অপূর্ব।
বিদায় নেবার সময় ভিক্টর ইভবুলিস আমাকে বললেন, আমার এই ফ্ল্যাটে আপনিই দ্বিতীয় বাঙালি এলেন। এর আগে যিনি এসেছিলেন, তাঁকে আপনি নিশ্চয়ই চিনবেন না। তিনি লেখক নন, কিন্তু আমার খুব বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন।
যে-কোনও বাঙালিকে আমার পক্ষে চেনা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়, তবু আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই প্রথম বাঙালিটিকে আমি চিনতে পারলুম। এঁর নাম উদয় চট্টোপাধ্যায়, খড়গপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক, সাহিত্যপ্রেমিক, নিজেও কবিতা লেখেন। প্রবাসে এসে চেনা কারুর কথা শুনলে ভালো লাগে।
রাত্তিরে হোটেলে ফিরে সারগেই-এর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ এক সময় সে লাফিয়ে উঠল। এই যাঃ, দারুণ ভুল হয়ে গেছে তো!
আমি জিগ্যেস করলুম, কী হল?
দারুণ চিন্তিতভাবে সারগেই বলল, আমাকে এক্ষুনি একবার রেল স্টেশনে যেতে হবে। ট্রেনে কন্ডাকটর গার্ড আমাদের টিকিট পরীক্ষা করতে নিয়েছিল, সেই টিকিট তো আর ফেরত দেয়নি! আমাকে টাকা-পয়সার হিসেব রাখতে হবে, টিকিটের কাউন্টার পার্ট না দেখালে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট আমাকে ধরবে!
আমি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলুম, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ কালো। বললুম, এই রাত্তিরে তোমাকে আবার দৌড়োতে হবে স্টেশনে? সে তো বেশ দূরে!
সারগেই ক্ষুণ্ণভাবে বলল, যেতেই হবে, সুনীলজি। মহিলাটির উচিত ছিল না নিজে থেকেই আমাদের টিকিট ফেরত দেওয়া? সেটাই তো নিয়ম।
আমি জিগ্যেস করলুম, আমি যাব তোমার সঙ্গে?
সারগেই বলল, না, না, আপনি গিয়ে কী করবেন? আমার কতক্ষণ লাগবে তার ঠিক নেই। আজ রাত্তিরের ট্রেন যদি ছেড়ে চলে যায়, তাহলে হয়তো ওই মহিলাকে আর পাবই না।
সারগেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।
তারপর আমি ঘণ্টাখানেক বই পড়লুম। ভিক্টর ইভবুলিসের বাড়িতে খানিকটা ভদকা ও ব্র্যান্ডি পান করেছিলুম, তার প্রভাবেই কিনা জানি না, বেশ গরম লাগছে। উঠে খুলে দিলুম সব জানলা।
রিগা শহরে লেনিনগ্রাদের চেয়ে শীত অনেক কম। তবু বাইরে বেরুবার সময় গরম কোট সঙ্গে রাখতে হয়, এখানে যখন-তখন বৃষ্টি নামে, বৃষ্টির পর শীত-শীত লাগে বেশ। মাঝে-মাঝে বেশ অসুবিধে হয়। রাস্তায় শীত, সেজন্য ফুলহাতা জামা, সোয়েটার, কোট ইত্যাদি পরে বেরুতে হয়, তারপর কোনও হোটেল বা অফিস বা বাড়িতে ঢুকলেই গরম লাগে, কারণ সেসব জায়গাতে সেন্ট্রাল হিটিং। ওভারকোট খুলে রাখা যায়, কিন্তু সোয়েটার ইত্যাদি তো খোলা যায় না। এক এক সময় আমার কপালে ঘাম বেরিয়ে যায়। সারগেই-এর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, সেই যে চামড়ার জ্যাকেটটা তাকে প্রথম দিন পরতে দেখেছি, তারপর সেটা আর ও একদিনও খোলেনি।
সারগেই এখনও ফেরেনি? বেরিয়ে গিয়ে পাশের ঘরে টোকা মারলুম। কোনও সাড়া নেই।
আবার খানিকটা বই পড়ার চেষ্টা করলুম, কিন্তু মন বসছে না। এখনও গরম লাগছে। সেন্ট্রাল হিটিং কমানো-বাড়ানোর ব্যবস্থা এক এক জায়গায় এক এক রকম। এ ঘরে সেই ব্যবস্থাটা যে ঠিক কোথায় খুঁজে পেলুম না। জানলা দিয়ে কোনও হাওয়া আসছে না।
এক এক সময় হোটেলের বন্ধ ঘরের মধ্যে বড় অস্থির লাগে। শুধু বই পড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ঘুমও আসছে না। আমি ভাবলুম, এখন টাটকা বাতাসের মধ্যে খানিকক্ষণ ঘুরে এলে কেমন হয়?
শার্ট-প্যান্ট পরাই ছিল, ওভারকোট নিয়ে, পায়ে জুতো গলিয়ে বেরিয়ে পড়লুম হোটেল থেকে। রাস্তায় কিছু লোকজন এখনও হাঁটাহাঁটি করছে। আমি গির্জার বাগানটা কোনাকুনি পার হয়ে চলে এলুম অন্য রাস্তায়। আমার ইচ্ছে নদীর ধারে যাওয়া। হোটেলের রাস্তা হারিয়ে ফেলার কোনও সম্ভাবনা নেই। রিগা শহরে উঁচু বাড়ির সংখ্যা খুব কম, পেছন ফিরে তাকালেই আমাদের হোটেলের আলো দেখতে পাওয়া যায়।
অচেনা শহর, এখানকার ভাষাও আমার সম্পূর্ণ অজানা। এখানে ইংরিজি জানা লোকের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু আমার আড়ষ্ট বোধ হচ্ছে না, গা ছমছম করছে না। সহজাত অনুভূতি দিয়েই ভয়কে টের পাওয়া যায়। আজকাল পশ্চিমের অধিকাংশ শহরই খুব হিংস্র, রাত্তিরবেলা একা একা চলাফেরা করা রীতিমতন বিপজ্জনক। কিন্তু সকাল থেকে রিগা শহরে কয়েকবার ঘুরেই আমার মনে হয়েছে, এখানে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ চিন্তার প্রয়োজন নেই।
যে পথ দিয়ে আমি এখন হাঁটছি, সে পথটি রীতিমতন জনবিরল। মাঝে-মাঝে দু-একটি লোক আমার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। একটু বাদে আমি পরিবেশের কথা ভুলে গেলুম। ওভারকোটের পকেটে এক হাত, অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, মাথা নীচু, গুনগুন করে সুর ভাঁজছি, ''আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন, বাতাসে...''।
এখন আমি পৃথিবীর যে-কোনও শহরের, যে-কোনও রাস্তার, যে-কোনও একজন মানুষ।
WOW!!
ReplyDeleteঅসাধারণ! পুরো লেখাটা পড়লাম৷ খুব খুব মজা পেলাম৷ রসিয়ে এত সুন্দর করে তো লিখতে পারেন যিনি তিনি তো সুনীল-ই৷
ReplyDelete