গোর্কী বলেছেন, 'আমার পাঠশালা হচ্ছে জীবন। আর জীবনই আমার বই।' তাঁর কথা হচ্ছে জীবন যেমন আমাদের একখানি বইয়ের কথা বুঝতে সাহায্য করে, তেমনি বই আমাদের জীবনকে বুঝতে সাহায্য করে একেই আমরা বলি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বই আর জীবনের মধ্যে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সম্পর্কে কোন কিছু বলা আমার মত লেখকের জন্য অনুচিত হবে। তার প্রবন্ধ সমগ্র পড়ে শেষ করলেম কিছুদিন আগে। সেখানে একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল "ইহজাগতিকতার শত্রুপক্ষ"। ভালো কোনো লেখা পড়লে অন্যকে পড়ানোর একধরনের তাগিদ অনুভব করি। আপনাদের ভালো লাগলে আমারও আমারো লাগবে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইহজাগতিকতার শত্রুপক্ষ
ইহজাগতিকতা থাকলে পারলৌকিকতাও থাকে, আলো থাকলে যেমন থাকে অন্ধকার, হয়তো-বা বলা যাবে মাটির ওপরে আকাশ; কিন্তু ইহজাগতিকতা পারলৌকিকতার অনুগত নয়, পারলৌকিকতাকে অবজ্ঞা না-করলেও উদাসীনতা যে দেখায় সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইহজাগতিকতার ভাবটা এই রকমের যে, পরলোক আছে কিনা জানি না, থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তাকে নিয়ে আমার উৎসাহ নেই, আমার জগৎ ইহজগৎ, সেখানেই আমার আগ্রহ। ইহকাল আছে; ইহজগৎ ইহকাল থেকেও ভিন্ন। কেননা কাল অনেক বিস্তীর্ণ জগতের তুলনায়।
অন্য অনেক কিছুর মতো ইহজাগতিকতারও দুটি দিক রয়েছে। একটি তাত্ত্বিক, অপরটি প্রায়োগিক। তাত্ত্বিক দিকটি দার্শনিক; প্রায়োগিক দিকটিতেও দার্শনিকতা রয়েছে, কিন্তু সেখানে জোরটা পড়ে জীবনযাপনের ওপরে। মেহনতি মানুষেরা যে সব সময়েই ইহজাগতিক সেটা নিশ্চয় করে বলবার উপায় নেই, কেননা প্ররোচনা থাকে আধ্যাত্মিক হবার। ইহজাগতিকতার শক্রপক্ষ ওই প্ররোচনাটি দিয়ে থাকে, দেয় নিজের স্বার্থে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের সাধারণ প্রবণতাটা হচ্ছে ইহজাগতিক হবার। না-হয়ে উপায় নেই। কেননা তাকে তো পরিশ্রম করতে হয় । জগতের সঙ্গে সংগ্রাম করে তাকে বাঁচতে হয়, প্রত্যক্ষ জগৎকে অবজ্ঞা করবে এমন সুযোগ তার জন্য খুবই কম।
অধ্যাতবাদ ইহজাগতিকতার বিপরীতপক্ষ বটে, কিন্তু ইহজাগতিকতার আসল শক্র সেখানে নেই, রয়েছে অন্যত্র । অধ্যাত্মবাদ এই শক্রর দ্বারা ব্যবহৃত হয়। আকর্ষণ করে, মোহ গড়ে তোলে। আসল শক্রটা তাহলে কে? সে হচ্ছে ভয় ।
এই ভয়ের ব্যাপারটায় আসার আগে ইহজাগতিকতা ব্যাপারটা কি সেটা একটু বুঝে নেওয়া যাক। ইহজাগতিকতা নাস্তিকতা নয়। ইহজাগতিক হতে হলে নাস্তিক হতে হবে এমন কোনো দিব্যি নেই, যদিও ইহজাগতিক মানুষকে নাস্তিক বলার রেওয়াজ রয়েছে। নাস্তিক বলা হয় সাধারণত ইহজাগতিকদেরকে ঘায়েল করার জন্য। বস্তুত, নাস্তিক না হয়ে তো বটেই, এমনকি ধর্মবিশ্বাসী হয়েও ইহজাগতিক হওয়া যায়। ইহজাগতিকতার ইংরেজি হচ্ছে সেকুলারিজম; সেকুলারিজমের ধারণাটি আমরা আধুনিক ইউরোপ থেকে পেয়েছি। যদিও সেকুলারিজম ব্যাপারটা আমাদের এই অঞ্চলে আগেও ছিল, অনেক আগেই। আধুনিক ইউরোপে ওই প্রত্যয়টি প্রতিষ্ঠার পেছনে যার ভূমিকা বেশী করে উল্লেখযোগ্য তিনি হচ্ছেন ফ্রান্সিস বেকন। বেকন মোটেই নাস্তিক ছিলেন না, নাস্তিকতার তিনি বরঞ্চ বিরোধিতাও করেছেন তার লেখাতে । কিন্তু তিনি অত্যন্ত ইহজাগতিক ছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, ঈশ্বর আছেন, তিনি থাকবেনও; কিন্তু ঈশ্বরকে থাকতে দিতে হবে তার নিজের জায়গায়, তাকে জাগতিক কাজকর্মের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা চলবে না। ওই মিশিয়ে ফেলাটা ভুল এবং ক্ষতিকর। ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের ব্যাপার, আর জগৎ চলে প্রাকৃতিক নিয়মে, জগতের চালিকাশক্তি ধর্মবিশ্বাস নয়, চালিকাশক্তি নানাধরনের দ্বন্দ্ব। বিশ্বাসের দরকার আছে, যুক্তিবুদ্ধিরও দরকার আছে, কিন্তু তাদেরকে সংমিশ্রিত করে ভেজাল উৎপাদন খুবই অন্যায়। যাকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বলি তার মূল ব্যাপারটাও ওইটাই রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে মিলিয়ে না-ফেলা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, এই কথাটা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশ জোরেশোরে বলা হয়েছে। কথাটা সত্যও বটে আবার মিথ্যাও বটে। সত্য এই দিক থেকে যে, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা নাগরিকদের এই পরামর্শ দেয় না যে, তোমাদেরকে ধর্মহীন হতে হবে; কিন্তু তাই বলে আবার এমন কথাও বলে না যে, রাষ্ট্র নিজে সকল ধর্মেরই চর্চা করবে কিংবা নাগরিকদেরকে নিজ নিজ ধৰ্মচর্চায় উৎসাহিত করবে; রাষ্ট্র বরঞ্চ বলবে, ধর্মচর্চার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোনো আগ্রহ নেই, রাষ্ট্র নিজে একটি ধর্মহীন প্রতিষ্ঠান, ধর্মবিশ্বাস নাগরিকদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্রের ওই ধর্মহীনতাকেই কিছুটা নম্র করে বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা । ইহজাগতিকতা হুবহু বস্তুতান্ত্রিকতা নয়, কিন্তু বস্তুতান্ত্রিকতা থেকে খুব যে দূরে তাও নয়।
জগৎ সত্য । সে অত্যন্ত বাস্তবিক। কিন্তু এই বাস্তবিক সত্যটাকে খাটো করে দিতে চায় ইহজাগতিকতার শক্রপক্ষ । তারা ধর্মকে টেনে নিয়ে আসে সামনে । ধর্ম বিশ্বাসের পেছনে একটা ভয় থাকে। পরকালের ভয়। অজানাকে ভয়। ওই ভয়টাকে কাজে লাগানো হয়। ইহজাগতিকতার যারা বিরুদ্ধ পক্ষ তারা ওই ভয়টাকে কাজে লাগায়। তারা নিজেরাও অবশ্য ভীতু৷ ভয় থেকেই ইহজাগতিকতার বিরুদ্ধে কাজ করে। ভয় থাকে পরকালের । কিন্তু তার চেয়েও বড় ভয় হচ্ছে স্বার্থহানির। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সঙ্গে যাদের জাগতিক স্বার্থ জড়িত তারা ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে নিজেদের শাসন-শোষণ-নিপীড়ন তথা কায়েমী স্বার্থ রক্ষার যে-চেষ্টা তারা করে তার আচ্ছাদন হিসেবে ! ঈশ্বরই এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যে, কেউ বড় হবে কেউ ছোট। এটাই ধর্মের বিধান বলে তারা প্রচার করে । ইহজাগতিকতা ধর্মের আচ্ছাদনটি যদি সরিয়ে দেয় তাহলে কায়েমী স্বার্থওয়ালাদের কদর্য কাজটা উন্মোচিত হয়ে জনসম্মুখে এসে যাবে, এই ভয়ে তারা হত্যাও করেছে, ইতিহাসে নজির রয়েছে। সাধারণ মানুষ যে ধর্মের কাছে যায় সেটা কেবল ভয়ে নয়, অনেক সময়ে ভরসাতেও । এই জগতে বিচার নেই, পরজগতে তারা বিচার আশা করে। জগতে নির্ভর করা যায় এমন শক্তি নেই, মানুষ তাই পরজগতের দিকে তাকিয়ে থাকে। কায়েমী স্বার্থের সংরক্ষক ও তাদের চেলাচামুণ্ডারা মানুষের ওই ধর্মবাদিতাকেও ব্যবহার করে থাকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থে। ইহজাগতিকতার শক্রপক্ষ মুখে যাই বলুক না কেন কার্যক্ষেত্রে তারা নিজেরা অত্যন্ত ইহজাগতিক। বিষয়-সচেতন ।
ইহজাগতিকতার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠিত স্বার্থের রক্ষকদের দ্বন্ধটা খুবই স্বাভাবিক। বঞ্চনাকারীরা বঞ্চিতদের সঙ্গে শক্রতা করবেই। কিন্তু পরিহাসের বিষয় এটা যে, বঞ্চনাকারীরা বঞ্চিতদেরকে তাদের পক্ষে নিয়ে নেয়। এই নেবার ক্ষেত্রে ধর্ম খুবই উপকারে আসে, তাদের জন্য। ইহজাগতিকদের ধর্মবিরোধী হিসেবে দাড় করানো হয়, বলা হয় এরা জড়বাদী, বলা হয় এরা সবাই নাস্তিক। চেষ্টা করা হয় রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে মিলিয়ে ফেলবার। ভারত একটি ইহজাগতিক রাষ্ট্র, কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে সেখানে মৌলবাদীরা চেষ্টা করছে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে। মধ্যপ্রাচ্যে কোনো কোনো দেশে ধর্ম ও রাষ্ট্র এক হয়ে গেছে। কেবল যে সৌদি আরবে তা নয়, ইসরাইলেও। ইসরাইলেই বরঞ্চ বেশী পরিমাণে ঘটেছে এই ব্যাপারটা। ওই রাষ্ট্রের অভু্যদয়ই ঘটেছে একটি ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে, তার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার লড়াই লড়ছে যে প্যালেস্টাইনীয় জনগণ, তাদের মধ্যে বরঞ্চ ইসলাম ছাড়াও অন্য ধর্মের লোক রয়েছে, খ্রিষ্টানরা আছে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের একনিষ্ঠ সমর্থক ! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট নামে ছোট কিন্তু আস্ফালনে অনেক বড়; মুসলিম ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে তিনি ক্রুসেড ঘোষণা করেছেন। উল্টোদিকে মুসলিম মৌলবাদীরা মনে করছে তারা জেহাদে আছে। দু'পক্ষই মৌলবাদী। এবং দুয়ে মিলে মানুষের সভ্যতাকে পেছনের দিকে ঠেলছে। এ সত্য তো ভুলবার উপায় নেই যে, সভ্যতা একটি ইহজাগতিক ব্যাপার। এর অগ্রগতিতে অতীতে ধর্মের একটি প্রগতিশীল ভূমিকাও ছিল, কেননা ধর্ম তখন বিদ্রোহ করেছে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। খ্রিষ্ট ও ইসলাম উভয় ধর্মই এসেছিল নিপীড়িত মানুষের অগ্রাভিযানের সাহায্য করবার অঙ্গীকার নিয়ে । কিন্তু পরে কায়েমী স্বার্থবাদীরা উভয় ধর্মকেই ব্যবহার করেছে নিজেদের নোংরা স্বার্থে এবং এখন দুই ধর্মের মধ্যে লড়াই বাধাবার তালে আছে। ধর্মের আধ্যাতিক স্বার্থে নয়, নিজেদের বস্তুগত স্বার্থে। ফলে ইউরোপীয় রেনেসান্সের সময় থেকে ইহজাগতিকতার যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল এখন তা নতুন করে বিঘ্নিত হচ্ছে।
ইহজাগতিকতার আরো একটি শক্র রয়েছে। সেটি হলো মানুষে মানুষে বৈষম্য। কায়েমী স্বার্থওয়ালারা নিজেদেরকে ধনী করতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষকে গরিব করে রাখে। এই গরিব মানুষেরা নির্যাতিত হয়, তারা বিচার পায় না, ভরসা পায় না, তখন তারা ধর্মের কাছে যায়। নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পথ দুটি—একটি গেছে বামে, অন্যটি ডানে। বামপন্থীরা ইহজাগতিক, তারা গণতন্ত্রী; ডানপন্থীদের অধিকাংশই ধর্মীয় মৌলবাদী। বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র ইহজাগতিকদের ওপর পীড়ন চালায়, ফলে সুবিধা হয় ধর্মীয় মৌলবাদীদের। তারা প্রধান প্রতিবাদকারী হয়ে উঠতে চায়। বিশ্বজুড়ে আজ এই ঘটনাই ঘটছে।
সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ছিল ইহজাগতিক। পুঁজিবাদী বিশ্বও নিজেকে ইহজাগতিক বলে প্রচার করে। কিন্তু দুয়ের মধ্যে মৌলিক ব্যবধান রয়েছে। প্রথম কথা হলো এই যে, পুঁজিবাদীরা দারিদ্র্য সৃষ্টি করে, আর দরিদ্র মানুষ বাধ্য হয় ধর্মের কাছে ছুটতে। দ্বিতীয় সত্য এটা যে, পুঁজিবাদীরা ভোগবাদী; দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষ নিজেদেরকে ভোগ থেকে বঞ্চিত দেখে পরকালে স্বর্গ পাবে এই আশার মধ্যে সান্তুনা খোজে। তৃতীয়ত, পুঁজিবাদীরা মৌলবাদীদেরকে সরাসরি উৎসাহিত করে ডানপন্থী হতে; আর ডান দিকে এগুলে মৌলবাদী হতে খুব বিলম্ব ঘটে তা নয়।
আমাদের এই উপমহাদেশে মানুষজন খুবই আধ্যাত্মিক বলে একটা রটনা আছে। এই প্ররোচনা বিশেষভাবে জোরদার হয়েছে ইংরেজ কর্তৃক ভারত দখলের পর থেকে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই দেখা গেছে ভারতবর্ষীয়রা তাদের ধর্মীয় উত্তরাধিকার নিয়ে গর্ব প্রকাশ করা শুরু করেছে। একাধিক কারণে এটা ঘটেছে। প্রথমত, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অভিমান তৈরি হয়েছে। নতুন শাসকরা নানাভাবে তাকে পীড়িত করছিল, ফলে তার মধ্যে একটা আগ্রহ জন্মেছে দাড়াবার জায়গা খুঁজবার। প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছুই বিদেশীরা দখল করে নিয়েছে, দেশী মানুষ এখন যায় কোথায়? গেছে সে ধর্মের কাছে। ইংরেজদের মধ্যে মিশনারিদেরকে দেখা যাচ্ছিল, যারা স্থানীয় মানুষদের ধর্মান্তরিত করতে উদ্যোগ নিচ্ছিল। সেটাও একটা কারণ নিজেদের ধর্মকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখার পেছনে। উল্টো দিকে আবার এটাও যে, উইলিয়াম জোনস ও মাক্সমুলারের মতো প্রাচ্যবিদরা প্রাচ্যে যে আধ্যাত্মিক মহত্বের সন্ধান পেয়েছেন তার প্রচারও স্থানীয় বিদ্ব্যজনকে উৎসাহিত করেছে, তারা অধ্যাত্মবাদের সন্ধানে ধর্মের কাছে চলে গেছেন। রাধাকৃষ্ণাণের মতো পণ্ডিত ব্যক্তিরা গর্ব করে বলেছেন যে, ভারতবর্ষ যে সময়ের ধ্বংসলীলা ও ইতিহাসের দুর্ঘটনা সহ্য করে দাড়িয়ে থাকতে পেরেছে তার কারণ রাজনৈতিক বা সামাজিক নয়, কারণ হচ্ছে ভারতবর্ষের গভীর আধ্যাতিকতা ।
অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, ভারতীয় চিন্তার ঐতিহ্যে ইহজাগতিকতা তো বটেই, এমনকি বস্তুবাদিতাও খুব বড় সত্য ! যে-বেদের আধ্যাত্মিকতার উচ্চকণ্ঠ প্রশংসা করা হয় তাতে আধ্যাত্মিকতা নয় ইহজাগতিকতাই প্রধান। বেদে দেবতাদের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক সেটা ভক্তি নয়, পারস্পরিক আদান-প্রদানের বটে। গ্ৰীক দেবদেবীদের সঙ্গে সে-দেশের মানুষের সম্পর্ক থেকে এটা কিছুটা ভিন্ন রকমের গ্রীসে দেবতা ও মানুষ পরস্পরের বন্ধুর মতো, যোগাযোগটা বেশ জানাশোনার। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যাপারটা সরাসরি দেওয়া-নেওয়ার। দেবতাদের কাছে মানুষ চায় সম্পদ, সম্পত্তি, নিরাপত্তার মতো জিনিস যা দেবতারা দিতে পারে। প্রতিদানে দেবতারা মানুষদের কাছে আশা করে খাদ্য ও পানীয়। যেমন ধরা যাক, দেবরাজ ইন্দ্রের কথা। তিনি সোমরসের বিশেষ ভক্ত। তার পূজারীরা ওই রস সরবরাহ করে এবং বিনিময়ে তার কাছ থেকে উপকার প্রত্যাশা করে থাকে।
গ্রীক দার্শনিকেরা দর্শনের চর্চা করতেন জীবন জগতের রহস্য বুঝবার জন্য। ভারতীয় দর্শনের বিকাশ ভিন্ন কারণে। ওই কারণটা হচ্ছে দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তির আকাজক্ষা। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, সূচনায় ভারতবর্ষের দার্শনিকতায় আধ্যাত্মিকতা ছিল না, ছিল যা তা হলো প্রবল ইহজাগতিকতা। ইহজগতের প্রয়োজনে মানুষ দেবদেবীর কৃপাপ্রার্থী হয়েছে, কোনো তত্ত্বগত প্রয়োজনে নয়। সেজন্য দেখা যায় প্রার্থনায় ঘোড়া ও গরুর কথা রয়েছে। গাভী যখন তার বাছুরদের উদ্দেশে ডাক দেয় তখন যে-ধ্বনি তৈরি হয় ঋগ্বেদে তার অতিউচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে ওই ধ্বনি মন্ত্ৰোচ্চারণের সঙ্গীতের মতো মধুর বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। বেদে বৃষ্টি, দীর্ঘজীবন, যৌবন, রোগের প্রতিকার, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, সব কিছুর জন্যই আন্তরিক প্রার্থনা শোনা যায়। বার বার বলা হচ্ছে আমাদের ধন ও পশু বর্ধিত হোক, আমাদের শক্রর বিনাশ ঘটুক, আমাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাক। আমাদের কথাই আসছে, আমার কথাটা না-এসে; যা থেকে বুঝতে পারি যে, ব্যক্তি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেনি, বিচ্ছিন্ন করবার মতো অবস্থা তার নয়। তাকে যুথবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়, তার আশেপাশে নিরাপত্তার ভীষণ অভাব এবং দৈবনির্ভরতা ভিন্ন তার উপায় নেই। গ্ৰীক দার্শনিকেরা সুখের অভাবে ছিলেন না, দর্শনের নানা বিষয়ে কৌতুহল ও আলোচনা করবার মতো জাগতিক সুবিধা তারা ভোগ করতেন; বেদের রচয়িতাদের জীবনে যার অভাব ছিল। বেদের সঙ্গীতময়তা খুবই সরল, আন্তরিক এবং শিল্পমূল্যে উচ্চ পর্যায়ের। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণরা নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থে ওই সঙ্গীতকে টীকাভাষ্যে জর্জরিত ও দুর্বোধ্য করতে চেয়েছে এবং সেই সঙ্গে শূদ্রের জন্য তার পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।
বেদে দেবদেবীর সংখ্যা অনেক, তাদের সকলেরই প্রয়োজন আছে, আধ্যাত্মিক কারণে নয়, দেবদেবীর স্বার্থে নয়, মানুষের স্বার্থে। প্রকৃতির নানা রূপকে দেবদেবীতে পরিণত করা হয়েছে সত্য, কিন্তু তাতে কোনো আধ্যাত্মিকতা দেখা দেয়নি। ব্যাপারটা রয়ে গেছে বাস্তবিক এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ব্যাপার। সেখান থেকেই উৎসারিত এবং সে-কারণে আমন স্বাভাবিক ও সুন্দর। আধ্যাত্মিকতার হস্তক্ষেপ ব্রাহ্মণদের অবদান।
এ প্রশ্নটা তো খুবই স্বাভাবিক, এবং সেটা উঠেছেও যে, প্রাচীন ভারত যদি অত আধ্যাত্মিকই হবে তবে মানব সভ্যতায় সে আমন বড় বড় অবদান যোগ করলো কি করে। সভ্যতা তো সর্বদাই ইহজাগতিক, তার আধ্যাত্মিকতা বাস্তববাদিতার ওপর নির্ভরশীল। আধ্যাত্মিকতা বাস্তববাদিতার জন্ম দেয়নি, বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটেছে। প্রাচীন ভারতে স্থাপত্য, রসায়ন, গণিত, চিকিৎসা, ভেষজশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, বিশ্ববিদ্যালয় এসব গড়ে উঠলো কিভাবে, মানুষ যদি জগৎকে উপেক্ষা করে পরলোকবাদী হয়ে থাকে? সভ্যতা পরলোকবাদিতায় গড়ে ওঠা সম্ভব নয়; এবং তা ঘটেওনি । আধ্যাত্মিকতা প্রচারের ফলে আস্কারা পেয়েছে। বাস্তবতা ছিল ভিন্ন প্রকারের।
রাধাকৃষ্ণাণের মতো ভাববাদী দার্শনিকেরা মনে করেন যে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে দার্শনিকেরা যে ভূমিকা পালন করবেন বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, সেই আশাই বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। কেননা ব্রাহ্মণরা ছিলেন দার্শনিক এবং তারাই ছিলেন রাষ্ট্র ও সমাজের নির্দেশক । বক্তব্যটি একাংশে সত্য, অপরাংশে নয়। হ্যা, ব্রাহ্মণরাই কর্তা হয়েছিলেন। তারাই কর্তৃত্ব করতেন। সমাজে নির্মম শ্রেণী বিভাজন কার্যকর ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা একদিকে, অন্যদিকে শ্রমজীবী অধিকাংশ মানুষ, যারা ছিল শূদ্র বলে চিহ্নিত ব্রাহ্মণরা শ্রম করতো না, তারা শূদ্ৰদের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বস্তুত ব্রাহ্মণরা যে কিছুতেই কৃষিকার্যে লিপ্ত হবেন না, এই নির্দেশ শাস্ত্রে বার বার দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে শূদ্রদের কাজই হচ্ছে শ্রম করা । তারা সেজন্যেই জন্মেছে। আর ওই যে শ্রেণীবিভাজন তাকে একটি ধর্মীয় অর্থাৎ আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাও দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যেটা ছিল অনপনেয়। বলা হয়েছিল যে, শূদ্ররা শূদ্র হয়ে যে জন্মেছে সেটা এমনি এমনি নয়, আগের জীবনের কর্মদোষ বটে। তাই এ জীবনে তাদেরকে শ্রম করতে হবে, করলে হয়তো পরজন্মে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু কেবল শ্রমে কুলাবে না সেবাও করা চাই। সেবা করতে হবে ব্রাহ্মণকে । সেটাও শূদ্রের বিধিলিপি; আগের জীবনে যে পাপ সে করেছে তার প্রতিফল। সেবা দিয়েই ওই পাপবন্ধন ছিন্ন করা সম্ভব, বিচ্যুত হলে পরবতী জীবনেও ওই কাজই করতে হবে। শ্রেণী বিভাজন অভিনব কোনো ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তু প্রাচীন ভারতে অধ্যাত্মবাদী ব্ৰাহ্মণরা যা করেছিলেন তা হলো ওই বিভাজনকে ধর্মীয় রূপ প্রদান ।
প্লেটোর দার্শনিকেরা শ্রম করবেন না; শ্রমের দায়িত্ব শ্রমজীবীর। প্লেটোর সমাজে দাস ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, এবং দার্শনিকরা ওই শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে বসে দর্শনের চর্চা করবার সুযোগ পেতেন। সেটা ছিল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। দার্শনিকরা ওই ব্যবস্থাকে রক্ষা করবার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিপ্লব ঠেকানো প্লেটো ও এ্যারিস্টটল উভয়েরই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল; রাষ্ট্রকেই তারা প্রধান করেছেন, ব্যক্তিকে নয়। অত করেও এ্যারিস্টটল শাসকদের ক্রোধ থেকে মুক্ত হতে পারেননি, মৃত্যুর পূর্বে তাকে এথেন্স ছেড়ে পালাতে হয়েছিল, প্রাণভয়ে। প্লেটাে এমন বিপদে পড়েননি। কারণ তিনি কাল্পনিক রাষ্ট্র নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বাস্তবিক রাষ্ট্রের সংবিধান তৈরির দায়িত্ব নেননি, এ্যারিস্টটল যেমনটা নিয়েছিলেন ।
সাদৃশ্য আছে, কিন্তু গ্ৰীক দার্শনিকদের সঙ্গে ভারতীয় ব্রাহ্মণদের পার্থক্যও ছিল মৌলিক। বিদ্যার টীকা ভাষ্য ব্যাখ্যা ইত্যাদি রচনা করা; যা ছিল জীবন্ত তাকে মন্ত্রে পরিণত করেছেন, শব্দ মুখ্য হয়ে উঠেছে বস্তুর তুলনায়। ব্রাহ্মণরা নিজেদের স্বার্থকে প্রধান করেছেন, গ্রীক দার্শনিকরা যা করেননি। গ্ৰীক দার্শনিকদের ভেতর ভাববাদিতা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু বস্তুবাদিতাও ছিল, ছিল ইহজাগতিকতা। ভারতীয় দর্শনেও বস্তুবাদিতা ও ইহজাগতিকতা ছিল। কিন্তু ওই দুই উপাদানকে ব্রাহ্মণরা কখনোই গুরুত্বপূর্ণ হতে দেননি, চেষ্টা করেছেন বরঞ্চ অবলুপ্ত করে দিতে। যাতে করে সাধারণ মানুষ ওসব বিষয়ে উৎসাহী না হয়, প্রশ্ন না তোলে, অসঙ্গতি দেখে বিদ্রোহ না করে বসে। বিদ্রোহ প্লোটো-এ্যারিস্টটলও চাননি, কিন্তু তাদের আয়োজনটা ছিল ইহজাগতিক, ব্রাহ্মণরা ব্যবস্থা করেছেন তথাকথিত আধ্যাত্মিকতার ব্রাহ্মণরা নিজেরা কিন্তু বেশ ইহজাগতিক ছিলেন, উৎপাদন করতেন না, পূজা-অৰ্চনার ওপর নির্ভর করতেন এবং ভোগের ব্যাপারে যে উৎসাহহীন ছিলেন তাও নয় ।
ভারতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিদ্যা অগ্রসর ছিল। ওই জ্ঞান মোটেই আধ্যাত্মিক ছিল না, ছিল পরিপূর্ণরূপে ইহজাগতিক ও বস্তুবাদী। কিন্তু বিজ্ঞান কেন এগুলো না, চিকিৎসাবিদ্যা কেন পিছিয়ে গেল? গেল ইহজাগতিকতার সঙ্গে ব্রাহ্মণদের কার্যকর শক্রতার কারণে। শক্রতাটা ছিল প্রধানত মতাদর্শিক। প্রচার করা হয়েছিল যে, জগৎ মিথ্যা। মায়া। তাই যদি হয় তাহলে বিজ্ঞান এগুবে কি করে? বিজ্ঞান তো মায়া নয়। সে তো বস্তুবাদী। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একই রকমের ঘটনা ঘটেছে। রোগের নিরাময় দেবতারা করবেন, করবেন পূজা-অৰ্চনার বিনিময়ে এবং পূজা-অৰ্চনা ঘটবে ব্রাহ্মণের মধ্যস্থতায়, ব্যবস্থাটা ছিল এই রকমের। মন্ত্র অনেক জরুরী ভেষজ ওষুধের তুলনায়, প্রচারণা ছিল এটাই। মতাদর্শিকভাবে শ্রমকে হেয় জ্ঞান করা হয়েছে। শ্রম হচ্ছে অভিশাপ, শ্রম করবে শূদ্র। সবরকম শ্রমকেই ইতর লোকের কাজ বলা হয়েছে। চাষা কামার কুমার ডোম মেথর কারো শ্রমই মর্যাদাবান নয়। বিজ্ঞানীর কাজও ছিল মর্যাদাহীন, চিকিৎসকের কাজও তাই কর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্রাহ্মণরাই ছিলেন আদর্শস্থানীয়। লোকে তাদের মতো পরশ্রমজীবী হতে চেয়েছে, পরিশ্রমজীবী না হয়ে । ওদিকে বিজ্ঞান রূপকথা নয়, সে প্রায়োগিক । বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করতে পারে তারাই যারা উৎপাদনে যুক্ত; কিন্তু ভারতবর্ষে উৎপাদনে যারা যুক্ত তাদেরকে তো খাটানো হয়েছে ঘানির বলদ হিসেবে; তারা কি করে বিজ্ঞান প্রয়োগ করবে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে নব উদ্ভাবনের পথে? প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জন্ম দেয়, সে-প্রয়োজনটা তৈরি হয়নি। বিজ্ঞানের জায়গায় এসেছে ঈশ্বরনির্ভরতা, পরলোক বড় হয়ে উঠতে চেয়েছে ইহলোককে পদানত করে।
আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো দেখা যায় যে, বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মৌলবাদী হন। এর প্রধান কারণ ওই বস্তুজগৎ বিচ্ছিন্নতা; বিজ্ঞান তাদের কাছে ঐন্দ্রজালিক বস্তুতে পরিণত হয়। সেখানে অঙ্ক থাকে, যে অঙ্ক মন্ত্রের মতো ভাববাদী, বস্তুবাদী নয়। মৌলবাদী বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা দেখেন এবং ভাবেন এ সবই একটি অনির্বচনীয় পরম সত্তার বহিঃপ্রকাশ; সবটাই যে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণের মধ্য দিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে সেই সাধারণ সত্যটি তারা ভুলে যান। প্লেটোর দার্শনিকদের রাজ্য ও সমাজ শাসনের সঙ্গে ব্রাহ্মণ দার্শনিকদের আধিপত্যের আরো একটি মৌলিক পার্থক্য তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা এই যে, প্লেটোর দার্শনিকরা জন্মসূত্রে দার্শনিক নন, তারা দার্শনিক নিজ নিজ যোগ্যতায় । জন্ম তাদের জন্য উল্লেখযোগ্য বিষয়ই নয়, কার কোন ঘরে জন্ম সেটা খেয়ালই করা হবে না, লোক-বাছাইয়ের কাজটা চলবে মেধার ভিত্তিতে। মেধাবানরাই দার্শনিক হবেন এবং কর্তৃত্ব করবেন। ভারতের ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে জন্মসূত্র হচ্ছে একেবারে প্রাথমিক বিবেচনা। ব্রাহ্মণের জন্ম যেখানে-সেখানে নয়, তার জন্ম ব্রাহ্মণের ঘরেই।
ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রাচীন ভারতে দার্শনিক অভু্যুথান ঘটেছে, যার সামাজিক তাৎপর্য মোটেই সামান্য ছিল না। বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব ও বিকাশ দুটি বড় ঘটনা। বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণদের শাসন অনুশাসন মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। তারা নাস্তিক ছিলেন, ঈশ্বর কিংবা স্বর্গে বিশ্বাস করতেন না; যেটা মস্ত বড় ব্যাপার। কিন্তু বৌদ্ধরা তাই বলে যে পুরোপুরি ইহজাগতিক ছিলেন তাও নয়। তারা কর্মফল ও জন্মচক্র মানতেন । ব্রাহ্মণদের মতো মোক্ষ চাইতেন না বটে, তবে নির্বাণ চাইতেন। নির্বাণ হচ্ছে নিভে যাওয়া, নির্বাপিত হওয়া। এই যে নির্বাপিত হতে চাওয়া, এর মধ্যে ইহজগৎবিমুখতা ছিল। জীবনকে তারা দুভোগ হিসেবে দেখতেন এবং জীবনের প্রতি আসক্ত হওয়াটাকে চূড়ান্ত ভ্রম বলে জানতেন। তাই নাস্তিক হয়েও জীবনবিমুখ ছিলেন। জীবনবিমুখদের পক্ষে ইহজাগতিক হওয়াটা কঠিন। ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধদের বিতাড়িত করেছে বটে, কিন্তু বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে মানতে অসুবিধা বোধ করেননি।
প্রাচীন ভারতের পুরোপুরি ইহজাগতিকেরা চার্বাক নামে পরিচিতি। এঁরা একাধারে নাস্তিক, ব্ৰাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী এবং জগতের প্রতি আসক্ত। ভারতীয় দার্শনিক ধারায় এরাই ছিলেন সর্বাধিক পরিমাণে বস্তুবাদী ! একেবারেই আপোসহীন । চার্বাকরা চার্বাক নাম কেন পেলেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ আছেন যারা এঁদের অস্তিত্বই অস্বীকার করেন। কিন্তু চাৰ্বাকরা যে ছিলেন তার প্রমাণ আছে। তবে তাদের নিজেদের রচনা পাওয়া যায় না, তার কারণ ব্রাহ্মণদের ক্রোধ। ব্রাহ্মণরা তাদের নাস্তিক, পাষণ্ড, ধূর্ত, কূটতার্কিক, ছেলেমানুষ ইত্যাদি নানা অভিধায় ভূষিত করেছেন, তিরস্কার করবার অভিপ্রায়ে। বোঝা যায় খুবই ক্ষিপ্ত ছিলেন। অবজ্ঞা করে জব্দ করা যায়নি, তাই আক্রমণ করা হয়েছে। চাৰ্বাকদের গ্রন্থ নয় কেবল, সম্পত্তি ও জীবন উভয়ই বিপন্ন ছিল বলে ধারণা করার কারণ রয়েছে। চাৰ্বাকদের নামকরণ সম্বন্ধে ঠাট্টাচ্ছলে বলা হয়েছে যে, তারা চারুভাষণ করতো, তাই চাৰ্বাক ছিল। চারুভাষণ অর্থ এক্ষেত্রে কটুভাষণই মনে হয়। চার্বাকরা সবকিছু চর্বন করতো, অনেকটা ছাগলের মতো, তাই তারা চার্বাক, এমনও বলা হয়েছে। চার্বাকদের আরেক নাম লোকায়ত। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এ নিয়ে গবেষণা করেছেন, এবং তিনি এই লোকায়ত নামকরণ পছন্দ করেন। চাৰ্বাক দর্শন আসলে লোকায়ত দর্শনই। একাধিক অর্থে। এ ছিল লোকদের আয়ত্তে। এই দর্শনে রয়েছে সাধারণ মানুষের ধারণা-জীবন ও জগৎ বিষয়ে। অন্যদিকে আবার ছিল সে ইহজাগতিক। কেবল ইহজাগতিক নয়, পরিপূর্ণরূপে বস্তুবাদী।
চার্বাকরা ব্রাহ্মণদের আধিপত্য মানে না। ব্রাহ্মণদের আধ্যাত্মিকতাকে মনে করে প্রতারণা। ব্রাহ্মণরা শ্রম করে না, অন্যেরটা খায়, তাই পূজা-অৰ্চনা প্রথা অনুষ্ঠানকে উচ্চে তুলে ধরে। ওই পথেই তাদের জীবিকা অর্জিত হয়। তারা যে শোষক শ্রেণীর অংশ এবং শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার কারিগর, এই ধারণাটা সম্ভবত এখনো আসেনি, তাই কেবল প্রতারকই বলা হয়েছে।
বৌদ্ধদের মতো এরা নাস্তিক বটে, স্বর্গ-নরক মানে না; তবে এরা আরো এক ধাপ অগ্রসর । কেননা, কর্মফলকেও তারা মিথ্যা মনে করে। জন্মান্তর নেই। মৃত্যুর পরে দেহ যখন পুড়ে ছাই হবে তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। কারণ, আত্মা বলে কিছু নেই। হ্যা, চৈতন্য আছে কিন্তু চৈতন্যের জন্য আত্মার প্রয়োজন নেই। মাটি, আগুন, পানি ও বায়ুর সংমিশ্রণে আমাদের দেহতৈরি এবং চৈতন্যও এই সংমিশ্রণেরই ফল। পাপ-পুণ্য কর্মফল পুনর্জন এসবই ধূর্তব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচার। যা প্রত্যক্ষ তাই শুধু সত্য, এই তাদের বিশ্বাস। শরীর থাকলে যেমন প্রাণ থাকে তেমনি চৈতন্যও থাকে। সুখ নিজেই মূল্যবান এবং সেই সুখ ইহকালেই পাওয়া যাবে, পরকালের জন্য অপেক্ষা করাটা মূর্খতা, কেননা পরকালের তো কোনো অস্তিত্বই নেই, আসলে। দৈহিক আনন্দই ঈপ্সিত। যে জন্য বলা হয় যে, খাও দাও ফুর্তি করো, ধার করে হলেও ঘি কেনো, এটাই তাদের নীতি ছিল। যেন ফুর্তিবাজের দল।
চার্বকদের বক্তব্যকে এভাবে ফুর্তিবাজি বলে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। কেননা, সরাসরি তাদের গ্রন্থ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যরা তাদের সম্পর্কে যা বলেছে তা থেকেই তাদের বিষয়ে ধারণা করতে হয়েছে। তাদের বক্তব্যের খণ্ডন পাওয়া যায়, মূল বক্তব্য পাওয়া যায় না। তবে বুঝতে কষ্ট নেই যে, তারা বিদ্রোহী ছিলেন। রাজবিদ্রোহী নয় হয়তো, কিন্তু সমাজবিদ্রোহী অবশ্যই। এবং বিদ্রোহে যে প্রবলতা থাকে সেটা সম্ভবত ছিল তাদের মধ্যেও, অথবা হতে পারে যে, তাদের কথাকে অতিশয়োক্তির সাহায্যে উপস্থাপিত করা হয়েছে, ব্রাহ্মণরাই করেছেন, চাৰ্বাকদেরকে যুক্তিহীন বলে চিহ্নিত করার অভিপ্রায়ে ।
এই লোকায়তিকদের অপরাধটা তো সামান্য নয়। এরা বেদ মানে না, এবং শুধু যে নামেনে ক্ষান্ত হয় তা নয়, বলে যে বেদ মিথ্যা, স্ববিরোধী ও অতিরঞ্জিত। আরো বড় মুশকিল এই যে, এদের কথা সাধারণ লোকে বিশ্বাস করবে। কেননা কথাগুলো সরল। ব্রাহ্মণরা যে ভণ্ড ও প্রতারক, তারা যে স্মৃতি ও শ্রুতির ব্যবসা করে এটা তো প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না, লোকে স্বচক্ষে দেখে। তাছাড়া সাধারণ লোক হিংসুটে, তারা ব্রাহ্মণদের সুখ সহ্য করতে পারে না। চার্বাকরা তাই অত্যন্ত বিপজ্জনক বৈকি। তারা ব্যক্তি নয়, গোটা ব্যবস্থার সঙ্গে শক্রতায় লিপ্ত । তাই ব্যবস্থাটা একত্ৰযোগে তাদেরকে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছে।
‘মহাভারতের শান্তি পর্বে চাবাক নামে এক রাক্ষসের উল্লেখ রয়েছে। লোকায়তের উল্লেখ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যাবে। পৌরাণিক উপাখ্যানে বলা হয়েছে, অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে দেবতারা সুবিধা করতে পারছে না দেখে দেবগুরু বৃহস্পতি এক বুদ্ধি বের করেছিলেন। তিনি ছদ্মবেশে অসুরদের সঙ্গে মিলে গেছেন এবং তাদেরকে চাবাক দর্শন অর্থাৎ ফুর্তি করার মতবাদ শিখিয়েছেন। এতে চমৎকার ফল পাওয়া গেছে। অসুররা শক্তি হারিয়েছে এবং দেবতারা জয়ী হয়েছে। মনে হচ্ছে এখানে দেবতা বলতে ব্রাহ্মণকে বুঝতে হবে, অসুর বলতে বুঝতে হবে শূদ্ৰকে ।
রামায়ণে রাম ভ্রাতা ভরতকে রাজকাৰ্য পরিচালনা বিষয়ে নানাবিধ মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। একটা পরামর্শ ছিল এই যে, ভরত যেন লোকায়ত ব্ৰাহ্মণদের সেবা না করেন। কেননা, ব্রাহ্মণ হলেও তারা মূর্খ তারা অনর্থক তর্ক করে, অভিমান করে পাণ্ডিত্যের, কিন্তু আসলে তারা বালকের মতো মূখ। লোকায়তিকরা ধর্মশাস্ত্র অবজ্ঞা করে, আর অর্থহীন বচসায় লিপ্ত হয়। রাম আদর্শ পুরুষ, তিনি ভদ্র ভাষায় কথা বলেন, কিন্তু যা বলছেন তা অত্যন্ত দৃঢ়। চাবাঁকরা মূখ, তারা বচসাপ্রিয় এবং নাস্তিক। নাস্তিক অর্থ হচ্ছে অবিশ্বাসী, চাৰ্বাকরা বেদ-ব্ৰাহ্মণে বিশ্বাস করে না । তাদের ওই নাস্তিকতার অর্থ দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। যেবিদ্রোহ কোনোমতেই সমর্থনীয় নয়, প্রশ্ৰয় দেবার তো প্রশ্নই ওঠে না।
এসব গেলো নেতিবাচক বিরোধিতা। ইহজাগতিকতার বিরুদ্ধে বিকল্প দাড় করিয়েও বিরোধিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই বিকল্প হচ্ছে মায়াবাদ | শঙ্করাচার্য যা অত্যন্ত বেগবান উপায়ে প্রচার করেছেন।
ইহজাগতিকতার সঙ্গেশক্রতা তাই নতুন নয়। এই শক্রতা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুবিধাভোগী মানুষেরা করেছে। ব্যক্তিও করেছে। দুটি কারণে। একটি হচ্ছে মতাদর্শিক পরিমণ্ডলের আধিপত্য। অন্যটি হচ্ছে ব্যক্তিগত ভয়। ইহকালে তো সুখ নেই, পরকালেও যদি তা না পাওয়া যায় তবে উপায় কি? ব্যক্তি তাই পরলোকে সুখ ও সুবিচার প্রাপ্তির আশাটাকে জোরেশোরে আঁকড়ে ধরেছে। ব্যক্তি একটি বিশ্বাসের জগৎ নিজের জন্য তৈরি করে নেয়, সেটা ভেঙ্গে পড়লে খুবই বিপদে পড়ে।
চীনের কনফুসিয়াসও প্রাচীন বিশ্বের দার্শনিক। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মানুষ তিনি। চীনের লোকেরা কথা বলে কম, কনফুসিয়াস বলতেন আরো কম। খুব সংযতভাব ছিল তাঁর। যা বলবার শিষ্যদেরকে বলে গেছেন এবং বলেছেন অল্প কথায়। সাজানো কথা এবং মনোভোলানো ব্যবহার যাদের অভ্যাস তারা সদগুণসম্পন্ন নয় বলেই তার সন্দেহ। যেজন্য তার বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
মানুষের অহমিকাকে যে তিনি খুব উচ্চমূল্য দিতেন তা নয়। একদা ঝর্ণাতলায় দাড়িয়ে বলেছিলেন, সবকিছুই ওই ঝর্ণার মতো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু শব্দমুখর। তবু মানতেই হবে যে, কনফুসিয়াসের সমস্ত চিন্তা ছিল ইহজগৎ নিয়ে, পরজগৎ সম্পর্কে তার উদাসীনতা ছিল খুবই স্পষ্ট। তাকে নাস্তিক বললে অন্যায় হবে না। কোনো সংগঠিত ধর্মমত প্রচার করেননি, তেমন কিছুতে বিশ্বাসও করতেন না। বৌদ্ধদের সঙ্গে তার মিল রয়েছে; কিন্তু দূরত্বটাও সামান্য নয়। জীবন সম্পর্কে বৌদ্ধদের মধ্যে যে-রকম বৈরাগ্য ছিল, কনফুসিয়াসের তা ছিল না। তিনি সম্পূর্ণরূপে জীবনবাদী। নির্বাণ চান না, জীবনকে সুন্দর করতে চান। বস্তুত সুন্দর জীবনই তার লক্ষ্য। কিন্তু আবার স্থলভাবে ভোগবাদী নন। সর্বক্ষেত্রে তিনি সংযমের সমর্থক। শিষ্যদেরকে বলেছেন কথা বলবে বুঝে-শুনে। যা দেখার নয় তা দেখবে না, যা শোনার নয় তা শুনবে না, যা করার নয় তা করবে না। একবারেই অপচয়বিমুখ ।
কনফুসিয়াসের উপদেশাবলী ইহজাগতিকতায় ভরপুর। একবার তিনি মরণাপন্ন হয়েছিলেন। সঙ্গীরা জিজ্ঞেস করেছিল তিনি প্রার্থনা করছেন কিনা। অত্যন্ত সংক্ষেপে কনফুসিয়াস বলেছেন, আমি তো দীর্ঘদিন ধরেই প্রার্থনা করছি। বলতে চাইছেন যে, সৎ জীবন-যাপনই হচ্ছে প্রার্থনা, এর বাইরে কোনো আনুষ্ঠানিকতা অনাবশ্যক। তার জন্যে পুরোহিত নেই, ধর্মগ্রন্থ নেই। মন্ত্র অনাবশ্যক। জীবনযাপনকেই নৈতিকভাবে উন্নত করা চাই, সেটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা ! জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পরকাল সম্পর্কে তার বক্তব্য কি? জবাবে বলেছেন, জীবিতদের প্রতি তোমার কর্তব্য কি শেষ করেছে যে মৃতদের প্রতি কর্তব্যের কথা ভাবছো? বলেছেন, আগে জীবনকে বুঝতে হবে, তবেই না মৃত্যুকে বোঝাবার ব্যাপারে চিন্তা করা যাবে।
রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ব্যক্তিকে দেখেননি, বরঞ্চ ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকেই রাষ্ট্রকে দেখতে চেয়েছেন। আত্মজ্ঞানের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি নিজেকে সমৃদ্ধ করবে। সমৃদ্ধ করা অর্থ হচ্ছে নৈতিকভাবে উন্নত করা। নৈতিক উৎকর্ষ হচ্ছে পথ প্রদর্শক, ধ্রুব তারার মতো। ব্যক্তি অনুগত থাকবে পিতামাতার প্রতি, পূর্বপুরুষের স্মৃতির প্রতিও তার ভেতর থাকবে অন্যের প্রতি সহানুভূতি।
অসুবিধাটা কিন্তু ব্যক্তির ওপর এই অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেই। এইখানেই তিনি অত্যন্ত ইহজাগতিক হয়েও মতাদর্শিকভাবে ইহজাগতিকতা-বিরোধী ! কেননা, তিনি স্থিতাবস্থার সমর্থক। আর স্থিতাবস্থা হচ্ছে চরিত্রগতভাবে ইহজাগতিকতা-বিরোধী। তিনি পরিবারকে পবিত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেন, এবং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র মিলে নৈতিকতার ভিত্তিতে মর্ত্যে একটি স্বর্গ রচনা করবে এরকম আশা করেন । এই যে প্রতিষ্ঠানকে পবিত্রতা দিচ্ছেন এটা প্রগতিবিরোধী। আর প্রগতি না-থাকলে ইহজাগতিকতা থাকে না, পাহাড়ি ঝর্ণা তখন পরিণত হয় স্থবির ডোবাতে। একটা নতুন ধর্মমত তৈরি হয়ে যায়। ইহজাগতিক ধর্মমত। এখানে কোনো বিদ্রোহ থাকবে না। বিরাজ করবে সন্তুষ্টি এবং সংহতি।
আদর্শ রাষ্ট্রের কথা কনফুসিয়াস বিস্তৃত করে বলেননি। কিন্তু শাসক যিনি তার কি কি গুণ থাকা আবশ্যক সেটা বলেছেন। রাজা ভয় দেখিয়ে শাসন করবেন না, শাসন করবেন নৈতিক উৎকর্ষ দেখিয়ে। ভয় এক সময়ে কেটে যায়, কিন্তু শ্রদ্ধা কাটে না। প্রজারা রাজাকে শ্রদ্ধা করবে, কেননা তারা রাজার মাহাত্ম্য দেখবে, জোর জবরদস্তি না-দেখে । রাজা হবেন শিষ্টাচারী ও বিনয়ী। তিনি তার প্রজাদেরকে ভালোবাসবেন, তাদের জন্য কর্মসংস্থান করবেন। কিন্তু রাজা যদি অত্যাচারী হন তাহলে?
