বই প্রসঙ্গ - ম্যাক্সিম গোর্কি

বই প্রসঙ্গ - ম্যাক্সিম গোর্কি
বই প্রসঙ্গ
— ম্যাক্সিম গোর্কি

এই বইটির (পি. মটিয়ার রচিত Histoire generale des literatures etrangeres-এর মুখবন্ধ হিসাবে এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে, প্যারিসে) মুখবন্ধ লিখে দেবার জন্য আপনারা আমাকে অনুরোধ করেছেন। কিভাবে ভালো মুখবন্ধ লেখা যেতে পারে। আমি জানি না তথাপি এ রকম একটি প্রীতিপ্রদ প্রস্তাব নাকচ করতে মন সায় দিচ্ছে না। সেজন্য প্রস্তাবটি গ্রহণ করে এই সুযোগে বই সম্বন্ধে সাধারণভাবে আমি কি ভাবি তা অল্প কথায় বলব।



আমার মধ্যে উৎকৃষ্ট যা কিছু আছে তার জন্য আমি ঋণী বইয়ের কাছে। মানুষের চেয়ে ললিতকলা যে অনেক বেশি মহানুভব তা আমার কৈশোরেই আমি উপলব্ধি করেছিলাম। আমি বইয়ের প্রেমিক, প্রত্যেকটি বইকে আমার মনে হয় অলৌকিক এবং লেখককে যাদুকর। বই সম্পর্কে কোনো কথা বলতে হলেই গভীর ভাবাবেগ এবং আনন্দঘন উৎসাহ ছাড়া আমার পক্ষে কিছু বলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। হাস্যকর মনে হলেও একথা সত্য। হয়তো অনেকের মতে এটা বর্বর-অনার্যদের উৎসাহ। কিন্তু যে যাই বলুক না কেন আমার পক্ষে এটা শোধরান সাধ্যের অতীত।

যখনি আমি কোনো একটা নূতন বই হাতে পাই, যে বইটি ছাপখানাতে একজন টাইপসেটার, একজন বীরপুরুষ, অপর একজন বীরপুরুষ আবিস্কৃত যন্ত্রে সে বইটি মুদ্রণ করেছে, তখন আমার মনে হয় কোনো একটি জীবন্ত আশ্চর্য জিনিস, যা কথা বলতে পারে, আমার জীবনে যেন প্রবেশ করল, একটা নূতন ধর্মগ্রন্থের অংশ যা একজন মানব তার নিজ জীবন সম্বন্ধে লিখেছে, যে জীবন পৃথিবীর সব কিছুর চাইতে অধিকতর জটিল, সবচেয়ে রহস্যময় ও ভালোবাসার যোগ্য, যার শ্রমে ও কল্পনার তুলিতে বিশ্বের যা কিছু সুন্দর, মহান ও চির কল্যাণকর তা সৃজিত হয়েছে ।

বই আমাকে জীবনের পথ দেখিয়েছে— যে জীবন সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা কিছুমাত্র কম নয়—তবু সব সময় বই-এর মধ্যে এমন একটা কিছুর ইঙ্গিত বা নির্দেশ পেয়েছি যা এর পূর্বে কোনো মানুষের মধ্যে আমি লক্ষ করি নি বা জানতে পারি নি। হয়তো একটা সোজা বই-এর মধ্যে একটি মাত্র দীপ্তিমান উজ্জ্বল বাক্য ছাড়া তুমি আর কিছু পাবে না, কিন্তু ঐ একটি বাক্যই তোমাকে মানুষের নিকটতর করে তোলে, তোমার সামনে একটা নতুন হাসি বা একটা নতুন মুখভঙ্গি উন্মোচন করে।

নক্ষত্র জগতের মহিমা, বিশ্ব জগতের সুসমন্বিত যান্ত্রিক গঠন পদ্ধতি এমনকি জ্যোতির্বিদ্যা বিশ্বতত্ত্ব সম্বন্ধে বাঙ্ময় বক্তৃতা আমাকে বিচলিত করতে বা আমার মধ্যে তেমন উৎসাহের উদ্রেক করতে সক্ষম হয় না। আমার নিজের ধারণা যে জ্যোতির্বিদগণ বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডকে যে রকম আশ্চর্যজনক বলে আমাদের চোখে প্রতিভাত করতে চান তা যথার্থ নয় এবং দুনিয়াতে জন্ম ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে স্বর্গীয় সাম্য বা সমতা অপেক্ষা অনেক বেশি অর্থহীন অসংগতি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান।

