এখন যেখানে ব্রিটিশ কাউন্সিল সেটা ছিল কলাগাছের বাগান। এর পাশেই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সাদা গম্বুজ দেওয়া যে অংশটি, সেখানে আমরা থাকি। কবে এ বাসায় উঠেছি তা আমার সঠিক স্মরণ নেই। তবে জ্ঞান হওয়ার পর আমি দেখছি, এই বাসায় আমরা থাকি। বাবা তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর। আমার জন্ম অবশ্য এখানে হয়নি। মায়ের কাছে শুনেছি, ব্রিটিশ কাউন্সিলের উত্তর দিকে সুউচ্চ একটি বুরুজ দেওয়া দোতলা যে বাড়িটি ছিল, সেখানে আমার জন্ম ১৯৩২ সালে। আমার জন্মের দিনক্ষণ আমার পিতা স্বহস্তে অন্য ভাইদের মতো লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছেন : হিঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৪ পৃষ্ঠার জের) ৯। সন ১৩৩৯। ১লা ভাদ্র, ইং ১৯৩২। ১৭ই আগস্ট হিঃ ১৩৫১। ১৪ রবিউস সানী বুধবার বেলা ১২। ২৫ মিনিট কৃষ্ণপক্ষ দ্বিতীয় আবু’ল খায়র্ মুর্তজা বশীরুল্লাহ্ সর্বশেষ লাইন ছিল আরবি অক্ষরের পুরো নাম।
আমার নামের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা ছিল বকুল, যা আমার ডাকনাম। এই নামটি অবশ্য আমার পিতা স্বহস্তে লেখেননি। সম্ভবত আমার কোনো ভাই কিংবা বোনের লেখা। আমি পিতামাতার নবম সন্তান এবং সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। তাই পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আমার জন্মবৃত্তান্তের শুরুতে ৯ কথাটি লিখেছিলেন। এ খাতাটি মেরুন রঙের মরক্কো চামড়ার বাঁধাই ছিল। এই খাতায় আমাদের ভাইবোনদের জন্মবৃত্তান্ত ছাড়াও আমার চাচাদের ও সন্তানদের জন্ম-মৃত্যুর উল্লেখ ছিল। যে বাড়িতে আমার জন্ম তার পরিচয় ছিল হাসান সাহেবের কুঠিবাড়ি। হাসান, অর্থাৎ ড. মাহমুদ হাসান, যিনি ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন, তিনি এই বাড়িতে বসবাস করতেন। কিন্তু তিনি বিলেতে কিছুকালের জন্য যখন যান তখন অস্থায়ী প্রভোস্ট হিসেবে এই বাড়িতে আমার পিতা ওঠেন। এ বাড়ির ডানপাশে দুটি পাশাপাশি কবর, দুই ভাইয়ের। আলু শাহ ও মালু শাহের। আমার মায়ের মুখে শুনেছি, আমার জন্মের আগের রাতে কিংবা জন্মের রাতে মাজারের ওখান থেকে প্রচুর আলো ঘরময় আলোকিত করে তোলে। তখনকার দিনে ইলেকট্রিকের বাতি রাস্তায় ছিল না, তাই এত আলো দেখে আমার ছোট চাচি মুহম্মদ খলিলউল্লাহ্র স্ত্রী কৌতূহলবশত জানালায় উঁকি দিয়ে দেখেন চার-পাঁচজন লোক পরনে আলখেল্লা, মাথায় পাগড়ি — তাঁরা মোনাজাত করছেন। আমার বড় বোন ড. সিরাজুল হকের স্ত্রী আমাকে বলতেন, এই বুজুর্গরা পৃথিবীতে একজন জালেম আসছে বলে তার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে হাত তুলেছিল। আমি শুনে বলতাম : এমনো তো হতে পারে যে, দুনিয়াতে একটা ভালো মানুষ আসছে, তার জন্য দোয়া চেয়েছিল? আমি মায়ের মুখে শুনেছি, আমার জন্মের দুদিন আগে তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। ফলে গর্ভবাস থেকে আমার একটি হাত বাইরে বেরিয়ে এসেছিল, তাই দুরাত দুদিন আমার মা না পারতেন বসতে, না পারতেন শুতে, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. বোস বলেছিলেন, প্রসূতিকে বাঁচাতে হলে সন্তানটিকে মেরে ফেলতে হবে। কিন্তু আমার মা তাতে রাজি হননি। তাই কোনোরকম দুষ্টামি করলে মা আমাকে বলতেন : তুই জন্মের আগেও আমাকে জ্বালিয়েছিস, এখনো জ্বালাচ্ছিস। শুনে মনে কষ্ট পেতাম। এর ফলে আমাকে একধরনের নিঃসঙ্গতা ছেলেবেলা থেকেই ঘিরে ফেলে, যা থেকে আমি এখনো মুক্তি পাইনি।
আমার ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলেন আমার বোন মহযুযা হক, তাঁর পরে আমার ভাই আবুল ফজল মুহম্মদ সফিয়্যূল্লাহ্। তাঁর পরের জন আমার বোন মসরূরা হক এবং পরে আমার ভাইয়েরা যথাক্রমে আবুল কালাম মোস্তফা ওলীয়্যূল্লাহ্, আবুল করম মাহমুদ যকীয়্যূল্লাহ্, আবুল জামাল মোহাম্মদ তকীয়্যূল্লাহ্, আবুল বায়ান মুজতবা নকীয়্যূল্লাহ্ ও আবুল করম মুতাওয়াক্কিল রাজীয়্যূল্লাহ্। আমার ছোট বোন তখন স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। তাকে যখন আমার জন্মের খবর স্কুলে জানানো হয় তখন তার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। তার একান্ত ইচ্ছা ছিল এতগুলো ভাইয়ের পর তাদের একটি বোন হবে। তাই আমার ডাকনাম বকুল, তিনি রেখেছিলেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে যখন আমরা ছিলাম, আমার সাত-আট বছর পর্যন্ত। সেই সময়কার কিছু কিছু কথা আমার স্মরণ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় যখন ছুটি হয়ে যেত, হলে তখন পরীক্ষার্থীরা ছাড়া আর কেউ থাকত না। সেই সময় রাতে খাবারের পর আমার মা আমাদের সঙ্গে নিয়ে হলের বারান্দায় একতলা-দোতলায় ঘুরতেন, এটা ছিল একধরনের বিনোদন। খুব ভালো লাগত। আকাশে রাতের তারা, বাগানে নানারকম ফুলগাছ ও গাছগাছালি — এগুলো তন্ময় হয়ে আমি দেখতাম। যেন একটা স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মাঝেমধ্যে