রাজারা যে অত্যাচারী হয়ে থাকেন সে-খবর তো কনফুসিয়াসের নিজের বক্তব্যের মধ্যেই পাওয়া যায়। একবার এক পাহাড়ের নির্জন প্রান্তে এক মহিলাকে ক্ৰন্দন করতে দেখেছেন তিনি। তার দুঃখটা কিসের? দুঃখ এই যে, আগে যে জনপদে তিনি ছিলেন সেখানে উৎপাত ছিল বাঘের । বাঘ তার শ্বশুরকে খেয়েছে, স্বামীকে খেয়েছে, খেয়েছে পুত্রকে । কিন্ত তিনি জনপদ ছেড়ে এই ভয়ঙ্করভাবে নির্জন পার্বত্য এলাকায় এলেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবে মহিলা বলেছেন, এখানে কোনো নিষ্ঠুর শাসক নেই। কনফুসিয়াস বলেছেন, হ্যা, কথাটা ঠিক, নিষ্ঠুর শাসক বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর ।
তাহলে? ওই বাঘকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কি করে? এই প্রশ্নের জবাব কনফুসিয়াস দিচ্ছেন না। রাজা নিজেই সংশোধন করবেন । কিন্তু করবেন কি? করবেন যে না সেটা তো স্বতঃসিদ্ধ । যারা নিজেদেরকে সংশোধন করেন তারা ব্যতিক্রম। রাজাদের ক্ষমতা থাকে অপরিসীম, এবং সেই ক্ষমতা তাদেরকে পরিচালিত করে অত্যাচারী হওয়ার দিকে । তারা হিংস্র হয়ে পড়ে। কনফুসিয়াস যে চরিত্রের ওপর সব দায়িত্ব অর্পণ করেছেন সেই কাজটা ভাববাদী, ইহজাগতিক নয়। ইহজগৎ রাজাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপের কথা বলে, চারিত্রিক পদক্ষেপ বাদ দিয়ে।
কনফুসিয়াসের সব বক্তব্যই ব্যক্তির উদ্দেশে । সে-ব্যক্তি রাজা হোক কি সাধারণ মানুষ হোক।
সদ্গুণকে বিকশিত করা চাই এবং সম্মান অর্জনই শ্রেয়। সম্মানিত ব্যক্তি নিজের চরিত্রের কথা ভাবে, নিম্নস্তরের ব্যক্তি ভাবে তার পদের কথা। সম্মানিত ব্যক্তি সুবিচার চায়, নিম্নস্তরের ব্যক্তি চায় করুণা। পদের জন্য লালায়িত হওয়াটা ভুল, পদের যোগ্য হওয়া চাই। এদিকে ঝুঁকবে না ওদিকেও ঝুঁকবে না, সদা সৎপথে চলবে । নীতিবানদের সঙ্গে চলবে, নীতিহীনদের থেকে দূরে থাকবে। সৎ পথ চেনে অথচ সেই পথে চলে না যে-ব্যক্তি সে একজন কাপুরুষ। তাকেই করতে গিয়ে অন্যকে বিকশিত করে। এসব বক্তব্যে গভীর দার্শনিকতা রয়েছে, ইহজাগতিকতাও; কিন্তু এসবে দ্বন্দ্বের কথাটা নেই। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে, তাদের মধ্যে থেকেই ব্যক্তি বিকশিত হবে, অবনত অবস্থাতেই উন্নতি করবে, এই বক্তব্য প্রকৃত ইহজাগতিকের নয়, ধর্মবাদীর বটে। ইহজাগতিকতাও যে ইহজাগতিকতার সঙ্গে শক্রতা করতে পারে কনফুসিয়াসের মতবাদ তারই নিদর্শন বটে !
তার মতবাদ অত্যন্ত প্রভাবশালী । বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত চীনে কুনফুসিয়াস খুবই সম্মানিত ছিলেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে চীনে কনফুসিয়াসের সামন্তবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। সামন্তবাদের যুগে সামন্তবাদী মনোভাব অসঙ্গত নয়, কিন্তু ওই মনোভাব যখন দার্শনিক প্রত্যয় হয়ে দাড়ায় এবং সকল যুগের জন্য প্রযুক্ত হতে চায় তখন বিপদ বাধে। চীন দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা নিশ্চিত রূপেই ছিল ইহজাগতিক, সেই ব্যবস্থা এখন আর শক্তিশালী নেই, দেখা যাচ্ছে এই দুর্বলতার অবকাশে কনফুসীয় মতবাদ আবার প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। মৌলবাদের অভু্যুথানে-উদ্বিগ্ন ইউরোপ-আমেরিকার বিদ্বানমহল লক্ষ্য করেছেন যে, চীনে নানা ধরনের জীবনবিরোধী ধর্মমতের সঙ্গে কনফুসিয়াসের মতও জায়গা করে নিচ্ছে। কেবল চীনে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও !
কনফুসিয়াসের বক্তব্যগুলোর মধ্যে একটি ছিল এই যে, উচ্চতর বিষয়ে আলোচনা নিম্নস্ত রের লোকদের সঙ্গে করা ঠিক নয়। তারা ওসব বুঝবে না। যারা গড়পড়তা নয়, ওপরে, তারাই কেবল দার্শনিক আলোচনার যোগ্য। সাধারণ মানুষের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গিটা তাৎপর্যহীন নয়। এটি প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণদেরও ছিল ।
8.
গ্রীক দার্শনিকেরা শ্রেণী-আধিপত্যের বিপক্ষে ছিলেন না। তাদের দেশে দার্শনিকেরা দর্শন নিয়ে ভাববার সময় ও সুযোগ পেতেন দাস শ্রম থাকার কারণে দাস-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দর্শন চর্চাও বিপদগ্রস্ত হয়েছে। সেকালে তত্ত্বজ্ঞান বিত্তবানদের একচেটিয়া অধিকারের মধ্যে ছিল।
ইউরোপের মধ্যযুগেও জ্ঞান সাধারণ মানুষ পায়নি। এবং সব জ্ঞান বাইবেলে আছে এই মত কর্তৃত্ব করেছে। রেনেসাসের কালে বড় বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে; তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে ঈশ্বরবাদিতার জায়গাতে মানববাদিতার প্রতিষ্ঠা। ব্যক্তি মাত্রেই গুরুত্বপূর্ণ এই বোধটা তখন তৈরি হয়েছিল; এবং জ্ঞানে সাধারণ মানুষের অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছিল, বিশেষভাবে দেশে দেশে মাতৃভাষার চর্চার ভেতর দিয়ে। বাইবেলও স্থানীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এসব ছিল ইহজাগতিকতার নতুন সম্পপ্রসারণ। চিত্রকলার ক্ষেত্রে মানুষ চলে এসেছিল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ।
কিন্তু একটা সীমা ছিল। ধর্ম যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে তা নয়, তার তৎপরতা ছিল । আর ছিল শ্রেণী। ইহজাগতিকতা যেমন ধর্মের বিভাজন মানতে চায় না, তেমনি শ্রেণীবিভাজনও তার পছন্দ নয়, কেননা মানুষকে পাপ-পুণ্যের বিচারে যেমন বিভক্ত করতে সে অসম্মত, তেমনি অনুৎসাহী সে মানুষকে ধন সম্পত্তির নিরিখে চিহ্নিত করতে, যদিও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে ইহজাগতিকতার যে অনীহা রয়েছে এমন বলা যাবে না। শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে কাজ করে তা ধর্মসংস্কারক মার্টিন লুথারের কাজের মধ্যে প্রমাণিত। লুথার ল্যাটিন বাইবেলের জার্মান অনুবাদ করে একটি বৈপ্লবিক কর্ম সম্পাদন করেছিলেন, তার ওই ভাষা ধ্রুপদী জার্মান ভাষাও ছিল না, ছিল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, কিন্তু তিনিই আবার জার্মানিতে কৃষক বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন। স্ববিরোধিতা নয়; এ হচ্ছে দুই বিপরীত উপাদানের সহ-অবস্থান।
রেনেসান্সের অতিউজ্জ্বল মানবতাবাদের মধ্যে সবটাই যে উচ্চ নৈতিকতা গুণসম্পন্ন ছিল তাও কিন্তু নয়। বাস্তববাদী নিকোলো মেকিয়াভেলি রাজার পক্ষে ছিলেন, জনগণের পক্ষে নয়। রাজাকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন একাধারে সিংহের মতো সাহসী এবং শৃগালের মতো ধূর্ত হবার। দুটির একটি হলে চলবে না, দুটোই হওয়া চাই, এবং একটি অপরটিকে যে নাকচ করে দিচ্ছে তা নয়; দুটোই কাজে লাগবে, দুই বাহুর মতো, যখন যেমন তখন তেমন। মেকিয়াভেলি কনফুসিয়াসের তুলনায় অনেক বেশী ভাষণপ্রিয়, এবং প্রায় আগ্রাসীরূপে ইহজাগতিক। কিন্তু তিনি আবার ইহজাগতিকতার সঙ্গে শক্রতাই করেন যখন রাজার পক্ষে দাড়ান, বিরোধী হন জনস্বার্থের। রাজস্বার্থ রক্ষার প্রণোদনায় মেকিয়াভেলি ধর্মকেও ব্যবহার করতে কুষ্ঠিত নন। তিনি বলছেন যে, ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো ভ্রান্ত হতে পারে, এবং প্রায়শই যে ভ্রান্ত হয় এটাও ঠিক, তবু রাজার কর্তব্য হবে সেগুলোকে প্রশ্ৰয় দেয়া এবং রক্ষা করা । কেননা জনগণ ওগুলোতে আস্থা রাখে । রাজার পক্ষে রাষ্ট্রধর্মের প্রতিপালক হওয়া খুবই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। রাজনীতির স্বার্থে মেকিয়াভেলি জেনে-শুনে বিজ্ঞান তথা ইহজাগতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বলবার অপেক্ষা রাখে না তবু স্মরণ করা যায় যে, সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ওই ধরনের নিষ্ঠুর রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ শাসক শ্রেণী এখনো করে যাচ্ছে। আমাদের স্বৈরশাসক হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ ব্যক্তিগত ধর্মকর্মের জন্য মোটেই বিখ্যাত নন, কিন্তু তিনি যে বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন তা ক্ষতির আকর ।
প্রথমে কোপারনিকাস এবং পরে গ্যালিলিও সৌরজগৎ সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দিয়েছেন, এবং বিশেষভাবে বিপদে ফেলেছেন ধর্মাশ্রয়ী পুরোহিতদের। বাইবেল বলছে, পৃথিবীই রয়েছে কেন্দ্রে, সূর্য তার চারদিকে অবিশ্রাম ঘুরছে; অথচ ওই জ্যোতির্বিদরা প্রচার করছেন সম্পূর্ণ উল্টো তত্ত্ব, যাতে লোকের ধর্মবিশ্বাস আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। কোপারনিকাসের তেমন বিপদ হয়নি, কিন্তু গ্যালিলিওর প্রাণসংশয় দেখা দিয়েছিল। দুই কারণে। প্রথমত, গ্যালিলিও কেবল যে বাইবেলীয় ধারণাকে বিপদগ্ৰস্ত করেছিলেন তা নয়, তার লেখা এমনই বিস্তৃত, প্রামাণ্য ও যুক্তিবুদ্ধিভিত্তিক যে কার্যত তিনি প্রকৃতিবিদ্যা থেকে সবরকমের আধ্যাত্মিকতাকেই নির্বাসনে পাঠাবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। প্রকৃতি হয়ে দাড়াচ্ছিল একটা ঘড়ির মতো, যেটা কারো ইচ্ছায় চলে না, চালু থাকে আপনার বৈজ্ঞানিকতায় । ধর্মবিদ্যাকে তিনি অমান্য করেন না, এ কথা তিনি জোর দিয়েই বলেছেন যে, ধর্মবিদ্যা অনেক উচু স্তরের ব্যাপার, অন্যসব বিজ্ঞানের তুলনায় অধিক সম্মান তার প্রাপ্য; কিন্তু ধর্মবিদ্যার এলাকা আর বিজ্ঞানের এলাকা এক নয়, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ধর্মবিদ্যার ক্ষেত্র হচ্ছে অতিপ্রাকৃতিক জগৎ এবং তার ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। প্রকৃতিবিদ্যা নিম্নস্তরের, সেখানে অতিপ্রাকৃতিক নেই, বিশ্বাসও নেই, রয়েছে যুক্তি ও প্রমাণ। এই যে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে পৃথক করা, এখানেই রয়েছে ইহজাগতিকতার একটি প্রধান সূত্র। সেই সঙ্গে এও বলেছেন তিনি যে, ধর্মবিদ্যার এখতিয়ার বিজ্ঞান তখন চলে যাবে এমন সব লোকদের দখলে বিজ্ঞান বিষয়ে যারা অজ্ঞ । দ্বিতীয় ব্যাপার এই যে, গ্যালিলিও ল্যাটিন ভাষায় লেখেননি, তার তত্ত্বকে তিনি উপস্থিত করতে চেয়েছেন জনবোধ্য ইটালিয়ান ভাষাতে; যা তার মাতৃভাষাও বটে। এতে বিপদ বেড়েছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, জনসাধারণ জেনে ফেলবে ধর্মব্যবসায়ীরা এতোদিন যা তাদেরকে শিখিয়ে এসেছে তার অন্তত একাংশ ভ্রান্ত, আর তাই যদি হয়, একাংশ যদি ভ্রান্ত বলে প্রমাণিতই হয় তাহলে অন্যান্য অংশ যে অভ্রান্ত তাই বা বলা যাবে কোন ভরসায়? ব্যবসা যাবে, অরাজকতা দেখা দেবে, কেউ মানবে না। ধর্মীয় বিচারালয় তাই গ্রেপ্তার করেছে গ্যালিলিওকে, তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত বাধ্য করেছে এই ঘোষণা দিতে যে, তার ধারণা ভুল এবং তাই তিনি স্বেচ্ছায় তার তত্ত্ব প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। সাময়িকভাবে যদিও, তবু ইহজাগতিকতা নত হয়েছে ধর্ম ব্যবসায়ের কাছে।
ব্রুনো কিন্তু অতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না। তিনি ধর্মীয় আদালতের হাতে ধরা পড়েছেন এবং তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ব্রুনো মোটেই নাস্তিক ছিলেন না, তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ধর্মযাজক হিসেবেই। কিন্তু সেখানে থাকতে পারেননি, ঘুরে ঘুরে জ্ঞান সংগ্রহ করেছেন এবং তা প্রচার করেছেন। এই যে প্রচার করাটা, ধর্ম ব্যবসায়ীদের এটা পছন্দ হবার কথা নয়, এবং এটা তারা পছন্দ করেওনি। পিছনে লেগেছে। ব্রুনোর বক্তব্য যাজকদের কাছে বিপজ্জনক মনে হবে এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কেননা তিনি বলছিলেন যে, জগৎ একটা নয়, অনেক, শত শত, অসংখ্য। ঈশ্বর হচ্ছেন অনন্ত, কাজেই তার সৃষ্টিও হবে অসীম। বাইবেলে তাহলে এ তথ্যও কেন নেই, এই প্রশ্নের জবাবে ব্রুনো বলছেন, ঈশ্বর সবই জানেন, কিন্তু স্বভাবতই তেমন ভাষাতেই কথা বলেছেন যে-ভাষা মানুষ বুঝবে, বোঝার জন্য প্রস্তুত ব্ৰুনো আপেক্ষিকতার তত্ত্বও প্রচার করেছেন। তিনি বলেছেন যে, চূড়ান্ত সত্য বলে কিছু নেই, জগৎ সম্পর্কে প্রত্যেক ব্যক্তির ধারণা তার ব্যক্তিগত অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। এসব চিস্তাকে সহ্য করা প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতের পক্ষে সম্ভব ছিল না ব্রুনোকে তাই প্রাণ দিতে হয়েছে। দেবার চূড়ান্ত কারণ এই যে, তিনিও সক্রেটিসের মতোই অনমনীয় ছিলেন, আপোস করেননি। প্রাণদণ্ডাদেশ শুনে ব্রুনো তার বিচারকদেরকে বলেছিলেন, “আমার সন্দেহ যে তোমরা যারা এই আদেশ দিচ্ছ তারা অধিক ভীত আমার চেয়ে, যার ওপর এই আদেশ জারি করা হচ্ছে।” বিচারকরা যে ভয়ের দরুন ওই মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ভয়টা স্বার্থহানির ।
ইউরোপে দর্শনচর্চার ইতিহাসের অগ্রগতির স্তরগুলোতে দেখবো যে, বেকনের ইহজাগতিকতাকে পরবর্তীকালে হবস, লক এবং আরো পরে মার্কস এগিয়ে নিয়ে গেছেন । অপরদিকে ভাববাদিতা এগিয়েছে দেকার্ত কান্ট ও হেগেলের কাজের ভেতর দিয়ে । কিন্তু বস্তুবাদিতায় আস্থা রেখেও হবস মনে করতেন যে, রাষ্ট্রের স্বার্থে যদি প্রয়োজন হয় তবে রাজা তার সার্বভৌম ক্ষমতা বলে প্রচলিত কুসংস্কারগুলোকে একটি ধর্মমত হিসেবে দাড় করাতে পারেন, সে-অধিকার রাজার আছে। আর যে ভলতেয়ার তার যুক্তিবুদ্ধির জন্য ফরাসি বিপ্লবের স্থপতিদের একজন হিসেবে স্বীকৃত তিনিও বলেছেন যে, চাষীরা যাতে খাজনা দেয় এবং ওপরওয়ালাদের কথা শোনে সেজন্য তাদেরকে ঈশ্বরে বিশ্বাসী করে রাখার আবশ্যকতা রয়েছে। অপরদিকে হেগেল তো দর্শনকে পরম সত্তার দিকেই নিয়ে গেছেন, এবং প্রকারান্তরে একনায়কত্রে দার্শনিক যৌক্তিকতাও সরবরাহ করেছেন।
ইসলামী দর্শনের যারা চর্চা করেছেন তাদের মধ্যে মোতাজিলা সম্প্রদায় অনেকগুলো যুক্তিবুদ্ধিভিত্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এঁরা সবাই ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, যদিও কাউকে কাউকে ধর্মদ্রোহী বলে মনে করা হয়েছে, এবং মোতাজিলা নামকরণের মধ্যেও তাদের প্রতি অবিশ্বাসের চিহ্ন রয়েছে। মোতাজিলা শব্দের অর্থ যিনি বিচ্ছিন্ন হয়েছেন, বিচ্ছিন্ন হয়েছেন ধৰ্মচর্চার মূল স্রোত থেকে, এবং তারা ধর্ম বিষয়ে নিজেদের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
মোতাজিলা গ্ৰীক দর্শন মনোযোগের সঙ্গে পড়েছেন। এ্যারিস্টটল ছিলেন তাদের জন্য বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্র, প্লেটোকে তারা জানতেন, প্লেটোর সঙ্গে খ্রিষ্টান চিন্তার সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যে নব্য-প্লেটোনিক মতবাদ গড়ে উঠেছিল তার সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ ছিল। গ্ৰীক দর্শনকে নতুন ইউরোপে পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে তারা মাধ্যম হিসেবেও কাজ করেছেন। তাদের মনে অনেকগুলো প্রশ্ন জেগেছিল। একটা প্রশ্ন কোরানের অনাদিত্ব নিয়ে। কোরান আল্লাহর সৃষ্টি; তাই কোরান যদি অনাদি হয়, যদি তার আদি না-থাকে তাহলে সৃষ্টি ও স্রষ্টা তো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, একের জায়গায় দুইকে পাওয়া যাচ্ছে, একত্ববাদের জায়গায় দ্বৈতবাদ তৈরি হচ্ছে। তাই তারা বলতে চেয়েছেন যে, কোরান নিত্যকালের নয়, এটি একটি বিশেষ সৃষ্টি, এবং সৃষ্টি যেহেতু তাই তার ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন রয়েছে। আর ব্যাখ্যা করবার মতো যে যুক্তিবুদ্ধি আল্লাহই মানুষকে দিয়েছেন, মানুষের পক্ষে তা প্রয়োগ না-করা অন্যায়। একইভাবে জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারেও তাদের প্রশ্ন রয়েছে। আল্লাহ চাইলেন তাই জগৎ সৃষ্টি হলো, জগতে মানুষ এলো। কিন্তু আল্লাহ চাইলেন কেন, চাইবেন কেন? তিনি তো স্বয়ংসম্পূর্ণ, তার তো ইচ্ছা থাকার মতো অপূর্ণতা নেই। এই প্রসঙ্গে আল্লাহর বহুবিধ গুণ সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আল্লাহর কোনো একটি গুণকে আলাদা করে উল্লেখ করা মানেই তিনি যে সর্বগুণসম্পন্ন সেই সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া ! আবার যখন কোনো গুণের উল্লেখ করা হয় তখন ধরে নেওয়া হয় নাকি যে ওই গুণ তার মধ্যে না-থাকাও সম্ভব ছিল। যেমন যখন বলা হয় যে তিনি করুণাময়, তখন ওই বলার পেছনে এই মনোভাব কি প্রকারান্তরে থাকে না যে তার পক্ষে করুণাময় না হওয়াও সম্ভব ছিল? কেননা, সংজ্ঞা দিতে যাওয়া মানেই হচ্ছে নেতির সৃষ্টি করা, সীমাবদ্ধতা তৈরি করা, আলোর কথা আলাদা করে বলা অর্থ অন্ধকার বলে একটি বস্তু আছে এটা স্বীকার করে নেওয়া । আল্লাহ হচ্ছেন এক ও অভিন্ন, তাই তার বহুগুণ কল্পনা করা এক ধরনের পৌত্তলিকতা বলেই মোতাজিলারা মনে করতেন।
মোতাজিলাদের মূল আগ্রহটা ছিল বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তিবুদ্ধির সমন্বয় ঘটানো। যুক্তিবুদ্ধিকেই তারা জ্ঞানের মূল উৎস মনে করতেন, এবং তার সাহায্যে বিশ্বাসের যে জগৎ রয়েছে তাকে বিশ্লেষণ করে যুক্তিসিদ্ধ করে নিতে চেয়েছেন। ধর্ম ও জগৎকে আলাদা করবার যে ইহজাগতিকতা সেটা আরো পরে এসেছে, ইউরোপীয় রেনেসাসের সময়ে। মোতাজিলারা রেনেসাসকে সাহায্য করেছেন, কিন্তু তারা ওই মতাদর্শিক বিশ্বের অধিবাসী ছিলেন না। তাদের চেষ্টাটা বিচ্ছিন্নকরণের ছিল না, ছিল সমন্বয়ের। তারা দেখেছেন যে, এ্যারিস্টটল বলছেন জগৎ অনাদি, কেউ তাকে সৃষ্টি করেনি, সে আপনা আপনি তৈরি হয়েছে, অথচ কোরান বলছে যে, আল্লাহই সব কিছুর স্রষ্টা, জগতেরও । তাহলে? সমস্যাটির সমাধান কি? মোতাজিলারা একটি সমাধান বের করেছেন । সেটি এই যে, জগৎ অনাদি বটে আবার সৃষ্টও বটে। জগৎ অনাদিকাল থেকেই ছিল, কিন্তু ছিল মৃত অবস্থায়, আল্লাহ সেই মৃত জগতের গতির সঞ্চার করেছেন, যার ফলে সে প্রাণ পেয়েছে; অর্থাৎ সে সৃষ্টি হয়েছে। মোতাজিলারা বলতে চেয়েছেন যে, আল্লাহ মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, সেই স্বাধীনতার ফলেই সে কাজ করে, এবং কখনো কখনো নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে মানুষ তার কাজের জন্য দায়ী থাকে না; তাই আল্লাহ তাকে শাস্তিও দিতে পারেন না। শাস্তি দেওয়াটা হচ্ছে আল্লাহর পক্ষে অযৌক্তিক। মোতাজিলারা আল্লাহর দর্শন লাভ সম্ভব বলে মনে করেন না। কেননা আল্লাহ হচ্ছেন নিরাবয়ব, তিনি কোনো অবয়ব নিতে পারেন না ।
মোতাজিলাদের প্রশ্নাবলী ও বক্তব্য মূল ধারার লোকেরা মোটেই পছন্দ করেনি। সাধারণ লোকও করেনি, কেননা তারা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে, জিজ্ঞাসা করা বাদ দিয়ে। আব্বাসীয় করেছিলেন। তিনি আইন করে মোতাজিলা মতবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। সাধারণ মানুষ মোতাজিলাদেরকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। কিছুটা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের প্রচারের দরুণ, কিছুটা যুক্তি ও সংশয়ের চাইতে বিশ্বাসের ব্যাপারে তাদের স্বাভাবিক আগ্রহের কারণে। আসরাইত দার্শনিকরা ছিলেন প্রথাসমর্থক, তারাই শেষ পর্যন্ত জয়ী ও স্থায়ী হয়েছেন।
যুক্তিবুদ্ধির দ্বারা যারা পরিচালিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে সর্বগ্রগণ্য হচ্ছেন ইবনে সিনা। তিনি কেবল দার্শনিক নন, বিজ্ঞানীও ছিলেন। দর্শন ও বিজ্ঞানের একটি বিশ্বকোষ তিনি নিজের উদ্যোগে তৈরি করেছিলেন। তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে চিকিৎসাক্ষেত্রে। ইবনে সিনা রচিত কানুন নামের গ্রন্থটি ল্যাটিনে অনূদিত হয়েছিল এবং মধ্যযুগের ইউরোপে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রধান পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বিবেচিত হতো।
ইবনে সিনা বিশ্বাস ও যুক্তিবুদ্ধির মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেননি, কারণ তার ধারণা সমন্বয় সম্ভব নয়। দর্শনকে তিনি গুরুত্ব দিতেন, এবং মনে করতেন যে, দর্শন ধর্মের অধীনে বিকশিত হয়নি, তার বিকাশ ঘটেছে স্বাধীনভাবে | দর্শন জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল; জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে আসে, কিন্তু ওই জ্ঞান পরিপূর্ণ হয় যৌক্তিক বিবেচনার মধ্য দিয়ে। সাধারণ মানুষ শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনাই দেখে, বিভিন্ন ঘটনার ভেতর যোগসূত্র দেখতে পায় না; যোগসূত্র আবিষ্কার দর্শনের কাজ। ইবনে সিনা বস্তুর ব্যাপারে আল্লাহকে প্রাসঙ্গিক মনে করেননি, আল্লাহ সবকিছুর উর্ধ্বে, তিনি আধ্যাত্মিক, এবং বস্তু জগতের অনেক ওপরে। আল্লাহ হচ্ছেন একক, তার ওপর বহুত্ব আরোপ করা অন্যায়। আল্লাহ হচ্ছেন পরিপূর্ণ, তাই অশুভ সাধন তার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে আল্লাহর পরিকল্পনায় অশুভের স্থান আছে। কেননা জগৎ অনন্ত নয়, সে সীমাবদ্ধ বটে। অশুভের সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু মানুষের জন্য অশুভ প্রয়োজনীয়। কেননা মানুষ বাস করে একটি সীমাবদ্ধ জগতে। আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোচ্চ, তার এবং অন্যান্য নির্বস্তুক সত্তার পক্ষে তাই সর্বজনীনতার বাইরে যাওয়া ঘটে না, স্থানীয় ও নির্দিষ্ট ঘটনাগুলো ঘটে ভিন্ন স্তরে ।
ইবনে সিনার দার্শনিক অবস্থান প্রায় বৈপ্লবিক । তার অনেক বক্তব্য বিজ্ঞানীদের মতো। তিনি মনে করেন মানুষের জন্য আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দান বিশ্বাস নয়, যুক্তিবুদ্ধি। মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে তার নির্দিষ্ট মত ছিল। তিনি মনে করতেন, পুনরুজীবন ঘটবে দেহের নয়, আত্মার। দেহের পুনজীবন লাভ ঘটলে দেহের কোন রূপটিকে গ্রহণ করা হবে? দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যার মৃত্যু ঘটেছে তার ওই বিকৃত দেহের পুনরুজীবন কি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হতে পারে? একজনের কোন বয়সের দেহ পুনরায় জীবন লাভ করবে, যৌবনের নাকি বাধ্যক্যের? এসব প্রশ্ন তুলে ইবনে সিনা দৈহিক পুনরুজ্জীবনের তত্ত্বকে নাকচ করে দিয়েছেন। ধর্মমতে পুনরুজ্জীবনের উল্লেখকে তিনি আক্ষরিক অর্থে নেবার পক্ষপাতী নন; তার মতে আত্মার পুনরুজ্জীবনের কথাই বোঝানো হচ্ছে, সাধারণ মানুষের বুঝবার সুবিধার জন্য দৈহিকতার রূপক ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। এমনকি কোরানে যে বেহেশত ও দোজখের বর্ণনা আছে তাকেও তিনি রূপক অর্থে নেবারই পক্ষপাতী ।
ইবেন সিনা আপোস করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই চিকিৎসাশাস্ত্রে তার অবদানকে যারা উচ্চ মর্যাদা দিয়েছে এমনকি তারাও তাকে বিপথগামী বলতে ছাড়েনি। তিনি মূল ধারার অন্তর্গত হতে পারেননি।
সে-কালে মূল ধারার শক্তিশালী মুখপাত্র ছিলেন গাজ্জালী। যিনি ইবনে সিনার পরে এসেছেন এবং ইবনে সিনার দার্শনিকতাকে নাকচ করে দিয়েছেন । গাজ্জালী রক্ষণশীল আসরাইতদের একজন, তিনি মোতাজিলাদের মুক্ত চিন্তার বিরোধী। ইবনে সিনার যুক্তিবুদ্ধির জায়গায় তিনি ধর্মবিশ্বাসের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্ৰতী হয়েছিলেন। সে-ব্যাপারে তার যোগ্যতারও কোনো ঘাটতি ছিলো না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ও সম্মানিত। তদুপরি তার রচনা ছিল শক্তিশালী |
দর্শনে তিনি নানা ধরনের অসঙ্গতি দেখতে পেয়েছেন, এবং সেগুলোকে চিহ্নিত করেছেন। দর্শন থাকতে পারে, কিন্তু থাকবে সে ধর্মশাস্ত্রের অধীনে, ওপরে নয়, স্বাধীনভাবেও নয়। জগৎ কার্যকারণ সম্পর্ক দ্বারা পরিচালিত এই ধারণাটি ঠিক আছে, কার্যকারণকে সুষম ধারাবাহিকতাও বলা যাবে, কিন্তু চূড়ান্ত কার্যকারণ হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা, তার বাইরে কিছু নয়। আল্লাহ সবকিছু জানেন। ইবনে সিনা যে বলেছেন আল্লাহ সর্বজনীনকে শুধু জানেন, নির্দিষ্ট জানেন না তা নয়, আল্লাহ সব কিছুই জানেন ।
তিনি খুব জোর দিয়েই বলেছেন যে, নীতিশিক্ষাকে কার্যকর করার জন্য দোজখের ভয়কে ফেরত আনা চাই। ফেরত আনার কথাটা উঠেছে এই জন্য যে, মোতাজিলাদের দর্শনচর্চার দরুণ ওই ভয়টা পেছনে চলে যাচ্ছিল, অন্ততপক্ষে শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে। গাজ্জালী বললেন যে, জীবনযাপনে নৈতিক মূল্যবোধ প্রাধান্য পাবে না যদি না মানুষ শাস্তির ভয় পায়। তাই দোজখের যন্ত্রণাকে জনচিত্তে বাস্তবিক করে তোলা আবশ্যক ।
দর্শন নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা থাকার বিপক্ষে তিনি। কেননা, তাতে তারা বিপথগামী হতে পারে। আর নিম্নস্তর অতিক্রম করে যারা উচ্চস্তরে আরোহণ করতে চায় তাদের উচিত দর্শন চর্চার বিপক্ষে যে সব যুক্তি রয়েছে সেগুলো পাঠ করা। এবং সর্বোচ্চ স্তরে যখন কেউ পৌছবে তখন তার জন্য সম্ভব হবে যুক্তিবুদ্ধি নয়, বোধির সাহায্যে আনন্দলোকে পৌছে যাওয়া, যেখানে আল্লাহর দর্শন লাভ সম্ভব হবে, উজ্জ্বলতার মধ্য দিয়ে। এই স্তরে আত্মা ছায়া বা ছায়ার ছায়া নিয়ে ব্যস্ত থাকবে না, চূড়ান্ত বাস্তবতার সম্মুখে চলে আসবে। সেখানে শাস্তির ভয় কিংবা পুরস্কারের আশা আর কার্যকর রইবে না।
ধর্মীয় নেতা ও দার্শনিক গাজ্জালী সুফী সাধনাতেও বিশ্বাস করতেন। প্রত্যাদেশকে তিনি চূড়ান্ত বলে মানতেন, এবং সেখানে কি এবং কেন যে অনাবশ্যক তাও বলে গেছেন। মনগড়া সন্দেহ মানুষকে অধিবিদ্যার রাজ্যে নিয়ে যায়, যেখানে প্রবেশ করাটা বিপজ্জনক, কেননা তাতে করে জীবন্ত যে বাস্তবতা তার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ঘটবে। এটা তার বক্তব্য।
গাজ্জালীর পরে ইবনে রুশদ এসেছেন, ইসলামিক দর্শনের জগতে। তার অবদানও অনেক বড়। তিনি গাজ্জালীর পক্ষে ছিলেন না, বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। গাজ্জালী একটি বই লিখেছিলেন দর্শনকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে, ইবেন রুশদ বই লিখলেন ওই ধ্বংস-প্রক্রিয়াকে বিধ্বস্ত করবার ইচ্ছা থেকে। তিনি বিজ্ঞানে আস্থা রাখেন এবং যুক্তিবুদ্ধির সাহায্যে রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নতি সম্ভব বলে মানেন। ধর্মের নৈতিক দিকটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ধর্মের বিধিগুলো হচ্ছে আইনের মতো, তাদেরকে মান্য করা জরুরী, তবে প্রকৃত নৈতিকতা অর্জনের পথটা ভিন্ন, সেটি হচ্ছে যুক্তিবুদ্ধির অনুশীলন।
ইবনে রুশদ জনপ্রিয় হননি। সাধারণ মানুষ তার বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। তবে এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে, তার মধ্যে ব্রাহ্মণ্যমনস্কতা ছিল; তিনি গাজ্জালীপন্থী নন ঠিকই, কিন্তু গাজ্জালীর মতো তিনিও বলেছেন দর্শন নিয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তা করা উচিৎ নয়। মানুষকে তিনি তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। সর্বোচ্চ স্তরে থাকবে দার্শনিকেরা, দ্বিতীয় স্তরে সেই সব যুক্তিবুদ্ধির মানুষেরা অনুশীলনের মাধ্যমে যারা বিশ্বাসের জগৎ থেকে দার্শনিকতার জগতে নিজদেরকে উত্তীর্ণ করাতে পারবেন; আর তৃতীয় স্তরে সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের ওপর ইবনে রুশদের আস্থা ছিল না। এদেরকে তিনি মনে করতেন আবেগতাড়িত ও যুক্তিবুদ্ধিহীন। ধর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যা এই সাধারণ মানুষকে জানানো অনাবশ্যক নয় শুধু, ক্ষতিকরও বটে। তাদের জন্যই ক্ষতিকর, কেননা এর দ্বারা তারা শুধু শুধু বিচলিত হবে।
তাহলে আমরা কোন সিদ্ধান্তে পৌছাবো। সেটা বোধ হয় এই যে, ইগজাগতিকতা কখনোই নিরাপদ ছিল না। তার প্রধান কারণ ভয় । ভয় ছিল শ্রেণীর, গোষ্ঠীর, সম্প্রদায়ের, এমনকি জাতিরও স্বার্থহানির ভয় । ব্যক্তিও ভয় পায় । তারও স্বার্থ থাকে। ব্যক্তি ইহজাগতিক হতে কুষ্ঠিত হয় একটি বিশেষ কারণে। সেটি ওই ভয়ই। পরকালের ভয়।
ইহজাগতিকতার শক্র অনেক। প্রত্যক্ষে রয়েছে,রয়েছে পরোক্ষে। যে-দার্শনিকতা স্থিতাবস্থার সমর্থন করে সে এমনকি ইহজাগতিক হলেও ইহজাগতিকতার সঙ্গে পরোক্ষ শক্রতাতেই লিপ্ত হয়। এর প্রথম কারণ মানুষ যখন দেখে তার সামনে কোনো পথ খোলা নেই, তখন সে পেছন দিকে মুখ ফেরায়। কেউ হয় পুনরুজীবনবাদী, কেউ হয় মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তির নানা রূপ রয়েছে। একটি হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা ! মানুষ স্বভাবতই অস্থির, সম্মুখযাত্রার উপায় না থাকলে সে পশ্চাদগামী হতে বাধ্য। দ্বিতীয় ঘটনা যা ঘটে তা হলো হতাশা। স্থবিরতা হতাশার জন্ম দেয় । মানুষ তখন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে অলৌকিকে আস্থা রাখে।
পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ উভয়েই ইহজাগতিক। কিন্তু তারা আবার ইহজাগতিকতার সঙ্গে শক্ৰতাও করে। শক্রতার একটি রূপ হচ্ছে দারিদ্র্য সৃষ্টি, দ্রারিদ্র্য সৃষ্টি হয় শোষণ ও বৈষম্যের কারণে। আর দারিদ্র্য মানুষকে ধর্মমুখী করে তোলে, আশ্রয়, বিচার ও সান্তুনার প্রয়োজনে; ইহজগতে যা তারা পায় না। দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা সরাসরি ধর্মের পক্ষে বলতে থাকে, যদিও তাদের নিজেদের জীবনে প্রকৃত ধর্মচর্চার লক্ষণ বলতে গেলে দেখাই যায় না।
সাম্রাজ্যবাদীরা কিভাবে ভাববাদিতাকে উৎসাহিত করে তার বাস্তব দৃষ্টান্ত মার্কিন আধিপত্যকে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তৎপর দুই ধুরন্ধরের বক্তব্য থেকে পাওয়া যায়। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে এদের একজন-জন ফস্টার ডালেস—বলেছিলেন যে, প্রাচ্যদেশের ধর্মবিশ্বাস কখনোই সাম্যবাদী বস্তুবাদ ও নিরীশ্বরবাদকে মেনে নেবে না; তাই চেষ্টা করতে হবে কমিউনিজমবিরোধী মতাদর্শের সঙ্গে প্রাচ্যদেশীয় ধর্মবিশ্বাসে একটি ঐক্য স্থাপনের। অপরজন-চেস্টার বাওলসপরামর্শ দিয়েছেন গান্ধীবাদের সঙ্গে তাদের মতাদর্শকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে । কেননা তার মতে সামরিক বা অর্থনৈতিক সাহায্য নয়, বরঞ্চ গান্ধীবাদী ধারায় কাজ করাটাই হবে প্রাচ্যের জনগণকে সাম্যবাদ-বিরোধী করার প্রকৃষ্ট পন্থা। (উদ্ধৃত, সতীনাথ চক্রবর্তী, ভাবাদর্শগত সংগ্রাম ও প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের উত্তরাধিকার, কলকাতা, ১৯৯২)।
রাষ্ট্র ও সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা ইহজাগতিকতা প্রতিষ্ঠা করা যে কত কঠিন, বাংলাদেশকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিলে সেটা বুঝতে সুবিধা হবে। বাংলাদেশের অভু্যদয় ঘটেছে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। নতুন রাষ্ট্রের হবার কথা ছিল পরিপূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইহজাগতিক | সংবিধান যখন রচিত হয় তখন ওই অঙ্গীকারই ব্যক্ত করা হয়েছিল । চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মধ্যে ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে খুব স্বাভাবিক ছিল এই অঙ্গীকার। কিন্তু এর জন্য যে সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি প্রয়োজন দেশে তা ছিল না। রাজনৈতিক প্রস্তুতিও ছিল না । ১৯৭০-এর নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে আওয়ামীলীগ প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছিল কোরান ও সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন পাস করা হবে না। বলেছিল যে, সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা’ রক্ষা করা হবে, এবং সর্বস্তরের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে ১৯৫৪-এর নির্বাচনের সময়ে আওয়ামী লীগ ছিল মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্টের প্রধান শক্তি, তার নাম তখন আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং যে যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগ যোগ দিয়েছিল তাতে নেজামে ইসলামের মতো ধর্মীয় দলও ছিল; তখন একুশ দফা নামে যে ঘোষণাপত্রটি প্রচার করা হয়েছিল তার প্রস্তাবনাতেই বলা হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট কোরান ও সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করবে না।
একাত্তরের যুদ্ধে প্রস্তুতিবিহীন অবস্থাতেই বাঙালিদেরকে যেতে হয়েছে। যুদ্ধের পর যখন সংবিধান তৈরি হলো (১৯৭২ সালে) তখন রাষ্ট্রীয় মূলনীতি চারটির কী তাৎপর্য তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে যে স্পষ্ট ছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র, এদের প্রতিটির জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল প্রধান শর্ত। কিন্তু তালিকায় সে এসেছে সবার শেষে জিয়াউর রহমানের বিপ্লবের পরে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নিশ্চিহ্নই করে দেওয়া হয়েছে; এবং সেই সঙ্গে, সমান বেগে, প্রথম মূলনীতি হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসীকে।
পরিবর্তনটা পরের ঘটনা । তার আগেও কি ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের? সংবিধান বলছে, ছিল না। সংবিধানে উল্লেখ আছে, (অনুচ্ছেদ ১২) যে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য, (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে । কিন্তু বলা হয়নি যে, ধর্মনিরপেক্ষতা জিনিসটা কি বলা দরকার ছিল যে, ধর্ম থাকবে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, সেখানে রাষ্ট্রের কোনো হস্তক্ষেপ যেমন ঘটবে না, তেমনি রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকবে না, রাষ্ট্র হবে ধর্মহীন। রাষ্ট্রের, ধর্মহীনতার এই ব্যাপারটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতার উপরে-উদ্ধৃত সাংবিধানিক সংজ্ঞায় উল্লেখ করা হয়েছে, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার বিলোপ করা হবে বললে ভালো হতো যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার মানেই অপব্যবহার। তাই আলাদা করে অপব্যবহার নয়, ধর্মের সবরকম রাজনৈতিক ব্যবহারই বিলুপ্ত করা হবে।”
পাকিস্তানি কারাগার থেকে ঢাকায় ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তৃতা দেন তাতে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বলে যে উল্লেখ করেছিলেন তা নিশ্চয়ই তাৎপর্যহীন নয়। ওই বছরই ৭ জুন তারিখের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, “বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিষ্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে।” কথার সুরে আত্মপক্ষ সমর্থনের ভাব রয়েছে এবং প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারটা মোটেই আসছে না। বঙ্গবন্ধুর পরে জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রক্ষমতা পেলেন তখন তিনি এ ব্যাপারে কোনো প্রকার দোদুল্যমানতা প্রকাশ করেন নি, ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরাসরি নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। এরশাদ এসে ঘটনাকে আরো এক স্তর এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তিনি রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেছেন। আর আজ এমন অবস্থা হয়েছে যে, আমেরিকানরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে নরমপন্থী মুসলিম রাষ্ট্র বলায় রাজনৈতিক বড় নেতৃত্ব কোনো প্রতিবাদ করছে না, বরঞ্চ খুশি এই কথা ভেবে যে, তাও যা হোক চরমপন্থী বলেনি।
সূচনালগ্নের ওই দ্বিধা আমলাতন্ত্রের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। কুদরাত-এ খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার কথা বলেছে, কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা তুলে দেবার কথা বলেনি। প্রথম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, “ধমীয় কূপমণ্ডুকতা, অন্ধবিশ্বাস ও গোড়ামি একদিনে দূর করবার বিষয় নয়, কিন্তু আশা করা যায় যে, ওই কূপমণ্ডুকতা বাংলাদেশের মাটিতে বাড়তে পারবে না, যদি ধর্ম রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত না হয় ।”
কিন্তু রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ধর্ম ঠিকই ফিরে এসেছে। ধর্মকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এনেছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও এনেছে। দেশের জনগণ কিন্তু বরাবরই ধর্মনিরপেক্ষ। তারা পাকিস্তানের পক্ষে যে ভোট দিয়েছিল সেটা পারলৌকিক কারণে নয়, ইহজাগতিক মুক্তি পাবে এই আশাতেই। একাত্তরে তারা যুদ্ধ করেছে ইহজাগতিকতার পক্ষেই। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার শাসক শ্রেণী করেছে, এবং সেই রাজনীতি তারা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। জনগণকে ইহজাগতিকতায় উদ্বুদ্ধ করার কাজ অতীতের শাসকেরা করেনি, এখনকার শাসকেরাও করছে না। কারণটা আর কিছু নয়, ভয়। সাধরাণ মানুষ দার্শনিকতায় শিক্ষিত হোক এটা গ্রীক দার্শনিকরা চাননি, ধর্মব্যবসায়ীরা চায়নি, ইবনে সিনার মতো বিপ্লবী চিন্তাবিদ পর্যন্ত চাননি। কিন্তু এই চর্চা তাদেরকে চাইতে হবে যারা সত্যি সত্যি ইহজাগতিকতা চান। কেননা জনগণকে সঙ্গে না পেলে রাষ্ট্র বদলাবে না, সমাজ তো অবশ্যই বদলাবে না। আর রাষ্ট্র ও সমাজ না বদলালে, অর্থাৎ তারা শক্রতা করলে, ইহজাগতিকতা এগুতে পারবে না, যেমন আজকের বিশ্ব অত্যন্ত বস্তুবাদী হওয়া সত্বেও ইহজাগতিক হচ্ছে না, ধর্ম নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, ধর্মীয় মৌলবাদ নানা ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল রয়েছে।