ছায়াপথের কোনো এক অসীম অনন্তে একটি সূর্য নির্বাপিত হলে আর তার চারপাশের গ্রহ তারকারাজি অনন্ত রাত্রির অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হ’লে আমি একেবারেই বিচলিত হই না। কিন্তু ক্যামিল ফ্ল্যামেরিয়ানের মতো একজন অত্যুৎকৃষ্ট কম্পনার অধিকারী এক ব্যক্তির মৃত্যুতে আমি গভীর দুঃখে মুষড়ে পড়ি।

যে প্রত্যেকটি সুন্দর ও মহৎ পদার্থ আমরা দেখতে পাই তা মানুষই প্রণয়ন করেছে, কিংবা বর্ণনা করেছে। এটা দুঃখজনক যে মানুষকে বেদনাও সৃষ্টি করতে হয়েছে, তাকে তীব্র করেও তুলতে হয়েছে, যেমন করেছেন দস্তয়েভস্কি, বোদলেয়ার এবং এমনি আরো তাদের মতো অনেকে। কিন্তু এগুলির মধ্যেও জীবনের যা কিছু অসুন্দর ও ঘৃণ্য তার মোচন ও নির্মল করার একটা ঐকান্তিক কামনাও আমি দেখতে পাই।

যে প্রকৃতি আমাদের ঘিরে রেখেছে এবং যা আমাদের প্রতি এত বিরূপ সেখানে কোনো সৌন্দর্য নেই। মানুষ আত্মার গভীরতম কন্দর থেকে যা সৃষ্টি করে সৌন্দর্য সেখানেই। এমনিভাবেই ফিনরা তাদের জলাভূমি, অরণ্য এবং স্বল্প খর্বকায় গাছগাছালি পূর্ণ বাদামি পাহাড়ি অঞ্চলকে সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। আরবদের কাছে মরুভূমিও সুন্দর। মানুষের মন দিয়ে, চিন্তা দিয়ে গ্রহণ করার চেষ্টা থেকেই সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। অবিন্যস্ত ও খাঁজকাটা পর্বত রাশির বিশাল শরীর দেখে আমি আনন্দ লাভ করি না। আমি মুগ্ধ হয়ে যাই তার উপর মানুষ যে অপূর্ব সৌন্দর্য আরোপ করে তা দেখে। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি মানুষ কি সহজে ও মহানুভবতায় প্রকৃতির রূপান্তর সংঘটিত করছে। একটু গভীরভাবে ব্যাপারটি সম্পর্কে চিন্তা করলে বোঝা যাবে এই মহানুভবতা পৃথিবীর মানুষের পক্ষে কতটা বিস্ময়কর, কারণ বাস করবার মতো খুব আরামদায়ক স্থান এই পৃথিবী নয়।

ভূমিকম্প, ঝড়ঝঞ্ঝা, তুষার ঝড়, বন্যা, অত্যধিক শীত ও গ্রীষ্মের কথা একবার চিন্তা করুন, কিংবা জঘন্য কীট পতঙ্গ, জীবাণুও হাজার হাজার নানাবিধ কষ্টের কথা ভাবুন। মানুষ শুধু বীর বলেই এসব সহ্য করেছে এবং এ অবস্থাকে সহনশীল করে তুলেছে।

আমাদের অস্তিত্ব সর্বত্র এবং সর্বসময়ে শোকাবহ, কিন্তু মানুষ এই অগণিত শোকাবহ ঘটনাবলীকে শিল্পকর্মে রূপান্তরিত করেছে! এই রূপান্তর অপেক্ষা মহত্তর এবং অধিকতর বিস্ময়কর কোনো ব্যাপারের কথা আমি জানি না। সেইজন্যই তারকারাজির শীতল ঝিকিমিক, সাগরের যান্ত্ৰিক ছন্দদোলা, বনানীর মর্মর ধ্বনি বা মরুভূমির নিস্তব্ধতার চেয়ে পুশকিনের একটা ক্ষুদ্র কাব্য গ্রন্থে বা ফ্লবেয়ারের একখানি উপন্যাসে আমি অধিক জ্ঞান ও জীবন্ত সৌন্দর্য অবলোকন করি।