আমার মা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রমনা অঞ্চলে অবস্থিত ড. সুশীল কুমার দে কিংবা ড. বোরাহসহ আরো অনেকের বাসায় যেতেন, তাঁদের নাম এখন আর মনে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছিলেন তখন একটা পরিবারের মতো, যা এখন নেই। বর্ষার সময় যখন মুষলধারায় বৃষ্টি হতো, কখনো-সখনো হলের সাদা গম্বুজের চৌকোনা পাথরগুলো খসে মাটিতে পড়ে যেত, বৃষ্টি কমলে আমি ও আমার পিঠাপিঠি ভাই যেমন করে শিল কুড়ায়, তেমনিভাবে কুড়াতাম এবং হলের প্রকৌশল বিভাগে জমা দিতাম। ঈদের সময় হলের ছাত্র-শিক্ষকরা মিছিল করে লম্বা সারিতে পল্টন ময়দানে ঈদের জামাতের জন্য যেত। সম্মুখে থাকত চাঁদতারাখচিত সবুজ পতাকা। ঈদের এই দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষা করতাম। আমি সরাসরি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হই ১৯৩৯ সালে নবকুমার হাই স্কুলে। এই দিনটির কথা আমার মনে গভীর দাগ কেটে আছে। এই দিনের ঘটনায় সমাজে যে শ্রেণিবৈষম্য, তার পাঠ দিয়েছিলেন আমার মা। তিনি আমার আঙুলের নখ কেটে দিলেন, চুল সুন্দরভাবে আঁচড়ে দিলেন, পায়ে মোজা দেওয়া কালো জুতা। তিনি বললেন, ক্লাসে যে ছেলেটির গায়ের রং ফর্সা তার পাশে বসবে। আমার মা ছিলেন গৌরবর্ণ, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, বড় বড় চোখের মণি ছিল হালকা সবুজাভ। তাঁর গলার চামড়ার ভেতর দিয়ে নীল শিরা দেখা যেত। আমাকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল আমার গৃহশিক্ষক। আমি ক্লাসরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে, ছাত্ররা আমাকে ডাকছে, আমি তখন সেইদিকে খেয়াল না করে দেখছিলাম বেঞ্চের নিচে ছেলেদের পাগুলো। তখন নব্বই ভাগ খালি পা, ছয়জনের মোজাবিহীন জুতো আর চারজনের পায়ে জুতা-মোজা। এই জুতা-মোজা পরা চারজনের মধ্যে দুজনের গায়ের রং ছিল গাঢ় কালো, তারা ছিল কবি মোহিতলাল মজুমদারের ছেলে। ফর্সা দুজনের একজনের পিতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রফেসর ড. এন এম বসুর ছেলে সুবীর এবং অন্যজন অরুণ, তবে তার পিতার নাম আমার স্মরণে নেই। আমি অরুণ ও সুরীরের পাশে বসলাম। নবকুমার স্কুলে সম্ভবত ১৯৪০ বা ’৪১ সালে লিপটন চা কোম্পানি টিফিন পিরিয়ডে বিনামূল্যে চা পরিবেশন করত ছাত্রদের মাঝে। আমরা লাইন দিয়ে দাঁড়াতাম। সোনার মতো চকচকে পিতলের বড় বড় পাত্রে চা থাকত, সেখান থেকে আমাদের চা দিত। এই বিনামূল্যে ছাত্রদের মাঝে চা খাওয়ানো কয়েক বছর ছিল। আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন আমার বাবা আমাকে বয়েজ স্কাউট হতে বলেন। আমি স্কাউটে ফার্স্টক্লাস পর্যন্ত হয়েছিলাম। স্বপ্ন ছিল, একদিন কিং-স্কাউট হওয়ার। কিং-স্কাউটের ব্যাজটা আমাকে খুব আকৃষ্ট করত। এমব্রয়ডারি করা একটি মুকুট উৎকীর্ণ করা ছিল ব্যাজটি। যখন কিং-স্কাউট হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি সে সময় দেশভাগ হয়ে গেল, কিং-স্কাউটের নাম পরিবর্তিত হয়ে হলো কায়েদে আজম স্কাউট। আমি স্কুলে নবম শ্রেণি থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন — ছাত্র ফেডারেশনের একজন কর্মী ছিলাম। তখন কমিউনিস্ট পার্টির একটি স্লোগান ছিল : ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। সাচ্চা আজাদি লেনা হায়। কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে পাকিস্তানের অস্তিত্বই তখন বিশ্বাস করি না। তাই আমার স্বপ্ন আর বাস্তবায়িত হলো না। কেননা স্কাউটদের নিয়ম ছিল, তারা দেশের পতাকা ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করত। ব্রিটিশ আমলে ইউনিয়ন জ্যাক ধরে শপথ নিতাম : এই দেশ রক্ষা এবং এর সব ভালো-মন্দ আমি পালন করব। কিন্তু পাকিস্তানের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে এই শপথ করতে পারলাম না। কেননা পাকিস্তানের অস্তিত্বই তখন আমরা স্বীকার করি না। কমিউনিস্ট পার্টির লাল পটভূমিতে হাতুড়ি-কাস্তে সুশোভিত পতাকা আমি প্রথম দেখি যখন আমার বয়স দশ কি এগারো। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছেড়ে আমরা তখন থাকি বর্তমানে শহীদ মিনার যেখানে, তার পূর্বদিকের রাস্তার কোনায়। বাড়িটিকে বলা হতো, দশ নম্বর বাংলো। আমার বড় ভাই সফিয়্যূল্লাহ্ কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা ছিলেন। সেই সময় আমাদের এই বাসায় একটি মৃতদেহ আনা হয়েছিল, যা ঢাকা ছিল হাতুড়ি-কাস্তে সুশোভিত লাল পতাকা দিয়ে। এই রক্তের মতো লাল পতাকা সোনার মতো উজ্জ্বল হাতুড়ি-কাস্তে আমার মনের গভীরে বিরাটভাবে দাগ কেটেছিল। মৃতদেহটি কার আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না, তবে শুনেছিলাম, তাকে হত্যা করা হয়েছিল। যারাই আমাদের বাসায় আসত সবাই সেখানে ফুল দিয়েছিল।
এই দশ নম্বর বাড়িতে একটা বকুলগাছ ছিল। গাছের নিচে বকুল ফুল কুড়াতে আমার ভালো লাগত, আর যখন ফলগুলো পেকে হলুদ রঙের হয়ে যেত, আমি গাছে উঠে ফল পাড়তাম। খেতে আমার খুব ভালো লাগত, আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন বিজ্ঞানী ড. সত্যেন বোস। বকুলগাছে কোকিল আসত বকুল ফল খেতে। আমিও গাছে উঠে কোকিলের মতো ডাকতাম। ড. সত্যেন বোসের মেয়েরা উচ্চৈঃস্বরে আমাকে বলত — ‘এই যে কোকিল, আমাদের কিছু বকুল ফল দিয়ে দেও।’ আমাদের এই বাড়িতে বড় একটা মাঠ ছিল। মাঠের একধারে ছিল সারিবদ্ধ কলাগাছ। তার পাশেই ছিল একটা ছোট্ট পাকা ঘর। আমি এই মাঠে ঘুরতাম। কলাগাছের ছায়া দিয়ে হাঁটতাম। আর সুযোগ পেলেই সেই ঘরটার সম্মুখে দাঁড়াতাম। সেখানে এক বৃদ্ধা থাকতেন। গৌরবর্ণ, উন্নত নাসা, চোখের নিচে সুরমা দেওয়া, কামিজ ও গারারা পরিহিতা উর্দুভাষী এই মহিলাকে আমি দেখতাম। তিনি রুপালি তার দিয়ে প্যাঁচানো লম্বা নল দিয়ে গড়গড়া টানতেন। বাতাসে ছিল মনমাতানো একটা সুবাস। শুনেছি, এই মহিলা একজন নামকরা বাইজি ছিলেন। বিগতযৌবনা এই মহিলা যখন নিরাশ্রয়, তখন আমার পিতা তাঁকে আমাদের বাসায় এনে রেখেছিলেন। তাঁকে আমরা বুড়িমা বলতাম। তিনি আমাদের এখানেই মারা যান। বাবা বলে যাঁকে আমরা জানতাম, তিনি হলেন টুপি পরিহিত ছোট্ট দাড়িওয়ালা একটি লোক, যিনি তাঁর নিজের লাইব্রেরি ঘরে বইপত্রের মধ্যে মগ্ন থাকেন। তাঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ তেমন ঘটত না। নামাজ পড়ার সময় তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তাম। এটুকুই। তবে মাসের প্রথম দিন তিনি তাঁর বেতনের টাকা টেবিলে রাখতেন এবং ছেলেদের বলতেন, যার যা ইচ্ছে নিতে। সেখানে অবশ্য আমার মা থাকতেন না। মা থাকতেন ঘরের বাইরে। দরজার আড়ালে। আমরা যখন ইচ্ছা মতন টাকা নিয়ে বেরোতাম তিনি সেই টাকাগুলো আমাদের হাত থেকে নিয়ে নিতেন। প্রত্যেকটি ছেলের নাম লেখা ছোট্ট কাঠের বাক্স ছিল, সেখানে তিনি টাকাগুলো রাখতেন। আমার আকর্ষণ ছিল রুপার টাকার দিকে। একটি কি দুটি আমি টেবিল থেকে তুলে নিতাম। মা এই সঞ্চিত অর্থ দিয়ে চব্বিশ পরগনায় আমাদের দেশের বাড়িতে বড় একটা বাগান কিনেছিলেন। সেখানে ছিল আম, জাম, খুদে জাম, নারকেল, ফলসাসহ নানারকম ফলের গাছ। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবা-মাসহ আমরা ভাইয়েরা যখন দেশের বাড়িতে যেতাম তখন ডাব খেতে চেয়েছি, কেউ পেড়ে দিচ্ছে না, কিংবা কাঁচা আম ছিঁড়েছি, তাতে কেউ বকেছে, এগুলো দেখে আমার মায়ের আভিজাত্যে লাগত। কেননা দেশের এই বাগানগুলো ছিল যৌথ পরিবারের। তাই মা আমাদের জন্য বাগান কিনেছিলেন, যাতে আমরা ছিঁড়ি, ফেলি, কারো বলার অধিকার থাকবে না।
ঘরে বাবার অনেক টেনিস র্যাকেট ছিল, আর ছিল ব্যায়াম করার জন্য মুগুর, ডাম্বল ইত্যাদি। তিনি নিয়মিত এগুলো দিয়ে ব্যায়াম করতেন এবং বিকেলে ইউনিভার্সিটির টেনিস কোর্টে টেনিস খেলতেন। তাঁর সঙ্গে আমি টেনিস খেলার মাঠে যেতাম। আমার খুব আকর্ষণ ছিল টেনিস বলের প্রতি। অনেক সময় বাতিলকৃত টেনিস বল পাওয়ার একটা বাসনা নিয়েই তাঁর সঙ্গে যেতাম। প্রতি রবিবারে দুপুরের খাবার পিতার সঙ্গে আমরা ভাইয়েরা ডাইনিং টেবিলে খেতাম। সেদিন বাড়িতে একটা আনন্দ উৎসবের মতো ছিল। আমার মা সুন্দর ফুলের কলি বা ফুটন্ত ফুলের মতো সাদা টেবিল ন্যাপকিন দিয়ে বানিয়ে গ্লাসে সাজাতেন। প্লেটের একধারে থাকত ছুরি, কাঁটাচামচ, টেবিল চামচ এবং প্লেটের মাথার দিকে থাকত সুপ খাবার গোল চামচ। সেদিন আমাদের বাড়িতে ইংলিশ ফুড হতো। খানসামা গলাবন্ধ সাদা কোট, মাথায় টারবান পরে আমাদের পরিবেশন করত। বাবা লক্ষ রাখতেন, ছুরি কিংবা কাঁটাচামচ ধরা ঠিক হয়েছে কি না। কখনো যদি প্লটে কাঁটাচামচের বা ছুরির কোনো শব্দ হয়েছে, তিনি শব্দ করতে বারণ করতেন। ঠিক এমনি করে যখন হাত দিয়ে ভাত খেতাম আমার মা দেখতেন, ভাত থালা থেকে মাটিতে পড়ছে কি না, কিংবা খাওয়ার সময় মুখ দিয়ে শব্দ বা মুখে লোকমা তোলার সময় তর্জনী সামনে উঁচিয়ে রয়েছে কি না। আমার বয়স পাঁচ, ছয়, সাত, কিংবা আট। অন্য ভাইদের সঙ্গে ভাত খেতে বসেছি। খাওয়ার মধ্যে তিনি বলতেন, ‘তোমরা খাওয়া বন্ধ করো।’ আমার মা আমাদের হাত নিরীক্ষণ করতেন। শুধু পাঁচটি আঙুলের ডগা ছাড়া হাতের তালুতে ভাত কিংবা ঝোল লেগে আছে কি না তা পরীক্ষা করতেন। যদি দৈবাৎ এই ভুলটা হয়েছে তাহলে বকাবকির শেষ থাকত না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরগ্রহণের পর আমার বাবা বগুড়ায় যান আযিযুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল হয়ে। আমার মা এবং আমার থেকে একটু বড় দুভাইসহ আমরা তখন ঢাকায় থাকি। বাবা ১৯৪৪ সালে আমাকে বগুড়ায় তাঁর কাছে নিয়ে যান। সেখানে জিলা স্কুলে আমি ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই। বাবা বগুড়া শহরের সবচেয়ে নামজাদা রেস্টুরেন্ট আমজাদিয়ায় আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেন। এবং বলেন — আমি যখন যা খাব, তা খাতায় লিখে রাখতে। মাসঅন্তে তিনি টাকা দিয়ে দেবেন। বাবা তাঁর কলেজ ও সভা-সমিতি নিয়ে থাকতেন ব্যস্ত, তাই শাসন করার কেউ নেই, আমি হয়ে উঠলাম খাঁচা থেকে মুক্ত একটা পাখির মতো। বন্ধুবান্ধব জুটে গেল। রেস্টুরেন্টে খাওয়া, সেইসঙ্গে সিনেমা হলে ম্যাটিনি শো দেখে আবার ইভনিং শো দেখা একটানা চলতে লাগল। বাবা ক্ষুব্ধ। তিনি বললেন তাঁর কাছে মাফ চাইতে। আমি মাফ চাইতে পারলাম না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার বাবা আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। মুক্ত বিহঙ্গের মতো আমি ছিলাম, ঢাকায় আবার খাঁচায় বন্দি হলাম। কয়েক বছর পর বাবা আমাদের সবাইকে বগুড়ায় নিয়ে গেলেন। বগুড়ায় তিনি বাড়ি কিনলেন সুলতানগঞ্জ পাড়ায় এবং স্থায়ীভাবে বগুড়ায় থাকার ইচ্ছা ছিল তাঁর। বগুড়া থেকেই আমি ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাশ করলাম। যদিও আমার ম্যাট্রিক দেওয়ার কথা ছিল ১৯৪৮ সালে। ক্লাস টেনে পড়ার সময় আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। স্কুলে ক্লাসরুমে টিফিন পিরিয়ডের পর যখন নাম রোল কল করা হতো সেই সময় আমার এক সহপাঠী অনুপস্থিত দেখে শিক্ষক তাকে অ্যাবসেন্ট করে দিয়েছিলেন, আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। শিক্ষকের সঙ্গে আমার কথাকাটাকাটি হয়েছিল, শিক্ষক হেডমাস্টারের কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করলে হেডমাস্টার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তাঁর কামরায় ঢুকে হেডমাস্টারের টেবিলে দুহাত ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে ডেকেছেন? হেডমাস্টার রাগান্বিত স্বরে বললেন, ঠিকভাবে কথা বলো। আমি অবাক হয়ে হেডমাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে এ কথাটির মানে খুঁজছিলাম। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমার ভুলটা কোথায়। রাগে হেডমাস্টারের চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। এক পাশে বসেছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার, অঙ্কের শিক্ষক নরেন ঢোল। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। মৃদুস্বরে বললেন, বশীর তুমি টেবিল থেকে হাত দুটো নামাও। ওভাবে টেবিলে হাত রেখে কথা বলা যে অন্যায় তা আমার মাথায় আসেনি। হেডমাস্টার বললেন, তোমার বাবার কাছে তোমার সম্পর্কে নালিশ করব। আমি তাঁকে বললাম, যা কিছু অন্যায় আমি করেছি, আমাকে বলুন, আমার বাবাকে কেন? তিনি বারবার একই কথা বলতে লাগলেন শুনে আমি ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বললাম; আমার বাবা কলেজের প্রিন্সিপাল, আপনি হলেন স্কুলের হেডমাস্টার, তাঁর সম্মুখে যাওয়ার যোগ্যতা আপনার নেই। আমি কোনো কথা আর না বলে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বারান্দায় কিছু শিক্ষক ও ছাত্ররা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল, তাদের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই আমি চলে গেলাম। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র পুত্র বলে ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে একধরনের আত্মগরিমা এবং সেইসঙ্গে কিছুটা ঔদ্ধত্য ছিল। একবার ক্লাস টেনে পড়ার সময় মুকুল ফৌজের মেয়েদের প্যারেডে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে সাইকেল চালিয়ে লাইন ভেঙে দিয়েছিলাম। স্কুলের মাঠের পাশে একজন সাব-রেজিস্ট্রার বাস করতেন। তা দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘খোকা, তুমি আজ যা করলে অন্য কেউ হলে তা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু তোমার বাবা চিরদিন বেঁচে থাকবেন না। তখন কেউ তোমাকে রেহাই দেবে না।’ সেদিন তাঁর কথায় আমি যে স্বপ্নের জগতে বিচরণ করতাম তা থেকে পতিত হলাম। দেশভাগের আগে এবং পর পর মফস্বল শহরে তিনজন ছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তি, সবার শ্রদ্ধেয়। এক. ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, দুই. সিভিল সার্জন, তিন. কলেজের অধ্যক্ষ। একে তো আমার পিতাকে এক নামে সবাই চেনে, তার ওপর তিনি কলেজের অধ্যক্ষ। ফলে আমার চলনে-বলনে একধরনের উন্নাসিকতা ফুটে বেরোত। স্কুলের গরিব শিক্ষকরা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বাজারে তখন কিছুই পাওয়া যেত না। গভর্নমেন্ট তখন সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট বলে একটি দপ্তর খুলেছিল। এই দপ্তরে মানুষ শাড়ি, লংক্লথ, কেরোসিন তেল ইত্যাদি পাওয়ার জন্য আবেদন করত। আবেদনকারীদের লাইন হতো বেশ লম্বা। তখন বগুড়ায় সিভিল সাপ্লাই দপ্তরের পরিচালক ছিলেন কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাপ্টেন আব্বাস মীর্জা। আমি শিক্ষকদের কার কী প্রয়োজন তা জেনে পিতার প্যাডে একটা দরখাস্ত করতাম। তাঁর নামের ওপরে আমার নাম এ.কে.এম. বশীরুল্লাহ্ ও পিতার নামের আগে s/o লিখতাম। অর্থাৎ Son of.
আমার নানারকম কীর্তিকলাপের কথা শুনে তিনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন : ‘শোনো, তোমার ইংরেজি গ্রামার বইতে তুমি পড়েছ না — এমিন্যান্ট ইমিন্যাট, প্রিন্সিপাল প্রিন্সিপল, নটোরিয়াস ফেমাস। তুমি আমার সন্তান আইদার নটোরিয়াস অর ফেমাস, ডোন্ট বি এ মিডিওকার।’ আমার ধারণা ছিল, হেডমাস্টার হয়তো নালিশ করেছেন, সেই আগাম ভয়ে আমি বাড়ি থেকে পালাবার মনস্থির করেছিলাম। তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। দেশ সবেমাত্র ভাগ হয়েছে। তখন ব্রিটিশ আমলের কাগজের টাকার নোটে উর্দুতে পাকিস্তান কথাটি মুদ্রিত থাকত। আমার মার কাছে বেশ কিছু টাকা ছিল, যেখানে পাকিস্তান শব্দটি মুদ্রিত ছিল না। আমি একদিন মাকে বললাম, ‘আমার এক বন্ধু কলকাতা যাবে। আপনি এই টাকাগুলো আমাকে দেন, আমি বিনিময়ে পাকিস্তান মুদ্রিত টাকা নিয়ে আসব।’ আসলে আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল মা সংসারের টাকাপয়সা কোথায় রাখেন তা দেখা। আমার মা সরল বিশ্বাসে তাঁর ড্রেসিং টেবিলের ডান ধারের ড্রয়ার চাবি দিয়ে খুললেন। কাঁটাচামচ রাখার জন্য চৌকোনা কাঠের বাক্স ছিল, সেখানে কাঁটাচামচ ছিল না। আমার মায়ের টাকাগুলো ছিল সেখানে। এই ড্রেসিং টেবিলটা ছিল সদ্য বিবাহিত আমার সেজ ভাইয়ের ঘরে। তখন গরমকাল, বাড়িতে সে সময় বিদ্যুতের আলো ও ফ্যান ছিল না, হারিকেনের আলো বা হাতপাখার চল ছিল। যেদিন আমি পালাব ঠিক করলাম, সেদিন বেছে নিয়েছিলাম শনিবারকে। কেননা আমি জানতাম রবিবার ছুটির দিন। ডাকঘর বা টেলিগ্রাম অফিস বন্ধ থাকবে। আমার বাবার টেবিলে পোস্টকার্ড, খাম, মনি-অর্ডার ও টেলিগ্রামের ফরম থাকত। আমি টেলিগ্রামের ফরম সেখান থেকে সরিয়ে ফেলেছিলাম। আমার নিরুদ্দেশের কথা সোমবারের আগে তিনি জানতে পারবেন না। কেননা রবিবার ছিল ছুটি। এক ঘরে আমি এবং আমার ঠিক ওপরের ভাই রাজীয়্যূল্লাহ, যাঁর ডাকনাম ছিল লালু, তাঁকে আমি বলেছিলাম আমার বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কথা। শুনে সে খুব দুঃখ পেয়েছিল এবং আমি আর কোনোদিন ফিরব না জেনে ব্যথা পেয়েছিল। দৈনন্দিন হাতখরচের পয়সা থেকে সে শখানেক টাকা সঞ্চিত করেছিল, সব সে আমাকে দিয়ে দিলো। আমি একটা চিঠিতে আমার চলে যাওয়ার কথা লিখেছিলাম এবং তাঁকে বলেছিলাম আমার বালিশের নিচে যাতে চিঠিটা রেখে দেয়। শনিবার সন্ধ্যার সময় আমি যখন টাকা নেওয়ার জন্য সেজ ভাইয়ের ঘরে ঢুকব, দেখি মা বারান্দায় বসে হাতপাখা নিয়ে বাতাস করছেন। আমি ঘরে ঢুকে ভাবিকে বললাম, ‘বেশ গরম, তাই না। ভাবছি গোসল করব।’ ভাবি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও ভাবছিলাম।’ শুনে বললাম, ‘আপনি আগে যান, আমি না হয় পরে যাব।’ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আমি গায়ে একটু পাউডার লাগালাম, ওগরু সেন্টের বোতল থেকে হাতে স্প্রে করলাম। ভাবি বেরিয়ে যেতেই আমি দেরাজটা খোলার চেষ্টা করলাম। যখন কিছুতেই খুলতে পারছি না তখন চাবি দিয়ে আটকানো অংশটা ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম। ড্রয়ার খুলে সব টাকা নিয়ে নিলাম। টাকাগুলো ছিল সংসারের খরচের জন্য বাবার বেতনের টাকা। ড্রয়ারটা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ভাবি ঘরে ঢুকলেন। আমি বাতিটা নিভিয়ে বললাম, ‘বাতি নিভে গেল, তেল নাই বুঝি।’ ঘর থেকে বেরোতেই মা বললেন, ‘কিরে তুই এখানে।’ আমি হেসে উর্দুতে বললাম, ‘দুনিয়া বদল যাইগি।’ আর কোনো কথা না বলে বাড়ির পেছনের খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। এক বন্ধুর কাছে ছোট একটা কাপড়ের চেন-টানা ব্যাগে আমার কিছু কাপড়চোপড় রেখেছিলাম, ব্যাগটা তার বাসা থেকে নিয়ে সোজা চলে এলাম রেলস্টেশনে। সেখান থেকে সান্তাহার জংশনে এসে দার্জিলিং মেইল ধরে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে এসে সকালে নামলাম। কলকাতা যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল আমার মেজভাই তখন কলকাতা থাকেন। তিনি খিদিরপুর ডকইয়ার্ডে কর্মরত ছিলেন। বগুড়ায় আমাদের বাসায় তিনি একবার এসেছিলেন সপরিবারে। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি পার্ক সার্কাস এলাকায় ট্রাম ডিপোর কাছেই সার্কাস মার্কেট প্লেসে থাকেন। সেখানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা বসবাস করে। শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কোনদিকে পার্ক সার্কাস। ট্রামগুলো চলাচল করছে। কোনোটার মাথায় লেখা রয়েছে পি সার্কাস হাওড়া স্টেশন, কোনোটায় লেখা হাওড়া স্টেশন পি সার্কাস। আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক ভদ্রলোক আমার আপাদমস্তক লক্ষ করে বললেন, ‘খোকা, তুমি কোথায় যাবে?’ আমি তাঁকে বললাম পার্ক সার্কাসের কথা। ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে একটা ট্রামে উঠিয়ে দিলেন। আমি মনে মনে শঙ্কিত হচ্ছিলাম এই ভেবে, তিনি আমাকে ঠিক পথে নিয়ে যাচ্ছেন কি না। আমি তাঁর সঙ্গে কোনো কথা বলছি না। কিছুক্ষণ পরে একটা ট্রাম-ডিপোর কাছে ট্রামটি থামল। আমি ভাবলাম, এটাই বোধ হয় পার্ক সার্কাস ডিপো। লোকটাকে আমি কিছু বললাম না। ট্রাম চলা শুরু করতেই আমি চলন্ত ট্রাম থেকে নেমে গেলাম। ভদ্রলোক ‘খোকা খোকা’ বলে চিৎকার করলেন। আমি সেই কথায় কান না দিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। আসলে ওটা পার্ক সার্কাস ডিপো ছিল না। ছিল লোয়ার সার্কুলার রোড। আমি লোককে জিজ্ঞাসা করে পার্ক সার্কাসের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করে পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপোর কাছে দাঁড়ালাম। আমার ভাই বলেছিলেন, ডিপোর ভেতর দিয়ে গেলে চট করে বাড়ির পথে আসা যায়।
ডিপোর সামনে একজন দারোয়ান বসা দেখতে পেয়ে কিছুতেই ভেতরে ঢোকার সাহস পেলাম না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার রাস্তাটি খুঁজে পেলাম ঠিকই, কিন্তু বাড়ি পেলাম না। আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লাম। ইচ্ছা ছিল, কয়েক দিন ভাইয়ের বাসায় থাকব। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আমি এখন কী করব? কোথায় যাব? বগুড়ায় স্কুলে আমার সহপাঠী ছিল বেশকিছু মাড়োয়ারি ছেলে। তাদের সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। সেই সুবাদে তাদের বাসায় আমার আসা-যাওয়া ছিল। তাদের বোনেরা দেওয়ালির সময় আমার হাতে রাখি বেঁধে দিত।
হঠাৎ মনে পড়ল আমার এক বন্ধুর কথা, যার বাড়ি গোরক্ষপুরের কাছে একটি গ্রামে — দেউরিয়া। সঠিকভাবে নামটি আমার মনে পড়ছে না। আমি ট্রাম ধরে হাওড়া স্টেশনে এলাম। টিকিট কাউন্টারে যখন ও গ্রামটির নাম বললাম, তারা চিনতে পারল না। প্ল্যাটফর্মে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে, আমি কাউন্টারে জিজ্ঞাস করলাম, ট্রেনটি গোরক্ষপুরের দিকে যাবে কি না? জানাল দিল্লির দিকে যাবে। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমার এক খালাত ভাই লক্ষ্ণৌতে থাকে, সেখানে সিভিল সাপ্লাই দপ্তরে চাকরিরত। ঠিক করলাম সেখানেই যাব। তাই লক্ষ্ণৌর একটা টিকিট কাটলাম। প্ল্যাটফর্মে অসংখ্য মানুষ। ভিড় ঠেলে রেলের বগিতে ওঠা খুবই অসম্ভব ব্যাপার দেখে আমি হাতের ইশারায় এক কুলিকে ডাকলাম। বললাম তাকে, একটি কম্পার্টমেন্টে আমাকে উঠিয়ে দিতে। কুলি প্রথমে অবাক হলো আমার সঙ্গে তেমন মালপত্র না দেখে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে কম্পার্টমেন্টের কাছে এসে কোলে তুলে জানালা দিয়ে বগির ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। পরপরই সে ভেতরে ঢুকেই মালপত্র রাখার জন্য যে জায়গা সেখানে শুইয়ে দিলো। আমি তাকে বললাম, আমাকে কিছু কলা কিনে দিতে পারবে কি না। তাকে পয়সা দিলাম। সে ছয়টি কলা কিনে এনে দিলো। আমি কলা তাড়াতাড়ি খেলাম না। আস্তে আস্তে চুষে চুষে খেতে থাকলাম, যাতে অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া যায়। খিদে না লাগে। তখন ট্রেনে বেজায় ভিড়। দিল্লিতে লালকেল্লায় তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের বিচার হচ্ছে। অনেকে তাই দিল্লর পথে। সকালে এক ভদ্রলোক অনেকক্ষণ ধরে আমাকে লক্ষ করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোথায় যাচ্ছি? আমি তাঁকে বললাম। তিনি আমার সঙ্গে হিন্দিতেই কথা বলছিলেন। নানারকম প্রশ্ন করছিলেন। ফলে আমি কিছুটা ভয় পাচ্ছিলাম। আমি তাঁকে বললাম, আমার মা মারা গেছে। আমার বাবা একটা বিয়ে করেছেন। সৎমার জ্বালা-যন্ত্রণায় আমি বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি লক্ষ্ণৌতে, আমার খালাত ভাইয়ের কাছে। লোকটা যখন শুনল আমি বগুড়া থেকে এসেছি, তখন তিনি পরিষ্কার বাংলায় আমাকে বললেন, ‘খোকা, তুমি কিন্তু সব মিথ্যা কথা বলছ। সত্যি করে বলো তো, তোমার বাবার নাম?’ তাঁকে আমার বাবার নাম বলতেই তিনি চিনতে পারলেন। তিনি জানালেন, সান্তাহারের কাছে নওগাঁয় তিনি থাকেন। এখন আহমেদাবাদে যাচ্ছেন। সেখানে তাঁর মিলকারখানা রয়েছে। লক্ষ্ণৌ স্টেশনে যখন ট্রেন এসে দাঁড়াল ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘খোকা, তুমি বাড়ি চলে যাও। আর যেতে যদি না চাও আমার সঙ্গে আহমেদাবাদ চলো, আমার মিলকারখানা দেখবে। তবে আমি চাই তুমি ঘরে ফিরে যাও।’ ভদ্রলোক আমাকে সঙ্গে নিয়ে প্ল্যাটফর্মের খাবারের ঘরগুলো দেখালেন। কোনোটা ইউরোপিয়ান, ইন্ডিয়ান এবং ভেজিটারিয়ান। বললেন, ‘তুমি এটার মধ্যে খেতে পার।’ আমাকে স্নান করার জায়গা দেখিয়ে দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী ঠিক করলে?’ কেন জানি আমার মন তখন বাড়ির জন্য উতলা হয়ে উঠল। মায়ের কথা বারবার মনে পড়ল। আমি তাঁকে বললাম, ‘আমি ঘরে ফিরে যাব।’ তিনি কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে কলকাতাগামী ট্রেন যাবে আমাকে তা দেখিয়ে দিলেন। তারপর আমার হাত ধরে বিদায় নিলেন। আমি চেয়ে থাকলাম তাঁর চলার পথের প্রতি। ট্রেনের যেই কামরায় ঢুকতে যাই লোকজন বলে সামনের বগিতে যাও। এভাবে একটার পর একটা বগি পেরিয়ে যখন শেষ বগির সামনে দাঁড়িয়েছি মনে মনে ঠিক করলাম ট্রেন ছাড়লেই উঠব। ট্রেন ছেড়ে দিলো, আমি তাড়াতাড়ি বগির ভেতর ঢুকলাম, কারো সঙ্গে কথা বললাম না। আমার হাতে ছিল একটা ম্যাগাজিন। তা দিয়ে সিটে বসা একজনকে মৃদু আঘাত করে ইশারায় সরে জায়গা করে দিতে বললাম। লোকটা অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল, আমার বয়স তখন চৌদ্দ। আমার এ ধরনের আচরণ দেখে কম্পার্টমেন্টের সব যাত্রীই অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল। বেশকিছু সৈনিক বন্দুক নিয়ে বসে ছিল, তারা ছিল শিখ। আমি আলাপ জুড়ে দিলাম। প্রশংসা করলাম তাদের বীরত্বের এবং কলকাতার পথে ট্যাক্সিচালকদের দক্ষতার। হাওড়া স্টেশনে নেমে বেশকিছু গরিব শিশু ও কিশোরকে দেখে প্ল্যাটফর্মে আমার পকেট থেকে টাকা-পয়সা ছড়িয়ে দিলাম। এগুলোর এখন আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু যখন বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম, তখন এই টাকা-পয়সা একজন কৃপণের মতো খরচ করেছিলাম।
টাকা-পয়সাকড়ি ছড়িয়ে দিয়ে মনে একটা তৃপ্তি পেলাম।
ভাইয়ের বাসা খুঁজে পেলাম এবার। কিন্তু ঘরে ঢুকতে কেমন লজ্জা লাগছিল। আমি জানি ইতোমধ্যে নিশ্চয় বাবার টেলিগ্রাম পেয়েছেন, আমার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার খবর জেনেছেন। সকালবেলা, রাস্তার ধারে কলপাড়ে দেখলাম, ভাইয়ের চাকর গোসল করছে। আমি তাকে না দেখার ভান করে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম। সে আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠল। আমি যেন শুনিনি, এই ভাব করে আস্তে আস্তে সামনে হাঁটছিলাম। সে পেছন থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, বাসায় চলেন। আমি বললাম না, সে তবু আমাকে হাত ধরে বাসার দিকে নিয়ে আসতে থাকল। আমি না যাওয়ার ভান করলাম। ভাব দেখালাম যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কিন্তু আমি জানি আমার ষোলআনা ইচ্ছে রয়েছে ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার।
ভাই-ভাবি আমাকে দেখে খুশি হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে পালিয়েছিস কেন?’ তাঁদের কথার কোনো জবাব দিলাম না। ইতোমধ্যে মেজ ভাইয়ের টেলিগ্রাম পেয়ে বগুড়া থেকে আমার ভাই নকীয়্যূল্লাহ্, যাঁর ডাকনাম প্যারিস, সে নিতে এলো। প্যারিস ভাইকে বললাম, দেশে অনেক দিন যাইনি। আগে দেশে যাব। আমাদের পৈতৃক নিবাস পেয়ারা গ্রাম। বাড়ির পেছনে বিরাট এক দীঘির পাড়, পাহাড়ের মতো উঁচু করা। সেখানে বৈচি ফলের বুনো ঝোপ। বৈচি ফল খেতে আমার খুব ভালো লাগত। বাবা-মার সঙ্গে যখন দেশের বাড়িতে এসেছি তখন দীঘির পাড়ে আমি ঘুরে বেড়াতাম। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে মার্টিন কোম্পানির ছোট্ট রেলগাড়িতে এলাম বেড়াচাঁপা, এখান থেকে গরুগাড়ি করে গ্রামের দিকে পথ।
বগুড়ার বাসায় যখন এলাম তখন সকাল। মা বারান্দায় বসে ছিলেন। কোনোকিছু না বলে শুধু বললেন, ঘরে যাও, তোমার বাবা সেখানে। ঘরে ঢুকতে আমার কেমন দ্বিধা লাগছিল। বাবা ইজিচেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিলেন। আমাকে দেখে রাগতভাবে উঠে দাঁড়ালেন। আমার মনে হলো, তিনি হয়তো মারবেন। আমি তাঁর পা ধরে সালাম করলাম। জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কোথায় গিয়েছিলাম। লক্ষ্ণৌ পর্যন্ত গিয়েছি শুনে তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, আর একটু সামনে আগ্রা গিয়ে তাজমহল তো দেখতে পারতে। আমার মনে হলো, যদি আগ্রায় গিয়ে তাজমহল দেখতাম তাহলে সংসারের এই অর্থের অপচয় হতো না। আমি মৃদুস্বরে বললাম, বাড়ির জন্য মন কেমন জানি করছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে মা সকালের নাশতা দিলেন মাখন দেওয়া পাউরুটি, পানিতে পোচ করা ডিম, দুধ মেশানো কোকো। আমি কোকোটা চুমুক দিয়েই চিৎকার করে উঠলাম — ঠাণ্ডা কেন? আমার ভাবটা এমন ছিল যেন বাড়ি থেকে পালিয়ে আমি ঘরে ফিরিনি।
স্কুলে নাইনে পড়ার সময় বাবার লাইব্রেরিতে রাখা বসুমতী, প্রবাসী, বিচিত্রা, ভারতবর্ষ ম্যাগাজিনগুলোর সব গল্প-উপন্যাস আমি পড়েছিলাম। এমনকি বঙ্কিম, শরৎ, রবীন্দ্রনাথ ও রমেশচন্দ্র দত্তের রচনাবলি সবই পড়েছিলাম। তাঁদের লেখা পড়ে আমার ইচ্ছে হতো তাঁদের মতো লেখক হওয়ার। বাবার রিডিং টেবিলে, দেরাজে কিংবা বাবাকে উপহার দেওয়া বইতে মোহিতলাল মজুমদার, সুকুমার সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, দীনেশ চন্দ্র সেন নাম দেখতাম। তখন মনে প্রশ্ন জাগত, আমার বাবাকে তাঁরা চেনেন? তখন মনে তীব্র আকাঙ্ক্ষা হতো আমি বাবার মতো হব। সেই সময় আমার অটোগ্রাফ জমাবার শখ ছিল। আমি শের-এ-কাশ্মীর শেখ আবদুল্লাহ, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও পরবর্তীকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, প্রথম বাঙালি ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস, কবি শেখর কালিদাস রায়, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বীর সৈনিক অম্বিকা চক্রবর্তী, এঁদের কাছে চিঠি লিখে ১৯৪৭ সালে অটোগ্রাফ আনিয়েছিলাম। ১৯৪৮ সালে দিল্লিতে পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুকে আমার আঁকা তাঁর একটি প্রতিকৃতি পাঠিয়ে বিনিময়ে তাঁর অটোগ্রাফসহ একটি ছবি চেয়েছিলাম। তিনি সানন্দে আমাকে তাঁর একটি ছবি সই করে পাঠিয়েছিলেন।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আমি ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী ছিলাম। আমার খুবই ইচ্ছা হতো আমি কমিউনিস্ট পার্টির অফিসের জন্য মার্কস, অ্যাঙ্গেলস, লেনিন ও স্তালিনের ছবি আঁকব। ছেলেবেলা থেকে ড্রইংয়ে আমি ছিলাম কাঁচা এবং আর্টিস্ট হওয়ার কোনো বাসনা কখনো আমার মনে স্থান পায়নি। তবে ছবি দেখতে আমার ভালো লাগত। বাবার লাইব্রেরিতে সুযোগ পেলেই আমি মাসিক পত্রিকাগুলোর এবং এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় মুদ্রিত রঙিন ছবি দেখতাম। বাবার লাইব্রেরিতে উনি যখন প্যারিস থেকে ১৯২৮ সালে ফিরে আসেন তখন প্যারিসে অবস্থিত ভারতীয় ছাত্র অ্যাসোসিয়েশন তাঁর বিদায় উপলক্ষে বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামের চিত্রগুলোর রঙিন ছবির দুই খণ্ড অ্যালবাম উপহার দিয়েছিল। যেহেতু এর বেশ কিছু ছবি ছিল বিবস্ত্রা নারীর, তাই তিনি আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রাখতেন। ক্বচিৎ কখনো তিনি তালা দিতে ভুলে গেলে আমি কৌতূহলের সঙ্গে এই ছবিগুলো দেখতাম। তখন আমি দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল, জর্জিনো, কুবে, বতিচেল্লি, টিসিয়ান, দেলাক্রোয়া, ইনগ্রে, রেমব্রাঁ কিংবা পল গগাঁ, ভ্যান গঘ, গেঁজা, পিকাসো এঁদের নাম জানতাম না। পরে আর্ট স্কুলে পড়ার সময় এই নামগুলো জেনেছি। পরবর্তীকালে যখন রোম, ফ্লোরেন্স বা প্যারিসে মিউজিয়ামগুলোয় এঁদের ছবি দেখেছি, এই চিত্রগুলো মনে হয়েছিল আমার অতিচেনা। তাই প্রথম দর্শনে যে চমক লাগত তা আমার হয় না।
দেশভাগের পরপর বগুড়ায় এসেছিলেন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন। তিনি পার্টি অফিসে আমার আঁকা প্রতিকৃতিগুলো দেখে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে খবর পাঠান। আমি আগেই বলেছি, শিল্পী হওয়ার কোনো বাসনা আমার ছিল না। তবু এসব মহান নেতার প্রতিকৃতি আঁকার এক দুর্বার আকাঙ্ক্ষা মনে জন্মেছিল। তাই আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম কীভাবে বড় সাইনবোর্ডে খোপ কেটে কেটে ছোট্ট ছবি বিশলাকায় আঁকা হতো। বাসায় এসে আমি সেভাবে অনুশীলন করতাম। পরে যখন কিছুটা রপ্ত হয় তখন প্রতিকৃতিগুলো আঁকি। ভবানী সেন আমার অটোগ্রাফ খাতায় লিখেছিলেন : ‘আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভিতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে।’ কথাগুলো আমার মনে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। পরবর্তীকালে আমার শিল্পীজীবনে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই শিল্পকর্মগুলো সৃষ্টি হয়েছে।
ম্যাট্রিক পাশ করার পর আমরা সবাই ঢাকা এসে পড়ি। বাবা অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেই সুপারনিউমারি অধ্যাপক হিসেবে পুনরায় যোগ দিয়েছিলেন। সেই সময় আমরা বগুড়ায় ছিলাম। তিনি লালবাগ অঞ্চলে জগন্নাথ সাহা রোডে আমার বড় ভাই সফিয়্যূল্লাহ্র বাড়িতে থাকতেন। আমরা যখন ঢাকায় একেবারেই চলে আসব সেজন্য মাহুতটুলীতে শরৎ চক্রবর্তী রোডে একটা একতলা বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন, যদিও বেগমবাজারে আমাদের একটি দোতলা বাড়ি রয়েছে। কিন্তু ভাড়াটিয়া তখনো বাসা না ছাড়ার জন্য আমাদের ভাড়া বাসায় উঠতে হয়। ঢাকায় পার্টির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘটেছিল ভাই তকীয়্যূল্লাহ্র মাধ্যমে। তকীয়্যূল্লাহ্ তখন আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট নেতা। পার্টি আমাকে আর্ট স্কুলে ভর্তির নির্দেশ দেয়। সেখানে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। বাবা অবশ্য চেয়েছিলেন আমি আলিগড়ে পড়াশোনা করি। তখনকার দিনে মুসলিম সমাজে এটা ছিল একধরনের বাসনা। কিন্তু আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা যখন তাঁকে বলি, তিনি বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, তিনি প্যারিসে ছিলেন, তিনি দেখেছেন আর্টিস্টদের জীবন অত্যন্ত কষ্টের এবং অনিশ্চয়তায় ভরপুর। তাঁর সন্তান অভুক্ত বা অনাহারে থাকবে, দুঃখকষ্টে দিনযাপন করবে, এটা পিতা হিসেবে তাঁর কাছে অশোভনীয়। আমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে দেখে তিনি বললেন রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতনে পড়ার জন্য। কিন্তু আমার মূল উদ্দেশ্য তো শিল্পী হওয়া নয়, পার্টির সাংগঠনিক ক্রিয়াকর্মে জড়িত থাকা। তাই ঢাকা আর্ট স্কুলে ভর্তির জন্য জেদ করলাম। প্রথম কয়েকদিন তিনি আমার সঙ্গে কথা বললেন না, তাঁর সঙ্গে নামাজ পড়তে ডাকলেন না। দুই-তিন দিন পর তিনি আমার হাতে ভর্তি হওয়ার জন্য টাকা দিয়ে তাঁর সঙ্গে লাইব্রেরি ঘরে নিয়ে গেলেন। আলমারি খুলে ল্যুভর মিউজিয়ামের ওই দুটি নিষিদ্ধ ফল আমার হাতে নির্দ্বিধায় তুলে দিলেন। বললেন, এই দুটি বই এতদিন ছিল আমার, আজ থেকে তোমার।
তিনি মনে করেছিলেন এই নগ্নিকা রমণীরা আমার কাছে দৃষ্টিনন্দন রমণী রূপে ধরা দেবে, কামনাজর্জরিত নগ্ন ছবি হিসেবে প্রলুব্ধ করবে না।
লেখাটি এই লেখকের "আমার জীবন ও অন্যান্য" বই থেকে সংগ্রহিত।
No comments:
Post a Comment