**অক্ষর বিন্যাসে ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
অধ্যাত্মবাদ ইহজাগতিকতার বিপরীতপক্ষ বটে, কিন্তু ইহজাগতিকতার আসল শক্র সেখানে নেই, রয়েছে অন্যত্র । অধ্যাত্মবাদ এই শক্রর দ্বারা ব্যবহৃত হয়। আকর্ষণ করে, মোহ গড়ে তোলে। আসল শক্রটা তাহলে কে? সে হচ্ছে ভয় ।
এই ভয়ের ব্যাপারটায় আসার আগে ইহজাগতিকতা ব্যাপারটা কি সেটা একটু বুঝে নেওয়া যাক।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইহজাগতিকতার শত্রুপক্ষ
ইহজাগতিকতা থাকলে পারলৌকিকতাও থাকে, আলো থাকলে যেমন থাকে অন্ধকার, হয়তো-বা বলা যাবে মাটির ওপরে আকাশ; কিন্তু ইহজাগতিকতা পারলৌকিকতার অনুগত নয়, পারলৌকিকতাকে অবজ্ঞা না-করলেও উদাসীনতা যে দেখায় সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইহজাগতিকতার ভাবটা এই রকমের যে, পরলোক আছে কিনা জানি না, থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তাকে নিয়ে আমার উৎসাহ নেই, আমার জগৎ ইহজগৎ, সেখানেই আমার আগ্রহ। ইহকাল আছে; ইহজগৎ ইহকাল থেকেও ভিন্ন। কেননা কাল অনেক বিস্তীর্ণ জগতের তুলনায়।
অন্য অনেক কিছুর মতো ইহজাগতিকতারও দুটি দিক রয়েছে। একটি তাত্ত্বিক, অপরটি প্রায়োগিক। তাত্ত্বিক দিকটি দার্শনিক; প্রায়োগিক দিকটিতেও দার্শনিকতা রয়েছে, কিন্তু সেখানে জোরটা পড়ে জীবনযাপনের ওপরে। মেহনতি মানুষেরা যে সব সময়েই ইহজাগতিক সেটা নিশ্চয় করে বলবার উপায় নেই, কেননা প্ররোচনা থাকে আধ্যাত্মিক হবার। ইহজাগতিকতার শক্রপক্ষ ওই প্ররোচনাটি দিয়ে থাকে, দেয় নিজের স্বার্থে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের সাধারণ প্রবণতাটা হচ্ছে ইহজাগতিক হবার। না-হয়ে উপায় নেই। কেননা তাকে তো পরিশ্রম করতে হয় । জগতের সঙ্গে সংগ্রাম করে তাকে বাঁচতে হয়, প্রত্যক্ষ জগৎকে অবজ্ঞা করবে এমন সুযোগ তার জন্য খুবই কম।
অধ্যাতবাদ ইহজাগতিকতার বিপরীতপক্ষ বটে, কিন্তু ইহজাগতিকতার আসল শক্র সেখানে নেই, রয়েছে অন্যত্র । অধ্যাত্মবাদ এই শক্রর দ্বারা ব্যবহৃত হয়। আকর্ষণ করে, মোহ গড়ে তোলে। আসল শক্রটা তাহলে কে? সে হচ্ছে ভয় ।
এই ভয়ের ব্যাপারটায় আসার আগে ইহজাগতিকতা ব্যাপারটা কি সেটা একটু বুঝে নেওয়া যাক। ইহজাগতিকতা নাস্তিকতা নয়। ইহজাগতিক হতে হলে নাস্তিক হতে হবে এমন কোনো দিব্যি নেই, যদিও ইহজাগতিক মানুষকে নাস্তিক বলার রেওয়াজ রয়েছে। নাস্তিক বলা হয় সাধারণত ইহজাগতিকদেরকে ঘায়েল করার জন্য। বস্তুত, নাস্তিক না হয়ে তো বটেই, এমনকি ধর্মবিশ্বাসী হয়েও ইহজাগতিক হওয়া যায়। ইহজাগতিকতার ইংরেজি হচ্ছে সেকুলারিজম; সেকুলারিজমের ধারণাটি আমরা আধুনিক ইউরোপ থেকে পেয়েছি। যদিও সেকুলারিজম ব্যাপারটা আমাদের এই অঞ্চলে আগেও ছিল, অনেক আগেই। আধুনিক ইউরোপে ওই প্রত্যয়টি প্রতিষ্ঠার পেছনে যার ভূমিকা বেশী করে উল্লেখযোগ্য তিনি হচ্ছেন ফ্রান্সিস বেকন। বেকন মোটেই নাস্তিক ছিলেন না, নাস্তিকতার তিনি বরঞ্চ বিরোধিতাও করেছেন তার লেখাতে । কিন্তু তিনি অত্যন্ত ইহজাগতিক ছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, ঈশ্বর আছেন, তিনি থাকবেনও; কিন্তু ঈশ্বরকে থাকতে দিতে হবে তার নিজের জায়গায়, তাকে জাগতিক কাজকর্মের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা চলবে না। ওই মিশিয়ে ফেলাটা ভুল এবং ক্ষতিকর। ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের ব্যাপার, আর জগৎ চলে প্রাকৃতিক নিয়মে, জগতের চালিকাশক্তি ধর্মবিশ্বাস নয়, চালিকাশক্তি নানাধরনের দ্বন্দ্ব। বিশ্বাসের দরকার আছে, যুক্তিবুদ্ধিরও দরকার আছে, কিন্তু তাদেরকে সংমিশ্রিত করে ভেজাল উৎপাদন খুবই অন্যায়। যাকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বলি তার মূল ব্যাপারটাও ওইটাই রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে মিলিয়ে না-ফেলা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, এই কথাটা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশ জোরেশোরে বলা হয়েছে। কথাটা সত্যও বটে আবার মিথ্যাও বটে। সত্য এই দিক থেকে যে, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা নাগরিকদের এই পরামর্শ দেয় না যে, তোমাদেরকে ধর্মহীন হতে হবে; কিন্তু তাই বলে আবার এমন কথাও বলে না যে, রাষ্ট্র নিজে সকল ধর্মেরই চর্চা করবে কিংবা নাগরিকদেরকে নিজ নিজ ধৰ্মচর্চায় উৎসাহিত করবে; রাষ্ট্র বরঞ্চ বলবে, ধর্মচর্চার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোনো আগ্রহ নেই, রাষ্ট্র নিজে একটি ধর্মহীন প্রতিষ্ঠান, ধর্মবিশ্বাস নাগরিকদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্রের ওই ধর্মহীনতাকেই কিছুটা নম্র করে বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা । ইহজাগতিকতা হুবহু বস্তুতান্ত্রিকতা নয়, কিন্তু বস্তুতান্ত্রিকতা থেকে খুব যে দূরে তাও নয়।
জগৎ সত্য । সে অত্যন্ত বাস্তবিক। কিন্তু এই বাস্তবিক সত্যটাকে খাটো করে দিতে চায় ইহজাগতিকতার শক্রপক্ষ । তারা ধর্মকে টেনে নিয়ে আসে সামনে । ধর্ম বিশ্বাসের পেছনে একটা ভয় থাকে। পরকালের ভয়। অজানাকে ভয়। ওই ভয়টাকে কাজে লাগানো হয়। ইহজাগতিকতার যারা বিরুদ্ধ পক্ষ তারা ওই ভয়টাকে কাজে লাগায়। তারা নিজেরাও অবশ্য ভীতু৷ ভয় থেকেই ইহজাগতিকতার বিরুদ্ধে কাজ করে। ভয় থাকে পরকালের । কিন্তু তার চেয়েও বড় ভয় হচ্ছে স্বার্থহানির। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সঙ্গে যাদের জাগতিক স্বার্থ জড়িত তারা ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে নিজেদের শাসন-শোষণ-নিপীড়ন তথা কায়েমী স্বার্থ রক্ষার যে-চেষ্টা তারা করে তার আচ্ছাদন হিসেবে ! ঈশ্বরই এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যে, কেউ বড় হবে কেউ ছোট। এটাই ধর্মের বিধান বলে তারা প্রচার করে । ইহজাগতিকতা ধর্মের আচ্ছাদনটি যদি সরিয়ে দেয় তাহলে কায়েমী স্বার্থওয়ালাদের কদর্য কাজটা উন্মোচিত হয়ে জনসম্মুখে এসে যাবে, এই ভয়ে তারা হত্যাও করেছে, ইতিহাসে নজির রয়েছে। সাধারণ মানুষ যে ধর্মের কাছে যায় সেটা কেবল ভয়ে নয়, অনেক সময়ে ভরসাতেও । এই জগতে বিচার নেই, পরজগতে তারা বিচার আশা করে। জগতে নির্ভর করা যায় এমন শক্তি নেই, মানুষ তাই পরজগতের দিকে তাকিয়ে থাকে। কায়েমী স্বার্থের সংরক্ষক ও তাদের চেলাচামুণ্ডারা মানুষের ওই ধর্মবাদিতাকেও ব্যবহার করে থাকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থে। ইহজাগতিকতার শক্রপক্ষ মুখে যাই বলুক না কেন কার্যক্ষেত্রে তারা নিজেরা অত্যন্ত ইহজাগতিক। বিষয়-সচেতন ।
ইহজাগতিকতার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠিত স্বার্থের রক্ষকদের দ্বন্ধটা খুবই স্বাভাবিক। বঞ্চনাকারীরা বঞ্চিতদের সঙ্গে শক্রতা করবেই। কিন্তু পরিহাসের বিষয় এটা যে, বঞ্চনাকারীরা বঞ্চিতদেরকে তাদের পক্ষে নিয়ে নেয়। এই নেবার ক্ষেত্রে ধর্ম খুবই উপকারে আসে, তাদের জন্য। ইহজাগতিকদের ধর্মবিরোধী হিসেবে দাড় করানো হয়, বলা হয় এরা জড়বাদী, বলা হয় এরা সবাই নাস্তিক। চেষ্টা করা হয় রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে মিলিয়ে ফেলবার। ভারত একটি ইহজাগতিক রাষ্ট্র, কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে সেখানে মৌলবাদীরা চেষ্টা করছে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে। মধ্যপ্রাচ্যে কোনো কোনো দেশে ধর্ম ও রাষ্ট্র এক হয়ে গেছে। কেবল যে সৌদি আরবে তা নয়, ইসরাইলেও। ইসরাইলেই বরঞ্চ বেশী পরিমাণে ঘটেছে এই ব্যাপারটা। ওই রাষ্ট্রের অভু্যদয়ই ঘটেছে একটি ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে, তার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার লড়াই লড়ছে যে প্যালেস্টাইনীয় জনগণ, তাদের মধ্যে বরঞ্চ ইসলাম ছাড়াও অন্য ধর্মের লোক রয়েছে, খ্রিষ্টানরা আছে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের একনিষ্ঠ সমর্থক ! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট নামে ছোট কিন্তু আস্ফালনে অনেক বড়; মুসলিম ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে তিনি ক্রুসেড ঘোষণা করেছেন। উল্টোদিকে মুসলিম মৌলবাদীরা মনে করছে তারা জেহাদে আছে। দু'পক্ষই মৌলবাদী। এবং দুয়ে মিলে মানুষের সভ্যতাকে পেছনের দিকে ঠেলছে। এ সত্য তো ভুলবার উপায় নেই যে, সভ্যতা একটি ইহজাগতিক ব্যাপার। এর অগ্রগতিতে অতীতে ধর্মের একটি প্রগতিশীল ভূমিকাও ছিল, কেননা ধর্ম তখন বিদ্রোহ করেছে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। খ্রিষ্ট ও ইসলাম উভয় ধর্মই এসেছিল নিপীড়িত মানুষের অগ্রাভিযানের সাহায্য করবার অঙ্গীকার নিয়ে । কিন্তু পরে কায়েমী স্বার্থবাদীরা উভয় ধর্মকেই ব্যবহার করেছে নিজেদের নোংরা স্বার্থে এবং এখন দুই ধর্মের মধ্যে লড়াই বাধাবার তালে আছে। ধর্মের আধ্যাতিক স্বার্থে নয়, নিজেদের বস্তুগত স্বার্থে। ফলে ইউরোপীয় রেনেসান্সের সময় থেকে ইহজাগতিকতার যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল এখন তা নতুন করে বিঘ্নিত হচ্ছে।
ইহজাগতিকতার আরো একটি শক্র রয়েছে। সেটি হলো মানুষে মানুষে বৈষম্য। কায়েমী স্বার্থওয়ালারা নিজেদেরকে ধনী করতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষকে গরিব করে রাখে। এই গরিব মানুষেরা নির্যাতিত হয়, তারা বিচার পায় না, ভরসা পায় না, তখন তারা ধর্মের কাছে যায়। নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পথ দুটি—একটি গেছে বামে, অন্যটি ডানে। বামপন্থীরা ইহজাগতিক, তারা গণতন্ত্রী; ডানপন্থীদের অধিকাংশই ধর্মীয় মৌলবাদী। বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র ইহজাগতিকদের ওপর পীড়ন চালায়, ফলে সুবিধা হয় ধর্মীয় মৌলবাদীদের। তারা প্রধান প্রতিবাদকারী হয়ে উঠতে চায়। বিশ্বজুড়ে আজ এই ঘটনাই ঘটছে।
সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ছিল ইহজাগতিক। পুঁজিবাদী বিশ্বও নিজেকে ইহজাগতিক বলে প্রচার করে। কিন্তু দুয়ের মধ্যে মৌলিক ব্যবধান রয়েছে। প্রথম কথা হলো এই যে, পুঁজিবাদীরা দারিদ্র্য সৃষ্টি করে, আর দরিদ্র মানুষ বাধ্য হয় ধর্মের কাছে ছুটতে। দ্বিতীয় সত্য এটা যে, পুঁজিবাদীরা ভোগবাদী; দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষ নিজেদেরকে ভোগ থেকে বঞ্চিত দেখে পরকালে স্বর্গ পাবে এই আশার মধ্যে সান্তুনা খোজে। তৃতীয়ত, পুঁজিবাদীরা মৌলবাদীদেরকে সরাসরি উৎসাহিত করে ডানপন্থী হতে; আর ডান দিকে এগুলে মৌলবাদী হতে খুব বিলম্ব ঘটে তা নয়।
আমাদের এই উপমহাদেশে মানুষজন খুবই আধ্যাত্মিক বলে একটা রটনা আছে। এই প্ররোচনা বিশেষভাবে জোরদার হয়েছে ইংরেজ কর্তৃক ভারত দখলের পর থেকে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই দেখা গেছে ভারতবর্ষীয়রা তাদের ধর্মীয় উত্তরাধিকার নিয়ে গর্ব প্রকাশ করা শুরু করেছে। একাধিক কারণে এটা ঘটেছে। প্রথমত, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অভিমান তৈরি হয়েছে। নতুন শাসকরা নানাভাবে তাকে পীড়িত করছিল, ফলে তার মধ্যে একটা আগ্রহ জন্মেছে দাড়াবার জায়গা খুঁজবার। প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছুই বিদেশীরা দখল করে নিয়েছে, দেশী মানুষ এখন যায় কোথায়? গেছে সে ধর্মের কাছে। ইংরেজদের মধ্যে মিশনারিদেরকে দেখা যাচ্ছিল, যারা স্থানীয় মানুষদের ধর্মান্তরিত করতে উদ্যোগ নিচ্ছিল। সেটাও একটা কারণ নিজেদের ধর্মকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখার পেছনে। উল্টো দিকে আবার এটাও যে, উইলিয়াম জোনস ও মাক্সমুলারের মতো প্রাচ্যবিদরা প্রাচ্যে যে আধ্যাত্মিক মহত্বের সন্ধান পেয়েছেন তার প্রচারও স্থানীয় বিদ্ব্যজনকে উৎসাহিত করেছে, তারা অধ্যাত্মবাদের সন্ধানে ধর্মের কাছে চলে গেছেন। রাধাকৃষ্ণাণের মতো পণ্ডিত ব্যক্তিরা গর্ব করে বলেছেন যে, ভারতবর্ষ যে সময়ের ধ্বংসলীলা ও ইতিহাসের দুর্ঘটনা সহ্য করে দাড়িয়ে থাকতে পেরেছে তার কারণ রাজনৈতিক বা সামাজিক নয়, কারণ হচ্ছে ভারতবর্ষের গভীর আধ্যাতিকতা ।
অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, ভারতীয় চিন্তার ঐতিহ্যে ইহজাগতিকতা তো বটেই, এমনকি বস্তুবাদিতাও খুব বড় সত্য ! যে-বেদের আধ্যাত্মিকতার উচ্চকণ্ঠ প্রশংসা করা হয় তাতে আধ্যাত্মিকতা নয় ইহজাগতিকতাই প্রধান। বেদে দেবতাদের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক সেটা ভক্তি নয়, পারস্পরিক আদান-প্রদানের বটে। গ্ৰীক দেবদেবীদের সঙ্গে সে-দেশের মানুষের সম্পর্ক থেকে এটা কিছুটা ভিন্ন রকমের গ্রীসে দেবতা ও মানুষ পরস্পরের বন্ধুর মতো, যোগাযোগটা বেশ জানাশোনার। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যাপারটা সরাসরি দেওয়া-নেওয়ার। দেবতাদের কাছে মানুষ চায় সম্পদ, সম্পত্তি, নিরাপত্তার মতো জিনিস যা দেবতারা দিতে পারে। প্রতিদানে দেবতারা মানুষদের কাছে আশা করে খাদ্য ও পানীয়। যেমন ধরা যাক, দেবরাজ ইন্দ্রের কথা। তিনি সোমরসের বিশেষ ভক্ত। তার পূজারীরা ওই রস সরবরাহ করে এবং বিনিময়ে তার কাছ থেকে উপকার প্রত্যাশা করে থাকে।
গ্রীক দার্শনিকেরা দর্শনের চর্চা করতেন জীবন জগতের রহস্য বুঝবার জন্য। ভারতীয় দর্শনের বিকাশ ভিন্ন কারণে। ওই কারণটা হচ্ছে দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তির আকাজক্ষা। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, সূচনায় ভারতবর্ষের দার্শনিকতায় আধ্যাত্মিকতা ছিল না, ছিল যা তা হলো প্রবল ইহজাগতিকতা। ইহজগতের প্রয়োজনে মানুষ দেবদেবীর কৃপাপ্রার্থী হয়েছে, কোনো তত্ত্বগত প্রয়োজনে নয়। সেজন্য দেখা যায় প্রার্থনায় ঘোড়া ও গরুর কথা রয়েছে। গাভী যখন তার বাছুরদের উদ্দেশে ডাক দেয় তখন যে-ধ্বনি তৈরি হয় ঋগ্বেদে তার অতিউচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে ওই ধ্বনি মন্ত্ৰোচ্চারণের সঙ্গীতের মতো মধুর বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। বেদে বৃষ্টি, দীর্ঘজীবন, যৌবন, রোগের প্রতিকার, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, সব কিছুর জন্যই আন্তরিক প্রার্থনা শোনা যায়। বার বার বলা হচ্ছে আমাদের ধন ও পশু বর্ধিত হোক, আমাদের শক্রর বিনাশ ঘটুক, আমাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাক। আমাদের কথাই আসছে, আমার কথাটা না-এসে; যা থেকে বুঝতে পারি যে, ব্যক্তি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেনি, বিচ্ছিন্ন করবার মতো অবস্থা তার নয়। তাকে যুথবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়, তার আশেপাশে নিরাপত্তার ভীষণ অভাব এবং দৈবনির্ভরতা ভিন্ন তার উপায় নেই। গ্ৰীক দার্শনিকেরা সুখের অভাবে ছিলেন না, দর্শনের নানা বিষয়ে কৌতুহল ও আলোচনা করবার মতো জাগতিক সুবিধা তারা ভোগ করতেন; বেদের রচয়িতাদের জীবনে যার অভাব ছিল। বেদের সঙ্গীতময়তা খুবই সরল, আন্তরিক এবং শিল্পমূল্যে উচ্চ পর্যায়ের। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণরা নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থে ওই সঙ্গীতকে টীকাভাষ্যে জর্জরিত ও দুর্বোধ্য করতে চেয়েছে এবং সেই সঙ্গে শূদ্রের জন্য তার পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।
বেদে দেবদেবীর সংখ্যা অনেক, তাদের সকলেরই প্রয়োজন আছে, আধ্যাত্মিক কারণে নয়, দেবদেবীর স্বার্থে নয়, মানুষের স্বার্থে। প্রকৃতির নানা রূপকে দেবদেবীতে পরিণত করা হয়েছে সত্য, কিন্তু তাতে কোনো আধ্যাত্মিকতা দেখা দেয়নি। ব্যাপারটা রয়ে গেছে বাস্তবিক এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ব্যাপার। সেখান থেকেই উৎসারিত এবং সে-কারণে আমন স্বাভাবিক ও সুন্দর। আধ্যাত্মিকতার হস্তক্ষেপ ব্রাহ্মণদের অবদান।
এ প্রশ্নটা তো খুবই স্বাভাবিক, এবং সেটা উঠেছেও যে, প্রাচীন ভারত যদি অত আধ্যাত্মিকই হবে তবে মানব সভ্যতায় সে আমন বড় বড় অবদান যোগ করলো কি করে। সভ্যতা তো সর্বদাই ইহজাগতিক, তার আধ্যাত্মিকতা বাস্তববাদিতার ওপর নির্ভরশীল। আধ্যাত্মিকতা বাস্তববাদিতার জন্ম দেয়নি, বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটেছে। প্রাচীন ভারতে স্থাপত্য, রসায়ন, গণিত, চিকিৎসা, ভেষজশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, বিশ্ববিদ্যালয় এসব গড়ে উঠলো কিভাবে, মানুষ যদি জগৎকে উপেক্ষা করে পরলোকবাদী হয়ে থাকে? সভ্যতা পরলোকবাদিতায় গড়ে ওঠা সম্ভব নয়; এবং তা ঘটেওনি । আধ্যাত্মিকতা প্রচারের ফলে আস্কারা পেয়েছে। বাস্তবতা ছিল ভিন্ন প্রকারের।
রাধাকৃষ্ণাণের মতো ভাববাদী দার্শনিকেরা মনে করেন যে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে দার্শনিকেরা যে ভূমিকা পালন করবেন বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, সেই আশাই বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। কেননা ব্রাহ্মণরা ছিলেন দার্শনিক এবং তারাই ছিলেন রাষ্ট্র ও সমাজের নির্দেশক । বক্তব্যটি একাংশে সত্য, অপরাংশে নয়। হ্যা, ব্রাহ্মণরাই কর্তা হয়েছিলেন। তারাই কর্তৃত্ব করতেন। সমাজে নির্মম শ্রেণী বিভাজন কার্যকর ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা একদিকে, অন্যদিকে শ্রমজীবী অধিকাংশ মানুষ, যারা ছিল শূদ্র বলে চিহ্নিত ব্রাহ্মণরা শ্রম করতো না, তারা শূদ্ৰদের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বস্তুত ব্রাহ্মণরা যে কিছুতেই কৃষিকার্যে লিপ্ত হবেন না, এই নির্দেশ শাস্ত্রে বার বার দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে শূদ্রদের কাজই হচ্ছে শ্রম করা । তারা সেজন্যেই জন্মেছে। আর ওই যে শ্রেণীবিভাজন তাকে একটি ধর্মীয় অর্থাৎ আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাও দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যেটা ছিল অনপনেয়। বলা হয়েছিল যে, শূদ্ররা শূদ্র হয়ে যে জন্মেছে সেটা এমনি এমনি নয়, আগের জীবনের কর্মদোষ বটে। তাই এ জীবনে তাদেরকে শ্রম করতে হবে, করলে হয়তো পরজন্মে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু কেবল শ্রমে কুলাবে না সেবাও করা চাই। সেবা করতে হবে ব্রাহ্মণকে । সেটাও শূদ্রের বিধিলিপি; আগের জীবনে যে পাপ সে করেছে তার প্রতিফল। সেবা দিয়েই ওই পাপবন্ধন ছিন্ন করা সম্ভব, বিচ্যুত হলে পরবতী জীবনেও ওই কাজই করতে হবে। শ্রেণী বিভাজন অভিনব কোনো ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তু প্রাচীন ভারতে অধ্যাত্মবাদী ব্ৰাহ্মণরা যা করেছিলেন তা হলো ওই বিভাজনকে ধর্মীয় রূপ প্রদান ।
প্লেটোর দার্শনিকেরা শ্রম করবেন না; শ্রমের দায়িত্ব শ্রমজীবীর। প্লেটোর সমাজে দাস ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, এবং দার্শনিকরা ওই শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে বসে দর্শনের চর্চা করবার সুযোগ পেতেন। সেটা ছিল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। দার্শনিকরা ওই ব্যবস্থাকে রক্ষা করবার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিপ্লব ঠেকানো প্লেটো ও এ্যারিস্টটল উভয়েরই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল; রাষ্ট্রকেই তারা প্রধান করেছেন, ব্যক্তিকে নয়। অত করেও এ্যারিস্টটল শাসকদের ক্রোধ থেকে মুক্ত হতে পারেননি, মৃত্যুর পূর্বে তাকে এথেন্স ছেড়ে পালাতে হয়েছিল, প্রাণভয়ে। প্লেটাে এমন বিপদে পড়েননি। কারণ তিনি কাল্পনিক রাষ্ট্র নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বাস্তবিক রাষ্ট্রের সংবিধান তৈরির দায়িত্ব নেননি, এ্যারিস্টটল যেমনটা নিয়েছিলেন ।
সাদৃশ্য আছে, কিন্তু গ্ৰীক দার্শনিকদের সঙ্গে ভারতীয় ব্রাহ্মণদের পার্থক্যও ছিল মৌলিক। বিদ্যার টীকা ভাষ্য ব্যাখ্যা ইত্যাদি রচনা করা; যা ছিল জীবন্ত তাকে মন্ত্রে পরিণত করেছেন, শব্দ মুখ্য হয়ে উঠেছে বস্তুর তুলনায়। ব্রাহ্মণরা নিজেদের স্বার্থকে প্রধান করেছেন, গ্রীক দার্শনিকরা যা করেননি। গ্ৰীক দার্শনিকদের ভেতর ভাববাদিতা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু বস্তুবাদিতাও ছিল, ছিল ইহজাগতিকতা। ভারতীয় দর্শনেও বস্তুবাদিতা ও ইহজাগতিকতা ছিল। কিন্তু ওই দুই উপাদানকে ব্রাহ্মণরা কখনোই গুরুত্বপূর্ণ হতে দেননি, চেষ্টা করেছেন বরঞ্চ অবলুপ্ত করে দিতে। যাতে করে সাধারণ মানুষ ওসব বিষয়ে উৎসাহী না হয়, প্রশ্ন না তোলে, অসঙ্গতি দেখে বিদ্রোহ না করে বসে। বিদ্রোহ প্লোটো-এ্যারিস্টটলও চাননি, কিন্তু তাদের আয়োজনটা ছিল ইহজাগতিক, ব্রাহ্মণরা ব্যবস্থা করেছেন তথাকথিত আধ্যাত্মিকতার ব্রাহ্মণরা নিজেরা কিন্তু বেশ ইহজাগতিক ছিলেন, উৎপাদন করতেন না, পূজা-অৰ্চনার ওপর নির্ভর করতেন এবং ভোগের ব্যাপারে যে উৎসাহহীন ছিলেন তাও নয় ।
ভারতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিদ্যা অগ্রসর ছিল। ওই জ্ঞান মোটেই আধ্যাত্মিক ছিল না, ছিল পরিপূর্ণরূপে ইহজাগতিক ও বস্তুবাদী। কিন্তু বিজ্ঞান কেন এগুলো না, চিকিৎসাবিদ্যা কেন পিছিয়ে গেল? গেল ইহজাগতিকতার সঙ্গে ব্রাহ্মণদের কার্যকর শক্রতার কারণে। শক্রতাটা ছিল প্রধানত মতাদর্শিক। প্রচার করা হয়েছিল যে, জগৎ মিথ্যা। মায়া। তাই যদি হয় তাহলে বিজ্ঞান এগুবে কি করে? বিজ্ঞান তো মায়া নয়। সে তো বস্তুবাদী। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একই রকমের ঘটনা ঘটেছে। রোগের নিরাময় দেবতারা করবেন, করবেন পূজা-অৰ্চনার বিনিময়ে এবং পূজা-অৰ্চনা ঘটবে ব্রাহ্মণের মধ্যস্থতায়, ব্যবস্থাটা ছিল এই রকমের। মন্ত্র অনেক জরুরী ভেষজ ওষুধের তুলনায়, প্রচারণা ছিল এটাই। মতাদর্শিকভাবে শ্রমকে হেয় জ্ঞান করা হয়েছে। শ্রম হচ্ছে অভিশাপ, শ্রম করবে শূদ্র। সবরকম শ্রমকেই ইতর লোকের কাজ বলা হয়েছে। চাষা কামার কুমার ডোম মেথর কারো শ্রমই মর্যাদাবান নয়। বিজ্ঞানীর কাজও ছিল মর্যাদাহীন, চিকিৎসকের কাজও তাই কর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্রাহ্মণরাই ছিলেন আদর্শস্থানীয়। লোকে তাদের মতো পরশ্রমজীবী হতে চেয়েছে, পরিশ্রমজীবী না হয়ে । ওদিকে বিজ্ঞান রূপকথা নয়, সে প্রায়োগিক । বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করতে পারে তারাই যারা উৎপাদনে যুক্ত; কিন্তু ভারতবর্ষে উৎপাদনে যারা যুক্ত তাদেরকে তো খাটানো হয়েছে ঘানির বলদ হিসেবে; তারা কি করে বিজ্ঞান প্রয়োগ করবে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে নব উদ্ভাবনের পথে? প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জন্ম দেয়, সে-প্রয়োজনটা তৈরি হয়নি। বিজ্ঞানের জায়গায় এসেছে ঈশ্বরনির্ভরতা, পরলোক বড় হয়ে উঠতে চেয়েছে ইহলোককে পদানত করে।
আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো দেখা যায় যে, বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মৌলবাদী হন। এর প্রধান কারণ ওই বস্তুজগৎ বিচ্ছিন্নতা; বিজ্ঞান তাদের কাছে ঐন্দ্রজালিক বস্তুতে পরিণত হয়। সেখানে অঙ্ক থাকে, যে অঙ্ক মন্ত্রের মতো ভাববাদী, বস্তুবাদী নয়। মৌলবাদী বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা দেখেন এবং ভাবেন এ সবই একটি অনির্বচনীয় পরম সত্তার বহিঃপ্রকাশ; সবটাই যে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণের মধ্য দিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে সেই সাধারণ সত্যটি তারা ভুলে যান। প্লেটোর দার্শনিকদের রাজ্য ও সমাজ শাসনের সঙ্গে ব্রাহ্মণ দার্শনিকদের আধিপত্যের আরো একটি মৌলিক পার্থক্য তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা এই যে, প্লেটোর দার্শনিকরা জন্মসূত্রে দার্শনিক নন, তারা দার্শনিক নিজ নিজ যোগ্যতায় । জন্ম তাদের জন্য উল্লেখযোগ্য বিষয়ই নয়, কার কোন ঘরে জন্ম সেটা খেয়ালই করা হবে না, লোক-বাছাইয়ের কাজটা চলবে মেধার ভিত্তিতে। মেধাবানরাই দার্শনিক হবেন এবং কর্তৃত্ব করবেন। ভারতের ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে জন্মসূত্র হচ্ছে একেবারে প্রাথমিক বিবেচনা। ব্রাহ্মণের জন্ম যেখানে-সেখানে নয়, তার জন্ম ব্রাহ্মণের ঘরেই।
ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রাচীন ভারতে দার্শনিক অভু্যুথান ঘটেছে, যার সামাজিক তাৎপর্য মোটেই সামান্য ছিল না। বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব ও বিকাশ দুটি বড় ঘটনা। বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণদের শাসন অনুশাসন মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। তারা নাস্তিক ছিলেন, ঈশ্বর কিংবা স্বর্গে বিশ্বাস করতেন না; যেটা মস্ত বড় ব্যাপার। কিন্তু বৌদ্ধরা তাই বলে যে পুরোপুরি ইহজাগতিক ছিলেন তাও নয়। তারা কর্মফল ও জন্মচক্র মানতেন । ব্রাহ্মণদের মতো মোক্ষ চাইতেন না বটে, তবে নির্বাণ চাইতেন। নির্বাণ হচ্ছে নিভে যাওয়া, নির্বাপিত হওয়া। এই যে নির্বাপিত হতে চাওয়া, এর মধ্যে ইহজগৎবিমুখতা ছিল। জীবনকে তারা দুভোগ হিসেবে দেখতেন এবং জীবনের প্রতি আসক্ত হওয়াটাকে চূড়ান্ত ভ্রম বলে জানতেন। তাই নাস্তিক হয়েও জীবনবিমুখ ছিলেন। জীবনবিমুখদের পক্ষে ইহজাগতিক হওয়াটা কঠিন। ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধদের বিতাড়িত করেছে বটে, কিন্তু বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে মানতে অসুবিধা বোধ করেননি।
প্রাচীন ভারতের পুরোপুরি ইহজাগতিকেরা চার্বাক নামে পরিচিতি। এঁরা একাধারে নাস্তিক, ব্ৰাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী এবং জগতের প্রতি আসক্ত। ভারতীয় দার্শনিক ধারায় এরাই ছিলেন সর্বাধিক পরিমাণে বস্তুবাদী ! একেবারেই আপোসহীন । চার্বাকরা চার্বাক নাম কেন পেলেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ আছেন যারা এঁদের অস্তিত্বই অস্বীকার করেন। কিন্তু চাৰ্বাকরা যে ছিলেন তার প্রমাণ আছে। তবে তাদের নিজেদের রচনা পাওয়া যায় না, তার কারণ ব্রাহ্মণদের ক্রোধ। ব্রাহ্মণরা তাদের নাস্তিক, পাষণ্ড, ধূর্ত, কূটতার্কিক, ছেলেমানুষ ইত্যাদি নানা অভিধায় ভূষিত করেছেন, তিরস্কার করবার অভিপ্রায়ে। বোঝা যায় খুবই ক্ষিপ্ত ছিলেন। অবজ্ঞা করে জব্দ করা যায়নি, তাই আক্রমণ করা হয়েছে। চাৰ্বাকদের গ্রন্থ নয় কেবল, সম্পত্তি ও জীবন উভয়ই বিপন্ন ছিল বলে ধারণা করার কারণ রয়েছে। চাৰ্বাকদের নামকরণ সম্বন্ধে ঠাট্টাচ্ছলে বলা হয়েছে যে, তারা চারুভাষণ করতো, তাই চাৰ্বাক ছিল। চারুভাষণ অর্থ এক্ষেত্রে কটুভাষণই মনে হয়। চার্বাকরা সবকিছু চর্বন করতো, অনেকটা ছাগলের মতো, তাই তারা চার্বাক, এমনও বলা হয়েছে। চার্বাকদের আরেক নাম লোকায়ত। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এ নিয়ে গবেষণা করেছেন, এবং তিনি এই লোকায়ত নামকরণ পছন্দ করেন। চাৰ্বাক দর্শন আসলে লোকায়ত দর্শনই। একাধিক অর্থে। এ ছিল লোকদের আয়ত্তে। এই দর্শনে রয়েছে সাধারণ মানুষের ধারণা-জীবন ও জগৎ বিষয়ে। অন্যদিকে আবার ছিল সে ইহজাগতিক। কেবল ইহজাগতিক নয়, পরিপূর্ণরূপে বস্তুবাদী।
চার্বাকরা ব্রাহ্মণদের আধিপত্য মানে না। ব্রাহ্মণদের আধ্যাত্মিকতাকে মনে করে প্রতারণা। ব্রাহ্মণরা শ্রম করে না, অন্যেরটা খায়, তাই পূজা-অৰ্চনা প্রথা অনুষ্ঠানকে উচ্চে তুলে ধরে। ওই পথেই তাদের জীবিকা অর্জিত হয়। তারা যে শোষক শ্রেণীর অংশ এবং শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার কারিগর, এই ধারণাটা সম্ভবত এখনো আসেনি, তাই কেবল প্রতারকই বলা হয়েছে।
বৌদ্ধদের মতো এরা নাস্তিক বটে, স্বর্গ-নরক মানে না; তবে এরা আরো এক ধাপ অগ্রসর । কেননা, কর্মফলকেও তারা মিথ্যা মনে করে। জন্মান্তর নেই। মৃত্যুর পরে দেহ যখন পুড়ে ছাই হবে তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। কারণ, আত্মা বলে কিছু নেই। হ্যা, চৈতন্য আছে কিন্তু চৈতন্যের জন্য আত্মার প্রয়োজন নেই। মাটি, আগুন, পানি ও বায়ুর সংমিশ্রণে আমাদের দেহতৈরি এবং চৈতন্যও এই সংমিশ্রণেরই ফল। পাপ-পুণ্য কর্মফল পুনর্জন এসবই ধূর্তব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচার। যা প্রত্যক্ষ তাই শুধু সত্য, এই তাদের বিশ্বাস। শরীর থাকলে যেমন প্রাণ থাকে তেমনি চৈতন্যও থাকে। সুখ নিজেই মূল্যবান এবং সেই সুখ ইহকালেই পাওয়া যাবে, পরকালের জন্য অপেক্ষা করাটা মূর্খতা, কেননা পরকালের তো কোনো অস্তিত্বই নেই, আসলে। দৈহিক আনন্দই ঈপ্সিত। যে জন্য বলা হয় যে, খাও দাও ফুর্তি করো, ধার করে হলেও ঘি কেনো, এটাই তাদের নীতি ছিল। যেন ফুর্তিবাজের দল।
চার্বকদের বক্তব্যকে এভাবে ফুর্তিবাজি বলে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। কেননা, সরাসরি তাদের গ্রন্থ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যরা তাদের সম্পর্কে যা বলেছে তা থেকেই তাদের বিষয়ে ধারণা করতে হয়েছে। তাদের বক্তব্যের খণ্ডন পাওয়া যায়, মূল বক্তব্য পাওয়া যায় না। তবে বুঝতে কষ্ট নেই যে, তারা বিদ্রোহী ছিলেন। রাজবিদ্রোহী নয় হয়তো, কিন্তু সমাজবিদ্রোহী অবশ্যই। এবং বিদ্রোহে যে প্রবলতা থাকে সেটা সম্ভবত ছিল তাদের মধ্যেও, অথবা হতে পারে যে, তাদের কথাকে অতিশয়োক্তির সাহায্যে উপস্থাপিত করা হয়েছে, ব্রাহ্মণরাই করেছেন, চাৰ্বাকদেরকে যুক্তিহীন বলে চিহ্নিত করার অভিপ্রায়ে ।
এই লোকায়তিকদের অপরাধটা তো সামান্য নয়। এরা বেদ মানে না, এবং শুধু যে নামেনে ক্ষান্ত হয় তা নয়, বলে যে বেদ মিথ্যা, স্ববিরোধী ও অতিরঞ্জিত। আরো বড় মুশকিল এই যে, এদের কথা সাধারণ লোকে বিশ্বাস করবে। কেননা কথাগুলো সরল। ব্রাহ্মণরা যে ভণ্ড ও প্রতারক, তারা যে স্মৃতি ও শ্রুতির ব্যবসা করে এটা তো প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না, লোকে স্বচক্ষে দেখে। তাছাড়া সাধারণ লোক হিংসুটে, তারা ব্রাহ্মণদের সুখ সহ্য করতে পারে না। চার্বাকরা তাই অত্যন্ত বিপজ্জনক বৈকি। তারা ব্যক্তি নয়, গোটা ব্যবস্থার সঙ্গে শক্রতায় লিপ্ত । তাই ব্যবস্থাটা একত্ৰযোগে তাদেরকে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছে।
‘মহাভারতের শান্তি পর্বে চাবাক নামে এক রাক্ষসের উল্লেখ রয়েছে। লোকায়তের উল্লেখ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যাবে। পৌরাণিক উপাখ্যানে বলা হয়েছে, অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে দেবতারা সুবিধা করতে পারছে না দেখে দেবগুরু বৃহস্পতি এক বুদ্ধি বের করেছিলেন। তিনি ছদ্মবেশে অসুরদের সঙ্গে মিলে গেছেন এবং তাদেরকে চাবাক দর্শন অর্থাৎ ফুর্তি করার মতবাদ শিখিয়েছেন। এতে চমৎকার ফল পাওয়া গেছে। অসুররা শক্তি হারিয়েছে এবং দেবতারা জয়ী হয়েছে। মনে হচ্ছে এখানে দেবতা বলতে ব্রাহ্মণকে বুঝতে হবে, অসুর বলতে বুঝতে হবে শূদ্ৰকে ।
রামায়ণে রাম ভ্রাতা ভরতকে রাজকাৰ্য পরিচালনা বিষয়ে নানাবিধ মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। একটা পরামর্শ ছিল এই যে, ভরত যেন লোকায়ত ব্ৰাহ্মণদের সেবা না করেন। কেননা, ব্রাহ্মণ হলেও তারা মূর্খ তারা অনর্থক তর্ক করে, অভিমান করে পাণ্ডিত্যের, কিন্তু আসলে তারা বালকের মতো মূখ। লোকায়তিকরা ধর্মশাস্ত্র অবজ্ঞা করে, আর অর্থহীন বচসায় লিপ্ত হয়। রাম আদর্শ পুরুষ, তিনি ভদ্র ভাষায় কথা বলেন, কিন্তু যা বলছেন তা অত্যন্ত দৃঢ়। চাবাঁকরা মূখ, তারা বচসাপ্রিয় এবং নাস্তিক। নাস্তিক অর্থ হচ্ছে অবিশ্বাসী, চাৰ্বাকরা বেদ-ব্ৰাহ্মণে বিশ্বাস করে না । তাদের ওই নাস্তিকতার অর্থ দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। যেবিদ্রোহ কোনোমতেই সমর্থনীয় নয়, প্রশ্ৰয় দেবার তো প্রশ্নই ওঠে না।
এসব গেলো নেতিবাচক বিরোধিতা। ইহজাগতিকতার বিরুদ্ধে বিকল্প দাড় করিয়েও বিরোধিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই বিকল্প হচ্ছে মায়াবাদ | শঙ্করাচার্য যা অত্যন্ত বেগবান উপায়ে প্রচার করেছেন।
ইহজাগতিকতার সঙ্গেশক্রতা তাই নতুন নয়। এই শক্রতা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুবিধাভোগী মানুষেরা করেছে। ব্যক্তিও করেছে। দুটি কারণে। একটি হচ্ছে মতাদর্শিক পরিমণ্ডলের আধিপত্য। অন্যটি হচ্ছে ব্যক্তিগত ভয়। ইহকালে তো সুখ নেই, পরকালেও যদি তা না পাওয়া যায় তবে উপায় কি? ব্যক্তি তাই পরলোকে সুখ ও সুবিচার প্রাপ্তির আশাটাকে জোরেশোরে আঁকড়ে ধরেছে। ব্যক্তি একটি বিশ্বাসের জগৎ নিজের জন্য তৈরি করে নেয়, সেটা ভেঙ্গে পড়লে খুবই বিপদে পড়ে।
চীনের কনফুসিয়াসও প্রাচীন বিশ্বের দার্শনিক। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মানুষ তিনি। চীনের লোকেরা কথা বলে কম, কনফুসিয়াস বলতেন আরো কম। খুব সংযতভাব ছিল তাঁর। যা বলবার শিষ্যদেরকে বলে গেছেন এবং বলেছেন অল্প কথায়। সাজানো কথা এবং মনোভোলানো ব্যবহার যাদের অভ্যাস তারা সদগুণসম্পন্ন নয় বলেই তার সন্দেহ। যেজন্য তার বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
মানুষের অহমিকাকে যে তিনি খুব উচ্চমূল্য দিতেন তা নয়। একদা ঝর্ণাতলায় দাড়িয়ে বলেছিলেন, সবকিছুই ওই ঝর্ণার মতো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু শব্দমুখর। তবু মানতেই হবে যে, কনফুসিয়াসের সমস্ত চিন্তা ছিল ইহজগৎ নিয়ে, পরজগৎ সম্পর্কে তার উদাসীনতা ছিল খুবই স্পষ্ট। তাকে নাস্তিক বললে অন্যায় হবে না। কোনো সংগঠিত ধর্মমত প্রচার করেননি, তেমন কিছুতে বিশ্বাসও করতেন না। বৌদ্ধদের সঙ্গে তার মিল রয়েছে; কিন্তু দূরত্বটাও সামান্য নয়। জীবন সম্পর্কে বৌদ্ধদের মধ্যে যে-রকম বৈরাগ্য ছিল, কনফুসিয়াসের তা ছিল না। তিনি সম্পূর্ণরূপে জীবনবাদী। নির্বাণ চান না, জীবনকে সুন্দর করতে চান। বস্তুত সুন্দর জীবনই তার লক্ষ্য। কিন্তু আবার স্থলভাবে ভোগবাদী নন। সর্বক্ষেত্রে তিনি সংযমের সমর্থক। শিষ্যদেরকে বলেছেন কথা বলবে বুঝে-শুনে। যা দেখার নয় তা দেখবে না, যা শোনার নয় তা শুনবে না, যা করার নয় তা করবে না। একবারেই অপচয়বিমুখ ।
কনফুসিয়াসের উপদেশাবলী ইহজাগতিকতায় ভরপুর। একবার তিনি মরণাপন্ন হয়েছিলেন। সঙ্গীরা জিজ্ঞেস করেছিল তিনি প্রার্থনা করছেন কিনা। অত্যন্ত সংক্ষেপে কনফুসিয়াস বলেছেন, আমি তো দীর্ঘদিন ধরেই প্রার্থনা করছি। বলতে চাইছেন যে, সৎ জীবন-যাপনই হচ্ছে প্রার্থনা, এর বাইরে কোনো আনুষ্ঠানিকতা অনাবশ্যক। তার জন্যে পুরোহিত নেই, ধর্মগ্রন্থ নেই। মন্ত্র অনাবশ্যক। জীবনযাপনকেই নৈতিকভাবে উন্নত করা চাই, সেটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা ! জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পরকাল সম্পর্কে তার বক্তব্য কি? জবাবে বলেছেন, জীবিতদের প্রতি তোমার কর্তব্য কি শেষ করেছে যে মৃতদের প্রতি কর্তব্যের কথা ভাবছো? বলেছেন, আগে জীবনকে বুঝতে হবে, তবেই না মৃত্যুকে বোঝাবার ব্যাপারে চিন্তা করা যাবে।
রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ব্যক্তিকে দেখেননি, বরঞ্চ ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকেই রাষ্ট্রকে দেখতে চেয়েছেন। আত্মজ্ঞানের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি নিজেকে সমৃদ্ধ করবে। সমৃদ্ধ করা অর্থ হচ্ছে নৈতিকভাবে উন্নত করা। নৈতিক উৎকর্ষ হচ্ছে পথ প্রদর্শক, ধ্রুব তারার মতো। ব্যক্তি অনুগত থাকবে পিতামাতার প্রতি, পূর্বপুরুষের স্মৃতির প্রতিও তার ভেতর থাকবে অন্যের প্রতি সহানুভূতি।
অসুবিধাটা কিন্তু ব্যক্তির ওপর এই অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেই। এইখানেই তিনি অত্যন্ত ইহজাগতিক হয়েও মতাদর্শিকভাবে ইহজাগতিকতা-বিরোধী ! কেননা, তিনি স্থিতাবস্থার সমর্থক। আর স্থিতাবস্থা হচ্ছে চরিত্রগতভাবে ইহজাগতিকতা-বিরোধী। তিনি পরিবারকে পবিত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেন, এবং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র মিলে নৈতিকতার ভিত্তিতে মর্ত্যে একটি স্বর্গ রচনা করবে এরকম আশা করেন । এই যে প্রতিষ্ঠানকে পবিত্রতা দিচ্ছেন এটা প্রগতিবিরোধী। আর প্রগতি না-থাকলে ইহজাগতিকতা থাকে না, পাহাড়ি ঝর্ণা তখন পরিণত হয় স্থবির ডোবাতে। একটা নতুন ধর্মমত তৈরি হয়ে যায়। ইহজাগতিক ধর্মমত। এখানে কোনো বিদ্রোহ থাকবে না। বিরাজ করবে সন্তুষ্টি এবং সংহতি।
আদর্শ রাষ্ট্রের কথা কনফুসিয়াস বিস্তৃত করে বলেননি। কিন্তু শাসক যিনি তার কি কি গুণ থাকা আবশ্যক সেটা বলেছেন। রাজা ভয় দেখিয়ে শাসন করবেন না, শাসন করবেন নৈতিক উৎকর্ষ দেখিয়ে। ভয় এক সময়ে কেটে যায়, কিন্তু শ্রদ্ধা কাটে না। প্রজারা রাজাকে শ্রদ্ধা করবে, কেননা তারা রাজার মাহাত্ম্য দেখবে, জোর জবরদস্তি না-দেখে । রাজা হবেন শিষ্টাচারী ও বিনয়ী। তিনি তার প্রজাদেরকে ভালোবাসবেন, তাদের জন্য কর্মসংস্থান করবেন। কিন্তু রাজা যদি অত্যাচারী হন তাহলে?
রাজারা যে অত্যাচারী হয়ে থাকেন সে-খবর তো কনফুসিয়াসের নিজের বক্তব্যের মধ্যেই পাওয়া যায়। একবার এক পাহাড়ের নির্জন প্রান্তে এক মহিলাকে ক্ৰন্দন করতে দেখেছেন তিনি। তার দুঃখটা কিসের? দুঃখ এই যে, আগে যে জনপদে তিনি ছিলেন সেখানে উৎপাত ছিল বাঘের । বাঘ তার শ্বশুরকে খেয়েছে, স্বামীকে খেয়েছে, খেয়েছে পুত্রকে । কিন্ত তিনি জনপদ ছেড়ে এই ভয়ঙ্করভাবে নির্জন পার্বত্য এলাকায় এলেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবে মহিলা বলেছেন, এখানে কোনো নিষ্ঠুর শাসক নেই। কনফুসিয়াস বলেছেন, হ্যা, কথাটা ঠিক, নিষ্ঠুর শাসক বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর ।
তাহলে? ওই বাঘকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কি করে? এই প্রশ্নের জবাব কনফুসিয়াস দিচ্ছেন না। রাজা নিজেই সংশোধন করবেন । কিন্তু করবেন কি? করবেন যে না সেটা তো স্বতঃসিদ্ধ । যারা নিজেদেরকে সংশোধন করেন তারা ব্যতিক্রম। রাজাদের ক্ষমতা থাকে অপরিসীম, এবং সেই ক্ষমতা তাদেরকে পরিচালিত করে অত্যাচারী হওয়ার দিকে । তারা হিংস্র হয়ে পড়ে। কনফুসিয়াস যে চরিত্রের ওপর সব দায়িত্ব অর্পণ করেছেন সেই কাজটা ভাববাদী, ইহজাগতিক নয়। ইহজগৎ রাজাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপের কথা বলে, চারিত্রিক পদক্ষেপ বাদ দিয়ে।
কনফুসিয়াসের সব বক্তব্যই ব্যক্তির উদ্দেশে । সে-ব্যক্তি রাজা হোক কি সাধারণ মানুষ হোক।
সদ্গুণকে বিকশিত করা চাই এবং সম্মান অর্জনই শ্রেয়। সম্মানিত ব্যক্তি নিজের চরিত্রের কথা ভাবে, নিম্নস্তরের ব্যক্তি ভাবে তার পদের কথা। সম্মানিত ব্যক্তি সুবিচার চায়, নিম্নস্তরের ব্যক্তি চায় করুণা। পদের জন্য লালায়িত হওয়াটা ভুল, পদের যোগ্য হওয়া চাই। এদিকে ঝুঁকবে না ওদিকেও ঝুঁকবে না, সদা সৎপথে চলবে । নীতিবানদের সঙ্গে চলবে, নীতিহীনদের থেকে দূরে থাকবে। সৎ পথ চেনে অথচ সেই পথে চলে না যে-ব্যক্তি সে একজন কাপুরুষ। তাকেই করতে গিয়ে অন্যকে বিকশিত করে। এসব বক্তব্যে গভীর দার্শনিকতা রয়েছে, ইহজাগতিকতাও; কিন্তু এসবে দ্বন্দ্বের কথাটা নেই। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে, তাদের মধ্যে থেকেই ব্যক্তি বিকশিত হবে, অবনত অবস্থাতেই উন্নতি করবে, এই বক্তব্য প্রকৃত ইহজাগতিকের নয়, ধর্মবাদীর বটে। ইহজাগতিকতাও যে ইহজাগতিকতার সঙ্গে শক্রতা করতে পারে কনফুসিয়াসের মতবাদ তারই নিদর্শন বটে !
তার মতবাদ অত্যন্ত প্রভাবশালী । বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত চীনে কুনফুসিয়াস খুবই সম্মানিত ছিলেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে চীনে কনফুসিয়াসের সামন্তবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। সামন্তবাদের যুগে সামন্তবাদী মনোভাব অসঙ্গত নয়, কিন্তু ওই মনোভাব যখন দার্শনিক প্রত্যয় হয়ে দাড়ায় এবং সকল যুগের জন্য প্রযুক্ত হতে চায় তখন বিপদ বাধে। চীন দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা নিশ্চিত রূপেই ছিল ইহজাগতিক, সেই ব্যবস্থা এখন আর শক্তিশালী নেই, দেখা যাচ্ছে এই দুর্বলতার অবকাশে কনফুসীয় মতবাদ আবার প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। মৌলবাদের অভু্যুথানে-উদ্বিগ্ন ইউরোপ-আমেরিকার বিদ্বানমহল লক্ষ্য করেছেন যে, চীনে নানা ধরনের জীবনবিরোধী ধর্মমতের সঙ্গে কনফুসিয়াসের মতও জায়গা করে নিচ্ছে। কেবল চীনে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও !
কনফুসিয়াসের বক্তব্যগুলোর মধ্যে একটি ছিল এই যে, উচ্চতর বিষয়ে আলোচনা নিম্নস্ত রের লোকদের সঙ্গে করা ঠিক নয়। তারা ওসব বুঝবে না। যারা গড়পড়তা নয়, ওপরে, তারাই কেবল দার্শনিক আলোচনার যোগ্য। সাধারণ মানুষের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গিটা তাৎপর্যহীন নয়। এটি প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণদেরও ছিল ।
8.
গ্রীক দার্শনিকেরা শ্রেণী-আধিপত্যের বিপক্ষে ছিলেন না। তাদের দেশে দার্শনিকেরা দর্শন নিয়ে ভাববার সময় ও সুযোগ পেতেন দাস শ্রম থাকার কারণে দাস-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দর্শন চর্চাও বিপদগ্রস্ত হয়েছে। সেকালে তত্ত্বজ্ঞান বিত্তবানদের একচেটিয়া অধিকারের মধ্যে ছিল।
ইউরোপের মধ্যযুগেও জ্ঞান সাধারণ মানুষ পায়নি। এবং সব জ্ঞান বাইবেলে আছে এই মত কর্তৃত্ব করেছে। রেনেসাসের কালে বড় বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে; তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে ঈশ্বরবাদিতার জায়গাতে মানববাদিতার প্রতিষ্ঠা। ব্যক্তি মাত্রেই গুরুত্বপূর্ণ এই বোধটা তখন তৈরি হয়েছিল; এবং জ্ঞানে সাধারণ মানুষের অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছিল, বিশেষভাবে দেশে দেশে মাতৃভাষার চর্চার ভেতর দিয়ে। বাইবেলও স্থানীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এসব ছিল ইহজাগতিকতার নতুন সম্পপ্রসারণ। চিত্রকলার ক্ষেত্রে মানুষ চলে এসেছিল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ।
কিন্তু একটা সীমা ছিল। ধর্ম যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে তা নয়, তার তৎপরতা ছিল । আর ছিল শ্রেণী। ইহজাগতিকতা যেমন ধর্মের বিভাজন মানতে চায় না, তেমনি শ্রেণীবিভাজনও তার পছন্দ নয়, কেননা মানুষকে পাপ-পুণ্যের বিচারে যেমন বিভক্ত করতে সে অসম্মত, তেমনি অনুৎসাহী সে মানুষকে ধন সম্পত্তির নিরিখে চিহ্নিত করতে, যদিও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে ইহজাগতিকতার যে অনীহা রয়েছে এমন বলা যাবে না। শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে কাজ করে তা ধর্মসংস্কারক মার্টিন লুথারের কাজের মধ্যে প্রমাণিত। লুথার ল্যাটিন বাইবেলের জার্মান অনুবাদ করে একটি বৈপ্লবিক কর্ম সম্পাদন করেছিলেন, তার ওই ভাষা ধ্রুপদী জার্মান ভাষাও ছিল না, ছিল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, কিন্তু তিনিই আবার জার্মানিতে কৃষক বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন। স্ববিরোধিতা নয়; এ হচ্ছে দুই বিপরীত উপাদানের সহ-অবস্থান।
রেনেসান্সের অতিউজ্জ্বল মানবতাবাদের মধ্যে সবটাই যে উচ্চ নৈতিকতা গুণসম্পন্ন ছিল তাও কিন্তু নয়। বাস্তববাদী নিকোলো মেকিয়াভেলি রাজার পক্ষে ছিলেন, জনগণের পক্ষে নয়। রাজাকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন একাধারে সিংহের মতো সাহসী এবং শৃগালের মতো ধূর্ত হবার। দুটির একটি হলে চলবে না, দুটোই হওয়া চাই, এবং একটি অপরটিকে যে নাকচ করে দিচ্ছে তা নয়; দুটোই কাজে লাগবে, দুই বাহুর মতো, যখন যেমন তখন তেমন। মেকিয়াভেলি কনফুসিয়াসের তুলনায় অনেক বেশী ভাষণপ্রিয়, এবং প্রায় আগ্রাসীরূপে ইহজাগতিক। কিন্তু তিনি আবার ইহজাগতিকতার সঙ্গে শক্রতাই করেন যখন রাজার পক্ষে দাড়ান, বিরোধী হন জনস্বার্থের। রাজস্বার্থ রক্ষার প্রণোদনায় মেকিয়াভেলি ধর্মকেও ব্যবহার করতে কুষ্ঠিত নন। তিনি বলছেন যে, ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো ভ্রান্ত হতে পারে, এবং প্রায়শই যে ভ্রান্ত হয় এটাও ঠিক, তবু রাজার কর্তব্য হবে সেগুলোকে প্রশ্ৰয় দেয়া এবং রক্ষা করা । কেননা জনগণ ওগুলোতে আস্থা রাখে । রাজার পক্ষে রাষ্ট্রধর্মের প্রতিপালক হওয়া খুবই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। রাজনীতির স্বার্থে মেকিয়াভেলি জেনে-শুনে বিজ্ঞান তথা ইহজাগতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বলবার অপেক্ষা রাখে না তবু স্মরণ করা যায় যে, সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ওই ধরনের নিষ্ঠুর রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ শাসক শ্রেণী এখনো করে যাচ্ছে। আমাদের স্বৈরশাসক হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ ব্যক্তিগত ধর্মকর্মের জন্য মোটেই বিখ্যাত নন, কিন্তু তিনি যে বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন তা ক্ষতির আকর ।
প্রথমে কোপারনিকাস এবং পরে গ্যালিলিও সৌরজগৎ সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দিয়েছেন, এবং বিশেষভাবে বিপদে ফেলেছেন ধর্মাশ্রয়ী পুরোহিতদের। বাইবেল বলছে, পৃথিবীই রয়েছে কেন্দ্রে, সূর্য তার চারদিকে অবিশ্রাম ঘুরছে; অথচ ওই জ্যোতির্বিদরা প্রচার করছেন সম্পূর্ণ উল্টো তত্ত্ব, যাতে লোকের ধর্মবিশ্বাস আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। কোপারনিকাসের তেমন বিপদ হয়নি, কিন্তু গ্যালিলিওর প্রাণসংশয় দেখা দিয়েছিল। দুই কারণে। প্রথমত, গ্যালিলিও কেবল যে বাইবেলীয় ধারণাকে বিপদগ্ৰস্ত করেছিলেন তা নয়, তার লেখা এমনই বিস্তৃত, প্রামাণ্য ও যুক্তিবুদ্ধিভিত্তিক যে কার্যত তিনি প্রকৃতিবিদ্যা থেকে সবরকমের আধ্যাত্মিকতাকেই নির্বাসনে পাঠাবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। প্রকৃতি হয়ে দাড়াচ্ছিল একটা ঘড়ির মতো, যেটা কারো ইচ্ছায় চলে না, চালু থাকে আপনার বৈজ্ঞানিকতায় । ধর্মবিদ্যাকে তিনি অমান্য করেন না, এ কথা তিনি জোর দিয়েই বলেছেন যে, ধর্মবিদ্যা অনেক উচু স্তরের ব্যাপার, অন্যসব বিজ্ঞানের তুলনায় অধিক সম্মান তার প্রাপ্য; কিন্তু ধর্মবিদ্যার এলাকা আর বিজ্ঞানের এলাকা এক নয়, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ধর্মবিদ্যার ক্ষেত্র হচ্ছে অতিপ্রাকৃতিক জগৎ এবং তার ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। প্রকৃতিবিদ্যা নিম্নস্তরের, সেখানে অতিপ্রাকৃতিক নেই, বিশ্বাসও নেই, রয়েছে যুক্তি ও প্রমাণ। এই যে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে পৃথক করা, এখানেই রয়েছে ইহজাগতিকতার একটি প্রধান সূত্র। সেই সঙ্গে এও বলেছেন তিনি যে, ধর্মবিদ্যার এখতিয়ার বিজ্ঞান তখন চলে যাবে এমন সব লোকদের দখলে বিজ্ঞান বিষয়ে যারা অজ্ঞ । দ্বিতীয় ব্যাপার এই যে, গ্যালিলিও ল্যাটিন ভাষায় লেখেননি, তার তত্ত্বকে তিনি উপস্থিত করতে চেয়েছেন জনবোধ্য ইটালিয়ান ভাষাতে; যা তার মাতৃভাষাও বটে। এতে বিপদ বেড়েছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, জনসাধারণ জেনে ফেলবে ধর্মব্যবসায়ীরা এতোদিন যা তাদেরকে শিখিয়ে এসেছে তার অন্তত একাংশ ভ্রান্ত, আর তাই যদি হয়, একাংশ যদি ভ্রান্ত বলে প্রমাণিতই হয় তাহলে অন্যান্য অংশ যে অভ্রান্ত তাই বা বলা যাবে কোন ভরসায়? ব্যবসা যাবে, অরাজকতা দেখা দেবে, কেউ মানবে না। ধর্মীয় বিচারালয় তাই গ্রেপ্তার করেছে গ্যালিলিওকে, তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত বাধ্য করেছে এই ঘোষণা দিতে যে, তার ধারণা ভুল এবং তাই তিনি স্বেচ্ছায় তার তত্ত্ব প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। সাময়িকভাবে যদিও, তবু ইহজাগতিকতা নত হয়েছে ধর্ম ব্যবসায়ের কাছে।
ব্রুনো কিন্তু অতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না। তিনি ধর্মীয় আদালতের হাতে ধরা পড়েছেন এবং তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ব্রুনো মোটেই নাস্তিক ছিলেন না, তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ধর্মযাজক হিসেবেই। কিন্তু সেখানে থাকতে পারেননি, ঘুরে ঘুরে জ্ঞান সংগ্রহ করেছেন এবং তা প্রচার করেছেন। এই যে প্রচার করাটা, ধর্ম ব্যবসায়ীদের এটা পছন্দ হবার কথা নয়, এবং এটা তারা পছন্দ করেওনি। পিছনে লেগেছে। ব্রুনোর বক্তব্য যাজকদের কাছে বিপজ্জনক মনে হবে এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কেননা তিনি বলছিলেন যে, জগৎ একটা নয়, অনেক, শত শত, অসংখ্য। ঈশ্বর হচ্ছেন অনন্ত, কাজেই তার সৃষ্টিও হবে অসীম। বাইবেলে তাহলে এ তথ্যও কেন নেই, এই প্রশ্নের জবাবে ব্রুনো বলছেন, ঈশ্বর সবই জানেন, কিন্তু স্বভাবতই তেমন ভাষাতেই কথা বলেছেন যে-ভাষা মানুষ বুঝবে, বোঝার জন্য প্রস্তুত ব্ৰুনো আপেক্ষিকতার তত্ত্বও প্রচার করেছেন। তিনি বলেছেন যে, চূড়ান্ত সত্য বলে কিছু নেই, জগৎ সম্পর্কে প্রত্যেক ব্যক্তির ধারণা তার ব্যক্তিগত অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। এসব চিস্তাকে সহ্য করা প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতের পক্ষে সম্ভব ছিল না ব্রুনোকে তাই প্রাণ দিতে হয়েছে। দেবার চূড়ান্ত কারণ এই যে, তিনিও সক্রেটিসের মতোই অনমনীয় ছিলেন, আপোস করেননি। প্রাণদণ্ডাদেশ শুনে ব্রুনো তার বিচারকদেরকে বলেছিলেন, “আমার সন্দেহ যে তোমরা যারা এই আদেশ দিচ্ছ তারা অধিক ভীত আমার চেয়ে, যার ওপর এই আদেশ জারি করা হচ্ছে।” বিচারকরা যে ভয়ের দরুন ওই মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ভয়টা স্বার্থহানির ।
ইউরোপে দর্শনচর্চার ইতিহাসের অগ্রগতির স্তরগুলোতে দেখবো যে, বেকনের ইহজাগতিকতাকে পরবর্তীকালে হবস, লক এবং আরো পরে মার্কস এগিয়ে নিয়ে গেছেন । অপরদিকে ভাববাদিতা এগিয়েছে দেকার্ত কান্ট ও হেগেলের কাজের ভেতর দিয়ে । কিন্তু বস্তুবাদিতায় আস্থা রেখেও হবস মনে করতেন যে, রাষ্ট্রের স্বার্থে যদি প্রয়োজন হয় তবে রাজা তার সার্বভৌম ক্ষমতা বলে প্রচলিত কুসংস্কারগুলোকে একটি ধর্মমত হিসেবে দাড় করাতে পারেন, সে-অধিকার রাজার আছে। আর যে ভলতেয়ার তার যুক্তিবুদ্ধির জন্য ফরাসি বিপ্লবের স্থপতিদের একজন হিসেবে স্বীকৃত তিনিও বলেছেন যে, চাষীরা যাতে খাজনা দেয় এবং ওপরওয়ালাদের কথা শোনে সেজন্য তাদেরকে ঈশ্বরে বিশ্বাসী করে রাখার আবশ্যকতা রয়েছে। অপরদিকে হেগেল তো দর্শনকে পরম সত্তার দিকেই নিয়ে গেছেন, এবং প্রকারান্তরে একনায়কত্রে দার্শনিক যৌক্তিকতাও সরবরাহ করেছেন।
ইসলামী দর্শনের যারা চর্চা করেছেন তাদের মধ্যে মোতাজিলা সম্প্রদায় অনেকগুলো যুক্তিবুদ্ধিভিত্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এঁরা সবাই ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, যদিও কাউকে কাউকে ধর্মদ্রোহী বলে মনে করা হয়েছে, এবং মোতাজিলা নামকরণের মধ্যেও তাদের প্রতি অবিশ্বাসের চিহ্ন রয়েছে। মোতাজিলা শব্দের অর্থ যিনি বিচ্ছিন্ন হয়েছেন, বিচ্ছিন্ন হয়েছেন ধৰ্মচর্চার মূল স্রোত থেকে, এবং তারা ধর্ম বিষয়ে নিজেদের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
মোতাজিলা গ্ৰীক দর্শন মনোযোগের সঙ্গে পড়েছেন। এ্যারিস্টটল ছিলেন তাদের জন্য বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্র, প্লেটোকে তারা জানতেন, প্লেটোর সঙ্গে খ্রিষ্টান চিন্তার সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যে নব্য-প্লেটোনিক মতবাদ গড়ে উঠেছিল তার সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ ছিল। গ্ৰীক দর্শনকে নতুন ইউরোপে পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে তারা মাধ্যম হিসেবেও কাজ করেছেন। তাদের মনে অনেকগুলো প্রশ্ন জেগেছিল। একটা প্রশ্ন কোরানের অনাদিত্ব নিয়ে। কোরান আল্লাহর সৃষ্টি; তাই কোরান যদি অনাদি হয়, যদি তার আদি না-থাকে তাহলে সৃষ্টি ও স্রষ্টা তো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, একের জায়গায় দুইকে পাওয়া যাচ্ছে, একত্ববাদের জায়গায় দ্বৈতবাদ তৈরি হচ্ছে। তাই তারা বলতে চেয়েছেন যে, কোরান নিত্যকালের নয়, এটি একটি বিশেষ সৃষ্টি, এবং সৃষ্টি যেহেতু তাই তার ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন রয়েছে। আর ব্যাখ্যা করবার মতো যে যুক্তিবুদ্ধি আল্লাহই মানুষকে দিয়েছেন, মানুষের পক্ষে তা প্রয়োগ না-করা অন্যায়। একইভাবে জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারেও তাদের প্রশ্ন রয়েছে। আল্লাহ চাইলেন তাই জগৎ সৃষ্টি হলো, জগতে মানুষ এলো। কিন্তু আল্লাহ চাইলেন কেন, চাইবেন কেন? তিনি তো স্বয়ংসম্পূর্ণ, তার তো ইচ্ছা থাকার মতো অপূর্ণতা নেই। এই প্রসঙ্গে আল্লাহর বহুবিধ গুণ সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আল্লাহর কোনো একটি গুণকে আলাদা করে উল্লেখ করা মানেই তিনি যে সর্বগুণসম্পন্ন সেই সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া ! আবার যখন কোনো গুণের উল্লেখ করা হয় তখন ধরে নেওয়া হয় নাকি যে ওই গুণ তার মধ্যে না-থাকাও সম্ভব ছিল। যেমন যখন বলা হয় যে তিনি করুণাময়, তখন ওই বলার পেছনে এই মনোভাব কি প্রকারান্তরে থাকে না যে তার পক্ষে করুণাময় না হওয়াও সম্ভব ছিল? কেননা, সংজ্ঞা দিতে যাওয়া মানেই হচ্ছে নেতির সৃষ্টি করা, সীমাবদ্ধতা তৈরি করা, আলোর কথা আলাদা করে বলা অর্থ অন্ধকার বলে একটি বস্তু আছে এটা স্বীকার করে নেওয়া । আল্লাহ হচ্ছেন এক ও অভিন্ন, তাই তার বহুগুণ কল্পনা করা এক ধরনের পৌত্তলিকতা বলেই মোতাজিলারা মনে করতেন।
মোতাজিলাদের মূল আগ্রহটা ছিল বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তিবুদ্ধির সমন্বয় ঘটানো। যুক্তিবুদ্ধিকেই তারা জ্ঞানের মূল উৎস মনে করতেন, এবং তার সাহায্যে বিশ্বাসের যে জগৎ রয়েছে তাকে বিশ্লেষণ করে যুক্তিসিদ্ধ করে নিতে চেয়েছেন। ধর্ম ও জগৎকে আলাদা করবার যে ইহজাগতিকতা সেটা আরো পরে এসেছে, ইউরোপীয় রেনেসাসের সময়ে। মোতাজিলারা রেনেসাসকে সাহায্য করেছেন, কিন্তু তারা ওই মতাদর্শিক বিশ্বের অধিবাসী ছিলেন না। তাদের চেষ্টাটা বিচ্ছিন্নকরণের ছিল না, ছিল সমন্বয়ের। তারা দেখেছেন যে, এ্যারিস্টটল বলছেন জগৎ অনাদি, কেউ তাকে সৃষ্টি করেনি, সে আপনা আপনি তৈরি হয়েছে, অথচ কোরান বলছে যে, আল্লাহই সব কিছুর স্রষ্টা, জগতেরও । তাহলে? সমস্যাটির সমাধান কি? মোতাজিলারা একটি সমাধান বের করেছেন । সেটি এই যে, জগৎ অনাদি বটে আবার সৃষ্টও বটে। জগৎ অনাদিকাল থেকেই ছিল, কিন্তু ছিল মৃত অবস্থায়, আল্লাহ সেই মৃত জগতের গতির সঞ্চার করেছেন, যার ফলে সে প্রাণ পেয়েছে; অর্থাৎ সে সৃষ্টি হয়েছে। মোতাজিলারা বলতে চেয়েছেন যে, আল্লাহ মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, সেই স্বাধীনতার ফলেই সে কাজ করে, এবং কখনো কখনো নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে মানুষ তার কাজের জন্য দায়ী থাকে না; তাই আল্লাহ তাকে শাস্তিও দিতে পারেন না। শাস্তি দেওয়াটা হচ্ছে আল্লাহর পক্ষে অযৌক্তিক। মোতাজিলারা আল্লাহর দর্শন লাভ সম্ভব বলে মনে করেন না। কেননা আল্লাহ হচ্ছেন নিরাবয়ব, তিনি কোনো অবয়ব নিতে পারেন না ।
মোতাজিলাদের প্রশ্নাবলী ও বক্তব্য মূল ধারার লোকেরা মোটেই পছন্দ করেনি। সাধারণ লোকও করেনি, কেননা তারা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে, জিজ্ঞাসা করা বাদ দিয়ে। আব্বাসীয় করেছিলেন। তিনি আইন করে মোতাজিলা মতবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। সাধারণ মানুষ মোতাজিলাদেরকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। কিছুটা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের প্রচারের দরুণ, কিছুটা যুক্তি ও সংশয়ের চাইতে বিশ্বাসের ব্যাপারে তাদের স্বাভাবিক আগ্রহের কারণে। আসরাইত দার্শনিকরা ছিলেন প্রথাসমর্থক, তারাই শেষ পর্যন্ত জয়ী ও স্থায়ী হয়েছেন।
যুক্তিবুদ্ধির দ্বারা যারা পরিচালিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে সর্বগ্রগণ্য হচ্ছেন ইবনে সিনা। তিনি কেবল দার্শনিক নন, বিজ্ঞানীও ছিলেন। দর্শন ও বিজ্ঞানের একটি বিশ্বকোষ তিনি নিজের উদ্যোগে তৈরি করেছিলেন। তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে চিকিৎসাক্ষেত্রে। ইবনে সিনা রচিত কানুন নামের গ্রন্থটি ল্যাটিনে অনূদিত হয়েছিল এবং মধ্যযুগের ইউরোপে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রধান পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বিবেচিত হতো।
ইবনে সিনা বিশ্বাস ও যুক্তিবুদ্ধির মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেননি, কারণ তার ধারণা সমন্বয় সম্ভব নয়। দর্শনকে তিনি গুরুত্ব দিতেন, এবং মনে করতেন যে, দর্শন ধর্মের অধীনে বিকশিত হয়নি, তার বিকাশ ঘটেছে স্বাধীনভাবে | দর্শন জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল; জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে আসে, কিন্তু ওই জ্ঞান পরিপূর্ণ হয় যৌক্তিক বিবেচনার মধ্য দিয়ে। সাধারণ মানুষ শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনাই দেখে, বিভিন্ন ঘটনার ভেতর যোগসূত্র দেখতে পায় না; যোগসূত্র আবিষ্কার দর্শনের কাজ। ইবনে সিনা বস্তুর ব্যাপারে আল্লাহকে প্রাসঙ্গিক মনে করেননি, আল্লাহ সবকিছুর উর্ধ্বে, তিনি আধ্যাত্মিক, এবং বস্তু জগতের অনেক ওপরে। আল্লাহ হচ্ছেন একক, তার ওপর বহুত্ব আরোপ করা অন্যায়। আল্লাহ হচ্ছেন পরিপূর্ণ, তাই অশুভ সাধন তার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে আল্লাহর পরিকল্পনায় অশুভের স্থান আছে। কেননা জগৎ অনন্ত নয়, সে সীমাবদ্ধ বটে। অশুভের সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু মানুষের জন্য অশুভ প্রয়োজনীয়। কেননা মানুষ বাস করে একটি সীমাবদ্ধ জগতে। আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোচ্চ, তার এবং অন্যান্য নির্বস্তুক সত্তার পক্ষে তাই সর্বজনীনতার বাইরে যাওয়া ঘটে না, স্থানীয় ও নির্দিষ্ট ঘটনাগুলো ঘটে ভিন্ন স্তরে ।
ইবনে সিনার দার্শনিক অবস্থান প্রায় বৈপ্লবিক । তার অনেক বক্তব্য বিজ্ঞানীদের মতো। তিনি মনে করেন মানুষের জন্য আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দান বিশ্বাস নয়, যুক্তিবুদ্ধি। মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে তার নির্দিষ্ট মত ছিল। তিনি মনে করতেন, পুনরুজীবন ঘটবে দেহের নয়, আত্মার। দেহের পুনজীবন লাভ ঘটলে দেহের কোন রূপটিকে গ্রহণ করা হবে? দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যার মৃত্যু ঘটেছে তার ওই বিকৃত দেহের পুনরুজীবন কি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হতে পারে? একজনের কোন বয়সের দেহ পুনরায় জীবন লাভ করবে, যৌবনের নাকি বাধ্যক্যের? এসব প্রশ্ন তুলে ইবনে সিনা দৈহিক পুনরুজ্জীবনের তত্ত্বকে নাকচ করে দিয়েছেন। ধর্মমতে পুনরুজ্জীবনের উল্লেখকে তিনি আক্ষরিক অর্থে নেবার পক্ষপাতী নন; তার মতে আত্মার পুনরুজ্জীবনের কথাই বোঝানো হচ্ছে, সাধারণ মানুষের বুঝবার সুবিধার জন্য দৈহিকতার রূপক ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। এমনকি কোরানে যে বেহেশত ও দোজখের বর্ণনা আছে তাকেও তিনি রূপক অর্থে নেবারই পক্ষপাতী ।
ইবেন সিনা আপোস করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই চিকিৎসাশাস্ত্রে তার অবদানকে যারা উচ্চ মর্যাদা দিয়েছে এমনকি তারাও তাকে বিপথগামী বলতে ছাড়েনি। তিনি মূল ধারার অন্তর্গত হতে পারেননি।
সে-কালে মূল ধারার শক্তিশালী মুখপাত্র ছিলেন গাজ্জালী। যিনি ইবনে সিনার পরে এসেছেন এবং ইবনে সিনার দার্শনিকতাকে নাকচ করে দিয়েছেন । গাজ্জালী রক্ষণশীল আসরাইতদের একজন, তিনি মোতাজিলাদের মুক্ত চিন্তার বিরোধী। ইবনে সিনার যুক্তিবুদ্ধির জায়গায় তিনি ধর্মবিশ্বাসের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্ৰতী হয়েছিলেন। সে-ব্যাপারে তার যোগ্যতারও কোনো ঘাটতি ছিলো না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ও সম্মানিত। তদুপরি তার রচনা ছিল শক্তিশালী |
দর্শনে তিনি নানা ধরনের অসঙ্গতি দেখতে পেয়েছেন, এবং সেগুলোকে চিহ্নিত করেছেন। দর্শন থাকতে পারে, কিন্তু থাকবে সে ধর্মশাস্ত্রের অধীনে, ওপরে নয়, স্বাধীনভাবেও নয়। জগৎ কার্যকারণ সম্পর্ক দ্বারা পরিচালিত এই ধারণাটি ঠিক আছে, কার্যকারণকে সুষম ধারাবাহিকতাও বলা যাবে, কিন্তু চূড়ান্ত কার্যকারণ হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা, তার বাইরে কিছু নয়। আল্লাহ সবকিছু জানেন। ইবনে সিনা যে বলেছেন আল্লাহ সর্বজনীনকে শুধু জানেন, নির্দিষ্ট জানেন না তা নয়, আল্লাহ সব কিছুই জানেন ।
তিনি খুব জোর দিয়েই বলেছেন যে, নীতিশিক্ষাকে কার্যকর করার জন্য দোজখের ভয়কে ফেরত আনা চাই। ফেরত আনার কথাটা উঠেছে এই জন্য যে, মোতাজিলাদের দর্শনচর্চার দরুণ ওই ভয়টা পেছনে চলে যাচ্ছিল, অন্ততপক্ষে শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে। গাজ্জালী বললেন যে, জীবনযাপনে নৈতিক মূল্যবোধ প্রাধান্য পাবে না যদি না মানুষ শাস্তির ভয় পায়। তাই দোজখের যন্ত্রণাকে জনচিত্তে বাস্তবিক করে তোলা আবশ্যক ।
দর্শন নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা থাকার বিপক্ষে তিনি। কেননা, তাতে তারা বিপথগামী হতে পারে। আর নিম্নস্তর অতিক্রম করে যারা উচ্চস্তরে আরোহণ করতে চায় তাদের উচিত দর্শন চর্চার বিপক্ষে যে সব যুক্তি রয়েছে সেগুলো পাঠ করা। এবং সর্বোচ্চ স্তরে যখন কেউ পৌছবে তখন তার জন্য সম্ভব হবে যুক্তিবুদ্ধি নয়, বোধির সাহায্যে আনন্দলোকে পৌছে যাওয়া, যেখানে আল্লাহর দর্শন লাভ সম্ভব হবে, উজ্জ্বলতার মধ্য দিয়ে। এই স্তরে আত্মা ছায়া বা ছায়ার ছায়া নিয়ে ব্যস্ত থাকবে না, চূড়ান্ত বাস্তবতার সম্মুখে চলে আসবে। সেখানে শাস্তির ভয় কিংবা পুরস্কারের আশা আর কার্যকর রইবে না।
ধর্মীয় নেতা ও দার্শনিক গাজ্জালী সুফী সাধনাতেও বিশ্বাস করতেন। প্রত্যাদেশকে তিনি চূড়ান্ত বলে মানতেন, এবং সেখানে কি এবং কেন যে অনাবশ্যক তাও বলে গেছেন। মনগড়া সন্দেহ মানুষকে অধিবিদ্যার রাজ্যে নিয়ে যায়, যেখানে প্রবেশ করাটা বিপজ্জনক, কেননা তাতে করে জীবন্ত যে বাস্তবতা তার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ঘটবে। এটা তার বক্তব্য।
গাজ্জালীর পরে ইবনে রুশদ এসেছেন, ইসলামিক দর্শনের জগতে। তার অবদানও অনেক বড়। তিনি গাজ্জালীর পক্ষে ছিলেন না, বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। গাজ্জালী একটি বই লিখেছিলেন দর্শনকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে, ইবেন রুশদ বই লিখলেন ওই ধ্বংস-প্রক্রিয়াকে বিধ্বস্ত করবার ইচ্ছা থেকে। তিনি বিজ্ঞানে আস্থা রাখেন এবং যুক্তিবুদ্ধির সাহায্যে রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নতি সম্ভব বলে মানেন। ধর্মের নৈতিক দিকটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ধর্মের বিধিগুলো হচ্ছে আইনের মতো, তাদেরকে মান্য করা জরুরী, তবে প্রকৃত নৈতিকতা অর্জনের পথটা ভিন্ন, সেটি হচ্ছে যুক্তিবুদ্ধির অনুশীলন।
ইবনে রুশদ জনপ্রিয় হননি। সাধারণ মানুষ তার বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। তবে এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে, তার মধ্যে ব্রাহ্মণ্যমনস্কতা ছিল; তিনি গাজ্জালীপন্থী নন ঠিকই, কিন্তু গাজ্জালীর মতো তিনিও বলেছেন দর্শন নিয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তা করা উচিৎ নয়। মানুষকে তিনি তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। সর্বোচ্চ স্তরে থাকবে দার্শনিকেরা, দ্বিতীয় স্তরে সেই সব যুক্তিবুদ্ধির মানুষেরা অনুশীলনের মাধ্যমে যারা বিশ্বাসের জগৎ থেকে দার্শনিকতার জগতে নিজদেরকে উত্তীর্ণ করাতে পারবেন; আর তৃতীয় স্তরে সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের ওপর ইবনে রুশদের আস্থা ছিল না। এদেরকে তিনি মনে করতেন আবেগতাড়িত ও যুক্তিবুদ্ধিহীন। ধর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যা এই সাধারণ মানুষকে জানানো অনাবশ্যক নয় শুধু, ক্ষতিকরও বটে। তাদের জন্যই ক্ষতিকর, কেননা এর দ্বারা তারা শুধু শুধু বিচলিত হবে।
তাহলে আমরা কোন সিদ্ধান্তে পৌছাবো। সেটা বোধ হয় এই যে, ইগজাগতিকতা কখনোই নিরাপদ ছিল না। তার প্রধান কারণ ভয় । ভয় ছিল শ্রেণীর, গোষ্ঠীর, সম্প্রদায়ের, এমনকি জাতিরও স্বার্থহানির ভয় । ব্যক্তিও ভয় পায় । তারও স্বার্থ থাকে। ব্যক্তি ইহজাগতিক হতে কুষ্ঠিত হয় একটি বিশেষ কারণে। সেটি ওই ভয়ই। পরকালের ভয়।
ইহজাগতিকতার শক্র অনেক। প্রত্যক্ষে রয়েছে,রয়েছে পরোক্ষে। যে-দার্শনিকতা স্থিতাবস্থার সমর্থন করে সে এমনকি ইহজাগতিক হলেও ইহজাগতিকতার সঙ্গে পরোক্ষ শক্রতাতেই লিপ্ত হয়। এর প্রথম কারণ মানুষ যখন দেখে তার সামনে কোনো পথ খোলা নেই, তখন সে পেছন দিকে মুখ ফেরায়। কেউ হয় পুনরুজীবনবাদী, কেউ হয় মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তির নানা রূপ রয়েছে। একটি হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা ! মানুষ স্বভাবতই অস্থির, সম্মুখযাত্রার উপায় না থাকলে সে পশ্চাদগামী হতে বাধ্য। দ্বিতীয় ঘটনা যা ঘটে তা হলো হতাশা। স্থবিরতা হতাশার জন্ম দেয় । মানুষ তখন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে অলৌকিকে আস্থা রাখে।
পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ উভয়েই ইহজাগতিক। কিন্তু তারা আবার ইহজাগতিকতার সঙ্গে শক্ৰতাও করে। শক্রতার একটি রূপ হচ্ছে দারিদ্র্য সৃষ্টি, দ্রারিদ্র্য সৃষ্টি হয় শোষণ ও বৈষম্যের কারণে। আর দারিদ্র্য মানুষকে ধর্মমুখী করে তোলে, আশ্রয়, বিচার ও সান্তুনার প্রয়োজনে; ইহজগতে যা তারা পায় না। দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা সরাসরি ধর্মের পক্ষে বলতে থাকে, যদিও তাদের নিজেদের জীবনে প্রকৃত ধর্মচর্চার লক্ষণ বলতে গেলে দেখাই যায় না।
সাম্রাজ্যবাদীরা কিভাবে ভাববাদিতাকে উৎসাহিত করে তার বাস্তব দৃষ্টান্ত মার্কিন আধিপত্যকে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তৎপর দুই ধুরন্ধরের বক্তব্য থেকে পাওয়া যায়। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে এদের একজন-জন ফস্টার ডালেস—বলেছিলেন যে, প্রাচ্যদেশের ধর্মবিশ্বাস কখনোই সাম্যবাদী বস্তুবাদ ও নিরীশ্বরবাদকে মেনে নেবে না; তাই চেষ্টা করতে হবে কমিউনিজমবিরোধী মতাদর্শের সঙ্গে প্রাচ্যদেশীয় ধর্মবিশ্বাসে একটি ঐক্য স্থাপনের। অপরজন-চেস্টার বাওলসপরামর্শ দিয়েছেন গান্ধীবাদের সঙ্গে তাদের মতাদর্শকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে । কেননা তার মতে সামরিক বা অর্থনৈতিক সাহায্য নয়, বরঞ্চ গান্ধীবাদী ধারায় কাজ করাটাই হবে প্রাচ্যের জনগণকে সাম্যবাদ-বিরোধী করার প্রকৃষ্ট পন্থা। (উদ্ধৃত, সতীনাথ চক্রবর্তী, ভাবাদর্শগত সংগ্রাম ও প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের উত্তরাধিকার, কলকাতা, ১৯৯২)।
রাষ্ট্র ও সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা ইহজাগতিকতা প্রতিষ্ঠা করা যে কত কঠিন, বাংলাদেশকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিলে সেটা বুঝতে সুবিধা হবে। বাংলাদেশের অভু্যদয় ঘটেছে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। নতুন রাষ্ট্রের হবার কথা ছিল পরিপূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইহজাগতিক | সংবিধান যখন রচিত হয় তখন ওই অঙ্গীকারই ব্যক্ত করা হয়েছিল । চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মধ্যে ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে খুব স্বাভাবিক ছিল এই অঙ্গীকার। কিন্তু এর জন্য যে সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি প্রয়োজন দেশে তা ছিল না। রাজনৈতিক প্রস্তুতিও ছিল না । ১৯৭০-এর নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে আওয়ামীলীগ প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছিল কোরান ও সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন পাস করা হবে না। বলেছিল যে, সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা’ রক্ষা করা হবে, এবং সর্বস্তরের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে ১৯৫৪-এর নির্বাচনের সময়ে আওয়ামী লীগ ছিল মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্টের প্রধান শক্তি, তার নাম তখন আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং যে যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগ যোগ দিয়েছিল তাতে নেজামে ইসলামের মতো ধর্মীয় দলও ছিল; তখন একুশ দফা নামে যে ঘোষণাপত্রটি প্রচার করা হয়েছিল তার প্রস্তাবনাতেই বলা হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট কোরান ও সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করবে না।
একাত্তরের যুদ্ধে প্রস্তুতিবিহীন অবস্থাতেই বাঙালিদেরকে যেতে হয়েছে। যুদ্ধের পর যখন সংবিধান তৈরি হলো (১৯৭২ সালে) তখন রাষ্ট্রীয় মূলনীতি চারটির কী তাৎপর্য তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে যে স্পষ্ট ছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র, এদের প্রতিটির জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল প্রধান শর্ত। কিন্তু তালিকায় সে এসেছে সবার শেষে জিয়াউর রহমানের বিপ্লবের পরে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নিশ্চিহ্নই করে দেওয়া হয়েছে; এবং সেই সঙ্গে, সমান বেগে, প্রথম মূলনীতি হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসীকে।
পরিবর্তনটা পরের ঘটনা । তার আগেও কি ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের? সংবিধান বলছে, ছিল না। সংবিধানে উল্লেখ আছে, (অনুচ্ছেদ ১২) যে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য, (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে । কিন্তু বলা হয়নি যে, ধর্মনিরপেক্ষতা জিনিসটা কি বলা দরকার ছিল যে, ধর্ম থাকবে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, সেখানে রাষ্ট্রের কোনো হস্তক্ষেপ যেমন ঘটবে না, তেমনি রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকবে না, রাষ্ট্র হবে ধর্মহীন। রাষ্ট্রের, ধর্মহীনতার এই ব্যাপারটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতার উপরে-উদ্ধৃত সাংবিধানিক সংজ্ঞায় উল্লেখ করা হয়েছে, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার বিলোপ করা হবে বললে ভালো হতো যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার মানেই অপব্যবহার। তাই আলাদা করে অপব্যবহার নয়, ধর্মের সবরকম রাজনৈতিক ব্যবহারই বিলুপ্ত করা হবে।”
পাকিস্তানি কারাগার থেকে ঢাকায় ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তৃতা দেন তাতে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বলে যে উল্লেখ করেছিলেন তা নিশ্চয়ই তাৎপর্যহীন নয়। ওই বছরই ৭ জুন তারিখের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, “বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিষ্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে।” কথার সুরে আত্মপক্ষ সমর্থনের ভাব রয়েছে এবং প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারটা মোটেই আসছে না। বঙ্গবন্ধুর পরে জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রক্ষমতা পেলেন তখন তিনি এ ব্যাপারে কোনো প্রকার দোদুল্যমানতা প্রকাশ করেন নি, ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরাসরি নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। এরশাদ এসে ঘটনাকে আরো এক স্তর এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তিনি রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেছেন। আর আজ এমন অবস্থা হয়েছে যে, আমেরিকানরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে নরমপন্থী মুসলিম রাষ্ট্র বলায় রাজনৈতিক বড় নেতৃত্ব কোনো প্রতিবাদ করছে না, বরঞ্চ খুশি এই কথা ভেবে যে, তাও যা হোক চরমপন্থী বলেনি।
সূচনালগ্নের ওই দ্বিধা আমলাতন্ত্রের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। কুদরাত-এ খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার কথা বলেছে, কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা তুলে দেবার কথা বলেনি। প্রথম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, “ধমীয় কূপমণ্ডুকতা, অন্ধবিশ্বাস ও গোড়ামি একদিনে দূর করবার বিষয় নয়, কিন্তু আশা করা যায় যে, ওই কূপমণ্ডুকতা বাংলাদেশের মাটিতে বাড়তে পারবে না, যদি ধর্ম রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত না হয় ।”
কিন্তু রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ধর্ম ঠিকই ফিরে এসেছে। ধর্মকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এনেছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও এনেছে। দেশের জনগণ কিন্তু বরাবরই ধর্মনিরপেক্ষ। তারা পাকিস্তানের পক্ষে যে ভোট দিয়েছিল সেটা পারলৌকিক কারণে নয়, ইহজাগতিক মুক্তি পাবে এই আশাতেই। একাত্তরে তারা যুদ্ধ করেছে ইহজাগতিকতার পক্ষেই। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার শাসক শ্রেণী করেছে, এবং সেই রাজনীতি তারা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। জনগণকে ইহজাগতিকতায় উদ্বুদ্ধ করার কাজ অতীতের শাসকেরা করেনি, এখনকার শাসকেরাও করছে না। কারণটা আর কিছু নয়, ভয়। সাধরাণ মানুষ দার্শনিকতায় শিক্ষিত হোক এটা গ্রীক দার্শনিকরা চাননি, ধর্মব্যবসায়ীরা চায়নি, ইবনে সিনার মতো বিপ্লবী চিন্তাবিদ পর্যন্ত চাননি। কিন্তু এই চর্চা তাদেরকে চাইতে হবে যারা সত্যি সত্যি ইহজাগতিকতা চান। কেননা জনগণকে সঙ্গে না পেলে রাষ্ট্র বদলাবে না, সমাজ তো অবশ্যই বদলাবে না। আর রাষ্ট্র ও সমাজ না বদলালে, অর্থাৎ তারা শক্রতা করলে, ইহজাগতিকতা এগুতে পারবে না, যেমন আজকের বিশ্ব অত্যন্ত বস্তুবাদী হওয়া সত্বেও ইহজাগতিক হচ্ছে না, ধর্ম নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, ধর্মীয় মৌলবাদ নানা ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল রয়েছে।
**অক্ষর বিন্যাসে ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
No comments:
Post a Comment