মরুভূমির নিস্তদ্ধতা? রাশিয়ান সুরসৃষ্টা বোরোডিন তাঁর একটি সৃষ্টিকর্মে মরুভূমির নিস্তব্ধতাকে জোরালো ভাষায় প্রকাশ করেছেন। অরোরা বোরিয়ালিস ? আমার কাছে হুইসলারের আঁকা ছবির মূল্যই অধিকতর। জন রাসকিন যখন বলেছিলেন যে টার্নারের আঁকা চিত্রের পর ইংলন্ডের সূর্যাস্ত অনেক বেশি মনোরম দেখায় তখন তিনি একটি গভীর সত্য উক্তিই করেছিলেন।

আকাশের তারাগুলি যদি আরো বৃহত্তর, উজ্জ্বলতর ও নিকটতর হতো তবে হয়তো আমাদের আকাশকে আমি আরোও বেশি ভালোবাসতাম। জ্যোতির্বিদরা এ সম্বন্ধে নানান খবর শোনাবার পর সত্যসত্যই তারারা আমাদের চোখে সুন্দরতর হয়ে উঠেছে।

আমি যে জগতে বাস করি সে জগৎ হলো ছোট ছোট হ্যামলেট এবং ওথেলোর, রোমিও ও গোরিওর জগৎ, কারামোজোভ ও মি: ডমবি, ডেভিড কপারফিল্ড ও ম্যাডাম বোভারির জগৎ, মেনন লেস্‌কট, অ্যানা কারেনিননা, ছোট ছোট ডন কুইক্‌সোট ও ডন জুয়ানদের জগৎ।

এইসব নগণ্য প্রাণীদের থেকে, আমাদের মতো লোকদের থেকে, কবিরা মহান মূর্তি সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের অমর করেছেন।

আমরা যে জগতে বাস করি সেখানে সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী প্রভৃতি পণ্ডিত ব্যক্তির লেখা আমরা যদি না পড়ি তবে মানুষকে বুঝতে পারা অসম্ভব। ফ্লবেয়ারের "uncoeur simple" আমার কাছে ধর্মবাক্যের মতো মূল্যবান। ন্যুট হামসুনের “গ্রোথ অব দি সয়েল” পড়ে আমি যেমন বিস্ময় অনুভব করি তেমনি বিস্মিত হই “ওডিসি” পড়ে। আমি নিশ্চিত যে আমার পৌত্রেরা রোমাঁ রোলাঁর জাঁ ক্রিষ্টফ পড়বে এবং লেখকের হৃদয় ও মনের মহত্ত্বকে, মানুষের প্রতি তার সীমাহীন ভালোবাসাকে শ্ৰদ্ধা জানাবে।

আমার আরো মনে হয় যে এই ভালোবাসা ক্ৰমে ক্ৰমে আরও শক্তিশালী ও সচেতন হয়ে উঠেছে। তার ফলে এর বহিঃপ্রকাশে একটা বাস্তব উপযোগিতা ও সংযমের ভাব এসে পড়েছে। কিন্তু এতে আমাদের সময়ে যখন জীবনধারণের সংগ্রাম ক্রমশ তিক্ততর হয়ে উঠেছে, তখন এ ধরনের অনুভূতির অযৌক্তিকতা কিছুমাত্র হ্রাস পায় না। মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো কিছু জানবার আগ্রহ আমার বিন্দুমাত্র নাই। এবং এর জন্য বই-ই বন্ধু এবং মহানুভব পথপ্রদর্শকের কাজ করে। যে নিরহঙ্কার বীর মানুষেরা দুনিয়ার সব সুন্দর ও মহান বস্তুনিচয় সৃষ্টি করেছে তাদের জন্য আমার অন্তরে রয়েছে অপরিসীম গভীর শ্রদ্ধা।

সূত্র : ম্যাক্সিম গোর্কি - সাহিত্য প্রসঙ্গ
মেহের কবীর
বাংলা একাডেমি
Yeadira Amran এর পোস্ট থেকে

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট